কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৪

আগের পর্বগুলোতে বলেছি অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর নোংরা পদ্ধতির বৃত্তান্ত। এপর্বে বলবো ২০১৬-এর ব্রেক্সিট নির্বাচন আর মার্কিন সাধারণ নির্বাচনে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর অসত্য প্রচারণার ভূমিকা। আর আগামী পর্বে তাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের করণীয় কি তাই বলে শেষ করব।

উপরের দুই নির্বাচনের আগেই কিন্তু অ্যানালিটিকার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়েছে। পুতিনের রাশিয়াতে এটি পেয়েছে শৈল্পিক রূপ, তার ওপর সেখানে টেলিভিশন-রেডিওও সরকারের (বা পুতিনের নিকটজনের) একচেটিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে, আর ফেসবুকের পরিবর্তে আছে তার ক্লোন ভ্কন্তাক্তিয়ে, যেটা পুতিনের ট্রোলে ভর্তি। তার ফলে আপনারা এমাসেই দেখলেন রুশে পুতিনের ৭৫% ভোটে জয়লাভের নির্বাচন নামের ভং। চীনসরকারও এসব পদ্ধতি ২০০৮-এ তাদের তিব্বত আর শ্শিনজিয়াং-উইগুর প্রদেশের প্রতিবাদ দমাতে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশ, যাদের গণতন্ত্র এদের থেকে বেশি টেকসই আর পরীক্ষিত, ২০১৬তে তাদের ওপরে এসব পদ্ধতি প্রথম সফলতা পায়।

ব্রেক্সিট নির্বাচন হয় ২০১৬র জুনে। তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাবার (বা ব্রেক্সিটের) স্বপক্ষে প্রায় ৫২% ভোট পড়ে, ৭২% ভোটার ভোট দেয়, আর দু’দলে ভোটের তফাত ছিল মোটে ৬লাখ, সাড়ে চার কোটি ভোটের মধ্যে। অর্থাৎ মোটামুটি ১%-এর মধ্যে ফটোফিনিশ। এ নির্বাচনের আগেও দু’দলে বিতর্ক-বিভক্তি হয়েছে অনেক, বিদেশী অভিবাসী-রেফ্যুজি, অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘অন্যায্য’ দাবি-দাওয়া, এসব ছিল হট টপিক। বিশেষজ্ঞরা অনেকভাবেই দেশের মানুষকে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলেন যে এর ফলে যুক্তরাজ্যের যারপরনাই অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্রেক্সিটের স্বপক্ষে ছিল এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসনের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির এক সুবিধাবাদী বিদ্রোহী গ্রুপ, তদ্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন ছিলেন এর বিপক্ষে। আরো স্বপক্ষে ছিল ইউকিপ নামে কট্টর জাতীয়তাবাদী এক পার্টি আর তার নেতা নাইজেল ফারাজ।

ফারাজকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সেই একই ভিলেন রবার্ট মার্সার! তারা ইউকিপকে সাহায্য করে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, কিন্তু তার বিনিময়ে অ্যানালিটিকা নাকি কোন পয়সা নেয়নি। অর্থাৎ এই সার্ভিস ছিল মার্সারের দেয়া ‘উপহার’। যুক্তরাজ্যের আইনে এ অবৈধ, কারণ মার্সার ব্রিটিশ নাগরিক নন। এনিয়ে সেদেশের পার্লামেন্টে এখন তদন্ত চলছে। অপরদিকে বোরিস জনসন গিয়ে ধরেন অ্যাগ্রেগেট আইকিউ বলে এক কানাডিয়ান কম্পানিকে, একই কাজের জন্য। যেটা পরে বেরিয়েছে সেটা হল অ্যাগ্রেগেট আইকিউ হলো গিয়ে কানাডায় কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মাতৃসংস্থা এসসিএলের নাম-ভাঁড়ানো ফ্রন্ট কম্পানি! জনসনের ভোট লীভ প্রচারণীদল তাদের পয়ত্রিশ লাখ পাউন্ড দেয়। দুইদলের মধ্যে নির্বাচনী তহবিল নিয়ে যোগসাজশের সম্ভাবনা আছে, এবং তারা আইনের সীমালংঘন করে বেশি অর্থ খরচ করেছে কিনা পার্লামেন্ট এ নিয়েও তদন্ত করছে।

এপ্রসঙ্গে দু’টো বৃত্তান্ত না বললেই নয়। ইউকিপের ফারাজ মিথ্যা প্রচারণা চালান একটি চটকদার পোস্টারের মাধ্যমে, যেটায় কিছু সংবেদনশীল শ্লোগানের সাথে দেখানো হয় হাজার হাজার আরব-এশিয়ান চেহারার অভিবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ডার ক্রসিংয়ে। এই চিত্র দেখিয়ে ব্রিটেনের যারা খেঁটে খাওয়া মানুষ (যাদের সামান্যসংখ্যকই বর্ণবাদী) তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, এরা ব্রিটেনে ঢুকলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পোস্টার দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ভোটারদের মাইক্রোটার্গেট করা হয়। বোরিস জনসনেরও প্রচারণার অংশ ছিল একটা ডাবলডেকার বাস যার গায়ে লেখা যে ব্রিটেন নাকি ইইউকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড পাঠায়, সে টাকা তাদের এনএইচএস নামের সরকারি গণস্বাস্থ্য প্রকল্পে ব্যয় করলে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার হত। বোরিসের সাথে লন্ডনের গর্বের প্রতীক ডাবলডেকার ব্রিটেনময় ঘুরে বেড়ায়, তার ছবিও ইন্টারনেটে মধ্যবিত্ত ব্রিটিশদের টার্গেট করে ছাড়া হয়।

বলা বাহুল্য দু’টোই মিথ্যাপ্রচারণা। সেই ‘অভিবাসীচিত্র’ আসলে ছিলো ক্রোয়েশিয়া-স্লোভেনিয়া বর্ডারে শরণার্থীশিবিরের ছবি, যারা দাতব্য সংস্থা ও জাতিসংঘের অর্থসাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আর ইইউকে ব্রিটেন যত টাকা পাঠায় তার থেকে বেশি অংকের সুবিধা তাদের থেকে পায়, অর্থের আকারে না হলেও। যথারীতি মানুষের মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিটের স্বপক্ষদল কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের সাহায্যে অবিশ্বাস্যজনকভাবে জিতে যায়।

ট্রাম্পের বিজয় ছিল সেরকমই অবিশ্বাস্যকর। বলছি কিভাবে সে কাহিনী অন্যরকম হতে পারত, তার আগে বলি কেম্ব্রিজ অ্যানালাটিকার সম্পর্ক। ট্রাম্পের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করে অ্যানালিটিকা। ট্রাম্পের সাথে কাজ শুরু করার আগেই তাদের নেটওয়ার্ক ১৭টি স্টেটে বিস্তৃত ছিল। রিপাবলিকান প্রাইমারির পরে তারা এই নেটওয়ার্ক আরো বাড়ায় আর ট্রাম্পের পক্ষে অনলাইন অ্যাডভার্টাইজিং করে, ফেসবুক-টুইটারে ফেক প্রোফাইল দিয়ে সম্ভাব্য ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেকসময় পার্সোন্যাল মেসেজও পাঠায়। পুতিনের রুশ ট্রোলরাও একই ভাবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে। ‌অ্যানালিটিকার কর্মকর্তারা প্রায়শই গর্ব করে বলেছে যে তারা ট্রাম্পের ডিজিটাল প্রচারণা থেকে দেশের কোন অঞ্চলে তার নির্বাচনী সমাবেশ করতে হবে, এসবকিছুই নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। তারা উইকিলিকসের জুলিয়ান আসাঞ্জের সাথে যোগাযোগ করে ক্লিনটনের কেলেংকারিময় ইমেল সংগ্রহের জন্য। রুশ হ্যাকারদের থেকে আসাঞ্জ এগুলোর কিছু পেয়েছিলেন, এখন তিনি দাবি করছেন যে তিনি নাকি অ্যানালিটিকাকে এগুলি দেননি। কিন্তু পরে ঠিকই ব্যক্তিগত আক্রোশবসত সময়মত (ট্রাম্পের হলিউড অ্যাক্সেসের কেলেংকারি ভিডিও যেদিন বেরুলো) এগুলো প্রকাশ করেন।

আমরা ‌অনেকেই জানি না যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা মোটামুটি বড় মাইনরিটি সাধারণত ভোট দেয় না, তারা ভাবে কোন পার্টিই তাদের স্বার্থ দেখে না। এদের কিছু হয়ত বর্ণবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যপাদী, স্রেফ বাইকার বা দন্তনখরহীন কন্সপিরাসি থিওরিস্ট। এরাও কিন্তু ইন্টারনেটে যাওয়া-আসা করে এবং তাদের ওয়েবসাইট-ফোরাম ইন্টারনেটের কোনা-কাঞ্চিতে বিপুল পরিমাণে আছে। গুগল-ফেসবুকের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বে বোঝানো পদ্ধতিতে তাদের চিন্তাধারা কি আর তারা আসলে কি চায় তা জানা সম্ভব, এবং তৃতীয় পর্বের পদ্ধতিতে তাদেরকে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ‘রিইনফোর্সিং মেসেজ’ দিয়ে কোন নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে রাজি করানো সম্ভব। ট্রাম্প যখন দাবি করেছেন যে তাঁর কারণে বিপুল পরিমাণ ভোটার রিপাবলিকান পার্টিতে এসেছে, কথাটা সত্য। সাধারণ রিপাবলিকানদের সাথে ওপরের ঐ গোষ্ঠীর ভোটও যোগ হয়েছে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা এই কাজটা সফলভাবে করেছে, আর ট্রাম্প তাদের এজন্য ৬২ লাখ ডলার দেন। আমার ধারণা ট্রাম্প সত্যিকার অর্থে কট্টর রেসিস্ট নন, কিন্তু তার পক্ষে বর্ণবাদী লেবেলটা অস্বীকার করাটাও সোজা নয়, কারণ তিনি সে ধরনের ভোটারদের ব্যবহার করেছেন। তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা — যারা তার সুরে আকৃষ্ট হয়েছে, তাদের একটা ছোট্ট অংশ ইঁদুর হতে পারে, কিন্তু তিনি নিজে সম্ভবত তা নন, তিনি স্রেফ একজন সেলসম্যান।

একথাও এখানে বলা জরুরী যে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণারও একটা বড় অংশ ছিল ডিজিটাল। কিন্তু তার অ্যানালিটিকাবাহিনীর পদ্ধতি নিয়ে কেউ এখনো প্রশ্ন তোলেনি, তুললে ট্রাম্পই সবার আগে গলাবাজি করে টুইটারে সত্য-মিথ্যা কিছু একটা দাবি করতেন। তার মানে এই নয় যে জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরিতে ক্লিন্টনের প্রচারণী ফার্মের কোনই ভূমিকা নেই।

এখন বলি এরকম অসম্ভাব্য ফলাফল কিভাবে হলো। অনেকেই হয়ত জানেন ক্লিনটন পপুলার ভোটে ট্রাম্পের থেকে প্রায় ৩০লাখ বেশি পেয়েছেন, সেটা মোট ভোটের ২.১%। ইলেক্টরাল কলেজ বলে একটা ব্যাপার আছে এদেশে, যার কারণে প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। একেকটা স্টেটের জন্য বরাদ্দকৃত কিছুসংখ্যক ইলেক্টরাল ভোট আছে, বেশিরভাগ স্টেটের নিয়মানুযায়ী যিনি সেখানে সবচে বেশি ভোট পাবেন, সে যতটুকু ব্যবধানেই হোক, তিনিই পাবেন সে স্টেটের সকল ইলেক্টরাল ভোট। আমেরিকার রাষ্ট্রনির্মাতারাই ইচ্ছা করে এরকমটা বানিয়ে দিয়ে গেছেন, এভাবেই দু’শতাধিক বছর ধরে চলছে, আর এটাকে পরিবর্তন করাও সহজ নয়। এধরনের ‘অন্যায্যতা’ রাখার কারণ হলো যেন কোন অসদুদ্দেশ্যের প্রার্থী চাইলেই জনগণের ভাবপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে পপুলার ভোটে বিজয়ী না হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পুরনো নিয়মটিকেই পুরোপুরি ‘গেম’ করা হয়েছে।

অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী তাদের তহবিলের অধিকাংশ টার্গেট করে ‘রাস্ট বেল্ট’ বলে জনবহুল একটি অঞ্চলে। সেখানকার জনগোষ্ঠী নানাকারণে খারাপ সময় পার করছে। পঞ্চাশ বছর আগে তাদের বাপ-দাদারা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে সমৃদ্ধি পেয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মান। অনেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ধরনের চাকুরিদক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেরকে পুরনোদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা ছিল সহজ। ট্রাম্পও অ্যানালিটিকার হিসাব অনুযায়ী এসব জায়গায় গিয়ে বিশাল সমাবেশ করেন, কিন্তু ক্লিনটন বলতে গেলে সেসব জায়গায় যানই নি, ভেবেছেন গত দু’নির্বাচনের মত এরা ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেবে। অথচ এরাই সুইং স্টেট, যাদের ভোটে শেষ ফলাফল নির্ধারিত হয়। সেসব জায়গায় অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা তাই চলেছে বেশি, ডেমোক্র্যাট শ্বেতাঙ্গ খেঁটে খাওয়া মানুষদের ব্রেক্সিটের উপায়ে কব্জা করা হয়েছে, আর ডেমোক্র্যাট কৃষ্ণাঙ্গদের বোঝানো হয়েছে কালো প্রেসিডেন্টের আমলে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, তাই তারা ভোটই দিতে যায়নি

হিসাব দেখুন। পেন্সিলভানিয়াতে ট্রাম্প জিতেছেন মাত্র ৪৪,০০০ ভোটের ব্যবধানে, সেটা সেখানের মোট ভোট ৬৩ লাখের ০.৭% মাত্র, সেখানের ইলেক্টরাল ভোট পেয়েছেন ২০টি। উইস্কনসিনে জিতেছেন ২৩,০০০ ব্যবধানে, সেটা মোট ভোট ৩০ লাখের ০.৩% মাত্র, ইলেক্টরাল ভোট ১০টি। মিশিগানে জিতলেন মা-আ-ত্র ১১,০০০ বেশি পেয়ে, মোট ভোট ৪৭ লাখের ০.৩%! ইলেক্টরাল ভোট ১৬টি। তার সাথে যদি আরেকটা ছোট স্টেট নিউ হ্যাম্শায়ারকে যোগ করি, সেখানে আড়াই হাজার ব্যবধান, মোট ৮ লাখের ০.৩%, ইলেক্টরাল ভোট ৪টি। অর্থাৎ ৫০টি ইলেক্টরাল ভোট খুবই চুলচেরা ব্যবধানে জিতেছেন। পুরো ইলেক্টরাল ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩০৪, ক্লিনটন ২২৭। ৫০ ইলেক্টরাল ভোট আর সাড়ে ৮০ হাজার পপুলার ভোট (মোট ভোটের ০.০৬%!) এদিক-ওদিক হলে ট্রাম্প পেতেন ২৫৪ ভোট আর ক্লিনটন ২৭৭ পেয়ে আজ থাকতেন মার্কিনের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৩

দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত যা কিছু বললাম, শুনতে ভয়াবহ মনে হলেও বেআইনি নয়, আর অনেকে হয়ত গায়েও লাগাবে না, কারণ মার্কিনে এসব নিত্যনৈমিত্তিক। আপনার যদি সর্পতৈলে আসক্তি থাকে, তিতাস মলমে আপনার আগ্রহ জন্মাতেই পারে। ফেসবুক যদি সেটার খবর আপনাকে দিয়ে দু’পয়সা কামিয়ে নেয়, ক্ষতি কি? যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব অবৈধ নয়, যতক্ষণ না আপনি (বা আপনার পক্ষে সরকার) প্রতারণার মামলা ঠুকে দিচ্ছে।

এপর্বে বলবো পরের ধাপটা কি, আর কিভাবে দুষ্ট লোকেরা আমার-আপনার-সবার ক্ষতি করছে।

অ্যানালিটিকার মত ফার্ম সম্ভবত এখনো এক কোটির মধ্যে একজনকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিনপয়েন্ট করে চিহ্নিত করতে পারে না, কিন্তু সমমনা মানুষদের একটা কম্যুনিটিকে পারে। সোজা উদাহরণ দিই। তারা তাদের তথ্যভান্ডারের উপর মেশিন লার্নিং কোরিলেশন অ্যালগরিদম চালিয়ে বের করলো যে যেসব পুরুষদের গোলাপীরং ভীষণ অপছন্দ তাদের অধিকাংশই গেদের ঘৃণা করে, তার সাথে যদি তারা রংধনুপতাকাওলা পোস্টে রাগের ইমো দেয়, তাহলে তো মিলেই গেল। তারা বের করলো যে আপনার জিপকোডে এরকম মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশ, কিন্তু ভোট দিতে যায় মাত্র ২০ শতাংশ। মার্সারপরিবারও গেদের দেখতে পারে না। তারা অ্যানালিটিকাকে বলল আপনার ভোটটা কব্জা করতে। অ্যানালিটিকা ফেসবুকের অ্যাডভার্টাইজিং প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আপনার জিপকোডকে টার্গেট করলো। একে বলে মাইক্রোটার্গেটিং, জিপকোডের সাথে অন্যান্য ক্যাটেগরির সেটের ইন্টারসেকশন করে তারা আপনার এলাকার সমমনা মানুষকে মাইক্রোটার্গেট করতে পারে।

তো সেই উপায়ে আজকে আপনার ফেসবুক ফীডের স্পন্সরড কন্টেন্টে দেখালো এমন একটা খবর যাতে আপনার পিত্তি জ্বলে যায়, ধরুন আপনার এলাকার কোন পদে একজন ডেমোক্র্যাট গে বা লেজ (উল্টোদিক থেকে চিন্তা করলে রিপাবলিকান তথাকথিত হোমোফোব) নির্বাচনপ্রার্থী। খবরটা সত্য হতে পারে, আর অসত্য হলেও আপনি জাংক মেইলের মত ট্র্যাশ করবেন না, মনে মনে একটা রাগের সুড়সুড়ি অনুভব করবেন এবং আপনি এটা মনে রাখবেন। হয়ত আপনার প্রোফাইলে শেয়ারও করবেন, অসত্য বলে আপনাকে কেউ চ্যালেন্জ করবে না, কেউ যেচে পড়ে ঝগড়া করতে যায় না।

পরের হপ্তায় আপনাদের দেখানো হলো ট্রাম্পমামু ইলেকশানে জিতলে বলেছেন কোনো গে-লেজের সাধ্য নাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। মনে একটু আনন্দের সুড়সুড়ি লাগলো, লাইক দিলেন এবং ফেসবুকের অ্যালগরিদমও বুঝে নিল পরেরবার আপনি কি লাইক করবেন। অর্থাৎ এবার হয়ত স্পন্সর্ড কন্টেন্টও লাগবে না, আপনার সমমনা কোন ফ্রেন্ডের ফীড থেকেই এর পরের হপ্তায় পড়বেন নিউইয়র্ক বা ক্যালি, সে যেখানেই হোক, স্কুলের পাঠ্যসূচীতে গে-লেজবিষয়ে জ্ঞানদান করা হবে! সেসব জায়গার বাসিন্দা না হলেও, একজন দায়িত্ববান গার্জেন হিসাবে আপনার কলিজা কেঁপে উঠবে। সত্যাসত্য যাচাই না করে মনে মনে ঠিক করে ফেলবেন কে আপনার ভোটের যোগ্য।

শুধু ইন্টারনেট-ফেসবুক নয়, আপনার লোক্যাল টিভিচ্যানেলেও সমানে আপনাকে সুড়সুড়ি দেয়া হলে আপনি রান্নাঘরের ক্যালেন্ডারে ইলেকশানের তারিখটাকে লাল কালিতে বড় করে কয়েকবার দাগিয়ে ফেলবেন। যদি হাতে খুচরা পয়সা থাকে, সেটাও দান করবেন পছন্দের প্রার্থীর প্রচারণা তহবিলে। আর এই পুরো ব্যাপারটা যে ঘটে চলছে, আপনার পাশের জিপকোডের মানুষ হয়ত টেরও পাবে না! হয়তো তাদের উপর চলছে উল্টো ব্যবস্থা, আর তা নাহলে ভোটের দিন লেজ গুটিয়ে বসে থাকার চিকিৎসা।

উপরের সবকিছুই কিন্তু গে-লেজের সামনে ‘এন্টি’ বসালেও সত্য। যে ঘরানার প্রতিই আপনি সহানুভূতিশীল হোন না কেন, অ্যানালিটিকা না হলেও অন্য কম্পানির থেকে আপনার নিস্তার নেই! মানুষ আকৃষ্ট হয় যেটা তার কাছে জেল্লাদার বা ভয়ের তার দিকে। সত্যকে নয়, সে বিশ্বাস করে সেটাই যা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সত্য জিনিস বলতে গেলে কখনোই জেল্লাদার হয় না। দিনের পর দিন সমানে সুড়সুড়ির পর পাশাপাশি দুই জিপকোডের মানুষ হয়ে যাবে পদ্মার এপার আর ওপার, শুধু চাই বারুদে দিয়াশলাই! শার্লটসভিলে আর বার্কলীতে নির্বাচনের পরপর অনেকটা সেটাই হয়েছে। মানুষ মরেছে এদের এসব খেলার জন্যে!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের পুতিনের রঁসুইঘরের মত বদেরা এসবের থেকেও দু’কাঠি সরেস! আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ আর দৃঢ়বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এক ঘন্টার নোটিসে দাঁড়া করিয়ে ফেলবে ভুয়া খবরভরা বিশ্বাসযোগ্য দেখতে খবরের কাগজের ওয়েবসাইট। সত্য খবর বের করা আর লেখা কিন্তু অনেক কঠিন কাজ আর ব্যয়বহুল, সাংবাদিকতায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় (সেকাজটার ০.১ শতাংশমাত্র আমি এমুহূর্তে করছি!)। মিথ্যা খবর বানানো বহুত সস্তা আর সহজ, একটা ল্যাপটপ নিয়ে কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতে আপনিও বানিয়ে ফেলতে পারবেন।

তাই ধরুন, কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক নামকরা কাগজ না ঘাঁটিয়ে গুগলে হয়ত খুঁজতে গেলেন মিশিগানে হিজাবধারীদের পেটানো হচ্ছে নাকি না, গুগল তাকে হাজারখান ভুয়া খবর দেখাবে তার ধারণার স্বপক্ষে, একটা সত্যও দেখাবে না কারণ খবরটা সত্য নয় — কিন্তু সে কিন্তু বুঝবে উল্টো! আমাদের অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী এধরনের বানোয়াট খবর এসইওর মাধ্যমে গুগলে সবার উপরে বসাবে আর উপরের ফেসবুকীয় পন্থায় পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে। সেসব মিথ্যা খবরকে পরখ করে সত্যটা বের করে জানাতে কিন্তু আসল সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে যাবে, সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, কারণ ‌অসত্যের তো কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, সত্যেরও মা-বাপ নেই, কী বের করবে তারা! ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।

ভু্য়াখবরের সাথে সাথে অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী চটকদার ডায়ালগসমৃদ্ধ রাজনৈতিক কার্টুন, ভিডিও, জেপেগ বা জিফও বানায় (এগুলিকে বলে ‘মীম’), তাতে তো আরো মহা সুড়সুড়ি! আর দুনিয়ার কোটি কোটি সস্তা চীনা মোবাইল থেকে হ্যাক করে চুরি করা অন্য মানুষের ছবি আর তথ্যও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলি দিয়েও অ্যানালিটিকা বানিয়ে রেখেছে হাজারো ফেক প্রোফাইল (এ ব্যাপারে পরে সুযোগ হলে প্র্যাকটিক্যাল দেখাব), তাদের মাধ্যমে হাজারো লাইক দিয়ে দিয়ে কোন একটা অসত্য খবর বা মীমকে ভাইরাল বানিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।

আপনি হয়তো ফেক নিউজের ব্যাপারে খুবই, মানে খু-উ-ব-ই সাবধানি। এর থেকেও বিশ্বাসযোগ্য চান? শুনুন সিইও নিক্স সাহেবের বাণী। লিংক: https://youtu.be/mpbeOCKZFfQ

যুক্তরাজ্যের দু’তিনজন সাংবাদিক এই ভিডিওতে সেজেছেন শ্রীলংকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তার সহকারী, যাদের বাসনা সেদেশে রাজনীতি করে সফল হওয়া। সে উসিলা নিয়ে কথা বলতে গেছেন কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কর্মকর্তাদের সাথে, সাথে গোপনে রেকর্ড করেছেন কথোপকথন।

তাতে নিক্স সাহেব উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কিছু উপায়। উপরেরগুলিতো বলেছেনই, তার ওপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে যদি প্রতিপক্ষ খুব ভালো হয় আর তার নোংরামির কোন প্রমাণ না থাকে তাহলে কি করবেন। উত্তরে নিক্স বলছেন যে তারা প্রতিপক্ষের কাছে ভিনদেশী ব্যবসায়ী সেজে যাবেন, দেখাসাক্ষাত করে তাদের আস্থাঅর্জনের পরে কোন বেআইনি সুবিধার বিনিময়ে উৎকোচের প্রস্তাব করবেন। কিংবা উক্রেনীয় সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে যাবেন মিটিংয়ে, সেই জল আরো কিছুদূর, হয়ত বেডরুম পর্যন্ত, গড়াবে। আর গোপন ক্যামেরাতে এসব রেকর্ড করার পরে সেটা জমা থাকবে ইলেকশানের আগের রাতে ফেসবুক বা ইউটিউবে ছাড়ার অপেক্ষায়। জল যদি বেশিদূর নাও গড়ায়, ভিডিও এডিট করে অন্তত নোংরা একটা রূপ দেয়া সম্ভব। এবং সেটুকুই হয়ত সামান্য ভোটের মার্জিনে জেতার জন্য যথেষ্ট। পুতিনের আগের জীবনের কর্মস্থল সোভিয়েত গোয়েন্দাসংস্থা কেজিবি স্নায়ুযুদ্ধের সময় এপন্থার নিশ্ছিদ্র সদ্ব্যবহার করে, একে তাদের ভাষায় বলে কমপ্রোমাত (অনেকের সন্দেহ পুতিন সরকারের কাছে ট্রাম্পের কেলেংকারিময় কমপ্রোমাত আছে)।

ঐ একই আন্ডারকাভার ভিডিওতে ‌অ্যানালিটিকা দাবি করছে যে তারা সফলভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নামে-বেনামে এসব নোংরামির পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। তার মধ্যে তারা বলেছে আমেরিকা, কেনিয়া-নাইজেরিয়ার মত আফ্রিকার দেশ, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, চীন আর পূর্ব ইউরোপের ‌অনুল্লিখিত একটি দেশের কথা।

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ২

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। কম্পানিটি নিবন্ধিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে, আর লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে তাদের অফিস আছে। প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্স এখন সাসপেন্ডেড, তিনি ‘ম্যানসিস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কম্পানিটির কাজ হলো ‘ড্যাটা-মাইনিং’ আর ‘বিগ ড্যাটা অ্যানালিসিস’-এর সাহায্যে কর্পোরেট আর রাজনৈতিক মক্কেলের স্বপক্ষে মানুষের চিন্তাধারা আর আচরণ পরিবর্তন করা। সোজা কথায় ‘মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন’! কম্পানিটির যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে, এস,সি,এল বলে আরেক কম্পানির অধীনে। এসসিএলের ব্যবসাও একই রকম, তারা অ্যানালিটিকার মূলধনের ১০% দেয়, আর বাকি ৯০% আসে রবার্ট মার্সারের থেকে।

যারা মার্সার পরিবারের নাম শুনেননি, একটু খুঁজে দেখুন! রবার্ট আর তার মেয়ে রেবেকা চরম রক্ষণশীল আর ট্রাম্প-ব্যাননের সবচে’ বড় পৃষ্ঠপোষক। মার্সার ছিলেন আইবিএমের নামকরা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ, পরে নিজে একটা স্টকে বিনিয়োগের ব্যবসা শুরু করেন, যেখানে তার আবিষ্কৃত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বিলিওনিয়ার বনে যান। পরে ব্যাননকে ব্রাইটবার্ট নিউজ দাঁড়া করাতেও সাহায্য করেন অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে। রেবেকাই ব্যাননকে মোলাকাত করিয়ে দেন ট্রাম্পের সাথে। এখানেই শেষ নয়, ব্যানন ছিলেন অ্যানালিটিকার ভিপি, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার দায়ভার নেয়ার আগে। ট্রাম্পের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন, যিনি রুশদের সাথে দহরম মহরম করে রবার্ট ম্যুলারের কাছে ধরা খেয়ে বসে আছেন, তিনি ছিলেন এসসিএলেরও উপদেষ্টা। আটলান্টিকের ওপারে ব্রেক্সিটের সমর্থনকারী তিনজন ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির রাজনীতিবিদেরও অ্যানালিটিকাতে ‘অর্থলগ্নি’ আছে। বুঝতেই পারছেন যে এই কম্পানি গভীর জলের তিমিমাছ!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করছে যে, তাদের কাছে ২২ কোটিরও বেশি মার্কিনবাসীর প্রত্যেকের ৫ হাজার শ্রেণীর তথ্য আছে। আর সেগুলি ব্যবহার করে তারা সমমনা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে টার্গেট করতে পারে, আর কি ধরনের ইনপুটে তাদের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে তা আন্দাজ করতে পারে। তারা ভেঙে না বললেও ধরে নিতে পারি যে তাদের কর্মচারীদের মধ্যে ড্যাটা সায়েন্টিস্ট, মনস্তত্ত্ববিদ, ডিজিটাল ওয়েবপেজ, ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য কন্টেন্ট সৃজনবিশারদ আছেন। এস,ই,ও জিনিসটাও খুঁজে দেখবেন, এটা হলো গুগল আর অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে কিভাবে আপনার ‘প্রডাক্টটা’ (সেটা নির্বাচনপ্রার্থীও হতে পারে) আর সব প্রতিযোগীর থেকে উপরে উঠে আসবে, তার শিল্প। আরও যেটা না বললেই নয়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গেও পুতিনের ‘বাবুর্চির’ পরিচালিত একই রকম একটা ট্রোল ফার্ম আছে, যার তেরজন কর্মকর্তাকে রবার্ট ম্যুলার দোষীসাব্যস্ত করেছেন ২০১৬ নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে।

অ্যানালিটিকা এত তথ্য পেলো কীভাবে?

এটা মনে রাখবেন যে ফেসবুক-গুগলের কাছে আপনি হয়ত সোশ্যাল সিক্যুরিটি বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেননি, কিন্তু তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে সেটা আরো মোক্ষম, সেটা হলো আপনার অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছানোর চাবিকাঠি!

অ্যানালিটিকা যোগসাজশ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রুশ-মলদোভান বংশোদ্ভূত লেকচারার আলেকসান্দ্র্ কোগানের সাথে। এই লোক রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন (উপরের ঐ একই শহরে!) আর রুশ সরকার থেকেও ‘গবেষণার’ টাকা পেয়েছেন। ২০১৪ সালে একটা ফেসবুক অ্যাপ বানান, যার নাম ThisIsYourDigitalLife। গবেষণার উসিলায় ফেসবুক তাকে অনুমতি দেয় অ্যাপটির মাধ্যমে শুধু অ্যাপের ব্যবহারকারী নয়, তাদের ফ্রেন্ডদেরও প্রোফাইল ঘাঁটানোর। মনে মনে ভাবুন, আপনি সেই অ্যাপ, অনেক ‌অপরিচিত মানুষের প্রোফাইল-ছবি-ভিডিও-নোটস দেখছেন, তারা সাদা না কালো, কোথাকার বাসিন্দা, জন্ম কবে, বয়স কত, একলা না দোকলা, কিসে কিসে লাইক দিল, স্ট্যাটাস আপডেট অনুযায়ী সে সুখী না দুখী, গেদের দুচোক্ষে দেখতে পারে কি পারে না, কোন গ্রুপে যাতায়াত, হোক্সনিউজ দেখে না চিকেন নুডুল, মাসে কয়বার কোন রেস্টুরেন্টে চেকিন করে, মাকড়সা ভয় করে নাকি আরশোলা, তারা কার বা কিসের প্রতি দুর্বল, যদি আইপি অ্যাড্রেস পান তাহলে তাদের জিপকোড, ইত্যাদি। সেগুলি দেখে আপনি নিজে যা যা আন্দাজ করবেন, এই তথ্যগুলো দিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তার থেকে শতগুণ বেশি আর শতগুণ দ্রুত আন্দাজ করা সম্ভব। কোগানের এই অ্যাপ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিত্ব কিরকম তা জানার জন্য ব্যবহার করে, অর্থাৎ আরো বেশি কিছু তথ্যও দিয়ে দেয়। এভাবে তিনি দু’মাসের মধ্যে ২,৬০,০০০ মানুষের তথ্য সরাসরি পান, আর তাদের ফ্রেন্ড যারা অ্যাপটা কখনো ব্যবহারও করেনি, তাদের মিলিয়ে সে সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি! এর সাথে তুলনা করুন মার্কিনে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২৫ কোটি। ফেসবুককে কেউ হ্যাক করেনি, আমরাই ফেসবুককে এসব তথ্য দিয়েছি, আর তাই নিয়ে তারা ব্যবসা ফেঁদেছে, ‘গবেষণার’ খেলা খেলেছে।

শুধু ফেসবুক না, আপনি যদি গুগলও ব্যবহার করেন লগ্ডইন অবস্থায়, আপনি কি খুঁজাখুঁজি করছেন, গুগল তা জানবে, এবং পরের বার আন্দাজ করে আপনার পছন্দসই রেজাল্ট আপনাকে দেখাবে। তাছাড়া দুনিয়ার বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে তাদের কোড বসানো আছে, অর্থাৎ আপনি সেসব সাইটে যাচ্ছেন কিনা, তার আগে-পরে আর কি খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেসব তথ্য তারা সংগ্রহ করছে। চিন্তা করুন অ্যানালিটিকা যদি পারত সেটাও কব্জা করতে!

আর এর উপরে আছে কনজিউমার ড্যাটাসেট! আর রাজনৈতিক ‘প্যাক’! কনজিউমার ড্যাটা হলো বিভিন্ন দোকানপাটের সিস্টেমে তাদের খদ্দেরদের নাম-ঠিকানা-ফোন-ইমেলসহ অন্যান্য তথ্য, যেগুলি তারা আপনার কাছ থেকে আপনাকে জানিয়েই সংগ্রহ করে। আপনি ফাইনপ্রিন্ট না পড়েই লিস্টে নাম লিখিয়ে ফেললেন, যার বিনিময়ে হয়ত তারা আপনাকে ডিসকাউন্ট দিল। ইন্টারনেটের কারণে একাজ এখন অনেক সহজ। আর ‘প্যাক’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি, যারা কোন নির্বাচনপ্রার্থীর সমর্থক, তাদের পক্ষে প্রচারণা চালায়, জনে জনে ফোনকল করে, কলিংবেল চেপে ঘরে এসে কথা বলে। তারা সরাসরি প্রার্থীর সাথে জড়িত না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থসংগ্রহ ও খরচ করতে পারে। এদের কাছেও আছে কোটি কোটি মানুষের তথ্য। আপনি হয়ত যেটা জানেন না বা গা করেন না, সেটা হলো এই সব স্টোর, প্যাক, এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও, আপনারসহ আরো অনেকের খুঁটিনাটি জানে এবং এগুলির কেনাবেচা করে। যেকোন মার্কেটিং-অ্যাডভার্টাইজিং কর্মকর্তা বুঝবেন যে এ এক সোনার খনি!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থার ড্যাটা সায়েন্টিস্টের পক্ষে খুবই সম্ভব এসব সাধারণ তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক থেকে পাওয়া অসাধারণ তথ্যের সাথে লাইন ধরে মেলানো। অর্থাৎ তারা জানে আপনার জটিল কোন রোগ আছে কিনা, সর্পতৈলের প্রতি দুর্বলতা আছে কিনা, আর আপনার সাথে যোগাযোগের উপায়। বাকি থাকলো মান্নান মিয়াকে গিয়ে ধরে তার পয়সা উসুল করা।

বলা বাহুল্য, এসকল তথ্য আপনি স্বেচ্ছাতেই কাউকে না কাউকে দিয়েছেন। ইউরোপে না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বৈধভাবেই এসব তথ্য কেনাবেচা সম্ভব। এই কারণেই প্রতি সপ্তাহে আপনি ভুড়ি-ভুড়ি জাংক চিঠি ও ইমেল ডাস্টবিনে ফেলেন আর অনাহূত ফোনকল-টেক্স্ট পেয়ে বিরক্ত হন!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ১

ধরুন আপনি জেমসের গানের মান্নান মিয়া, আপনার তিতাস মলমের বিজনেস। আপনি নিজেও লিস্ট করে বলতে পারেন না, আপনার স্বপ্নে পাওয়া মলমের কত হাজার রোগ সারানোর গুণ। কিন্তু আপনার বিক্রি-বাট্টা কোন ভাবেই বাড়ছে না, অথচ বউকে প্রমিজ করে বসে আছেন যে নেক্স্ট মডেলের টেসলাটা আপনি আগামী মাসে কিনে দিচ্ছেন। কিভাবে করবেন এই অসাধ্যসাধন? চিন্তার কিছু নেই, আছে ফেসবুক! টার্গেটেড অ্যাড দাঁড়া করিয়ে দেন, দুনিয়ার যত উজবুক যারা দোয়াপড়া-ছ্যাপফেলা পানি খাওয়া থেকে শুরু করে সাপের তেল মালিশ করেছে (সাথে সাথে সেগুলির গুণকীর্তন করে ফেসবুকে পোস্টাইছে নয়তো লাইকাইছে), সবগুলোকে একসাথে পেয়ে যাবেন ফেসবুকে। বিশ্বাস করুন, দুনিয়াতে উজবুকের সংখ্যাই বেশি, যে জাত-ধর্মেরই হোক না কেন। অতএব, ফেসবুককে দিলেন অ্যাডের পয়সা, আর সাথে ক’টা একটু চাল্লু উজবুককে দুটো পয়সা দিয়ে বললেন একটা করে লাইক ফেলার জন্য (নইলে আল্লার গজব পড়বে!), আর চটকদার পজিটিভ কমেন্টের জন্য চার পয়সা, হাজার ফ্রেন্ডওলা প্রোফাইল থেকে শেয়ার হলে দশ পয়সা। যদি আপনার মলমের শিশিটা দেখতে জব্বর হয় (অনন্ত জলিলের ছবিওলা লেবেল লাগিয়ে), আর দুয়েকটা ‘ফেকবুক ডাক্তারের’ ভাল ‘প্লাগ’ পান, তাহলে টেসলা না হলেও একটা টাটা মহীন্দ্র তো হয়েই যাবে!

আর যদি আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্প হন, অথবা কোন আফ্রিকান ‘প্রিন্স’, আর আপনি চান একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে, তাহলে আপনার দরকার কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার ইস্পেশাল নির্বাচনী প্যাকেজ! একটা ছোট উদাহরণের পরে করছি অ্যানালিটিকার অ্যানালিসিস।

বছর দশেক আগে আমি দু-তিনজন অ্যামেচারকে জানতাম, যারা এক সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুকের দু-একটা গ্রুপের সদস্যদের শুধু নাম-পরিচয় না, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা-মতামত কোন ধরনের, এসব তথ্যসংগ্রহের উপায় বের করেছিল। শুধু তাই না, কমপক্ষে পাঁচশ সদস্যের এসব তথ্য তাদের অজান্তে সংগ্রহও করেছিল। কয়েকটা ফেক প্রোফাইল আর ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে তারা পরের স্তরে কিছুদূর গিয়েছিল, সেটা হলো ঐ তথ্য কাজে লাগিয়ে গ্রুপের সদস্যদের চিন্তাধারাকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা। এই কাজ বেশ কঠিন, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব নয়। হাতে অঢেল সময় থাকলে, একজন ভাল বিহেভিয়োরাল সাইকোলজিস্টকে দলে পেলে আর ফেসবুক অ্যাডে ঢালার মত যথেষ্ট পয়সা থাকলে সেটাও এই একহাতে গোনা অ্যামেচাররা পারতো বলে আমার বিশ্বাস। আর ফেসবুকও এটা সহজে ধরতেই পারতো না। যাই হোক, নানাকারণে সেই অ্যামেচাররা বেশিদূর না এগিয়ে কেটে পড়ে।

বাঙ্গালীর দাসপ্রথা

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ। এখনো বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়তই চলে আসে এদেশের রাজনীতির মধ্যে। আমাদের জন্য সেটা কেমন ছিল?

চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন বাঙ্গালী আত্মভোলা একটা জাত। সেকথা এক্কেবারে ঠিক! বাঙ্গালীর ইতিহাসেও দাসপ্রথা ছিল এবং এখনো আছে। সে নিজে দাস হয়েছে, আবার ক্রীতদাসের মালিক হতেও তার খুব একটা বাঁধেনি।

প্রথমে বলি কবে কোথায় আমাদের স্বজাতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছিল। অনেকে ভুল আন্দাজ করবেন যে মুসলিম শাসনামলে এর শুরু। ইসলামের আগেও আরবদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল। ইসলামে ক্রীতদাসের সাথে সদাচরণ করতে বলা হলেও সেটাকে বিলুপ্ত করা হয়নি। সে কারণে নানাযুগে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে হাবশী-তুর্কী দাসেরা এদেশে এসেছে। আবার তারা নিজেরাও একসময় রাজা বনেছে, যেমন দিল্লীর মামলুক, বাংলার হাবশী রাজ্য। এইসব রাজারা সবাইই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদের ধরে দাস হিসেবে পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিক্রি করে দিয়েছে।

দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব মিনার খ্যাত কুতব আলদ্বীন আইবক (১১৫০-১২১০) শিশুকালে দাস হিসাবে বিক্রিত হন। তুর্কীস্তানের অধিবাসীদের দাস হিসাবে চাহিদা ছিল, কারণ প্রশিক্ষণ দিলে তারা ভাল সৈন্য হত। ছবিতে লাহোরস্থিত আইবকের সমাধি।
ভারতের গুজরাতের নেটিভ রাজ্য সাচিনের নবাব দ্বিতীয় ইব্রাহিম মোহাম্মদ ইয়াকুত খান (নবাবীর কাল, ১৭৯১-১৮০২)। জাঞ্জিরা দ্বীপের আফ্রিকান সুন্নি মুসলিম রাজবংশে জন্ম। তার পূর্বসূরীরা সুলতানী আমলে দাস হিসাবে ভারতে এসেছিল, পরে সম্রাটের অনুগ্রহে রাজত্ব পায়।

কিন্তু এই অভিশাপ শুধু মুসলিম শাসনামলেই ছিল না। জীমূতবাহনের দায়ভাগে আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু উত্তরাধিকারবিধিতে দাসীর উল্লেখ, তারও আগের বৌদ্ধ বিনয়পিটকেও দেখি দাসেদের ভিক্ষু হওয়া বারণ। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টধর্মেও যীশু এপ্রথার বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলে যাননি, যার ফলে সন্ত পল দাসদের উপদেশ দিয়েছেন মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে। শ্বেতাঙ্গরাও অতীত আর বর্তমানকালে দাসত্বের শৃংখল পরেছে, সেকথা সুযোগ হলে অন্য সময়।

প্রাগাধুনিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনার সাথে সাথে দাসবাণিজ্য আরও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছিল। পর্তুগীজ হার্মাদ জলদস্যু আর বার্মার আরাকানের মগ দুয়ে মিলে ষোড়শ শতকে দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন, সন্দ্বীপ আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায়ই লুট তরাজ চালিয়ে দাস ধরে নিয়ে যেত — যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’। অন্যদিকে মোঘলরা ছিল দাসপ্রথার বিরোধী (আওরঙ্গজেব বাদে), তারা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করে এই মুল্লুকের সমাপ্তি ঘটায়।

মনুস্মৃতিতে জীমূতবাহনের দায়ভাগে দাসীর ঔরসে সন্তান জন্মালে কিভাবে সম্পত্তি ভাগ হবে তার নিয়ম।
বৌদ্ধ বিনয়পিটক অনুযায়ী দাসদের ভিক্ষু হওয়া বারণ।
সেন্ট পল দাসদের বলে গেছেন মনিবের প্রতি অনুগত থাকতে।
কুরআন অনুযায়ী দাসদাসীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম।

প্রায় একই সময়ে, সপ্তদশ শতকে, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (VOC) কাশিমপুর, হুগলী এসব জায়গায় ঘাঁটি গাঁড়ে। তারা লুটতরাজ করত না, কিন্তু দাস কেনাবেচা সেখানে ঠিকই চলত। এসব দাসদের কারা এনে তাদের হাতে সমর্পণ করত, তার কাগজেকলমে প্রমাণ না থাকলেও আন্দাজ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কর্তাই হয়ত পেটের দায়ে সে কাজটি করেছেন, নয়ত বাঙ্গালী বা অন্য ভারতীয় বেনিয়া-ছেলেধরাদের কাজ। ইন্দোনেশিয়ার বাতাফিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে এসব দাসের অধিকাংশ গিয়ে পৌঁছায়, এখনও তাদের বংশধররা সেখানে আছেন, কিন্তু নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেরা অনেকে সেখানে করেছে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, আর মেয়েদের চাহিদা ছিল ভাল সেবক আর সূঁচকর্মী হিসাবে, কারও কারও ভাগ্যে পণমুক্তি আর ওলন্দাজ জামাইও জুটেছিল। সেদেশের এককালীন শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কেরও ধমনীতে নাকি বাংলার রক্ত আছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিও (EIC) কিছুটা সময় মাদ্রাজ আর কলকাতা থেকে এসব করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্যে ভাঁটা পড়া শুরু হল ব্রিটিশদের কারণেই। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা আইন করে বন্ধ করে দেয়, আর তাদের সমুদ্রে কোন দাসবাহী জাহাজ পেলে সেটা দখল করে দাসদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। অবশ্য এতে করে অন্য ধরনের দাসত্বও শুরু হয়ে যায়, সেটা ক্রয়বিক্রয়ের দাস নয়, একে বলে চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব। ভারতে অবশ্য তখনও ব্রিটিশরা দেশীদের ভিতরে ক্রীতদাস-প্রথা সহ্য করত, অভ্যন্তরীণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাক গলাতে এসে ঝামেলা পোহাতে চাইত না। অবশেষে তারা সেটাও আইন করে বন্ধ করে ১৮৬১ সালে।

১৬০১এর এনগ্রেভিংয়ে পূর্ব ইউরোপীয় জনগণকে গলায় দড়ি বেঁধে দাস হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে তুর্কী অটোমান সেনাদল।
ঊনবিংশ শতকে আলজিয়ার্সের মুসলিম শাসকরা মার্কিন ও ইউরোপীয় জাহাজ দখল করে তার নাবিকদের দাস হিসাবে ব্যবহার করত।
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তিতে পালিয়ে যাওয়া আইরিশ চাকরানীর সন্ধানের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রে পালিয়ে যাওয়া স্কটিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্টের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট পরিবার। ঊনবিংশ শতকে পটাটো ফ্যামিনের সময় প্রচুর আইরিশ চাকর হিসাবে আমেরিকায় আসে।

এখন বলি বাঙ্গালী কখন নিজে হয়েছে দাসের মালিক। ঐযে কেপ টাউনের কথা বললাম, সেখানেই কিছু কিছু বঙ্গীয় মুক্তি-অর্জনের পরে নিজেই স্বদেশ-বিদেশ থেকে আনা দাস ক্রয় করত। সেটা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আরো পরে, এমন কী ১৮৬২ সালে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকা থেকে পুনর্প্রকাশিত একটা খবর পড়লাম, তাতে প্রতিবেদক অভিযোগ করছেন যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম – এসব জায়গায় নাকি গোলাম-বাঁদি কেনাবেচা চলে। এদের কেউ আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাস, আর কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক। মফস্বলের জমিদারদের মধ্যে দাস কেনা-বেচা আর উপহার হিসাবে আদান-প্রদানও চলত পুরোদমে। সেসময়কার এরকম আরও অন্তত দুটো খবর ইন্টারনেটে খুঁজে পাই।

আধুনিক বাংলাদেশে সেই প্রথা কি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত? আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজ আলোকচিত্রী, আর তার স্ত্রী (হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এই একবিংশ শতকেই বাংলাদেশের দুবলার চরে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক দাসত্ব। শুঁটকির ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আর শিকলপরা কিশোরদের প্রচুর ছবি আমাকে দেখিয়েছেন, এমনকি এক ছেলেকে উদ্ধার করেও নিয়ে এসেছিলেন। এরকম আরও নানারকম দাসত্ব আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত দেখতে পাই।

সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার কলোনিগুলিতে ইংলিশ কনভিক্টদেরও কেনাবেচা চলত
সাদা দাসদাসীদের কপালেও সাজা খুব সোজা প্রকৃতির ছিল না। মার্কিন উডকাট, অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতক।
আঙ্গেলা ফন বেঙালা, বাংলা থেকে কিডন্যাপ করে দাসব্যবসায়ীরা ডাচদের কাছে বিকিয়ে দেয় এনাকে। ১৬৫৭ সালে কেপ কলোনিতে এসে হাজির হন। ১৬৬৮তে মালিক মুক্তি দিয়ে দেন, ও তিনি খ্রীষ্টান হিসাবে ব্যাপ্টাইজ হন। ১৬৬৯ সালে ডাচ বুর্গার সমাজে বিয়েশাদী করে সেটলার শ্রেণীর অংশ হয়ে যান।
এই বইটিতে বাঙালী দাসরা কিভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনিতে এসে হাজির হয় তার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

যাই হোক, ধরলাম এইগুলি স্বভাবের ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মূল কথা হল, মার্কিনীরা গৃহযুদ্ধ করল এই নিয়ে, আর আমরা যুদ্ধ না করে পার পেয়ে গেলাম ব্রিটিশদের খাতিরে। যদি ব্রিটিশরা আমাদের ওপর খানিকটা ছড়ি না ঘোরাত— নাহয় তারা আর মার্কিনরাই এই প্রথার উচ্ছেদ করলো শুধু নিজেদের রাজ্যে — তাই যদি হতো, দাস কেনা-বেচাতে কি বাঙালী পিছিয়ে থাকত আরব কিংবা পর্তুগীজদের থেকে?

এই পেপারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এফ ডি ক্লার্কের বংশলতিকার বিশ্লেষণে বেরিয়েছে যে তার এক পূর্বপুরুষের নাম ‘ডায়ানা অফ বেঙ্গল’।
ইংল্যান্ডের ফ্রমে দাসপ্রথাবিরোধী অ্যাবসিশনিস্টদের সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি, ১৮২৫।
১৮৩৩ সালের স্লেভারি অ্যাবলিশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তার সকল কলোনিতে দাসপ্রথা রহিত করে।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পর ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট বা কন্ট্রাক্ট লেবারের মার্কেট তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতকের এই সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন এক বন্দরে আসা ব্রিটিশ কারুকারদের ফিরিস্তি দিয়ে তাদের দাম বলা হয়েছে।
ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট হিসাবে ভারতেরও কিছু অচ্ছুৎ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কুলি ও শ্রমিক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হাজির হয়।
১৮৬২তে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় বাংলাদেশের দাসপ্রথার বর্নণা।
ব্রিটিশরা ব্রিটিশ ভারতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করলেও নেটিভ রাজ্যগুলি, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায়, তখনো সেটা করতে পারেনি। ভারত সরকারের এগুলি বন্ধ করতে ষাটের দশক লেগে যায়।
নেপালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯২৫এ
১৯২৭এ বার্মায় ক্রীতদাস মুক্ত করতে গিয়ে মারা গেছে ব্রিটিশ সৈন্য
ভূটানে দাসপ্রথা রহিত হয় ১৯৬০এ
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!