বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ১

বিটকয়েনের ভবিষ্যত সম্পর্কে শুরু থেকেই আমি সন্দিহান। অনেককিছু দেখেশুনেই সেটা। তবে বলে রাখি আমার খুব সামান্য অংকের টাকা বিটকয়েন, লাইটকয়েন আর ইথারিয়াম হিসাবে আছে। কিন্তু তার মূল্য আমার মূল ইনভেস্টমেন্টের তুলনায় নগণ্য। এটা আমার ‘গ্যাম্বলিং মানি’, যা হারালে ক্ষতি নেই। যদি ডিজিটাল কারেন্সির সমর্থকরা যা বলে মানুষকে বুঝ দিচ্ছেন তা সত্য হয়, তাহলে সেটা ১০০ গুণ হয়ে ফেরত আসলে দোষ কী! ১,০০০ টাকা বেড়ে ১০০,০০০ হলেই আমি সন্তুষ্ট, ১,০০০,০০০ বানানোর লোভে মূলধন আরো ৯,০০০ ফেলার রিস্ক নিতে আমি রাজি নই।

আবার এটা বলাও জরুরী যে আমি পেশাদার অর্থনীতিবিদ বা ক্রিপটোগ্রাফার নই, আমার যুক্তিতে ভুল থাকতে পারে বা প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে। আর এটা অবশ্যই এমন একটা আলোচনা যেখানে আমার ভিন্নমতের মানুষও পুরোপুরি ভুল নাও হতে পারেন।

টাকার উৎপত্তি কিভাবে, এর প্রয়োজনই বা কেন, আর কেন আমরা আড়াই হাজার বছর ধরে এর কোন না কোন রূপের উপর নির্ভরশীল? বিটকয়েন বোঝার আগে এই মৌলিক ব্যাপারটা বোঝা দরকার।

প্রস্তরযুগের মানুষ কোনরকম খেয়ে পড়ে বাঁচতো, কেউ ছিল শিকারী বা মেষপালক, আবার কেউ কৃষক বা ফলমূলসংগ্রহকারী। যেসময় থেকে মানুষ প্রস্তর বা তাম্রনির্মিত সহায়ক সরঞ্জাম ব্যবহার করা শিখল, আর বছরের পর বছর ধরে তার উন্নতিসাধন করতে থাকল, তত তার জীবিকা হয়ে উঠল বিশেষায়িত। অর্থাৎ মৎস্যজীবী শুধু মাছ ধরতে জানে, লাঙ্গলের ল-ও বোঝে না। একই সাথে তৈরি হল তাদের পণ্যের উদ্বৃত্ত, যার হয়ত ভোক্তা আছে অন্য কোন পেশাজীবীদের মধ্যে। তারা শুরু করল নিজেদের মধ্যে পণ্যবিনিময়। সময়ে এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ল, যেমন কোন এক বছরে কৃষকের ঘরে খরার কারণে শস্য কম, সে জেলে ভাইকে অনুরোধ করল বাকিতে মাছ দিতে। জেলের আপত্তি নেই, শুধু সাক্ষী রাখলো দু’জনকে, আর হয়ত কাগজের অভাবে গাছের বাকলে কোন একটা চিহ্ন খোদাই করে রাখল ঋণের প্রমাণস্বরূপ। বলতে পারেন এটাই কারেন্সির আদিরূপ।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এরপরে আরো হাজার বছর পেরোনোর পর শ্রমের বিশেষায়নের কারণে উদ্ভব হল ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ রাজা-পুরোহিতশ্রেণীর। তারা বলল, আমরাই তোমাদের উদ্বৃত্ত কিনে নিয়ে হব সেন্ট্রাল ব্যাংক, বিনিময়ে দেব সোনামানিক। কারণ সোনার সাপ্লাই কম, মানুষের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসাবেও দাম আছে, আর স্বল্পপরিসরে অনেককিছুর দাম দেয়ার মত পরিমাণ পরিবহন করা যায়। রাজা-প্রজার মধ্যে সম্পর্ক যে শুধু শাসনের তা নয়, আস্থারও, কারণ রাজার একটা কাজ হলো এই সাপ্লাই-ডিমান্ডের ভারসাম্য অনুযায়ী মুদ্রা সাপ্লাই করা, আর তার অবমূল্যায়ন রোধ করা। রাজ্যপালেরা স্বর্ণমুদ্রা বানানো শুরু করেন প্রাচীন তুরস্কের পশ্চিম উপকূলের লিডিয়া রাজ্যে, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে।

মুদ্রার কাজ মোটামুটি তিনরকম। এক, ক্রয়ক্ষমতার আধার হিসাবে কাজ করা, যেন আগামী বছর যে গাড়িটা আমি কিনতে চাই, সেটার জন্য একবছর ধরে টাকা জমাতে পারি। দুই, পণ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে কাজ করা, টাকা না থাকলে সমপরিমাণ অন্য সম্পদ আমাকে দিতে হত গাড়ির বিনিময়ে, যেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হত। আর তিন, মূল্যায়নের একক বা ইউনিট হিসাবে কাজ করা, যে কারণে গাড়ির দাম কাউকে আন্দাজ করতে বললে সে হাজার টাকার ঘরে চিন্তা না করে করে লাখ টাকার হিসাব।

সুতরাং আড়াই হাজার বছর ধরে আমরা টাকা ব্যবহার করছি সঙ্গত সুবিধার কারণেই। আজ আমাদের অর্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত আরো অনেক কিছুর সাথে।আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংকব্যবস্থা চল্লিশ বছর আগেই সোনার সাথে ডলারের যোগাযোগ কেটে দিয়েছে, যার কারণ মূলত আমাদের পণ্যউৎপাদন যে হারে বেড়েছে সোনার সেভাবে বাড়েনি, অর্থাৎ দুনিয়ার তাবৎ সোনা দিয়েও বাকি বিষয়-আশয়ের দাম দেয়া সম্ভব নয়।

তার ফলে ফিয়াত কারেন্সি ব্যাপারটা আবার বিংশ শতকে শুরু হল চীনাদের সপ্তম খ্রীষ্টাব্দে প্রথম বিফল প্রচেষ্টার পরে। এর অর্থ “চাহিবামাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাগজে লিখিত অর্থের সমপরিমাণ ‘কিছু একটা’ দিতে বাধ্য থাকিবে”। ঐ কিছু একটা হয়ত অন্য কোন মুদ্রা বা কোন পণ্য, যার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা সমপরিমাণ। সবই কারো না কারো ওপর স্থাপিত ঐ প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সোজা কথায় মানুষ বিশ্বাস রাখে বলেই ডলার-ইউরো আজ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক কারেন্সি, তাদের ইস্যুকারী ব্যাংকরাও আস্থা হারানোর মত কাজ না করার চেষ্টা করে। যেমন মাঝেমধ্যে নতুন নোট প্রিন্ট করতে হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত হলে আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে (যেমন জিম্বাবু্য়ে ডলার!)। সেকারণে তারা ততটুকুই সাপ্লাই বাড়ায়, যতটুকু তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করে, তার সামান্য বেশি। সাপ্লাই সামান্য বেশি না রাখলে স্ফীতিহ্রাসের সম্ভাবনা, তাতে মানুষ অর্থখরচ না করে বেশি বেশি টাকা লেপের নিচে লুকিয়ে রাখবে! অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে তাতে কমতি হতে পারে।

তো মাঝেমধ্যে পুঁজিবাদী সমাজে স্বাভাবিক কারণেই মন্দা আসে। শেষবার হল ২০০৮এ। বিটকয়েনের উৎপত্তি সে সময়েই, ‘সাতোশি নাকামোতো’ ছদ্মনামধারী এক কম্প্যুটার প্রোগ্রামার আরো ক’জনার সাথে এ জিনিস শুরু করেন। এর কম্প্যুটার কোডও ওপেন সোর্স, অর্থাৎ যে কেউ সেটাকে নিয়ে নতুন নিয়মের আঙ্গিকে নতুন ধরনের ডিজিট্যাল কারেন্সি বানাতে পারে। বিটকয়েনের আবিষ্কর্তারা সরকার আর ব্যাংকগুলির উপর ভালরকম বীতশ্রদ্ধ ছিলেন আর সেসময়ের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য এদেরকে দায়ী করতেন। তারা বিটকয়েন বানান একারণেই যেন টাকা-ডলারের পরিবর্তে মানুষ ধীরে ধীরে বিটকয়েনে বিশ্বাসস্থাপন করে, আর তাতে সরকার-ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত জনগণের একটা মুদ্রা প্রতিষ্ঠা পায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!