কামার ও শয়তান – ১

“… শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল যে বেচারার দমই ফেলা দায় । সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল— সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।

“কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিপে ধরল। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে হেইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রাবারের মত লম্বা হতে লাগল। … “

প্যারা দুটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘তিনটি বর’ নামে গল্প থেকে নেয়া। ছোটবেলায় তার সংকলিত দেশ-বিদেশের উপকথা নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ছিল। শয়তানের মত ধূর্ত বদ চরিত্রকেও যে ঢিঁট করা সম্ভব, সে গল্প পড়ে বেদম মজা পেয়েছিলাম।

এই গল্পটা নাকি কমপক্ষে ছয় হাজার বছরের পুরনো!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




২০১৬ সালে গবেষক জামশেদ তেহরানি ও গ্রাসা দি সিলভা ফাইলোজেনেটিক অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের ভিত্তিতে রিসার্চ করে এ তথ্যটা আমাদের দিয়েছেন। তাদের বিচারে ইন্দোইউরোপীয় ভাষার জন্মের আদিকালে এ গল্পটি মুখে-মুখে প্রচলিত ছিল। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়া আর রাশিয়া থেকে শুরু করে আয়ারল্যান্ড অব্দি এটি নানা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে শ্রোতাদের কাছে। সে সময়ে বই দূরের কথা, লিখনপদ্ধতিরও আবিষ্কার হয়নি। কথক কিংবা বার্ড বলে একটি পেশা ছিল যাদের কাজ কেচ্ছা শুনিয়ে বেড়ানো।

ঊনবিংশ শতকের ইলাস্ট্রেশনে সেন্ট ডানস্ট্যান শয়তানের নাকটা চিমটে দিয়ে ধরে দিলেন এক টান, হেইয়ো…

গল্পটার সারবস্তু হলো শয়তান, মৃত্যু, জ্বীন কিংবা কোন অপদেবতার কাছ থেকে নিজের আত্মার বিনিময়ে কামার অলৌকিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়। তারপর সে ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়েই কূটকৌশল করে চুক্তি থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নেয়।

উপেন্দ্রকিশোরের গল্পটিতে অবশ্য কামার তিনটি বর পায় এক বৃদ্ধ মানুষের ছদ্মবেশধারী দেবতাকে সাহায্য করে। আর মৃত্যুর পর স্বর্গ-নরক কোথাও কামারের স্থান হয় না। শয়তান নরকের আগুন থেকে কাঠকয়লা ছুঁড়ে তাকে দূর করে দেয়। সেই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে জলায় জলায় সে ঘুরে বেড়ায়, আর তার আলো দেখা যায়। তাইই নাকি আলেয়া — জ্যাক ও’ল্যান্টার্ন। হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের উৎপত্তি এই রূপকথা থেকেই। ইংরেজী কাহিনীতে কামারের নাম জ্যাক। আবার অন্য কোন কাহিনীতে সে সেন্ট ডানস্ট্যান। ফ্রান্সে সেন্ট ডানস্ট্যান হয়ে গেছে স্যাঁত-এলোয়া।

হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টারনের উৎস স্মিথ অ্যান্ড দ্য ডেভিল নামে সুপ্রাচীন এক উপকথায়।

রাশিয়াতে কাহিনীটা একটু পরিবর্তিত। সেখানে কামারের সহকারী শয়তান, যে কিনা তাকে বিপদে ফেলে। গ্রীকদেরও প্রায় একইরকম গল্প আছে। চেক ভারশনে উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের মত স্টুলে শয়তানকে আটকে রাখে কামার। এর্রেমেন্তারি বলে একটা বাস্ক ভাষার ছবি দেখেছিলাম ক’দিন আগে নেটফ্লিক্সে, তার কাহিনীতেও শয়তানকে চালাকি করে নিজের কারখানায় নেহাইয়ের সাথে আটকে রেখে দিয়েছিল শ্মশ্রুমন্ডিত পাগলা কামার। আয়রিশ ভার্শনে কামারকে বর দেয় ফেইরি কুইন।

বাস্ক লোককাহিনীভিত্তিক মুভি এর্রেমেন্তারিতে শয়তানকে খাঁচায় পুরে রেখে দিয়েছে কামার।

প্রায় একই রকম গল্প জার্মানিতে প্রচলিত ছিল বিদ্বান ডক্টর ফাউস্টের নামে। শয়তানের কাছে নিজের জীবন বন্ধক রেখে নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াত মধ্যযুগীয় এ চরিত্র। পরে ক্রিস্টোফার মার্লো আর গ্যেটে ফাউস্টকে নিয়ে মেলোড্রামাটিক ক্লাসিকাল কাহিনী ফেঁদে বসেছেন। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় এসেও কাহিনীটির বিবর্তন শেষ হয়নি। আপালাচিয়ান পর্বতমালার মানুষ জনি দ্য ফিডলার নামে চেনে এই ধূর্ত কামারকে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




গ্রীক কামার দেবতা হেফেস্টাস তার কর্মশালায়, ক্লাসিকাল শিল্পীর কল্পনাতে।

কামারের ধূর্ততা আর কূটকৌশলের একটা তাৎপর্য যে আছে সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করতে চাই। শুধু যে লোককথায় আছে কামার তা নয়। বিভিন্ন প্রাচীন দেবদেবীর কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে কামার দেবতার পেশাভিত্তিক যে স্থান, সেটা আর কারো নেই। উদাহরণ, গ্রীক দেবতা হেফেস্টাস, আফ্রোদিতির স্বামী। মুখভর্তি দাঁড়ি, লেংচা, কুৎসিত। অথচ ধাতু নিয়ে সে অসাধারণ সব জিনিস বানিয়ে ফেলে। জিউসের বজ্র থেকে শুরু করে হার্মিসের শিরোস্ত্রাণ, একিলিসের বর্ম — এগুলি তারই বানানো। একটা রথও সে বানিয়ে ফেলে যা কিনা নিজ থেকেই সচল। অর্থাৎ হেফেস্টাস গ্রীক দেবতাদের টেক-গীক! ও হ্যাঁ, নিজের মা হেরাকেও চেয়ারে সেঁটে রাখার কৃতিত্ব তারই। এখানে শয়তানের জায়গা নিয়েছেন মাতৃজননী স্বয়ং।

গ্রীকদের হেফেস্টাসের মত রোমানদের ভাল্কান। দু’জনেরই কর্মশালা আগ্নেয়গিরির মধ্যে। যখন তারা কাজ শুরু করে সেখানে, তখন মাউন্ট এটনা থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়।

নর্স-জার্মানিক জাতিগোষ্ঠীদের কামার দেবতার নাম ওয়েল্যান্ড কিংবা ভলুন্ড। আইসল্যান্ডিক ভাষায় লেখা পোয়েটিক এডাতে তার গল্প রয়েছে। কেল্টিকদের গভন্যু। ফিনিশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় নয়, তারপরও তাদের জাতীয় কাহিনী কালেভালাতে ইলমারিনেন নামে এক কামার চরিত্র রয়েছে। জাদুর ধাতব জিনিসপাতি বা সাম্পো তৈরি করে সে — তামার জ্যান্ত ঘোড়া পর্যন্ত।

ফিনিশ-সোভিয়েত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘সাম্পো’তে কালেভালা কাহিনীর কামার ইলমারিনেন একটা ধাতব স্লেজ বানাচ্ছে।

ইরানী উপকথায় কাভে আহাঙ্গারানও কামার। অত্যাচারী রাজা জাহাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পারসিকদের মুক্ত করে সে। ককেশাসের ওসেটিয়াতেও রয়েছে কামারদেবতার উপকথা। আর বৈদিক যুগের ভারতের ত্বস্তৃ, পরবর্তীতে বিশ্বকর্মা নামে ব্রহ্মায় মিলিয়ে যান। জাপানেও রয়েছে আদি কামার আমাকুনি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কেন্টাকির লেক্সিংটনে পুরনো বাড়ির চৌকাঠে হর্স শু ঝুলছে। এ কুসংস্কার আমেরিকায় এসেছে আইরিশদের সাথে।

শুধু এশিয়া আর ইউরোপ নয়, পশ্চিম আফ্রিকাতেও কামারদের আলাদা মর্যাদা। অনেকের ধারণা তারা জাদুকর। কোন কোন কালচারে কামার আর মেডিসিনম্যান একই ব্যক্তি। লোহা আর আগুনের কম্বিনেশন দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যাপারটাও মনে হয় কামার-ওঝাদের ঊর্বর মস্তিষ্কের ফল! হর্সশুও তাই অমঙ্গলনাশক। নাইজেরিয়ার দেবতা ওগুন কামারদেরই পৃষ্ঠপোষক।

অর্থাৎ, ইন জেনারেল, কামার পেশাটা ম্যাজিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, শুধু ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতিতেই নয়। কেন ও কিভাবে, এটাই জানতে চাই! হাজার হোক, টেকনলজিস্ট আর ইনজিনিয়াররা এ যুগের কামার, শুধু সেকালের সম্মানটা আর নাই!

(দ্বিতীয় খন্ডে সমাপ্য)



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




One Reply to “কামার ও শয়তান – ১”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!