রাষ্ট্রবিহীন জাতি

আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দীঅধ্যুষিত এলাকার মানচিত্র

কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।

ইরাকী কুর্দিস্তান রোডসাইন, তিন ভাষায়
সিরিয়ার ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত রোজাভা এলাকায় লাতিন হরফে কুর্দী সিনিয়েজ

অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আ‌ইয়ুবী শাসনামলে।

সালাউদ্দিনের চিত্রসম্বলিত আইয়ুবী মুদ্রা

প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি ‌অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের ‌অন্যান্য জাতির মত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের ‌অন্যান্য ‌অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।

তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।

‌আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।

অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরব প্রতিনিধি ভবিষ্যৎ জর্দানী রাজা ফয়সাল, সৌদী নন, হাশেমী

যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।

প্যারিস শান্তি আলোচনার ‌অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।

উইলসনিয়ান আরমেনিয়া
কিং ক্রেন কমিশনের রিপোর্ট

কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, ‌অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।

এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।

লোজান চুক্তি পরবর্তী মানচিত্রে উইলসনিয়ান আর্মেনিয়া ও কুর্দীস্তান অনুপস্থিত

১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।

মাহমুদ বারজানজী — “কিং ‌অফ কুর্দীস্তান”

বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।

ভাইকিং বেদ

Featured Video Play Icon

প্রাচীন ভারতের অথর্ববেদ আর ভাইকিং ওল্ড নর্স সাগার (মহাকাব্য) মধ্যে শুধু যোজন যোজন দূরত্ব নয়, কমপক্ষে এক হাজার বছরের বিভক্তি।

তারপরও এই গানটিতে গাওয়া ওল্ড হাই জার্মান আর ওল্ড নর্স ভাষার মন্ত্রগুলি শুনে আমার বেদের কথা মনে পড়ে গেল।

গানটিতে দুটি ভাষা আর তিনটি আলাদা মন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি অষ্টম শতকের প্রাচীন জার্মানিক ভাষায় শত্রুর বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্র। মন্ত্রের যাদুকরী শক্তির বলে উত্থিত ‘ইদিসি’ নামক নারীদৈবশক্তির সাহায্যে হাতের বন্ধন আলগা করে পালানোর তাল করছে বন্দী যোদ্ধারা।

অষ্টম শতকে লেখা এ মন্ত্র ভাগ্যক্রমে মের্সেবুর্গ নামে এক পুরনো জার্মান শহরের ক্যাথলিক মনাস্টেরির লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকে। মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টান প্রেয়ারবুকের মাঝে আলগা কাগজে লেখা ছিল দুটি মন্ত্র। একটার কথা বললাম, আর অন্যটার বিষয়বস্তু আহত ঘোড়ার খুরের পরিচর্যা। প্রাক-ভাইকিং জার্মানিক দেবতা উওটান তার পুত্র বাল্ডরের ঘোড়ার ডিসলোকেটেড হাড় ঠিক করার জন্যে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন: Bone to bone, blood to blood, limb to limb, as if they were mended!

গানের দ্বিতীয় মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নেক্রোম্যান্সি বা মৃতব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলার ওল্ড নর্স মন্ত্র। আইসল্যান্ড আর নরওয়েতে পাওয়া ভাইকিং আমলের ‘পোয়েটিক এডার’ কাহিনীর সাথে জড়িত গ্রোগাল্ডর মহাকাব্যের নায়ক তার মৃত মা গ্রোয়ার সমাধিস্তূপে গিয়ে তার প্রেতাত্মাকে উত্থিত করেছে। উদ্দেশ্য, বিপদসংকুল যাত্রার আগে গ্রোয়ার উপদেশগ্রহণ। গ্রোয়ার আত্মা গুনে গুনে নয়টি মন্ত্র দিয়ে ছেলের ওপর রক্ষাকবচ দিয়ে দিচ্ছে। তার একটি ঐ মের্সেবুর্গ মন্ত্রের হাতের বন্ধন আলগা করার হুবহু সমান্তরাল। আর নয় সংখ্যাটি ওল্ড নর্স ধর্মে একটি পুণ্যকর সংখ্যা।

আর গানের কোরাসে পুরুষকন্ঠে যে মন্ত্র তাকে বলে ওয়াশিং ভার্স। এটাও ভাইকিং যুগের। শত্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন যোদ্ধা বলে উঠছে: I wash from me my enemies’ hatred, the greed and wrath of powerful men। ধরে নিতে পারি, এর সাথে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করার একটা রিচুয়াল ছিল। প্রার্থনাটির মূল উদ্দেশ্য নিজের মনস্তত্ত্বকে পরিষ্কার করা। যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, আর দৈনন্দিন জীবনেই হোক, যেন নিষ্কলুষ মনে প্রতিশোধপ্রবণতা পরিহার করে যেটা করণীয় সেটা করা যায়।

মের্সেবুর্গ চার্মগুলি অনন্য। তার কারণ, রোমের প্রভাবে ‘বর্বর’ থেকে ‘সভ্য’ জাতিতে পরিণত হবার সময় প্রাচীন জার্মানিক গোত্রগুলো তাদের পাগান ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়। সে প্রক্রিয়া কখনো শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, কখনো ক্রুসেডের মাধ্যমে সহিংসভাবে হয়েছে। ফলে আগের যে মন্ত্রগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলি সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মের্সেবুর্গ চার্মগুলি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মনাস্টেরিতে খ্রীষ্টানের ভেঁক ধরে থাকা পাগান বিশ্বাসীর কল্যাণে। সপ্তম-অষ্টম শতকে জার্মানিক জাতিগুলি এভাবে তাদের ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। একই অবস্থা হয় দশম শতকের ভাইকিংদের।

যেখানে ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য বেঁচেবর্তে থাকে সেটা উত্তর ভারত। বেদ আর এডার মধ্যে অনেক মিল। শুধু দেবদেবী আর মিথলজি নয়। থর হচ্ছেন বেদের ইন্দ্র, তার হাতের বজ্র থরের অস্ত্রের সমান্তরাল। ইত্যাদি অনেক মিল রয়েছে।

আরও এ গানটিতে যে মিল পাচ্ছি সেটা হলো অ্যালিটারেশন বা অনুপ্রাস। অর্থাৎ কাব্যের শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর দিয়ে মিল।

উদাহরণস্বরূপ, অথর্ববেদের রোহণী বনস্পতি সুক্ত, যেটা কিনা ঐ দ্বিতীয় মের্সেবুর্গ চার্মের মতই মাংসের সাথে মাংস লাগুক, চর্মের সাথে চর্ম ইত্যাকার মন্ত্রপাঠের পাশাপাশি ক্ষতে অরুন্ধতিচূর্ণ দিতে বলছে, তার কয়েক লাইন দিলাম:

“রোহণ্যসি রোহণ্যস্থচ্ছিন্নস্য রোহণী, রোহয়েদমরুন্ধতি
যৎ তে রিষ্টং যৎ তে দ্যুত্তমস্তি পেষ্ট্রং ত আত্মনি
ধাতা তদ্ ভদ্রয়া পুনঃ সং দধত্ পরুষা পরুঃ…”

আর ওল্ড নর্সে গাইছে:
Þann gel ek þér fyrstan,
– þann kveða fjölnýtan, þann gól Rindi Rani, –
at þú of öxl skjótir, því er þér atalt þykkir;
sjalfr leið þú sjalfan þik.

(থন গেল্ এক্ থের ফ্যুর্শটান,
থন ক্বেদা ফ্যিয়লন্যুতান, থন গোল রিন্দি রানি
অৎ থু ওফ অক্শল শ্যিয়তির, থ্বি এর থের অতল্ত থুক্কির;
শ্যিয়াল্ফর লেইদ থু শ্যিয়াল্ফান থিক…)
ইত্যাদি।

আমরা ছোটবেলায় শিশুতোষ ছড়াতে অ্যালিটারেশন প্রচুর করেছি। এটা ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্যে একটা কমন ব্যাপার। বিশেষ করে, বৈদিক সংস্কৃত, ওল্ড হাই জার্মান, ওল্ড নর্স, অ্যাংলোস্যাক্সন আর ওল্ড আইরিশ ভাষার সাহিত্যে বেশ ভালমতই ব্যবহার হত এই অলংকার।

গানটি শুনলে তাই মনে হয়ে বেদের কোন মন্ত্র আওড়ানো চলছে। আসলেই ভাইকিংরা এভাবে সুর করে মন্ত্র পড়ত কিনা, তা হয়ত ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন না, কারণ তাদের কোন লিখিত সঙ্গীত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাব্যিক অলংকরণের মিল থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, যে বৈদিক যজ্ঞ-মন্ত্রের সুর থেকে প্রাচীন জার্মানিক গোত্র আর পরবর্তী ভাইকিংরা খুব বেশি দূরে ছিল না।

আজকাল যে সামান্য পরিমাণ পাগানবিশ্বাসী মানুষ উত্তর ইউরোপে বাস করে, তারা তাই বৈদিক সংস্কৃতের অনুকরণেই মন্ত্রপাঠ করে। আর সেটাই এই গানটাতে ধরা পড়েছে।

কামার ও শয়তান – ২

(প্রথম পর্বের পর)

প্রস্তরযুগের মানুষের বিবর্তনের কথা বলেছি এর আগে। সেসাথে আগুনের আবিষ্কারের ফলাফল। আগুনের পরপরই সম্ভবত ধাতুকার্যের কাকতালীয় আবিষ্কার।

প্রস্তরযুগ আর তাম্রযুগের মাঝের যুগটাকে বলে ক্যালকোলিথিক। এসময় তামা মেশানো পাথর বা আকরিক দিয়ে অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি বানানো হত। হয়ত এরকম কোন আকরিক পাথর আগুনের কুন্ডলীতে ফেলার পর সেটা গলে পরিশুদ্ধ ধাতু হয়ে বেরোয়। ক্যাম্পফায়ারের তাপমাত্রা খুব বেশি নয়, হয়ত কোন বিশেষ ধরনের চুলোর মধ্যে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে এই আকস্মিক আবিষ্কারটি হয়।

আবিষ্কারটি প্রথম যারা করেছিল, তারা ওয়াকিবহাল ছিল এর তাৎপর্য সম্পর্কে। ধাতু পাথরের থেকে কয়েক গুণ বেশি শক্ত আর গলিত অবস্থায় বিভিন্ন আকার দেয়া যে যায় তাকে, তারা সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে কারণে যে খনি থেকে তামার আকরিক পেয়েছে, সেখানে তারা ফিরে গেছে আরো সংগ্রহের জন্যে। তারপর আরো গবেষণা করে জ্ঞানটাকে মোটামুটি পাকাপোক্ত করেছে।

আর এরা জ্ঞানটা গোপন রেখেছে অন্যান্যদের কাছ থেকে। ইন ফ্যাক্ট, এই প্রাচীন কামারদের কাছে এটা বিজ্ঞান নয়, প্রকৃত অর্থেই জাদুবিদ্যা ছিল। কারণ কখনো কখনো ঠিক তাপমাত্রায় চুল্লী গরম রাখতে না পারলে পুরো কাজটা যেত ভেস্তে। তাই মন্ত্রপাঠ আর দেবপূর্বপুরুষদের পূজোর দরকার হয়ে পড়ত বৈকি। আবার কখনো পশু কিংবা নরবলিরও!

এই যে তামা কিংবা তামার সাথে টিন মিশিয়ে আরো শক্ত ব্রোঞ্জ তৈরির প্রণালী, এর আবিষ্কার কমপক্ষে আট হাজার বছর আগে। ওয়েলসের ক্লানদুদনোতে ৪,০০০ বছরের পুরনো বিশাল এক তামার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখান থেকে উত্তোলিত তামা পুরো মধ্যোপসাগরে রপ্তানি হত। অর্থাৎ ইতিমধ্যে ধাতুর খনন কুটিরশিল্প থেকে বৃহদশিল্পে পরিণত হয়েছে। এরকম আরেকটা জায়গা বর্তমান সাইপ্রাস, যার নামের মধ্যেই রয়েছে ‘কপার’ (গ্রীকে ক্যুপ্রোস, তুর্কীতে কিবরিস)। প্রাচীন মিশর-তুরস্ক-গ্রীসের ব্রোঞ্জশিল্পের তামার আদি উৎস এই সাইপ্রাস।

ওয়েলসের ক্লানদুদনোর গ্রেট ওর্ম কপার মাইনস। ৪,০০০ বছর আগে এখানে খনিতে কাজ শুরু হয়। ম্যালাকাইট নামের আকরিক উত্তোলনের পন্থা ছিল পশুর হাড় আর পাথরের হাতুড়ি দিয়ে খনির দেয়াতে ক্রমাগত ঘা মারা।
সাইপ্রাসের স্কুরিওতিসার তামার খনি বিশ্বের প্রাচীনতম। ৪,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে এখনও পর্যন্ত এখানে তামা উত্তোলন চলছে।

ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের পরে কর্মকারদের সৃজনশীলতা তুঙ্গে ওঠে। খোদার ওপর খোদকারি করে নানা জন্তু-জানোয়ার, মানুষ, বস্তু, এমনকি দেবদেবীর নিখুঁত মূর্তি পর্যন্ত তারা বানিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে এ বিদ্যা জাদুটোনার থেকে কম কিছু ছিল না। শিকারী কিংবা কৃষকের কাছে খনির গভীর অন্ধকারে ঢুকে পাথর খোঁড়া ছিল রহস্যময় একটা ব্যাপার। সে ‘পাথর’ যে চুল্লীতে ঢুকে নতুন সৃষ্টি হয়ে বেরিয়ে আসছে, এটাও অলৌকিক শক্তির লক্ষণ। শয়তান বা অশুভ আত্মাকে যদি কেউ নাকানি-চুবানি দিতে পারে, তো সে এই ধূর্ত কামারই। ‘কর্মকার’ মানেও আসলে ‘স্রষ্টা’।

ব্রোঞ্জ আমলের কামারদের অবশ্য অনেক পেশাগত ঝুঁকি ছিল। তামা-টিনের খনিতে মিশ্রিত থাকে বিষাক্ত আর্সেনিক ও সীসা। এ বিষের সংস্পর্শে এসে শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য দেখা দিত তাদের। এ কারণেই হেফেস্টাস ল্যাংচা, পাগলা, বেঁটে। হয়ত আয়রিশ লোককথায় ডয়ার্ভস কিংবা বামনদের সাথে খনি ও ধাতুবিদ্যার রহস্য জড়িত এ কারণেই।

১৫৫০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে সোনার তৈরি মাস্ক অফ আগামেমনন। ট্রয়ের আবিষ্কর্তা হাইনরিষ শ্লীমান মাইসেনির ধ্বংসাবশেষে এটি খুঁজে পান। তিনি ভেবেছিলেন ইলিয়াডের আগামেমননের সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। ব্রোঞ্জ যুগের অসাধারণ ধাতবশিল্পের প্রমাণ এটি।

ব্রোঞ্জের পর লৌহযুগের শুরু হয় প্রায় ২,২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এ ছিল আরেক অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ ক্যাম্পফায়ারে ৪০০ ডিগ্রিরই বেশি তাপমাত্রা ওঠে না, আর লোহার গলনাংক ১,৪০০-১,৫০০ ডিগ্রি। অর্থাৎ লোহা গলানোর জন্যে দরকার হয়ে পড়ে বিশেষ ধরনের চুল্লি। তাছাড়া কাঠকয়লারও দরকার পড়ে আকরিককে পরিশুদ্ধ করার জন্যে। কখনো কখনো পশুর হাড়গোড়ও চুল্লিতে ফেলত কামাররা, এতে অর্গানিক কার্বন মিশে লোহাকে আরেকটু মজবুত করত। স্টীলের রহস্য ঠিক তাই। সাধারণ মানুষ অবশ্য এর উসিলায় ‌গুজব রটাত যে কামাররা চুল্লীতে নরবলি দেয়। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

ইতিহাসের সবচে পুরনো লোহার তৈরি অস্ত্র পাওয়া গেছে তুরস্কের প্রাক-হিট্টাইট হাট্টিয়ান কালচারে। এ অসম্ভব না যে, এদের উত্তরপূর্বের পন্টিক স্তেপের আদি ইন্দোইউরোপীয়রাই লোহা বিশুদ্ধকরণ প্রণালী প্রথম আবিষ্কার করে। মিশরে অবশ্য এর থেকেও পুরনো লোহার তৈরি ছুরি আবিষ্কৃত হয়েছে, তুতানখামুনের সমাধিতে। কিন্তু সেটা পৃথিবীর লোহা নয়, উল্কার লোহা! অর্থাৎ তার বিশুদ্ধিকরণের তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। মোটামুটি একটা উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়ে পিটলেই হলো।

১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে ব্রোঞ্জের তৈরি এই সূর্যরথ। সূর্যদেবতাকে প্রতি ভোরে ঘোড়ায় টানা এ রথ টেনে তোলে। ঋগ্বেদসহ সকল ইন্দো-ইউরোপীয় মিথে প্রায় একই মোটিফের ছড়াছড়ি।
৩৭০০-৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বে ককেশাসে মাইকপ কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জ দিয়ে এই ষাঁড়টি বানায়। পন্টিক স্তেপের ইন্দোইউরোপীয়দের সরাসরি দক্ষিণের পড়শী ছিল এরা। দু জাতের মধ্যে প্রযুক্তি আদানপ্রদান হওয়ারই কথা।
২৩০০-২০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আনাতোলিয়ার হাট্টিয়ান কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জে তৈরি করেছে এই জোড়া ষাঁড়।
১৭০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে তৈরি হয়েছিল ব্রোঞ্জের এই শিরোস্ত্রাণ।

লৌহযুগের আগমনের সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র বানানোতে একটা বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ভাল কামাররা তরবারি তৈরির প্রক্রিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব ‘অলৌকিক’ তরবারিকে নাম দিলে তার জাদুশক্তি আরো কয়েকগুণ বাড়ত। সেই থেকে আর্থারের এক্সক্যালিবার, রোলাঁর দ্যুরন্দাল, শার্লমেনের জোয়াইওজ, সিগুর্দের গ্রাম, বেওউল্ফের হ্রুনটিং, আলীর জুলফিকার, ইত্যাদি।

এদের সাথে যোগ করতে পারি বর্তমান যুগের ‘রূপকথা’ লর্ড অফ দ্য রিংসের দুটো ধাতব জিনিস। ওয়ান রিং — যার মধ্যে রয়েছে সারা বিশ্বের ক্ষমতালাভের শক্তি। আর নারসিল, যে তরবারি দিয়ে সাউরনের হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ইসিলদুর। ভেঙে যাওয়া নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি হয় নতুন তরবারি আন্দুরিল। আর ধাতুবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ গিমলির জাত ডয়ার্ফরা। তাদের আবাস পাহাড়ের গভীরের খনিশহরে।

তুতানখামুনের সমাধিতে পাওয়া মিটিওরিক আয়রনের তৈরি ছুরি, ১৩২৩ খ্রীষ্টপূর্ব, ব্রোঞ্জ যুগ চলছে তখনও।
শার্লমেনের তরবারি লা জোয়াইয়োজ। লেজেন্ডারি এই তরবারি নাকি আরো আদি রাজা রোলাঁর দ্যুরন্দালের ধাতু গলিয়ে তৈরি। ফরাসী রাজাদের রাজ্যাভিষেকে দ্বাদশ শতক থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
লর্ড অফ দ্য রিংসে ভেঙে যাওয়া তরবারি নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি এল্ফরা আরাগর্নের জন্যে তৈরি করে নতুন আরেক তরবারি আন্দুরিল।

যাক গে, রূপকথা থেকে বহু দূরে সরে এসেছি। কামার ও শয়তান রূপকথাটির একটা মোরাল বা নীতিকথা অবশ্য আছে। ফাউস্টের মত বিদ্বান ব্যক্তিরা, যারা কিনা কামারের উন্নত সংস্করণ, তারা নিজেদের আত্মা বিকিয়েছেন জাগতিক অলৌকিক ক্ষমতার বিনিময়ে। তারা বৈশ্বিক জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েছেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপরে।

কামারদের চরিত্রটাও অনেকটা সেরকম। খোদার ওপর খোদকারির ব্যাপারটা বলেছি। তাছাড়াও সোনা-রূপা ইত্যাদি ধাতুর জাগতিক মূল্যটাই খালি বুঝতে পারে কামার। এখানেই তার ট্র্যাজেডি। ধূর্ত শয়তানকে ঠকিয়ে ইহলোক সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে পরলোকে স্বর্গ-নরক কোথাও ঠাঁই হয় না জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের। এ কারণেই প্রাচীন গল্পটা পরবর্তীকালের খ্রীষ্টান ধর্মের লেজেন্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আজকে অবশ্য আমরা এত কিছু গবেষণা করে বের করতে পারছি কামারের মতই প্রযুক্তির ম্যাজিক খাঁটিয়ে। তেহরানি তার গবেষণায় যে খান পঞ্চাশেক ভাষার আড়াইশ’ রূপকথার প্রব্যাবিলিস্টিক অ্যানালিসিস করেছেন, তা সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বদৌলতে। ঊনবিংশ শতকের গ্রিমভ্রাতৃদ্বয় জার্মানিতে, আর বিংশ শতকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশে বছরের পর বছর গবেষণা করে যে সব ইন্দোইউরোপীয় রূপকথার কাহিনী একে অন্যের সাথে যুক্ত করেছেন, সে কাজটা কম্পিউটারের বদৌলতে এখন কয়েক সপ্তাহের না হলেও মাস দুয়েকের ব্যাপার। তাই বলতে পারি, জয় হোক কামারের হাতুড়ি-নেহাই-হাঁপর-চিমটের। আর প্রোগ্রামারের মাউস-কীবোর্ড-মনিটরের।

কামার ও শয়তান – ১

“… শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল যে বেচারার দমই ফেলা দায় । সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল— সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।

“কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিপে ধরল। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে হেইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রাবারের মত লম্বা হতে লাগল। … “

প্যারা দুটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘তিনটি বর’ নামে গল্প থেকে নেয়া। ছোটবেলায় তার সংকলিত দেশ-বিদেশের উপকথা নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ছিল। শয়তানের মত ধূর্ত বদ চরিত্রকেও যে ঢিঁট করা সম্ভব, সে গল্প পড়ে বেদম মজা পেয়েছিলাম।

এই গল্পটা নাকি কমপক্ষে ছয় হাজার বছরের পুরনো!

২০১৬ সালে গবেষক জামশেদ তেহরানি ও গ্রাসা দি সিলভা ফাইলোজেনেটিক অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের ভিত্তিতে রিসার্চ করে এ তথ্যটা আমাদের দিয়েছেন। তাদের বিচারে ইন্দোইউরোপীয় ভাষার জন্মের আদিকালে এ গল্পটি মুখে-মুখে প্রচলিত ছিল। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়া আর রাশিয়া থেকে শুরু করে আয়ারল্যান্ড অব্দি এটি নানা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে শ্রোতাদের কাছে। সে সময়ে বই দূরের কথা, লিখনপদ্ধতিরও আবিষ্কার হয়নি। কথক কিংবা বার্ড বলে একটি পেশা ছিল যাদের কাজ কেচ্ছা শুনিয়ে বেড়ানো।

ঊনবিংশ শতকের ইলাস্ট্রেশনে সেন্ট ডানস্ট্যান শয়তানের নাকটা চিমটে দিয়ে ধরে দিলেন এক টান, হেইয়ো…

গল্পটার সারবস্তু হলো শয়তান, মৃত্যু, জ্বীন কিংবা কোন অপদেবতার কাছ থেকে নিজের আত্মার বিনিময়ে কামার অলৌকিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়। তারপর সে ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়েই কূটকৌশল করে চুক্তি থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নেয়।

উপেন্দ্রকিশোরের গল্পটিতে অবশ্য কামার তিনটি বর পায় এক বৃদ্ধ মানুষের ছদ্মবেশধারী দেবতাকে সাহায্য করে। আর মৃত্যুর পর স্বর্গ-নরক কোথাও কামারের স্থান হয় না। শয়তান নরকের আগুন থেকে কাঠকয়লা ছুঁড়ে তাকে দূর করে দেয়। সেই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে জলায় জলায় সে ঘুরে বেড়ায়, আর তার আলো দেখা যায়। তাইই নাকি আলেয়া — জ্যাক ও’ল্যান্টার্ন। হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের উৎপত্তি এই রূপকথা থেকেই। ইংরেজী কাহিনীতে কামারের নাম জ্যাক। আবার অন্য কোন কাহিনীতে সে সেন্ট ডানস্ট্যান। ফ্রান্সে সেন্ট ডানস্ট্যান হয়ে গেছে স্যাঁত-এলোয়া।

হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টারনের উৎস স্মিথ অ্যান্ড দ্য ডেভিল নামে সুপ্রাচীন এক উপকথায়।

রাশিয়াতে কাহিনীটা একটু পরিবর্তিত। সেখানে কামারের সহকারী শয়তান, যে কিনা তাকে বিপদে ফেলে। গ্রীকদেরও প্রায় একইরকম গল্প আছে। চেক ভারশনে উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের মত স্টুলে শয়তানকে আটকে রাখে কামার। এর্রেমেন্তারি বলে একটা বাস্ক ভাষার ছবি দেখেছিলাম ক’দিন আগে নেটফ্লিক্সে, তার কাহিনীতেও শয়তানকে চালাকি করে নিজের কারখানায় নেহাইয়ের সাথে আটকে রেখে দিয়েছিল শ্মশ্রুমন্ডিত পাগলা কামার। আয়রিশ ভার্শনে কামারকে বর দেয় ফেইরি কুইন।

বাস্ক লোককাহিনীভিত্তিক মুভি এর্রেমেন্তারিতে শয়তানকে খাঁচায় পুরে রেখে দিয়েছে কামার।

প্রায় একই রকম গল্প জার্মানিতে প্রচলিত ছিল বিদ্বান ডক্টর ফাউস্টের নামে। শয়তানের কাছে নিজের জীবন বন্ধক রেখে নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াত মধ্যযুগীয় এ চরিত্র। পরে ক্রিস্টোফার মার্লো আর গ্যেটে ফাউস্টকে নিয়ে মেলোড্রামাটিক ক্লাসিকাল কাহিনী ফেঁদে বসেছেন। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় এসেও কাহিনীটির বিবর্তন শেষ হয়নি। আপালাচিয়ান পর্বতমালার মানুষ জনি দ্য ফিডলার নামে চেনে এই ধূর্ত কামারকে।

গ্রীক কামার দেবতা হেফেস্টাস তার কর্মশালায়, ক্লাসিকাল শিল্পীর কল্পনাতে।

কামারের ধূর্ততা আর কূটকৌশলের একটা তাৎপর্য যে আছে সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করতে চাই। শুধু যে লোককথায় আছে কামার তা নয়। বিভিন্ন প্রাচীন দেবদেবীর কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে কামার দেবতার পেশাভিত্তিক যে স্থান, সেটা আর কারো নেই। উদাহরণ, গ্রীক দেবতা হেফেস্টাস, আফ্রোদিতির স্বামী। মুখভর্তি দাঁড়ি, লেংচা, কুৎসিত। অথচ ধাতু নিয়ে সে অসাধারণ সব জিনিস বানিয়ে ফেলে। জিউসের বজ্র থেকে শুরু করে হার্মিসের শিরোস্ত্রাণ, একিলিসের বর্ম — এগুলি তারই বানানো। একটা রথও সে বানিয়ে ফেলে যা কিনা নিজ থেকেই সচল। অর্থাৎ হেফেস্টাস গ্রীক দেবতাদের টেক-গীক! ও হ্যাঁ, নিজের মা হেরাকেও চেয়ারে সেঁটে রাখার কৃতিত্ব তারই। এখানে শয়তানের জায়গা নিয়েছেন মাতৃজননী স্বয়ং।

গ্রীকদের হেফেস্টাসের মত রোমানদের ভাল্কান। দু’জনেরই কর্মশালা আগ্নেয়গিরির মধ্যে। যখন তারা কাজ শুরু করে সেখানে, তখন মাউন্ট এটনা থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়।

নর্স-জার্মানিক জাতিগোষ্ঠীদের কামার দেবতার নাম ওয়েল্যান্ড কিংবা ভলুন্ড। আইসল্যান্ডিক ভাষায় লেখা পোয়েটিক এডাতে তার গল্প রয়েছে। কেল্টিকদের গভন্যু। ফিনিশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় নয়, তারপরও তাদের জাতীয় কাহিনী কালেভালাতে ইলমারিনেন নামে এক কামার চরিত্র রয়েছে। জাদুর ধাতব জিনিসপাতি বা সাম্পো তৈরি করে সে — তামার জ্যান্ত ঘোড়া পর্যন্ত।

ফিনিশ-সোভিয়েত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘সাম্পো’তে কালেভালা কাহিনীর কামার ইলমারিনেন একটা ধাতব স্লেজ বানাচ্ছে।

ইরানী উপকথায় কাভে আহাঙ্গারানও কামার। অত্যাচারী রাজা জাহাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পারসিকদের মুক্ত করে সে। ককেশাসের ওসেটিয়াতেও রয়েছে কামারদেবতার উপকথা। আর বৈদিক যুগের ভারতের ত্বস্তৃ, পরবর্তীতে বিশ্বকর্মা নামে ব্রহ্মায় মিলিয়ে যান। জাপানেও রয়েছে আদি কামার আমাকুনি।

কেন্টাকির লেক্সিংটনে পুরনো বাড়ির চৌকাঠে হর্স শু ঝুলছে। এ কুসংস্কার আমেরিকায় এসেছে আইরিশদের সাথে।

শুধু এশিয়া আর ইউরোপ নয়, পশ্চিম আফ্রিকাতেও কামারদের আলাদা মর্যাদা। অনেকের ধারণা তারা জাদুকর। কোন কোন কালচারে কামার আর মেডিসিনম্যান একই ব্যক্তি। লোহা আর আগুনের কম্বিনেশন দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যাপারটাও মনে হয় কামার-ওঝাদের ঊর্বর মস্তিষ্কের ফল! হর্সশুও তাই অমঙ্গলনাশক। নাইজেরিয়ার দেবতা ওগুন কামারদেরই পৃষ্ঠপোষক।

অর্থাৎ, ইন জেনারেল, কামার পেশাটা ম্যাজিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, শুধু ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতিতেই নয়। কেন ও কিভাবে, এটাই জানতে চাই! হাজার হোক, টেকনলজিস্ট আর ইনজিনিয়াররা এ যুগের কামার, শুধু সেকালের সম্মানটা আর নাই!

(দ্বিতীয় খন্ডে সমাপ্য)

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!