বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ২

বিটকয়েনের অসাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হল এই মুদ্রা একই নামের একটা ‘পিয়ার-টু-পিয়ার’ পেমেন্ট নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত, এমনকি এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আরো নতুন মুদ্রা তৈরি হয়, স্রেফ হাওয়ার থেকে! ডলার-ইউরোও অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকরা এরকম ‘ম্যাজিক’ করেই তৈরি করে।

বিটকয়েন নেটওয়ার্কের কাজ হল ‘দবিরের কাছে সগিরকে দেয়ার মত দশটাকা আছে কিনা, আর সে যে আবার জমিরকে একইসাথে সেই একই দশটাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠগবাজি করছে না’ তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ এটাকে গণিতের একটা সমস্যা হিসাবে সংগঠিত করে তার সমাধান বের করা। গণিতের এই ধাঁধা তৈরির পেছনে আছে ক্রিপটোগ্রাফি বলে একটা বিষয়, যার কারবার হলো প্রাইভেট কী আর পাবলিক কী বলে দু’টো সংখ্যা নিয়ে চালাচালি করা, বা এনক্রিপশন-ডিক্রিপশন। এই এনক্রিপশন টেকনোলজি প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো।

ধরুন, আপনি — দবির — সগিরের কাছে বিটকয়েন পাঠাবেন। সেজন্য আপনাকে উল্লেখ করতে হবে সগিরের পাবলিক কী, অর্থাৎ তার সাংখ্যিক পরিচয়, প্রাপ্য টাকার পরিমাণ, আর সগির যখন হবে প্রেরক তখন কি শর্ত অনুযায়ী প্রমাণিত হবে যে সে একই অংকের টাকা অন্য কাউকে পাঠানোর অধিকার রাখে।

সগির যখন জমিরকে টাকা পাঠানোর জন্য নতুন একটি লেনদেনের সূচনা করবে, তখন বিটকয়েন নেটওয়ার্ক তন্নতন্ন করে সগিরের আগের সব লেনদেনের হিসাব খুঁজে দেখে তার পাবলিক কী দিয়ে পরিচয় মেলাবে। তারপর যদি সে ঐ পরিমাণ অর্থ খরচের অধিকার রাখে বলে নির্ধারিত হয়, তখন সগিরকে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করতে হবে যে তার কাছে সেই পাবলিক কী-এর যমজ প্রাইভেট কী আছে কিনা, যেটা কেবলমাত্র সেই জানে। এ প্রমাণ দেখানোর জন্য সগিরের প্রাইভেট কী নেটওয়ার্কে প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই, তার দেখানো ‘পরোক্ষ প্রমাণ’ই যথেষ্ট, আর সে প্রমাণ থেকে উল্টো হিসাব করে তার গোপন প্রাইভেট কী বের করা অসম্ভব।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




হাতে-কলমে এ জটিল হিসাব কষা যেনতেন কাজ নয়। সে জন্য আছে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের লাখো লাখো কম্প্যুটার। দুনিয়ার সব জায়গায় এসব কম্প্যুটার ছড়িয়ে আছে, আপনিও চাইলে আপনার কম্প্যুটারে বিটকয়েনের সফটওয়্যার চালিয়ে এতে অংশ নিতে পারেন। একেই বলে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের কম্প্যুটারগুলি সবসময় একসাথে কয়েকটা বৈধ লেনদেনের সমন্বয়ে তৈরি কোন না কোন ‘ব্লকের’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে। তাদের কাজ হলো এমন একটা সংখ্যা খুঁজে বের করা, যেটা ব্লকে যোগ করলে ব্লক একটা বিশেষ গাণিতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। যে এই সমাধান সবার আগে বের করবে, সে বাকিদের সেটা জানান দিবে, আর তারা সেটা যাচাই করে দেখবে। যাচাইয়ে পাশ হলে এই ব্লকটি আগের ব্লকের শেষে গিয়ে যুক্ত হবে আর নেটওয়ার্কের সবাই তাদের লেনদেনের পুরো হিসাব হালনাগাদ করে নিবে। এই পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ব্লক দিয়ে তৈরি ডিজিটাল হিসাবখাতাকে বলে ব্লকচেইন।

যে কম্প্যুটারটা সফলভাবে একটা ব্লক ‘ক্লোজ’ করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের পারিশ্রমিকস্বরূপ নতুন তৈরি বিটকয়েন, যেটা ‘বায়বীয়’(!) উপায়ে হিসাবখাতার মধ্যে যোগ করে ফেলা হয়। এটি হচ্ছে এই ‘মাইনার’ কম্প্যুটারের কাজের প্রমাণ। বিটকয়েনের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই, সেটা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র। গাণিতিক যে সমস্যাটি মাইনারদের সমাধান করতে হয়, তার জটিলতাও বিটকয়েনের কোডে এমনভাবে পরিবর্তিত হয়, যেন গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক ক্লোজ় করা যায়। ব্লক ক্লোজ় করল যে, তার পুরস্কার চার বছর পর পর অর্ধেক হয়ে যায়, এখন সেটা প্রতি ব্লকে সাড়ে বারো বিটকয়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকশ’ কম্প্যুটার মিলে একসাথে একটা ব্লক ক্লোজ় করার চেষ্টা করে, আর তাতে সফল হলে পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেয়। এ ধরনের সমন্বয়কারী মাইনারদের গোষ্ঠীকে বলে ‘মাইনিং পুল’। যেভাবেই মাইন করা হোক না কেন, সর্বমোট ২.১ কোটি বিটকয়েনের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়, আর প্রায় ১.৭ কোটি ইতিমধ্যেই মাইন করা হয়ে গেছে।

কতটুকু বোঝাতে পারলাম জানি না। হয়ত আপনার কাছে মনে হচ্ছে এ এক মনোপোলি বোর্ড গেম! অনেকটা তাই-ই! কিন্তু অনেকগুলো সুবিধা পাচ্ছেন এই খেলায়।

যেমন, টাকায় তো মানুষের আস্থা আছে বলেই তারা তা ব্যবহার করে। বিটকয়েনের উদ্ভাবকরাও ঐ আস্থার ব্যাপারটা এখানে তৈরি করে দিয়েছেন পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের মধ্যে। কেউ যদি দু’নম্বরী করে নেটওয়ার্কে দাবি করে যে সে কয়েকটা বিটকয়েনের মালিক, তাহলে নেটওয়ার্ক সেটা গাণিতিকভাবে যাচাই করতে গিয়ে ধরে ফেলবে, আর সেই দাবিটা ব্লকচেইনে যুক্ত করা হবে না।দুনিয়ার অধিকাংশ বিকেন্দ্রীভূত মাইনারের উপরে চোরবাবাজীর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সে এটা করতে পুরোপুরি অপারগ। হ্যাকারদেরও সাধ্যে নেই লাখ লাখ কম্প্যুটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাতারাতি হিসাব পরিবর্তন করে ফেলা।

তারপরে ধরুন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে কোন ব্যাংকের বালাই নেই, নেই দু’দিন ধরে অপেক্ষার প্রয়োজন, নেই বড় অংকের ফী। আর আপনার বা প্রাপকেরও পরিচয় দাখিল করার জন্য সোশ্যাল সিক্যুরিটি নম্বর বা পরিচয়পত্রের কোন দরকার নেই। প্রাপকের পাবলিক কী জানলেই হবে, তার নাম-পরিচয়-অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে কোনই কাজ নেই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এসব সুবিধার পরেও ব্যাপারটা খেলাই থাকতো, যতক্ষণ না বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় এতে অংশ নিচ্ছে আর পদ্ধতিটাকে আস্থাস্থাপনের যোগ্য করে তুলছে।

তো, খেলার থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস রূপ নেওয়া শুরু করলো সিল্করোড নামে এক ওয়েবসাইটের কারণে।

সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!