স্টারি নাইট – ১

ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই গোগ্রাসে গিলতাম। প্রথম পড়েছিলাম কাকাতুয়া রহস্য। পরের দিকে পুরনো শত্রু। হয়ত সমবয়সী কারো কারো মনে পড়বে দু’টোরই কাহিনী মূল্যবান চিত্রকর্ম নিয়ে।

পুরনো শত্রুতে একই কটেজের কুড়িটি পারসপেক্টিভ থেকে আঁকা ছবি দিয়ে রহস্যের শুরু। আর রহস্যাবৃত যে চিত্রকরের বেগুনী পাহাড় আর নীল ঘোড়ার অদ্ভূত মাস্টারপীস দিয়ে কাহিনীর শেষ, তার অনুপ্রেরণা ভ্যান গঘ় ছাড়া আর কেউ নন! (ডাচ ভাষায় নামের উচ্চারণটা কিন্তু যথেষ্ট কঠিন — ফান ঘ়ুফ়!)

ভ্যান গঘ়ও সিরিজ়ে ছবি আঁকতেন। এদের মধ্যে সবচে’ পরিচিত হলো বিভিন্নভাবে আঁকা ফ্লাওয়ারভাজ়ে সাজানো সূর্যমুখীর সিরিজ়টা। তিন গোয়েন্দা কাহিনীর কল্পিত আর্টিস্ট ফ্রাঁসোয়া ফরতুনারের মত তাঁরও কয়েকটি চিত্রকর্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমার আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। ভ্যান গঘ়ও শারীরিক আর মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা।

কিন্তু স্টারি নাইট নামে গানটায় ডন ম্যাকলীন ভ্যান গঘ়ের বিভিন্ন চিত্রকর্মের বর্ণনা দেয়ার সাথে সাথে তাঁর মননশীলতাকে খুবই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গানের কথায় বুঝবেন যে এই প্রতিভাবান শিল্পী মানসিক রোগী মোটেও ছিলেন না! অনেক সংবেদনশীল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কপালের ফেরে একাধিক প্রিয়জনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ভাই থিও আর বোন উইল বাদে পরিবারের আর সবাই তাঁকে পাগল ঠাউরাতো। ভ্রাতৃতুল্য চিত্রকর ও চিত্ররসিকদের কাছেও যে সম্মান-স্বীকৃতি আশা করেছিলেন, জীবদ্দশায় তা পাননি। নিজের কাছে তিনি ছিলেন ব্যর্থতার চূড়ান্ত। তারপরও তাঁর রংতুলি এঁকে গেছে সমানে, কারণ এই একটা জিনিসেই তিনি পারতেন নিজের মনের অবস্থা সুক্ষ্ণভাবে তুলে ধরতে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ভ্যান গঘ় যে ধারার শিল্পী ছিলেন তাকে বলে পোস্ট-ইমপ্রেশনিজ়ম। তাঁর আগের প্রজন্মের ইমপ্রেশনিস্টরা ছিলেন প্রকৃতি ও মানুষের দক্ষ পর্যবেক্ষক। সুচিকন তুলির সাহায্যে তেলরঙে জীবন্ত করে তুলতে পারতেন যেকোন দৃশ্যকে। তাদের মনোযোগ ছিল নিখুঁত প্রতিলিপি তৈরিতে। এর সবচে’ বড় উদাহরণ ক্লোদ মোনের ওয়াটার লিলিজ় সিরিজ়, নিউ ইয়র্কের মিউজ়িয়াম অফ মডার্ন আর্টে (মোমা) দেখেছি তার কয়েকটা।

পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্টরা ছিলেন সনাতন ইমপ্রেশিনজ়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোভাগে। তাঁরা বললেন, নিখুঁত প্রতিলিপি দেখতে ভাল, কিন্তু মানুষের মন আর আবেগকে সমুচিত নাড়া দেয় না। শিল্পীর মানসপটে একটা দৃশ্য কী অনুভূতি জাগ্রত করেছিল তা আঁকতে হলে চাই রং আর কাঠামোর পরিবর্তন। তাঁরা মোটা তুলি ধরলেন, বাঁছাই করলেন এমনসব রংয়ের কম্বিনেশন, যেগুলি সনাতনরা দেখে সংয়ের পোশাক বলে গালি দিবেন। কিন্তু তাঁদের সাহসী রংতুলিতে যেসব ছবি ফুঁটে উঠলো, সময় লাগলেও রসিকরা বোঝা শুরু করলেন সেগুলির মর্যাদা। ততদিনে ভ্যান গঘ় মনের বোঝা সইতে না পেরে ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছেন।

পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আর্টের একটা সুন্দর উদাহরণ ভ্যান গঘ়ের স্টারি নাইট বলে সাঁ-রেমি শহরের রাতের দৃশ্যের ছবি। মোমাতে এটি সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর একটা প্রতিলিপিও পোস্টার আকারে ঝুলছে আমার ঘরে। এতে যে দৃশ্য ভ্যান গঘ় এঁকেছেন, সেটা কিন্তু তাঁর পাগলা গারদের জানালা থেকে দেখা। ১৮৮৮এর কানকাটার ঘটনার পরের বছর ১৮ই জুন তিনি এটি আঁকা শেষ করেন। (ঘটনাচক্রে তার ঠিক ৯০ বছর পরে আমার জন্ম!)

স্টারি নাইটের দৃশ্যটি পার্থিব নয়। কোন তারাজ্বলা রাতে এরকম প্রুশিয়ান ব্লু আকাশে ইন্ডিয়ান ইয়েলো রঙের তারা, সেগুলি আবার বিশাল আকারের — এসব দেখতে পাবেন না। তার মাঝখানে আবার একটা ঘূর্ণাবর্তের ছবি।

কিন্তু চোখটা বন্ধ করে ভাবুন আপনি দক্ষিণ ফ্রান্সে। যদি সেথায় না গিয়ে থাকেন, ভাবুন আপনি উত্তরবঙ্গের কোন মফস্বল শহরে, যেখানে ঢাকার কংক্রীট-জঙ্গল নেই। তারাভরা পরিষ্কার আকাশ। ফ্রান্সের গ্রীষ্মকাল, হয়ত আমাদের শরৎ বা হেমন্ত। আরামদায়ক আবহাওয়া, ঝিরঝিরে বাতাস। মনটাকে ছেড়ে দিন। আপনার কল্পনার জগতে যে অনুভূতিটা আসবে, স্টারি নাইট ঠিক সেটাই তুলে ধরেছে। ঘূর্ণাবর্তটা হতে পারে দক্ষিণ ফ্রান্সের ঝড়ো মিস্ত্রাল বায়ুর চিত্ররূপ, আবার হতে পারে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। আপনি ভেবে নিতে পারেন অকাল কালবৈশাখীর পূর্বাভাষ। কোনটা যে কি বস্তু সেটা জরুরী নয়, আপনার মনে যে অনুভবটা আসছে ছবিটি দেখার পরে, সেটাকে যথোপযুক্ত প্রাণ দেয়াটাই ভ্যান গঘ়ের অভিপ্রায়!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এর মধ্যেও চিত্রশিল্পের বেসিক নিয়মগুলি মেনেছেন ভ্যান গঘ়। সাইপ্রেস বৃক্ষের ঊর্ধ্বমুখী অবয়বকে ব্যালেন্স করেছেন ছোট্ট আর্ল শহরের ভূসমান্তরাল বিস্তৃতি দিয়ে। শহরের চার্চের চূড়াটাও বাস্তবের আর্লের থেকে আলাদা, সেটার শৈলী ভ্যান গঘ়ের কৈশোরের বাসস্থান নেদারল্যান্ডের ধাঁচে। অর্থাৎ চিত্রকর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত।

কিছুটা আধ্যাত্মিক সিম্বোলিজ়মও আছে। সাইপ্রেসকে মেডিটেরেনিয়ান কালচারে ধরা হয় পরকালের প্রতীক হিসাবে। আর হলুদ রং হলো জীবনের প্রতীক। সাইপ্রেস গাছকে বাহন বানিয়ে ভ্যান গঘ় যেন যেতে চাইছেন স্বর্গালয়ে। তাঁকে বুঝবার, তাঁর আত্মাকে শান্তি দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র স্বর্গপিতারই আছে।

হলুদ আর প্রুশিয়ান ব্লুর কম্বিনেশনটা কিন্তু অনেক প্রাচীন। প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন শিল্পকর্মে লাপিস-লাজ়ুলি নামের নীলরত্ন আর হলদে সোনার বিস্তর ব্যবহার হত। ফারাও তুতানখামেনের মমিমুখোশ তার সবচে বিখ্যাত উদাহরণ। মধ্যযুগে যীশুখ্রীষ্টের বাইজ়্যান্টাইন চিত্রেও এধরনের কালার কম্বিনেশন রয়েছে।

জীবদ্দশায় কেন বিখ্যাত হননি ভ্যান গঘ়? তার মূল কারণ, চিত্রকর্ম আঁকার লক্ষ্য তাঁর কাছে অর্থ উপার্জন কিংবা খ্যাতির প্রলোভন ছিল না। তিনি আঁকতেন কারণ তাঁর কাছে সেটাই ছিল তাঁর মনের অনুভূতি যোগাযোগের উপযোগ্য মাধ্যম। তাঁর টেকনিক-কম্পোজ়িশন কাউকে খুশি করার জন্যে নয়, নিজের আত্মতুষ্টির জন্যে। সেকারণেই বোধহয় এখন তাঁর চিত্রকর্ম সমসাময়িক পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্টদের তুলনায় অনেক বেশি দরে নিলামে বিক্রি হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!