বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৩

বিটকয়েন আজ এতটা জনপ্রিয় নাও হতে পারত, শুধু সীমাবদ্ধ থাকতে পারত ছোট কয়েকটা অনলাইন কম্যুনিটির মধ্যে, আর তারা হয়ত কয়েকশ’ বিটকয়েন নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেনামি মনোপোলি খেলায় এখনও ব্যস্ত থাকতো।

বিটকয়েনের জনপ্রিয়তাবৃদ্ধির পিছনে ডীপ বা ডার্ক ওয়েব বলে একটা জিনিসের বেশ বড় ভূমিকা আছে। ইন্টারনেটের একটা বিশাল অংশ আছে, যেগুলি কখনো গুগল সার্চ করে পাবেন না। পাবলিক ওয়েবসাইটের ডট কমজাতীয় ডোমেইন নেইম থাকলে তার রেজিস্ট্রেশনের তথ্য আইক্যান বলে একটা সংগঠনের সাইটে পাওয়া যায়, তার সাথে ডোমেইন ওনারের নাম-ঠিকানাও। ডীপ ওয়েব এসবের ধার ধারে না। তাদের সাইটগুলি রেজিস্টার্ড না, কিন্তু চাইলে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারে। আপনিও চাইলে নিজের কম্প্যুটারকে সার্ভার বানিয়ে ফেলতে পারেন, তখন আপনার সাইটটাকে আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে ব্রাউজারে দেখা সম্ভব, তার জন্য ডট কম জাতীয় নামের কোন দরকার নেই। আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে এটাও বোঝা সম্ভব আপনার সার্ভারের অবস্থান কোথায়। এধরনের অনেক সাইট নিয়েই ডীপ ওয়েব তৈরি।

এদের কিছু আবার নাম-পরিচয় গোপনের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। তাদেরকে আলাদা করে বলে ডার্ক ওয়েব। এদের দেখার জন্য টর বলে বিশেষ একটা ওয়েব ব্রাউজার লাগে। এই ব্রাউজার এনক্রিপশন আর বিশেষ ধরনের রাউটিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে যে সাইটটা দেখছে তার এবং সাইটটার মালিকেরও পরিচয় ঢাকতে সাহায্য করে। সেরকম সিল্ক রোড ছিল ডার্ক ওয়েবের ইবের মতই একটা ই-কমার্স সাইট। এর প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট উলব্রিখ্ট ছিলেন লিবার্টারিয়ান মতাদর্শের অনুসারী, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে সরকার বা বড় কম্পানিগুলির অতিরিক্ত নাক গলানো তার পছন্দ ছিল না। কোন অসদুদ্দেশ্যসাধনের থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আদর্শই ছিল বেনামী এই সার্ভিস চালু করার মূল কারণ।

কিন্তু সিল্করোড চালু হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অপরাধজগতের লোকজন বুঝে ফেলল একে তাদের কাজে লাগানো সম্ভব। তারা সিল্করোডে অবৈধ মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, পর্নোগ্রাফি, এসব বিক্রি করা শুরু করল। আর যারা তাদের কাছ থেকে এসব কিনত, তারা দাম দিত বিটকয়েনের মাধ্যমে, কারণ ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করলে নাম-পরিচয় ফাঁস! সিল্করোডের সফলতা দেখে আরো অন্যান্য ডার্ক সাইটও একইভাবে বিটকয়েন ব্যবহার শুরু করল। সেসবে হেন কোন বস্তু বা কাজ নেই, যার মূল্য বিটকয়েন দিয়ে পরিশোধ করা হয়নি — চুরি করা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, হ্যাককরা ইমেইল, ভুয়া পরিচয়পত্র, এমনকি পেশাদার খুনী আর হ্যাকাররাও তাদের ‘সার্ভিস’ এসব সাইটে ‘বিক্রি’ করেছে! আইসিসের মত সন্ত্রাসবাদী দল আর উত্তর কোরিয়ার মত একঘরেকরা দেশও এসব সাইট আর বিটকয়েনের মাধ্যমে তাদের তহবিল সংগ্রহ আর অস্ত্রশস্ত্র বেচাকেনা করেছে। এমনকি জুলিয়ান আসাঞ্জও উইকিলিকসে যারা বেনামে তথ্য পাঠাতে আগ্রহী, তাদেরকে বিটকয়েন দিয়ে পরিশোধ করেছেন। ২০১৩তে ডেমোক্র্যাট সিনেটর চাক শ্যুমারের অনুরোধে এফবিআই সিল্করোডের তদন্ত শুরু করে, উলব্রিখ্টের পরিচয় বের করে তাকে গ্রেফতার করে, আর সিল্করোড বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যেই সিল্করোড প্রায় ১ কোটি বিটকয়েনের লেনদেনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে ফেলেছে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




বিটকয়েনে দাম পেলেই তো হবে না, তাকে অন্য সত্যিকারের কারেন্সিতে রূপান্তরেরও প্রয়োজন দেখা দিল। তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ব্যবসার মত ঝাঁকে ঝাঁকে গজিয়ে উঠল বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ। সেসবে অপরাধজগতের সাথে যুক্ত লোকজনই শুরুতে বিটকয়েন কিনে কিনে তার দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ডলার-ইউরো খরচ করে বিটকয়েন কিনতে। তাতেই তাদের লাভ, কারণ এতে তারা তাদের ‘কাল্পনিক’ মুদ্রার ভান্ডার খালি করে পেতে পারে ডলার-ইউরোর মত সত্যিকারের মুদ্রা। এসব এক্সচেঞ্জের বেশিরভাগ বহুদিন সরকারি নিয়মনীতির অভাবে যথেচ্ছভাবে ফী সংগ্রহ করে চুটিয়ে ব্যবসা করে গেছে। এফবিআই যখন শেষপর্যন্ত এদের দিকে নজর দিয়েছে, তখন মানি লন্ডারিং বা হুন্ডিব্যবসার অভিযোগে অনেককে জেলে পুরেছে। কিন্তু ততদিনে বিটকয়েন ইন্টারনেটের গলি-ঘুঁপচি থেকে এসে ঢুকে পড়েছে মূলসরণীতে। বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, কফিশপ, এরা দাম পরিশোধের মাধ্যম হিসাবে বিটকয়েন গ্রহণ করা শুরু করে দিয়েছে।

কাহিনীর এই পর্যায়ে এসেই হয়ত আমি-আপনি প্রথম শুনেছি বিটকয়েনের নাম।

সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!