‘ডিকেন্জিয়ান ডিস্টোপিয়া’

আজকের গানটা ১৯৬৮ সালের ব্রিটিশ মিউজিক্যাল ‘অলিভার!’ থেকে। মনে হয় ৯২-৯৩এর দিকে এটা বিটিভিতে পরিবেশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়ার আগেই এটা দেখেছিলাম। আর গানগুলির কথা না বুঝেই গল্পটা আর সুরগুলি খুব মনে ধরেছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অনেক খুঁজে ডিভিডি সংগ্রহ করি।

এটা সেলেক্ট করার কারণ মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া, ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমনতর ছিল। ডিকেন্স এ কাহিনী লিখেন ১৮৩৭এ। রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের বছর সেটা। যুক্তরাজ্য সাম্রাজ্যের উচ্চতম শিখরে তখন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না, কথাটা এই সময়েই চালু হয়; কারণ তাদের কোন না কোন উপনিবেশে যখন সূর্য অস্তগামী, অন্য কোনটাতে তখন সূর্যোদয়। ভারতে ১৮৫৭র সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে সরিয়ে সম্রাজ্ঞী হিসাবে সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নেন ভিক্টোরিয়া।

আমরা ভাবতে পারি যে এসময় ভারতসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলিকে শোষণ করে ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ বিপুল সমৃদ্ধি ‌অর্জন করেছিল। বাস্তবতা এই সরল সত্যের থেকে জটিলতর! ভিক্টোরিয়ান যুগ যেমন ব্রিটিশ আভিজাত্যের নাক-উঁচু এটিকেটের জন্যে পরিচিত, ঠিক ততটা পরিচিত ‘ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়া’ হিসাবে! ডিকেন্সের আবাসস্থল লন্ডনে তখন শিল্পবিপ্লবের হাওয়া লেগেছে। শহরের বায়ু ভারি, আকাশ কালো — কয়লা পুড়িয়ে ফ্যাক্টরি-রেল চালানোর ধোঁয়ায়।

সে শহরের নিম্নবিত্ত আর উঠতি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ছিল সেরকম নিম্নমানের। তাদের পোশাকআশাক ছেঁড়া, তাপ্পিমারা, ধূলিধূসরিত, বে-সাইজের। যাদের ভাগ্যে খাদ্য-পানীয় নিয়মিত জুটত, তাও ছিল অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা। অনেকে থাকত পরিত্যক্ত বাড়িতে বস্তি করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা অসুস্থ হয়ে পড়ত, তাদের ডাক্তার পাঠাত সমুদ্রতীরের বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্যে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা আর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্লেগ-মহামারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি নিয়মকানুনও অতটা চটপটে হয়ে উঠেনি যে দ্রুত পতনমুখী জীবনযাত্রার মান আর উচ্চগামী আয়বৈষম্যকে আয়ত্তে আনবে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এই দৃশ্যে দেখবেন এতিম অলিভার কপালের ফেরে ফেগিন নামে এক পকেটমার সর্দারের আস্তানায় এসে পড়েছে। ডিকেন্সের নিজের ছোটবেলার একটা ছায়া আছে অলিভারের মধ্যে। তাঁর ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবাকে জেল খাটতে হয় অপরিশোধিত ঋণের কারণে। তখন পরিবারের ঘানি টানতে স্কুল ছেড়ে ফ্যাক্টরিতে কাজে যেতে হয় ডিকেন্সকে।

এই গানটিতে অলিভার ভাবছে ফেগিনদের লন্ড্রির ব্যবসা, কারণ একটা ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে তাদের গোপন আখড়ায় অনেকগুলি সিল্কের রুমাল শুকাতে দেয়া হয়েছে। নিষ্পাপ-সরল অলিভারকে খেলাচ্ছলে ফেগিন আর তার বালক সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝাচ্ছে কিভাবে পকেট কাটতে হয়। সে দৃশ্যে ফেগিন সেজেছে অভিজাত উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ — কিছুটা কমিক তার সেই ভোল, কারণ উচ্চবিত্তের এটিকেট থাকলে কী হবে, সত্যিকার অর্থে তারাও ছিল লোভী-হিংসুক গোছের! অলিভারকে শিখাতে ফেগিনকে বোকা বানিয়ে আর্টফুল ডজার আর তার দোস্তরা সমানে মাল সরিয়ে চলেছে!

ডিকেন্স ছিলেন মানবচরিত্রের ভাল পর্যবেক্ষক, আর জটিল ক্যারিকেচার তৈরির বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাহিনীগুলির কোন ক্যারেক্টারই সোজাসাপ্টা খারাপ বা ভাল ছিল না — সাদাও নয়, কালোও নয়, ধূসর। যেমন এই মুভির ফেগিন চরিত্রটা — সে লোভাতুর বটে, কিন্তু সে যে সেটা করছে পেটের দায়ে! বুড়ো বয়েসে তাকে দেখার কেউ নেই, এসব চিন্তায়। আর বালকবয়সী চামচাদের সে বাবা না হলেও গার্জেনের মত, আগলে রাখার মত কিছুটা দায়িত্ববোধ আছে।

ভিক্টোরিয়ান সমাজে এত শ্রেণীবিভেদ, এত অসমতা থাকা সত্ত্বেও সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল। ডিকেন্সের ক্যারেক্টারগুলি কখনো কখনো সৌভাগ্যবানও হত। বাস্তবেও যারা সুযোগসন্ধানী ছিল, তারা খোদ ব্রিটেনে না পারলেও জাহাজের খালাসী হিসাবে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে, নয়ত ভারতে — যেখানে ভদ্রলোকে যেতে চাইত না — সেখানে সেনা-নৌ অফিসার হিসাবে গিয়ে রাতারাতি একটা কূলকিনারা করে ফেলতে পারত। তারপর বাড়ি ফিরে জমিজমা কিনে, ব্যবসা বানিয়ে ভবিষ্যতটা আরেকটু পাকাপোক্ত করে ফেলত।

শেষ করি একটা কন্ট্রাস্ট দেখিয়ে। সোশ্যালিজম-কম্যুনিজমের পিতৃদেব কার্ল মার্ক্সও ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ অব্দি লন্ডনে ছিলেন। ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়ার প্রতক্ষদর্শী তিনিও। তাঁর ১৮৬৭তে লেখা ‘ডাস কাপিটাল’এ ব্যাখ্যা করেছেন শ্রমিকশ্রেণীর ওপর পুঁজিবাদী শোষণের পদ্ধতি, আর সেই শ্রেণীবিষম সিস্টেম ভাঙার লক্ষ্যে প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু সেই বিপ্লব ব্রিটেনে হয়নি। হয়েছিল শিল্পবিপ্লবে পিছিয়ে থাকা ইউরোপের সবচে’ কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়াতে, যেখানে তা হবারই কথা নয়, তাও আরো ৫০ বছর পরে। মার্ক্সের থিওরি নানা প্যাঁচঘোঁচ মেরে তৈরি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ‌অতিরিক্ত সিম্প্লিস্টিক ছিল, তাই ভুলও ছিল। হয়ত বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করে আর গলা হাঁকড়িয়ে নিম্নবিত্তগোষ্ঠীর ‘সায়েন্টিফিক প্রফেট’ হওয়াটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সেখানে কিন্তু ডিকেন্স শুধু উপন্যাস-বই লিখেই দমে থাকেননি। রাজনীতিতে সরাসরি যোগ না দিয়েও লেখনী দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমটার উৎকর্ষসাধন করেছেন। খাদ্য-পানীয় আর শিশুশ্রম সংক্রান্ত অনেক মানবিক আইন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অক্লান্ত অ্যাকটিভিজমের কারণেই হয়। অনেকগুলি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সহায়তা করেন। সেসব কর্মকান্ডের সুফল তাঁর পরবর্তীপ্রজন্ম এখনো ভোগ করছে। তাঁর ভাষায়, ‘দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হেড, অ্যান্ড… দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হার্ট!’ উচিত কথা!

(এখানে পাবেন গানটির কথা।)



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




One Reply to “‘ডিকেন্জিয়ান ডিস্টোপিয়া’”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!