ভূতের রাজা দিল বর…

Featured Video Play Icon
“ভূতের রাজা দিল বর, জবরে জবরে তিন বর!” বাল্যকালের  আর সবকিছু এখন দেখলে পুরনো মনে হয়। কিন্তু যত দিন যায়, গুপী-বাঘা ততই জোয়ান হয়!

ছোটবেলায় গুপী-বাঘার যে দৃশ্যটা সবচে’ মন কাড়ত, সেটা মনে হয় ভূতের নাচ। সত্যজিৎ ভূতের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তাদের দেখে ভয়ে চোখ-কান বন্ধ করার মত কিছুই ছিল না। এখনো যখন দেখি, মনে হয় সত্যজিতের অন্যতম অসামান্য কারুকার্য এটা। হয়ত ছোটবেলায় ভাবতাম এটা কার্টুনছবি!

মজার ব্যাপার হল, গুপী গাইন বাঘা বাইনের হবার কথা ছিল রঙীন চলচ্চিত্র। ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে সাদা-কালো। রঙীন হলে আর ভূতনৃত্য দেখতে হত না!

অনেকে বলবেন এই দৃশ্যটা বাকি কাহিনীর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে ছোটখাটো অনেক কিছু চোখে পড়বে, আবার কিছু জিনিস বুঝতে সাহায্য দরকার হবে। আজকে আমি সেই চেষ্টাটা একটু করি।

অনেকে বলেন যে এই দৃশ্যে হিন্দু বর্ণবিভেদের অথবা পুঁজিবাদী শ্রেণীসংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমার হিসাবে তা নয়। কারণ চারটি গোত্রের ভূত থাকলেও, তারা নিজেদের মধ্যেই মারামারি করে পটল তুলছে, একে অন্যের সাথে যুঝছে না। বর্ণপ্রথারও কোন অর্থ হতে পারে না। ম্লেচ্ছ ফিরিঙ্গি বেনিয়াদের টেনেটুনে বৈশ্যের সারিতে ফেলার কোন মানে নেই। শ্রেণীসংগ্রাম হলে শোষণের চিহ্ন কোথায়? এদের সংঘাতটাও অসম শক্তির মনে হয় না।

বরং আমার মনে হয়, সত্যজিৎ যেটা দেখাতে চেষ্টা করেছেন সেটা একরকম অন্তর্দ্বন্দ্ব। সমশ্রেণীর, সমপরিচয়ের মানুষের — যারা জাতি, ধর্ম, পেশাগত বা বাণিজ্যিক স্বার্থ, এধরনের কোনদিক দিয়ে একটু আলাদা — তাদের কলহ। দ্রুত লয়ের সাথে সাথে সেই বাকবিতন্ডা তারা নিয়ে গেছে অন্তিম পর্যায়ে। ফলাফল, পরস্পরের হাতে নির্মম মৃত্যু!

শেষ দৃশ্যটাতে আবার পুনরুত্থিত ভূতের দল একে অন্যের হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি নাচছে। ছাত্রাবস্থায় কোনার্কের সূর্যমন্দিরে সত্যজিৎ দেখেছিলেন এরকম কয়েক সারিতে খোদাই করা প্রাচীন ভারতীয় নর্তক-নর্তকীর চিত্র। আবহসংগীতে সব বাদ্যযন্ত্র একসাথে ঐকতান করছে। বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গীত বিভিন্ন গোত্রের ভূতকে আবার মিলিয়ে-মিশিয়ে দিয়েছে, তারা ভুলে গেছে তাদের ঝগড়াঝাঁটি।

ভূত হওয়ায় এদের না হয় দৈবজ্ঞান হয়েছে! মর্ত্যলোকের মানুষের জ্ঞান হতে কী ভূত হতে হবে?

এখন একে একে বলি চার গোত্র কারা।

প্রথম দলটা শ্বেতশুভ্র পোশাকপরিহিত, রাজরাজড়া বা অভিজাত না হয়েই যায় না! তারা নাচছে মৃদঙ্গমের রাজকীয় তালের সাথে। নাচের ভঙ্গি আর তাদের মুখোশের ইঙ্গিত দেখে মনে হচ্ছে, এর অনুপ্রেরণা দক্ষিণ ভারতের কথাকলি নৃত্য। এদের মধ্যে দু’একটা মুখাবয়ব দেখে মনে হয় যে তারা জীবদ্দশায় মুসলিম সুলতান গোছের কিছু একটা ছিল।

দ্বিতীয় গ্রুপ শ্যামলা বা কালো রঙের ভূত, কারো উদোম শরীর। এরা সাধারণ খেটে-খাওয়া বলেই ঠাউর হয়। এদের কারো পোশাক-তরবারি-ঢাল দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমের রাজস্থানী, আবার কাউকে দেখে মনে হচ্ছে বাংলার লাঠিয়াল। এরা নাচছে কাঞ্জিরার তালে। রাজপুতদের তলোয়ার নাচ আর মারাঠাদের মার্শাল আর্টের কিছুটা প্রভাব আছে বলে মনে হয়।

তারপরেরটা চেনা সবচে’ সোজা। এদের পোশাক-আশাক যতটা না বিলাতী, তার থেকে বেশি সাধারণ ইউরোপীয়। এদের কাঠখোট্টা নড়াচড়ার সাথে জুতসই হয়েছে ভাতের পাত্র ঘটমের উপর চাঁটের আওয়াজ। এরা হুকাবাহী নেটিভকে চপেটাঘাত করলেও আমার হিসাবে ঔপনিবেশিকতার প্রদর্শন এখানে গৌণ। এই দলে ব্রিটিশদের সাথে ওলন্দাজ-ফরাসীরাও আছে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে তারা নিজেদের মধ্যে দেদারসে যুদ্ধ করেছে

আর শেষের বিশালবপুর দল হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত গোষ্ঠী। ধর্মীয় বেশভূষা থাকলেও তারা আবশ্যিকভাবে ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রচারক নয়, কিন্তু ধর্ম আর ধর্মের মত বিভিন্ন ইজ়ম তাদেরকে ব্যাপক টানে। আর একে অন্যের উপর মতামত চাপিয়ে দিতে এদের জুড়ি নেই। তাই এদের কৌতুকপ্রদ অঙ্গভঙ্গির সাথে মানানসই বাদ্যযন্ত্র মোরসিং, যার আরেক নাম জিউ’স হার্প

মিউজ়িকটা ষাটের দশকের সাইকিডেলিয়া হিসেবে ভাল চলবে। দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীত-ঐতিহ্য থেকে বাদ্যযন্ত্র আর নৃত্যের কিছু আইডিয়া ধার নিয়েছেন সত্যজিৎ। পারকাশন ছাড়া আর অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র না রাখার কারণ বোধহয় আদিমতা-সরলতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। ক্যামেরা আর এডিটিংএ স্পেশাল এফেক্টস সে যুগে কিভাবে করলেন সেটা অবাককরা ব্যাপার। আলোছায়ার খেলার সাথে নাচের কোরিওগ্রাফীও মিলেছে ভালো। অবশ্য সত্যজিৎ ভয়ে ছিলেন যে, সাধারণ দর্শক তাঁর এই অ্যাবস্ট্রাক্ট, আভঁ-গার্ড শিল্প গিলবে কিনা!

আর এটা আশা করি মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, ছবিটার শেষটা হলো হাল্লা-শুন্ডির দুই রাজার ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ থামানোর দৃশ্য। অর্থাৎ ভূতনৃত্যের সংঘাতবিরোধী বাণী বাকি ছবির সাথে অতীব সঙ্গতিপূর্ণ!

মুলোর মত দাঁত আর ভাঁটার মত রক্তলাল চোখেও বান্ধবসুলভ যে আধো-রহস্যময় হাসি ভূতের রাজার ঠোঁটে, তার রহস্য ভেদ করে ফেললাম!

ট্রেইল অফ টিয়ারস

Featured Video Play Icon
আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। ইউরোপীয়রা জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত ১২ শতাংশ, ভারতীয়-চীনা ইত্যাদি সকল এশিয়ান ৫ শতাংশ। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায় আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের অস্তিত্ব, যারা এখন জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম, দোআঁসলা মিলিয়ে মাত্র ৫০ লাখের মত। তাই আজকে এদের ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান নাম দিয়ে আমরা যাদের সবাইকে এক বাক্সে বন্দী করি, তাদের কিন্তু প্রায় ৫০০টি স্বতন্ত্র ট্রাইব আর তারা ৯টি আলাদা পরিবারের ৩০০টি ভাষায় কথা বলে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক রীতিনীতিও সেরকম বৈচিত্রময়। অ্যারিজ়োনার হোপিরা মাতৃতান্ত্রিক, ওকলাহোমার ওসেজরা পুরুষশাসিত। মিডওয়েস্টের প্রেইরি ইন্ডিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর শিকারী গোত্র, আবার নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার আনাসাজ়ি-পুয়েবলোরা কৃষিপ্রধান নগরসভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

এ সকল জাতেরই পিতৃপুরুষ পূর্ব এশিয়া বা সাইবেরিয়ায় বাস করত। ত্রিশ হাজার বছর আগে — বরফযুগের শেষে — তারা শিকার তাড়া করতে করতে বরফাবৃত বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে আলাস্কায় ঢুকে পড়ে। বরফ গলে যাবার পরে প্রশান্ত মহাসাগরের অকূল পাথার তাদেরকে এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর কয়েক হাজার বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। অন্যান্য বিশ্বসভ্যতা, বাণিজ্যপথ, আর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান থেকে আলাদা হয়ে পড়ায় ১৪৯২এ ক্রিস্টোফার কলাম্বাস তাদেরকে পান প্রস্তরযুগীয়, বড়জোর ব্রোঞ্জ প্রযুক্তির পর্যায়ে। এমনকি চাকার ব্যবহারটা পর্যন্ত কেউ জানত না!

দক্ষিণে আজ়তেক, মায়া, ইন্কারা যখন পাথর কেঁটে অতিকায় পিরামিড বানাতে ব্যস্ত, তখন উত্তরের নেটিভ আমেরিকান ট্রাইবগুলি অতটা অগ্রসর ছিল না। তারপরেও তাদের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় ইলিনয়ের ক্যাহোকিয়া, কলোরাডোর মেসা ভের্দে, আর নিউমেক্সিকোর টাওসচাকোর ধ্বংসাবশেষগুলোর মাঝে। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা ষোড়শ শতকে মেক্সিকোতে লোকমুখে শুনেছিল উত্তরের সাতটি স্বর্ণমণ্ডিত নগরীর কথা। সেগুলো খুঁজে বের করতে তারা অভিযানও পাঠিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে এ সকল জনপদ ক্ষয়িষ্ণু।

১৬২১এর হেমন্তে মেফ্লাওয়ার জাহাজে আগত ইংরেজ সেটলার আর তাদের পড়শি ওয়াম্পানোগ ট্রাইব নবান্নের খাবার একসাথে ভাগাভাগি করে খায়। থ্যাংকসগিভিং ঐতিহ্যের সূত্রপাত এখানেই। কথিত আছে ১৬১৪ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে জন স্মিথ বলে এক ইংরেজ সেটলারের প্রেমে পড়ে স্থানীয় ইন্ডিয়ান চীফের মেয়ে পোকাহোন্তাস। আমেরিকার ইতিহাসে নাকি সেই প্রথম ইন্টাররেশিয়াল বিয়ে। তাদের প্রেমকাহিনী নিয়েই অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘পোকাহোন্তাস’ তৈরি করে ডিজ়নি।

অন্যদিকে ইউরোপীয়রা বাজে যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল আমেরিকায়, তা হলো গুটিবসন্তের জীবাণু। পুরনো পৃথিবীর এ রোগের সাথে অপরিচিত নেটিভদের ইম্যুন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে ছিল অকার্যকরী। ফলে মহামারিতে বিপুলসংখ্যক ইন্ডিয়ান মারা যায়।

আমেরিকার গোড়াপত্তনের পরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্বন্ধে মার্কিন প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা ছিল ভাল-খারাপ মিশ্রিত। তাদের হিসাবে নেটিভরা জংলী জাত হলেও নৈতিক মূল্যবোধ টনটনে, আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব তাদেরকে সভ্যতা শেখানো। (ব্যতিক্রমঃ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।)  এ কারণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ট্রাইব, যেমন চেরোকিরা, তাদের আদিভাষা, পোশাক-আষাক, কৃষ্টি ছেড়ে আমেরিকান হতে শুরু করে।

তারপরও যখনই নেটিভদের জমিজমার উপর ইউরোপীয়দের দৃষ্টি পড়েছে, তখনই তারা প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে। চেরোকিদের এলাকায় স্বর্ণ আবিষ্কৃত হলে বাইবেলের এক্সোডাসের ইহুদীদের মত তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে শ’ শ’ মাইল পায়ে দলে চেরোকিদের চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিমের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিতে। যাত্রাপথে খাদ্যাভাবে, ঠান্ডায় মৃত্যুবরণ করেছিল অনেকে। তার উপরে ভিন্নগোষ্ঠীর নেটিভরাও তাদের উপরে আক্রমণ করে। যারা আদিনিবাস ছাড়তে অরাজি ছিল, তাদের সাথেও ইউরোপীয়দের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৮৩০এর দশকের এসব ঘটনা ইতিহাসে পরিচিত ‘ট্রেইল অফ টিয়ারস’ হিসাবে।

গৃহযুদ্ধের পরে শিল্পবিপ্লবের সস্তা প্রডাক্ট মদ্যপানীয় আর আগ্নেয়াস্ত্রও নেটিভদের হাতে আসা শুরু করে। সাদাদের বিরুদ্ধে তো ইন্ডিয়ানরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেই, একে অন্যের বিরুদ্ধেও অপ্রতুল গোচারণভূমি নিয়ে ঝগড়াঝাটিতে লেগে থাকে তারা। ফলে যুদ্ধে, নেশায়-বিষণ্ণতায়, অনাহারে-অপুষ্টিতে নেটিভ আমেরিকান জনসংখ্যা আরো কমতে থাকে।

১৮৯০এ এক মার্কিন সেনাদল সাউথ ডাকোটার উন্ডেড নী ক্রীকের কাছে লাকোটা ইন্ডিয়ানদের একটা গ্রুপকে  তাদের নির্ধারিত রিজ়ারভেশনে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় ভুল বুঝাবুঝি থেকে ঝগড়ার সুত্রপাত হয় আর সৈন্যরা গুলি করে প্রায় তিনশ’ লাকোটাকে মেরে ফেলে। তাদের মধ্যে নারী-শিশু মৃতের সংখ্যা ছিল ২০০। উন্ডেড নী এখন মার্কিন ইতিহাসে সবচে’ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড হিসাবে স্বীকৃত।

এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ১৯২৪ সালে। সে বছর আমেরিকার সকল আদিবাসীকে জাতিগোষ্ঠীনির্বিশেষে মার্কিন নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার দেয়া হয়। ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত চার্লস কার্টিস ১৯২৯এ রিপাবলিকান পার্টির টিকেটে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট রোজ়ভেল্টের আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচুর নেটিভ আমেরিকান জওয়ান সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিল। সেনাজীবনকে নেটিভরা সেসময়ে সম্মানজনক হিসাবে দেখতো। ২০০২এর উইন্ড-টকারস মুভিটাতে দেখতে পারবেন নাভ়াহো ট্রাইবের নেটিভরা কিভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীকে গোপন সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ করতে সাহায্য করেছিল।

আজ অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকান শহুরে, কিছু থাকে রিজ়ারভেশনে। রিজ়ারভেশনগুলি স্বায়ত্ত্বশাসিত, তাদের ক্ষেত্রে স্টেটের আইন খাঁটে না। তার সুযোগ নিয়ে কিছু রিজ়ারভেশন জুয়া আর টাকা ধারের ব্যবসা বসিয়ে টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলছে। সবসময় সেগুলি যে সৎ ব্যবসা তা নয়। নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার কিছু নেটিভ জীবিকানির্বাহ করে চিত্তাকর্ষক স্যুভনির হস্তশিল্প বানিয়ে। আবার মন্টানা-ডাকোটার অনেক রিজ়ারভেশন আছে, যারা সরকারী অনুদানের উপর নির্ভরশীল। তাদের ভালো স্কুল-কলেজ নেই, বেকারত্ব-মাদকাসক্তির হার অতিরিক্ত।

২০০৯এ ওবামা সরকার নেটিভ আমেরিকানদের ওপর অতীতের দুর্ব্যবহারের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এখন অনেক নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মকে তাদের আদিভাষা-সংস্কৃতি শিখানোর ব্যাপারে সচেতন। ওকলাহোমার চেরোকিদের অঞ্চলে গেলে ইংরেজির পাশাপাশি তাদের ভাষারও রোডসাইন দেখা যায়। মতপ্রকাশ আর সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বাসস্থান আর খাদ্যসংস্থানের নিরাপত্তার জন্যে এখনও অনেক সম্প্রদায়কে সংগ্রাম করতে হয়।

নেটিভ আমেরিকান বংশোদ্ভূত একজনকে আমি চিনি। ইউএস আর্মিতে বহুদিন থাকার পরে সফ্টওয়্যার সেক্টরে চাকরি করে সফল হয়, আর্লি রিটায়ার করে। সে অবশ্য ব্যতিক্রম। নেটিভ আমেরিকানদের মোটে ১৫% স্নাতক ডিগ্রিধারী। তবে বেকারত্বের হার সাদাদের তুলনায় একটু বেশি হলেও এখন আগের তুলনায় বেশি নেটিভ সার্ভিস সেক্টরের পেশায় আসে। কিছু বছর আগেও তারা ট্রাডিশনাল সমাজব্যবস্থা আর জীবনযাত্রা ছেড়ে চাকরীতে খুব একটা আসতো না।

ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়ে নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে খ্রীষ্টান যেমন আছে, সেরকম স্থানীয় একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীও আছে। পেয়োটে বলে এই ধর্মে ওয়াখান থানকা, অর্থাৎ ‘মহান আত্মা’, নামে এক নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। প্রকৃতির জীব-জড় সবকিছু ওয়াখান থানকার আত্মার ধারক, তাই বুনো গাছপালা আর জানোয়ারদের সংরক্ষণ করা পেয়োটে অনুসারীদের ধর্মীয় কর্তব্য। নেটিভ আমেরিকানদের নাচ-গানও মূলত প্রাকৃতিক শক্তি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তাদের প্রসিদ্ধ নাচগুলি হল গোস্ট ডান্সরেইন ডান্সসান ডান্স, প্রভৃতি।

মা’ক্ চি বলে এই গানটির ভাষা অধুনাবিলুপ্ত টুটেলো-সাপোনি। মোহক-বংশোদ্ভূত রোবি রবার্টসন কানাডার মূলধারার স্বনামধন্য শিল্পী। আর মার্কিন ইউলালি ব্যান্ডটার সদস্যরাও ইন্ডিয়ান ঐতিহ্যের। নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা গানটির বিষয়বস্তু। উত্তরপ্রজন্মকে সাহস যোগাতে তাদের আত্মা ফিরে ফিরে আসে, যেন নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধে তারা অটল থাকে, যেন তারা ভুলে না যায় আত্মপরিচয় আর স্বজাতির শিকড়।

সুবর্ণদ্বীপের বানরনৃত্য

Featured Video Play Icon
জাকার্তা, সুকার্নো, ইয়োগইয়াকার্তা, সুহার্তো, জাভা, সুমাত্রা, গারুডা, মালয়, সিঙ্গাপুর — মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার এই নামগুলির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ বলবো কি কারণে এই নামগুলো যথাক্রমে আসলে জয়কর্তা, সুকর্ণ, যোগ্যকর্তা, সু-অর্থ, যব, সমুদ্র, গরুড়, মলয়, সিংহপুর ইত্যাদি থেকে এসেছে।

লেখার সাথের ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘কেচা’ নামক অনুষ্ঠান। অপার্থিব এই দৃশ্যটি নেয়া হয়েছে ‘বারাকা’ বলে ১৯৯২এ তৈরি তথ্যচিত্র থেকে। এটা ধারণ করা হয়েছে বালির গুনুং কাউয়ি বলে একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে।

বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, ঠিক ততটা মনকাড়া তাদের শিল্প-সংস্কৃতি — যার মধ্যে আছে ছায়ানাট্য, লেগংবারং নৃত্য, আর রামায়ণের নাট্যাভিনয়। রাবণের রাক্ষসবাহিনী বনাম হনুমানের বানরবাহিনীর যুদ্ধের প্রতীকী রি-এন্যাক্টমেন্ট এই কেচা  নামক ‘বানরনৃত্য’।

অংশগ্রহণকারীদের কানে গোঁজা জবাকুসুম — যেটা বাংলায় দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত হয়। দৃশ্যটির গোঁড়ার দিকে দেখা যাচ্ছে বালির উলুওয়াতু মন্দিরের নিকটবর্তী অরণ্যের শাখামৃগদের, তারা সেখানকার পবিত্র রক্ষক। আর দেখানো হয়েছে জাভার বোরোবুদুর বৌদ্ধবিহার আর কম্বোডিয়ার আংকোর ভাটের বিষ্ণুমন্দিরের স্থাপত্য ও অলংকরণ। সেগুলি ভারতবর্ষের মন্দির-মসজিদগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়!

রামায়ণ আর হিন্দুধর্ম বালিসহ সারা ইন্দোনেশিয়াতে এসেছে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো।

ভিয়েতনামের ফুনানচম্পা, কম্বোডিয়ার চেনলাখ্মের, থাইল্যান্ডের দ্বারাবতী, মালয়েশিয়ার গঙ্গানগরলংকাসুকা, ইন্দোনেশিয়ার মজাপহিতশ্রীবিজয়াশৈলেন্দ্র, মায়ানমারের পাগান — অতীতের এ সকল রাজ্য সবাই কোন না কোনভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করেছে। এদের অধিকাংশের নামই সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য।

বিশেষ করে ভারতের দুটো অঞ্চল পূর্বদিকে হিন্দু-বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত-পালি ভাষা, নাগরীলিপি, স্থাপত্যশৈলী, আর পরবর্তীতে ইসলাম, ইত্যাদির বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সে দুটো কোরোমান্ডেল উপকূল আর বঙ্গ। নালন্দার বৌদ্ধবিহারে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে খচিত শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি ‘সুবর্ণদ্বীপের’ — অর্থাৎ সুমাত্রার — শ্রীবিজয়া রাজ্যের শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজা বলপুত্র কর্তৃক একটি মঠস্থাপনের জন্যে অনুদানের কথা। আর আমাদের বিক্রমপুরের বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে ধর্মপ্রচারে যাবার আগে সুবর্ণদ্বীপেই  শ্রীবিজয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যয়ন করেন।

কি উপায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রথম পূর্ব এশিয়াতে এসে পৌঁচেছে, তার বিস্তারিত কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা যেতে পারে বাণিজ্যের খাতিরে শ’ শ’ বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানকার স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা — সাথে তাদের প্রজারা — ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ধর্মচিন্তার ঐশ্বর্য দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের তেলেগু পল্লব বংশের রাজারাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমুদ্রের অপরপারে নতুন রাজ্য আর রাজবংশ স্থাপনে। এ ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।

ভারতীয় দখলদারিত্ব আর ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসও অবশ্য একটা সময়ে পাওয়া যায়। সেটা হলো একাদশ শতাব্দীতে তামিল চোলবংশের আগ্রাসনে শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের পরাজয়, যাদের স্থান পরে পূরণ করে ত্রয়োদশ শতকের মজাপহিত বলে জবদ্বীপের — অর্থাৎ জাভার — আরেকটি রাজবংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ঠিকানাও এ এলাকায় প্রাচীনতা থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে তাদের বাণিজ্যপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর-নগরগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। সুফী ধর্মপ্রচারকরা দ্বীপগুলির আরো গভীরাঞ্চলে ইসলামের বাণী নিয়ে যায়। তার উপরে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে তাদের বনেদী বংশগুলির সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার রাজারাও ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। তাছাড়াও আরবীর পরিবর্তে মালয় ভাষাতে ইসলামী পান্ডুলিপির প্রাচুর্য ছিল। এসব কারণে শীঘ্রই পুরো ইন্দোনেশিয়ার আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম হয়ে যায়।

সেই ধারার ব্যতিক্রম শুধু বালি । বহুদিন ধরে তারা জাভা-সুমাত্রার মুসলিম রাজ্যগুলি থেকে স্বাধীন ছিল। আলাদা দ্বীপ হওয়ায় ধর্মপ্রচারকরাও সহজে সেখানে যেতে পারেনি। সেকারণে তারা আদিধর্ম বজিয়ে রেখেছে। তাদের রাজ্যগুলিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দখলে নেয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হল্যান্ড। বালিনিজ়দের উপর তাদের অত্যাচার দেখে বাকি ইউরোপীয় জাত তাদেরকে ছি-ছি করেছিল। সে কারণে তিরিশের দশকে অনেকটা ক্ষতিপূরণস্বরূপ ডাচরা বালির শিল্পসংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া শুরু করে। কেচা-নৃত্যের উদ্ভব সে সময়।

এদের হিন্দুধর্মও ভারতের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। পুরনো অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের মূল খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না। যেমন, কেচা আসলে সাংহিয়াং বলে বালির এক ভূততাড়ানি অনুষ্ঠানের আধুনিক রূপ। বৌদ্ধধর্মও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। মজাপহিত রাজবংশের সময় শিব আর বুদ্ধ দু’য়েরই উপাসনা চলত একই মন্দিরে, এ ছিল তাদের অভাবনীয় ধর্মীয় সংস্কার আর সহনশীলতার প্রমাণ। ইসলামের বিস্তারের পরেও আগের অনেক আচারব্যবস্থা সুফী চিন্তার প্রভাবে রিডিফাইন-রিপারপাজ় হয়েছে। যেমন সুরো বলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তাসহকারে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের সময় থেকে মুসলিম-খ্রীষ্টান, মালয়-চীনা দাঙ্গা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। নাইন-ইলেভেনের মত ভূরাজনৈতিক কারণে স্থানীয় কট্টরপন্থীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে ইন্দোনেশীয়দের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতা বিপন্ন। বালির হিন্দু জনগোষ্ঠী তাও বেঁচে গেছে দেশের কদর বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের টাকা উপার্জনের সামর্থের কারণে। সেটা কতদিন টেকে সেটা দেখবার বিষয়। অন্তত যতদিন ওয়াহহাবি মতবাদের সরকারগুলির অর্থায়ন থাকবে, ততদিন তাদের ভয় থেকেই যাবে।

তুর্কীনাচন

Featured Video Play Icon
ইসলামের প্রসার ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফী চিন্তাধারার অবদান অনস্বীকার্য। আর সুফী সাধকদের মধ্যে মওলানা রুমী উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত — তুরস্ক-পারস্য-ভারতে তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাঁর কাব্য আজ বহুলপঠিত।

উপরের ভিডিওতে যেটা দেখছেন, তাকে নাচগানের পর্যায়ে ফেলাটা ভুল হবে। এই পারফরম্যান্সটা জনসমক্ষে করা হলেও অতীতে এ ধরনের প্রার্থনাগীতি আর ঘূর্ণিনৃত্যের সমাবেশ হত শুধু মৌলভীদের খানকায়। যে কেউ তাতে অংশ নিতে পারত বা দেখতে যেতে পারত, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা, দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন নয়।

এই ধরনের জ়িকর বা স্রষ্টার নামস্মরণ করাকে তুর্কী ভাষায় বলে সেমা, যেটার আরবী শব্দমূলের অর্থ শ্রবণ করা। প্রখ্যাত সুফী কবি জালালুদ্দিন রুমী ত্রয়োদশ শতকে মিস্টিসিজ়ম বা গূঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে সেমাসহ অন্যান্য সুফী ঐতিহ্যের সূচনা করেন, যেটা তুর্কী-ফার্সী-আরবী ভাষায় মৌলভী তরিকা বলে পরিচিত। মূলধারার অনেক মুসলিম মনীষীদের হিসাবে এগুলি ইসলামের বিপরীত নয়, নামাজ-রোজার প্রতিস্থাপকও নয়। রুমী কুরআন-হাদীসের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রকাশিত জানা নিয়মকানুন থেকে শুরু করার পরে ইসলামের আরেকটি গূঢ় অন্তর্মূলে যাওয়া সম্ভব, যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক প্রেমের। সেমার মত জ়িকর সুফী সাধককে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করে।

সুফী দর্শনের শুরু রুমীর মাধ্যমে নয়, তাঁর আগেও অনেক মনীষী ইসলামের মানবিক আধ্যাত্মিক দিকগুলি খুঁজে বের করে তার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত সাধক ছিলেন একজন নারী, তাঁর নাম রাবিয়া বসরী। আর ইমাম গাজ্জ়ালী — যাঁর মতাদর্শের প্রসারের কারণে ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের ইসলামী যুক্তিবাদী দর্শন জনপ্রিয়তা-পৃষ্ঠপোষকতা হারানো শুরু করে — তিনি আশারী নামক সুফী মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন। বিজ্ঞান দিয়ে স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে বোঝার থেকে তাঁর পছন্দ ছিল অন্তর্মুখী সাধনা আর ধ্যানের মাধ্যমে স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়া আর সৃষ্টির মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করা। তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী, যদি অন্তরের পবিত্রতা থাকে, তাহলে নাচ-গান-সুরের সাহায্য নিয়ে জ়িকর করা অবৈধ নয়।

এই পারফরম্যান্সে তাই দেখতে পাচ্ছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার — যার মধ্যে আছে নেই নামক বাঁশি, রিক্ক্ বলে খঞ্জনী, গীটারের মত উদ, আর আমাদের সন্তুরের মত কানুন। শিল্পীরা তাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফাতিহা দিয়ে শুরু করেছেন, কিন্তু সেমার বাকি অংশে কোন কুরআন-হাদীসের বাণী টানা হয়নি। সেটা ইচ্ছামূলক, যেন কেউ তাঁদের আবৃত্তিকে পবিত্র বাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলে পাপী না হয়।

কানুন বাদ্যযন্ত্রটি এখানে বাজাচ্ছেন জ়ুলিয়্যাঁ জালালুদ্দিন ওয়াইস বলে এক ফরাসী মিউজ়িশিয়ান, যিনি ইউরোপে সুফীসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ। সিরিয়ার দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়্যা মসজিদের শেখ শাক্কুর এখানে প্রধান গায়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন। খোদাকে স্মরণ করছেন কয়েক রকম নামে, আল্লাহু হা’ঈ অর্থ আল্লাহ সদাজীবিত, সর্বদা-জাগ্রত। ক’দিন আগে একটা হিব্রু ইয়েমেনী গান নিয়ে লিখেছিলাম, সেখানেও স্রষ্টাকে একই হা’ঈ নামে ভূষিত করেছেন ইহুদী গীতিকার। আরেকটা উপাধিতে খোদাকে স্মরণ করছেন শেখ শাক্কুর, আলিমুল সির্‌রি‍‍‍ ওয়া জাহরি, অর্থাৎ গুপ্ত আর প্রকাশিত সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ। এখানেই উঠে এসেছে সুফী চিন্তাধারার মূল প্রতিপাদ্য, যে, আক্ষরিকের পরেও কুরআন-হাদীসে ‘গুপ্ত’ একটা লেভেল আছে, সেটা হিউম্যানিজ়ম বা মানবতাবাদ থেকে খুব অভিন্ন কিছু নয়।

ঘূর্ণিনৃত্যের পোশাক আর একেকটা অঙ্গভঙ্গির মধ্যেও গুহ্য অর্থ রয়েছে। সিক্কা বলে ঊটের লোমের তৈরি লম্বা টুপি আসলে সমাধিস্তম্ভের রূপক, সে সমাধি আত্ম-অহমের। আর শিল্পীদের পরনে যে ঢোলা স্কার্টের মত সাদা পোশাক, সেটা যেন কাফনের কাপড়। তাঁরা শুরু করছেন বুকের উপরে দু’হাত রেখে বাউ করে, এই ভঙ্গি তওহীদ বা স্রষ্টার একত্বের প্রতীকী ঘোষণা। তাঁরা ঘুরছেন ডান থেকে বামে, ডান হাত কখনো উপরে ফেরানো, বাম হাত অধঃমুখী। যেন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসার বাহক হিসাবে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে এসে বিলিয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর বাকিসব প্রাণীকে। গ্রহনক্ষত্রের আবর্তনের প্রাচীন স্বর্গীয় নিয়মকে অনুকরণ করে সেমাজ়েনরা ঘুরে চলেছেন। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়া তাঁদের লক্ষ্য নয়।

রুমীর চিন্তাধারার মধ্যে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষেরই খোদার ভালবাসা ‌অর্জনের ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, অন্যান্য অনেক প্রাচীন আর আধুনিক ধর্মের মধ্যেও সুফীদের মত আধ্যাত্মিক দর্শনের উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টের আগমনের সময়ে গ্নস্টিসিজ়ম বলে একটা গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শন প্রচলিত ছিল, যেটা প্রাক-ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্মকেও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম কিংবা শ্রীকৃষ্ণলীলাও এধরনের গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উত্তম উদাহরণ। তাই বলে এটা ভাবাটা পুরোপুরি ঠিক নয় যে, রুমী ও অন্যান্য সুফীরা অনৈসলামিক চর্চাকে ইসলামী রূপ দিয়েছেন। তাঁরা স্বগরিমায় মূলধারার ইসলামী আইনকানুনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার বিবর্তন হয়েছে অনেক পড়াশোনা আর মেডিটেশনের মাধ্যমে।

সুতরাং সুফীবাদ ইসলামের থেকে আলাদা বিশেষ কিছু নয়। একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সুফীদের বহু তরিকা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। ভারতে ইসলামের বিস্তারের মূল কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে সুফী সাধকদের আগমন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ভারতবর্ষের নামীদামী মাদ্রাসাগুলো সুফী মতাদর্শেরই দিকপাল ছিল। বায়েজ়িদ বোস্তামী, হাফেজ়, শেখ সাদী, রুমী ইত্যাদি মনীষীর চিন্তাধারা পরবর্তীতে প্রভাবিত করেছে মির্জ়া গালিব, ইকবাল, নজরুলের মত কবিকে।

আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থার কারণে মুসলিমরা হয় পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদী ধারায় ফিরেছে, নয়ত সালাফী-ওয়াহহাবী অর্থায়নের কারণে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থটাকে গ্রহণ করে একটু কট্টরপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছে। দু’পক্ষের কেউই সুফী চিন্তাধারার শক্তিটাকে অনুধাবন করতে পারে না। অবহেলার কারণে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ভন্ডপীর আর মুরীদের দল সুফী মতবাদকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে।

বিশেষ করে সালাফীরা সুফীসাধনাকে অনৈসলামিক মনে করে। তারা সেমা, জ়িকর, নামাজের পর দোয়া — এসব সুফী প্রথাকে বলে বিদআত বা ধর্মবিচ্যুত উদ্ভাবন। সেকারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইসিস খুঁজে খুঁজে সুফী সাধকদের হত্যা করেছে। জালালুদ্দিন ওয়াইস তখন তাঁর দামেস্কের বাসস্থান থেকে পালাতে বাধ্য হন। এই ভিডিওতে অংশ নেয়া সেমাজ়েনদের অনেকে এখন গৃহহীন রেফ্যুজি, একজন পায়ে শ্রাপনেলের আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী।

আবার যুক্তিবাদী সেক্যুলারদের শাসনেও সুফীরা তাদের অনেক অধিকার হারিয়েছে। ১৯২৫ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে প্রকাশ্যে সুফী মতবাদের চর্চা আইন করে বন্ধ করে দেন, অভিযোগ ছিল এগুলো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার। ইস্তাম্বুলের প্রায় আড়াইশ’ তেক্কে বা খানকা বন্ধ করে দেয়া হয়, নয়ত তাদের জাদুঘর হিসাবে সরকারী মালিকানায় নিয়ে আসা হয়। তারপরেও অনেক সুফী গোপনে ব্যাক্তিগতভাবে চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সেমা পালন করার লাইসেন্স দেয়া হয়। ২০০০এর দশক থেকে এখন খুব একটা কড়াকড়ি নেই। মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলি থেকে অবশ্য সত্যিকারের সুফীবাদ পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে, আছে খালি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের খোলস হিসাবে। অথচ একসময় এরাই সুফীসাধনার অগ্রগণ্য কেন্দ্র ছিল।

পশ্চিমাবিশ্বে কিন্তু এখন সুফীদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পরে অনেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে সুফীবাদকে পুনরাবিষ্কার করেছে। আমেরিকায় কবিতার বইয়ের কাতারে রুমীর অনুবাদগুলো এখন বেস্টসেলার। ইউনেস্কোও ২০০৮এ সেমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানবসভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য হিসাবে।

মানবতার সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে রুমীর লেখা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করিঃ
“At times we are hidden, at times revealed;
We are Muslims, Christians, Jews; of any race.
Our hearts are shaped like any human heart,
But every day we wear a different face.”

মাৎসুরি

Featured Video Play Icon

জাপানের পরব মাৎসুরি বাংলাদেশের মেলার মতই উৎসবমুখর, রঙ্গীন। আর তাতে তাল-সুর দিয়েছে আমাদের ঢাকের মত তাইকো ড্রাম।

ছোটবেলায় গ্রাম্যমেলা রচনা লিখতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। ঢাকার উত্তরায় থাকতে আব্বা কাছের গ্রামেই বৈশাখী মেলায় নিয়ে যেতেন। চড়কীতে চড়া, বাতাসা খাওয়া, ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক আনন্দ ছিল।

এখন মার্কিনী প্রবাসজীবনে যাই কাউন্টি আর স্টেট ফেয়ারে। সে অভিজ্ঞতা বস্তুত অন্যরকম, কিন্তু ভাবে একইরকম! দূর-দূরান্তের ফার্ম থেকে গরু-ছাগল-ঘোড়া-ভেড়া চলে এসেছে, সাথে ট্রাক্টর-প্লাউ-ওয়্যাগন ইত্যাদিও হাজির। বাচ্চারা চরম মজা পায় সেগুলিতে চড়ে। টার্কি লেগ খাই যত অখাদ্যই হোক। একেক স্টেটের ফেয়ারের ভাবগতিকও তাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিমত একেকরকম।

তবে আজকে লিখছি জাপানী মেলা নিয়ে!

জাপানে গ্রাম্য মেলা এখন আর গ্রাম্য নেই। মাৎসুরি নামে পরিচিত এসব অনুষ্ঠান এখন সাধারণত শহরের মূল রাস্তা ধরেই হয়। প্রত্যেকটা পার্বণের পিছনে কোন শিন্তো বা বৌদ্ধধর্মীয় উপাসনার উপলক্ষ্য আছে। কোথাও কোথাও ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়াও হয়। একেক এলাকায় অনুষ্ঠান হয় বছরের বিভিন্ন নির্ধারিত সময়ে। বিশেষ করে পৌষপার্বণ বা নবান্নের সময়ে অনেক অঞ্চলেই এ অনুষ্ঠান হয়। হানামি বা চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল তো এখন বিশ্বের যেখানেই চেরি হয়, সেখানেই ছড়িয়ে গেছে! বু্দ্ধের জন্মোৎসবও পালিত হয় হানামাৎসুরির মাধ্যমে।

সেই মেলাতে কখনো কখনো জাপানীরা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা বা শিয়া সম্প্রদায়ের তাজ়িয়ার মত পাল্কিতে করে তাদের আঞ্চলিক কামি বা ‘দৈবশক্তির আধার প্রতিমাকে’ নিয়ে মন্দিরে স্থাপন করে। এমন একই জিনিস সামনাসামনি দেখেছি ঢাকার ইস্কন রথযাত্রায়, সেটার আরেকটু অরিজিন্যাল দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরে। কৃষ্ণের প্রতিমা বাৎসরিক বাপের-বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করে। ক্যাথলিকদের প্যাশন প্লে-ও অনেকটা একই।

মাৎসুরি মেলার দোকানপাটে বড়রা তাকোইয়াকি বলে সীফুড স্ন্যাক খায়, ছোটরা গোল্ডফিশ ধরার খেলা খেলে। চীনের লায়ন ড্যান্স বা ড্রাগন ড্যান্সের মত কাগজের তৈরি নেবুতা ফ্লোট নিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিহিত জাপানীরা শোভাযাত্রা করে। হানেতো বলে লম্ফজম্ফের বিশারদ হাতে পাখা নিয়ে তাদের সামনে নাচতে নাচতে যায়।

আর সে উৎসবের প্রাণ ঢাক জিনিসটা বঙ্গীয়-জাপানী দুই কালচারে এক্কেবারে কমন!

বাংলাদেশে কমপক্ষে বিশ রকমের পারকাশন ইন্স্ট্রুমেন্ট আছে। পাখোয়াজ-তবলা তুলনামূলক অধুনার আবিষ্কার, আরবী-ফারসীদের রপ্তানী। জাপানী বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে, তাইকো নামের কয়েকরকম ঢাক প্রাচীনকালে — ষষ্ঠ শতকে — ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে সিল্ক রোডের মারফত চীন-কোরিয়া হয়ে আমদানি হয়। বহু বৌদ্ধ সংস্কৃত পান্ডুলিপিও সে পথে পাচার হয়েছে, সাথে সংস্কৃত কিছু প্রপার নাউনও জাপানীতে ঢুকে পড়েছে। যেমন ধ্যান হয়ে গেছে জ়েন, অমিতাভ বুদ্ধ থেকে আমিদা

যে ট্র্যাকটা দিলাম লেখার সাথে, সেটা পরিবেশন করছে কোদো বলে একটা বিশ্বখ্যাত তাইকো ড্রামারদল। সাদো বলে একটা ছোট দ্বীপে তাদের বাস। বাঁশি, করতাল, জয়ঢাক আর দুন্দুভির মত বাদ্যযন্ত্রের সাথে নাচানাচি করে তারা মাৎসুরির চমৎকার একটা আবহ তৈরি করেছে। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে শোনা ঢাকের তালও মনে করিয়ে দেয় এদের ঢাকের আওয়াজ। শব্দধারণটাও খেয়াল করবেন! ভাল হেডফোনে বা থ্রিডি সাররাউন্ড সিস্টেমে ফুল ভল্যুমে শুনলে আপনার মনে হবে লাইভ শুনছেন।

আর এ লাইভে শোনারই বস্তু! আমি প্রথম তাইকো শুনি বোধহয় ২০০৩এ, ঢাকার শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে ওয়াদাইকো ইয়ামাতো দলটির পরিবেশনায়। সে এক না-ভোলা অভিজ্ঞতা! গগনবিদারী ড্রামের শব্দের ভাইব্রেশনটা আপনার হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে ফেলবে! মুস্তাফা জামান আব্বাসী বোধহয় তখন ডিরেক্টর আর উপস্থাপক ছিলেন, আমাদের দেশের ঢাকঢোলের সমান্তরালটা দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে ভুলেননি!

১৯৬৪র টোকিও অলিম্পিকে তাইকোর রিদম শোনার পরে পশ্চিমা বিশ্বও এই ঐতিহ্যকে জাতিনির্বিশেষে আপন করে নিয়েছে। খোদ আমেরিকাতেই মনে হয় এখন আটশ’র বেশি তাইকো ক্লাব। গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি আর শারীরিক ব্যায়ামের মজায় অনেকেই এসবে অংশ নেয়। জাপানের ইলেক্ট্রনিক মিউজ়িকের কম্পোজ়ার কিতারোও তাঁর কয়েকটি ট্র্যাকে তাইকো ড্রাম ব্যবহার করেছেন, মাৎসুরি নামে তাঁরও একটা কম্পোজ়িশন আছে।

এখন পপ কালচারে তাইকো জায়গা করে নিলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের সামুরাই-সামন্ততান্ত্রিক কামাকুরা পিরিয়ড থেকে। জাপানের অন্যান্য স্বকীয় সংস্কৃতিরও উদ্ভব এসময়ে। তখন সমগ্র জাপান সম্রাটের শাসনে নামমাত্র থাকলেও সামন্তরা ছিল নিজেদের এলাকায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্য নিজেদের মধ্যে সামুরাই বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করত। তখন যুদ্ধসঙ্গীতে তাইকোর স্থান ছিল। তারপর নো বা কাবুকি নাটকের উদ্ভবের পরে তার আবহসংগীত তৈরিতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাইকোও শামিল হয়।

পুরনো আমলে ঢাকঢোল পেটানোতে ছেলেদের একচেটিয়া মনোপোলি থাকলেও এখন কিন্তু জাপানে মেয়ে তাইকোবাদকের সংখ্যা ছেলেদের থেকে বেশি! জাপানের ট্র্যাডিশনাল সমাজে আরো অনেক কিছুর সাথে এখানেও একটা সমতা চলে এসেছে। টকিং অ্যাবাউট দ্যাট!… বাংলাদেশী মেয়েদের জন্যে ঢাকঢোল পেটানোর অনুপ্রেরণা রইলো!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!