হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।

হাইতি – ১, স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

হাইতির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবরণী, বড় করে দেখার জন্যে ক্লিক করুন।

মানচিত্রে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে নজর দিলে যে তিনটি বড় দ্বীপ প্রথমেই চোখে পড়বে, সেগুলি হলো কিউবা, জামেইকা আর হিস্পানিওলা। শেষটি অনন্য, কারণ একটি দ্বীপের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র — পূর্ব ৫/৮ অংশে ডমিনিকান রিপাবলিক, আর পশ্চিম ৩/৮ অংশে হাইতি।

হাইতি অনেক দিক থেকেই বাকিদের থেকে আলাদা। দুনিয়ার মানুষ তাকে চেনে ভুডু ম্যাজিকের আখড়া হিসাবে। তাছাড়াও এ অঞ্চলের অল্প যে কটি দেশে ফরাসী ভাষা চলে, হাইতি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। দোআঁশলা ক্রেওল ভাষাও এখন সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

হাইতির যাত্রা শুরুও ব্যতিক্রমী। চিনি উৎপাদক ফরাসী উপনিবেশে ক্রীতদাসদের অভ্যুত্থান থেকে তার অভ্যুদয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। যুক্তরাষ্ট্রের পর পরই আমেরিকা মহাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হাইতি।

হাইতির জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের বংশধর আর একটা বড় অংশ দোআঁশলা মুলাটো জাত। মূল আমেরিকান অধিবাসী উপজাতিগুলি কলোম্বাসের পদার্পণের কয়েক দশকের মধ্যে মহামারী আর যুদ্ধের কবলে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৭৯১এ শুরু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এখন পর্যন্ত হাইতি প্রচুর উত্থানপতন দেখেছে। দেখেছে জনসংগ্রাম আর যুদ্ধের মুখে দুজন সম্রাট আর ডজনখানেক রাষ্ট্রপতির অপসারণ। পার্শ্ববর্তী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিককে দখল করে রেখেছে কয়েক বছর। আর নিজে দখলীকৃত হয়েছে দু’বার।

ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দ্বীপরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আজকের হাইতি বিফল রাষ্ট্র বলা চলে। হাইতি যে উচ্চাভিলাষ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ হাইতি। এমনকি পর্যটনের আকর্ষণ প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের মানুষের মাথাপিছু আয় হাইতির পাঁচ-ছয় গুণ — যদিও দেশ দুটি প্রায় একই ধরনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে গেছে।

পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত পাপাডক-বেবিডকের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের পরবর্তী অরাজকতা আর ২০১০এ ৭ রিখটারের সর্বনাশা ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশী সেনাদলও হাইতিতে গিয়েছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখপ্রদ নয়, এটা শান্তিরক্ষীদের অসামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। শ্রীলংকা সরকার একটি ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়।

অর্থাৎ দেশটা এমন হয়ে গেছে যেখানে অমানবিকতা প্রতিদিনকার ব্যাপার। সেখানে বিদেশীরা বেশিদিন থাকলে তাদেরও অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী।

কিভাবে হাইতি এমন অবস্থায় এসে পড়লো, তাই নিয়ে পাঁচখন্ডের এবারের সিরিজ।

প্রথম পর্ব: স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

দ্বিতীয় পর্ব: রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

তৃতীয় পর্ব: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

চতুর্থ পর্ব: দখলদার মার্কিন, ১৯১০-৫০

পঞ্চম পর্ব: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ১৯৫০-


হিস্পানিওলা নামের যে দ্বীপটিতে হাইতি অবস্থিত, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানের শেষভাগে কলোম্বাস সেখানে অবতরণ করেন। কলোনিস্থাপনের প্রথম কয়েক দশকে আদিবাসীরা স্প্যানিশদের সাথে সংঘর্ষে, মহামারীতে আর দাসত্বশৃংখলের কঠোর পরিশ্রমে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্প্যানিশদের মনোযোগ মূল ভূখন্ডের দিকে যত বেশি নিবিষ্ট হয়, হিস্পানিওলার সান্তো দোমিংগো কলোনির গুরুত্ব তত কমতে থাকে। সপ্তদশ শতকের শেষ নাগাদ দ্বীপটির পশ্চিমাংশ থেকে স্প্যানিশরা সরে যায়, তার জায়গা নেয় ফরাসী-ইংরেজ জলদস্যুরা। এই জলদস্যুদের রাস্তা ধরেই ফ্রান্স পশ্চিম হিস্পানিওলার পূর্ণ দখল নেয় ১৬২৫ সালে।

কলাম্বাসের হিস্পানিওলাতে অবতরণের দৃশ্য উডকাট করেছেন ডাচ শিল্পী থিওডর দ্য ব্রি, ১৫৯৪
ক্যারিবিয়ানের ফরাসী বাকেনিয়ার (জলদস্যু) ফ্রঁসোয়া লোলোনোয়া স্প্যানিশ জাহাজ লুটতরাজ করতেন, ১৬৮৪ সালের চিত্র

নতুন নামকৃত স্যাঁ-দোম্যাঙ্গ উপনিবেশটি ফরাসীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে আখ, তামাক, কফি ইত্যাদি অর্থকরী শস্যের চাষাবাদ ও ফলন ভালই হয়। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের খামারে খাঁটুনির কাজের জন্যে হাজারে হাজারে আফ্রিকান ক্রীতদাস আনা শুরু হয়।

ফরাসীরা ক্রীতদাসদের অমানবিকভাবে খাঁটাত। অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ক্রীতদাসরা কিছুটা হলেও মূল্য পেত। কিন্তু ফরাসী রাজতন্ত্রের সেকেলে নিয়মে ক্রীতদাসরা বলতে গেলে ছিল একটিবার ব্যবহারের পণ্য। ফলে প্রতি বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে হাজার হাজার জওয়ান ক্রীতদাস মৃত্যুবরণ করত। ১৭৯০ সাল নাগাদ সেখানে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ দাস আর হাজার পঞ্চাশেক ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামার মালিক।

আরো একটি ‘বর্ণ’ ছিল, যাদের নাম মুলাটো বা মিশ্রজাত। আর ছিল অল্প কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ। এরা মূলত কারিগর, খেতশ্রমিকের তদারককারী, পুলিশ, পেয়াদা, ইত্যাদি অবকাঠামোভিত্তিক পেশায় জড়িত ছিল।

স্পেনের আমেরিকান কলোনিগুলিতে শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মিলনে প্রচুর মুলাটো বা মিশ্র সন্তানের জন্ম হয়, কারণ ভদ্র পরিবারের ইউরোপীয় মেয়েরা সাধারণত আমেরিকায় যেতে চাইত না, ১৭৭৫এর ‘কাস্তা’ চিত্র, স্প্যানিশ চিত্রকার ফ্রান্সিস্কো ক্লাপেরা, ১৭৪৬-১৮১০, ডেনভার আর্ট মিউজিয়াম
১৮২৩ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ অ্যান্টিগাতে ক্রীতদাসদের আখ খামারে কাজ করার অ্যাকুয়াটিন্ট বানিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম ক্লার্ক

ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজা-রাজড়া আর অভিজাত বংশগুলির শোষণের প্রতিবাদে জেগে ওঠে পেশাজীবী মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র কৃষক। বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রথমে গদি ছাড়তে হয়, তারপর তার আর রাণী মারি অঁতোয়ানেতের গর্দান যায় গিলোটিনে। দশ বছরব্যাপী অন্তর্ঘাতে নিমজ্জিত হয়ে যায় ইউরোপের শক্তিশালী দেশটি।

এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অবস্থাপন্ন মুলাটো ও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তারা আরো রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের লক্ষ্য স্বাধীন দেশ কিংবা দাসপ্রথার উচ্ছেদ ছিল না। এমনকি এদের অনেকে কালে খামার মালিক বনেছে, দাসদেরও মনিব হয়েছে, তুলা-নীল-কফি রপ্তানী করে বেশ সম্পদশালী হয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল রাজতন্ত্রবাদী ফরাসী খামারমালিকদের প্রশাসন তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে, এরা হাত মেলায় সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের সাথে।

এই দাসরা কিন্তু আফ্রিকার আবাসভূমিতে ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা! আফ্রিকার গৃহযুদ্ধগুলিতে পরাজিত হবার পর শত্রুরা এদেরকে বেচে দিয়েছিল ইউরোপীয়দের কাছে। এসকল কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের সাহায্যে একটা শক্তিশালী সামরিকতন্ত্র দাঁড়া হয়ে যায় স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে।

১৭৯৪ সালে ফরাসী জনতা তাদের প্রাক্তন রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেয়, লুই ব্লঁ-এর ইস্তোয়ার দ্য লা রেভোল্যুসিওঁ বইএর এনগ্রেভিং
হাইতির ১৭৯৩ সালের রক্তাক্ত বিপ্লবের চিত্র দেখানো হয়েছে ১৮২০ সালের ফরাসী বইয়ে
১৮৩৩ সালে ফ্রঁস মিলিতের বইয়ে অংকিত হাইতি বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের চিত্র

স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে ত্রিমুখী গোলমাল চলে ১৭৯১ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গসংগ্রামের একক কোন নেতা ছিল না। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল একেক প্রদেশে স্বাধীন শাসন কায়েম করে বসেছিল। ক্রমে এদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন তুস্যাঁ লুভেরত্যুর নামে এক মুক্ত মুলাটো। বাল্যকালে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর কোচচালক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তারপর শিক্ষিত হয়ে নিজেই খামার দেন, দাস পালেন। বিপ্লবের সময় বিদ্রোহী সেনাপ্রধান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। স্বাধীন হাইতির প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় লুভেরত্যুরকেই।

১৮০৪/০৫ সালে ফরাসী শিল্পী জিরার্দ্যাঁর আঁকা তুস্যাঁ ল্যুভেরতুরের পোর্ট্রেট

১৭৯৪ সালে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রবাদীরা ক্ষমতাদখল করে ফরাসীশাসিত সকল দেশে দাসপ্রথা রদ করে দেয়। বিদ্রোহী লুভেরত্যুর তখন পক্ষপরিবর্তন করে ফরাসী সরকারের গভর্নর হিসাবে নামেমাত্র ফরাসীঅধীন কলোনিটির শাসনভার দখল করেন। প্রজাতন্ত্রবিরোধী খামার মালিকদের প্রতিরোধযুদ্ধ তখনও চলছিল। তাদের আহ্বানে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পাঁচ বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অধিকাংশ এলাকা দখল করে রাখে।

কিছু দাসপ্রথাবিরোধী শ্বেতাঙ্গ অবশ্য লুভেরত্যুরের সাথে যোগ দেয়। লুভেরত্যুর ছিলেন সাদা-কালোর মধ্যে আপোষকামী, তাঁর অধীনে শ্বেতাঙ্গ সেনাপ্রধান ও সচিবও ছিল। সাদা বন্দীদের সাথে ভাল আচরণের উদাহরণও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের লাগাম টেনে ধরেন নাপোলেওঁ বোনাপার্ত স্বয়ং। ফ্রান্সে ১৭৯৯ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রথমে কনসাল ও পরে সম্রাট পদবী গ্রহণ করেন তিনি। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে পুনরায় কব্জা করার জন্যে এক বিশাল নৌবাহিনী পাঠানো হয় ক্যারিবিয়ান সাগরে। তাদের সেনাপ্রধান লক্লের্কের চালাকির শিকার হয়ে লুভেরত্যুর ফ্রান্সে বন্দী হিসাবে প্রেরিত হন, সেখানেই মৃত্যু হয় তার। তার সহযোদ্ধা জঁ-জাক দেসালিন ও অন্যান্যরা উপায়ান্তর না দেখে নাপোলেওনের পক্ষে যোগ দেন আর লড়াই চালান স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য নাপোলেওনের দাসপ্রথা পুনর্বহাল করার গোপন পরিকল্পনা যখন ফাঁস হয়ে যায়, তখন আবার দেসালিন পক্ষপরিবর্তন করেন। স্পেন ও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা অস্ত্রের সাহায্যে কঠিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ফরাসীদের ১৮০৩ সালে তাঁড়াতে সক্ষম হয় দেসালিনের সেনাদল। সে যুদ্ধের খরচ ওঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লুইজিয়ানা টেরিটোরির বিশাল ভূখন্ড বিক্রি করে দেয় ফ্রান্স।

১৮০৪ সালে ফরাসী জেনারেল নাপোলেওঁ বোনাপার্ত নিজের মাথায় নিজেই মুকুট পরে ফ্রান্সের সম্রাট বনে বসেন, জাক লুই-দাভিদের অংকিত চিত্র, ১৮০৮।
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাইতির সেনাদল। পেছনে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গের নির্দেশনায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র দাসের দল, ১৮০৩। ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত ইস্তোয়ার দ্য নাপলেওঁ বই থেকে
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদল প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিকামী কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।
নাপোলেওনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হাইতির কৃষ্ণাঙ্গরাও নেয় খুব নৃশংসতার সাথে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দেসালিন ১৮০৪ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে নতুন নাম দেন হাইতি। এ ছিল লোককথা অনুযায়ী দ্বীপটির জন্যে আমেরিকান আদিবাসীদের ব্যবহৃত নাম। দেসালিন লুভেরত্যুরের মত আপোষকামী ছিলেন না, তার আমলে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ খামারমালিককে সপরিবারে হ্ত্যা করা হয়। গর্ব করে হাইতিকে ফরাসীদের সমাধি ডাকনাম দেন দেসালিন। কিছু শ্বেতাঙ্গ মিত্রের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা অবশ্য দেয়া হয়।

স্বাধীন হাইতির গঠনতন্ত্রে দাসপ্রথা রহিত করার পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ঘোষণা করা হয়, যদিও কিছু পোলিশ শ্বেতাঙ্গ সেনা অফিসারকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। আরো যে ধারাটি লেখা হয়, সেটি হাইতিকে অনেক দিন ভোগাবে। সেধারা হলো, হাইতিতে বহির্দেশীয়, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ কারো সম্পত্তির মালিকানা নিষিদ্ধ।

দাসপ্রথা রহিত করা হলে কি হবে, লুভেরত্যুর-দেসালিন দু’জনই পূর্ববর্তী খামার ব্যবস্থাকে অটুট রাখেন! তাদের হিসাবে বড় প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চিনি রপ্তানি করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে না পারলে আবার হাইতির স্বাধীনতা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আর বাকি বিশ্বকে দেখাতে হবে না, কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কম নয়?

স্বাধীন হাইতির প্রথম নেতা ও সম্রাট জঁ-জাক দেসালিন, পোর্তো প্র্যান্সের ম্যুরাল চিত্র
নাপোলেওনের সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে যোগ দেয় অধিকৃত পোল্যান্ডের সৈন্যদল, ১৮০০

 

 

 

 

 

 

 

 

ফরাসীদের কাছ থেকে লুইজিয়ানা টেরিটরি কিনে যুক্তরাষ্ট্রের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, ১৮০৩

ফলশ্রুতিতে, সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাস থেকে এবার পরিণত হলো ভূমিদাসে! খামার ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার ও বসবাস করার অনুমতি এদের ছিল না। শহরে যেতে হলে তাদের লাগত পাসপোর্ট। খামার থেকে পালালে দেসালিনের পুলিশবাহিনী খুঁজে এনে আবার খামারে সোপর্দ করত। বলা বাহুল্য, খামারগুলোর মালিক তখন দেসালিনের সেনাবাহিনীর অফিসার আর সৈন্যের দল। আর যেসকল চাষী তাদের ক্ষুদ্র জমিতে স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করত, তাদেরও যাতায়াতের স্বাধীনতা ছিল না। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হত।

অন্যদিকে প্রজাদের উন্নয়নের জন্যে যে শিক্ষা আর অবকাঠামো যেকোন নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজন, তার দিকে কোন নজর দেসালিন দেননি। সাধারণ হাইতিয়ানদের জন্যে দরকার ছিল ভূমিসংস্কার আর বড় খামারগুলো ভেঙে ছোট স্বাবলম্বী চাষাবাদযোগ্য জমি তৈরি। সেসব না করার কারণে প্রাক্তন দাসরা লুভেরত্যুর আর দেসালিন দুজনের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। এগুলি কঠোর হাতে দমন করেন দুজনেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয় হাইতি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির সাথে প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য চললেও ফ্রান্স স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেয়ায় পাশ্চাত্যের বাকি সরকারগুলিও একই পথ অবলম্বন করে। বিশেষ করে ‘অগ্রজ’ যুক্তরাষ্ট্রের এহেন আচরণে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে হাইতির শাসকগোষ্ঠী। ‘স্লেভ লেবারের’ ব্যবহারে উৎপন্ন চিনি-কফির রপ্তানির পয়সায় দেসালিন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কিনেন, আর স্থানে স্থানে দুর্গ তৈরি করা হয় ভবিষ্যত কোন এক যুদ্ধের প্রতিরক্ষার জন্যে।

স্বাধীনতার পর হাইতির শহুরে জনগণ কয়েক বছর উৎসব করে। গ্রামের কর্মঠ কৃষক জনগণের থেকে এদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পর খামার বা প্ল্যান্টেশন ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ক্রীতদাসরা পরিণত হয় ভূমিদাসে, তাদের খামারের নতুন মালিক বনে দেসালিন-লুভেরত্যুরের অনুগত সেনা অফিসাররা। আর তাদের খাঁটনির পয়সায় সরকার সারা দেশে গড়ে তোলে অনেকগুলি অস্ত্রাগার ও দুর্গ।

এভাবে হাইতির সামরিকতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী আর প্রাক্তন দাস প্রজাদের মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সাধারণ হাইতিয়ানরাও সন্দেহবাতিকে ভুগতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সকে নিয়ে নয়। নিজের স্বাধীন জীবনাচরণ নিয়ে, আর তাতে ক্রমাগত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের নাকগলানো নিয়ে।

দেসালিনের ইচ্ছে ছিল দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দেবেন যে কৃষ্ণাঙ্গরা রাজনীতি-অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু তার এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে জনসাধারণের যে স্বাধীনতাটা বিসর্জন দিতে হলো, তাই হাইতির অরিজিনাল সিন। আর সেই পাপের ভার আরেক দফা বাড়ালেন দেসালিন নিজেই — হাইতির স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে!

লাইবেরিয়া – ৩, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রগঠন, ১৮৪০-১৮৬০

১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!

এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।

লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।
লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।

নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।

লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।

লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।

সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।

শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।

এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।

লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।

এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।

লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!

লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।

সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।

লাইবেরিয়া – ১, শুরুর কথা, ১৮০০-১৮২০

জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থান
লাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।

আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।

কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।

লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার

লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।

মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।

পল কাফি, ১৭৫৯-১৮১৭
নিউ ইয়র্কের কলোনাইজেশন সোসাইটির মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট, ১৮৩৭

কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।

জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।

এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’

যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।

আফ্রিকার দাসবাণিজ্য

হাতির দাঁতে বানানো অসাধারণ এ মুখোশটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামে। তৈরির স্থান পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন সাম্রাজ্য, কাল আনুমানিক ১৫২০। মডেল, সাম্রাজ্যের অধিকর্তার (ওবা) রাণীমাতা স্বয়ং। মাতৃকুলীন সমাজব্যবস্থায় তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল, যেটা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রতিচ্ছবিতে।

হাতির দাঁতে তৈরি বেনিনের রাণীমাতার আদলে মুখোশ, নিউ ইয়র্ক মেট মিউজিয়াম, ষোড়শ শতক।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল আফ্রিকার মানুষ উন্নত সভ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত নয়। এ চিন্তার মূলে দাসপ্রথা আর বহু শতক পূর্বের দু’জাতের সমতাপূর্ণ সম্পর্কের বিস্মরণ। তারপর আবিষ্কৃত হয় কিছু অসাধারণ ব্রোঞ্জ মূর্তি, আর বেনিন রাজ্য থেকে লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে এরকম কিছু প্রাচীন নিদর্শন। এসব মন্দ কাজের ভাল প্রতিফলও আসে। পশ্চিমা গবেষকরা ত্রিশের দশক থেকে নতুন করে আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ঘাটনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ফিরে আসি মুখোশ প্রসঙ্গে। একটু খেয়াল করে দেখলে মুখোশের চারধারে একটা অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়বে। রাণীমাতার কোঁকড়ানো চুলের একেকটি বিনুনি কিন্তু চুল নয়! অদলাবদলি করে মাডফিশ নামে এক মাছের প্রতিকৃতি, আর এক পর্তুগীজ নাবিকের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব! (২য় ছবি)

বেনিনের রাণীমাতার মুখোশের ডিটেইল।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের মধ্যে উত্থান স্বাধীন পর্তুগাল রাজ্যের। চতুর্দশ শতকে আরব প্রযুক্তি সম্বল করে একটি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন প্রিন্স হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর। নতুন নতুন দূরপাল্লার সব জাহাজ তৈরি শুরু হয়। সেগুলি নিয়ে আটলান্টিকের তীর ধরে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে তারা। মূল লক্ষ্য, ইতালির জেনোয়িজ আর তুরস্কের অটোমানদের একচেটিয়া প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করা।

সেই অভিযানের প্রথম পর্ব আমেরিকা-ভারত নয়, ছিল আফ্রিকার আবিষ্কার। ১৪৬০ থেকে শুরু করে ১৪৯০এর দশক পর্যন্ত পর্তুগীজরা একে একে কাবো ভের্দে দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লেওন, নাইজেরিয়া, বেনিন প্রভৃতি অধুনা আফ্রিকান দেশগুলির উপকূলে অবতরণ করে।

এসব সাবসাহারান দেশগুলি মোটেও অনুন্নত ছিল না, কোন কোনটি ছিল পুরোদস্তুর সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে মালি, বেনিন, সোনিনকে, মালিনকে ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কিছু কিছু জাতি সাক্ষর ছিল যেমন মালির তিমবাক্তু ইসলামী-আরবী সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। আর বেনিন-নাইজেরিয়ার রাজ্যগুলি সাক্ষর না হলেও কাঠ, আইভরি, ব্রোঞ্জ শিল্পে অগ্রসর ছিল।

পর্তুগীজদেরকে এসব জাতি প্রথমে ভেবেছিল তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তিত আত্মা হিসাবে। তাদের ধর্মে সাগর ছিল জীবিত-মৃতের মধ্যে পৃথককারী পর্দা। পর্তুগীজদের শ্বেত বর্ণও তাদের সে ধারণার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রথম সে মোলাকাতে আমেরিকার অ্যাজটেক-ইংকাদের মত শ্বেতাঙ্গদের দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

তারপর ধীরে ধীরে যত সময় গেছে দু’জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। পর্তুগীজ বণিকরা বেনিন, সাপি, কোংগো রাজ্যে তৈরি আইভরি বা হোয়াইট গোল্ড নিয়ে স্বদেশে বিক্রি করেছে। বিনিময়ে আফ্রিকার রাজ্যগুলি কিনেছে পর্তুগীজ আগ্নেয়াস্ত্র।

আজকে অনেকে আফ্রিকান বলতে একটি অভিন্ন জাতি ভেবে থাকলে ভুল ভাববেন। বিভিন্ন ভাষাপরিবারের বিভিন্ন গোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির জন্যে অভ্যন্তরের সাম্রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বন্দুক ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বিনি পর্তুগীজ সল্ট সেলারে চিত্রিত হয়েছে ইউরোপীয় যোদ্ধা, ষোড়শ শতক, ম্যুজে দ্য কে-ব্রঁলি

এছাড়াও পর্তুগালে ছিল সোনা, মরিচ ও রকসল্টের বিশাল চাহিদা। সেগুলিরও সাপ্লাই আসে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে। ৩য় ছবির বেনিন আইভরিতে তৈরি সল্টসেলারটিতে পর্তুগীজ যোদ্ধাকে চিত্রিত করা হয়েছে।

আরো যে রসদটির যোগান দেয় পর্তুগীজদের নেটিভ দোসররা তা হলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। আটলান্টিকের দাসবাণিজ্যের শুরু কিন্তু এটা নয়। আফ্রিকার রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই দাসপ্রথা ছিল। ভিন্নজাতের শত্রুদের পরাজিত করে দাস বানিয়ে তাদের গতর খাঁটানো হত। তাছাড়াও উত্তরের ‘বারবারি কোস্টের’ মুসলিম রাজ্যগুলি দাসব্যবসা করত। একই রকম অবস্থা বিরাজমান ছিল ভারত মহাসাগরের উপকূলে। সেখানে জানজিবার দ্বীপ ছিল আরবে দাস রপ্তানির ঘাঁটি।

পর্তুগীজ-স্প্যানিশ ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা কিন্তু চাইলেই হৈচৈ করে আফ্রিকান দাস ধরে নিয়ে যেতে পারত না। আফ্রিকার অভ্যন্তর অঞ্চলে ঢোকার সাধ্য তাদের ছিল না। কারণ জলাজঙ্গলের ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগশোককে তারা ভীষণ ভয় পেত। আর কম লোকবল নিয়ে বিশাল সেনাশক্তির সাম্রাজ্যগুলির মোকাবিলা করার সাহস-সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আফ্রিকার কলোনিয়ালাইজেশন তুলনামূলক অধুনার ইতিহাস — মোটে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। ততদিনে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের পশ্চিমাদের মত মধ্যযুগীয় পর্তুগীজরা যে কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এরকম মনোভাব পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের পড়শী গ্রানাদার মুসলিম রাজ্যগুলিতে দেখেছে শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টানদের ধরে দাস বানানো হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অনেক ইউরোপীয় দেশে ঋণগ্রস্তরাও দাসে পরিণত হত। অপরদিকে তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকার সুলতানরাও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি থেকে ক্রীতদাস পাচার করত। তাদের অনেকে ছিল সেক্সুয়াল স্লেভ যাদের স্থান হত সুলতানের হারেমে — ছেলে-মেয়ে দুইই।

অর্থাৎ পর্তুগীজদের সাথে প্রথম মোলাকাতের পর আফ্রিকার একাধিক প্রভাবশালী রাজ্যই তাদের দাস সাপ্লাই দিয়েছে। আর কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এটাও ইউরোপে ছিল না। ৪র্থ ও ৫ম ছবিতে রেনেসাঁস যুগে অংকিত চিত্রকর্মে বনেদী কৃষ্ণাঙ্গ দুই ব্যক্তির ছবি দিয়েছি। সত্যি বলতে একটা সময় দাস আর বনেদীবংশ মিলে কৃষ্ণাঙ্গরা লিসবন শহরের জনসংখ্যার দশ শতাংশ হয়ে যায়।

১৫৭০ থেকে ১৫৮০র মধ্যে আঁকা এ ছবিতে পর্তুগালের লিসবন বন্দরের দৈনন্দিন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়সওয়ারের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু কসমোপলিটান ব্যাপারস্যাপার চলে এসেছে।
১৫২০/২৫এ ডাচ চিত্রকর ইয়ন মোশতারতের আঁকা পোরট্রেট অফ অ্যান আফ্রিকান ম্যান।

দাসবাণিজ্যে জোয়ার আসতে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কার ও স্প্যানিশদের প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে। একটি ত্রিমুখী বাণিজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। আফ্রিকা থেকে ‘কাঁচামাল’ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খালাস। সে ‘কাঁচামালের’ শ্রমে উৎপন্ন চিনি, রাম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি। তারপর ইউরোপের বন্দুক ও ফিনিশড গুডস নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা, বিনিময়ে আবার ‘কাঁচামাল’ জাহাজে উঠানো।

আফ্রিকান শ্রমের এরকম এবিউজ হয়ত হত না যদি না কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন পশ্চিম আফ্রিকার রাজ্যগুলিকে ওলটপালট করে দিত। প্রাচীন মালি সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি ছোট ছোট রাজ্যগুলির সাথে নতুন বড় সাম্রাজ্যগুলির সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সপ্তদশ শতকে ঘানার আশান্তি সাম্রাজ্য বেশ প্রতাপশালী হয় ওঠে। কৃষিতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে তারা উত্তরে ও পশ্চিমে মালিংকে রাজ্যগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসদের একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়।

একই ঘটনা ঘটে আরেকটু পূর্বে। নবাগত দাহোমে জাতি মূল জনগোষ্ঠী এদোদের ওপর শাসন কায়েম করে। সে ব্যবস্থায় বিজিতরা ছিল দাস। দাহোমের উপকূলেও দাসরপ্তানিকেন্দ্র গড়ে ওঠে।

অর্থাৎ আফ্রিকার পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ ছিল আটলান্টিক দাসব্যবসার বিশাল আকারের অন্যতম বড় কারণ। ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা হয় সেই মার্কেটের এন্ড ইউজার। যদি আফ্রিকান মিডলম্যানরা বলত দাস সাপ্লাই বন্ধ, তাহলে ইউরোপীয়দের পক্ষে শ্রম আমদানির উপায় হত হয় ইনডেনচার্ড সার্ভিচ্যুড — যেটার শিকার দাসপ্রথাপরবর্তীকালে দরিদ্র আইরিশ-স্কটিশ-ইংলিশরা হয়েছে। নয়ত পেইড লেবার।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আর মার্কিনরাই আবার প্রথম দাসব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে। প্রথমে নিজেদের বন্দরে ক্রীতদাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এই শতকের প্রথমভাগে। এরপর ব্রিটিশরা জোরপূর্বক স্প্যানিশ-পর্তুগীজ জাহাজে হামলা চালিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করত। ব্রিটিশ-ফরাসীরা উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টের সুলতানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেসব রাজ্যের জলদস্যুতা আর শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের ধরে দাস বানানোর প্রতিশোধ হিসাবে। (৬ষ্ঠ ছবি)

অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ার তুর্কিসমর্থিত দা’ইয়ির রাজ্যে শ্বেতাঙ্গ দাসত্বের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলি শোরগোল তোলে। ব্রিটিশ এক কাপ্তানের বর্ণনা সম্বলিত এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তখন। ১৮১৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আলজিয়েরস আক্রমণ করে।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নতুন দাস রপ্তানি বন্ধ হলেও মার্কিনদের স্বদেশে এতদিনে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আগমন হয়েছে, তাদের দাস বংশধরদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা হয়নি। তার জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক দশক ও একটি যুদ্ধের জন্য। পশ্চিমা ও পশ্চিমাশাসিত দেশগুলির মধ্যে সবচে’ শেষে দাসপ্রথা রহিত হয় পর্তুগীজ ব্রাজিলে — ১৮৮০র দশকে।

আরব দেশগুলিতে দাসবাণিজ্য চলে ত্রিশের দশক পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এখনো তা চলছে। ৭ম ছবিতে মক্কার এক বণিকের পাশে তার শ্বেতাঙ্গ দাসকে দেখা যাচ্ছে। তার চেহারাতে পূর্ব ইউরোপীয় স্লাভিক ছাঁচ দৃশ্যমান। এরা অটোমান সাম্রাজ্যে পরিচিত ছিল সিরকাসিয়ান হিসাবে।

মক্কার হেজাজী সওদাগরের সাথে তার শ্বেতাঙ্গ সিরকাসিয়ান দাস, ১৮৮৬-৮৭

আফ্রিকান আমেরিকানদের বেদনাময় ইতিহাস এখনো মার্কিন রাজনীতিতে অহরহ আসে। এই বিতর্কে কতটা হিস্টরিকাল কনটেক্সট টানা হয় তা খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। এতে কোন সন্দেহ নেই, মার্কিনদের দাসপ্রথার ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক অধুনা ইতিহাসে এর আগের একাধিক শতকের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ-স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে।

আরো ঢাকা পড়ে গেছে আটলান্টিক দাসব্যবসার কৃষ্ণাঙ্গ মদদকারীদের ইতিহাস। পোস্ট কলোনিয়াল আফ্রিকার প্রথম স্বাধীন দেশ ঘানা। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট কয়ামে ন্ক্রুমা প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা (৭ম ছবিতে চে গেবারার সাথে)। তার হাত ধরেই আরো বহু সাবসাহারান দেশ স্বাধীন হয়। সেসব দেশের স্কুল কারিকুলামে পড়ানো হয় প্রাচীন আফ্রিকান দেশগুলির প্রতিপত্তি-অগ্রগতির কথা। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিদের অত্যাচারের কথা। সবই খাঁটি কথা। কিন্তু শুধু চেপে যাওয়া হয় ন্ক্রুমার স্বগোষ্ঠী আশান্তিরাই যে ছিল অন্যতম মদদকারী দাসরপ্তানীকারী রাজ্য সে কথা। চেপে যাওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার এলিট বংশগুলির কথা, যারা দাসব্যবসা করে স্বদেশে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল একটি ভবিষ্যত দিয়ে গেছে।

কিউবার বিপ্লবী চে গেবারার সাথে ঘানার প্রেসিডেন্ট কওয়ামে ঙ্ক্রুমা, ১৯৬৫। চে সে যাত্রায় আটটি আফ্রিকান দেশ সফর করে বাছবিচার করেন কোন কোনটিতে বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে।

২০১৯এ ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে একটি সাড়াজাগানো আর্টিকেল লিখে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার হন আদাওবি নওয়াউবানি নামের এক নাইজেরিয়ান পুরস্কারবিজয়ী লেখক। আজকের পলিটিকাল ক্লাইমেটে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অবিচার নিয়ে যারা সঙ্গত কারণেই সোচ্চার, আশা করি সেটা করার পাশাপাশি মুদ্রার এপিঠটাও তারা একটু উল্টে দেখবেন। আদাওবির লেখাটি পড়তে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!