বায়তুল মাকদিস – ৩

জুম্মার নামাজের পর ডোম অফ দ্য রকে যে অভিজ্ঞতা, রোববারে চীনা সহকর্মীদের সাথে তার থেকে ভিন্ন রকম। আজ বলি সে কথা, আর ইসলামের ভেতরে-বাইরে এই টেম্পল মাউন্টের কি ইতিহাস, কি তাৎপর্য, তার কিছুটা।

টেম্পল মাউন্ট নামটা পশ্চিমা বিশ্বে ডোম অফ দ্য রকের মতই ভাল চলে। মুসলিম বিশ্বে অবশ্য নামটা একটু সংবেদনশীল। কারণ এই “টেম্পল” মানে হল ইহুদীদের কিং সলোমনের পবিত্র টেম্পল। এর প্রাচীন অস্তিত্ব বায়তুল মোকাদ্দাসের নিচে। ইহুদীদের হাতে গোনা ফ্রিঞ্জ কিছু গ্রুপের এ ব্যাপারে অ্যানাক্রনিস্টিক দাবি রয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে অনতিভবিষ্যতে এখানে তৃতীয় আরেকটি টেম্পল প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্য মুসলিম বা আরবদের সামনে টেম্পল মাউন্ট শব্দটা ব্যবহার না করাটাই শ্রেয়।

মরোক্কো গেট বায়তুল মাকদিসের একমাত্র ফটক যেখানে অমুসলিমদের প্রবেশের অনুমতি আছে, তবে মেটাল ডিটেক্টর ও এক্সরে স্ক্যানের কড়া নিরাপত্তা

আগে বলেছি, অমুসলিমদের ঢোকার জন্যে কেবল একটি ফটক। বাব এল মাগরেব বা মরক্কো গেট নামের এ দরজায় পৌঁছতে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দক্ষিণ প্রবেশপথে গিয়ে লাইন করতে হয়। একটা ফুটব্রীজ ওয়েস্টার্ন ওয়ালের প্রাঙ্গনের ওপর দিয়ে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে গেটটির সাথে। মুসলিমদের জন্যে বরাদ্দ বাকি ১১টি প্রবেশপথের মত এ রাস্তায় ঢোকা সোজা নয়। ইসরাইলী পুলিশ এখানকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। সকল দর্শনার্থীর ব্যাগ-শরীর চেক হচ্ছে মেটাল ডিটেক্টর আর এক্স রে স্ক্রীনে। সূরা-দোয়া পড়ে পার পাবার উপায় নেই।

সকালে যখন মাউন্ট অফ অলিভস আর সিটি অফ ডেভিড একলা ঘুরছি, তখন নাকি চীনা সহকর্মীরা এখানে লাইন করেছিল। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হবার পর তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, বলা হয় এ মুহূর্তে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অবশ্যই জোহরের কারণে এই বিরতি। নামাজের সময়টা অমুসলিম পর্যটকদের উপস্থিতি কাম্য নয়। দুপুরের খাবারের পর আবার চীনারা ফিরে এসেছে, আমিও হোটেলে বিশ্রাম করে এসে ওদের সাথে যুক্ত হয়েছি।

মাথায় টুপি পরে খালি পায়ে বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছে ধর্মপ্রাণ ইহুদী, পুরো কম্পাউন্ডে এরা খালি পায়ে হাঁটে, কোনায় কোনায় গিয়ে প্রার্থনা করে

আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে দু’ তিনজন কিপ্পা আর প্রেয়ার শাল’পরা ধার্মিক ইহুদী। এদের পা খালি। পবিত্র ভূমিতে জুতা পরে ঢোকা তো বটেই, বেশির ভাগ ইহুদীদের জন্য এখানে ঢোকাটাই ধর্মে মানা। এদের আসার রাস্তা পর্যটকদের সাথেই। আর ভেতরে ঢুকতে পারলেও ইসলামী ওয়াকফের নির্দেশ অনুযায়ী ধর্মীয় পোশাক পরা কিংবা প্রার্থনা করা বারণ।

এসব ইহুদী তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। ইসরাইলের চীফ রাবিনেট থেকে এখানে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞার কারণ, সলোমনের টেম্পলে যে “হোলি অফ হোলিজ” ছিল তাতে প্রবেশের অধিকার সাধারণ ইহুদীদের আদিকালেই ছিল না। ছিল কেবলমাত্র প্রধান পুরোহিতের। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসসাধনের পর আর সে বাস্তবতা নেই, যদি না ঈশ্বর দৈববলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান।

গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে ইসলামী ওয়াকফের তদারকি। তারা চেক করছে দর্শনার্থীদের পোশাকআশাকের শালীনতা। পুরুষ যারা শর্টস পরেছে তাদের দেয়া হচ্ছে ধূসর রঙের লুংগির মত ক্যানভাসের আবরণ। সে লুংগির প্যাঁচে পড়ে গেল এক সহকর্মী। জেরুজালেমে ঢোকামাত্রই আমি বুঝেছি শর্টস পরলে কোথাও না কোথাও আটকে যাব, তাই বাঁচলাম। মেয়েদের মাথা ঢাকা না থাকলে গরমের মধ্যেই ওয়াকফ সদস্যরা তাদের পরতে দিচ্ছে হুডিসহ জোব্বা।

আমাদের মেয়াদ মোটে এক ঘন্টা। আশপাশেই নজরদারিতে রয়েছে ওয়াকফের লোকজন। ভেতরের প্রাঙ্গনে সাধারণ অনেক মুসল্লী প্রার্থনারত। তবে শুক্রবারের মত মানুষ নেই। মসজিদুল আকসার প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি গেলেই সেখানকার দ্বাররক্ষী বিপরীত পথ প্রদর্শন করছে। কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকতে দিলেও মসজিদুল আকসা আর ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঢোকার অনুমতি অমুসলিমদের নেই।

একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় আমাদের দিকে এগিয়ে এল এক আরব। কিছু টাকার বিনিময়ে ট্যুর গাইড হবার অফার করল। তিন চীনা সঙ্গী আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, লাগবে না, এ আমাদের গাইড। তাতে ভদ্রলোক রাগে গজগজ করতে এক ইউরোপীয় দলের দিকে চলে গেল। সে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! তার থেকে বেশি জানবে আরেক “ট্যুরিস্ট?” তার বেশভূষা দেখে অবশ্য অধ্যাপক বলে মনে হয় না। শুক্রবার জুম্মার পরে দেখেছি বহু প্রফেশনাল ট্যুর গাইড মুসলিমদেরকে ফিরিস্তি দিচ্ছে। ইনি তাদের মত নন।

ডোম অফ দ্য রকের চারপাশ দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলাম। ইহুদীদের “হোলি অফ হোলিজ” নাকি ছিল এখানেই, সাখরা পাথরের ওপর। এই “হোলি অফ হোলিজের” হিব্রু নাম “কোদেশ হা’কোদাশিম।” হিব্রু কোদেশ আর আরবী কুদ্দুস একই শব্দ — পবিত্র। রুহুল কুদ্দুস বা হোলি স্পিরিট শব্দটা প্রায় হুবহু হিব্রুতে তালমুদে রয়েছে — রুয়াখ কোদেশ। হোলি অফ হোলিজ বস্তুটি আসলে একটি পর্দাঘেরা জায়গা বা টেবার্নেকল। তার ভেতরে রাখা ছিল আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট। আর আর্কের ভেতর খোদার কাছ থেকে টেন কমান্ডমেন্টসের যে পাথরে খোদাই ট্যাবলেট মোজেস পেয়েছিলেন, সেগুলি রাখা ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলাইটদের দৈব সহায়তা দিত এই আর্ক।

চীফ রাবিনেটের মতে ডোম অফ দ্য রকের ভেতরেই যে কোদেশ হা’কোদাশিম ছিল তার শক্ত কোন প্রমাণ নেই। সেটি পুরো টেম্পল মাউন্টের যে কোন জায়গায় হতে পারে। অষ্টম/সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব থেকে শুরু করে বহু ধর্মের বহু শাসক এই কম্পাউন্ডের পরিবর্ধন, পরিমার্জন আর ধ্বংসসাধন করেছে। তাই এখন ঠিক করে বলার উপায় নেই কোথায় ছিল সে “কোদেশ হা’কোদাশিম।” সুতরাং পুরো কম্পাউন্ডে ইহুদীদের প্রবেশ না করাটাই নিরাপদ। একই কারণে যারা প্রবেশের সাহস করেছে তারা পুরো কম্পাউন্ডে হাঁটছে খালি পায়ে।

ফাউন্ডেশন রকটি নিয়ে আরো কিছু বিশ্বাস রয়েছে ইহুদীদের। এই পাথরটিকে ভিত্তি করেই নাকি ঈশ্বর বিশ্বজগতের সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। এ পাথরের ওপরই নাকি এব্রাহাম তার পুত্র আইজ্যাককে বলিদান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন অবশ্য এই টেম্পলের অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে ছিল মাউন্ট মোরিয়া বলে একটা উঁচু পাহাড়, আর এই সমতল পাথুরে প্ল্যাটো। আরো নানাবিধ তাৎপর্য আছে এ পাথরের।

ডেভিডের নেতৃত্বে কেনানাইটদের ওপর বিজয়ের মাধ্যমে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ পায় আদি ইসরায়েলাইট জনগোষ্ঠী। ডেভিডের পুত্র সলোমন এই মাউন্ট মোরিয়ার চূড়ায় তৈরি করেন প্রথম টেম্পল প্রাঙ্গন। সেখানে ঈশ্বর “ইয়াওয়ের” উদ্দেশ্যে পশু বলি হত, যেটা ছিল এব্রাহামের উত্তরাধিকার। মুসলিমরাও ঈদুল আযহার সময় সে ঐতিহ্য অনুসরণ করে।

যদিও ইহুদী মত অনুযায়ী সলোমনের টেম্পল এক হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি, অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের হিসাবে সেটি আসলে সপ্তম/অষ্টম খ্রীষ্টপূর্ব শতকের আগে নয়। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, সুলায়মান এ “মসজিদ” তৈরি করেন মানুষ, জ্বীন ও পশুপাখির দৈব সাহায্য নিয়ে। এখানেই তার সাথে সাক্ষাত করেন কুইন অফ শেবা “বিলকিস।” ইহুদী ধর্মের বিশ্বাসও একই।

সলোমনের ঐক্যবদ্ধ রাজ্য শীঘ্রই ইসরাইল ও জুদাহ রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৫৮৭/৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে দু’রাজ্যের স্বাধীনতাহরণ করে ব্যাবিলনের রাজা নেবুকাদনেসার। তার সেনাদল টেম্পলটি লুটপাটের পর ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ইহুদীদের বশ্যতা স্বীকার না করার এ ছিল প্রতিশোধ। ইহুদী ধর্মমতে খোদা ছাড়া আর কারো আনুগত্যপালন গর্হিত অপরাধ। জেরুজালেমের এলিটদের ধরে নির্বাসনে পাঠানো হয় ব্যাবিলনে — যার থেকে বনি এম’এর বাই দ্য রিভার্স অফ ব্যাবিলন গান।

সলোমনের টেম্পল ধ্বংসের সত্তর বছর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান আকিমেনিদ পারসিক সম্রাট দারিয়ুস। তিনি ইহুদীদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেন। একই সাথে ফিরিয়ে দেন নেবুকাদনেসারের সময় লুন্ঠনকৃত ধর্মীয় অনুষঙ্গের অধিকাংশ। আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট অবশ্য হারিয়ে যায়। দারিয়ুসের সাহায্যে পারসিক ইয়েহুদ প্রদেশে নতুন একটি টেম্পল পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় অ-ইহুদী জনগণের বিরোধিতার মুখে কয়েক বছর সে কাজ স্থগিত থাকে। সম্পূর্ণ হয় সম্রাট সাইরাস বা কুরুশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। অনেক ইহুদী বিবরণীতে তিনিই নাকি তাদের মেসিয়া, ত্রাতা। যীশুর আগেই তার আবির্ভাব।

অমুসলিম দর্শনার্থীদের ভালমত চোখে চোখে রাখে ওয়াকফ সদস্যরা। অন্তত দু’বার স্থানীয় আরবরা এসে কিছু প্রশ্ন করল। আমাদের দু’জনের হাতে যেহেতু বড় লেন্সের ক্যামেরা, তাদের জিজ্ঞাসা “বেরেস?” আমরা কেউ বুঝি না সে কি। “তিভি?” না, না আমরা টিভি নই, প্রাইভেট ছবি তুলছি, টুরিস্ট। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে কেটে পড়লেও সামান্য দূরে দূরেই থাকল। তখন আমার মাথায় লাইটবাল্ব জ্বলে উঠল! আরবী “বেরেস”, ইকুয়াল টু ইংরেজী “প্রেস!”

এক ঘন্টা ফুরোতে না ফুরোতেই ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে সকলকে বের করে দেবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল ওয়াকফের লোকজন। হয়ত আসরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসছে বলে। দ্রুতপদে হাঁটা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম সবচে কাছের গেটটা দিয়ে। এসে পড়লাম খ্রীষ্টান কোয়ার্টারের ভিয়া দোলোরোসার কাছে। হাতে আছে আরো ঘন্টা দুয়েক। তারপর অ্যালেক্সের “শ্কডা” ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে যাবে তেল আবিব এয়ারপোর্টে। এবারের মত যাত্রা হবে সাঙ্গ!

সেকেন্ড টেম্পল আর বায়তুল মোকাদ্দাসের বাকি কাহিনী শেষ করি। পারসিক সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল ইহুদীদের। এই সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড তাদের ইতিহাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময়েই তাদের অধিকাংশ ধর্মীয় দর্শন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। বলা ভাল, বাইরের বিশ্ব থেকে অন্যান্য বহু সংস্কৃতির ম্যাচিওর প্রডাক্টও তাদের ধর্মে ইন্টেগ্রেট হয়।

বিশেষত, এঞ্জেলস, ডেমনস, ডেভিল, প্রিন্স অফ ডার্কনেস, হেভেন-হেল — এসব বিশ্বাসগুলি মূলে অনেকটাই পারসিক জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ঈশ্বর ও শয়তানের ডাইকোটমি পরিষ্কারভাবে তৈরি হয় এ সময়ে। এখনো কিন্তু ইহুদী ও ইসলাম ধর্মে এ ব্যাপারে দার্শনিক বিতর্ক রয়েছে। শয়তান কি ফ্রী এজেন্ট? নাকি কেবল খোদার গূঢ় উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের আনফ্রী এজেন্ট? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে শয়তান আর জোরোয়াস্ত্রিয়ান আহরিমানের মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই। এ ব্যাপারে ডেড সী স্ক্রলসের প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য কোন সময় বলব।

পারসিকদের পতন হয় ম্যাসেডনের রাজা মহামতি আলেকজান্ডারের হাতে। লেভান্ট অঞ্চল নিয়ে তার উত্তরসূরী টলেমি ও সেলুকাসের মধ্যে রেষারেষিতে জয় পায় সিরিয়ার সেলুসিড রাজ্য (গ্রীকে সেলেফকোস)। তাদের শাসনামলে সেকেন্ড টেম্পলটিকে পরিণত করা হয় পৌত্তলিক মন্দিরে। ইহুদী ধর্ম ও হিব্রু ভাষায় প্রচুর গ্রীক প্রভাব ঢোকে। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন শহুরে হিব্রুভাষীরা গ্রীক আচার গ্রহণে বাধ্য হয়। যারা একটু বেশি ধার্মিক, তারা এসব থেকে দূরে সরে পূর্বে ডেড সী’র কাছে একরকম সন্ন্যাসব্রত নেয়। ম্যাকাবি-ফ্যারিসি-এসেন-“জীলট” ইত্যাদি গ্রুপ এদের মধ্যে পড়ে।

গ্রীক শাসনের অবসান ঘটায় বিদ্রোহী ম্যাকাবি হাসমনিয়ান বংশ। তবে ক্রমে তারা রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়। আর যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আশপাশ দিয়ে রাজা হন হেরড। রোমানদের মিত্র হেরডই সেকেন্ড টেম্পলের বিশাল সংস্কার করেন। প্রচুর কর আরোপের মাধ্যমে তিনি টেম্পলটির আঙ্গিনা আরো বাড়ান। সে যুগে এই টেম্পল ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ তীর্থস্থান। গ্রীকদের প্রভাব কাটিয়ে ইহুদীরা আবার আগের মত উপাসনা করে এখানে। পূণ্যলাভ ও পাপস্খলনের প্রত্যাশায় রোমান বিশ্ব থেকে জাহাজে করে অগণিত ইহুদী আসত। প্রচুর অর্থ খরচ করে রিচুয়াল বাথের পর কোরবানীর পশুসহ প্রবেশ করত টেম্পলে। তারপর পবিত্র পাথরের নিকটে কোরবানি করে তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হত পশুর রক্ত। হিব্রু আর আরবী ভাষায় “কোরবান” হুবহু একই শব্দ।

নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী যীশু খ্রীষ্টেরও পদধূলিধন্য এই টেম্পল। তবে সমসাময়িক ইহুদী রিচুয়ালগুলোকে সারশূন্য বলে সমালোচনা করেছেন তিনি। কিন্তু টেম্পলের পবিত্রতাকে অস্বীকার করেননি। এই সেকেন্ড টেম্পলের একটা প্রমাণ সাইজ মডেল রয়েছে ইসরায়েল মিউজিয়ামে, যার ছবি দিয়েছি।

সত্তর খ্রীষ্টাব্দে ইহুদীদের চলমান রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহকে নির্মূল করে জেরুজালেমের দখল নেয় রোমসম্রাট টাইটাসের সেনাদল। সেকেন্ড টেম্পলের প্রায় সম্পূর্ণ বিলোপসাধন করে তারা। দ্বিতীয় ও শেষবারের মত টেম্পলের ইহুদী ধর্মীয় পবিত্র অনুষঙ্গগুলি হরণ করে বিদেশী সৈন্যরা। তার মধ্যে ছিল টেম্পল মেনোরা — সাত শাখাবিশিষ্ট মোমবাতিদানি। ইহুদী রাজনৈতিক মানসের মূর্তমান প্রতীক ছিল এটি।

এরপর আর কখনো স্বদেশ ফিরে পায়নি ইহুদীরা — ১৯৪৮ পর্যন্ত (আসলে ঊনবিংশ শতক!)। রোমানরা জেরুজালেম থেকে তাদের বহিষ্কার করে। অনেকে মিশর-সিরিয়া-জর্দান-ইরাক-ইয়েমেনে গিয়ে বসতি গাঁড়ে। প্রায় সন্দেহাতীতভাবে এদের কিছু গোত্র আরবে অভিবাসী হয়, যাদের উল্লেখ আমরা হাদীসে পাই মদীনা বা ইয়াথরিব শহরের অধিবাসী হিসাবে।

ইহুদীদের উচ্ছেদের পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত টেম্পল মাউন্টের ওপর জুপিটারের মন্দির তৈরি করে রোমানরা। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতক নাগাদ সে মন্দিরও হয় ধূলিসাৎ, কারণ সম্রাট কনস্ট্যান্টিনের খ্রীষ্টধর্মগ্রহণ ও তার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। পুরো টেম্পল মাউন্ট হয় রোমানদের গার্বেজ ডাম্প। তবে অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদরা বর্তমান মসজিদুল আকসার নিচে একটি খ্রীষ্টান ব্যাসিলিকার আংশিক ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন। হতে পারে ঐ দক্ষিণাংশে খ্রীষ্টানরা টেম্পলের স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের তাৎক্ষণিক পরে ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন আরব সেনাদল জেরুজালেমে এসে অবরোধ বসায়, তখন জেরুজালেম ছিল খ্রীষ্টান শহর, ইহুদী নয়। তবে এর পূর্ববর্তী তিন দশকের মধ্যে দু’বার হাতবদল হয়েছে এ শহর। পারসিক সাসানী শাহেনশাহ বিজ্যান্টাইন “রোমের” বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় পেয়ে সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল নেয়। খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া। এই যুদ্ধের সুযোগে সিরিয়ার ইহুদী ট্রাইবগুলিও রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। জেরুজালেম পুনরুদ্ধার ছিল তাদের জন্য ধর্মীয় কর্তব্য। অবশ্য তাদেরকে খুব একটা কদর সাসানীরা করেনি।

এই সংঘাতের ব্যাপারটা কুরআনের সূরা রূমে আছে। সেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে এবং রোম আবার জয়ী হবে। ক্রমে তাই হয়, এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশাতেই জেরুজালেমসহ সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল ফিরে আসে বিজ্যান্টাইনদের হাতে। তবে সে বিজয় আসলে পরবর্তী আরেকটি বিজয়ের অগ্রদূত। শীঘ্রই জেরুজালেমের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় আরব বেদুইন সেনাদল। তাদের নমিনাল নেতা নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রা)।

বিজ্যান্টাইন সেনাদল ইতিমধ্যে জেরুজালেম থেকে কেটে পড়েছে। শহরের খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস বাদে সেখানে কোন কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি নেই। অবরুদ্ধ শহরের দরজা মুসলিমদের জন্যে খোলার অনুমতি দিলেন তিনি, শর্তসাপেক্ষে। ওমর (রা) কে ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছ থেকে আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে হবে। আরেক শর্ত, জেরুজালেমে নতুন দিগ্বিজয়ীদের সাথে ইহুদীরা প্রবেশ করতে পারবে না। এটি লিপিবদ্ধ আছে সমসাময়িক খ্রীষ্টান পর্যবেক্ষকদের বিবরণীতে।

অর্থাৎ খুব সম্ভবত সিরিয়া ও আরবের ইহুদীদেরও একাংশ মুসলিম আরবদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এটা অসম্ভব কিছু নয়। এমন সম্ভাবনা ইসলামের আদি ইতিহাস পড়লেও আঁচ করা যায়। জেরুজালেম থেকে রোমানদের বিতাড়িত ইহুদীদের প্রত্যাবর্তনের শতভাগ প্রণোদনা তো ছিলই, তাছাড়াও মদীনা সনদের মত দলিল থেকেও জানতে পারি ইসলামের আদি যুগ থেকেই ইহুদী ও পীপল অফ দ্য বুকএর সাথে মুসলিমদের মিত্রতার উদাহরণ। যদিও বর্তমান রীডিং অনুযায়ী সেসব মিত্রতা স্থায়ী হয়নি।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কৌতূহলপ্রদ কথা বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে একটি আদি ইসলামী মুদ্রা আছে। উমাইয়া শাসনামলের ইলিয়া প্রদেশ অর্থাৎ ফিলিস্তিন/জেরুজালেমে এটি মুদ্রিত। এর এক পিঠে আরবী কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর অপর পিঠে পাঁচ শাখার মোমবাতিদানি। সেটা দেখতে হুবহু মেনোরা — ইহুদী জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা নানাজন নানাভাবে দিয়েছেন। অন্যতম ব্যাখ্যা অবশ্যই ইসলামী জেরুজালেমে ইহুদীদের আংশিক পুনর্বাসনের একটা বড় সম্ভাবনা। হযরত ওমর (রা) নাকি আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদীদের “বহিষ্কার” করেছিলেন। সেটা সত্য নাকি তাদের স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল — সেটা সত্য? এর সরাসরি প্রমাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র বহু শতাব্দীর এডিট করা ইসলামী ইতিহাসের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

যা হোক, উমর (রা) জেরুজালেমে প্রবেশের পর টেম্পল মাউন্টে এসে বিজ্যান্টাইন “আস্তাকুঁড়ের” সন্ধান পান। সেই প্রাচীন পাথুরে প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ পাশে একটি মেকশিফট মসজিদ তৈরি করা হয়। যেটা আদি মসজিদুল আকসা। হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের সময়ে অবশ্যই এখানে সেসব স্থাপনা ছিল না। উমর (রা)এর মসজিদটি এখনো বর্তমান আল আকসার লাগোয়া একটি ভবনে ছিল বলা হচ্ছে। তবে নিশ্চয় অনেক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে সেটি। এই অস্থায়ী মসজিদের কথা গথিক বিশপ আর্কউল্ফের বিবরণীতেও রয়েছে। তবে তার ভ্রমণকাল মুয়াবিয়ার সময়।

আরেকটা প্রসঙ্গ টানি। উমরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে দুই সাহাবী সচেষ্ট ছিল। তাদের একজন ইহুদী থেকে ধর্মান্তরিত, আরেকজন খ্রীষ্টান থেকে — ইসলামী ইতিহাস মতে। এ দু ধর্ম অবশ্যই জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণলাভের জন্যে প্রতিযোগী ছিল। সম্ভবত এরা আসলে ধর্মান্তরিত ছিল না। ছিল বিজয়ী সেনাদলে শামিল “আহলাল কিতাব।” আবার ইহুদী ধর্মান্তরিত এক দল নাকি উপদেশ দিয়েছিল মক্কার কিবলামুখী মসজিদুল আকসাটি টেম্পল মাউন্টের দক্ষিণে প্রতিষ্ঠা না করে উত্তরে প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে যেটা হত, তা হল মক্কার কিবলার মাঝে পড়ে যেত ইসলামের প্রথম আঠারো মাসের কিবলা সেই পবিত্র পাথরটিও। ইহুদী প্রভাব বা সমব্যথিতা না থাকলে মদীনায় মক্কামুখী কিবলা হবার পরেও এ সুপারিশ কিভাবে সম্ভব?

উমর (রা) টেম্পল মাউন্টে নতুন স্থাপনা তৈরির নির্দেশ দেন। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠতে শুরু করে নতুন ধর্মের পবিত্র ধর্মালয়। প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়াবিয়া তার খেলাফতের বায়াত নেন মসজিদুল আকসার ভেতর। ততদিনে আরব বিশ্বে গৃহযুদ্ধ চলমান। প্রথমে আলীর সাথে তালহা-জুবায়ের-আয়েশা, খারেজী ও মুয়াবিয়ার সিরীয় সেনাবাহিনীর। তারপর কারবালার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদের বিরুদ্ধে আদি শিয়া, খারেজী ও ইবনে জুবায়েরের। ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত মক্কা ও মদীনার পবিত্র নগরীর দখল উমাইয়াদের হাতে ছিল না।

তবে সুফিয়ানী উমাইয়ারা নির্বংশ হবার পর শক্তভাবে রাজ্যের হাল ধরে মারওয়ানী খলীফারা। তাদের নেতা সুচতুর মারওয়ান ও তার পুত্র আব্দুল মালিক নিষ্ঠুরতার সাথে বিভিন্ন কোন্দলের সমাপ্তি ঘটান। বিজ্যান্টাইনদের উপঢৌকন পাঠিয়ে কিছুদিনের জন্য উত্তরের সীমান্ত নিরাপদ রাখেন। তারপর বিশ্বস্ত সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাহায্যে ইবনে জুবায়রের পাল্টা খেলাফতের ইতি ঘটান। মক্কার কা’বা শরীফ এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ত্রেবুশে নামক আদি আর্টিলারির আঘাতে। মক্কা অবরোধে ইবনে জুবায়েরের মৃত্যুর পর তিন পবিত্র নগরীর শাসক হন আব্দুল মালিক। পুরো ইসলামী বিশ্ব হয় আবার ঐক্যবদ্ধ।

বিজয়ের পর কা’বা শরীফ পুনর্নির্মাণের কাজটি সমাধা করেন আব্দুল মালিক। তবে তার আগেই মুয়াবিয়ার শুরু করা টেম্পল মাউন্ট পুনর্গঠনের জটিল কাজটি প্রায় সম্পূর্ণ করে আনেন তিনি। মক্কা-মদীনার দখল না থাকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈধতা পেতে এ কাজটি করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তার। মসজিদুল আকসার বর্তমান ভিত্তি ও কাঠামো আব্দুল মালিক ও তার পুত্র ওয়ালিদের অবদান।

আর ডোম অফ দ্য রক — কুব্বাত আস সাখরা — এটি ইসলামী স্থাপত্যকলায় একক স্থান অধিকার করলেও প্রাচীন বিশ্বে এমন স্থাপত্যের অন্য উদাহরণ রয়েছে। হয়ত সেসবের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয় আব্দুল মালিকের লেভ্যান্টাইন খ্রীষ্টান স্থপতিরা।

যেমন, জেরুজালেম ও বেথলেহেমের মধ্যে তীর্থযাত্রা চলত। সেই পুরনো রোমান পথের পাশেই ক’বছর আগে আবিষ্কৃত হয় একটি ধ্বংসাবশেষ। এটি চার্চ অফ দ্য ক্যাথিজমা। গর্ভধারী মেরী নাকি বেথলহেম থেকে জেরুজালেমে যাত্রাপথে এখানে একটি পাথরের ওপর খেঁজুর গাছের পাতা ধরে বসে বিশ্রাম নেন। সে পাথরটি আছে এখনো, তার চারপাশে দুই স্তরের চক্রাকার অ্যাম্বুলেটরি, বা হাঁটার রাস্তা। ভেতরের অ্যাম্বুলেটরি পাথর ঘিরে, আর বাইরেরটা অষ্টভূজাকার দেয়াল ধরে। অর্থাৎ হুবহু ডোম অফ দ্য রকের নকশা! কিন্তু এ চার্চটির অস্তিত্বকাল পঞ্চম খ্রীষ্টীয় শতক, অর্থাৎ আরব দিগ্বিজয়ের পূর্বে।

এ ছাড়াও প্রাক-খ্রীষ্টান পাগান কিছু টেম্পল ছিল সিরিয়ার দামেস্ক ও এডেসা শহরে। সেসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোন না কোন পবিত্র পাথর, যেগুলিকে দেবপ্রদত্ত বলে সম্মান করত স্থানীয় আরব ও আরামায়িক অখ্রীষ্টান গোত্রগুলো। অর্থাৎ সেসবেরও একটা অবচেতন স্মৃতি সম্ভবত রয়ে গেছে ডোম অফ দ্য রকের নকশায়। আর যাই হোক, ডোম অফ দ্য রকের পরিকল্পনা সাদামাটা মসজিদের নয়। হয়ত মক্কার কা’বার মতই একটি তীর্থস্থল তৈরির পরিকল্পনা ছিল আব্দুল মালিকের। পরবর্তী যুগের অনেক ইতিহাসবিদ দোষারোপ করে যে কিনি নাকি কা’বার জায়গায় ডোম অফ দ্য রককে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন। আসলে বোধহয় তা নয়। ধর্মপ্রাণ ও আলেম হিসাবে আব্দুল মালিকের খ্যাতি ছিল।

উমাইয়া বংশের পতনের পর আব্বাসী খলীফারা এই স্থাপনাগুলির ব্যাপক সংস্কার করেন। একজন এমনকি আব্দুল মালিকের নাম উঠিয়ে নিজের নাম বসিয়ে দেন নির্মাতা হিসাবে। আব্বাসীদের পরে কায়রোর ফাতিমী শিয়া রাজবংশ তিন পবিত্র স্থানের পৃষ্ঠপোষকতা করে। জেরুজালেমের খ্রীষ্টান বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারের ধ্বংসসাধনের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষিত হয়। এরপর জেরুজালেম দ্বিতীয়বারের মত খ্রীষ্টান শাসনে আসে। ক্রুসেডার রাজারা টেম্পল মাউন্টকে সলোমনের টেম্পল হিসাবে স্বীকার করে। ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঝোলায় যীশু, মেরি ও সেন্টদের আইকন, আর বাইবেলের পদাবলী। আরবী কোন নকশা বা লেখার ক্ষতিসাধন অবশ্য তারা করেনি। তবে ক্রুসেডাররা পবিত্র পাথরটি থেকে স্যুভনির হিসাবে খন্ড ভেঙে নিয়ে যাবার কারণে সে জায়গাটি ঘিরে দেয়া হয়। এই টেম্পলের নামেই তৈরি হয় অর্ডার অফ দ্য নাইটস টেম্পলার।

দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডারদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হন আইয়ুবী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুর্দী সেনাপতি সালাহ উদ্দীন। আইয়ুবীদের পর আসে মামলুক, তারপর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য। বহু শতকে বহু সংস্কার হয়। এখনো নতুন কোন সংস্কারের সময় পাথরের মেঝে ভাংলেই বেরিয় পড়ে আরো বহু শতাব্দীর পুরনো নিদর্শন।

ইহুদীদের পবিত্র টেম্পলই যে এখানে ছিল তার কি প্রমাণ? সলোমনের তৈরি প্রথম টেম্পলের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেটা সবচে আদি স্থাপনা। কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু সন্দেহের অতীত নয়। তবে সেকেন্ড টেম্পলের অগণিত নিদর্শন এখানে পাওয়া গেছে। ঊনবিংশ শতকে পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয় যাতে গ্রীক ভাষায় লিখিত সাবধানবাণী, এ সীমানার ভেতরে অ-ইহুদী কেউ প্রবেশ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এমন দুটি ফলক বা অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির তারিখ বৈজ্ঞানিক পন্থায় নিরূপিত হয়েছে রাজা হেরডের শাসানামলে।

মসজিদ আল আকসার দক্ষিণপশ্চিম পাশে কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে আবিষ্কৃত হয়েছে ইহুদীদের ব্যবহৃত গোসলখানা, আর টেম্পলের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনোর সিঁড়ি। দক্ষিণে রয়েছে পাথর তুলে বন্ধ করে দেয়া প্রাচীন হুলদা গেট। দক্ষিণ-পূর্বে সলোমন’স স্টেবল এলাকায় কয়েক বছর আগে ইসলামী ওয়াকফ মারওয়ানী মসজিদ তৈরি করতে গিয়ে বড়সড় খননকার্য চালায়। তার থেকে খোঁড়া পাথর-মাটির অবশেষ ফেলা হয় সীমানার ঠিক বাইরে। ইসরাইলী প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো সেই আবর্জনা ঘাঁটিয়ে চলেছেন। প্রজেক্টটির নাম টেম্পল মাউন্ট সিফটিং প্রজেক্ট। সেকেন্ড টেম্পল যুগের গিল্ডেড মোজাইক ফ্লোরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ড সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়েছে খ্রীষ্টান আমল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ইসলামী আমলেরও নিদর্শন।

জুয়িশ কোয়ার্টারে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে সেকেন্ড টেম্পলে ঢোকার জন্যে হেরডের তৈরি আর্চের ধ্বংসাবশেষ। আর ষাটের দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত মরক্কো কোয়ার্টার পরিষ্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওয়েস্টার্ন ওয়াল। সেটুকু জায়গাই এখন ইহুদীদের ক্ষুদ্র তীর্থস্থান। মোরিয়া পাহাড়ের এ অংশে পুরো কম্পাউন্ডের সাপোর্টিং ওয়াল চলে গেছে বেশ গভীরে। সন্দেহ নেই এটি হেরডের প্রতিষ্ঠিত সেকেন্ড টেম্পলেরই পাথুরে সীমানা। কাছেই রয়েছে বিতর্কিত সুড়ঙ্গপথ। ওয়েস্টার্ন ওয়ালেরই উত্তরাংশ পৌঁছানো যায় এ টানেলের মধ্য দিয়ে। এসব সুড়ঙ্গ মুসলিম কোয়ার্টারের নিচ দিয়ে গেছে। স্বভাবতই আরব-ইহুদী দাঙ্গার ইতিহাস আছে এই টানেল প্রজেক্ট নিয়ে।

বর্তমান যুগে ইসরাইল বিদ্বেষ যে পরিমাণে ব্যাপ্ত মুসলিম বিশ্বে, তেমনটা সব সময় আসলে ছিল না। আদি উমাইয়া আমলের কিছু উদাহরণ টেনেছি। একই ব্যাপার ইসলামের স্বর্ণযুগেও। ইসলামী স্বর্ণযুগ একাধারে ছিল ইহুদী স্বর্ণযুগ। ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রভৃতি মুসলিম মনীষীদের মত মুসা ইবনে মাইমুন, মুসা ইবনে নাহমান নামের ইহুদী মনীষীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অবশ্য মুসলিমদের সমপরিমাণ সম্মান আরব বিশ্বে তাদের সে সময়েও ছিল না। তারপরও দুটো সম্প্রদায় একে অপরের দর্শন ও ইতিহাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। মানুষের মাঝে বিভক্তি এখন প্রাচীন যুগের থেকেও প্রকট। যেটা দেখলাম, শুধু পশুপাখির মধ্যে সে বাছবিচার নেই। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সর্বত্র শান্তির কবুতর। তারা নির্বাধ বিচরণ করছে মসজিদুল আকসার ফাসাদেও, ডোম অফ দ্য রকের প্রাঙ্গনে। উড়ে চলে যাচ্ছে অনতিদূরে খ্রীষ্টান জগতের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারে। কোথাও বাঁধা নেই। নেই মেটাল ডিটেক্টর চেক, কিংবা সূরা পড়ার বালাই।

ঐশ্বরিক শান্তির পায়রা ডানা ছড়িয়ে মানুষকে কবে তার ছায়াতলে আনবে, শুধু সে প্রশ্নের উত্তর এখনো রয়ে গেছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বায়তুল মাকদিস – ২

জুম্মার নামাজের পর বায়তুল মুকাদ্দাসে নারী-পুরুষের আর কোন ভেদাভেদ নেই। কুব্বাত আস সাখরার “মহিলা” অংশে এসে ঢুকছে তীর্থযাত্রীর দল। মসজিদুল আকসার ভেতরেও মহিলাদের ঢোকার কোন বাঁধা নেই। ছবি উঠাচ্ছে সকলে। চলছে গাইডদের ধারাভাষ্য। ভিড় আছে কিন্তু গায়ে লাগালাগির মত নয়।

কুব্বাত আস সাখরার প্রবেশে এক মুরুব্বী শ্রেণীর মানুষ তদারকি করছে। জুতা খুলে ব্যাগে ভরে নিলাম। ভেতর থেকে বেরুচ্ছে মহিলা মুসল্লীর দল। কেউ কেউ তখনো ভেতরে প্রার্থনারত। তার মধ্যেই চলছে জনতার সমাগম।

বাইরে থেকে এই ডোম অফ দ্য রক দেখতে যতটা অসাধারণ, ভেতর থেকে আরো বেশি। এই কম্পাউন্ডের সবচে আদি স্থাপনা এই গম্বুজসহ আটকোনা দালান — যেটা ছিল প্রথম কিবলা, তার পার্শ্ববর্তী কুব্বাত আস সিলসিলা (ডোম অফ দ্য চেইন) আর দক্ষিণপশ্চিমের মসজিদুল আকসা।

এগুলি ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয় উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাকি সব তৈরি হয়েছে পরবর্তী মুসলিম ফাতিমী-মামলুক-আইয়ুবী-অটোমান প্রভৃতি বংশের শাসনামলে। একেকটি সময়ে যুক্ত হয়েছে নতুন-পুরনো বিশ্বাসের নানা লেজেন্ড, সাথে স্থাপনা।

ভবনগুলির ভিত্তি ও কাঠামো আদি উমাইয়া আমলের হলেও আদি অলংকরণ বিশেষ একটা অবশিষ্ট নেই। যেমন, সোনালী যে গম্বুজ দিয়ে সকলে এটিকে চেনে সেটির বয়স বেশি নয়, ষাটের দশকে জর্দানী কর্তৃপক্ষ সে সংস্কারটা করে। আগে সীসার আচ্ছাদন ছিল। বাইরের আটটি দেয়াল ও চারটি প্রবেশদ্বারে নানা রঙের আরাবেস্ক নকশা আর কুরআনের আয়াত লেখা।

ডোম অফ দ্য রকের একেকটি স্তম্ভ মার্বেলে তৈরি। দেয়ালের প্রায় সর্বত্র মার্বেলের ব্যবহার। মোজাইক টাইল দিয়ে তৈরি নকশা বসানো। স্তম্ভগুলি গ্রীক আয়োনিয়ান বা ডোরিক ধাঁচের। মোজাইক ও গ্রীক কলাম উভয়েই মূলে পশ্চিমা শিল্প। এর কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ের সময় এ এলাকার অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বণিক, স্থপতি ও শিল্পীরা সকলেই ছিল বিজ্যান্টাইন ঐতিহ্যের অনুসারী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। যাযাবর আরব মুসলিমদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আব্বাসী খিলাফতের আগ পর্যন্ত ধর্মান্তরকরণের খুব একটা ইনসেন্টিভ ছিল না।

ডোমের ভেতরেও ইসলামী শৈল্পিক কারুকার্য ভর্তি সর্বত্র। এখানেও বিজ্যান্টাইন প্রভাব চোখে পড়ার মত। বিশেষত, রঙীন কাঁচে তৈরি জানালা, যেগুলি এখনো প্রাচ্য-প্রতীচ্যের গথিক ঘরানার চার্চগুলিতে দেখা যায়, শুধু সেসবে যীশু-মেরীর অবয়বঅংকিত। ডোমের ভেতরে দুটো চক্র, একটা বাইরের অষ্টভূজ দেয়াল ধরে, আরেকটা চার কলামের মাঝে স্থাপিত সাখরা পাথর ঘিরে। গম্বুজটি ঠিক সাখরার ওপর। কোন দেয়াল ফাঁকা নেই, সব জায়গায় নীল-সোনালী, লাল-সবুজ-সোনালী অলংকরণ। কোথাও ভাসের চিত্র, কোথাও লতানো গাছ, কোথাও অ্যাবস্ট্রাক্ট আরাবেস্ক। তার মাঝে কনট্রাস্ট উজ্জ্বল রঙের স্টেইনড গ্লাসের জানালা।

কোন কোন কলামের নিচে কুরআনভর্তী বুকশেল্ফ। ধার করে পড়ার জন্য এমন প্রার্থনাপুস্তক দেখেছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনেও, আর তার লাগোয়া সিনাগগে। গম্বুজের ঠিক নিচে ভেতরের সার্কলে আধুনিক আরবী ক্যালিগ্রাফিতে আয়াতুল কুরসি লেখা। আর বাইরের অষ্টভূজের ভেতর অংকিত সার্কলে প্রাচীন কুফী হরফে প্রতিষ্ঠাতা-প্রতিষ্ঠাসাল এগুলি লেখা। এই লেখাটি একেবারে আদি সময়ের। কুফী হরফে যের-যবর-পেশ যেমন নেই, নেই নুক্তাও। কালিমার পাশাপাশি কুরআনের কয়েকটি আয়াত একটু আনকনভেনশনাল উপায়ে জোড়াতালি লাগিয়ে একটি মেসেজ দেয়া হয়েছে। বর্তমান যুগে এমন জোড়াতালি লাগানোটা সম্ভবত মূলধারা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মালিকের নামটিকে বিকৃত করে অবশ্য আব্বাসী খলিফা আল মামুন নিজের নাম বসিয়েছিলেন। কিন্তু তারিখটা পরিবর্তন করেননি। আব্দুল মালিক কুরআনের যে সকল আয়াত বেঁছে এখানে বসিয়েছেন, তার মূল কথা কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট বা হযরত ঈসা (আ) কে নিয়ে। সে অনুযায়ী যীশু কেবল মর্ত্যলোকের মানুষই ছিলেন, একক খোদার বাণী নিয়ে এসেছিলেন। খোদা এক, তার অন্য কোন রূপ নেই প্রভৃতি। নির্দ্বিধায় বলা যায় এ মেসেজটা তখনকার খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস খন্ডনের জন্যে। আর একই সাথে ইসলামে ঈসা (আ) এর পাকাপোক্ত সম্মানের আসনটি দেখানোর জন্যে। সে আমলে কিন্তু মুসলিমদের মত আরো একটি খ্রীষ্টান গ্রুপ ছিল যাদের যীশু সম্পর্কে ধর্মীয় দর্শন প্রায় এক ছিল। এদের নাম মনোফিজাইট, যীশুর একটিমাত্র রূপেই যারা বিশ্বাস করে।

পাথরটির পাশে একটি টংয়ের মত জায়গা, তাতে হাত ঢোকানোর একটা ফোঁকর। সেখানে হাত ঢুকিয়ে পাথরটি স্পর্শ করা যায়। হয়তবা বহু শতকের কোটি কোটি হস্তস্পর্শ পড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল আকারের ছাঁপ। যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, লেজেন্ড অনুযায়ী এ ছাঁপটি নাকি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পায়ের ছাঁপ, স্বর্গারোহণের সময় এখানে পদচিহ্ন ফেলে যান। আবার অনেকে বলছে ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) এর হাতের ছাঁপ, পাথরটি মুহাম্মদ (সা) কে অনুসরণ করে উপরে উঠে যাচ্ছিল বলে নাকি সেটা ধরে থামিয়ে দেন। এসব অবশ্য মূলধারার বিশ্বাসে নেই।

পাথরটি উপরে উঠে যাবার কারণেই নাকি তার ঠিক নিচে একটি ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। সে গুহাটি এখনো বিদ্যমান। এর নাম “ওয়েল অফ সোলস।” পৃথিবীর অন্তিমকালে নাকি এখানে এসে জড়ো হবে সকল মৃতদের আত্মা। একটা সিঁড়ি বেয়ে সেই গুহার ভেতরে গেলাম। পুরুষ-মহিলাদের জন্যে আলাদা করে নামাজ পড়ার জায়গা সেখানে। স্বল্প জায়গার মধ্যে নামাজ কিংবা কোরআন পড়ছে অনেকে। স্বভাবতই আধভূঁতুড়ে আধ্যাত্মিক একটা আবহাওয়া।

ডোম অফ দ্য রক থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে কয়েকশ গজ হেঁটে পৌঁছলাম মসজিদুল আকসায়। মসজিদটির গম্বুজ রূপালী রঙের। এর ভিত্তি আর কাঠামো আদি যুগের হলেও এর কলাম, বাইরের ফাসাদ, ভেতরের কারুকার্য আরেকটু আধুনিক। বিশেষ করে ফাসাদের স্থাপত্য মধ্যযুগীয় ফাতিমী শৈলীর সাথে মেলে, অনেকটা ইউরোপীয় গথিকের মত। মসজিদের ভেতরটাও অসম্ভব সুন্দরভাবে অলংকৃত, অটোমান প্রভাব দৃশ্যমান। এখানে বলে রাখা ভাল, জেরুজালেমে খ্রীষ্টান ধর্মালয়গুলিতেও এমন অলংকরণের ঐশ্বর্য আছে। কিন্তু সে তুলনায় সিনাগগ আর ইহুদী তীর্থস্থানগুলি বেশ সাদামাটা।

এই দুই বড় ভবনের পর সবচেয়ে বড় স্থাপনাটি হচ্ছে কুব্বাত আস সিলসিলা। ডোম অফ চেইনস। এটিও আব্দুল মালিকের তৈরি। ডোম অফ দ্য রকের ছোট প্রোটোটাইপ ভার্শন বলা চলে একে। এর তাৎপর্য ঠিকমত জানা নেই। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনী অনুযায়ী নাকি এখানে একটি চেইন ঝোলানো ছিল, যেটা দৈব প্রক্রিয়ায় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর তফাত করতে পারত। কিং ডেভিড বা দাউদ (আ) সেটিকে ব্যবহার করে ন্যায্য রায় দিতেন। পরে ঘটনাচক্রে সেটি স্বর্গে ফিরে যায়।

আব্দুল মালিক এই চেইনের ব্যাপারটাকে হয়ত একটু ব্যবহার করতে চেয়েছেন নিজ শাসনকে বৈধতা দিতে। ইসলামের সে সংঘাতময় সময়ে তার বিপরীতে খলীফা ছিলেন আরো দু তিনজন, মক্কা-মদীনার দখল তার হাতে ছিল না। জেরুজালেমের দাউদ-সুলায়মানের লেগ্যাসি দাবি করে তিনি স্বরাজ্যের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করেন। এক ছেলের নামও রাখেন সুলায়মান। হয়ত বাব আস সিলসিলা আর কুব্বাত আস সিলসিলার চেইনের ব্যাপারটা ডেভিড-সলোমনের বংশপরম্পরার ধারাবাহিকতা দাবি করার গূঢ় উদ্দেশ্য।

এছাড়া রয়েছে ডোম অফ দ্য অ্যাসেনশন, কুব্বাত আল মি’রাজ। মক্কা থেকে জেরুজালেমে ইসরার যাত্রাশেষে বুরাককে নাকি এখানে বেঁধে রাখেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। কিন্তু এই স্থাপনাটি সম্ভবত আব্দুল মালিকের তৈরি নয়। আরো আছে ডোম অফ দ্য প্রফেট, কুব্বাত আন নাবী। স্বর্গে আরোহণের আগে নাকি এখানে পূর্বের সকল নবী আর ফেরেশতাদের জামাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা)। আরো আছে কুব্বাত আস সুলায়মান, কুব্বাত আল মুসা, কুব্বাত আল খাদর, কুব্বাত আল ইউসুফ প্রভৃতি নানা ছোট খাঁট গম্বুজ। একেকটির একেক ধর্মীয় তাৎপর্য। সবগুলি যে অথেনটিক তা কিন্তু নয়। একেক যুগের ইসলামী শাসক নিজেদের লেগ্যাসি লেজিটিমেসি দাঁড়া করাবার জন্যে এগুলি তৈরি করেছেন।

কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের বাইরেও বেশ কিছু বড় ভবন, মিনার ও গেট আছে। এগুলিরও রয়েছে বলা না-বলা ইতিহাস। তখতে সুলায়মান বলে একটি ভবনে নাকি সুলায়মানের সিংহাসন সংরক্ষিত। সেটি বন্ধ থাকায় দেখা হল না। মসজিদুল আকসার লাগোয়া ইসলামী জাদুঘরটিও বন্ধ। তবে সেসবের কাছে বিশাল প্রাঙ্গণে কিছুদূর পর পর বিশাল সব প্রাচীন স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ রাখা। বিভিন্ন যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের অভাব নেই। নতুন কনস্ট্রাকশনের সময় এখানে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে সেকেন্ড টেম্পল থেকে শুরু করে অটোমান তুর্কী শাসনামল পর্যন্ত ব্যাপ্ত প্রত্ননিদর্শন। বিশেষ করে স্টেবল অফ সলোমন বলে উত্তর পূর্বের একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের ব্লক দিয়ে ভর্তি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্যে এ জায়গাটা রীতিমত সোনার খনি।

আজ শেষ করি একটা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়ে। কুরআনে একটা সূরা আছে, আত ত্বীন। ওয়াত্বীনি ওয়াজ জাইতুন, ওয়া তূরে সীনিন। সূরার শুরু কসম কেটে, মানে সাক্ষী রেখে। সাক্ষী ডুমুর ফল, জলপাই ফল, সিনাই পর্বত, ও এই পবিত্র শহর (তফসিরকারীরা বলছেন মক্কা)। কিসের সাক্ষী? তারা সাক্ষী যে মানুষকে তৈরি করা হয়েছে সর্বোত্তম রূপে, কিন্তু তাতে দোজখের আগুন থেকে তাদের রেহাই নেই, শুধু তারা বাদে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আর উত্তম কাজ করে। তাদের জন্যে রয়েছে সর্বোচ্চ পুরস্কার। শেষ বিচারের দিন অস্বীকারের স্পর্ধা কে রাখে? আল্লাহ কি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?

মক্কা-মদীনা শহরের আশপাশে কিন্তু একটাও ডুমুর কিংবা জলপাই গাছ খুঁজে পাবেন না। সেটা পাবেন এ জেরুজালেম শহরে (আর জর্দান-সিরিয়ায়)। এই হারাম আল শরীফের জায়গায় জায়গায় জলপাই গাছ। জলপাই মধ্যোপসাগরীয় অঞ্চলের স্টেপল। গ্রীক প্যাগান ধর্মেও অলিভ পবিত্র ফল। গ্রীক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের খাওয়া মানেই জলপাই, মক্কার খেঁজুর নয়। জেরুজালেমের নানা জায়গায় দেখা মেলে এ গাছের। ডোম অফ দ্য রকের বিপরীতে ইহুদী সমাধিক্ষেত্র মাউন্ট অফ অলিভসও ভর্তি সে গাছে।

আমার মনে তাই প্রশ্ন, হাজাল বালাদিল আমিন, “এ পবিত্র শহর” বলতে কি আসলে মক্কা বোঝানো হয়েছে? সেটি আসলে জেরুজালেম হবার সম্ভাবনা বেশি নয় কি?

বায়তুল মাকদিস – ১

জেরুজালেমে বৃহস্পতিবার রাতে এসে পৌঁছালাম। আগের থেকেই ইচ্ছে ছিল জুম্মার নামাজটা পড়ব বায়তুল মুকাদ্দিস প্রাঙ্গণে। চীনা সহকর্মীদেরও আগ থেকে বলে রেখেছি শুক্রবার দুপুরে তাদের সাথে হয়ত থাকতে পারব না। মনে অবশ্য খুঁতখুঁতানি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে। এখানে বড়সড় গোলমাল বেঁধেছিল এপ্রিল মাসে।

লিওনার্দো বুটিক নামের যে হোটেলে আমরা থাকছি, সেটি ফাত্তাল গ্রুপের পরিচালিত। এই চেইনের মালিক ইরাকী বংশোদ্ভূত। রিসেপশনে কাজ করছে এক যুগল। দাঁড়িওয়ালা যুবকটির নেমট্যাগে লেখা “হাসান আয়ন” — আয়ন সম্ভবত আসলে আইয়ুন। আর মেয়েটির নাম “কমার”, আরবী অর্থ চাঁদ। দুজনে অবশ্যই আরব। কিন্তু এদের অধিকাংশ গেস্ট মাথায় কিপ্পাপরা ধার্মিক ইহুদী, এসেছে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের “মোনাজাতে” অংশ নিতে।

রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে রিসেপশনে পেলাম কেবল কমারকে। তার থেকে উপদেশ নিলাম কিভাবে আল-আকসায় নামাজ পড়তে পারি, জানালাম চীনা সঙ্গীদেরও শখ তারা যেতে চায়। চীনাদের ব্যাপারে কমার তেমন আগ্রহ দেখানো না। বলল, যদি মুসলিম হও তাহলে তো তোমার যাওয়া অত্যাবশ্যক। অমুসলিমদের ঢোকার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করো না। জুম্মার জামাতে লাখ খানেক মানুষ হয়। সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ সময়।

পরদিন সকালে ইসরাইল মিউজিয়াম হয়ে দুপুরে ডোম অফ দ্য রকে যেতে যে দুই উবার/ট্যাক্সি চালক পেলাম, তারা উভয়েই ফিলিস্তিনী আরব। প্রথমজন বলল, চীনারা আজ ঢুকতে পারবে না, কালও নয়। অমুসলিমদের গেট আলাদা, সেটার নিয়ন্ত্রণে ইসরাইলী পুলিশ। শুক্র-শনি তারা ছুটিতে। যদি তোমাদের কাজ দু’ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, আমিই তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। আমিও যাচ্ছি জুম্মার জামাতে। যেহেতু ‌অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি ডাকছি, তাই ফিরতি পথে আর একে পেলাম না।

ইসরাইল মিউজিয়ামের বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ দেখতে হল বেশ তাড়াহুড়ো করে। এসব ব্যাপারে সঙ্গীরা আমার কৌতূহল শতভাগ শেয়ার করে না। ফিরতি ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিল ওল্ড জেরুজালেম শহরের জাফা গেটের কাছে। চীনারা গেল দুপুরের খাওয়া সারতে। আমি জোর কদমে সোজা হাঁটা দিলাম বায়তুল মোকাদ্দিসের দিকে। প্রাচীন অলিগলি বেয়ে হাঁটাপথে সঙ্গী আরো অসংখ্য আরব নারী-শিশু-পুরুষ। সকলের গন্তব্য এক।

বায়তুল মুকাদ্দিসের বাব-আল সিলসিলা বা চেইন গেটের কাছে ইসরাইলী পুলিশের একটা ছোটখাট দল, গেট থেকে সামান্য দূরত্বে। এরা কিছু চেক করছে না। গেটে বসে আছে ফিলিস্তিনী/জর্দানী ইসলামী ওয়াকফের পান্ডারা। এরা যাকে ইচ্ছে হয় থামাচ্ছে। আমাকেও থামালো, কারণটা অবশ্যই আমার অনারব চেহারা। প্রশ্ন, আর ইউ মুসলিম। হ্যাঁ উত্তরের বিপরীতে নির্দেশ কুরআন থেকে কিছু মুখস্থ শোনাতে। ছোটবেলা থেকে যেটার চর্চা রয়েছে সেটা তো আমার জন্য জলবৎ তরলং! বুকে হাত রেখে চোস্ত উচ্চারণে ফাতিহার অর্ধেক শুনাতে না শুনাতে হাসতে হাসতে যাও যাও বলে পার করে দিল রক্ষী। এই ইসলামী ওয়াকফ জর্দানী সরকারকর্তৃক নিযুক্ত, পুরো কম্পাউন্ডের প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপালন করে এরা। ইসরাইলী পুলিশ গেটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে, সার্বিক নিরাপত্তার দেখভাল করে।

বাব আল সিলসিলা

দক্ষিণের দোর থেকে ডোম অফ দ্য রক প্রথমবারের মত কাছে থেকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। এই পবিত্রভূমি নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত যুদ্ধ, রক্তপাত। ভেতরে ঢুকে ওজুর স্থানের দিকে যেতে আবার গেট থেকে আরেক পান্ডা এল দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নিতে। পরীক্ষায় পাশ করার কিছু পরে এক দশ-বারো বছরের ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, হয়ের ইউ ফ্রম! উত্তরে বললাম, আমেরিকা। এমন অনিশ্চয়তার জায়গায় আমেরিকার নাগরিকত্ব আর পাসপোর্টই হয়ত সবচে বেশি নিরাপত্তা দেবে। তবে হয়তবা এ ক্ষেত্রে ভুল করেছি। পরবর্তীতে জেরুজালেমের পুরনো শহরে যেসব আরব দোকানে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়েছি, তারা বেশি সমাদর করেছে। তারা বাংলাদেশী পর্যটক কালেভদ্রে পায়ও বটে।

ছেলেটি প্রায় আধা ঘন্টা আমার আশপাশে ঘুরঘুর করল। বেশিরভাগ মানুষ যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছায়ার মধ্যে বসেছে সেখানে আমি অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে মাস্তাবার ওপর বসেছি। কড়া রোদে। তাতেও ছেলেটি পাশ ছাড়ছে না। হয়ত মুরুব্বীদের থেকে নির্দেশ আছে বিদেশীকে চোখে চোখে রাখার জন্য, নয়ত ভালমন্দের খোঁজ নেবার জন্য। একবার বোতলের পানিও সাধল।

মসজিদে প্রবেশের দুখলুল মসজিদ নামাজ আদায় করে অবশ্য আমি এই ফেঁউকে ছাড়িয়ে কেটে পড়লাম। খুতবা চলছে একাধিক মাইকে। তার মাঝেই মানুষজন বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। ভিড়ে মিশে হেঁটে চলে গেলাম মসজিদুল আকসার সামনাসামনি। ‌

অনেকে হয়ত জানেন যে বায়তুল মুকাদ্দিস কম্পাউন্ডটি বিশাল এবং এখানে একাধিক ছোটখাট স্থাপনা। পুরো ওল্ড জেরুজালেম শহরের এক তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে এ কম্পাউন্ড। এর ভেতর কেবল দুটি চালু মসজিদ। একটি পশ্চিম ধারে অবস্থিত মসজিদুল আকসা, যেখানে মি’রাজের পর হযরত মুহাম্মদ (সা) অন্যান্য সকল নবীর সাথে নামাজে ইমামতি করেছিলেন বলে মুসলিমদের বিশ্বাস। আরেকটি তার থেকে কিছু দূরে মারওয়ানি মসজিদ। আল-আকসা শব্দের আক্ষরিক অর্থ দূরবর্তী স্থান। সে স্থানটি যে জেরুজালেমই, তার সরাসরি প্রমাণ কিন্তু কুরআনে নেই। তফসীরকারকরা অন্যান্য তথ্যের যোগসাজশে সেটা বলেছেন।

কম্পাউন্ডের কেন্দ্রে যে ডোম অফ দ্য রক নামে সোনালী গম্বুজের স্থাপনা, সেটি কিন্তু আদতে মসজিদ নয়। আরবীতে কুব্বাত আস-সাখরা নামের অসম্ভব সুন্দর অলংকৃত আটকোনা এই দালানটির মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল পাথর (সাখরা, ফাউন্ডেশন স্টোন), যেটির ওপর থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের যাত্রা শুরু। এ ভবনের স্থাপত্যশৈলী মসজিদের নয়, এ ব্যাপারে পরে বলছি।

জুম্মার সময় যেহেতু মানুষ বেশি হয়, মসজিদুল আকসার ভেতর সকলের ঠাঁই মেলে না। কম্পাউন্ডের ভেতরে নানা জায়গায় পাথরের উঁচু মঞ্চ বা মাস্তাবা করে দেয়া আছে, সেগুলি ব্যবহৃত হয়। মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ ডোম অফ দ্য রকের পুরো উঁচু প্ল্যাটফর্মটা।

মসজিদ উল আকসা ফাসাদ
কুব্বাত আস সাখরা থেকে দেখা মসজিদ উল আকসা
কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক

জামাত ভাঙার পর আরো বহু মানুষের সাথে আমিও ঘুরে ঘুরে দেখলাম কুব্বাত-আস সাখরা আর মসজিদুল আকসার ভেতরটা। বাইরের আর ভেতরের প্ল্যাটফর্মের কোন অংশই বাদ রাখলাম না। নামাজের পর মসজিদের ভেতরে অনেক মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। হয় বাইরের গরম থেকে বাঁচতে, নয়ত পবিত্র মসজিদের ভেতর যদি কোন স্বপ্নদর্শন হয় সে প্রত্যাশায়। বাইরের কম্পাউন্ডে তখন কিশোর-যুবাবয়সীরা ফুটবল খেলে। আরব সংস্কৃতিতে মসজিদ আসলে কম্যুনিটি সেন্টার। সকল প্রকার সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকান্ড সেখানে চলে। আর কম্পাউন্ডের ভেতরে একটা জায়গায় কেবল সশস্ত্র ইসরাইলী পুলিশ রয়েছে, চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ইথিওপিয়ান যেমন রয়েছে, তেমন আছে প্রাচ্যের আরব চেহারা। সম্ভবত ইয়েমেন বা ইরাকের মিজরাহী ঐতিহ্যের ইসরাইলী এরা।

কম্পাউন্ড ঘুরে দেখার সময়েই খেয়াল করলাম মসজিদুল আকসা ও কুব্বাত আস-সাখরার ভেতরে-বাইরে গাইডসহ অসংখ্য বিদেশী পর্যটক গ্রুপ। এরা সকলেই মুসলিম দেশ থেকে এসেছে। তুর্কী, জার্মান, ঊর্দু-হিন্দী, সোমালি প্রভৃতি নানা ভাষার সমাহার। কোন দল বেশি হুজুর টাইপ, ছেলেরা পরেছে জোব্বা, মেয়েদের চেহারাসহ আপাদমস্তক আবৃত। আর ইউরোপীয় যারা তাদের বেশভূষা তুলনামূলক পশ্চিমা, মেয়েরাও অত কঠোরভাবে আবৃত নয়। তাজিকিস্তানের একটি গ্রুপ সিঁড়িতে বসে পতাকা হাতে ছবি তুলছে। এদের সকলে ইসরাইল ইমিগ্রেশন ও সিকুরিটি ‌অতিক্রম করেই কিন্তু এখানে এসেছে। বাংলা ভাষারই অভাব চোখে পড়ার মত। দুনিয়ার যেখানে গেছি, কোন না কোনভাবে বাঙালী কারো সাথে দেখা হয়ে গেছে। জেরুজালেমে পেলাম শূন্য।

কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক
কুব্বাত আল ইউসুফ
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলছে আরব ছেলেরা
এক কিনারায় সামান্য কিছু ইসরাইলী পুলিশ পাহারায় নিয়োজিত
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে প্রচুর পায়রা
মসজিদ উল আকসার সামনে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
জর্ডান সরকারের ইসলামী ওয়াকফের দাপ্তরিক প্রতীক
তাজিকিস্তান থেকে আগত মুসলিম ট্যুরিস্ট
মারওয়ানি মসজিদের সামনে সিঁড়িতে চেয়ার নিয়ে স্লাইড করে নামার খেলা করছে দুই আরব মেয়ে
বেরুবার গেটে ইসরাইলী পুলিশের কড়া প্রহরা

আদি ইসলামী মুদ্রা – ৩

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে সিরিজের তৃতীয় লেখা এটি। প্রথম পর্বে ছিল উমাইয়া খেলাফতের পতন ও আব্বাসিয়াদের উত্থানের ইতিহাস। দ্বিতীয় পর্বে ছিল আরব-বিজ্যান্টিন মুদ্রার কথা, যেগুলিতে ক্রুশ, মানব অবয়ব ও অন্যান্য অনৈসলামিক প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে বিসমিল্লাহ ইত্যাদি লেখা।

আজকের পাঁচটি রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম আর একটি তাম্রমুদ্রা বা ফালস সাসানী রাজবংশ থেকে শুরু করে উমাইয়া খলীফাদের গভর্নরদের আমলের — ইরাক ও ‌অন্যান্য প্রদেশের। সাসানীদের সাম্রাজ্যের দ্রুত অধঃপতনের পেছনের কাহিনীর পাশাপাশি লিখছি নতুন আরব প্রশাসনিক নীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণী।

ছয়টি মুদ্রা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। আপাতদৃষ্টিতে সবগুলি দেখতে প্রায় একই। কিন্তু এরা আলাদা আলাদা সময়ের। প্রথম দুটি সাসানী সাম্রাজ্যে আর শেষের চারটি উমাইয়া খেলাফতের পূর্বাংশের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে প্রচলিত ছিল।

১। সাসানী শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরুর দিরহাম, ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ
২। সাসানী শাহেনশাহ তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের দিরহাম, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ

সাসানী মুদ্রাগুলো যথাক্রমে শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরু (মুদ্রার তারিখ ৬২০ খ্রীষ্টাব্দ) আর তার পৌত্র তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের (৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। দুটোতেই তাদের প্রোফাইল অংকিত। মাথার ওপর ‘ফারাভাহার’ — পাখাওয়ালা সূর্য — জোরোয়াস্ত্রিয়ান মঙ্গল দেবতা আহুরা মাজদা অথবা শাহেনশাহের গার্ডিয়ান এঞ্জেল ফেরেশতার প্রতীক। চার ধারে চাঁদতারা — ঊর্বরতা ও জ্ঞানের দেবী অনাহিতার (ভারতের সরস্বতী) প্রতীক। সম্রাটের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়বের সামনে পিছনে পাহলভী হরফে তার নাম-পদবী লেখা। অপরপিঠে দুই গদাধারী রক্ষকের মাঝে জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মমতের পবিত্র অগ্নিপ্রজ্জ্বলিত মশালের বেদী। সাথে পাহলভী হরফে টাঁকশালের নামের আদ্যাক্ষর।

৩। ইরাকের মুসলিম গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আমিরানের দিরহাম, ৬৬৩/৬৬৮ সাল
৪। ইরাকের মুসলিম গভর্নর জিয়াদ ইবনে আবি সুফিয়ানের দিরহাম, ৬৬৮/৬৬৯ সাল

তৃতীয় ও চতুর্থ মুদ্রার ডিজাইন আগেরগুলোর মতই। কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, সম্রাটের ছবির ফ্রেমের ঠিক বাইরে আরবী কুফী হরফে বিসমিল্লাহ লেখা। চতুর্থটিতে বিসমিল্লাহ রাব্বী। সম্রাটের মুখচ্ছবির আশপাশ দিয়ে লেখা নাম আর সাসানী সম্রাটের নয়, আরব গভর্নরদের! প্রথমটায় পাহলভী হরফে লেখা ‘প্দুল ‘জিজ ঈ প্দুল ঈ মীল’ন’ — আব্দুল আজিজ ই আব্দুল্লাহ ই আমিরান (৬৬৩/৬৬৪)। দ্বিতীয়টিতে জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান (৬৬৮/৬৬৯)।

দু’জনেই বেশ পরাক্রমশালী উমাইয়া গভর্নর। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় থেকে মুয়াবিয়ার আমল পর্যন্ত সে আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তুতো ভাই উসমানের গুপ্তহত্যার পর শুরু হওয়া প্রথম গৃহযুদ্ধের সময় (৬৫৬-৬৬১) হযরত আয়েশা, তালহা ও জুবায়েরের আলীবিরোধী দলকে বসরাতে আশ্রয় দেন তিনিই। আর জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান ছিলেন আলীর মনোনীত গভর্নর, তার হত্যার পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে শুরুতে আলীপন্থীদের সমর্থন দিলেও মুয়াবিয়া তাকে সৎভাইয়ের মর্যাদা দিয়ে দলে টেনে নেন।

৫। দ্বিতীয় খসরুর দিরহামের চার ধার কেটে তাকে খেলাফতের মাপে নিয়ে আসা হয়েছে
৬। ইরাকের মুসলিম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের তামার ‘পাশিজ’ বা ‘ফালস’, ৬৯৪/৬৯৫ সাল

আর শেষ দুটি মুদ্রার প্রথমটির চারধার থেকে বাড়তি ধাতু কেটে ফেলা হয়েছে। যদি তা না করা হত, আলাদা করে আরব মুদ্রা হিসাবে বোঝা সম্ভব ছিল না। চারধার কাটার কারণ তার ওজনটাকে নতুন আরব খেলাফতের দিরহামের ওজনের স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসা। আর শেষ মুদ্রাটি তামার ‘ফালস’ (৬৯৪/৬৯৫)। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নামে আরেক শক্তিশালী ইরাকী গভর্নরের। তিনি ছিলেন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের খুবই বিশ্বাসযোগ্য এক সেনাপতি। মুদ্রার এক পিঠে সাসানী সম্রাটের প্রতিকৃতি, অপর পিঠে একটি ঘোড়ার ছবি!

পারস্য সাম্রাজ্যে আরব সেনাভিযানের প্রাক্কালে সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। মুদ্রায় দেখানো দ্বিতীয় খসরুকে সিংহাসনে বসার সাথে সাথে বাহরাম চোবিন নামে এক সেনাপতির বিদ্রোহ সামাল দিতে হয়। বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে জাতশত্রু বিজ্যান্টিনদের সাহায্যের জন্যে হাত পাতেন তিনি। সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সফলতার পর বিজ্যান্টিনদের হাতে মেসোপটেমিয়ার কয়েকটি সমৃদ্ধ শহর ছেড়ে দেন খসরু।

দ্বিতীয় খসরুর সময় সাসানী সাম্রাজ্যের বিস্তার, আনুমানিক ৬১০ সাল

বিজ্যান্টিনদের সাথে শান্তির সুযোগ নিয়ে নিজের গদি পাকাপোক্ত করতে মনোনিবেশ করেন খসরু। যে দুই চাচা তাকে রাজক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করেন খসরু। তার ফলে এতদিনের যে সাসানী-আর্শাকী রাজবংশের একতার ওপর ইরানী সাম্রাজ্য দাঁড়িয়েছিল, তাতে চিঁড় ধরতে শুরু করে। অভিজাতবংশীয় সেনানায়ক ও জমিদাররা (দেহগান) দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

একই সময়ে নিজের হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইরাকের পাপেট রাষ্ট্র আল-হিরার আরব লাখমীবংশীয় রাজা আল-নুমানকে বন্দী করে হত্যা করেন খসরু। এই রাষ্ট্রের যাযাবর ও অর্ধযাযাবররা এতদিন শত্রু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে সৈন্য-সামন্ত ও সামরিক বাফার এলাকার নিয়ন্ত্রণ যুগিয়ে এসেছে সাসানীদের। এভাবে বিজ্যান্টিন ও মরু এলাকার আরব ট্রাইবগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যূহ রাতারাতি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

খসরুর ভাগ্য পাল্টে যেতে শুরু করে ৬০২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। তার মিত্র বিজ্যান্টিন সম্রাট মরিস নিজ সেনাপতি ফোকাসের হাতে খুন হন। ফোকাস নিজেকে সম্রাট দাবি করলে মরিসের পুত্রকে সিংহাসনে আসীন করার ‘ন্যায়সঙ্গত’ লক্ষ্য নিয়ে খসরু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। প্রথম প্রথম খুব দ্রুততার সাথে আগের হারানো শহরগুলি পুনরুদ্ধার করে ফেলেন। ঈজিয়ান সাগরে নৌযুদ্ধেও সফলতা পায় সাসানীরা, মিশরও তাদের দখলে আসে। বিজ্যান্টিন সম্রাটের প্রাসাদে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। ফোকাসকে সরিয়ে সম্রাট হন হেরাক্লিয়াস আর খসরুকে শান্তির প্রস্তাব পাঠান। খসরু তাতে কান না দিয়ে উল্টো মরিসের পুত্র থিওডসিয়াসকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেবার দাবি করেন। তার সেনাপতি শহরবরাজ/সরফরাজ দামেস্ক ও জেরুজালেম দখল করে যীশুখ্রীষ্টের ট্রু ক্রস লুট করে নিয়ে যান।

৬২৬এ হেরাক্লিয়াস সাসানীদের কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হন। এ সময় থেকে যুদ্ধের মোড় বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। পূর্ব ফ্রন্টে তুর্কী ও হেফথালাইটদের সাথে মিত্রতাস্থাপনের পর দ্রুত সিরিয়া-মেসোপটেমিয়ায় বেশ কিছু যুদ্ধে বিজয় পান হেরাক্লিয়াস। এরপর একেবারে সাসানী রাজধানী ক্টেসিফোনে এসে হাজির হয় বিজ্যান্টিন সেনাদল। এবার খসরুর সময় এল অতীতের সব অত্যাচারের মাসুল দেবার। তার বিরোধী পাহলভী বনেদী পরিবারগুলো বিদ্রোহ শুরু করে। এদের মধ্যে ছিলেন শাহনামাখ্যাত রুস্তম ও তার পরিবার। তারা খসরুর কারাবন্দী পুত্র শেরোয়েকে মুক্ত করে তাকে শাহেনশাহ ঘোষণা করে। শেরোয়ে রাজকীয় নাম নেন কাভদ। বিজ্যান্টিনদের হারানো রাজ্যগুলি ফিরিয়ে দেন, পাশাপাশি উত্তর ইরাক তাদের কাছে ছেড়ে দেন। বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে শান্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতার তাড়নায় নিজ পিতাকে তো হত্যা করেনই, স্বপরিবারের আপন ভাই, সৎ ভাই সকলকে নিকেশ করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। ফলে সাসানী পরিবার প্রায় নির্বংশ হয়ে যায়, রাজা হবার যোগ্য কোন বংশধর আর থাকে না।

কাভদকেও অচিরেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। তাকে সরানোর পর চার বছরে দশবার সম্রাট পরিবর্তন হয়। শেষমেশ শাহেনশাহ হন খসরুর এক নাতি তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ। ৬৩২ সালে রাজাভিষেকের সময় তার বয়স ছিল মোটে আট বছর। তিনিই ছিলেন ইসলামী বিজয়াভিযানের সময় সাসানী সম্রাট। তার রাজত্বের শুরুতে পুরো সাম্রাজ্যের ওপর তার তেমন কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত তার দেশ। নানা প্রদেশে প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছে বিভিন্ন গভর্নররা। ধীরে ধীরে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে আবার সাসানী সাম্রাজ্যকে একীভূত করতে হয় তাকে। কিন্তু ততদিনে আরবদের উত্থান শুরু হয়ে গেছে। ৬৫১ সালে পলায়নরত অবস্থায় এক মিলার তাকে চিনে ফেলে, তাকে হত্যা করে মুসলিম সেনাদল নয়, বরং বিরোধীবংশীয় এক সামন্ত।

এ হলো সাসানীদের সমসাময়িক অবস্থা। আরব মুসলিমদের মাঝে এ সময়ে কি ঘটছিল তা বুঝতে হলে শুরু করতে হবে ইরাক ও তার ডেমোগ্রাফি দিয়ে।

এ সময়ের এক হাজার বছর আগের আকিমেনিদ আমল থেকেই ইরাক বা মেসোপটেমিয়া ইরানী গোত্র ও রাজবংশগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু অতীতে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে ছিল অ্যাসিরীয়-ব্যাবিলোনীয় সাম্রাজ্যের জন্মভূমি। এদের মহান রাজা নেবুকাদনেজার বা বখত-নসর ইন্দোআর্য পারসিক ছিলেন না, ছিলেন আরব ও হিব্রুদের মতই সেমিটিক গোত্রীয়। পারসিকরা যখন অতীতে ছিল স্তেপের শিকারী ও মেষপালক গোত্র, তখন ব্যাবিলোনিয়ার সাম্রাজ্য ছিল নাগরিক সভ্যতার পুরোধা। কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে এরা ছিল পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি।

অর্থাৎ ইরানী বনেদী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও ইরাকের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ তখনো সেমিটিক আরামাইক ভাষায় কথা বলত, ঠিক যেমনটা ছিল বিজ্যান্টিন সিরিয়ার সিরিয়াকভাষীরা। এদের ভাষার সাথে ফারসীর মিল নেই, মিল আছে আরবী ও হিব্রুর।

এসকল আরামায়িকভাষী মানুষের বসবাস ছিল ইরাকের বড় শহরগুলিতে। তাদের পাশাপাশি ছিল ফারসীভাষী সরকারী কর্মচারী ও সৈনিক। শ্রেণী ও গোত্রভিত্তিক বিভাজন ছিল সেসব শহরে। জোরোয়াস্ত্রিয়ান ফায়ার টেম্পল ছিল পারসিকদের শক্তির প্রতীক। কিন্তু অধিকাংশ জনগণের ধর্ম ছিল নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি। পাশাপাশি কিছু ইহুদী ছিল যারা ড্যানিয়েল-এজেকিয়েলের সময় থেকে ইরাকের বাসিন্দা।

আর দুই নদীর উপত্যকার ঠিক পশ্চিমে যেখানে ঊর্বরভূমির সাথে মরুভূমির মিলন ঘটেছে, সেখানে আবাস ছিল বহু অর্ধ-যাযাবর মেষপালক আরব গোত্রের। এদের অধিপতি ছিল বনু লাখম বলে একটি বড় গোত্র, ঠিক যেমন সিরিয়াতে বনু ঘাসান ছিল বিজ্যান্টিনদের মনোনীত আরব নেতৃত্বস্থানীয় গোত্র। ভিনদেশী সাসানীদের হয়ে আরব গোত্রগুলো থেকে করসংগ্রহের দায়িত্ব ছিল লাখমীদের। এছাড়াও দক্ষিণে পারস্যোপসাগরের তীরবর্তী খুজেস্তান থেকে শুরু করে উত্তরের জাগ্রোস পর্বত পর্যন্ত আরো নানা আরব গোত্রের বসবাস ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাইবান, তাগলীব, তানুখ প্রমুখ। এদের অধিকাংশ ছিল নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান। ইরাকের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছিল জরথুস্ত্রবাদ থেকে বিবর্তিত নিষিদ্ধঘোষিত মাজদাকী-মানিকেয়ান, আর আধ্যাত্মিক ভক্তিবাদী মান্দিয়ানরা।

আরব গোত্রদের কাছে হযরত মুহাম্মদ(সা)এর ইসলাম প্রচারের অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল তাদেরকে একতাবদ্ধ করা। তার জীবদ্দশায় কুরাইশশাসিত মক্কা ও মুসলিমশাসিত মদীনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফসল হিসাবে আরবের বেদুঈন ও শহরবাসী ট্রাইবগুলোর কনসলিডেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে। মক্কাবিজয়ের পরও একই প্রক্রিয়া আরো বড় মাপে চলতে থাকে, আর তার বিস্তার হয় দক্ষিণে ইয়েমেন-ওমান, উত্তরে আল-ইয়ামামা, আর পূর্বে বাহরাইন পর্যন্ত। হযরত মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আবু বকরের খলীফা হবার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তিনি সকল আরব ট্রাইবের পুংক্ষানুপুংক্ষ বংশপরিচয় জানতেন, অর্থাৎ তাদের সাথে কূটনীতিতে সফলতার চাবিকাঠি ছিল তার হাতে। তাই রিদ্দা নামক বিদ্রোহগুলিকে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে তার দু’বছরের বেশি সময় লাগেনি।

আবু বকরের শাসনামলেই ইয়ামামার ‘ভন্ডনবী’ মুসায়লামাকে পরাজিত করতে সেনাদল পাঠানো হয়। সে সংগ্রাম চলাকালীন অবস্থাতেই ইরাকে অভিযান চালান মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি দক্ষিণ ইরাকের বনু শাইবান গোত্রের নেতাকে তার সাথে হাত মেলানোর প্রস্তাব দেন। ততদিনে বনু শাইবান নিজেরাই মরুভূমি থেকে আক্রমণ চালিয়ে দজলা-ফোরাতের পশ্চিম তীরে মোটামুটি একটা স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে। সাসানীরা হয় তখনো সামরিক দুর্বলতার শিকার, নয়ত শাইবানদের ছোটখাট আক্রমণে গা না করে বড় কোন সমস্যা নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত।

খালিদ বিন ওয়ালিদ ৬৩৩/৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ইরাকের স্থানীয় বেদুঈন আরবদের সাহায্য নিয়ে মরুসংলগ্ন এলাকা আর বসরার কাছে আল-উবুল্লা আর কুফার নিকটবর্তী আলহিরার মত আরবঅধ্যুষিত শহরগুলিকে ইসলামী রাজত্বের আওতায় আনেন। এ সময়ে সাসানী সেনাবাহিনীর কোন প্রতিরোধ তাদের বিরুদ্ধে আসেনি। খালিদ সিরিয়া বিজয়ের যুদ্ধে অংশ নিতে ইরাক ত্যাগ করে বিশাল মরুযাত্রা করেন আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যান শাইবানদের গোত্রপতি আল-মুসান্নার হাতে।

ইসলামী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা ‌অবশ্য আসে স্থানীয় আরব গোত্রগুলোর থেকে। এদের অনেকে লাখমীদের জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিল। নতুন পাওয়া ক্ষমতা ছাড়তে তারা ছিল নারাজ। এদের বিরুদ্ধে আল-মুসান্না ইসলামী খেলাফতের নামে দু’একটা সফল অভিযান চালালেও শীঘ্রই সরাসরি সাসানী বিরোধিতার সম্মুখীন হন। আল-জিসরের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন তিনি।

এর প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় খলীফা উমার স্বল্পকিছু রিইনফোর্সমেন্ট পাঠান বাজিলা গোত্রের জারীর ইবনে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে। তাদের সাথে পরে যোগ দেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বড় সৈন্যদল। ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এরা সকলে মিলে ঘাঁটি গাড়ে আলহিরার নিকটবর্তী আল-ক্বাদিসিয়ার প্রাঙ্গনে। সেখানে পারসিক সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংখ্যায় অপ্রতুলতা সত্ত্বেও আরবরা কয়েকদিনের প্রচেষ্টায় যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। এখানেই নাকি রুস্তমের সাথে মোলাকাত হয় আরবদের, আর রুস্তম তাদের চরম অপমান করেন।

ক্বাদিসিয়ার যুদ্ধে সাসানীরা হারার পর তাদের তেমন কোন প্রতিরক্ষা আর অবশিষ্ট থাকে না। তারা পিছু হটে আশ্রয় নেয় মাদাইন শহরে তাদের রাজধানীতে, তারপর সেখান থেকে পালিয়ে চলে যায় জাগ্রোস পর্বতের পাদদেশে। সেখানে ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জালুলার যুদ্ধে আরেকবার শোচনীয় পরাজয় ঘটে সাসানীদের। ইয়াজদেগার্দ তার নিকটস্থদের নিয়ে আরো পূর্বে খোরাসান ও সগডিয়ার দিকে পালিয়ে যান, আর সুযোগ খুঁজতে থাকেন তার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের। সে উদ্দেশ্যে চীনাদেরও সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। কিন্তু তার সেই সংগ্রাম ৬৫১ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপে চললেও শেষ পর্যন্ত সাসানী সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বিফল হয়। তার পুত্র চীনের সম্রাটের দরবারে আশ্রয় নেন নির্বাসিত রাজা হিসাবে। আর কখনোই ইরানে ফিরে যেতে পারেনি সাসানীদের বংশধররা।

পারসিক সেনাদলের সংখ্যাধিক্য আর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আরবদের যুদ্ধে বিজয়ের কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কারো ধারণা পারসিকদের হস্তীবাহিনীকে আরব তীরন্দাজরা দূর থেকে ধরাশায়ী করে ফেলে। আবার তাদের সাংগঠনিক একতার কারণও দেন অনেকে। তাদের বিপরীতে সাসানী বাহিনী ছিল বহু জাতি-গোত্রে বিভক্ত আর তারা মোটে জটিল গৃহবিবাদ কাটিয়ে উঠেছে। আর ইরানী সেনাদলের স্বাভাবিক আকারের তুলনায় তারা ছিল স্বল্প। আরবরা যে সংখ্যায় দুর্বল ছিল আর তাদের তীরন্দাজ, পদাতিক আর ঊষ্ট্রারোহী ছাড়া তেমন কোন সৈন্য ছিল না, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এই সৈন্যসংখ্যা কম হবার কারণেই উমার রিদ্দার সময়কার বিদ্রোহী আরব গোত্রগুলিকে না চাইতেও ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। ‘ভন্ডনবী’ তুলায়হাকেও তার ট্রাইবসহ ইরাকে পাঠান তিনি। তুলায়হাকে সেনানেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি দেননি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার কৌশলগত উপদেশ ঠিকই মুসলিমদের কাজে লেগেছে। এ ছিল সাসানীদের অন্তর্কলহের ঠিক বিপরীত। আরব সেনাদলে যে সকলে মুসলিম ছিল তাও নয়, ইরাকের খ্রীষ্টান ট্রাইবগুলোর কিছু সদস্যও যুদ্ধে আরব পক্ষ নেয়। সিরিয়ার যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ ও মদীনার আনসারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও দেখা যায় যে ইরাকে সে প্রক্রিয়াটায় বেশি অংশ নিয়েছে মধ্য আরব ও ইরাকের অ-কুরাইশ স্থানীয় আরব ট্রাইবগুলি।

এভাবে ইরাকবিজয় ছিল নেহাত আরব ট্রাইবগুলির কনসলিডেশনের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সিরিয়াতে মক্কার কুরাইশদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল, জেরুজালেমের কারণে সেখানকার একটা ধর্মীয় গুরুত্বও ছিল। সেসব কোন কিছু ইরাকের বেলায় ছিল না। আরব কনসলিডেশন ও এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে যখনই সাসানী বা তাদের সমর্থকদের বাঁধা এসেছে, তখনই আরবদের সুযোগ চলে এসেছে আরো এলাকা হস্তগত করার। এভাবে ইরাক থেকে শুরু করে ক্রমে সাসানী সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের খোরাসান-হেরাতে ছড়িয়ে পড়ে আরব সেনাদল। আর সেভাবে তারা এসে হাজির হয় সিন্ধু উপত্যকায় — ঠিক ভারতের দোরগোড়ায়।

সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের জীবদ্দশাতেই ইরাকের রাজধানী ক্টেসিফোন বা আল-মাদাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় আলহিরার নিকটবর্তী নতুন সৃষ্ট গ্যারিসন টাউন কুফাতে। এর মূল কারণ সম্ভবত মরু এলাকার নিজস্ব পাওয়ার বেসের কাছাকাছি থাকা, আর মরুর ট্রাইবগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার সুবিধা। এতে বোঝা যায়, ইরাকে সাম্রাজ্যবিস্তারের মূল লক্ষ্য সাসানী সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকেন্দ্র দখল করা নয়, বরং ছিল আরব গোত্রগুলিকে একীভূত করে একই সিস্টেমের আওতাধীন করা।

উমার ও পরবর্তী খলীফারা ইরাকে বিভিন্ন আরব যাযাবর ট্রাইবকে ‘হিজরত’ কিংবা ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে হিজরত ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে ইসলামের একটি অনানুষ্ঠানিক স্তম্ভ হিসাবে। হিজরতে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে খেলাফতের নেতৃত্বস্থানীয়দের মূল লক্ষ্য ছিল পরিবর্তনশীল মানসিকতার বেদুঈনদেরকে আরবের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা, আর সম্ভব হলে সাসানীদের অবশিষ্ট সেনাদলের বিরুদ্ধে এদের ব্যবহার করা। এসকল বেদুঈন ট্রাইব কুফা কিংবা বসরার মত নতুন শহরে এসে বসতি গাড়ে। একেকটি ট্রাইবের জন্যে নির্ধারিত ছিল একেকটি মহল্লা। কোন ক্ষেত্রে বনেদী পারসিক মিত্র ‘দেহগান’ জমিদার আর ‘সাওয়ারী’ অশ্বারোহীদের জন্যেও নতুন এলাকা ছেড়ে দিতে তাদের বাধ্য করা হয়।

আরব ট্রাইবগুলি মরুতে বসবাসরত অবস্থায় মদীনায় ট্যাক্স পাঠাত, আর ইরাকে অভিবাসনের পর এখন তারা উল্টো পায় সরকারী ভর্তুকি। এরা কিন্তু ইরাকের আদি অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিজমা দখল করেনি। চাষাবাদে আরব বেদুঈনদের কোন আগ্রহ ছিল না, আগের চাষীদের থেকে কর আদায় করেই তারা ক্ষান্ত হয়েছে। যে করটা এসব আরামায়িকভাষী চাষীরা ইরানিদের দিত, তা এখন পাওয়া শুরু করে আরব গোত্রগুলো। আরবদের জনসংখ্যা বাড়া শুরু করলে কুফা-বসরা শহরে ধীরে ধীরে অশান্তি-অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধে তার একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সে ব্যাপারে পরে বলব।

ইসলামী সরকার কেবল সেসব জমিগুলির অধিগ্রহণ করে যেগুলি শান্তিচুক্তিঅনুযায়ী স্থানীয়রা তাদের কাছে ছেড়ে দেয়, নয়ত যেগুলি আগে ছিল সাসানী সরকারের মালিকানাধীন, নতুবা তাদের মালিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিংবা দেশান্তরী হয়েছে। সেসব জমির চাষাবাদ থেকে পাওয়া কর দিয়ে সরকার পরিচালিত হত।

সরকারী কাজে যেসব ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও অন্যান্য জাত-ধর্মের কর্মচারী ছিল, তাদের অবস্থানও অটুট থাকে। সরকারী ভাষা তখনও পাহলভী। উমারের সময় থেকে আশি বছর পরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাষাসংস্কারের আগে কোন খলীফা বা গভর্নর এসব প্রক্রিয়ার ওপর কোন হস্তক্ষেপ করেননি। সে ব্যাপারটা এই মুদ্রাগুলির মধ্যেও উঠে এসেছে।

সাসানী সম্রাটের মুখাবয়বওয়ালা এই মুদ্রা রাশিদুন খেলাফতের আমলে চালু তো ছিলই, উমাইয়া শাসনামলেও তার পরিবর্তন হয়নি। উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক সিরিয়ার মুদ্রার সংস্কার করে তার থেকে মানব অবয়ব বাদ দিয়ে দেন ৬৯৬ সালে। কিন্তু ইরাকের এই মুদ্রার কোন পরিবর্তন তিনি করেননি। উমাইয়াদের পর আব্বাসিয়া খেলাফতের বেশ কিছু প্রদেশেও এমন মুদ্রা চালু ছিল। অর্থাৎ ৬৩৪ থেকে শুরু করে ৭৮৬ পর্যন্ত দেড়শ বছর ইসলামী সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের মুদ্রায় শুধু রাজার মুখচ্ছবি নয়, জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মের চাঁদতারা প্রতীক ও অগ্নিবেদী শোভা পেয়েছে।

আজ এ পর্যন্ত। আগামী পর্বে আসবে স্ট্যান্ডিং কালিফ অর্থাৎ দন্ডায়মান খলীফার অবয়ব ও বিকৃত ক্রুশ অংকিত সিরিয়ার তামার ফালস, যেটা ছিল প্রথম ইসলামী মৌলিক ডিজাইনের মুদ্রা। ঐ যে আব্দুল মালিকের কথা বললাম, তারই নির্দেশে মুদ্রিত। মানুষের ছবি তো বটেই, বিজ্যান্টিন বা সাসানী সম্রাটের নয়, স্বয়ং ইসলামের খলীফার! আর সাথে লিখব তার সেই সংস্কারের পটভূমি।

আদি ইসলামী মুদ্রা – ২

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা — প্রথম লেখা এখানে

আজকে লিখছি আরব দিগ্বিজয়ের সমসাময়িক সিরিয়ার মুদ্রা নিয়ে। ছবির মুদ্রাগুলো আমার সংগ্রহ থেকে। ভালমত খেয়াল করলে দেখবেন, বিজ্যান্টাইন ধাঁচের মুদ্রাগুলিতে সম্রাট কিংবা খলীফার ছবি তো রয়েছেই, তার সাথে দৃশ্যমান একাধিক ক্রুশ। কখনো এসব খ্রীষ্টান প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে ধর্মীয় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ অনুবাক্য লেখা। মুদ্রাগুলির বর্ণনার পর তদকালীন ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত একটা বিবরণ দেব, তারপর কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিশ্লেষণ।

এখানে দেখানো সব মুদ্রাই তামার তৈরি। কালের বিবর্তনে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, তারপরও ছাঁপগুলি দৃশ্যমান। এগুলি চালু ছিল পূর্ব রোম সাম্রাজ্যে, যার প্রচলিত নাম বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য। আরবদের কাছে এ সাম্রাজ্য পরিচিত ছিল ‘রূম’ হিসাবে। কুরআনে একটি সুরাও রয়েছে একই নামে। এ সুরায় রোম আর পারস্যের সাসানী সাম্রাজ্যের চিরন্তন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শেষ ফলের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যে এই নিম্ন মূল্যের মুদ্রা পরিচিত ছিল ফোলিস নামে। আরবদের কাছে এর নাম ফালস, বর্তমানযুগের বহু আরবীভাষী দেশে দিরহাম বা দিনারের থেকে ছোট মানের মুদ্রাকে বলা হয় ফিলস, বহুবচনে ফুলুস। সন্দেহ নেই, আরবী নামটির উৎস সেই লাতিন ফোলিস।

বিজ্যান্টিন সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্সের তাম্রমুদ্রা

ছবির প্রথম মুদ্রা খোদ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের। ৬৪১ থেকে ৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। এক পিঠে বড় করে লাতিন হরফ ‘এম’ লেখা, এটা মুদ্রা মানের প্রতীক। সাথে লাতিন হরফে টাঁকশালের নামের কয়েকটি অক্ষর আর বছর। অপর পিঠে দন্ডায়মান সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্স, ডানহাতে ক্রুশমন্ডিত রাজদন্ড, আরেক হাতে ক্রুশওয়ালা গ্লোব — গ্লোবুস ক্রুসিজের।

পরের আটটি ছবির মুদ্রা সিরিয়ায় প্রচলিত ছিল এমন এক সময়ে যখন সে দেশটি আর বিজ্যান্টিনদের হাতে নেই। ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দামেস্ক থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা হয়েছে নতুন ইসলামী রাশিদুন খেলাফতের করায়ত্ত। মুদ্রাগুলি নতুন প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট। দেখা যাচ্ছে, বিজ্যান্টিনদের আমল থেকে মুদ্রার চেহারার এমন কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই ‘এম’, সেই সম্রাটের কায়া, এমনকি ক্রস পর্যন্ত। মুদ্রা গবেষকরা কিভাবে আলাদা করে বুঝলেন এগুলি ইসলামী মুদ্রা? এর কারণ, একটু নজর দিলে বোঝা যাবে মুদ্রার ছাঁচে পরিবর্তন, গুণমানের তফাত। আরো চোখে পড়বে এখানে সেখানে ত্রুটিপূর্ণ লাতিনের ব্যবহার। আর কোন ক্ষেত্রে মুদ্রার আকৃতি ও ওজন বিজ্যান্টিন মুদ্রার থেকে ভিন্ন। বিজ্যান্টিনসদৃশ এই ইমিটেশনগুলিকে নিউমিজম্যাটিস্টরা নাম দিয়েছেন স্যুডো-বিজ্যান্টিন। সময়কাল ৬৪৭ থেকে ৬৭০ সালের মধ্যে। সবচেয়ে পুরনোটিতে তিন ক্রসধারী ‘সম্রাটের’ ছবি, সময়কাল ৬৩৮-৬৪৩।

রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ফালস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘সম্রাত-সম্রাজ্ঞী’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দাঁড়িওয়ালা
দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস

আর সব শেষের পাঁচটি মুদ্রা রাশিদুন খেলাফত পরবর্তী উমাইয়া খলীফাদের সময়কার সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের।

প্রথম দুটি প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়া’বিয়ার সময়কার (শাসনকাল ৬৬১-৬৮০), যার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত দিয়ে ইসলামের প্রথম ‘ফিতনা’ বা গৃহযুদ্ধের শুরু। একটি মুদ্রা দেখতে হুবহু আগের আমলের স্যুডো-বিজ্যান্টিনগুলির মত। অন্যটিতে একটু তফাত চোখে পড়ে। ক্রসওয়ালা রাজন্ডধারী ‘সম্রাটের’ ঠিক সামনে আরবীতে ওপর থেকে নিচে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা। আর অপর পিঠে এম অক্ষরের ওপরে বামপাশে অর্ধচন্দ্র, ডানপাশে ছয়মাথা তারা। অস্পষ্ট কিন্তু এমের নিচেও আরবীতে ‘তাইয়িব’ লেখা, যার অর্থ ‘উত্তম’ অর্থাৎ এই মুদ্রা লেনদেনের জন্যে স্বীকৃত।

পরের তিনটি মু্য়া’বিয়ার উত্তরসূরী আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ের। উমাইয়া বংশের পঞ্চম এই খলীফা ৬৮৫ থেকে ৭০৫ পর্যন্ত শাসন করেন। তার মূল কৃতিত্ব ছিল মুয়া’বিয়ার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় ফিতনার অবসান ঘটিয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে একীভূত করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইসলামের জন্যে একটি গঠনমূলক সময়। সে ব্যাপারে বিস্তারিত ভিন্ন পোস্টে বলবো। আব্দুল মালিকের মুদ্রা দুটির প্রথমটিতে সেই সম্রাটের ছবি, হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের, মাথায় ক্রুশধারী মুকুট। সাথে গ্রীকে লেখা ΚΑΛΟΝ – কালোন, অর্থ ‘উত্তম’। অন্যপাশে আরবীতে লেখা ‘বি-হিমস’ অর্থাৎ এমেসা বা হিমস (বর্তমান হোমস) শহরে মুদ্রিত। অপরপিঠে এম অক্ষর, ওপরে সাতমাথা তারকা, আর দুপাশে গ্রীক অক্ষরেও এমেসা শহরে মুদ্রিত লেখা — এমেসিস — ΕΜΙ/СΗС। নিচে আরবীতে ‘তাইয়িব।’ দ্বিতীয় মুদ্রাটিতেও সম্রাট-ক্রস, আর এমের নিচে আরবী লেখা ‘আল-ওয়াফা লিল্লাহ’ — অর্থাৎ বিশ্বস্ততা আল্লাহর। কোন ধর্মীয় পুস্তকে বা দোয়ার মধ্যে এখন এমন অনুবাক্য অবিশ্বাস্যকরভাবে অনুপস্থিত। তৃতীয় মুদ্রায় ক্রসধারী তিন বিজ্যান্টিন সম্রাটের মূর্তি এক পিঠে। আরেক পিঠে এম অক্ষরের ওপর খ্রীষ্টান কাই-রো গুপ্তলিপি (এমনটার ব্যবহার কুরআনেও রয়েছে, যেমন ইয়া-সীন)। আর তিন পাশে আরবী লেখা — ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান। অর্থাৎ বাইসান (স্কাইথোপোলিস) শহরে মুদ্রিত প্রকৃত ফালস। শহরটি বর্তমান ইসরাইলের বেইত-শে’আন।

প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বিসমিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বি-হিমস/তাইয়িব অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, আল-ওয়াফা লিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ইমিটেশন ফোলিস, ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান’ অংকিত

সিরিয়াতে কিভাবে ৬৩৩-৬৩৬এর ভেতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হল, তার জন্য দুইটি বিপরীত প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখতে হবে। এক, বিজ্যান্টিন-সাসানী সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাদের মধ্যে একটানা যুদ্ধবিগ্রহ। আরেকটি হলো আরব উপদ্বীপে ট্রাইবাল সিস্টেমের বহুত্বভিত্তিক পরিচয় শেষ হয়ে ইসলামী একত্বভিত্তিক আত্মপরিচয়ের শুরু।

লেইট অ্যান্টিকুইটি বলে ৩০০ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে সময়টা, তখন সভ্য বিশ্বে দুইটি পরাশক্তি — কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য আর বাগদাদের নিকটবর্তী ক্টেসিফোনভিত্তিক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় বিজ্যান্টিনরা সাসানীদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে লড়ে ৫০২-৫০৭এ আনাস্তাসিয়ান যুদ্ধ, ৫২৪-৫৩২এ আইবেরিয়ান যুদ্ধ, ৫৪০-৫৫৭তে জাস্টিনিয়ান-খসরুর যুদ্ধ, ৫৭২-৫৯১এ ককেশাসের যুদ্ধ, আর শেষমেশ ৬০২-৬২৮এর বিজ্যান্টিন-সাসানী যুদ্ধ।

৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আশপাশ দিয়ে সাসানী-বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের সাথে স্থানীয় রাজ্যগুলির মানচিত্র

এ যুদ্ধগুলো মহাযুদ্ধের থেকে কম কিছু ছিল না। দুই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্নভাষী সৈন্য এসবে অংশ নেয়। বড় শহর অবরোধ ও গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রের ধ্বংসসাধন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যেরই ছিল একাধিক শক্তিশালী মিত্র। ইথিওপিয়ার আক্সুম সম্রাট নাজুস ছিলেন অর্থডক্স খ্রীষ্টান ও বিজ্যান্টিনদের বন্ধু। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনের প্রাচীন রাজ্যগুলির একটি হিমইয়ার তখনো ছিল মোটামুটি শক্তিশালী। তাদের ওপর ছিল পারস্যের প্রভাব। এই ইয়েমেনই সংঘটিত হ্য় বিজ্যান্টিন ও সাসানীদের রক্তক্ষয়ী প্রক্সি ওয়ার। কুরআনে বর্ণিত আবরাহার সেনাবাহিনী ছিল ইথিওপিয়া থেকে প্রেরিত। তারা স্থানীয় ইয়েমেনী ইহুদী রাজার খ্রীষ্টান নির্মূল অভিযানের বদলা নিতে নাজরান এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সুরা ফীল অনুযায়ী আবাবিল পাখির প্রস্তরবর্ষণে মক্কাঅভিমুখী আবরাহা আর তার হস্তীবাহিনীর নির্মম মৃত্যু হয়। ইয়েমেনের মত স্থানে খ্রীষ্টান-ইহুদীর পাশাপাশি পাগানবিশ্বাসী দক্ষিণ আরবীয় ট্রাইবের বসবাস ছিল। এদের জীবনধারা উত্তর আরবের হেজাজ আর মধ্য আরবের বেদুইনদের থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল।

দুই সাম্রাজ্যের আরেকটা বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আরবের উত্তরে সিরিয়া-ইরাকের বিশাল স্তেপ সমভূমি। পূর্বে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে আবাস গাড়া আরব লাখমী বংশের ট্রাইব। এক দুই শতক ধরে এরা সাসানীদের আজ্ঞাবহ, কখনো কখনো রাজা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আর মধ্যোপসাগরীয় উপকূলের পশ্চাদভূমি সিরিয়া-জর্দানের আরব ট্রাইবগুলির নেতৃত্বে ছিল ঘাসানী বংশের গোত্রপতিরা। এরা বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করত। এই দুই পক্ষের আরবরা যে কোন বড় যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে থাকত। তাদের লাইট ক্যাভালরি দিয়ে দ্রুত আক্রমণ ছিল বিজ্যান্টিন-সাসানী দুপক্ষেরই প্রমিত রণকৌশল।

৬২০-৬২৮এর যুদ্ধে সাসানীরা বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে ইরাক-সিরিয়া পুরোটুকু দখল করে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত চলে যায়। পুরো নিকটপ্রাচ্য পদানত হয় পারসিকদের। এই দীর্ঘ সামরিক অধিকৃতির সময়টা সিরিয়ার মানুষ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। খ্রীষ্টান ঘাসানী দলনেতারাও পালিয়ে যায় বিজ্যান্টিন এলাকায়। অপরদিকে সাসানীরা বিজয়ের সুযোগে ইরাকের লাখমীদের স্বাধীনতা খর্ব করে তাদের রাজাকে লাঞ্ছিত করে। পুরস্কার দূরে থাকুক, কেন্দ্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়তে হয় এ এলাকার নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, মানিকেইস্ট ও পাগান আরব ট্রাইবগুলিকে।

এ হলো আরব উপদ্বীপের ঠিক বাইরের ভূরাজনৈতিক চিত্র। হেজাজ ও মধ্য আরবে এই দুই সাম্রাজ্যের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিশাল মরু এলাকায় নাগরিক সভ্যতা গড়ে তোলা, করসংগ্রহের মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন কাজ। সামান্য জীবিকার ওপর বেঁচে থাকা মরুর বেদুইনরাও কাবু করার মত মানুষ নয়। প্রায়ই এরা দল বেঁধে চড়াও হত এই এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য কাফেলার ওপর। আর দুই সাম্রাজ্যের দুর্বলতা একটু টের পেলে এরা দ্রুত মরুভূমি অতিক্রম করে আক্রমণ করত সভ্যতার কিনারায় গড়ে ওঠা শহরগুলিতে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও এরা জেরুজালেম অবরোধ করেছিল একবার। এসব আক্রমণের লক্ষ্য সেসব এলাকার স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়, শহরবাসী ও বিজ্যান্টিন গভর্নরদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে কেটে পড়া।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী যদি ধরি মক্কা ছিল হেজাজের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তাহলে মক্কাকে ওপরের ট্রাইবগুলির ব্যতিক্রম বলতে হবে। আরব উপদ্বীপে এরকম ছোট ছোট কিছু শহর ছিল, যাদের যৎসামান্য বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল, তার পাশাপাশি স্থানীয় দেবদেবীর মন্দির থাকার কারণে একটা বাৎসরিক মেলাও হত — তার ইকনমিক ইমপ্যাক্ট পড়ত স্থানীয় লোকজনদের ওপর। অর্থাৎ এ শহরগুলির বাসিন্দারা মরুর বেদুইনের মত পুরোপুরি যাযাবর নয়, বলা চলে সেমি-নোমাডিক।

এদেরই মত সেমি-নোমাডিক ঐ ঘাসানী-লাখমীরাও। বাণিজ্যকেন্দ্রিক শহর তাদেরও ছিল। দক্ষিণ আরবের ক্যাশ ক্রপ আতর-ধূপ আর সেমিপ্রেশাস রত্ন ইত্যাদি সিরিয়া হয়ে রোমে পৌঁছত আদিকালে। ঘাসানীদের পূর্বসূরী নাবাতীরা সেভাবে সম্পদশালী হয়ে গড়েছিল পেত্রার মত শহর। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় কিছুটা হলেও এ বাণিজ্য চালু ছিল — যদিও আগের মাত্রায় নয়। এই বাণিজ্যপথ ধরেই দামেস্ক-হিমস পর্যন্ত যাতায়াত ছিল মক্কার কুরাইশ ট্রাইবসহ অন্যান্য আরবদের। সেসব বড় শহরে নিঃসন্দেহে তাদের আত্মীয়স্বজনেরও বসতি ছিল। হাদীসে ঘাঁটালে দেখা যাবে, আবু জাহল, যিনি ছিলেন অন্যতম ইসলামবিদ্বেষী কুরাইশ, তার মালিকানায় নাকি দামেস্কের আশপাশে জমিজমা ছিল।

মোট কথা, সিরিয়া ও ইরাকের জনগণের শহুরে অংশ বিজ্যান্টিন বা সাসানী হলেও তাদের সেমিটিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়নি। শহুরেদের ভাষা গ্রীকের পাশাপাশি আরামায়িক। আর নাগরিক সভ্যতার ফ্রিঞ্জে গেলে দেখা মিলবে আরামায়িকের নিকটাত্মীয় ভাষা আরবীর, আর সেমি নোমাডিক আরবদের। অর্থাৎ জাতিগত-ভাষাগত পরিচয়ের কথা চিন্তা করলে বিজ্যান্টিন বা সাসানী সাম্রাজ্যের এই এলাকাগুলি আরবদের বেশি কাছাকাছি।

ইসলামের অভ্যুদয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দাওয়া বা ধর্মপ্রচার। কিন্তু এটি আমরা এখন যেভাবে বুঝি তেমনটা নয়। মুহাম্মদ(সা) ছিলেন সুচতুর কূটনীতিবিদ। মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নেবার কারণটাই ছিল মদিনাবাসীর অনুরোধ, যেন তিনি তাদের জাতিগত বিবাদগুলির নিষ্পত্তি করে দেন। তিনি সেটা করতে সমর্থ হন। আর এর মাধ্যমে সারা আরবের ট্রাইবগুলির একীভূত হবার বীজবপন হয়। মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি মদিনার ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। পাশাপাশি একাধিক বিয়ের মাধ্যমে ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আরো বেদুইন ট্রাইবকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হন।

কিন্তু এসব মিত্র ট্রাইবগুলি যে সবাই মুসলিম হয়েছিল তা নয়। সাকিফ বলে ইরাকের কাছের একটি ট্রাইব তার সকল যুদ্ধে সৈন্য পাঠালেও মুসলিম হয়নি। আর মদীনায় ইহুদী ট্রাইবেরও উপস্থিতি ছিল। হাদীসে যদিও বলা হয়েছে, কুরাইশদের সাহায্য করার কারণে চুক্তিভঙের শাস্তি হিসাবে হয় এদেরকে হত্যা করা হয়, নয়ত নির্বাসনে পাঠানো হয়, আমার ধারণা সেটা সব ইহুদীদের বেলায় ঘটেনি। পরবর্তী ইসলামী দিগ্বিজয়ের সময় মুসলিমদের পাশাপাশি সম্ভবত ঘাসানী ও ইয়েমেনী খ্রীষ্টান, হেজাজি ও ইয়েমেনী ইহুদী, আর ইরাকী মানিকেইস্ট আরব যুদ্ধে পাশাপাশি অংশ নেয়। এর কারণ ইসলামের আবির্ভাবের একটি সাইড-এফেক্ট ছিল বংশপরিচয়ভিত্তিক বিভাজনের বিনাশ। এটি একবার হয়ে গেলে ধর্মীয় বিভাজনটা আর অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর রাশিদুন প্রথম খলীফা আবু বকর কনসলিডেশন ও করসংগ্রহ শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আসে। অনেক ট্রাইব আগের চুক্তি অনুযায়ী ‘জাকাত’ ট্যাক্সের বাইরে ছিল। তাদের এটা দিতে বাধ্য করা হলে এরা বেঁকে বসে। আবার কিছু ট্রাইবের নেতা মুহাম্মদ(সা)এর দেখাদেখি নিজেদের নবী বলে দাবী করে বসে। ইত্যাকার নানা বিদ্রোহ দমন করার জন্যে আবু বকর বিভিন্ন সেনাপতিকে পাঠান প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ আর কোন ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল এদের পদ্ধতি। এ যুদ্ধগুলিকে একত্রে বলে ‘রিদ্দা’ যুদ্ধ। ইসলামী সেনানায়কদের বেশিরভাগই আবার ছিল মুহাম্মদ(সা)এর প্রাক্তন শত্রু, যারা মক্কার আত্মসমর্পণের পর ধর্মান্তরিত হয়। এরা যেহেতু মক্কার মত একটা কসমোপলিটান শহরের মানুষ, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড আর পলিটিক্স এরা ভালই বুঝত — বেদুইনদের মত নয়।

সিরিয়া ও ইরাকের বিজয় এই রিদ্দা যুদ্ধের সূত্র ধরেই। যখন এ সকল সেনানায়করা দূরদূরান্তের ট্রাইবগুলিকে বশ করতে গেছে, তখন তারা এসেছে বিজ্যান্টিন ও সাসানী ভূমিতে আবাসরত আরবদের সংস্পর্শে। স্বভাবতই এদের ট্রাইবাল পরিচয় ভেঙে তাদেরকে নতুন আরব-মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে আনার একটা প্রচেষ্টা হয়। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রে মূলো ঝুলানোর মাধ্যমে সে কাজটা হয়।

বিশেষ করে সিরিয়া ছিল আরবের বাইরে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্যে খুবই উপযুক্ত। ততদিনে বিজ্যান্টিনরা সাসানীদেরকে হঠিয়েছে। তারা আবার নতুন করে ঘাসানীদের মত একটা মিত্র ট্রাইবাল স্ট্রাকচার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছে। তাদের সে লক্ষ্যটা আবার রাশিদুন খলীফাদের লক্ষ্যের পরিপন্থী, সংঘাত ছিল অনিবার্য। তাছাড়াও সিরিয়া ছিল আরব উপদ্বীপের তুলনায় স্বর্গ। মেডিটেরানিয়ান সাগরের আর্দ্র বাতাসের কারণে সেখানে চাষাবাদ হত ভাল। বাণিজ্যের সম্পর্কও সেখানে কুরাইশ-উমাইয়াদের আগে থেকেই ছিল। তার ওপর ইসা(সা)সহ অনেক আব্রাহামিক নবীর কারণে জেরুজালেম শহরের ধর্মীয় গুরুত্বও অপরিসীম।

সিরিয়াতে শুরুতে পাঠানো পাঁচ সেনাপ্রধানের সকলেই মক্কাবাসী কুরাইশ ছিলেন, যাদের আগের জীবন ছিল ইসলামবিদ্বেষী, কিন্তু পাপমোচনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইসলামগ্রহণ করেন। সাথে তারা নিয়ে আসেন যুদ্ধের কৌশলজ্ঞান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমর ইবনে আবুল আস, খালিদ বিন ওয়ালিদ, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান, আবু উবায়দা ইবনে আল জার্রাহ, শুরাহবিল ইবনে আবু হাসানা। এদের সৈন্যরা ছিল শুধু মক্কার কুরাইশবংশীয় নয়, ইয়েমেনের কিন্দাবংশীয় ও মধ্য আরবের তায়ী বংশীয়। অর্থাৎ মূলত রিসেন্ট মুসলিম কনভার্ট, যারা হয়ত রিদ্দা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরবদের সিরিয়া অভিযানের মানচিত্র

প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ার মরু ও গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এদের সেনাবাহিনী। স্থানীয় সব ট্রাইব তাদেরকে যে সাহায্য করেছিল তা নয়। ঘাসানসহ চারপাঁচটি ট্রাইব বিজ্যান্টিনদের পক্ষ নিয়ে ছোট ছোট যুদ্ধে লড়ে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারে না। দামেস্কের মত শহরগুলি বহু সংঘাত দেখে ক্লান্ত, আরব সেনাবাহিনী তাদের দ্বারে আসলে নামমাত্র প্রতিরোধ করার পর করপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ধর্মান্তরের কোন শর্ত ছিল না। আর এধরনের কর তারা সাসানী কিংবা বিজ্যান্টিনদের আগে থেকেই দিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিনরা ঘটনার সংবেদনশীলতা আঁচ করতে পেরে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্রাট হেরাক্লিয়াস স্বয়ং সিরিয়ার অ্যান্টিয়োক শহর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথমদিকে ধরাশায়ী শহরগুলি এ সুযোগে আবার পক্ষপরিবর্তন করে। কিন্তু যুদ্ধকৌশলের সুবাদে কিংবা নেহাত ভাগ্যক্রমে সংখ্যায় কম আরব সৈন্যদলের কাছে বিজ্যান্টিনরা একে একে পরাজিত হয় আজনাদাইন আর ইয়ারমুকের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে। যুদ্ধে নিহত হয় হেরাক্লিয়াসের বহু নিকট সেনাপ্রধান, ৬৩৫এ সিরিয়া ছেড়ে কন্সট্যান্টিনোপলে ফিরে যান তিনি। সে বছরই দামেস্ক পুনরায় আরবদের করতলগত হয়। তারপর ৬৩৬এ জেরুজালেম অবরোধ করে বসে আরবরা। শহরটির অর্থডক্স খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস আরবদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেম তাদের হাতে তুলে দেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জেরুজালেমে ইহুদীদের পুনর্বাসন করা যাবে না।

তৃতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে এ এলাকায় সরাসরি আর কোন হস্তক্ষেপ আসে না। মোটামুটি ৫০ বছরের জন্যে চিন্তাহীনভাবে চলে রাশিদুন ও উমাইয়া খলীফাদের শাসন, বিজ্যান্টিনরা ৬৯০এর দিকে একটিবার চেষ্টা চালায় কিন্তু শেষমেশ ঘুষ নিয়ে চলে যায়। উমাইয়া শাসনামলে মদীনা থেকে খেলাফতের গদি সরিয়ে নিয়ে আনা হয় দামেস্কে, কারণ শহরটির অবস্থান ছিল কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্ববাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত। আশপাশের তুলনামূলক দুর্গম এলাকাগুলিতে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে উমাইয়াদের বশ্যতা স্বীকার করে। এদের মধ্যে অ্যান্টি-লেবানন পর্বতের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান মার্দাইটরা বহুদিন কার্যত স্বাধীন ছিল। এসব বিচ্ছিন্ন জনপদ করপ্রদান ছাড়াও অন্যান্য নানা শর্ত মেনে নিয়ে উমাইয়াদের শাসন মেনে নেয়।

এই হল মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সম্পূর্ণ না হলেও সংক্ষিপ্ত একটা আউটলাইন। এবার কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আর প্রশ্ন করি। প্রশ্নগুলির কিছুর উত্তর আছে, কিছুর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই।

প্রথমত, আদি ইসলামী শাসকরা বর্বর যাযাবর ছিল না। মক্কা-মদীনা-তায়েফের মত হেজাজের কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাসিন্দা ছিল এরা। সিরিয়ার সভ্য আরব গোত্রদের সাথে বাণিজ্যিক খাতিরে তাদের যোগাযোগ ছিল। টাকাপয়সা আর কর আদায়ের গুরুত্বটা আগের রেজিমগুলির মত তাদের বেশ ভালই জানা ছিল। ইরাকের আরব গোত্রগুলোর ওপর সাসানীদের চাপিয়ে দেয়া ‘ইতিওয়া’ করের সাথে যেমন তারা পরিচিত ছিল, তেমনই তাদের নিজেদের সমাজেও দুর্বল ট্রাইবদের থেকে তারা প্রটেকশন মানি হিসাবে খুউওয়া নামে কর আদায় করত। সিরিয়ার এই মুদ্রাগুলির ডিজাইনের পেছনে সেটাই মটিভেশন। যে নতুন ধর্মই তারা গ্রহণ করুক না কেন, বাণিজ্য-অর্থনীতির কোন ডিসরাপশন হবে না, চলতে থাকবে। একই কারণে মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আদি ইসলামী কম্যুনিটিতে তার বংশ বনু হাশিমের পরিবর্তে প্রভাব বেড়েছে বাণিজ্যে অগ্রগণ্য বনু উমাইয়া গোত্রের। তৃতীয় খলীফা উসমান ছিলেন তাদেরই এক গোত্রনেতা। তেমনটা ছিলেন প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়া’বিয়া।

দ্বিতীয়ত, কর আর অর্থনীতি চালু রাখতে মু্দ্রাব্যবস্থার হঠাৎ কোন সংস্কার তারা করেনি। একই রকম বিজ্যান্টিন মুদ্রা চালু রেখেছে, এমনকি ৬৬০এর দশক পর্যন্ত সরাসরি বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে তাম্রমুদ্রা আমদানি করেছে। নিজেরা মুদ্রণ শুরু করলেও মানব অবয়ব কিংবা ভিন্নধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ব্যাপারে কার্পণ্য করেনি। তাতে আরবী অক্ষর আনতেও সময় লাগিয়েছে ত্রিশ বছরের বেশি। এটা রাশিদুন খলীফাদের সময়েও হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের নামের কোন চিহ্ন এসব মুদ্রায় রেখে যাননি, যেটা পরবর্তী উমাইয়ারা করেছেন।

মুয়া’বিয়া আর তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসবিদরা, বিশেষ করে শিয়ারা, গুপ্ত খ্রীষ্টান আখ্যায়িত করে। তার একটা মূল কারণ, উমাইয়া সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্র ছিল সিরিয়া যেটা প্রাক্তন বিজ্যান্টিন এলাকা, পারস্য-ইরানের নয়। দ্বিতীয় কারণ আলী আর তার পুত্রদের সাথে এদের সংঘাত। আরেকটা কারণ হতে পারে পরবর্তী যুগের ইতিহাসবিদরা এসব মুদ্রা দেখেই সে ধারণায় উপনীত হয়েছেন এবং সেটাই লিখে গেছেন। আসল ব্যাপারটা হল, মুয়া’বিয়া একবার মানবঅবয়ববিহীন স্বর্ণমুদ্রা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার সভ্য মানুষের কাছে তখনো মুদ্রার ফিয়াত মূল্যের সাথে সম্রাট-ক্রস প্রভৃতির ইমেজ সংযুক্ত। মুয়া’বিয়ার প্রথম প্রচেষ্টার মুদ্রাগুলিকে কেউ গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে আগের মুদ্রার নকশা ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে।

একই প্রসঙ্গে বলা ভাল, শুধু মুদ্রায় নয়। জর্দান ও ইসরাইলের মরুভূমিতে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সেসবে রয়েছে খুবই হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণবন্ত মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি। অর্থাৎ, শুধু মু্দ্রায় নয় ব্যক্তিগত জীবনেও উমাইয়ারা ইসলামের বর্তমান স্বীকৃত ট্যাবুর একটি ভেঙেছেন, আর পরবর্তী ধর্মগুরুদের থেকে তাদের ধর্মবিচ্যুতির অভিযোগ একটা খেয়াল করার মত ব্যাপার। আরো উল্লেখ্য, কুরআনে সরাসরি ছবি আঁকা, মূর্তি বানানোর নিষেধাজ্ঞা নেই, যদি না তার উদ্দেশ্য খোদার শরীক করে পূজো করা হয়। এসব ট্যাবুর ভিত্তি হাদীসে, যেগুলি সংকলিত হয় এসব মুদ্রা ও প্রাসাদের পত্তনেরও একশ বছর পর।

জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর দন্ডায়মান খলিফার মূর্তি, পাদানিতে দুইটি সিংহ
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি

তৃতীয়ত, চাঁদ-তারা প্রতীক। এ প্রতীক উমাইয়া মুদ্রায় দেখা যায় আর পরবর্তীতে ইসলামী প্রতীক হিসাবেও তার ব্যবহার হয়। কিন্তু এটি আরো পুরনো সিম্বল। বিজ্যান্টিন আর সাসানী দুই সাম্রাজ্যের মুদ্রাতেই চাঁদতারা ব্যবহৃত। আসলে চাঁদ ও তারা, যেটা কিনা আসলে শুক্রগ্রহ, পাগান একটি সিম্বল। রোমান পাগান বিশ্বাসে দেবী ডায়ানার প্রতীক চাঁদ ও তারা। তেমন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশতারেরও, যেটা চলে এসেছে সাসানী মুদ্রায়। এ বিধর্মী চিহ্নটি কি জেনেশুনে অ্যাডপ্ট করেছিল আদি মুসলিম শাসকরা? আজকাল অনেকে বলে চাঁদ-তারার জন্যে দায়ী অটোমানরা। সেটা অর্ধসত্য, এই মুদ্রাগুলি চাঁদ-তারার আদি গুরুত্বের প্রমাণ।

চতুর্থত, আল ওয়াফা লিল্লাহ। লয়াল্টি বিলংগস টু আল্লাহ। এমন অনুবাক্য কেন অন্য কোথাও আর চোখে পড়ে না? বিসমিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদ রাসুলাল্লাহ, লিল্লাহিল হামদ, ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ, লা হাওলা ওয়া কুওয়াতা…, আল্লাহুস সামাদ… — ইত্যাদি জিকর ও সুরার অংশবিশেষ উমাইয়া আমলের মুদ্রায় দেখা যায়, যেগুলি এখনো সুপরিচিত। কিন্তু আল ওয়াফা লিল্লাহ — এর কোন খোঁজ নেই। কোথা থেকে এল? আর কোথায় গেল? আগে ছিল? আগে থাকলে হারিয়ে গেল কিভাবে?

পরবর্তী উমাইয়া ফালসে মানব অবয়ব না থাকলেও চাঁদ-তারা চলে যায়নি

পঞ্চমত, আরব সেনাবাহিনীতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সম্ভাব্য উপস্থিতি। তদকালীন সিরিয়াক-কপ্টিক-গ্রীক ভাষায় লিখিত ইতিহাসবিদদের বিবরণীর কোথাও মুসলিম বা ইসলাম শব্দটি পাওয়া যায় না। তাদের বিবরণীতে নতুন আরব শাসকদের নাম ‘মাহগেরে’ বা মাহগ্রায়ে। কোথাও তায়ী গোত্রের নামে তাইইয়ায়ে। মাহগ্রায়ে শব্দটি আরবী মুহাজির শব্দের অপভ্রংশ। মদীনায় যে আদি মুসলিমরা মক্কা থেকে গিয়েছিলেন তাদের নাম মুহাজির বা স্বেচ্ছানির্বাসিত। ইসলামে এখনও হিজরতের একটা রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স আছে। এখন এরা মুসলিম ছিল নাকি বিভিন্ন ধর্মের আরবের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল এটা একটা বিশাল প্রশ্ন।

সোফ্রোনিয়াসের চুক্তিতে ইহুদীদের জেরুজালেমে পুনর্বাসন নিষেধের যে শর্তটা, সেটা কি বিজয়ী আরব সেনাদলে ইহুদীদের অন্তর্ভুক্তির কারণে? নাকি মদিনা আর সংলগ্ন এলাকা থেকে খলীফা উমরের সময় কথিত ইহুদী উচ্ছেদের রিঅ্যাকশন? এখানে উল্লেখ্য, ৬২০-২৮এর সাসানী-বিজ্যান্টিনদের মহাযুদ্ধের অংশ হিসাবে একটি ইহুদী বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। বিজ্যান্টিনদের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাসরত ইহুদীরা প্যালেস্টাইন প্রিমা প্রদেশে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আরব দিগ্বিজয়ের সময়ে কি এরা তুতো ভাই আরবদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করে? বর্তমান যুগে ইহুদীদেরকে মুসলিম বিশ্ব দু’চোখে না দেখতে পারলেও ইসলামের ইতিহাসের তুলনামূলক অধিক সময়ে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল, এমনকি তাদের ধর্ম ও দর্শনও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি উভয়ে দলবদ্ধ হয়ে সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের দখল নেয়, তাতে অবাক হব না। পরের ইসলামী ইতিহাসবিদরা যা লিখে গেছেন, তার অধিকাংশ তাদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেল্ফ-সার্ভিং হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্তত সমসাময়িক অনৈসলামী উৎস সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।

আজ এ পর্যন্তই। এতগুলি প্রশ্ন করার কারণ এসট্যাবলিশমেন্টকে আঘাত করা নয়, অবজেক্টিভ পদ্ধতিতে ইতিহাস নিরূপণ। আশা করি, পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!