কামার ও শয়তান – ১

“… শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল যে বেচারার দমই ফেলা দায় । সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল— সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।

“কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিপে ধরল। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে হেইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রাবারের মত লম্বা হতে লাগল। … “

প্যারা দুটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘তিনটি বর’ নামে গল্প থেকে নেয়া। ছোটবেলায় তার সংকলিত দেশ-বিদেশের উপকথা নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ছিল। শয়তানের মত ধূর্ত বদ চরিত্রকেও যে ঢিঁট করা সম্ভব, সে গল্প পড়ে বেদম মজা পেয়েছিলাম।

এই গল্পটা নাকি কমপক্ষে ছয় হাজার বছরের পুরনো!

২০১৬ সালে গবেষক জামশেদ তেহরানি ও গ্রাসা দি সিলভা ফাইলোজেনেটিক অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের ভিত্তিতে রিসার্চ করে এ তথ্যটা আমাদের দিয়েছেন। তাদের বিচারে ইন্দোইউরোপীয় ভাষার জন্মের আদিকালে এ গল্পটি মুখে-মুখে প্রচলিত ছিল। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়া আর রাশিয়া থেকে শুরু করে আয়ারল্যান্ড অব্দি এটি নানা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে শ্রোতাদের কাছে। সে সময়ে বই দূরের কথা, লিখনপদ্ধতিরও আবিষ্কার হয়নি। কথক কিংবা বার্ড বলে একটি পেশা ছিল যাদের কাজ কেচ্ছা শুনিয়ে বেড়ানো।

ঊনবিংশ শতকের ইলাস্ট্রেশনে সেন্ট ডানস্ট্যান শয়তানের নাকটা চিমটে দিয়ে ধরে দিলেন এক টান, হেইয়ো…

গল্পটার সারবস্তু হলো শয়তান, মৃত্যু, জ্বীন কিংবা কোন অপদেবতার কাছ থেকে নিজের আত্মার বিনিময়ে কামার অলৌকিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়। তারপর সে ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়েই কূটকৌশল করে চুক্তি থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নেয়।

উপেন্দ্রকিশোরের গল্পটিতে অবশ্য কামার তিনটি বর পায় এক বৃদ্ধ মানুষের ছদ্মবেশধারী দেবতাকে সাহায্য করে। আর মৃত্যুর পর স্বর্গ-নরক কোথাও কামারের স্থান হয় না। শয়তান নরকের আগুন থেকে কাঠকয়লা ছুঁড়ে তাকে দূর করে দেয়। সেই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে জলায় জলায় সে ঘুরে বেড়ায়, আর তার আলো দেখা যায়। তাইই নাকি আলেয়া — জ্যাক ও’ল্যান্টার্ন। হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের উৎপত্তি এই রূপকথা থেকেই। ইংরেজী কাহিনীতে কামারের নাম জ্যাক। আবার অন্য কোন কাহিনীতে সে সেন্ট ডানস্ট্যান। ফ্রান্সে সেন্ট ডানস্ট্যান হয়ে গেছে স্যাঁত-এলোয়া।

হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টারনের উৎস স্মিথ অ্যান্ড দ্য ডেভিল নামে সুপ্রাচীন এক উপকথায়।

রাশিয়াতে কাহিনীটা একটু পরিবর্তিত। সেখানে কামারের সহকারী শয়তান, যে কিনা তাকে বিপদে ফেলে। গ্রীকদেরও প্রায় একইরকম গল্প আছে। চেক ভারশনে উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের মত স্টুলে শয়তানকে আটকে রাখে কামার। এর্রেমেন্তারি বলে একটা বাস্ক ভাষার ছবি দেখেছিলাম ক’দিন আগে নেটফ্লিক্সে, তার কাহিনীতেও শয়তানকে চালাকি করে নিজের কারখানায় নেহাইয়ের সাথে আটকে রেখে দিয়েছিল শ্মশ্রুমন্ডিত পাগলা কামার। আয়রিশ ভার্শনে কামারকে বর দেয় ফেইরি কুইন।

বাস্ক লোককাহিনীভিত্তিক মুভি এর্রেমেন্তারিতে শয়তানকে খাঁচায় পুরে রেখে দিয়েছে কামার।

প্রায় একই রকম গল্প জার্মানিতে প্রচলিত ছিল বিদ্বান ডক্টর ফাউস্টের নামে। শয়তানের কাছে নিজের জীবন বন্ধক রেখে নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াত মধ্যযুগীয় এ চরিত্র। পরে ক্রিস্টোফার মার্লো আর গ্যেটে ফাউস্টকে নিয়ে মেলোড্রামাটিক ক্লাসিকাল কাহিনী ফেঁদে বসেছেন। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় এসেও কাহিনীটির বিবর্তন শেষ হয়নি। আপালাচিয়ান পর্বতমালার মানুষ জনি দ্য ফিডলার নামে চেনে এই ধূর্ত কামারকে।

গ্রীক কামার দেবতা হেফেস্টাস তার কর্মশালায়, ক্লাসিকাল শিল্পীর কল্পনাতে।

কামারের ধূর্ততা আর কূটকৌশলের একটা তাৎপর্য যে আছে সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করতে চাই। শুধু যে লোককথায় আছে কামার তা নয়। বিভিন্ন প্রাচীন দেবদেবীর কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে কামার দেবতার পেশাভিত্তিক যে স্থান, সেটা আর কারো নেই। উদাহরণ, গ্রীক দেবতা হেফেস্টাস, আফ্রোদিতির স্বামী। মুখভর্তি দাঁড়ি, লেংচা, কুৎসিত। অথচ ধাতু নিয়ে সে অসাধারণ সব জিনিস বানিয়ে ফেলে। জিউসের বজ্র থেকে শুরু করে হার্মিসের শিরোস্ত্রাণ, একিলিসের বর্ম — এগুলি তারই বানানো। একটা রথও সে বানিয়ে ফেলে যা কিনা নিজ থেকেই সচল। অর্থাৎ হেফেস্টাস গ্রীক দেবতাদের টেক-গীক! ও হ্যাঁ, নিজের মা হেরাকেও চেয়ারে সেঁটে রাখার কৃতিত্ব তারই। এখানে শয়তানের জায়গা নিয়েছেন মাতৃজননী স্বয়ং।

গ্রীকদের হেফেস্টাসের মত রোমানদের ভাল্কান। দু’জনেরই কর্মশালা আগ্নেয়গিরির মধ্যে। যখন তারা কাজ শুরু করে সেখানে, তখন মাউন্ট এটনা থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়।

নর্স-জার্মানিক জাতিগোষ্ঠীদের কামার দেবতার নাম ওয়েল্যান্ড কিংবা ভলুন্ড। আইসল্যান্ডিক ভাষায় লেখা পোয়েটিক এডাতে তার গল্প রয়েছে। কেল্টিকদের গভন্যু। ফিনিশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় নয়, তারপরও তাদের জাতীয় কাহিনী কালেভালাতে ইলমারিনেন নামে এক কামার চরিত্র রয়েছে। জাদুর ধাতব জিনিসপাতি বা সাম্পো তৈরি করে সে — তামার জ্যান্ত ঘোড়া পর্যন্ত।

ফিনিশ-সোভিয়েত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘সাম্পো’তে কালেভালা কাহিনীর কামার ইলমারিনেন একটা ধাতব স্লেজ বানাচ্ছে।

ইরানী উপকথায় কাভে আহাঙ্গারানও কামার। অত্যাচারী রাজা জাহাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পারসিকদের মুক্ত করে সে। ককেশাসের ওসেটিয়াতেও রয়েছে কামারদেবতার উপকথা। আর বৈদিক যুগের ভারতের ত্বস্তৃ, পরবর্তীতে বিশ্বকর্মা নামে ব্রহ্মায় মিলিয়ে যান। জাপানেও রয়েছে আদি কামার আমাকুনি।

কেন্টাকির লেক্সিংটনে পুরনো বাড়ির চৌকাঠে হর্স শু ঝুলছে। এ কুসংস্কার আমেরিকায় এসেছে আইরিশদের সাথে।

শুধু এশিয়া আর ইউরোপ নয়, পশ্চিম আফ্রিকাতেও কামারদের আলাদা মর্যাদা। অনেকের ধারণা তারা জাদুকর। কোন কোন কালচারে কামার আর মেডিসিনম্যান একই ব্যক্তি। লোহা আর আগুনের কম্বিনেশন দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যাপারটাও মনে হয় কামার-ওঝাদের ঊর্বর মস্তিষ্কের ফল! হর্সশুও তাই অমঙ্গলনাশক। নাইজেরিয়ার দেবতা ওগুন কামারদেরই পৃষ্ঠপোষক।

অর্থাৎ, ইন জেনারেল, কামার পেশাটা ম্যাজিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, শুধু ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতিতেই নয়। কেন ও কিভাবে, এটাই জানতে চাই! হাজার হোক, টেকনলজিস্ট আর ইনজিনিয়াররা এ যুগের কামার, শুধু সেকালের সম্মানটা আর নাই!

(দ্বিতীয় খন্ডে সমাপ্য)

একশৃঙ্গ অভিযান

সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর রোমাঞ্চকর সব অভিযানের মধ্যে একটা ছিল একশৃঙ্গ অভিযান। তাতে শঙ্কু আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা তিব্বতের দুর্গম এলাকায় গিয়ে সন্ধান পান অদ্ভূত এক স্থানের। সেখানে দুনিয়ার যাবতীয় রূপকথার প্রাণী আর বৃক্ষের আবাস — এদের মধ্যে একটা হচ্ছে ইউনিকর্ন, যার বাংলা সত্যজিৎ করেছেন একশৃঙ্গ।

এই গল্পটা আজ মনে পড়ল একটা খবর দেখে। বিজ্ঞানীরা পুরনো কিছু ফসিল পুনরায় নিরীক্ষণ করেছেন, যেগুলি এলাস্মোথেরিয়াম বলে এক অতিকায় গন্ডারজাতীয় প্রাণীর। গন্ডারের শিংয়ের থেকেও লম্বা একটিমাত্র শিং ছিল এই আদি স্তন্যপায়ী প্রাণীটির। কিছুদিন আগেও ধারণা করা হত যে এলাস্মোথেরিয়াম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক থেকে দু’লাখ বছর আগে।

নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন যে পশ্চিম রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া ও উত্তর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এলাস্মোথেরিয়াম বেঁচে ছিল ৩৬,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ এলাস্মোথেরিয়াম সিবিরিকাম নামক এ প্রজাতিটির সাথে আদি হোমো স্যাপিয়েন্সের মোলাকাত অসম্ভব কিছু ছিল না। হয়ত কোন কোন দুর্গম এলাকায় আরো কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে এই ইউনিকর্ন।

স্বভাবতই আমরা ভাবতে পারি এই এলাস্মোথেরিয়ামই রূপকথার ইউনিকর্ন কিনা। প্রাচীনকালের মানুষ হয়ত সে জানোয়ারকে নিয়েই বর্তমানের রূপকথা ফেঁদেছে। যদিও রূপকথার ইউনিকর্ন দেখতে ঘোড়ার মত, তার শিং প্যাঁচানো। আর এলাস্মোথেরিয়াম দেখতে গন্ডারের মত। তবে তাপির, গন্ডার আর ঘোড়া একই বর্গের খুরসহ প্রাণী — তাদেরকে বলে অড-টোড্ আঙ্গালেটস

যদি ধরে নিই এলাস্মোথেরিয়ামই আদিকালের ইউনিকর্ন, তাহলে প্রস্তরযুগের মানুষ তার চিত্র ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় এঁকেছে ১৩,০০০ বছর আগে। আবার ২,৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার টেরাকোটা সীলেও পাওয়া গেছে এর মত এক ছবি। চীনা আর তুর্কী-মোঙ্গল মিথলজিতেও এরকম ঘোড়া আছে। আবার অনেক ক্লাসিক গ্রীক লেখক ইউনিকর্নের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের বইয়ে। কিন্তু সন্দেহ নেই তাদের সে বিবরণ সেকেন্ড-হ্যান্ড, পূর্ববর্তী কোন মৌখিক গল্প শুনে তাতে আরো মনের মাধুরী মিশিয়ে মুখরোচক বানিয়েছেন একশৃঙ্গ ঘোটককে।

মধ্যযুগে আরব আলকেমিস্টরা ইউনিকর্নের শিংয়ের ভেষজ গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। আবার বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ নাকি ফ্রাংক সম্রাট ও প্রথম হোলি রোমান এম্পেরর শার্লমেইনকে ইউনিকর্নের শিং উপহার পাঠিয়েছিলেন, যেগুলো এখন ফ্রান্সের এক জাদুঘরে সংরক্ষিত। কিন্তু এগুলো আসলে নারহয়াল নামে এক শিংওয়ালা তিমির। এখনো চীনের হোমিওপ্যাথি মেডিসিনে গন্ডারের শিংয়ের ওষধি গুণ আছে বলে কুসংস্কার চালু আছে। যেকারণে আফ্রিকার প্রচুর দেশে পোচাররা বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক রাইনো মেরে তাদের শিং চীনা-অধ্যুষিত দেশগুলিতে মোটা দামে পাচার করেছে।

রূপকথার প্রাণী নিয়ে যে জীববিদ্যা তাকে বলে ক্রিপ্টোজুওলজি। যারা এতে আগ্রহ পান, তারা নানাভাবে অতীতের বিলুপ্ত প্রাণীর সাথে রূপকথার জীবের যোগাযোগ বের করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে তাদের থিওরিগুলি প্রমাণ করা সহজ কাজ নয়। মানুষের আদিমতম স্মৃতিগুলি সোজাসাপ্টা লিখিত ভাষায় কেউ বলে যায়নি। যদি থেকে থাকে তো তা মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ টাইপ ঘুমের গান অথবা ঠাকুরমার ঝুলির মত গল্পের মাধ্যমে কালে কালে অনেক ফিল্টার হয়ে আমাদের কাছে এসেছে।

কিন্তু রূপকথা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা বলবেন যে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথাগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। আমাদের দেশের ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতবর্ষের রূপকথার সাথে পূর্ব ইউরোপের রূপকথার যোগাযোগ নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন বলে মনে পড়ে। তাঁর আগ্রহ যোগানোর জন্যে বোধহয় তাঁর গুরু ময়মনসিংহগীতিকার সংকলক দীনেশচন্দ্র সেন কৃতিত্বের দাবিদার। দীনেশচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় উপকথার পাইওনিয়ার, যদিও তিনি তুলনামূলক লোককথা নিয়ে শহীদুল্লাহর মত কাজ করেননি।

এখানে এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, শহীদুল্লাহ ধর্মপরায়ণ মুসলিম ছিলেন, একই সাথে বৌদ্ধ চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা-অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃত-তিব্বতীসহ বহু প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় তাঁর দখল ছিল। পশ্চিমা শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়েও আরবী-ফারসী থেকে অনেক সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যার মধ্যে রুবাইয়াতে ওমর খইয়াম রয়েছে। আজকের যুগে আমাদের তরুণপ্রজন্ম তাঁর নাম শুনেছে কিনা আমার সন্দেহ!

যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি। চীনের মিথে যেমন ড্রাগন আছে, তেমন ইউরোপেও আছে, আবার দক্ষিণ আমেরিকাতেও সর্পরূপী দেবতার উপাসনা করা হত। আমাদের রূপকথায় যেমন পঙ্খীরাজ, তেমন তুর্কী-মোঙ্গল-তিব্বতী রূপকথাতেও আছে উড়ন্ত ঘোড়া। তুর্কীদের পঙ্খীরাজের নাম আবার তুলপারনর্স ভাইকিংদের উপকথার ভালক্যুরিরা উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসত নিহত বীরদেরকে ভালহাল্লা স্বর্গে নিয়ে যেতে। গ্রীকদের পাখাওয়ালা ঘোড়ার নাম পেগাসাস

সেরকম কেল্টিক রূপকথায় আছে ডয়ার্ফগবলিন, লর্ড অফ দ্য রিংসে দেখে বুঝেছেন যে ডয়ার্ফদের অবসেশন মাটি খুঁড়ে ধনরত্ন বের করা, কিন্তু তাদের মত কিপ্টে আর হয় না। সেরকম ভারতের রূপকথায় আছে যক্ষ আর যক্ষের ধন।

কোত্থেকে কি এসেছে সেটা বের করা কঠিন কাজ। তবে কিছু কমন থিম সব রূপকথায় আছে। যেমন জোসেফ ক্যাম্পবেল বলে এক উপকথাবিদ হিরো থিমটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। হিরো থাকবে একজন গল্পে, তার ‘কামিং অফ এইজে’ বা পরিপক্বতার বয়েসে   কোন কঠিন পরীক্ষা বা ফীট থাকবে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গ্রীকদের ‘টুয়েল্ফ টাস্কস অফ হারকিউলিস’। জোসেফ ক্যাম্পবেল এসব কাহিনীকে ইন্টারপ্রেট করেছেন প্রাচীন মানুষের মনস্তত্ত্ব আর তাদের ম্যাজিকে বিশ্বাসের মাধ্যমে। এ থিমটা তাই সব কালচারেই কমন, কারণ সব মানবপ্রজাতির আদি মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন একইভাবে হয়েছিল, পরে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেসবে আরো স্থানীয় ডিটেইল যোগ হয়।

কিছু রূপকথাতে সেক্সুয়াল আন্ডারটোনও রয়েছে। যেমন বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট এবং আরো অনেক। আমি জানি না কোন নৃতত্ত্ববিদ এ প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, যে সেসব কাহিনী প্রাচীনকালে যেসব আলাদা আলাদা মানবপ্রজাতি ছিল — যেমন নিয়ান্ডারটাল, হোমোসেপিয়েন্স, ডেনিসভ়ান, আরো একটি অজানা প্রজাতি — তাদের মধ্যে ইন্টারমিঙলিংয়ের অবচেতন স্মৃতি। তারা যে ইন্টারমিঙ্গল করেছিল তা এখন বিজ্ঞানীদের অজানা নেই, আফ্রিকার বাইরের মানুষের কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ জীন নিয়ান্ডারটাল। বলা বাহুল্য নিয়ান্ডারটালদের চেহারা ছিল গাঁট্টাগোট্টা, অনেকটা লর্ড অফ দ্য রিংসের ডয়ার্ফরাজা গিমলির মত! আবার যদি ডেনিসোভানদের আরো পরিপূর্ণ ফসিল বেরোয়, আর তাতে যদি দেখা যায় তারা এল্ফদের মত, তাহলে তো উপকথাবিদ-নৃতত্ত্ববিদ দুয়েরই পোয়াবারো! এখানে আমি সত্যজিতের মত একটু অতিকল্পনার আশ্রয় নিলাম!

অনেক কাহিনীই আছে যেখানে কল্পনার আশ্রয় নেয়ার কোন দরকার নেই। নূহনবীর মহাপ্লাবনের কাহিনী ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সুমেরীয় গল্প থেকে এসেছে। সে কাহিনী পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তার অংশবিশেষের উল্লেখ আছে প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশের বীরত্বগাঁথার মধ্যে। আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ যদি পড়ে থাকেন, তাহলে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রাচীন মিশরের টেইল অফ দ্য শিপরেকড সেইলর পড়ে মিলিয়ে দেখুন!

আরব্যোপন্যাসের আলিবাবা-চল্লিশ চোরের কাহিনী তো সত্য ঘটনা অবলম্বনে! ১৪৫৬ থেকে ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে হিব্রুদের পূর্বসূরী কানানাইট জাতির জোপা (বর্তমান জাফা) নগররাষ্ট্র ফারাও তৃতীয় থুতমোসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। প্রাচীন মিশরের নাপোলেওঁ হিসাবে পরিচিত থুতমোসে তাঁর জেনারেল জেহুতিকে পাঠান বিদ্রোহদমনে। জেহুতি জোপ্পার রাজকুমারকে শান্তিআলোচনার নামে নগরপ্রাচীরের বাইরে তাঁর ক্যাম্পে দাওয়াত দিয়ে পাঠান। তারপর চালাকি করে তাঁকে বন্দি করে ফেলেন। আর কয়েকশ’ সৈন্যকে বস্তায় ভোর ঘোড়াগাধার পিঠে চাপিয়ে এক রথীকে পাঠান নগরে। সেখানে গিয়ে রথী ঘোষণা করে যে জেহুতি রাজকুমারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন আর নগরবাসীকে শান্তির টোকেনস্বরূপ উপহার পাঠিয়েছেন। মাথামোটা কানানাইটরা যে দরজা খুলে দিয়েছিল বলা বাহুল্য! ট্রোজান হর্সের কাহিনীও একই রকম!

কথায় কথায় ইউনিকর্ন থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। উপসংহারে এটুকুই বলতে চাই যে, মানবসভ্যতার রূপকথা-মিথ-ফেইরিটেল-লেজেন্ডের মধ্যে অনেক ভুলেযাওয়া স্মৃতি আছে যেগুলি মানুষ এখনো ফিরে ফিরে মনে করে, কারণ সেগুলি তার মানসের কাছে এখনও ‌আকর্ষণীয়। কয়েক শতাব্দী পরে স্টার ওয়ারসের ল্যুক স্কাইওয়াকার হয়ে যাবে গিলগামেশ, লর্ড অফ দ্য রিংস হয়ে যাবে রামায়ণ বা ইলিয়াড। এগুলিতে যা রয়েছে, পূর্বসূরীদের মত তাদের একই রসদ! তখনকার মানুষ তাই খাবে, কারণ তার মনস্তত্ত্ব তখনও থাকবে আজকের মতই প্রাচীন।

 

১৮৭৮ সালে শিল্পীর কল্পনায় এলাস্মোথেরিয়াম চিত্রিত হয়েছিল এভাবে। ১৮০৮ সালে প্রাণীটির বিবরণ প্রথম প্রাণীবিদদের কাছে তুলে ধরেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের পরিচালক য়োহান ভ়াল্ডহাইম।
নেদারল্যান্ডের উট্রেখটের রাইকসমিউজিয়ামে সংরক্ষিত ‘ইউনিকর্নের শিং’।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনায় ১৮৮৫ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯এ ঢাকাতে। বহুভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ. করার পরে ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল চর্যাপদের প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট বা আঞ্চলিক ভাষার বিশ্লেষণ। তিনি ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেটধারী। দেশবিভাগের আগেই পূর্ববঙ্গের নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ৫২র ভাষা আন্দোলনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
কনরাড গেসনার নামক এক সুইস প্রকৃতিবিজ্ঞানী ১৫৫১ সালে তাঁর প্রকাশিত ইস্তোরিঈ আনিমালিয়ুম গ্রন্থে ইউনিকর্নকে কল্পনা করেছেন এভাবে।
ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় পাওয়া ‘ইউনিকর্নের’ স্কেচ, ১০ থেকে ৫০,০০০ হাজার বছরের পুরনো।
মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া চার হাজার বছরের পুরনো ‘ইউনিকর্নের’ ছাপমারা সীল। এরকম বহু পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পাতে। অবশ্য পাশ থেকে দেখা জ়েবু নামক বৃহদাকার গবাদিপশুও হতে পারে।
দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম ঢাকা জেলায়, ১৮৬৬ সালে; মৃত্যু ১৯৩৯এ কলকাতায়। ঢাকা কলেজ আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের (বর্তমানে কলেজ) প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় ২১টি গাঁথা সংকলন করেন, চন্দ্রকুমার দে’র সহযোগিতায়। ১৯২৩এ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পরে দেশী-বিদেশী সাহিত্যবোদ্ধামহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকেই এ গানগুলো সংগৃহীত। মৈমনসিংহ গীতিকার সাফল্যের পরে পূর্ববঙ্গগীতিকা বলে আরেকটি সংকলন ১৯২৬এ প্রকাশিত হয়। এতে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর পালাগানের নমুনা সংরক্ষিত হয়েছে।
নারহয়াল তিমি, ঠান্ডা উত্তর সাগরে এর বাস। এর ‘শিং ’ আসলে তার লম্বা প্যাঁচানো একটি দাঁত।
ব্ল্যাক রাইনো, সারা দুনিয়াতে পাঁচ হাজারেরও কম আছে এখন। পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে নিরামিশাষী এই প্রাণীর আবাস ছিল।
নিউ ইয়র্কের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত নিয়ানডারটালের কংকাল। দেড় লাখ বছর আগে আদি মানুষ হোমো ইরেক্টাসের একটি ধারা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে এবং বিবর্তিত হয় হোমো নিয়ান্ডারটালেন্সিসে। ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এরা টিকে ছিল ৪২,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। ৪৫,০০০ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স, যে কিনা আফ্রিকায় ইরেক্টাস থেকে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়, ইউরোপে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ তিন থেকে চার হাজার বছর মানুষের দুটো আলাদা জাত একই এলাকায় পাশাপাশি বসবাস করেছে। সন্দেহ নেই যথেষ্ট মারামারি তারা করেছে খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদার জন্যে। তাদের মধ্যে যে ব্রীডিংও হয়েছিল সেটার প্রমাণও আমাদের জেনেটিক ম্যাপে পাওয়া গেছে।
মোঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীকে তাদের উপকথার উড়ন্ত অশ্ব তুলপারকে দেখানো হয়েছে এভাবে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে আঁকা তেয়্যেরিয়ানো-রেমেনসিস কোডেক্সে মধ্য আমেরিকার অ্যাজটেক সভ্যতার দেবতা কেৎসালকোয়াতলকে দেখানো হয়েছে পালকওয়ালা সর্প হিসাবে। মায়াদের কাছে একই দেব পরিচিত কুকুলকান হিসাবে। মেক্সিকোর বিখ্যাত তেওতিওয়াকানে এই সর্পদেবের উপাসনার প্রমাণ পাওয়া যায়, ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ফেদারড সারপেন্টের উপাসনা আরো আদিম ওলমেক সভ্যতাতেও ছিল, তাদের বয়স কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর। পূর্ব এশীয় সভ্যতাগুলিতেও ড্রাগন একইরকম সম্মানের আসনে অধিষ্ট।
ইংরেজ চিত্রশিল্পী অশ্বারোহী ভালক্যুরিদের কল্পনা করেছেন এভাবে। নর্স মিথোলজিতে আরেকটা উড়ন্ত ঘোড়া আছে যার নাম হোফৰার্পনির আর আরোহী বার্তাবাহক দেবী গ্না। দেবপিতা ওডিনের আটপেয়ে ঘোড়ার নাম স্লীপনির। কোরিয়ার প্রাচীন রাজাদের সমাধিতেও আটপেয়ে পাখাওয়ালা ঘোড়ার চিত্র পাওয়া গেছে।
ল্যুভরে প্রদর্শিত অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি বীর গিলগামেশের মূর্তি। গিলগামেশের কাহিনীতে তিনি অমরত্বের সন্ধানে গিয়ে হাজির হন দিলমুন বলে দূরের এক দেশে (বর্তমান বাহরাইন এলাকার সুমেরীয় নাম)। সেখানে উতনাপিশতিম বলে এক সাধুর কাছে আছে অমরত্বের গুপ্তরহস্যের উত্তর। এই উতনাপিশতিম নিজে অমর, দেবতাদের আশীর্বাদে। আর দেবতাদের নির্দেশে নূহনবীর মত বজরা বানিয়ে মহাপ্লাবন থেকে নিজ পরিবারকে রক্ষা করেন, সাথে বিভিন্ন প্রাণী।
Link
৭৮-৮০ খ্রীষ্টাব্দে রোমসম্রাট ডোমিশানের এই মুদ্রার এক পিঠে গ্রীক পুরাণের পেগাসাসের ছবি। হিরো বেলেরোফোন তাকে ধরে পোষ মানায়, তারপর তার সাহায্যে কাইমিরা নামক এক দানবকে হত্যা করে।
সাইবেরিয়ার ডেনিসোভার গুহায় দুয়েকটা দাঁত আর অল্পকিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে বেশিদিন হয়নি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে, এগুলি নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্স থেকে ভিন্ন আরেকটি মনুষ্যপ্রজাতির, যার নাম দেয়া হয়েছে ডেনিসোভান। এগুহায় অন্যান্য সময়ে নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্সেরও বসতি ছিল। ১৫০,০০০ থেকে ৪৮,০০০ বছর আগ পর্যন্ত এই গুহায় ডেনিসভানদের বসবাস ছিল। নিয়ান্ডারটাল আর ডেনিসভান সংকর এক কিশোরীর হাড়ের অংশও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেলানেশিয়ান আর অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ৩% থেকে ৫% জীন তারা পেয়েছে ডেনিসভানদের থেকে।
This tale is the oldest known instance of a story of a castaway on a fabulous island, who returns home laden with riches. The Sinbad, the Sailor stories [1] from One Thousand and One Nights belong to the same tradition and share many of its characteristics.
Link
মিশরের লুক্সরের কারনাক মন্দিরে খোদাই করা ফারাও থুতমোসের যুদ্ধংদেহী কায়া। তিনি একাধিক যুদ্ধবন্দীর চুল মুঠো করে ধরে মুগুর দিয়ে তাদের মাথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন। একই সাথে লেখা আছে প্যালেস্টাইনের ১১৯টি শহরের নাম, আর লেবানন থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ২৪০টি শহরের নাম, যেগুলিকে তিনি মিশরের বশ্যতাস্বীকারে বাধ্য করেন। এ এলাকার লোকজন সবসময়ই সুযোগে থাকত কখন আশপাশের বড় বড় রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে নিজেদের সার্বভৌমত্ব জাহির করবে। কোন ফারাওয়ের মৃত্যুবরণের পরে যদি কমবয়েসী যুবরাজ সিংহাসনে আসীন হত, তখন তারা মোক্ষম সুযোগ ভেবে অন্য বড় সাম্রাজ্যের সহায়তায় বিদ্রোহ করে বসত।

বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য

Featured Video Play Icon

গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।

ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!

এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।

এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।

এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা

কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অ‌গ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।

সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।

ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।

দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।

পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।

এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।

আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেল ডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিক গথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁওহিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।

অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।

পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।

উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।

বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।

এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।

স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।

কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল

বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।

ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।

লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!

আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।

ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।
জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।
বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।
৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।
দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।
ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।
জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।
জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।
১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।
মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই এক‌ই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।
গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)
১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)
১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।
ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।
জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।
বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।

প্রেতাত্মার রাত্রি

Featured Video Play Icon

হ্যালোউইন সমাগত প্রায়। অক্টোবর শেষের এই উৎসব আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে নানা নামে পালিত হয়। এদেশের বাচ্চারা ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোর সাজ পড়ে পাড়ার বাড়ি বাড়ি যায় ভয় দেখাতে। ট্রিক অর ট্রীট বলে টফি-চকলেট আদায় করে নেয়।

এই উৎসব মার্কিনদেশে এসেছে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড থেকে। এখন সেক্যুলার অনুষ্ঠান হিসাবে পালিত হলেও, খ্রীষ্টধর্মের ঐতিহ্যের অংশ এটা। হ্যালোউইন মানে হ্যালোড ইভ়নিং বা পবিত্র রাত্রি, যে রাত সকল সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনার জন্যে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু এর শিকড় প্রাক-খ্রীষ্টান কেল্টিক ড্রুইড ঐতিহ্যে, যার ‌বৈশিষ্ট্য পূর্বপুরুষ আর প্রকৃতিদেবীর আরাধনা। বর্তমান যুগে সে ঐতিহ্যের বাহক আইরিশরা হ্যালোউইনকে সাওয়িন নাইট বা পবিত্ররাত্রি হিসাবে পালন করে — শুধু সেটা তাদের ক্যাথলিক ধর্মে এসে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে।

হ্যালোউইন আসলে একটা হারভেস্ট ফেস্টিভাল বা নবান্ন পরব। ফসল কাটা শেষে পড়শীদের মধ্যে মিষ্টি-খাবার আদান-প্রদানের উৎসব। সে থেকে পাম্পকিন প্যাচের হোৎকা কুমড়ো আর খড়ের গাঁদা। আবার বছরের একই সময়ে শীতের প্রাক্কালে ঊর্বরতা বিদায় নেয়, আর প্রকৃতিমাতার ঘুম অথবা ‘মৃত্যুর’ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

হ্যালোউইনের সাথে সেজন্যে মৃত্যুরও একটা যোগাযোগ আছে। ভূতপ্রেত সাজার ব্যাখ্যাও সেটা, যদিও এরকম সাজসজ্জা তুলনামূলকভাবে নতুন প্রচলন। অনতিপ্রাচীনকালে এসময় পরলোকগত পূর্বপুরুষদের স্মরণ-সম্মান করা হত। প্রাক-কলাম্বাস যুগের ঐতিহ্য ধরে মেক্সিকোতে হ্যালোউইনের সময়েই পালন করা হয় দিয়া দে লস মুয়ের্তোসকোকো নামের ডিজ়নি ছবির কাহিনী এ নিয়েই।

যারা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা তাদেরকে বোঝানো একটু কঠিন উত্তরের দেশগুলিতে এসময় কি ধরনের ঋতুপরিবর্তন হয়। আবহাওয়া হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে যায়, পর্ণমোচী বৃক্ষ সবুজ পাতা ঝেড়ে ফেলে ধূসর হাতের মত শাখাপ্রশাখা নিয়ে ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা শীতল স্যাঁতসেঁতে বাতাস সেসব উদোম ডালপালার ভেতর দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ করে বয়ে যায়। দিন ছোট হয়ে আসে আর অনেক জায়গায় ঝাঁপ দিয়ে পাঁচটার সময় থমথমে অন্ধকার হয়ে যায়। গায়ে কাঁটা দেয়ার মত ব্যাপারস্যাপার!

সাজপোশাকের পাশাপাশি হন্টেড হাউজ় বা পোড়োবাড়িগুলোর ব্যবসাও এসময় তুঙ্গে ওঠে। সাবার্বের বাড়িগুলিকেও পোড়োবাড়ি সাজানোর হিড়িক পড়ে যায়। পাম্পকিন প্যাচ আর থিম পার্কগুলিতে স্পেশাল ভয়ের রাইডগুলি ছোট-বড় ফ্যান্কেনস্টাইন আর ড্রাকুলার ভীড়ে ভর্তি হয়ে যায়।

কানাডিয়ান শিল্পী লরীনা ম্যাককেনিটের ‘অল সোলস নাইট’ নামের এই গানটা বিভিন্ন সংস্কৃতির হ্যালোউইন কিংবা একই ধরনের উৎসবের মূল প্রাচীন ভাবাবেগটা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে। বোনফায়ারের চারদিকে নেচে চলেছে ছায়ার দল, এরা ইউরোপীয় ভূত। আর মোমবাতি-কাগজের লন্ঠনের কাঁপা-কাঁপা আলোতে জাপানীদের পিতৃপুরুষ-স্মরণের ওবোন উৎসব। অক্টোবরের পরিবর্তে অবশ্য অগাস্টে পালিত হয় ওবোন।

মৃত্যু ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতিতে একরকম টাবু। আমরা সে ব্যাপারে আলোচনা করতে ভয় পাই, বিমর্ষ হয়ে পড়ি। গুরুগম্ভীর টপিক সেটা। সেটা অমূলক নয়। যদিও ইসলামধর্মে মৃত্যুকে খোদার নিকট ফিরে যাওয়া হিসাবে ধরা হয়, অর্থাৎ আসলে টাবু কোন বিষয় এটা নয়। আমার মতে, হ্যালোউইন বা অল সোলস নাইটের মত উৎসব পালনের মাধ্যমে অন্যান্য সংস্কৃতিতে মৃত্যুকে নরমালাইজ় করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরলোকগত পিতৃপুরুষদের সম্মান করে তাঁদের জীবদ্দশার আনন্দের স্মৃতি আর সাফল্যগুলো স্মরণ করা এবং সেসবের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে স্রষ্টার কাছে তাঁদের জন্যে প্রার্থনা করা — মৃত্যুর বিষণ্ণতাকে লাঘব করার জন্যে এ এক অনন্য উৎসব।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!