বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৫ (শেষ)

আমি চতুর্থ পর্বে ব্যাখ্যা করেছি কেন আমি বিটকয়েনের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান, আবার প্রথম পর্বে বলেছি আমার কিছু টাকা এসবে আছে। এটা পরস্পরবিরোধী নয়। ইনভেস্টমেন্টে সব সময় অপরচুনিটি কস্ট বলে একটা জিনিস চিন্তা করতে হয়। লাখে একটা লটারি লাগলেও সেটা কারো না কারো লাগে। ধরুন লটারিই কিনেছি, ভবিষ্যতে দশগুণ হলে মনে মনে আক্ষেপ থাকবে না যে অপরচুনিটিটা নিইনি। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা সবসময় মনে রাখবেন সাফল্যের মূলমন্ত্র ডাইভার্সিফিকেশন, পরস্পরবিরোধী জিনিসে টাকা রাখলে সব মিলিয়ে লাভই হবে, যদি না অর্থনৈতিক মন্দার সময় হয়।

যারা টেকি টাইপের মানুষ, নতুন টেকনোলজি দেখলে উত্তেজিত হয়ে যান, তা হোন। কিন্তু দশপা পিছনে গিয়ে ভাল করে পুরো চিত্রটা একবার দেখবেন। সব টেকনোলজি সময়মত আসে না আর সবকিছুই ভাল বাজার পায় না। আইপ্যাডের পূর্বসুরী একটা প্রোটোটাইপ বোধহয় মটোরোলা আশির দশকে বানিয়েছিল, কিন্তু তখন মার্কেট রিসার্চে তার লাভজনকতা কেউ দেখেনি। ফাইন্যান্সিয়াল ইনডিকেটরগুলি সম্পর্কে ভাল করে জানবেন, কাজে দিবে। টেকিদের জন্য এসব বোঝা কঠিন নয়।

বিটকয়েনজাতীয় মুদ্রাকে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চীনের মত ব্যান করবে না, এটা আমি লিখে দিতে পারি। কিন্তু তারা স্পেক্যুলেশন আর মানি লন্ডারিংয়ের যথাযোগ্য প্রতিষেধক না পেলে তাকে সরকারি নিয়মনীতি ছাড়াই যেভাবে পারে আটকাবে। যেমন অনেক ক্রেডিট কার্ড কম্পানি বলেছে তারা কয়েন কেনার ট্রানজ্যাকশন অনুমোদন করবে না। ফেডারেল সরকার না করলেও অনেক স্টেট সরকার তাদের নাগরিকদের জালিয়াতি থেকে রক্ষার জন্য নতুন আইনকানুন প্রণয়ন করছে। গুগল-ফেসবুক-টুইটারও বলেছে তারা কয়েনওয়ালাদের অ্যাড তাদের সাইটে দেখাবে না। অথচ এদের মাধ্যমেই কয়েনওয়ালারা তাদের অধিকাংশ ক্রেতা খুঁজে পায়।

মানি লন্ডারিং সবচে’ বড় ভয়ের কারণ, যেহেতু বিটকয়েনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীরা বিদেশে তাদের তহবিল যেমন সংগ্রহ করতে পারে, তেমন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের লুক্কায়িত সদস্যদেরও টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করতে পারে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিটকয়েনের ভবিষ্যত অন্ধকার। এদেশের মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা ভালবাসলেও এখনকার যুগে নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তার ওপর আবার রাশিয়া বিটকয়েনের মাধ্যমে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করেছে, সেরকমটা খবর বেরুলেও আমি অবাক হব না। শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, কর্পোরেট এস্পিওনাজের উদ্দেশ্যে হ্যাককরা ইমেল বা ডকুমেন্টও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া দৈনন্দিন ব্যাপার।

এসব নানাকারণে বিটকয়েনে মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারাবে এবং আগামী অর্থনৈতিক মন্দার সময় পুরোপুরি নেই হয়ে যাবে, এরকমটা আমার ধারণা। এর আগেও ডিজিটাল টোকেনের ব্যবসাকারী বেশ কিছু কম্পানি ডটকম বাবল বাস্টের সময়ে পটল তুলেছিল। সে মন্দাটা কবে হবে তা বলতে পারি না। কোন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদও বলতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও হডলাররা একে ধরে বসে থাকবে ভবিষ্যত লাভের আশায়! (আবার বলছি, আমার ধারণা ভুল হয়ে এর দশগুণ মূল্যবৃদ্ধি হলেই আমার লাভ!)

বিটকয়েন বিলুপ্ত হলেও দুটো জিনিস থাকবে। এক, ব্লকচেইন টেকনোলজি, আর দুই, একটা সত্যিকারের বৈশ্বিক মুদ্রার সম্ভাবনা। ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক আছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের সেরা ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেরা গবেষণা করে বের করছে কিভাবে একে তাদের বর্তমান ব্যবস্থার সাথে একীভূত করে মক্কেলদের লেনদেনকে ত্বরান্বিত করা যায়। তারা এসব ব্যাপারে সরাসরি কাজ করছে আইবিএমের মত নামী টেক কম্পানিগুলির সাথে। এরা ওপেন সোর্সওয়ালাদের মত অ্যামেচার নয়। আমার ধারণা এদের নতুন প্রযুক্তিরই বিস্তার হবে তাড়াতাড়ি আর সাধারণ মানুষ বিটকয়েনের অনেক সুবিধা এদের মাধ্যমে পাবে, অধিকাংশ ক্ষতিকর দিকগুলি বাদ দিয়ে। সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামধারী বেনামী প্রোগ্রামারদের থেকে এসব নামঠিকানাধারী বড় কম্পানিকেই আমি আপাতত বিশ্বাস করি একটু বেশি। আর বিশ্বাস ভাঙ্গলে জাকারবার্গের মত সোজা ওয়াশিংটনে বুড়োবুড়ি সিনেটরদের আখড়ায় হাজিরা! (ওয়েলস-ফারগোও গুগলিয়ে দেখুন।)

ব্যাংকিং ছাড়াও অন্যান্য অনেক খাতে ব্লকচেইনের ব্যবহার বাড়বে। যেমন মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলি রোগীর স্বাস্থ্যতথ্য নিরাপদভাবে রাখতে এবং শেয়ার করতে পারবে রোগী আর তার অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে। স্টক ব্রোকার আর ইনশুরেন্স কম্পানিরাও এর থেকে লাভবান হতে পারে। বাড়ির মর্টগেজ আর অন্যান্য ধারের কাজও আগের থেকে দ্রুত সম্ভব হতে পারে। এগুলি সবই ধীরে ধীরে চলে আসতে দেখবেন। কিন্তু সাধারণ এনক্রিপশন টেকনোলজির সাথে ব্লকচেইনকে মেলাবেন না। ইন্টারনেটে নানা রকম কম্পানি আছে যারা নামে ‘ব্লকচেইন’ শব্দটা লাগিয়ে ইনভেস্টরদের ধোঁকা দিচ্ছে। দুটো টেকনোলজির তফাতও ভাল করে বুঝবেন। এনক্রিপশন কোন নতুন কিছু নয়।

শেষপর্যন্ত বলি, সীমানাবিহীন, সমান-সুযোগের একটা মুক্ত বিশ্ব অনেক মানুষের আকাঙ্ক্ষা। হয়ত সেরকম সীমানাবিহীন একটা মুদ্রাব্যবস্থা তার আগে এসে পৃথিবীর মানুষকে তার জন্যে প্রস্তুত করবে। বিটকয়েন দিয়ে তার কিছুটা আস্বাদন যখন মানুষ করতে পেরেছে, তখন এ ব্যাপারটা নিয়ে অনেকেই আরো গভীর চিন্তা করবে, এখনকার ক্রিপটোকারেন্সিগুলির সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করবে। হয়ত ক্রিপটোকারেন্সি ২.০ আমাদেরকে সেই ইউটোপিয়ার দিকে একঘর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজ না হলেও হয়ত বছর কুড়ি পরে। বিটকয়েনের দশগুণ দরবৃদ্ধি নয়, আমি সেই ইউটোপিয়ান আশাতেই থাকলাম!

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৪

বিটকয়েনের দেখাদেখি এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে চালু হয়েছে। তার মধ্যে বিটকয়েনের পরেই বাজারমূল্যের হিসাবে উপরে আছে রিপল, ইথারিয়াম, বিটকয়েন ক্যাশ, কারডানো আর লাইটকয়েন। এদের সম্পূর্ণ বাজারদর বলা হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি ডলারের উপরে! মনে রাখবেন, মানুষ এগুলোকে টাকা দিয়ে কিনছে বলেই এদের দাম আছে, নাহলে তারা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র! সবগুলি যে একইরকম তাও নয়, প্রত্যেকটির বিশেষ বিশেষ গুণাগুণ আছে, যেমন ইথারিয়ামকে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আসল টাকার প্লেসহোল্ডার হিসাবে ব্যবহার করছে, তার কিছু সুবিধার কারণে। কিন্তু বাজারে প্রচলিত বেশির ভাগ ক্রিপটোকারেন্সিই ‘প্লেইন ভ্যানিলা’ ওপেন সোর্সের উপর তৈরি, আর যে কেউই নতুন একটা বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহুল প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে সেটা কিনতে আগ্রহী করে তুলতে পারে, আর সে সুযোগে বিশাল অংকের টাকা অনবহিত ক্রেতার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য একারণে নতুন নীতি এসেছে এক্সচেঞ্জগুলির জবাবদিহিতার জন্যে। অপরদিকে চীনে এক্সচেঞ্জ এবং মাইনিং এখন নিষিদ্ধ।

এসব নানা নিয়মনীতির ভয়ে এখন ক্রিপটোকারেন্সিগুলি একটু দামে কম। যদি আপনি বিনিয়োগের চিন্তা করে থাকেন, তাহলে এখন ভাল সময়। কিন্তু আমি সে উপদেশ দেব না। ফটকাবাজি বা স্পেক্যুলেশনের কারণে বিটকয়েন আর অন্যান্য কারেন্সির দাম অনেক উঠা-নামা করে, আর সেটা করে সকলে একসাথেই কোরিলেটেড-ভাবে, অর্থাৎ সত্যিকারের ডাইভার্সিফিকেশনের অভাব। ওয়ালস্ট্রীটের বড় বড় ফার্মও এ ব্যবসায় নেমেছে। তাদের পকেট অনেক গভীর, আর কম্প্যুটার অ্যালগরিদমের সহায়তায় হাই ফ্রিকুয়েন্সি ট্রেডিং করে তারা এদের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাঝখান থেকে পকেট কাটা পড়বে আপনার-আমার মত চুনোপুঁটির। অনেকে বলছে সীমিত সাপ্লাইয়ের কারণে এগুলোর দাম এমনিতেই স্বর্ণের মত ঊর্ধ্বমুখী হবে। আমার প্রশ্ন, সোনার গয়নাও তো মানুষ হাতে-গলায় পড়ে পার্টিতে যেতে পারে, বিটকয়েনের ব্যবহারটা কি, সার্টিফিকেট বানিয়ে বাঁধিয়ে রাখবেন? (খেয়াল করুন, ব্লকচেইন টেকনোলজির গুষ্টি উদ্ধার করছি না! ৫ম পর্ব দ্রষ্টব্য।) স্টক মার্কেটের কম্পানিগুলির তো লাভ না থাকলেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, আছে ভবিষ্যত লাভের সম্ভাবনা, টেসলার কথাই ধরুন – বিপুল ক্ষতিতে বহুদিন থাকার পরে এখন লাভ করা শুরু করেছে। সেসব ছেড়ে কেন বিটকয়েনে জুয়া খেলা?

কম্প্যুটার প্রোগ্রামারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও আমি বলবো যে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক আর ওপেন সোর্স মডেলে টাকাপয়সা লেনদেন করার সমস্যা আছে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারে বাগ থাকে অনেক, সেগুলি ঠিকঠাক করে আর কোড মেইনটেইন করে ভলান্টিয়াররা। যদি সেসব দুর্বলতার কারণে কারো কোটি টাকা মার যায়, তাহলে তাকে টাকা ফেরত দিবে কে? ব্যাংকের টাকা মার গেলেও তো বীমার কারণে সেটা ফেরত পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগোষ্ঠীর দরকার অবশ্যই আছে, কারণ তাদের জবাবদিহিতা করতে হয়! জনগণের অর্থলেনদেনব্যবস্থা যদি বিটকয়েন হয়, তাহলে তার এদিক-সেদিক হবার জবাবদিহিতা করবে কে? তার ওপর, আপনার প্রাইভেট কী গোপন থাকলেও আপনার কম্প্যুটার হ্যাক করে যে কেউ সেটা বেহাত করে নিয়ে টাকাপয়সা সরিয়ে নিবে না, তার কি নিশ্চয়তা? এভাবে তো ইতিমধ্যেই কয়েকটা এক্সচেঞ্জে হ্যাকাররা আক্রমণ করে পয়সা গায়েব করে ফেলেছে।

আপনি যদি ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারক-বাহক হন আর সে কারণে বিটকয়েন ব্যবহার করেন, তাহলে নগদ ব্যবহার করতে সমস্যা কোথায়? এটিএম থেকে টাকা তুলে আপনি গাঁজা-হেরোইন-পর্ন যা খুশি কিনুন, দেখতে আসছে কে? আর আপনি যদি রকেট লঞ্চার একখান কিনতে চান, তাহলে তো অবশ্যই সেটা সরকারের নাক গলানোর মত বিষয়! আর বিটকয়েন দিয়ে লেনদেন করে যে পার পাওয়া সম্ভব নয়, এফবিআই কর্তৃক উলব্রিখ্টের পরিচয় উদ্ঘাটন তার বড় প্রমাণ। তাছাড়া, যত দিন যাবে, বিটকয়েন মাইনিংয়ের পুরস্কার তত কমবে, অর্থাৎ লাভজনকভাবে মাইনিং করতে পারবে কেবল সেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান যারা একসাথে অনেকগুলি কম্প্যুটার নিয়ে সর্বাধিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। তারাই তখন হবে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক আর চাইলে ব্লকচেইনের হিসাবে গরমিল করতে পারবে। অর্থাৎ ‘ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান’, সেই সেন্ট্রাল ব্যাংকের মনোপোলি আর ডলার-ইউরোর কারবার (অথবা তার থেকেও খারাপ)!

আর অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও বিটকয়েনজাতীয় মুদ্রার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশাল অর্থনীতির মুদ্রা হিসাবে বিটকয়েন কতটুকু সফল হতে পারে? খুব একটা নয়! প্রথমত, সাপ্লাই সীমিত থাকার অর্থ এই কারেন্সি ডিফ্লেশনারি। অথচ, আধুনিক সব কারেন্সি উচিত কারণে ইনফ্লেশনারি, প্রথম পর্বে বলেছি। যত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তত সম্পদের সাথে সাথে কয়েনের সংখ্যা না বাড়লে প্রতিটা বিটকয়েনের ক্রয়ক্ষমতা হবে অত্যধিক। তখন মানুষ সেটা লেপের নিচে পোরা শুরু করবে, সেটা এখনই হচ্ছে, যাকে কয়েনপ্রেমীরা বলে HODLing। তো, যে লেনদেনের কাজের জন্য বিটকয়েনের উদ্ভব, সে কাজ না করে যদি তা হয়ে যায় সংগ্রহবস্তু, তাহলে কারেন্সি হলো কিভাবে?

দ্বিতীয়ত, আস্থা! যেকোন মুদ্রার বেলায় এটা সবচে’ জরুরী। কিন্তু বিটকয়েন নিয়ে মানুষ এক্সচেঞ্জে কেনাবেচায় এতই পাগল যে আজ বিটকয়েনের দাম ১৭,০০০ ডলার তো কাল ৭,০০০। কিভাবে এ মুদ্রা ক্রয়ক্ষমতার আধার হয়? লোকে বলছে মানুষ যত একে লেনদেনে ব্যবহার করবে তত তার মূল্য স্থিতিশীল হবে। মানুষ কি আসলেই বিটকয়েন লেনদেনে ব্যবহার করছে, নাকি লেপের নিচে ভরছে?

তৃতীয়ত, যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন না কোন সময় ধ্বস নামে, নানাকারণেই। সবসময় যে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষ দেয়া যায়, তা না। তখন যদি মুদ্রার সাপ্লাই বাড়িয়ে-কমিয়ে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে অর্থনীতি পাগলা ঘোড়ার মত একদিকে ছুটবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে আপনি ফীডব্যাক ব্যাপারটা বুঝবেন। ফীডব্যাকের অবশ্যই দরকার আছে, মুক্তবাজারের সরকার-কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু আপৎকালেই হস্তক্ষেপ করে বলে সবসময় আমাদের অবস্থা জিম্বাবুয়ে-ভেনেজুয়েলার মত দাঁড়ায় না। সে হিসাবে আমি বলবো ২০০৮এ ফেডারেল রিজার্ভ আর ইসিবির নামী অর্থনীতিবিদরা ডলার-ইউরো প্রিন্ট করে বিশ্বের অর্থনীতিকে রক্ষাই করেছেন, এখন স্থিতিশীলতার পরে সে ডলারগুলো (বা সমকক্ষ বন্ড) আবার বাজার থেকে তুলে নিয়ে ‘ধ্বংস’ করে ফেলা হচ্ছে। বিটকয়েনের ব্যবস্থায় তো কম্প্যুটার অ্যালগরিদম বানায় নতুন পয়সা। সে তো নিয়মে বাঁধা, সে কীভাবে বুঝবে কখন কি ফীডব্যাক দেয়া দরকার?

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৩

বিটকয়েন আজ এতটা জনপ্রিয় নাও হতে পারত, শুধু সীমাবদ্ধ থাকতে পারত ছোট কয়েকটা অনলাইন কম্যুনিটির মধ্যে, আর তারা হয়ত কয়েকশ’ বিটকয়েন নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেনামি মনোপোলি খেলায় এখনও ব্যস্ত থাকতো।

বিটকয়েনের জনপ্রিয়তাবৃদ্ধির পিছনে ডীপ বা ডার্ক ওয়েব বলে একটা জিনিসের বেশ বড় ভূমিকা আছে। ইন্টারনেটের একটা বিশাল অংশ আছে, যেগুলি কখনো গুগল সার্চ করে পাবেন না। পাবলিক ওয়েবসাইটের ডট কমজাতীয় ডোমেইন নেইম থাকলে তার রেজিস্ট্রেশনের তথ্য আইক্যান বলে একটা সংগঠনের সাইটে পাওয়া যায়, তার সাথে ডোমেইন ওনারের নাম-ঠিকানাও। ডীপ ওয়েব এসবের ধার ধারে না। তাদের সাইটগুলি রেজিস্টার্ড না, কিন্তু চাইলে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারে। আপনিও চাইলে নিজের কম্প্যুটারকে সার্ভার বানিয়ে ফেলতে পারেন, তখন আপনার সাইটটাকে আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে ব্রাউজারে দেখা সম্ভব, তার জন্য ডট কম জাতীয় নামের কোন দরকার নেই। আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে এটাও বোঝা সম্ভব আপনার সার্ভারের অবস্থান কোথায়। এধরনের অনেক সাইট নিয়েই ডীপ ওয়েব তৈরি।

এদের কিছু আবার নাম-পরিচয় গোপনের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। তাদেরকে আলাদা করে বলে ডার্ক ওয়েব। এদের দেখার জন্য টর বলে বিশেষ একটা ওয়েব ব্রাউজার লাগে। এই ব্রাউজার এনক্রিপশন আর বিশেষ ধরনের রাউটিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে যে সাইটটা দেখছে তার এবং সাইটটার মালিকেরও পরিচয় ঢাকতে সাহায্য করে। সেরকম সিল্ক রোড ছিল ডার্ক ওয়েবের ইবের মতই একটা ই-কমার্স সাইট। এর প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট উলব্রিখ্ট ছিলেন লিবার্টারিয়ান মতাদর্শের অনুসারী, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে সরকার বা বড় কম্পানিগুলির অতিরিক্ত নাক গলানো তার পছন্দ ছিল না। কোন অসদুদ্দেশ্যসাধনের থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আদর্শই ছিল বেনামী এই সার্ভিস চালু করার মূল কারণ।

কিন্তু সিল্করোড চালু হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অপরাধজগতের লোকজন বুঝে ফেলল একে তাদের কাজে লাগানো সম্ভব। তারা সিল্করোডে অবৈধ মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, পর্নোগ্রাফি, এসব বিক্রি করা শুরু করল। আর যারা তাদের কাছ থেকে এসব কিনত, তারা দাম দিত বিটকয়েনের মাধ্যমে, কারণ ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করলে নাম-পরিচয় ফাঁস! সিল্করোডের সফলতা দেখে আরো অন্যান্য ডার্ক সাইটও একইভাবে বিটকয়েন ব্যবহার শুরু করল। সেসবে হেন কোন বস্তু বা কাজ নেই, যার মূল্য বিটকয়েন দিয়ে পরিশোধ করা হয়নি — চুরি করা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, হ্যাককরা ইমেইল, ভুয়া পরিচয়পত্র, এমনকি পেশাদার খুনী আর হ্যাকাররাও তাদের ‘সার্ভিস’ এসব সাইটে ‘বিক্রি’ করেছে! আইসিসের মত সন্ত্রাসবাদী দল আর উত্তর কোরিয়ার মত একঘরেকরা দেশও এসব সাইট আর বিটকয়েনের মাধ্যমে তাদের তহবিল সংগ্রহ আর অস্ত্রশস্ত্র বেচাকেনা করেছে। এমনকি জুলিয়ান আসাঞ্জও উইকিলিকসে যারা বেনামে তথ্য পাঠাতে আগ্রহী, তাদেরকে বিটকয়েন দিয়ে পরিশোধ করেছেন। ২০১৩তে ডেমোক্র্যাট সিনেটর চাক শ্যুমারের অনুরোধে এফবিআই সিল্করোডের তদন্ত শুরু করে, উলব্রিখ্টের পরিচয় বের করে তাকে গ্রেফতার করে, আর সিল্করোড বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যেই সিল্করোড প্রায় ১ কোটি বিটকয়েনের লেনদেনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে ফেলেছে।

বিটকয়েনে দাম পেলেই তো হবে না, তাকে অন্য সত্যিকারের কারেন্সিতে রূপান্তরেরও প্রয়োজন দেখা দিল। তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ব্যবসার মত ঝাঁকে ঝাঁকে গজিয়ে উঠল বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ। সেসবে অপরাধজগতের সাথে যুক্ত লোকজনই শুরুতে বিটকয়েন কিনে কিনে তার দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ডলার-ইউরো খরচ করে বিটকয়েন কিনতে। তাতেই তাদের লাভ, কারণ এতে তারা তাদের ‘কাল্পনিক’ মুদ্রার ভান্ডার খালি করে পেতে পারে ডলার-ইউরোর মত সত্যিকারের মুদ্রা। এসব এক্সচেঞ্জের বেশিরভাগ বহুদিন সরকারি নিয়মনীতির অভাবে যথেচ্ছভাবে ফী সংগ্রহ করে চুটিয়ে ব্যবসা করে গেছে। এফবিআই যখন শেষপর্যন্ত এদের দিকে নজর দিয়েছে, তখন মানি লন্ডারিং বা হুন্ডিব্যবসার অভিযোগে অনেককে জেলে পুরেছে। কিন্তু ততদিনে বিটকয়েন ইন্টারনেটের গলি-ঘুঁপচি থেকে এসে ঢুকে পড়েছে মূলসরণীতে। বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, কফিশপ, এরা দাম পরিশোধের মাধ্যম হিসাবে বিটকয়েন গ্রহণ করা শুরু করে দিয়েছে।

কাহিনীর এই পর্যায়ে এসেই হয়ত আমি-আপনি প্রথম শুনেছি বিটকয়েনের নাম।

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ২

বিটকয়েনের অসাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হল এই মুদ্রা একই নামের একটা ‘পিয়ার-টু-পিয়ার’ পেমেন্ট নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত, এমনকি এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আরো নতুন মুদ্রা তৈরি হয়, স্রেফ হাওয়ার থেকে! ডলার-ইউরোও অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকরা এরকম ‘ম্যাজিক’ করেই তৈরি করে।

বিটকয়েন নেটওয়ার্কের কাজ হল ‘দবিরের কাছে সগিরকে দেয়ার মত দশটাকা আছে কিনা, আর সে যে আবার জমিরকে একইসাথে সেই একই দশটাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠগবাজি করছে না’ তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ এটাকে গণিতের একটা সমস্যা হিসাবে সংগঠিত করে তার সমাধান বের করা। গণিতের এই ধাঁধা তৈরির পেছনে আছে ক্রিপটোগ্রাফি বলে একটা বিষয়, যার কারবার হলো প্রাইভেট কী আর পাবলিক কী বলে দু’টো সংখ্যা নিয়ে চালাচালি করা, বা এনক্রিপশন-ডিক্রিপশন। এই এনক্রিপশন টেকনোলজি প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো।

ধরুন, আপনি — দবির — সগিরের কাছে বিটকয়েন পাঠাবেন। সেজন্য আপনাকে উল্লেখ করতে হবে সগিরের পাবলিক কী, অর্থাৎ তার সাংখ্যিক পরিচয়, প্রাপ্য টাকার পরিমাণ, আর সগির যখন হবে প্রেরক তখন কি শর্ত অনুযায়ী প্রমাণিত হবে যে সে একই অংকের টাকা অন্য কাউকে পাঠানোর অধিকার রাখে।

সগির যখন জমিরকে টাকা পাঠানোর জন্য নতুন একটি লেনদেনের সূচনা করবে, তখন বিটকয়েন নেটওয়ার্ক তন্নতন্ন করে সগিরের আগের সব লেনদেনের হিসাব খুঁজে দেখে তার পাবলিক কী দিয়ে পরিচয় মেলাবে। তারপর যদি সে ঐ পরিমাণ অর্থ খরচের অধিকার রাখে বলে নির্ধারিত হয়, তখন সগিরকে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করতে হবে যে তার কাছে সেই পাবলিক কী-এর যমজ প্রাইভেট কী আছে কিনা, যেটা কেবলমাত্র সেই জানে। এ প্রমাণ দেখানোর জন্য সগিরের প্রাইভেট কী নেটওয়ার্কে প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই, তার দেখানো ‘পরোক্ষ প্রমাণ’ই যথেষ্ট, আর সে প্রমাণ থেকে উল্টো হিসাব করে তার গোপন প্রাইভেট কী বের করা অসম্ভব।

হাতে-কলমে এ জটিল হিসাব কষা যেনতেন কাজ নয়। সে জন্য আছে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের লাখো লাখো কম্প্যুটার। দুনিয়ার সব জায়গায় এসব কম্প্যুটার ছড়িয়ে আছে, আপনিও চাইলে আপনার কম্প্যুটারে বিটকয়েনের সফটওয়্যার চালিয়ে এতে অংশ নিতে পারেন। একেই বলে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের কম্প্যুটারগুলি সবসময় একসাথে কয়েকটা বৈধ লেনদেনের সমন্বয়ে তৈরি কোন না কোন ‘ব্লকের’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে। তাদের কাজ হলো এমন একটা সংখ্যা খুঁজে বের করা, যেটা ব্লকে যোগ করলে ব্লক একটা বিশেষ গাণিতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। যে এই সমাধান সবার আগে বের করবে, সে বাকিদের সেটা জানান দিবে, আর তারা সেটা যাচাই করে দেখবে। যাচাইয়ে পাশ হলে এই ব্লকটি আগের ব্লকের শেষে গিয়ে যুক্ত হবে আর নেটওয়ার্কের সবাই তাদের লেনদেনের পুরো হিসাব হালনাগাদ করে নিবে। এই পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ব্লক দিয়ে তৈরি ডিজিটাল হিসাবখাতাকে বলে ব্লকচেইন।

যে কম্প্যুটারটা সফলভাবে একটা ব্লক ‘ক্লোজ’ করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের পারিশ্রমিকস্বরূপ নতুন তৈরি বিটকয়েন, যেটা ‘বায়বীয়’(!) উপায়ে হিসাবখাতার মধ্যে যোগ করে ফেলা হয়। এটি হচ্ছে এই ‘মাইনার’ কম্প্যুটারের কাজের প্রমাণ। বিটকয়েনের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই, সেটা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র। গাণিতিক যে সমস্যাটি মাইনারদের সমাধান করতে হয়, তার জটিলতাও বিটকয়েনের কোডে এমনভাবে পরিবর্তিত হয়, যেন গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক ক্লোজ় করা যায়। ব্লক ক্লোজ় করল যে, তার পুরস্কার চার বছর পর পর অর্ধেক হয়ে যায়, এখন সেটা প্রতি ব্লকে সাড়ে বারো বিটকয়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকশ’ কম্প্যুটার মিলে একসাথে একটা ব্লক ক্লোজ় করার চেষ্টা করে, আর তাতে সফল হলে পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেয়। এ ধরনের সমন্বয়কারী মাইনারদের গোষ্ঠীকে বলে ‘মাইনিং পুল’। যেভাবেই মাইন করা হোক না কেন, সর্বমোট ২.১ কোটি বিটকয়েনের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়, আর প্রায় ১.৭ কোটি ইতিমধ্যেই মাইন করা হয়ে গেছে।

কতটুকু বোঝাতে পারলাম জানি না। হয়ত আপনার কাছে মনে হচ্ছে এ এক মনোপোলি বোর্ড গেম! অনেকটা তাই-ই! কিন্তু অনেকগুলো সুবিধা পাচ্ছেন এই খেলায়।

যেমন, টাকায় তো মানুষের আস্থা আছে বলেই তারা তা ব্যবহার করে। বিটকয়েনের উদ্ভাবকরাও ঐ আস্থার ব্যাপারটা এখানে তৈরি করে দিয়েছেন পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের মধ্যে। কেউ যদি দু’নম্বরী করে নেটওয়ার্কে দাবি করে যে সে কয়েকটা বিটকয়েনের মালিক, তাহলে নেটওয়ার্ক সেটা গাণিতিকভাবে যাচাই করতে গিয়ে ধরে ফেলবে, আর সেই দাবিটা ব্লকচেইনে যুক্ত করা হবে না।দুনিয়ার অধিকাংশ বিকেন্দ্রীভূত মাইনারের উপরে চোরবাবাজীর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সে এটা করতে পুরোপুরি অপারগ। হ্যাকারদেরও সাধ্যে নেই লাখ লাখ কম্প্যুটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাতারাতি হিসাব পরিবর্তন করে ফেলা।

তারপরে ধরুন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে কোন ব্যাংকের বালাই নেই, নেই দু’দিন ধরে অপেক্ষার প্রয়োজন, নেই বড় অংকের ফী। আর আপনার বা প্রাপকেরও পরিচয় দাখিল করার জন্য সোশ্যাল সিক্যুরিটি নম্বর বা পরিচয়পত্রের কোন দরকার নেই। প্রাপকের পাবলিক কী জানলেই হবে, তার নাম-পরিচয়-অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে কোনই কাজ নেই।

এসব সুবিধার পরেও ব্যাপারটা খেলাই থাকতো, যতক্ষণ না বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় এতে অংশ নিচ্ছে আর পদ্ধতিটাকে আস্থাস্থাপনের যোগ্য করে তুলছে।

তো, খেলার থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস রূপ নেওয়া শুরু করলো সিল্করোড নামে এক ওয়েবসাইটের কারণে।

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ১

বিটকয়েনের ভবিষ্যত সম্পর্কে শুরু থেকেই আমি সন্দিহান। অনেককিছু দেখেশুনেই সেটা। তবে বলে রাখি আমার খুব সামান্য অংকের টাকা বিটকয়েন, লাইটকয়েন আর ইথারিয়াম হিসাবে আছে। কিন্তু তার মূল্য আমার মূল ইনভেস্টমেন্টের তুলনায় নগণ্য। এটা আমার ‘গ্যাম্বলিং মানি’, যা হারালে ক্ষতি নেই। যদি ডিজিটাল কারেন্সির সমর্থকরা যা বলে মানুষকে বুঝ দিচ্ছেন তা সত্য হয়, তাহলে সেটা ১০০ গুণ হয়ে ফেরত আসলে দোষ কী! ১,০০০ টাকা বেড়ে ১০০,০০০ হলেই আমি সন্তুষ্ট, ১,০০০,০০০ বানানোর লোভে মূলধন আরো ৯,০০০ ফেলার রিস্ক নিতে আমি রাজি নই।

আবার এটা বলাও জরুরী যে আমি পেশাদার অর্থনীতিবিদ বা ক্রিপটোগ্রাফার নই, আমার যুক্তিতে ভুল থাকতে পারে বা প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে। আর এটা অবশ্যই এমন একটা আলোচনা যেখানে আমার ভিন্নমতের মানুষও পুরোপুরি ভুল নাও হতে পারেন।

টাকার উৎপত্তি কিভাবে, এর প্রয়োজনই বা কেন, আর কেন আমরা আড়াই হাজার বছর ধরে এর কোন না কোন রূপের উপর নির্ভরশীল? বিটকয়েন বোঝার আগে এই মৌলিক ব্যাপারটা বোঝা দরকার।

প্রস্তরযুগের মানুষ কোনরকম খেয়ে পড়ে বাঁচতো, কেউ ছিল শিকারী বা মেষপালক, আবার কেউ কৃষক বা ফলমূলসংগ্রহকারী। যেসময় থেকে মানুষ প্রস্তর বা তাম্রনির্মিত সহায়ক সরঞ্জাম ব্যবহার করা শিখল, আর বছরের পর বছর ধরে তার উন্নতিসাধন করতে থাকল, তত তার জীবিকা হয়ে উঠল বিশেষায়িত। অর্থাৎ মৎস্যজীবী শুধু মাছ ধরতে জানে, লাঙ্গলের ল-ও বোঝে না। একই সাথে তৈরি হল তাদের পণ্যের উদ্বৃত্ত, যার হয়ত ভোক্তা আছে অন্য কোন পেশাজীবীদের মধ্যে। তারা শুরু করল নিজেদের মধ্যে পণ্যবিনিময়। সময়ে এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ল, যেমন কোন এক বছরে কৃষকের ঘরে খরার কারণে শস্য কম, সে জেলে ভাইকে অনুরোধ করল বাকিতে মাছ দিতে। জেলের আপত্তি নেই, শুধু সাক্ষী রাখলো দু’জনকে, আর হয়ত কাগজের অভাবে গাছের বাকলে কোন একটা চিহ্ন খোদাই করে রাখল ঋণের প্রমাণস্বরূপ। বলতে পারেন এটাই কারেন্সির আদিরূপ।

এরপরে আরো হাজার বছর পেরোনোর পর শ্রমের বিশেষায়নের কারণে উদ্ভব হল ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ রাজা-পুরোহিতশ্রেণীর। তারা বলল, আমরাই তোমাদের উদ্বৃত্ত কিনে নিয়ে হব সেন্ট্রাল ব্যাংক, বিনিময়ে দেব সোনামানিক। কারণ সোনার সাপ্লাই কম, মানুষের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসাবেও দাম আছে, আর স্বল্পপরিসরে অনেককিছুর দাম দেয়ার মত পরিমাণ পরিবহন করা যায়। রাজা-প্রজার মধ্যে সম্পর্ক যে শুধু শাসনের তা নয়, আস্থারও, কারণ রাজার একটা কাজ হলো এই সাপ্লাই-ডিমান্ডের ভারসাম্য অনুযায়ী মুদ্রা সাপ্লাই করা, আর তার অবমূল্যায়ন রোধ করা। রাজ্যপালেরা স্বর্ণমুদ্রা বানানো শুরু করেন প্রাচীন তুরস্কের পশ্চিম উপকূলের লিডিয়া রাজ্যে, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে।

মুদ্রার কাজ মোটামুটি তিনরকম। এক, ক্রয়ক্ষমতার আধার হিসাবে কাজ করা, যেন আগামী বছর যে গাড়িটা আমি কিনতে চাই, সেটার জন্য একবছর ধরে টাকা জমাতে পারি। দুই, পণ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে কাজ করা, টাকা না থাকলে সমপরিমাণ অন্য সম্পদ আমাকে দিতে হত গাড়ির বিনিময়ে, যেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হত। আর তিন, মূল্যায়নের একক বা ইউনিট হিসাবে কাজ করা, যে কারণে গাড়ির দাম কাউকে আন্দাজ করতে বললে সে হাজার টাকার ঘরে চিন্তা না করে করে লাখ টাকার হিসাব।

সুতরাং আড়াই হাজার বছর ধরে আমরা টাকা ব্যবহার করছি সঙ্গত সুবিধার কারণেই। আজ আমাদের অর্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত আরো অনেক কিছুর সাথে।আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংকব্যবস্থা চল্লিশ বছর আগেই সোনার সাথে ডলারের যোগাযোগ কেটে দিয়েছে, যার কারণ মূলত আমাদের পণ্যউৎপাদন যে হারে বেড়েছে সোনার সেভাবে বাড়েনি, অর্থাৎ দুনিয়ার তাবৎ সোনা দিয়েও বাকি বিষয়-আশয়ের দাম দেয়া সম্ভব নয়।

তার ফলে ফিয়াত কারেন্সি ব্যাপারটা আবার বিংশ শতকে শুরু হল চীনাদের সপ্তম খ্রীষ্টাব্দে প্রথম বিফল প্রচেষ্টার পরে। এর অর্থ “চাহিবামাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাগজে লিখিত অর্থের সমপরিমাণ ‘কিছু একটা’ দিতে বাধ্য থাকিবে”। ঐ কিছু একটা হয়ত অন্য কোন মুদ্রা বা কোন পণ্য, যার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা সমপরিমাণ। সবই কারো না কারো ওপর স্থাপিত ঐ প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সোজা কথায় মানুষ বিশ্বাস রাখে বলেই ডলার-ইউরো আজ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক কারেন্সি, তাদের ইস্যুকারী ব্যাংকরাও আস্থা হারানোর মত কাজ না করার চেষ্টা করে। যেমন মাঝেমধ্যে নতুন নোট প্রিন্ট করতে হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত হলে আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে (যেমন জিম্বাবু্য়ে ডলার!)। সেকারণে তারা ততটুকুই সাপ্লাই বাড়ায়, যতটুকু তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করে, তার সামান্য বেশি। সাপ্লাই সামান্য বেশি না রাখলে স্ফীতিহ্রাসের সম্ভাবনা, তাতে মানুষ অর্থখরচ না করে বেশি বেশি টাকা লেপের নিচে লুকিয়ে রাখবে! অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে তাতে কমতি হতে পারে।

তো মাঝেমধ্যে পুঁজিবাদী সমাজে স্বাভাবিক কারণেই মন্দা আসে। শেষবার হল ২০০৮এ। বিটকয়েনের উৎপত্তি সে সময়েই, ‘সাতোশি নাকামোতো’ ছদ্মনামধারী এক কম্প্যুটার প্রোগ্রামার আরো ক’জনার সাথে এ জিনিস শুরু করেন। এর কম্প্যুটার কোডও ওপেন সোর্স, অর্থাৎ যে কেউ সেটাকে নিয়ে নতুন নিয়মের আঙ্গিকে নতুন ধরনের ডিজিট্যাল কারেন্সি বানাতে পারে। বিটকয়েনের আবিষ্কর্তারা সরকার আর ব্যাংকগুলির উপর ভালরকম বীতশ্রদ্ধ ছিলেন আর সেসময়ের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য এদেরকে দায়ী করতেন। তারা বিটকয়েন বানান একারণেই যেন টাকা-ডলারের পরিবর্তে মানুষ ধীরে ধীরে বিটকয়েনে বিশ্বাসস্থাপন করে, আর তাতে সরকার-ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত জনগণের একটা মুদ্রা প্রতিষ্ঠা পায়।

সকল পর্বের লিংকঃ

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!