আফিম যুদ্ধ

(জাপানের মেইজি যুগ সম্পর্কে এ লেখাটি লিখতে গিয়ে চীনা-ভারতীয় আফিমের ডালপালা গজিয়ে গেল!)

ব্রিটিশদের সাথে চিং সাম্রাজ্যের দু’দু’টো যুদ্ধ হয়েছিল আফিমব্যবসাকে কেন্দ্র করে (প্রথম, ১৮৩৯-৪২; দ্বিতীয়, ১৮৫৬-৬০)। এর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের সর্বাধিক, আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে অসম অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা হয়ে যায় অর্ধেক। চীনের মানুষ এখনও মনে করে যে তারা এসময় পশ্চিমের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। আফিম যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আর ফলশ্রুতি অবশ্য এভাবে এক লাইনে বর্ণনা করলে দু’পক্ষের প্রতিই অবিচার করা হবে। তাই আমি আরেকটু বড় করে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি।

(এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় জাপানের একতরফা আগ্রাসনের মুখে চীনের নতুন প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা সরকারদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর সহানুভূতিশীলতা পেয়েছিল।)

আফিমের ওষধি গুণাগুণ আর আসক্তিকর প্রভাবের কথা প্রাচীন চীন ও ভারত দুই এলাকারই মানুষ জানত। আমরা রান্নায় যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি সীড বা আফিম গাছেরই বীজ। মধ্যযুগে চীনে স্থানীয়ভাবে আফিমের চাষ তেমন একটা হত না। মূলত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদের পর চীনে রপ্তানি হত আর কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হত। আকবরের সময় মুঘলরা ছিল চীনে আফিমব্যবসার একচেটিয়া সত্ত্বাধিকারী। মুঘলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (ইআইসি) উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যবসা পায়। অবশ্য সপ্তদশ শতকে ইআইসি নয়, ভিওসি (ডাচ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) ছিল চীনের মূল আফিম সরবরাহকারী।

১৯০৮ সালে মার্কিন আলোকচিত্রী ভারতের সরকারী ফ্যাক্টরিতে আফিম ওজন করার দৃশ্য ধারণ করেছেন — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

সপ্তদশ শতকের শেষে চিবিয়ে খাবার বদলে ধূম্রপানের মাধ্যমে আফিমসেবনের নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। আফিমের ধোঁয়া ছিল আরো বেশি আসক্তিকর। ভারতের থেকে চীনেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবে আফিমসেবন। এ কারণে চিংসম্রাট ফরমান জারি করে ১৭২৯ সালে আফিমের ব্যবহার ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেন। প্রথম প্রথম তাতে আফিমের আমদানি কমলেও দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়। সরকারি দুর্নীতি আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতকের শেষে আফিমব্যবসার চাবিকাঠি ইআইসির হাতে এসে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে ভারতের সবচে’ বেশি আফিমউৎপাদনকারী দুই এলাকা — বাংলা ও বিহার। আর পশ্চিমে ছিল মলওয়া রাজ্য। কলকাতায় বাঙ্গালী জমিদার আর মারোয়াড়ি বণিকরা কম্পানি খুলে বসে ইআইসির জাহাজে আফিম সাপ্লাইয়ের জন্যে। আফিমচাষীদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে এসব দালালরা বহুগুণ লাভে ইআইসির কাছে বিক্রি করত (বাংলার ১৭৭০এর দুর্ভিক্ষের একটি কারণ আফিমচাষের ওপর জমিদারদের ভারসাম্যহীন গুরুত্বপ্রদান)। এভাবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বহু জমিদার আর বণিক কলকাতায় প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিরলা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শিবনারায়ণ, আর অনেক প্রভাবশালী পার্সী শিল্পপতিদের পূর্বপুরুষ। মুজতবা আলীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে সিলেটেও মুসলিম জমিদাররা আফিমচাষে অর্থলগ্নি করত। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় উৎপন্ন আফিমের এক-তৃতীয়াংশ চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে।

ইআইসির আফিমভর্তি জাহাজ নোঙর ফেলত চীনের একমাত্র বৈদেশিক বন্দর ক্যান্টনে (গুয়াংচৌ) গিয়ে। সেখান মালখালাসের পর চীনা কালোবাজারিদের কাছে আফিম বিক্রি করে দেয়া হত। তারা সেসব নিয়ে লুকিয়ে বেচত স্থানীয় বাজারে। এভাবে সরাসরি চীনে আফিমের বাজারে ইআইসি যুক্ত না থাকলেও সাপ্লাই লাইনের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা। এই কালোবাজারির লাভের মাধ্যমে চীনের সাথে বিশাল ট্রেডগ্যাপের ব্যালেন্স করে ব্রিটিশরা, কারণ চীন থেকে বিলাসদ্রব্য ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণে কিনলেও বিলাতি বিলাসদ্রব্য চীনে বিক্রি করা ছিল নিষিদ্ধ।

১৯০৬ সালে চীনের বেজিংয়ে তামাক ও আফিম সেবন চলছে আফিমের আখড়ায় — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

১৮৩০এর দশকে আফিমব্যবসায় ইআইসি ও ভারতীয় আফিমের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয় মার্কিন চোরাকারবারীরা (জন কেরি আর ফ্রাংকলিন রোজভেল্টের পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন)। তাদের জাহাজ পারস্য-তুরস্ক থেকে আফিম কিনে চীনে বিক্রি শুরু করে। প্রতিযোগিতার ফলে দরপতন হতে থাকে। লাভ ধরে রাখতে তাই জাহাজীরা বাধ্য হয় আরো বেশি পরিমাণে আফিম পরিবহন করতে। চীনাদের মধ্যে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে আফিম-আসক্তি।

১৮৩১ সালে চীনের সম্রাট নতুন করে আফিমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এতেও যখন কাজ হল না, তখন ১৮৩৯এ সম্রাটের নির্দেশে চীনা সরকারী কর্মচারীরা ক্যান্টনের সকল আড়ত থেকে আফিম জব্দ করা শুরু করে। ব্রিটিশ আর অন্যান্য বিদেশীদের মজুদও রেহাই পেল না। বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হল ইআইসি ও ভারতীয় লগ্নিকাররা। অপমানের জবাব দিতে ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ পাঠাল দক্ষিণ চীন সাগরে। জাহাজের কামান থেকে দূরপাল্লার গোলানিক্ষেপ করা হল উপকূলের বন্দরগুলিতে। ক্যান্টন বন্দর দখল করে নিল তারা। চীনারা বাধ্য হলো শান্তিচুক্তি করতে। সে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা পেল হংকংয়ের মালিকানা, আর পাঁচটি সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার।

কিন্তু আফিম ব্যবসার ব্যাপারে কোন সুরাহা সে চুক্তিতে হয়নি। চীনে তখনও তা বেআইনী। এ সুযোগে হংকংয়ের চীনা কালোবাজারিরা নিজেদের জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় আফিম আনানেয়া করতে থাকে। ১৮৫৬ সালে এরকম একটি জাহাজ আটক করে চিং কর্মচারীরা, আর তারা জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এতে ফরাসী ও ব্রিটিশদের জয়লাভের পরে আফিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন সম্রাট, এবং আরো আশিটির মত বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, পারস্য, বল্কানে উৎপন্ন আফিমে সয়লাব হয়ে যায় চীন।

বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট এরঝ়ে টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে ত্রিশের দশকের চীনের আফিম আখড়ার ছবি এঁকেছেন — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

আফিম আসক্তি নিরসনে চিংদের ভুল পদক্ষেপগুলি জাপানসহ অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা হয়ে ছিল। যদি চীনা বন্দরগুলিতে সাধারণ বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য করতে দেয়া হত, তাহলে হয়ত আফিম কালোবাজারির খুব একটা দরকার পড়ত না পশ্চিমা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। আফিমকে বেআইনী করার কারণেও ‌অনিচ্ছাকৃতভাবে তার দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটিকে লোভনীয় রূপ দেয় তারা। তারা চাইলে আফিম ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সপ্রদান করে আর উচ্চশুল্ক আরোপ করে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। শুল্ক থেকে সরকারী আয় নিয়ে স্থানীয় আফিমখোরদের বালাই সারাতে খরচ করতে পারত। শুধু মুনাফাখোর ব্রিটিশদের সকল দোষের ভাগীদার করা মনে হয় ন্যায়সঙ্গত নয়। চীনাদের ভুল পদক্ষেপ আর মিথ্যে সামরিক গর্বের কারণে তারা তো যুদ্ধে হেরে অর্থনৈতিক শক্তি হারায়ই, তার ওপর ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে ওঠে আফিমাসক্ত।

আর আফিম-আসক্তি যে শুধু চীনাদের সমস্যা ছিল তা নয়। পৃথিবীর সকল সভ্য স্থানেই আফিম চলত সে আমলে, কোথাওই বেআইনী ছিল না। বাদশা জাহাংগীর আর তাঁর পুত্র মুরাদ আফিমে আসক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আর মার্কিন প্রচুর বিখ্যাত মানুষেরও এরকম আসক্তি ছিল। যেমন, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (অসমাপ্ত ‘কুবলা খান’ মহাকাব্য লিখেছিলেন নেশার প্রভাবে!), চার্লস ডিকেন্স, মেরি শেলী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, এলিজাবেথ ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান পো, জন কীটস, লিউয়িস ক্যারল, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখের আফিমসেবনের বদভ্যাস ছিল।

আমেরিকায় এখন আফিমের ডেরিভেটিভ ওপিয়েট পেইনকিলার বড়িতে প্রচুর সাধারণ মানুষ আসক্ত। এর দোষ যদিও মুনাফাখোর ওষুধ কম্পানিগুলিকে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত আসল ঘটনা তার থেকে জটিলতর — আফিম যুদ্ধের ইতিহাসের মতই।

মেইজি জাপান

ঊনবিংশ শতকের শেষে এশিয়াতে যে ক’টি স্বাধীন দেশ ছিল, তাদের মধ্যে জাপান সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। (নিচে মানচিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে এশিয়া-প্যাসিফিকের অবস্থা দেখা যাচ্ছে।) পশ্চিমাদের জবরদস্তির মুখে দেশের বদ্ধ দুয়ার খুলতে বাধ্য হলেও জাপান উপনিবেশ তো হয়ই নি, বরং খুব কম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক আর সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এশিয়ার কয়েকটি এলাকায় নিজেরাই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।

জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপানের চূড়ান্ত রূপান্তর যে সময়টায় হচ্ছিল, তার সাক্ষী ছবিতে দেখানো আমার সংগ্রহের ডাকটিকেট দু’টি। প্রথমটা জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১)। এর মাত্র তিন বছর আগে সম্রাট মুৎসুহিতোর সিংহাসনে আরোহণের সাথে ‘মেইজি’ যুগের সূচনা হয়। ১৯১৫তে রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক হিসাবে দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এই দুই ডাকটিকেটের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে আছে জাপানের দিগনির্ধারক একটি যুগ।

চিন্তা করছিলাম জাপান কেন ইতিহাসের ব্যতিক্রম।

পশ্চিমা বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমনের ঠিক আগে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বহুদিন বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মডেল ছিল চীন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষা, বাণিজ্য, ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ছিল সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। সম্রাট ছিলেন দেবতার আসনে আসীন। ছিল ম্যান্ডারিন নামে বিশাল আমলাতন্ত্র। ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকলেও অর্থবহ সমাজজীবন সৌরজগতের গ্রহগুলির মত সূর্যদেবের প্রতিনিধি স্বর্গপুত্র সম্রাটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত । নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে সরকারই হত প্রকারান্তরে তার মালিকানাধারী পৃষ্ঠপোষক। বিজ্ঞানী, আবিষ্কর্তা, কবি বা শিল্পীরা ছিলেন রাজদরবারেরই সদস্য।

প্রাচীনকালে সিল্ক রোডের মাধ্যমে বাইরের সাথে যুক্ত থাকলেও চীনে বিদেশী দ্রব্যের প্রয়োজন তেমন একটা ছিল না। সব চাহিদারই স্থানীয় সরবরাহ ছিল। মিং-চিং যুগের চীনাদের অধিকাংশের দৃষ্টিতে বিদেশীরা ছিল বর্বর, আর নিজস্ব বিজ্ঞান-দর্শন ইত্যাদি ছিল সর্বোত্তম। বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের পরে বোধ করি বাইরের কোন গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক ধ্যান-ধারণাই চীন সাম্রাজ্যে পাকাপোক্ত স্থান পায়নি। আর চংহোর ট্রেজ়ারশিপবহরের অভিযাত্রার (১৪০৫-১৪৩৩) পরে সম্রাটের নির্দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য সীমিত করে ফেলা হয়। তদোপরি কনফুশিয়ান সমাজব্যবস্থা ছিল বর্ণকেন্দ্রিক। জন্মসূত্র নয়, সে বিভাজন ছিল পেশাভিত্তিক। এ শ্রেণীবিভাগে বণিকদের স্থান খুব একটা উচ্চ ছিল না।

শুধু চীন নয়, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপান — এদের সবাইই কোন না কোন প্রকারে চীনের শাসনব্যবস্থা অনুকরণ করত।

রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক ডাকটিকেট (১৯১৫) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপান একটু ভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। ইউরোপে যেমন নানাভাষী অনেক জাতি নিজেদের মধ্যে ছাড়াও ওসমানী তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লেগে থেকে নিজেদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষসাধন করেছিল, চীনে তেমনটা বৃহদাকারে হয়নি। কিন্তু জাপানে অনেকটা এ অবস্থা বিরাজমান ছিল। সম্রাটকে দেবতুল্য আসনে রেখেই সেখানকার বিভিন্ন সামন্ত একে অন্যের সাথে প্রভাববিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেশচালনার শক্তির কেন্দ্র ছিল কোন না কোন সামন্তপরিবার, সম্রাট ছিলেন প্রতীকমাত্র। ষোড়শ শতকের শুরুতে যখন পর্তুগীজরা প্রথম আসে, তখন জাপান ছিল অনেকগুলি দাইমিয়ো বা সামন্তরাজ্যে বিভক্ত, আর একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুগকে বলে ‘সেনগোকু’ বা ‘ওয়ারিং স্টেটস’ যুগ (১৪৬৮-১৬০০)। চীনে বাণিজ্যের দুয়ার তখন জাপানীদের জন্যেও ছিল বন্ধ। আর তাদের দ্বীপপুঞ্জে কাঁচামালের প্রাচুর্য অতটা ছিল না যে বাণিজ্য ছাড়া স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

তাই পর্তুগীজ, ও পরে স্প্যানিশ-ওলন্দাজদের, সংস্পর্শে যখন জাপানীরা আসে, প্রথমে কালচার শক হয় তাদের। চীনাদের দেখাদেখি ইউরোপীয় বণিকদের ‘নানবান’ বা ‘দখিনা বর্বর’ বলে ডাকত জাপানীরা। আর আলকাতরা-মাখানো ইউরোপীয় জাহাজের নাম তারা দিয়েছিল ‘কুরোফুনে’ — কালোজাহাজ। (নিচের ছবিতে ঊনবিংশ শতকের জাপানী চিত্রে একটি কুরোফুনের রাক্ষুসে চেহারা দেখানো হয়েছে।) দক্ষিণ জাপানের দাইমিয়োগুলি কালচার শক দ্রুত কাটিয়ে উঠে ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তোলে। নাগাসাকি শহরের গোড়াপত্তনই হয় ইউরোপীয় বাণিজ্যঘাঁটি হিসাবে (১৫৭১)। গাদাবন্দুকেরও আমদানি করে পর্তুগীজরা। সে বন্দুক তৈরির প্রযুক্তি ত্রিশ বছরের মধ্যে জাপানীরাই শিখেপড়ে স্বদেশে উৎপাদন-শিল্প গড়ে তোলে। সেসময় ইউরোপের একেকটা দেশে যত না বন্দুক ছিল, জাপানে ছিল তার থেকে অনেক বেশি। চীনের বাণিজ্যপথ বন্ধ থাকায় জাপানীরা নিজেদের স্বার্থেই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে, নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে, আর নিজেরাও ‘রেড সীল’ বলে নৌবহর (১৬০০-১৬৩৬) পাঠিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেসব দেশের বন্দরে জাপানী নাবিকদের দুর্নাম ছিল রুক্ষ মারপিটে স্বভাবের বলে।

জাপানের এ পর্যায় চলেছে প্রায় সত্তর বছর (১৫৪৩-১৬১৪)। এর মধ্যে পর্তুগীজ মিশনারীরা অনেক স্থানীয় মানুষকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছে। জাপানীরা তাদের সাথে ক্রীতদাস কেনাবেচাতেও অংশ নিয়েছে। দাইমিয়োগুলির মধ্যে যুদ্ধবিবাদে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হয় তোকুগাওয়া বলে একটি সামন্ত পরিবার। তাদের নেতা ইয়েইয়াসু খ্রীষ্টধর্ম উৎপাটন অভিযান শুরু করেন এই কারণে যে সে ধর্মে জাপানী সম্রাটের বিশেষ দেবতুল্য স্থান নেই। স্প্যানিশ-পর্তুগীজদের সাথে আঁতাঁত করে খ্রীষ্টানরা জাপানকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেবে, এ ভয় ছিল তাঁর। দেশকে সুসংহত করার পর চীনের মত জাপানের দুয়ারও তাই বিদেশীদের জন্যে বন্ধ করে দেয় তোকুগাওয়া শোগুনাত

তোকুগাওয়া আমলে (১৬০৩-১৮৬৭) তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল জাপান। নিষিদ্ধ খ্রীষ্টধর্মের জায়গা নেয় কনফুশিয়ানিজ়ম, সাথে আসে পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন। মূলত কৃষিভিত্তিক আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ছিল নগর আর গ্রামাঞ্চলের মাঝে। বন্দুকের বদলে সামুরাই তলোয়ার আবার একটি সম্মানজনক অস্ত্র হিসাবে স্থান পায়। হাইকু কাব্যচর্চা আর উডব্লক প্রিন্টিংয়েরও উৎকর্ষ সাধিত হয়

তোকুগাওয়ারা তাদের এই ‘সাকোকু’ নামক রুদ্ধদ্বারনীতি বেশ শক্তহাতে বাস্তবায়ন করে। জাপানে যদি ভুলেও কোন বিদেশী পদার্পণ করত, এমনকি জাহাজডুবি হয়েও, তাহলে তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। একই শাস্তি ছিল জাপানীদের কপালেও, যদি তারা স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে পা রাখত। শুধুমাত্র ওলন্দাজ়দের সাথে ভাল সম্পর্কের খাতিরে দেজিমা দ্বীপে তাদের বাণিজ্যঘাঁটি রাখার অনুমতি দেয়া হয়।

ঊনবিংশ শতকে কয়েকটি ব্রিটিশ, ফরাসী, রুশ ও মার্কিন কুরোফুনে চেষ্টা করে রুদ্ধদ্বারনীতির পাশ কাটিয়ে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করতে। প্রতিক্ষেত্রেই জাপানীদের আগ্রাসী মনোভাবের কাছে তারা পরাস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলমোরের কাছ থেকে চুক্তির প্রস্তাবনাপত্র নিয়ে আসে কমোডর পেরির নেতৃত্বে চারটি যুদ্ধজাহাজ।

কুরোফুনে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসময় ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়েছে তিন বছরও হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ার বন্দর সান ফ্রান্সিস্কো থেকে তিমিশিকারী জাহাজ উত্তরে বেরিং প্রণালী পর্যন্ত যাওয়াআসা শুরু করে। কিন্তু একবার প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ফেললে তাদের স্টীমশিপের কয়লার মজুদ যেত ফুরিয়ে। প্যাসিফিকের অন্যপারে তাদের কোলিং স্টেশনের দরকার ছিল খুব। ইউরোপীয়রা জাপানে আসতো পশ্চিমদিক থেকে। তাদের যাত্রাপথে এশিয়া-আফ্রিকার নানা বন্দরে জ্বালানি সংগ্রহের বন্দোবস্ত ছিল। মার্কিনদের এমন সৌভাগ্য ছিল না।

পেরি এদো (বর্তমান টোকিও) এসে পৌঁছালে জাপানীদের নির্দেশমত বৈদেশিক বন্দর নাগাসাকিতে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি জাপানী কর্মকর্তাদের বার্তা পাঠান যে তাঁকে তীরে অবতরণ করতে না দেয়া হলে জাহাজের কামান থেকে গোলা মেরে শহরকেন্দ্র ধ্বংস করে দেবেন। শক্তি প্রদর্শনের জন্যে কামান থেকে ফাঁকা আওয়াজের নির্দেশ দেন তিনি। তখনকার শোগুন ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী। যথাযথ নেতৃত্ব দেবার লোক না থাকায় জাপানীরা পেরিকে নোঙর ফেলার অনুমতি দেয়। পেরি চুক্তির প্রস্তাব হস্তান্তর করে সে যাত্রা ক্ষান্ত দেন।

পরের বছর আবার ফিরে আসেন পেরি। ততদিনে জাপানীরা বহির্বিশ্বের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা। চীনের মত দানবীয় শক্তিকে সৈন্যসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও কিভাবে ব্রিটেন কাবু করেছে প্রথম আফিম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) , তাও তাদের গোচরে এল। বিশেষত দক্ষিণের দু’টি দাইমিয়ো এসব দেখেশুনে তোকুগাওয়াদের রক্ষণশীল নীতির সমালোচনা শুরু করে। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর জাপানীরা সিদ্ধান্ত নেয় জাপানকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার। পেরির সাথে দ্বিতীয় মোলাকাতের সময় তোকুগাওয়ারা বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব আর বাণিজ্যের অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপরে ফরাসী, ব্রিটিশ, জার্মানদের সাথেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এধরনের অসম চুক্তির মাধ্যমেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের বেশ ক’টি বন্দরের লীজ় বাগিয়ে নিয়েছিল । জাপানেরও এমনটা হতে চলছিল।

কিন্তু জাপানীরা ক্রমান্বয়ে যেটা করল, তা চীনাদের ঠিক উল্টো।

নতুন করে বৈশ্বিক সম্পর্কস্থাপনের শুরুর ক’টি বছরে স্বাভাবিক কারণেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল। ১৮৬৮তে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া শেষে চোশু ও সাৎসুমা নামক প্রগতিশীল দু’টি দাইমিয়ো তোকুগাওয়াদের রাজনৈতিক শক্তিকে হারিয়ে পনেরোবছরবয়েসী সম্রাট মিৎসুহিতোকে প্রকৃত রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী এশিয়া-প্যাসিফিকের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের চেহারা — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

চীনাদের মত পশ্চিমাদের বর্বর বলে গালিগালাজ করে আরো গুটিয়ে যাবার পরিবর্তে মেইজি সম্রাট আর তাঁর অনুসারীরা অভিজাত শিক্ষানুরাগীদের পশ্চিমে পাঠাতে শুরু করেন। বিদেশের চালচলন দেখেশুনে এসে এসব শিক্ষানবিশ অল্প সময়ের মধ্যে জাপানকে পশ্চিমা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে তোলে। চীনাদের মুখস্থ-বুলি-কপচানো, উপর-থেকে-চাপানো ‘নৈতিকতার’ পরিবর্তে যুক্তিতর্কভিত্তিক আলোচনার পরিবেশ গড়ে ওঠে। ১৮৬০ সালেই নিজেদের স্টীমশিপে করে আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল জাপানীরা। জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালি-ব্রিটেনেও দূত প্রেরিত হয়। চুক্তিসম্পাদনের পাশাপাশি রাষ্ট্রদূতদের কাজ ছিল এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাষ্ট্রপরিচালনা, সেনাবাহিনী, ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হল জাপানে। বিশেষ করে জাপানীদের সামরিক শিক্ষা, ইউনিফর্ম, নিয়মানুবর্তিতা — এসবের উপর জার্মান রাজ্য প্রুশিয়ার সেনাধ্যক্ষদের ‌অনেক বড় প্রভাব ছিল।

এসব সংস্কার অবশ্য খুব সহজে হয়নি। তোকুগাওয়াপন্থী বিদ্রোহীদেরকে প্রথমে দমন করতে হয় মেইজিপন্থীদের (বোশিন যুদ্ধ, ১৮৬৮)। তারপর সামন্ততন্ত্রের অবসানের পরে ভূমিসংস্কারবিরোধী দাইমিয়োরা বিদ্রোহ করে বসে (সাৎসুমা বিদ্রোহ, ১৮৭৭)। জমির মালিকানা কৃষকদের বুঝিয়ে দেয়া হলেও তারা ভূমিকর আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (চিচিমা বিদ্রোহ, ১৮৮৪)। বিপুল সংখ্যায় সামুরাই যোদ্ধাও ছিল সরকারের ভাতাভোগী হিসাবে। তাদের সে ভাতা বন্ধ করে দেয়া শুরু হলে তাদের থেকেও বিরোধিতা আসে (আকিজ়ুকি ও অন্যান্য বিদ্রোহ, ১৮৭৬) । কিন্তু এসবের প্রতিটায় পশ্চিমা সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে তৈরি নতুন সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়। পরাজিত পক্ষগুলি অনন্যোপায় হয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়। যেসব দাইমিয়ো মুৎসুহিতোকে সাহায্য করেছিল, তারা পুরস্কৃত হয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদমর্যাদা আর অভিজাত পদবী পেয়ে।

১৮৮৯ সালে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রনয়ণের মাধ্যমে জাপান পরিণত হয় কনস্টিট্যুশনাল মনার্কিতে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়, শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। প্রথমে ধনবান পুরুষ নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর বিশের দশকের মধ্যে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয় সকল নাগরিকদের জন্যে। সামুরাইদের অস্ত্রধারণের এতদিনের একচেটিয়া অধিকার সকল স্বাধীন নাগরিককে দেয়া হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার ফলে স্বাক্ষরতার হারও দ্রুত বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্র বানানোর স্থানীয় কারখানা গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আর কনফুশিয়ান পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়।

বাণিজ্যের অগ্রগতির সাথে জাপানের স্টীমশিপের বহরও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কূটনীতিক মিশন পাঠিয়ে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে অসম চুক্তিগুলিকেও সংশোধন করতে সমর্থ হয় মেইজি সরকার। রেশমশিল্পের আধুনিকায়নে বৈদেশিক অর্থায়ন আসা শুরু করে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অংশ নিয়ে বনেদী কিছু সামুরাই পরিবার অর্থবান ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মিৎসুই-মুৎসুবিশি সেরকমই দুটো পরিবার। এধরনের পরিবারের মালিকানাধীন কম্পানিগুলিকে বলা হয় জ়াইবাৎসু। শিল্পায়নের সাথে দ্রুত নগরায়ন ঘটে, গ্রামাঞ্চলের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলি শহরমুখী হয়।

মেইজি জাপানের সফলতার কারণ বোধ করি তাদের দূরদর্শিতা। পেরির জোরাজুরির প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে করিৎকর্মা জাপানীরা পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে দ্রুত তাল মিলিয়ে পা ফেলতে শুরু করে। ফন্দিবাজ পশ্চিমাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত চুক্তি সম্পাদন আর সেসব রক্ষা করতে সক্ষম হয় তারা। সংস্কারের ধাঁপে ধাঁপে জাপানের শাসকগোষ্ঠী ও প্রিভিলেজড ক্লাস আর তাদের সাথে জড়িত পশ্চিমা শিল্পপতিদের ইনসেন্টিভ ছিল বলে তারা এ প্রক্রিয়ায় অর্থবহ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। পশ্চিমা ধ্যানধারণাগুলি ভালভাবে নিরীক্ষা করে জাপানীরা সেসবের ভালগুলি বেছে নিজেদের দেশে চালু করে, নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আগলে রেখেই।

আর এই দ্রুত প্রগতির পথে পদার্পণের কারণেই আমার মনে হয় জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছিল অবধারিত। সে আলোচনা হবে পরে কোন এক সময়।


(১) চীনাদের কাছে সম্রাট ছিলেন তিয়ানজ়ি বা স্বর্গীয় পুত্র। তাঁর শাসন করার অধিকার স্বর্গ থেকে আরোপিত। যদি সম্রাট অন্যায্য কাজ করেন ও যুদ্ধ বা বিদ্রোহে তাঁর পরাজয় ঘটে, তাহলে ধরে নেয়া হত তিনি সে স্বর্গীয় অধিকার হারিয়েছেন। চীনের রাজকীয় নাম ছিল তিয়েন মিং, স্বর্গীয় সাম্রাজ্য। তিয়েন শিয়া, বা স্বর্গের নিচে যা কিছু রয়েছে, এসকলের ওপর স্বর্গপুত্রের অধিকার।
একইভাবে জাপানের সম্রাটকে ডাকা হত তেন্-নো বলে। তিনি স্বয়ং সূর্যদেবী আমাতেরাসুর বংশধর। ভিয়েতনামের সম্রাটের পদবী সেরকম ছিল তিয়েন-তু।
আমাদের দেশের মুঘল রাজদরবারের থেকে খুব একটা আলাদা নয় ব্যাপারটা! মুঘল সম্রাটের অন্যতম পদবী ছিল ফিরদাউস আশিয়ানা — ডোমেইন অফ প্যারাডাইজ়।
চীনের প্রথম সম্রাটকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে ‘হিরো’ বলে একটা মুভি দেখেছিলাম। তাতে দেখেছি এই তিয়েন শিয়া ধারণার মাধ্যমে চীনের বর্তমান টপ-ডাউন সিংগল-পার্টি শাসনব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। [Mandate of Heaven]

(২) চ্যংহো ছিলেন মিং ইয়ংল্য সম্রাটের দরবারের প্রভাবশালী মুসলিম খোঁজা। তিনি সাতবার সম্রাটের নির্দেশে সাগরপাড়ি দেন। সাথে ছিল বিশাল বিশাল ট্রেজ়ারশিপ। দক্ষিণ চীন সাগর আর ভারতীয় মহাসাগরের উপকূলের বিভিন্ন দেশে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য নয়, এসব দেশের শাসকদের কাছ থেকে চীনসম্রাটের প্রতি আনুগত্য আর উৎকোচ আদায় করা। বাংলার সুলতানের দরবার থেকেও চীনসম্রাটকে উপহার পাঠানো হয় চ্যংহোর জাহাজে। আফ্রিকা থেকে জিরাফসহ বেশ কিছু অদ্ভূত বুনোপ্রাণী চীনে নিয়ে যাবার পর সেদেশে বেশ সাড়া পড়ে যায়। শ্রীলংকা আর মালাক্কার শাসকরা চীনসম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করে চ্যংহোকে আক্রমণ করায় তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করে মিং সম্রাটের দরবারে হাজির করা হয় নাকে খত দেবার জন্যে। ইয়ংল্য সম্রাটের মৃত্যুর পর খোঁজামহল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারায় ম্যান্ডারিন আমলাদের কাছে। ম্যান্ডারিনদের মন্ত্রণায় নতুন সম্রাট নৌবহর ধ্বংস করে দিয়ে ‘হাইজিন’ বা ভারতীয়দের মত কালাপানির আইন চালু করেন। [Ming treasure voyages]

(৩) জাপানীদের ‘রেড সীল’ বা ‘লালমোহর’ নৌবহরের এরকম নামের কারণ তারা তোকুগাওয়া শাসকের প্রদত্ত লাল রঙের মোহরাংকিত খামে বাণিজ্যের অনুমতি নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করত। তোকুগাওয়ার পত্রে বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। জাপানী শোগুনের পাশাপাশি ইউরোপীয়রাও রেড সীল জাহাজদেরকে জলদস্যুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহায্য করত। জাহাজগুলির কাপ্তানদের মধ্যে জাপানী যেমন ছিল, সেরকম চীনা, ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগীজরাও ছিল। জাহাজের পাল-হাল ইত্যাদির গড়নও ছিল চীনা আর ইউরোপীয় সংকর। সাথে ছিল আত্মরক্ষার জন্য কামান। ১৬০০ থেকে ১৬৩৫এর মধ্যে এরকম ৩৫০টি জাহাজ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ফিলিপিন, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন রাজ্যে যাত্রা করে। [Red seal ships]

(৪) শোগুন অর্থ সামরিক শাসক। শোগুনের সম্পূর্ণ জাপানী পদবীর অর্থ ‘বর্বরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সর্বাধিনায়ক’। জাপানের ইতিহাসে বহুবার বিভিন্ন সামুরাই পরিবার সম্রাটকে প্রতীকী স্থানে রেখে নিজেরাই রাষ্ট্রচালনা করত। তোকুগাওয়া শোগুনদের আগে কামাকুরা-আশিকাগা প্রমুখ শোগুনাতও জাপান শাসন করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে এরকমই সামরিক উগ্রপন্থীরা সম্রাটকে সিম্বলিক লীডার মেনে নিজেরাই পররাষ্ট্র ও আভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করত। [Shōgun]

(৫) অদ্ভূত ছন্দ আর শব্দস্বল্পতার অভিনবত্বের কারণে জাপানী হাইকু কাব্য এখন পশ্চিমে বেশ জনপ্রিয়। ১৬৭০এর দশকে তোকুগাওয়া আমলে হাইকুর উদ্ভব।
জাপানের সবচে’ খ্যাতিমান উডব্লক প্রিন্টেড শিল্পকর্ম ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ অফ কানাগাওয়া’ (১৮৩০)। এর শিল্পী হোকুসাইয়ের জীবতকাল ছিল তোকুগাওয়াদের শেষভাগে। বেলজিয়ামের আন্টওয়ের্প বন্দরে জাপানীদের উডকাট শিল্প দেখে আকৃষ্ট হন ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকর ভ্যানগগ। তাঁর সংগ্রহে প্রচুর জাপানী শিল্পকর্ম ছিল। ভ্যানগগের ছবিতেও জাপানী প্রভাব উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে ‘আইরিসেস’ সিরিজ দেখলে বোঝা যায় জাপানী প্রকৃতিপ্রেম আর অংকনশৈলী ছিল ভ্যানগগের অনুপ্রেরণা। [The Great Wave off Kanagawa]

(৬) এই লেখাটি পড়ুন। [Opium Wars]

(৭) ১৮৪০এর প্রথম আফিম যুদ্ধের আগে চীনের একমাত্র ক্যান্টন (গুয়াংচৌ) বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্যের অনুমতি ছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়ে চিং সাম্রাজ্য ‘চিরতরে’ হংকং হারায় (১৯৯৭ পর্যন্ত)। একইসাথে শাংহাইসহ পাঁচটি বন্দরে ঘাঁটিস্থাপনের অধিকার আদায় করে নেয় ব্রিটিশরা। এগুলিকেই বলা হত ‘ট্রিটি পোর্ট’। ব্রিটিশদের পরে ফরাসী আর মার্কিনরাও এ ধরনের অসম চুক্তি করে চীনের সাথে। এসব চুক্তির একটা শর্ত ছিল একস্ট্রাটেরিটরিয়ালিটি, অর্থাৎ কোন বিদেশী অপরাধ করলে স্থানীয় আইনে তার বিচার করা যাবে না, করতে হবে তার স্বদেশে। এভাবে প্রচুর বড় বড় অপরাধী নিস্তার পেয়ে যেত। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পর ১৮৬০এ আরো প্রায় আশিটি বন্দর এভাবে ট্রিটি পোর্টে পরিণত হয়। এসব পোর্টে বিদেশীজের জন্যে বিশেষ এলাকা আলাদা করে দেয়া ছিল। সেখানে তারা স্বদেশী সৈন্যদের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে আরামের জীবন কাটাত। পরে লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ, অস্ট্রিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, নরওয়ে, রাশিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, জাপানও এধরনের সুবিধাভোগ করে। বিশেষ করে জাপান অত্যন্ত অন্যায্য কিছু সুবিধাভোগের জন্যে চীনকে জোরাজুরি করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমারা তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের জার্মানদের পক্ষে যোগ দেয়ার এটা একটা কারণ। [Treaty ports]

(৮) ‘দ্য লাস্ট সামুরাই’ নামে ২০০৩এ টম ক্রুজের অভিনীত একটি হলিউডি চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে স্বাধীনচেতা সামুরাইদের অন্তিম চিত্র। চলচ্চিত্রটির অনুপ্রেরণা সাৎসুমা অঞ্চলের সামুরাই বিদ্রোহের সত্য ইতিহাস। আর টম ক্রুজের মত জাপানে নানবান ও মেইজি যুগে প্রচুর পশ্চিমা ‘কাউবয়’ অ্যাডভেঞ্চারার জাপানীদের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে, তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। [The Last Samurai]

আইসিন জোরো পু-য়ী

ডাকটিকেটে যাঁর ছবি, তাঁর নাম আইসিন জোরো পু-য়ী। চীনের উথাল-পাথাল সময়ে দু’বার শিশুসম্রাট হয়েছেন, একবার পরেছেন মানচুকোর রাজমুকুট। আলোকচিত্রে তাঁকে দেখা যাচ্ছে বেজিংএর বোটানিক্যাল গার্ডেনে মালীর কাজ করতে !

মানচুকোর ১৯৩২ সালের ডাকটিকেটে শেষ চিং সম্রাট আইসিন জোরো ওরফে হেনরি পু-য়ীর ছবি — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

পু-য়ীর অবিশ্বাস্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে চীনের সমস্যাসংকুল সময়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের ইতিহাস।

ঊনবিংশ শতকের শেষে জাপান ইউরোপীয়প্রধান ‘উপনিবেশী ক্লাবে’ যোগ দেয়। রুদ্ধদ্বার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাপানে মেইজি যুগ আরম্ভ হয় ১৮৬৮তে। মেইজি রাষ্ট্রনায়করা সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখেই স্বদেশের ‘পশ্চিমাকরণ’ শুরু করেন। সে সূত্রে আসে ভূমিসংস্কার, সীমিত গণতন্ত্র, বৈদেশিক বাণিজ্য আর ভাড়াটে সামুরাইদের পরিবর্তে নিয়মিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রচলন।

জাপানে কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল কম, জনসংখ্যার অধিকতার কারণে অন্ন ও কর্মসংস্থানও ছিল সীমিত। পশ্চিমাদের দেখাদেখি শিল্পায়ন শুরু হলে জাপানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ পড়ে চীনের ওপর। বিশেষ করে চীনের ‌অধীন কোরিয়া আর মানচুরিয়া, দুটোই ছিল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা।

চীন সেসময় ছিল রক্ষণশীল, পশ্চাদপর, সামন্ততান্ত্রিক একটি সাম্রাজ্য। চীনের সমসাময়িক চিংবংশীয় শাসকরা ছিল দুর্বলচিত্ত, অন্দরমহলের রাজমাতা আর খোঁজাদের প্রভাবে চালিত, আর জনবিচ্ছিন্ন। তদোপরি, চিংরা ছিল বহিরাগত। মিং নামক একটি স্থানীয় হান রাজবংশ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীন শাসন করে। এরপর পূর্ব সাইবেরিয়ার মানচুরা নুরহাচির নেতৃত্বে চীনের বিভিন্ন অংশ একে একে জয় করে চিংএর গোড়াপত্তন করে।

১৯০৬ সালে নুরহাচির আইসিন জোরো বংশে জন্ম পু-য়ীর। ১৯০৮এ চীনসম্রাট ওয়ারিশহীন অবস্থায় মারা যাবার পর রাজমাতা তিনবছরবয়সী পু-য়ীকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট হিসাবে। বিধবা-সম্রাজ্ঞী ৎসিশির জবরজং পোশাক আর কুঁকড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে পু-য়ী বেদম কান্না করেছিলেন সবার সামনে। এর কিছুদিন পর ৎসিশিও মারা যান

১৯১২ সালে হান জাতীয়তাবাদীদের শিনহাই বিদ্রোহের মুখে পু-য়ীর বাবা রাজসিংহাসনের ওপর তাঁর অধিকার রদ করে দেন। সুন-ইয়াত-সেন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেও তাঁর দলের সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বিশৃংখলা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলির গভর্নর কিংবা সেনাপ্রধানরা নিজ এলাকায় প্রকারান্তরে স্বাধীন শাসন শুরু করেন। ছবির ম্যাপে চীনের চেহারা তাই দেখা যাচ্ছে পাজ়ল পীসের মত

এই সময়টা তক্কে তক্কে ছিল জাপানের সামরিক উগ্রপন্থীরা। ইতিমধ্যেই ১৮৯৭ সালে কোরিয়া জাপানী সাম্রাজ্যের আওতায় এসেছে। চীনের ওপর রুশদের লোলুপ দৃষ্টিকে জাপানীরা অন্ধ করে দেয় ১৯০৫এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে তাদেরকে হারিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকার সুবাদে জার্মানির চীনা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কলোনিগুলি জাপানের হস্তগত হয়।

এভাবে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জাপান ইউরোপীয়দের মতই চীনসম্রাটের কাছ থেকে ‘কনসেশন’ আদায় করা শুরু করে। তারা চিংদের আদিনিবাস মানচুরিয়া অঞ্চলে রেলরোড গড়ার আর পরিচালনার লীজ় বাগিয়ে নেয়।

কোমিনটাংদের সময় চীনের অবস্থা। কোরিয়া, তাইওয়ান জাপানের অংশ, মানচুকো তাঁবেদার রাষ্ট্র, ১৯৩৭এ উত্তর চীনের বাকি অংশও জাপানের দখলে। — মানচিত্র ইন্টারনেট থেকে।

এরকম সময়ে পু-য়ী তাদের হাতে এসে পড়েন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে।

বালক পু-য়ী সম্রাট না হলেও রাজদরবার তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি। ১৯১৭এ এক জেনারেল বেজিং দখল করে পু-য়ীকে আবার সম্রাট ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা নামমাত্র সম্রাট হবার বারো দিন পর আরেক ওয়ারলর্ডের বিরোধিতার মুখে সে দাবি পরিত্যক্ত হয়। তখন পু-য়ীর বয়স এগারো।

১৯২৪ সালে পু-য়ীকে ফরবিডেন সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসময় পু-য়ীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তাঁর ব্রিটিশ শিক্ষক রেজিনাল্ড জনস্টন। পু-য়ী চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে। জাপানপ্রেমী জনস্টনই তাঁকে সুপারিশ করেন ব্রিটেনে না গিয়ে তিয়ানজিন শহরে আশ্রয় নিতে, সেখানে জাপানীদের প্রভাব রয়েছে। তিয়ানজিনে পৌঁছনোর পর চিনিতে মাছি পড়ার মত সুবিধাবাদী জাপানী-চীনাদের ভীড় জুটে গেল পু-য়ীর চারপাশে। সম্রাটের মত জীবনযাপন করতে তাঁর কোন সমস্যা হল না।

১৯৩১ সালে রেলপ্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জাপানী বাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজান্তে মানচুরিয়াকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা মুকদেন শহরের কাছে রেললাইনের ওপর ডায়নামাইট ফাঁটিয়ে তার দোষ চাপায় চীনা ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ ওপর । অফিসার্স ক্লাব থেকে জাপানীরা চীনা সেনানিবাসে গোলানিক্ষেপ করে। স্থানীয় চীনা ওয়ারলর্ড কোন অর্থবহ প্রতিরোধ না করায় কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর চীনের তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ জাপানী সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

চীন এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লীগ অফ নেশন্সে। লীগ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্ল লিটনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন পাঠায়। তদন্ত শেষ না হতেই জাপানের চররা পু-য়ীকে অনুরোধ করে ‘স্বাধীন’ মানচুরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হতে। ২৫ বছরবয়সী পু-য়ী ছোটবেলা থেকেই পরিচারকদের কাছে শুনে এসেছেন নিজ রাজবংশের গৌরবের ইতিহাস। জেনেছেন আইসিন জোরোরা স্বর্গীয় অধিকারবলে চীনের সম্রাট। অপরিপক্ব সরলমনা পু-য়ী জাপানীদের আসল মতলব বোঝার পরিবর্তে ভাবলেন, এবার তিনি ন্যায্য স্থানে পুনরোধিষ্ঠিত হবেন।

জাপানীরা অবশ্য তাঁকে শুরুতেই সম্রাট না বানিয়ে নতুন ‘পাপেট’ রাষ্ট্র মানচুরিয়ার ‘চীফ এগজেকিউটিভ’ পদে বসায়। সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম জাপানীদেরই হাতে ছিল। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই হাজারে হাজারে জাপানী এসে হাজির হলো মানচুরিয়াতে, কাজ শুরু করলো নতুন কয়লাখনি, স্টীল ফ্যাক্টরিতে। চীনাদের রাজনৈতিক স্বাধিকার পায়ে দলে তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করলো জাপানী শিল্পপতিরা।

১৯৩২এ লিটনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পর আসল সত্য বেরিয়ে এল। লীগসদস্যরা জাপানকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব আনল। অপরাধস্বীকারের পরিবর্তে জাপানের প্রতিনিধি উল্টো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করছে জাপান, চীন তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে কী পরিমাণ অবহেলা করছে, ইত্যাদির ফিরিস্তি দেবার পর দলবলসহ সম্মেলনকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। ছবিতে দেখানো টিনটিন ‌অ্যান্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকসের কার্টুন স্ট্রিপে এই সত্যি ঘটনাটি অমর করে রেখেছেন কার্টুনিস্ট এরঝ়ে।

টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে দেখানো হয়েছে লীগ অফ নেশন্স থেকে জাপানের ওয়াক-আউটের ঐতিহাসিক দৃশ্য, যদিও এখানে কাহিনী আসল ইতিহাসের থেকে শেষমেশ একটু আলাদা। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপর ১৯৩৭এ জাপান চীনের বাকি উত্তরাংশও দখল করে নেয়। চীনাদের ওপর অভূতপূর্ব সিভিলিয়ান বমিং ও হত্যাযজ্ঞ ‘রেপ অফ নানকিং’ সংঘটিত হয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পু-য়ী হন সোভিয়েতদের রাজবন্দী। তারা আরামেই রাখে প্রাক্তন সম্রাটকে। টোকিওতে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দেন পু-য়ী। এরপর ১৯৫০এ চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে পু-য়ীকে হস্তান্তর করে সোভিয়েতরা। পু-য়ী ভেবেছিলেন রুশ কম্যুনিস্টরা যেমন ৎসার নিকোলাসকে সপরিবারে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল, তেমনটাই হবে তাঁর ভাগ্যলিখন। কিন্তু মাও আর চৌএনলাইয়ের ছিল অন্য ধান্ধা।

পু-য়ীকে একটি রিএডুকেশন ক্যাম্পে রাখা হল নয় বছর। এই প্রথমবার তিনি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। এতদিন তাঁর দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করে দিত কোন না কোন চাকর, এখন সব নিজের দায়িত্ব। এছাড়াও তাঁকে দেখানো হলো তাঁর পূর্বজীবনের অত্যাচারের চিত্র। দুর্বল মনস্তত্ত্বের সুযোগে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হল তাঁকে। ১৯৫৯এ পেলেন মুক্তি, সম্রাট হিসাবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে। মাও-চৌএনলাই প্রমুখের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হল তাঁর।

বেজিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যাকারীর কাজ করছেন সম্রাট আইসিন-জোরো পু-য়ী — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

কম্যুনিস্টরা পু-য়ীর পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের ঢোল বাজাতে ব্যবহার করলেও পু-য়ীর তাতে তেমন কিছু যায়-আসেনি। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশেছেন, তারাও তাঁকে ভালবেসেছে। বেজিংয়ে মালীর কাজ করেও লজ্জিত হননি। নিজের পুরনো রাজপ্রাসাদের ট্যুরিস্ট গাইডও হয়েছিলেন কিছুদিন। সম্রাটজীবনে বার চারেক রাজনৈতিক বিয়ের পর শেষ স্ত্রীর সাথে সুখেই ঘর বাঁধেন ১৯৬২তে। ১৯৬৭ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে মারা যান শেষ চীনসম্রাট।

মারা যাবার আগে স্বদেশের প্রগতিশীল সংস্কার দেখে যান পু-য়ী। তাঁর নিজেরও যে মোক্ষলাভ হয়েছিল, তা ফুঁটে উঠেছে তাঁর বইয়ের এই উক্তির মধ্যেঃ
“I was the number one prisoner of my palaces. Today, I enjoy real freedom and equality. I can go anywhere — something I never dreamed possible in the first fifty years of my life.”


(১) মাও আর চৌএনলাইএর উৎসাহ পাওয়ার পর নিজের একটা জীবনী লিখেন পু-য়ী। ‘দ্য ফার্স্ট হাফ অফ মাই লাইফ’ নামে এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ইতালীয় পরিচালক বেরতোলুচ্চি ১৯৮৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানান, নাম ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’। [The Last Emperor]

(২) মানচু (আরেক নাম জুরচেন) জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা মোঙ্গলদের কাছাকাছি। মানচুরিয়া বলে কখনো কোন আলাদা দেশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে জাপানী ‘গবেষণার’ উপর ভিত্তি করে মানচুরিয়া আর তার অধিবাসীদের আলাদা পরিচয় বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ‘মানচুরিয়ার’ অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল হান চীনা, মানচুরা ছিল সংখ্যালঘু। তাছাড়াও মানচুরা ইতিমধ্যে হান চীনা ভাষা-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছিল। পু-য়ী মানচু ভাষায় কথা বলতে একদমই পারতেন না, ম্যান্ডারিন আর ইংরেজী পারতেন অল্প অল্প। [Manchu people]

(৩) ৎসিশি ১৮৫০এর দশকে চীনা সম্রাটের রক্ষিতা ছিলেন। সম্রাট মারা যাবার পর তিনি হন এম্প্রেস-ডাউএজার। প্রথমে ছেলে, তারপর ভাগ্নেকে সম্রাট বানিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ৎসিশিই। নানা রকম অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ছিল চিং দরবারে দৈনন্দিন ঘটনা। চীনের বহির্দেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের সম্রাটদের আমলের রক্ষণশীলতা চলে আসছিল। কয়েকটি বিদ্রোহ-বিপ্লবের পর ৎসিশি শেষের দিকে চেষ্টা করলেও চীনের উদারীকরণ করতে ব্যর্থ হন। [Empress Dowager Cixi]

(৪) ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীন ছিল গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। সুন-ইয়াত-সেন কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরে তাঁকে সরিয়ে ইউয়েন-শি-কাই নিজে সম্রাট হবার চেষ্টা করেন। বিশের দশকে কুওমিনটাং পার্টিকে সুসংহত করেন চিয়াং-কাই-শেক, সে জন্যে নতুন রাজনৈতিক দল কম্যুনিস্টদের সাথেও হাত মেলান। এসময় চীনের বড় বড় প্রদেশ, যেমন সিনকিয়াং, তুরকেস্তান, ইয়ুনান, তিব্বত, প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট মিলিশিয়া দল একরকম চাঁদাবাজি করে বেড়াত, আর একে অন্যের সাথে আঁতাত করে অন্যান্য ওয়ারলর্ডদের সাথে যুদ্ধে লেগে থাকত। ১৯২৮এ চিয়াং-কাই-শেক চীনের অধিকাংশ এলাকা একীভুত করে ওয়ারলর্ড যুগের সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু তারপরও উত্তরে বহু দুর্গম অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজিয়ে রাখে। [Warlord Era]

(৫) উত্তর চীনের উন্নয়নের নামে রুশরা মাঞ্চুরিয়াতে রেলরোড গড়ে দেয়। তার সকল আয় ছিল রুশ সরকারের। তাছাড়াও রেলরোডের আশপাশের অঞ্চলে প্রতিরক্ষার নামে সৈন্য মোতায়েন করার অধিকার বাগিয়ে নেয় তারা। রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতার পর রেলরোডের দক্ষিণাংশ জাপানীদের দখলে আসে। ১৯২৯ সালে চীনারা সোভিয়েতদের কাছ থেকে রেলওয়ে ফেরত চায়। তারা দাবি করে যে ১৯১৭এর বিপ্লবের সময় এক রুশ সেনানায়কের সাথে চুক্তি হয়েছিল রেলওয়ে বিনা খরচে চীনকে ফিরিয়ে দেবে রাশিয়া। সোভিয়েতের সাথে এক দফা যুদ্ধে হারার পর চীন রেলরোডের পূর্বাংশের ওপর রুশদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। [Chinese Eastern Railway]

(৬) নিজেরাই শত্রুর সাজ নিয়ে নিজেদের ওপর আক্রমন করে দোষ শত্রুর উপর চাপিয়ে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার এই কৌশলকে বলা হয় ‘ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক’। জাপানীদের মানচুরিয়ার ঘটনার পরপরই ইতালীয়রা ইথিওপিয়াতে আর জার্মানি পোল্যান্ডে এধরনের আক্রমণের উসিলা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধায়। অধুনা সময়ে পুতিনের রাশিয়াও এধরনের আগ্রাসন করেছে। এফএসবি বলে রুশ গোয়েন্দা-সংস্থার এক সদস্য ১৯৯৯ সালে মস্কোর অ্যাপারট্মেন্টে বোমা পাতার সময় নাকি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়। বোমা হামলার দোষ চাপানো হয়েছিল চেচেন সন্ত্রাসবাদীদের উপর, আর এই উসিলায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পুতিনের গদি পাকাপোক্ত হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে রুশরা। [False flag]

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর সিংগাপুর, মালয়, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীনও জাপানের কব্জা হয়। ১৯৪১এ পার্ল হারবার আক্রমণ, তারপর জাপানীদের বিরুদ্ধে মার্কিনদের বিপুল রক্তক্ষয়ী একেকটা দ্বীপযুদ্ধ। তারপর মিত্রদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্তালিনের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। পশ্চিম দিকে সামরিকভাবে দুর্বল জাপানী সেনাশক্তির বিরুদ্ধে রুশদের জয়যাত্রা শুরু হয় মানচুরিয়া থেকে, আর শেষ হয় উত্তর কোরিয়া আর সাখালিন দ্বীপপুঞ্জ দখলের মাধ্যমে। [Soviet invasion of Manchuria]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!