শত্রু যখন মিত্র


সময়ঃ ২২শে জুন ১৯৪১ রাত ৩টা। স্থানঃ রাশিয়ার বাল্টিক থেকে রোমানিয়ার কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ১,৮০০ মাইলের সীমান্ত। জার্মানি, ইতালি, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও হাঙেরি থেকে ৩৬ লাখ সৈন্য, ৩,৩৫০ ট্যাংক, ৭,২০০ আর্টিলারি, ৭ লাখ ঘোড়ায় টানা সাপ্লাই ওয়াগন, ২,৭৭০ এয়ারপ্লেন পূর্বঘোষণা ছাড়াই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়নের পোলিশ ও ইউক্রেনীয় এলাকায়। শুরু হল অপারেশন বারবারোসা।

নাৎসিবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় সেকালের সর্ববৃহৎ সামরিকবাহিনী। বোমারু ব্লিৎজক্রিগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তারা। মস্কোর সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়। ১০ দিনের মধ্যে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হয় ৪০০ মাইল, দখল হয় মিনস্ক, বন্দী হয় ৪ লাখ রুশ সেনা, ওদেসা-কিয়েভে শুরু হয় মাসব্যাপী অবরোধ।

উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান পানৎসার ডিভিশন, জুন ১৯৪১
উত্তর রাশিয়ায় মুরমানস্ক রেললাইন অতিক্রম করছে ফিনিশ সেনা, অক্টোবর ১৯৪১
২২শে জুন থেকে ২৫শে আগস্টের মধ্যে রাশিয়ায় অক্ষশক্তির আক্রমণের চিত্র

পুরো অপারেশনে বন্দী ৫০ লাখের অধিকাংশ আর ঘরে ফেরেনি। দিনে ৪০ হাজার করে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৯০ শতাংশ রুশ মেকানাইজড ব্যাটালিয়ন ধূলিসাত হয়ে যায়। জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ট্যাংকই ধ্বংস হয় ১৫ হাজার। দেড় হাজার প্লেন ধ্বংস হয়, দুই তৃতীয়াংশ টারমাকে পার্ককরা অবস্থাতেই। ২ কোটি সোভিয়েত নাগরিক রাতারাতি আবিষ্কার করে তারা বাস করছে অন্য জগতে। এদের অনেকেই জার্মানদের মুক্তিদাতা হিসাবে স্বাগত জানায়।

রেড ৎসার স্তালিন স্বয়ং নার্ভাস ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। অনাগ্রসন চুক্তি সইয়ের দু’বছর পুরো না হতেই নাৎসি বাহিনী তাকে আক্রমণ করবে, ভাবনাতেও আসেনি তার। ব্রেস্ত থেকে সেবাস্তোপোল পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, কিন্তু জার্মান অফিশাল ঘোষণা না আসা পর্যন্ত প্রতি-আক্রমণের নির্দেশ এল না তার কাছ থেকে। কৃষ্ণসাগরের দাচায় গিয়ে সমানে ভদকা গিলছেন তিনি। কমান্ডার ইন চীফ হিসাবে আসীনও হলেন না। রুশদের কাছে রেডিওতে খবর ভাঙলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলোতভ, স্তালিন নয়।

টারমাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ফাইটার প্লেন, ১৯৪১
অপারেশন বারবারোসায় জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দী লালবাহিনীর সৈনিক, ১৯৪১
জার্মান যুদ্ধবন্দীশিবিরের দিকে হেঁটে চলেছে আত্মসমর্পণকৃত সোভিয়েত সৈন্য, ১৯৪১
লাটভিয়ার রিগাতে জার্মান সৈন্যরা পায় মুক্তিদাতার সাদর আপ্যায়ন, জুলাই ১৯৪১
জার্মানি ও অক্ষশক্তির দেশগুলির সোভিয়েত আক্রমণের খবর পাবার মূহুর্তে স্তালিন, ১৯৪১

যখন স্তালিনের আদেশ আসল, সেটা জায়গায় থেকে হানাদার আক্রমণ প্রতিহত করার। কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করা যাবে না। কোণঠাঁষা স্বল্পশিক্ষিত সৈন্যদলগুলিকে পিছু হটতে বারণ করা হল। ফল হল লাখে লাখে রুশ যুদ্ধবন্দী।

কিভাবে এমনটা হল? এর পূর্ববর্তী এক দশকে রাশিয়া তো পরিণত হয়েছিল শিল্পায়িত দানবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈন্যদল তাদের। এমন চকিত পরাজয় ঘটল কেন?

ফাস্ট রিওয়াইন্ড, ১৯৩৭ সাল। মস্কোতে গোপন বিচার বসেছে লালবাহিনীর মার্শাল তুখাচেভস্কিসহ সাতজন জেনারেলের। তুখাচেভস্কি যেনতেন লোক নন, যুদ্ধ উপমন্ত্রী। অভিযোগ, এরা জাপান ও জার্মানির সাথে সোভিয়েতবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। খুব দ্রুত তাদের অপরাধ প্রমাণ করে দিল ট্রিবুনাল, সাক্ষ্য দিল তাদের নিকট সহকর্মীরা। মৃত্যুদন্ড হল শাস্তি।

আসলে যেসকল সাক্ষী ছিল, তাদেরকে অত্যাচার করে নয়ত ব্ল্যাকমেল করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছিল। এসব বেরিয়েছে নব্বইপরবর্তী যুগে পুরনো সোভিয়েত আর্কাইভ ঘাঁটিয়ে। এই ক্যাঙ্গারু কোর্টের কারণ আর কিছুই নয়, স্তালিনের সন্দেহবাতিক।

বিশের দশকের শেষভাগে স্তালিন অন্যান্য বলশেভিক নেতাদের ঘাঁড় ভেঙে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লিওন ত্রতস্কি। দু’জনের মধ্যে নানা ব্যাপারে টক্কর লেগে থাকত। মূল আদর্শগত সংঘাত ছিল বিশ্বে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া নিয়ে। ত্রতস্কি তার পক্ষপাতী, স্তালিন তার বিরোধী। ত্রতস্কির নির্বাসন হয় ১৯২৯ সালে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কিন্তু, স্তালিনের মনে সবসময় সন্দেহ ছিল ত্রতস্কিপন্থীরা লুকিয়ে আছে তারই পার্টির মাঝে। পার্টি আর সেনানেতৃত্বের মাঝে থেকে কেউ ষড়যন্ত্র করছে তাকে সরাতে। ১৯৩৪ সালে এক জনপ্রিয় নেতা কিরভের গুপ্তহত্যার পর তার মনে সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের সেই সন্দেহ থেকে অগণিত কম্যুনিস্ট পার্টি সদস্যের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর খাঁড়া। তুখাচেভস্কির শো ট্রায়াল ছিল এরই অংশ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা, মাঝে স্তালিন, সর্বডানে নিগৃহীত মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মার্শাল তুখাচেভস্কি
মেক্সিকোতে সর্বশেষ ঠিকানা হয় নির্বাসিত সোভিয়েত নেতা লিওন ত্রতস্কির, সাথে স্ত্রী নাতালিয়া, পেছনে চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কালো, ১৯৩৭
স্তালিনের গ্রেট পার্জের শিকার আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ পড়ে শোনানো হচ্ছে, ১৯৩৬
১৯৩৭ সালে মস্কো খাল উদ্বোধনকালে স্তালিনের পাশে ছিলেন গুপ্তপুলিশপ্রধান ইয়েষভ। পরের বছর পার্জে তারই প্রাণ যায়। ছবি থেকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় তাকে।

গর্দান গেল লালবাহিনীর প্রথমদিককার এসকল নায়কোচিত নেতৃত্বের। গুলাগে কারাদন্ডে যায় আরো অসংখ্য জেনারেল-কর্নেল। ১৯৩৮ নাগাদ প্রায় ৩৮ হাজার লালবাহিনী সদস্য হয় চাকরিচ্যুত, এদের ২৩ হাজারের হয় মৃত্যুদন্ড। এই গ্রেট পার্জের শেষে দেখা গেল, ৫ জন সোভিয়েত মার্শালের ৩ জন লাপাত্তা। ১০১ জেনারেলের ৯১ গ্রেপ্তার, ৮০জন মৃত। ৮০ শতাংশ কর্নেল শেষ। নেভির ৯ অ্যাডমিরালের ৮জন আর নেই। এই রেড টেররে দেশব্যাপী মারা যায় সর্বমোট ১৩ লাখ।

যে লালবাহিনী ছন্নছাড়া চাষা-শ্রমিক বিপ্লবীদের দঙ্গল থেকে ত্রিশের দশক নাগাদ পরিণত হয়েছে ১৩ লাখের প্রশিক্ষিত সেনাদলে, যে বাহিনীতে সংযুক্ত হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মেকানাইজড আর্মার্ড ব্রিগেড, সে বাহিনী হয়ে পড়ল যোগ্য নেতৃত্বশূন্য, অদক্ষ, মনোবলহীন, রাজনৈতিক আটাশে ও গুপ্তচর দিয়ে ভর্তি। বিমান ও নৌবাহিনীর অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। সামরিক সরঞ্জাম ছিল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো।

কিয়েভে লালবাহিনীর ৪৫তম মেকানাইজড কোরের মহড়া, ১৯৩৫
বৃহত্তম সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে ক্রেমলিনে, ১৯৪১

হিটলারের সাথে ষড় করে ১৯৩৯এর সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেবার পর পর নভেম্বরে এ সেনাবাহিনী নিয়েই স্তালিন আক্রমণ করে বসেন ফিনল্যান্ডকে। উদ্দেশ্য, প্রাক্তন রুশ এ কলোনিকে আবার কব্জা করা। বাল্টিকের দেশগুলিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। কিন্তু ফিনল্যান্ডে আশাতীতরকম মার খায় লালবাহিনী। ৩ গুণ কম সৈন্য আর ৩০ গুণ কম বিমানের ফিনিশ বাহিনী বিশাল সোভিয়েত সেনাদলকে ফিনিশ করে দেয় উইন্টার ওয়ারে। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে মুখ বাঁচানো শান্তিচুক্তি করেন স্তালিন।

হিটলারের আর বুঝতে বাকি থাকে না লালবাহিনীর আসল হাল। এখানেই আরম্ভ আমার আর্টিকেল।

স্তালিন যথেষ্ট সাবধানবাণী পেয়েছিলেন চার্চিল-রোজাভেল্টের কাছ থেকে। কিন্তু সেগুলি গা করেননি। তার ধারণা ছিল ব্রিটেনের সাথে জার্মানির যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। সময় পাবে সোভিয়েতরা। যা হল, তার জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না রুশরা। অথচ এ পর্যন্ত অনাগ্রসন চুক্তির খাতিরে খোদ জার্মানিকেই টনকে টন গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য রপ্তানী করে এসেছে তারা। দুধকলা খাইয়ে সাপ নয়, ড্রাগন পোষা যাকে বলে!

২৩শে আগস্ট ১৯৩৯, অনাগ্রাসন চুক্তি স্বাক্ষর করছেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোতভ। পেছনে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, আর স্তালিন। এর গোপন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের ছোট স্বাধীন দেশগুলি তারা ভাগাভাগি করে নেয়।
জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের দুই সপ্তাহের মাথায় সোভিয়েতরাও পূর্ব পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, দুই বাহিনীর কমান্ডারের করমর্দনের চিত্র, সেপ্টেম্বর ১৯৪১
উইন্টার ওয়ারে ফিনিশদের হাতে যুদ্ধবন্দী ক্যামোফ্লাজবিহীন লালবাহিনীর সৈন্য, ১৯৩৮-৪০
নাৎসি জার্মানির সর্বমোট আমদানির শতাংশ হিসাবে সোভিয়েত থেকে আমদানির চিত্র

খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হল রুশ নেতৃত্বকে। জার্মানির হাতে পড়ার ভয়ে বিশাল সব ফ্যাক্টরিগুলি খুলে খুলে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হল উরাল পর্বতের পূর্বে। আর যেগুলি নেয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে খামার ও কৃষি সরঞ্জাম, সেগুলি পোড়ামাটি নীতি ধরে ধ্বংস করে দিয়ে পিছু হটল লালবাহিনী।

রাজনৈতিক আটাশেদের সরানো হল, লালবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হল সামরিক র‍্যাংক আর ডেকোরেশন। অর্থডক্স চার্চকে পুনরিজ্জীবিত করা হল সাধারণ মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনতে, তারা আশীর্বাদ করতে শুরু করল অস্ত্রধারী রিজার্ভ সৈনিকদের। তৈরি হল গুলাগের বন্দীদের ব্যাটালিয়ন। যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নের শাস্তি হল তাৎক্ষণিক মৃত্যুদন্ড।

মস্কোর প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল। অদম্য তরুণ নেতৃত্বের কারণে সে যাত্রা মস্কো বেঁচে গেল।

কিন্তু রসদ বেশি অবশিষ্ট নেই। জার্মানির দখলে বিশাল শিল্পায়িত এলাকা আর ফসলী জমির ৪০ শতাংশের বেশি। চাষাবাদের যন্ত্র আর পশুরও ৫০ শতাংশ। বাকি জনগণ কৃষিজমির বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে শামিল। কে করবে চাষাবাদ?

উরাল পর্বতের অপর পারে স্থানান্তরের জন্য আলাদা করে রাখে সোভিয়েত কারখানার যন্ত্রাংশ, ১৯৪১
পোড়ামাটি নীতির অংশ হিসাবে রুশরা লেনিনগ্রাদের নিকটস্থ একটি গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছে, ১৯৪১
উপায়ান্তর স্তালিন সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু অর্থডক্স চার্চকে পুনর্বাসিত করেন, তারা যুদ্ধগামী সেনাদের আশীর্বাদ প্রদান করে, ১৯৪১-৪৩
মস্কোর সন্নিকটে ট্যাংকবিরোধী ব্যারিকেড, অক্টোবর ১৯৪১

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ক্রান্তিলগ্নে দ্রুত পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের এতদিনের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

হ্যাঁ, অস্তিত্বসংকটাপন্ন ব্রিটেনের অন্তত সেকেন্ড ফ্রন্ট দরকার ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তখনও পার্ল হারবার আক্রমণ হয়নি। তখনও কংগ্রেস মিত্রবাহিনীকে সরাসরি অস্ত্র ও অর্থসাহায্য দেবার বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় রোজাভেল্ট কংগ্রেসের একটা বড় অংশের সহায়তায় পাশ করলেন লেন্ড লীজ বিল। মার্চ ১৯৪১এ, বারবারোসার আগেই। এই বিলের লক্ষ্য, মিত্রবাহিনীর দেশগুলিকে এমন অস্ত্র সাহায্য দেয়া, যেটা যুদ্ধে ধ্বংস হলে আর দাম দিতে হবে না। যদি ধ্বংস না হয়, তাহলে ফেরত আসবে নয়ত ব্যবহারকারীরা কিনে নেবে। এ ছিল রোজাভেল্টের সাথে রিপাবলিকানদের কমপ্রমাইজ।

প্রথমে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও প্রজাতন্ত্রী চীন এ বিলের আওতায় সাহায্য পায়। বারবারোসার পর যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের শেষ নাগাদ সর্বমোট ৫০ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য যায়, আজকের মুদ্রামানে ৮০০ বিলিয়ন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের ১৭ শতাংশ এটি।

৫টি পথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ১৭ মিলিয়ন টন রসদ আসে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এক, কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে ইরান ও ককেশাসের ভেতর দিয়ে। দুই, ভূমধ্যসাগর ও বসপোরাস প্রণালী ধরে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলিতে। তিন, নরওয়ের উত্তরে আর্কটিক সাগরের বন্দর মুরমান্সক ও আর্খেনগেল্সকে। চার, সোভিয়েতের সাথে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে আবদ্ধ জাপানের ৎসুশিমা প্রণালী ধরে ভ্লাদিভস্তকে। আর পাঁচ, বেরিং প্রনালী অতিক্রম করে চুকোতকা উপদ্বীপে।

লেন্ডলীজ অ্যাক্ট সই করছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোজাভেল্ট, মার্চ ১৯৪১
সোভিয়েতমুখী লেন্ডলীজ রুটের চিত্র

মার্কিন সাহায্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৩০ হাজার রেডিও সেট, ৩,৪৪,০০০ টেলিফোন-টেলিগ্রাফ, ১২ লাখ মাইলের তার, সাড়ে ৪ লাখ বিভিন্ন সাইজের ট্রাক, ৩৪ হাজার মটরবাইক, ১১ হাজার রেলকার, ২ হাজার রেল ইঞ্জিন, সাড়ে ৮ হাজার ট্র্যাক্টর, ১৪ হাজার প্লেন ও হেলিকপ্টার, ১ হাজার কন্স্ট্রাকশন ইকুইপমেন্ট, ৫০ হাজার প্যানেলের রানওয়ে ম্যাট, আর একেবারে নতুন ব্রিটিশ প্রযুক্তির রেডার।

লালবাহিনীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিশাল ফ্রন্টলাইনের যোগাযোগ ও লজিস্টিকস। সোভিয়েত প্রযুক্তির রেডিও ছিল খুবই অকার্যকর। মার্কিন রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন ছিল উচ্চমানের। ফ্রন্টলাইনে রসদ নিয়ে যাবার মত যথেষ্ট ট্রাক সোভিয়েতদের ছিল না। এসময় মার্কিন ডজ ও স্টুডেবেকার ট্রাক হয়ে দাঁড়ায় লালবাহিনীর নির্ভরযোগ্য বাহন। স্টুডেবেকারের ওপর কাতিয়ুশা রকেট লঞ্চার লাগালে সেগুলি পরিণত হত মোবাইল আর্টিলারিতে। যুদ্ধকালীন সময়ে রেল পরিবহন ব্যবস্থার এক তৃতীয়াংশ, আর রেললাইনের ৯৩ শতাংশ স্টীল আসে লেন্ডলীজ থেকে। বমার-ফাইটার-ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটের ৩০ শতাংশ ছিল মার্কিননির্মিত।

মার্কিন খাদ্য ও জ্বালানিতেল রাশিয়ায় যায় যথাক্রমে ৪৫ লাখ টন ও ২৭ লাখ টন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্ষমতা ছিল না স্থানীয়ভাবে এত উৎপাদনের। এছাড়াও সাড়ে ৭ হাজার মার্কিন ও ৫ হাজার ব্রিটিশ ট্যাংক আসে। পূর্ব ফ্রন্টের যুদ্ধক্ষেত্রের ১৬ শতাংশ ট্যাংক আসে লেন্ডলীজ থেকে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট, অ্যান্টিট্যাংক, আর্টিলারি মোটর ক্যারেজ ২ হাজার। ফীল্ড গান, অ্যান্টিট্যাংক গান, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ৭,১০০। মর্টার ও মেশিনগান ১১ হাজার। সাবমেশিনগান ও স্মল আর্মস দেড় লাখ। কামানের গোলা ৮০ লাখ রাউন্ড। এএ রাউন্ড ৮৩ লাখ। মর্টার রাউন্ড সাড়ে ৩ লাখ। স্মল আর্মস রাউন্ড ১১ লাখ। ৯০টি কার্গো শিপ, ১০৫টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার শিপ। অগণিত বিস্ফোরক ডায়নামাইট, টিএনটি, ডেটোনেটর। ফোর্ডের পুরো একটি টায়ার প্ল্যান্ট তুলে নিয়ে এসে পুনর্স্থাপন করা হয় উরালে।

যুক্তরাজ্য থেকেও ৫ হাজার মাটিল্ডা ট্যাংক পাঠানো হয়, ১৯৪১
মার্কিন শারম্যান ট্যাংকে করে চলেছে লালবাহিনী, ১৯৪৩
রাশিয়ার বেলগরদ শহরে মার্কিন ট্যাংকের সাথে রুশ সৈন্য, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩
মার্কিন স্টুডেবেকার ট্রাকের ওপর চাপানো কাতিউশা লঞ্চার থেকে রকেট ছুটছে, ১৯৪২
ককেশাসে মার্কিন লেন্ডলীজ ট্রাক ও অ্যান্টিট্যাংক গানের সাথে সোভিয়েত সৈন্য, সেপ্টেম্বর ১৯৪২
মার্কিন লেন্ডলীজ ডগলাস হ্যাভক বোমারু বিমানের সাথে সোভিয়েত ক্রু
সিনসিনাটি শহরের ক্রোগার বেকারিতে মার্কিন কর্মীরা ক্যান করছে সোভিয়েত লেন্ডলীজের খাদ্য, জুন ১৯৪৩
বি-১৭ ফ্লাইং ফর্ট্রেস বোমারু বিমানের গোলার সামনে করমর্দনরত সোভিয়েত ও মার্কিন বৈমানিক, ১৯৪৪
ইরানের দুর্গম পাহাড়ী গিরিসংকটের রাস্তা দিয়ে যেত সোভিয়েতের উদ্দেশ্যে মার্কিন লেন্ডলীজ সাহায্য
ইরানের পারসিয়ান করিডর দিয়ে ৭,২০০ ট্রাকে করে সোভিয়েতে যেত মার্কিন সাহায্য
ইরানের আবাদান এয়ারফীল্ড থেকে মার্কিন যুদ্ধবিমান বুঝে নিত সোভিয়েত বৈমানিকের দল

রুশদের দেয়া মার্কিন এই সাহায্যের মু্দ্রামান সে সময়ে ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার, বর্তমান যুগের ১৮০ বিলিয়ন। ব্রিটেন লেন্ডলীজের ৫৮ শতাংশ সাহায্যের ভাগীদার ছিল আর দ্বিতীয় স্থানের ২৩ শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের। বিনিময়ে এরা যুক্তরাষ্ট্রকে কি দিয়েছিল?

যুক্তরাজ্য থেকে অত্যাধুনিক কিছু প্রযুক্তি আসে যুক্তরাষ্ট্রে, যার মধ্যে পড়ে রেডার, সাবমেরিন ডিটেকশন, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপিক গানসাইট, ম্যাগনেট্রন, প্লাস্টিক এক্সপ্লোজিভ প্রভৃতি। যুদ্ধশেষে অবশিষ্ট যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ যুক্তরাজ্য কিনে নেয় ৯০ শতাংশ ছাড়ে। সে বাবদ ১.১ বিলিয়ন পাউন্ডের কর্জ পরিশোধ করে ২০০৬ সালে।

আর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় প্রচুর কাঁচামাল — ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, প্লাটিনাম, স্বর্ণ, কাঠ। সেসবের হিসাব মিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাওনা দাবি ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার। সোভিয়েত ইউনিয়ন দর কষাকষি করে দিতে চায় মোটে ১৫০ মিলিয়ন। শেষ পর্যন্ত ৭০০ মিলিয়নে রফা হয় ১৯৭২ সালে। বাকি পাওনা মাফ করে দেয়া হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের আর্জি মেনে স্তালিন কমিনটার্ন নামের ইতিমধ্যে অকার্যকর আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট সংগঠনটিকে অফিশালি বন্ধ করে দেন।

গত পোস্টে বর্ণিত দ্রুত শিল্পায়ন সোভিয়েতকে এ যুদ্ধে যতটুকু সাহায্য করার কথা ছিল, সেটা যে হয়নি নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না! সোভিয়েত বাহিনীর প্রযুক্তি ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব ছিল লক্ষ্যনীয়। তুখাচেভস্কির বাতলে দেয়া ডীপ অপারেশনস থিওরির প্রয়োগ করা হয় অনেক দেরিতে। এমনকি বারবারোসা শুরুর এক সপ্তাহ আগেও ৩০০ অফিসারকে পার্জ করা হয়। পোল্যান্ডে নির্মানাধীন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জার্মানদের থামাতে যথেষ্ট টেকসই ছিল না।

কিন্তু স্তালিনের ভাগ্য সহায় যে জাপান নিরপেক্ষতা বজিয়ে রাখে। প্রখর রুশ শীত জার্মানদের কাঁদার পাঁকে ফেলে। আর কোটি কোটি সোভিয়েত নাগরিক বিনা বাক্যব্যয়ে অস্ত্র তুলে নেয়, প্রাণ দেয়। আর শিল্পবিপ্লবের সময়কার মত সোভিয়েত পেশীর সাথে শামিল হয় মার্কিন যন্ত্র ও প্রযুক্তি।

পুতিনের রাশিয়াতে এ ইতিহাস আর শেখানো হয় না। প্রতি বছর বিজয়দিবসের প্যারেডে দাবি করা হয়, সোভিয়েতরা একাই বীরত্বের সাথে নাৎসিদের হটিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, রক্ত তারা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন প্রযুক্তি সাথে না থাকলে স্তালিন এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন না। স্তালিন কখনো খোলাখুলি এ কথা কাউকে বলেননি। কিন্তু পরবর্তী সোভিয়েত নেতা খ্রুষভের বরাত অনুযায়ী স্তালিন বহুবার এ কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য না করলে জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েতের অস্তিত্বরক্ষা ছিল নিতান্তই অসম্ভব।

এদিকে অধুনা ২০২২ সালে নতুন করে মার্কিন লেন্ডলীজ চালু হয় রাশিয়ার চকিত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। সাহায্য গেছে ৬০ বিলিয়ন মু্দ্রামানের। রাশিয়া পেয়েছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার, ফেরত দিয়েছিল ৭০০ মিলিয়ন। সেটা কি ফেরত চাইবেন কেউ? সর্বকালের ইতিহাসের এ‌ই হল সবচেয়ে বড় আয়রনি, সবচেয় করুণ ট্র্যাজিকমেডি!

আগস্ট ২২, ১৯৪৫। বিজয়ীবেশে বার্লিনে রুশ, মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা।


আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের সমাজতান্ত্রিক জটিলতা


গত দুটি পোস্টে (, ) বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্যোগের সময় কিভাবে বিশাল সহায়তা করে মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা কম্পানিগুলি। শেষ খন্ড বলা বাকি আছে। তবে আলোচনার এ পর্যায়ে একটা সেগোয়ে করতে চাই। সোভিয়েত প্রযুক্তিবিপ্লবের অর্থসংস্থান কোত্থেকে কিভাবে হল? আর কতটুকুই সফলকাম হয় সোভিয়েতরা?

স্তালিনের দাবি ছিল, তিনি নাকি রুশ জনতাকে খুঁজে পান জমিতে কাঠের লাঙল দিয়ে চাষাবাদরত, আর তাদের রেখে যাচ্ছেন পারমাণবিক চুল্লীর মালিক হিসাবে। এটা বাস্তবিক কথা নয়। রুশ বিপ্লবের আগেই ৎসারপন্থী রাশিয়ায় শিল্পায়ন চলছিল। পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হলেও স্টীল উৎপাদনে রাশিয়ার স্থান ছিল বিশ্বের চার নম্বর। বিপ্লব ও যুদ্ধের ডামাডোল আর তারপর কম্যুনিস্টদের অনভিজ্ঞ বাস্তবতাবিবর্জিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণেই ৎসার আমলের শিল্পগুলি জীর্ণ দশায় নিপতিত হয়। সেসব ঘটনা না ঘটলে ৎসারের সিস্টেমে রাশিয়া শিল্পায়িত হতে পারত।

ৎসারের আমলের রুশ টেক্সটাইল মিল, ১৯০৫

মার্কিন সাহায্যে লব্ধ স্তালিনী শিল্পায়নের জন্য যে সোভিয়েত জনগণকে মূল্য দিতে হয়নি তা কিন্তু নয়! মার্কিন প্রকৌশলীদের উচ্চ বেতন দেয়া হত কিভাবে, সেটা আন্দাজ আছে কারো?

মস্কোতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ডুরান্টির মত পুলিৎজারবিজয়ী সাংবাদিক যখন সোভিয়েতদের প্রগতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন গ্যারেথ জোনস নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক সোভিয়েতদের চোখ এড়িয়ে চলে যান ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে। সেখানে দেখেন আরেক মহাদুর্ভিক্ষের চিত্র, যেটি আজও হলোদমর নামে স্বীকৃত। কিন্তু আগের মত কোন সহায়তার অনুরোধ যায়নি সেবার। ৫০ লাখের মত মানুষ তাতে মারা যায়। এর কারণ, ইউক্রেনের ঊর্বরভূমির খাদ্যশস্য কৃষকদের থেকে জোর করে কেড়ে শহরের শিল্পায়নরত শ্রমিকদের খাওয়াচ্ছে স্তালিন সরকার, নয়ত রপ্তানি করেছে। উদ্দেশ্য, ঐ শিল্পায়নের মূলধন জোগাড়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ওয়াল্টার ডুরান্টি। ত্রিশের দশকে সোভিয়েত প্রগতিশীলতার ওপর রিপোর্ট লিখে পুলিৎজার জিতেন। কিন্তু সোভিয়েত শোষণের বিরুদ্ধে লেখেননি কিছু।
কিয়েভের নিকট গৃহহীন ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৪
ইউক্রেনের পলতাভার নিকট দুর্ভিক্ষে মৃত নারী, ১৯৩৪
খার্কিভের রাস্তায় এসে স্থান নিয়েছে দুর্ভিক্ষপীড়িত ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৩
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনসের ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনস, ১৯৩৩-৩৪এ ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট করেন। কম্যুনিস্ট সরকার এ দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে।

তাছাড়া শিল্পায়নে ব্যবহৃত রুশ শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশ ছিল অনৈচ্ছিক শ্রমিক। অনেকে ছিল গুলাগের রাজনৈতিক বন্দী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক। এসকল শ্রমে অনভিজ্ঞ মানুষ হাজারে হাজারে মারা যায় স্তালিনের প্রকল্পগুলিতে কাজ করতে গিয়ে।

কারখানার শ্রমিকদের ওয়ার্কিং ও লিভিং কন্ডিশন এমন ছিল যে সেটা ব্রিটেনের শিল্পায়নের যুগের ডিকেনজিয়ান ডিসটোপিয়াকেও হার মানায়। সাধারণ শ্রমিকরা নিয়ম না মানলে তাদের আইনসিদ্ধ শাস্তি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু সরকারের মালিকানায় পরিচালিত কারখানায়গুলো থেকে শ্রমিকরা অন্যত্র গেলে কাজ করবে কে? কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবে। এ কারণে ১৯৩২ সাল থেকে স্তালিন ইন্টারনাল পাসপোর্ট সিস্টেম চালু করেন। দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে গেলে অনুমতি ব্যতিরেকে যাওয়া অসম্ভব। আয়রনির ব্যাপার হল, ৎসারের সময়ে শেষ এ সিস্টেম চালু ছিল, লেনিন এই আইনকে পশ্চাদমুখী স্বৈরাচারী ইত্যাদি অভিধা দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেত ৎসার নিকোলাসের জায়গা নিলেন এবার রেড ৎসার স্তালিন।

১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পের চিত্র
১৯৩৬এ গুলাগের বিছানাগুলির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে পোস্টারের যুগল মার্ক্স ও স্তালিন
১৯৩২ সালে গুলাগের সর্দারদের গ্রুপ ছবি
দার্শনিক পাভেল ফ্লরেন্সকি ১৯৩৩ সালে সোভিয়তবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপতার হন। স্তালিনের গুলাগে তার ১০ বছরের নির্বাসন হয়। তিন বছরের মাথায় গুলাগে গুলি করে মারা হ্য় তাকে।
গুলাগ সর্দার স্তেপান গারানিন। ১৯৩৭ সালে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকরোক্তি আদায়ের অভিযোগে তার নিজেরই বন্দীদশা শুরু হয়। গুলাগে মারা যায় কয়েক বছর পর।
১৯৩৭ সালে অনৈচ্ছিক শ্রম দিয়ে তৈরি মস্কো খাল পরিদর্শনে স্তালিন, পেছনে মলোতভ
গুলাগের মহিলা সেকশন, সাইবেরিয়ার ঠান্ডায় নেই কোন হীটিং ব্যবস্থা, ত্রিশের দশক
ৎসারের আমলের ইন্টারনাল পাসপোর্ট। এ কাগজ ব্যতিরেকে স্বদেশের এক জায়গা থেকেই আরেক জায়গায় কেউ যেতে পারত না।

রাশিয়ায় টেইলরিজম চালুর অনেক সমস্যাও ছিল। পশ্চাদপসর রুশ কর্মীদের ঘড়ি ছিল না। সময়মত শিফটে এসে হাজির হত না। তারপর কম্যুনিস্ট পার্টির হর্তাকর্তারা কারখানার এক জায়গায় দক্ষতা বাড়ালে দেখা যেত বটলনেক অন্যত্র, যেখানে বিন্দুমাত্র নজর দেয়া হয়নি। কর্মীরা আমদানিকৃত দামী যন্ত্র ব্যবহার করত খুব অদক্ষভাবে। সেগুলি প্রায়ই বিকল হয়ে যেত। তৈরি পণ্যের গুণগত মানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। এসবের দোষ পড়ত প্রকৌশলী ও ম্যানেজারদের ঘাঁড়ে। কখনো কখনো তাদের সাবোটাজের অভিযোগে কর্মচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হত শাস্তি হিসাবে।

কোন কারণ ছাড়াই ওপরমহল থেকে নির্দেশ আসত কাজ দ্রুত করার নয়ত প্রডাকশন কোটা বাড়ানোর। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের তড়িতায়ন স্বপ্নে তাড়িত সোভিয়েত পার্টিকর্মীরা সারা দেশে তামার স্যালভেজ অপারেশন চালায়। অশিক্ষিত চাষারা নিয়ে আসে বিভিন্ন মানের তামার দ্রব্য, যেগুলি থেকে ভালমানের বৈদ্যুতিক তার বানানো লাভজনক নয়। এরাই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এবং তাদের তৈরি গাড়ি ও ট্র্যাক্টর হয় বেশ নিম্নমানের।

ফোর্ডের তৈরি দশ বছরের গ্যারান্টিওয়ালা ট্র্যাক্টর সোভিয়েত চাষার ব্যবহারে তিন মৌসুমের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে থাকত। পড়ে থাকলে বরং রুশ চাষার লাভ, সরকারী যৌথখামারের কাজে ফাঁকি দিতে পারে! ট্র্যাক্টর ঠিক করানোর পার্টস ও রিপেয়ার শপ ছিল নামে মাত্র। মেশিন টুলসের যন্ত্র সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ত। ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর জনপ্রিয় হলেও ইউক্রেন ও ভল্গা অববাহিকার মাটি গভীরভাবে কর্ষণের উপযুক্ত ছিল না। আর এদের জ্বালানী ছিল বেনজিন, যেটা রাশিয়ায় সহজলভ্য নয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




১৯৩৭ নাগাদ এর্ন্সট মের ডিজাইন করা মাগনিতোগোর্স্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলো হয়ে পড়ে নোংরা, জনাকীর্ণ বস্তি। মে’র ডিজাইনের সাথে মিল না রেখে অ্যাপার্টমেন্টগুলির এত পরিবর্তন সাধন করে সোভিয়েতরা, যে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হন। একেকটি ফ্ল্যাটে দেখা যেত পাঁচ ছ’জন গাঁদাগাঁদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকছে। বাথটাব ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোরেজের জন্য।

সোভিয়েত ব্লক অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘর, ৫০/৬০এর দশক
স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্টের নারীকর্মী, তিরিশের দশক
স্তাখানোভাইট আন্দোলনের পোস্টার। এরা ছিল “অতিমানবিক” শ্রমিক। এদের কাজ ছিল ক্রমাগত কাজ করে রেকর্ড ভাঙা। সহকর্মীরা এদের দেখতে পারত না। এদের কাজের গুণগত মানও ছিল কম।
পোস্টারে লেখা কয়লা শিল্পায়নের পাঁচ বছরের পরিকল্পনা শেষ হবে তিন বছরে।

বাস্তবতাবিবর্জিত পরিকল্পনার কারণে দেখা যায় স্তালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে সব কাজ সমাধা হবার কথা ছিল, সেগুলি পিছিয়ে দিতে হয় পরের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষভাগে। ওদিকে পোস্টার সেঁটে চলেছে পার্টিকর্মীরা, “পাঁচ বছরের কাজ শেষ করি চলো তিন বছরে!” মাগনিতোগোর্স্কে দেখা দিল সাপ্লাই চেইন সমস্যা। যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে বটলনেক। এত বড় স্টীল মিল হওয়া সত্ত্বেও সে কমপ্লেক্সটির ভেতরের সকল রেললাইন বানানোর উপযুক্ত উৎপাদনই মিলটিতে নেই। গত পোস্টে বলেছি ডিমান্ড বিল্ডাপ না করেই সবকিছু বিশাল বিশাল বানানোর সোভিয়েত শখের কারণে দ্নিপ্রোগেসের মত বিদ্যুতকেন্দ্রও ক্ষতিতে চলেছিল কয়েক বছর।

স্তালিন এ অবস্থা দেখে নতুন ফতোয়া দিলেন “ডিজী উইথ সাক্সেস” নামে। তার এক্সকিউজ, এত দ্রুত সোভিয়েতরা সাফল্যের মুখ দেখছে যে সেটা হজম করতে পারছে না! এবার আনতে হবে ধীরতা।

ডিজী উইথ সাক্সেস, পার্টির উদ্দেশ্যে স্তালিনের লেখা ফতোয়া, ১৯৩০

স্তালিনের ফ্যাক্টরি ম্যানেজাররা তো আরো এক কাঠি ওপরে। তারা সচেষ্ট ছিলই পার্টি বসদের কাছে নিজেদের জাহির করতে। ফোলানো-ফাঁপানো প্রডাকশন নাম্বার যেত ফাইনাল রিপোর্টে। কোটা পূরণ করতে না পারলে গর্দান যায়, আর কোটা পূর্ণ করেও বেশি দেখাতে পারলে মেডেল আছে কপালে! সোভিয়েত ব্যবস্থাপকদের চয়েস খুবই ক্লীয়ার।

সাধারণ মানুষ যে এই দ্রুত অগ্রগতির থেকে লাভবান হয়েছিল তাও নয়। ভারিশিল্পের ওপর বেশি জোর দেবার কারণে ভোক্তাশিল্প ছিল অবহেলিত। খাদ্য-বস্ত্রের মত মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে সরকারের নজর ছিল কম। অসঙ্গতিপূর্ণ নোট ছাঁপানোর কারণে ভোক্তাপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি ছিল অত্যাধিক। দেখা যেত, যেসকল ব্যক্তিমালিকানার খামার তখনও অবশিষ্ট ছিল, সেসবের কৃষক শস্য বিক্রির পরিবর্তে স্টক করে রাখছে। সরকার এসে সেগুলি কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত সেগুলি বিক্রি করত না। শেষ পর্যন্ত সে রাস্তাই নিতে হত কম্যুনিস্ট পার্টিকে। তাতেও যখন চাহিদা না মেটে, তখন শহরের মানুষকে আনা হয় রেশনের আওতায়। রুটির জন্য লম্বা লাইন ছিল সোভিয়েত শহরগুলির দৈনন্দিন দৃশ্য।

তিরিশের দশকে মস্কোতে রুটির জন্য লম্বা লাইন

ওদিকে তথাকথিত সাম্যবাদের দেশের শিল্পায়ন হয় কিন্তু পুঁজিবাদী আদলেই! রাষ্ট্র ছিল সকলের বেতনভাতার নির্ধারক। সোভিয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা ডিপ্লোমা ইনজিনিয়াররা পেত সাধারণ অদক্ষ কর্মীর ৬ থেকে ৮ গুণ। উপরের লেভেলের ম্যানেজাররা পেত ৩০ গুণ। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের বেতনভাতা ছিল সর্বোচ্চ। তারা থাকত বিশেষ বিদেশী এলাকায় ভাল বাসস্থানে। আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্য আনা হত তাদের জন্য। ছিল সুইমিং পুল গল্ফ কোর্স। বিনিময়ে কর্নেল কুপারের মত মানুষ সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সফল লবিইং করেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি মার্কিন পণ্যের রপ্তানি হয়, মার্কিন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তো মন্দ কি?

সব মিলিয়ে বুঝতে পারছেন হয়ত, সোভিয়েত সিস্টেমে পুঁজিবাদী শোষণের পরিবর্তে সেটি হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয়-সরকারী শোষণ। স্টেট সেখানে এক্সপ্লয়টার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের জায়গায়। বরং আরো বাজে এক্সপ্লয়টার। ফোর্ড-টেইলরের মত মানুষ যেখানে শ্রমিকদের ভাল বেতন দেবার পক্ষপাতী ছিলেন, সেখানে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র শ্রমিকদের বেতন তো বটেই, যাতায়াতও ফিক্স করে রেখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্তালিনের আমলে বেশ কিছু শ্রমিক ধর্মঘটও হয়, সমাজতন্ত্রী ওয়ার্কার্স প্যারাডাইজ প্রলেতারিয়াত ডিক্টেটরশিপ রাষ্ট্রে যেটা অভাবনীয়। অবশ্য যথারীতি সেসব ধর্মঘটের বিনাশও করে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ।

স্তালিনের আমলের অগণিত শ্রমিক ধর্মঘটের একটি স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পোস্টারে স্থান নেয়

যাই হোক, ত্রিশের দশকের শেষ নাগাদ নানা ভুল রাস্তায় টক্কর মেরে সোভিয়েত একটা স্থিতিশীল শিল্পায়নের অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তবে লেনিন-স্তালিনের এই ডিজী উইথ সাক্সেস শিল্পায়নের পেছনে বলেছি একটা প্যারানয়া কাজ করত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসনের ভয়ে এর আরম্ভ বিশের দশকে। ত্রিশের দশকে যখন সত্যি সত্যি সে সময়টা এল, তখন কি সোভিয়েত রাষ্ট্র তৈরি ছিল প্রতিরক্ষার জন্য? সে কাহিনী বলে সাড়ব আগামী খন্ডে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের পুঁজিবাদী তরিকা


সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক অস্তিত্ব সংকটগুলি কেটে যায় বিশের দশকের মাঝ নাগাদ। রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে লালবাহিনী জয়লাভ করে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক হারালেও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র শ্বেতবাহিনী ও স্থানীয় বিরোধিতা শক্তহাতে নিষ্ঠুরতার সাথে নির্মূল করতে সক্ষম হয় ত্রতস্কির সেনাদল।

ভল্গায় যখন ১৯২১এর দুর্ভিক্ষ চলমান, তখন কিন্তু লেনিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রকে কিভাবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা সম্ভব, সে চিন্তায় বেশি প্যারানয়েড। কারণ, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েতকে ঘিরে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলিকে তারা “শ্রেণীশত্রু” হিসাবে দেখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও প্রযুক্তিতে সেসব দেশ এগিয়ে আছে পঞ্চাশ বছর! তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকা সম্ভব, আর কিভাবেই বা সম্ভব সেসব দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে দেয়া?

সোভিয়েত প্রপাডান্ডা পোস্টারে কটাক্ষ করা হয়েছে ফরাসী, মার্কিন ও ব্রিটিশ পুঁজিবাদীদের, ১৯২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগেই প্রতিবেশীদের আগ্রাসনের ভয়ে শিল্পায়ন শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯২৯

বলশেভিক রাশিয়ার অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে তাই লেনিনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দ্রুত রাশিয়ার শিল্পায়ন সম্পন্ন করা। তাছাড়াও কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে শিল্পায়িত দেশে, কৃষিকাজনির্ভর দেশে নয়। রাশিয়া তখনো কৃষিভিত্তিক দেশ। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আদর্শবাদী পথে শিল্পায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাঁপ। ৎসারের আমলে যে অর্গানিক শিল্পায়ন শুরু হয়েছিল, সেটা যুদ্ধ ও বিপ্লবের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। লেনিন এবার যে শিল্পায়নের জন্য সচেষ্ট হলেন, সেটা বলপূর্বক শিল্পায়ন। ব্যক্তিগত পুঁজি নয়, রাষ্ট্র কিংবা সমবায় সমিতি হবে সে শিল্পায়নের মূল কান্ডারী।

স্বপ্ন এক কথা আর সেটা বাস্তব বানানো আরেক। বিপ্লবের পর রাশিয়ার খুব করুণ অবস্থা। শিল্পায়ন নতুন করে শুরু করবে কাকে দিয়ে? “বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু” প্রকৌশলী-বিজ্ঞানীরা হয় বিপ্লবীদের হাতে নিহত, নয়ত তাদের জীবনের সঞ্চয় নিয়ে অন্যদেশে পলাতক। আর লেনিন স্বয়ং দুটো স্টীমারে করে অগ্রগণ্য চিন্তাবিদদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। কেবল দুই স্যুটকেসে সারা জীবন ভরে নিয়ে দেশান্তরী হন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈর্ব্যক্তিক শিক্ষার জায়গা ততদিনে নিয়েছে আদর্শবাদী রাজনৈতিক বুলি আর শ্লোগান।

স্টীমশিপ হাকেন, দুটো জাহাজের একটি যাতে করে রুশ ১৯২২ সালে বিরুদ্ধমতের দার্শনিকদের আজীবন নির্বাসনে পাঠান লেনিন

হ্যাঁ, সমাজতন্ত্রীদের পেশীশক্তি আছে, অদক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু প্রযুক্তি নেই, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভাব। যেসব ব্যবস্থাপক ও সংগঠক ৎসারের আমলে শ্রমিকদের সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত করে কারখানা চালু রাখত, তারা এখন মৃত নয়ত নিগৃহীত।

ঠিক এমন অবস্থাতেই উপায়ান্তরহীন কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব — লেনিন, ত্রতস্কি, স্তালিন স্বয়ং — অনেক সাধারণ সদস্য ও লেবার ইউনিয়নের বিরোধিতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে বৈদেশিক সাহায্য দরকার। পুঁজিবাদী শ্রেণীশত্রুদের শরণাপন্ন হলেও সমস্যা নেই। তারা কম্যুনিস্ট হলেও সে আহ্বানে সাড়া দেয় পশ্চিমের নামীদামী প্রাইভেট কম্পানি — পশ্চিমা সরকাররা নয়, বরং সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু প্রাইভেট অন্টরপ্রনররা! এসকল কম্পানির অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ছিল মার্কিন ধনকুবেরদের পরিচালিত।

ফ্রেডেরিক টেইলর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনজিনিয়ারিংএর জনক, কারখানার কর্মীর সাথে
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল মিলে “টেইলরাইজড” অ্যাসেম্বলি লাইন
টেইলরের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের চিত্রীয় ব্যাখ্যা

বিস্তারিত বলার আগে লেনিন মার্কিন প্রযুক্তি, শ্রমদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে কতটা মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন সেটা না বললেই নয়। ফ্রেডরিক টেইলর নামে এক মার্কিন স্টীল কারখানার ফোরম্যান ও ইনজিনিয়ারিং ম্যানেজারের ভক্ত ছিলেন তিনি। এই টেইলর সাহেব কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইনজিনিয়ারিংয়ের জনক হিসাবে স্বীকৃত। কারখানার একেকটি বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙে শ্রমিকদের দক্ষতা ও দ্রুততা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া টেইলর বের করেন। শ্রমজীবীদের নেতা লেনিন অদক্ষ শ্রমিকদের রোবটের মত মবিলাইজ ও ইউটিলাইজ করতে এরকম থিওরিই খুঁজছিলেন। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল, বলশেভিক বিপ্লবকে শক্ত খুঁটিতে দাঁড়া করাতে প্রয়োজন এমন মার্কিন ধাঁচের উৎপাদনশীলতা। তবে সেখানে দক্ষ জনবল “লোভাতুর” পুঁজিবাদকে নয়, শক্তিশালী করবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত চালু “ওয়ার কম্যুনিজমের” ব্যাপক বিফলতার পর লেনিন চালু করেন “নিউ ইকনমিক পলিসি।” কারখানায় আবার অধিষ্ঠিত হয় ৎসারের আমলের প্রশিক্ষিত ম্যানেজার ও ইনজিনিয়াররা। ব্যক্তিপুঁজিকেও হালাল করা হয় কিছু খাতে। তবে ভারিশিল্প, তড়িত অবকাঠামো, আর পরিবহন ক্ষেত্র ছিল সরকারের একছত্র নিয়ন্ত্রণে। এসকল খাতেই নিয়ে আসা হল বাইরের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী কন্ট্রাক্টরদের।

“দাও শিল্পায়ন” — সোভিয়েত পোস্টার, ত্রিশের দশক
সারা দেশে তড়িতায়নের সপক্ষে লেনিনের চিত্রসহ প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯৩০
স্তালিনের চিত্রসম্বলিত প্রপাগান্ডা পোস্টারে সমাজতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত এ দাবির সাথে পাওয়ার প্ল্যান্টের ছবি, ১৯৩২

প্রথম বৃহদাকার যে প্রজেক্টটা শুরু হয় সেটি বর্তমান ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর জলপ্রপাতের ওপর বিশাল একটি বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। দ্নিপ্রোগেস নামের এই প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করা হয় মার্কিন কর্নেল হিউ কুপারকে। তিনি ছিলেন টেনেসি ভ্যালীতে ১৯২৪ সালে সমাপ্ত দৈত্যাকার মাসল শোলস পানিবিদ্যুত প্রকল্পেরও প্রধান। সোভিয়েতরা দ্নিপ্রো নদীর ওপর এত বিশাল প্রজেক্ট শুরু করল যেটা মাসল শোলসকেও হার মানায়। অথচ রাশিয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। যেখানে মার্কিন পুঁজিবাদীরা শুরু করে ছোট থেকে, তারপর চাহিদা অনুযায়ী আয়তন বাড়ায়, সেখানে লেনিনের স্বপ্ন একবারে চাঁদে লাফ দেয়া। এ কারণে পরে সমস্যা তৈরি হয়। লোড-ব্যালেন্স ঠিকমত না হলে সবসময় লাভজনকভাবে এসকল প্ল্যান্ট চালানো যায় না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ইউক্রেনের কসাকদের একসময়কার দুর্ভেদ্য দুর্গ দ্নিপ্রো নদীর প্রপাতে মাসল শোলসের আরো বড় কপি এই বাঁধ তৈরিতে সাহায্য করে অসংখ্য পশ্চিমা কম্পানি। জেনারেল ইলেক্ট্রিক বানায় পাঁচটি বিশালকায় জেনারেটর। নিউপোর্ট নিউজ শিপবিল্ডিং তৈরি করে নয়টি ৮৫,০০০ অশ্বশক্তির টারবাইন — সেসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ। জার্মান ও সুইডিশদের অংশগ্রহণ থাকলেও ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ছিল মার্কিন। স্টীম শভেল, ক্রেন, ট্রেন ইঞ্জিন, ড্রীল, কন্স্ট্রাকশন স্টীল — সবকিছু আসে আমেরিকা থেকে। পুরো সাইটটি দেখে এক পরিদর্শক এর নাম দিয়েছিলেন “লিটল আমেরিকা।”

ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর ওপর সেকালের সর্ববৃহৎ দ্নিপ্রো বাঁধ ও পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র, ১৯৩২ সালে সম্পূর্ণ হয়
দ্নিপ্রো বাঁধ নির্মাণে তদারকি করছেন যুকরাষ্ট্রে মাসল শোলস বাঁধের প্রধান পরিচালক কর্নেল কুপার, ১৯৩২
আমেরিকার আলাবামা স্টেটের মাসল শোলস বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র, যেটি দ্নিপ্রোর মূল ডিজাইন

১৯৩২ সালে দ্নিপ্রোগেস চালু হয় লেনিনের নাম নিয়ে। সেসময়ে সেটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী এখানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা দিয়ে উন্নত বিশ্ব থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রযুক্তিশিক্ষার গ্যাপ পুরো হয়ে যায়। ১৯১৩ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রাশিয়ার ছিল, ১৯৩২ সালে সেটা বেড়ে হয় ৭ গুণ। সে বছরই হিউ কুপারকে স্তালিন রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অফ দ্য রেড স্টার প্রদান করেন। কুপারই ছিলেন সে মেডেলের প্রাপক প্রথম বিদেশী।

১৯২৮ সাল নাগাদ রুশদের কাছে টেইলরের থেকেও অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অটোমোবাইল শিল্পের পথিকৃত শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড। ১৯২৬ নাগাদ রাশিয়ায় আমদানি হয় ২৫ হাজার ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর। ১৯২৭এ রাশিয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক ও ট্র্যাক্টরের ৮৫ শতাংশই ছিল ফোর্ডের তৈরি। ১৯২৪এ যেখানে মোটে ১,০০০ ট্র্যাক্টর ছিল রাশিয়ায়, সেখানে ১৯৩৪এর সংখ্যাটা ২ লাখ, অধিকাংশ তৈরি যুক্তরাষ্ট্রে। রাশিয়ার একাধিক গ্রামের নামকরণ হয় ফোর্ডসন নামে। ত্রতস্কির ভাষ্যে “দেশের প্রগতিশীল কৃষক সমাজের মুখে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম ফোর্ডসন।”

মডেল টি মোটরগাড়ীর সাথে মার্কিন শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড
ডেট্রয়েট নদীর পাশে রিভার রুজে বিশাল একটি ফোর্ড মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট তৈরি হয় ১৯১৭ থেকে ১৯২৮এর মধ্যে, সোভিয়েত বহু প্রজেক্ট একে নকল করে
ফোর্ড প্ল্যান্টের অ্যাসেম্বলি লাইনে কর্মীদের চিত্র

ফোর্ডের লক্ষ্য যেমন ছিল সস্তায় অ্যাসেম্বলি লাইন প্রডাকশন আর মাস কনজামশন, সেই একই লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। স্তালিনগ্রাদের একটি বিশাল ফ্যাক্টরির পরিকল্পনা দেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান। মস্কোতে তার অফিসে কার্যরত ছিল ২৫ মার্কিনের পাশাপাশি ৪,০০০ পর্যন্ত রুশ প্রকৌশলী। তার কম্পানি ডিজাইন করে কমপক্ষে ৫০০টি রুশ প্রকল্প। স্তালিনগ্রাদের কারখানাটি পুরো তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর পার্ট বাই পার্ট স্তালিনগ্রাদে নিয়ে এসে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টার নামের মার্কিন কম্পানি থেকেও আসে উপদেষ্টার দল। কাল্ডার নামে মার্কিন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ মার্কিন কর্মচারীর সহায়তায় ১৯৩০ সালে প্ল্যান্টটি উৎপাদন শুরু করে। কাল্ডার চেলিয়াবিনস্কেও আরেকটি ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে সেটি স্তালিনেতস নামে মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি ট্র্যাক্টর তৈরি শুরু করে। এ সবের রয়্যাল্টি বাবদ কোন অর্থ মার্কিন পেটেন্ট হোল্ডারদের সোভিয়েত সরকার দেয়নি। লেনিনগ্রাদ ও খারকভেও ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টারের কপি বানানোর প্ল্যান্ট গড়ে ওঠে।

রাশিয়ায় ফোর্ড কম্পানির অফিস
মিশিগানের ফোর্ড ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর, যেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নে রপ্তানি হত।
১৯২৯ সালে রাশিয়ায় মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট বানানোর চুক্তি সইয়ের পর সোভিয়েত প্রতিনিধিদের সাথে হেনরি ফোর্ড

অশিক্ষিত চাষীদের ট্র্যাক্টর চালানোতে পারদর্শী করতেও প্রশিক্ষকদল আমেরিকা থেকে আসে। আবাদী জমির যৌথখামারীকরণের স্তালিনী পরিকল্পনায় মার্কিন ট্র্যাক্টর পালন করে অনস্বীকার্য অবদান।

ট্র্যাক্টরের পাশাপাশি মোটরগাড়িরও চাহিদা তৈরি হয় সোভিয়েত নগরগুলিতে। ফোর্ড কম্পানির সাথে স্তালিন সরকার চুক্তি করে নিঝনি নভগোরদ শহরে একটি বিশাল কারখানা বানানোর। মিশিগানের রিভার রুজের বিশাল ফোর্ড কারখানার আদলে এর পরিকল্পনা হয়। অস্টিন কম্পানিও আরেকটি গাড়ির কারখানার চুক্তি করে। আলবার্ট কান পরিকল্পনা দেন মস্কোর একটি কারখানারও।

এসব কারখানায় মার্কিন যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল করে তৈরি হয় মার্কিন মডেলের কপি মোটরগাড়ি। শত শত মার্কিন প্রকৌশলীর সাথে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদানপ্রদান হয় সোভিয়েত প্রকৌশলীদের। নিঝনি নভগোরদের প্ল্যান্ট যখন ১৯৩০এ শুরু হয়, তখন সোভিয়েতরা ষড় করে মার্কিন প্রকল্প পরিচালককে দুই মাসের বিলাসবহুল ছুটিতে কৃষ্ণসাগর উপকূলে পাঠিয়ে দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ছাড়া সোভিয়েত প্রকৌশলীরা প্ল্যান্ট চালাতে পারছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

রাশিয়ায় বিশের দশকে জনপ্রিয় ছিল এই ফোর্ডসন ট্র্যাক্টরের নাম
১৯৩২ সালে সোভিয়েত সরকারে সাথে চুক্তি সই করেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান
আলবার্ট কানের তৈরি স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট

১৯৩২ সালে যখন ফোর্ড মডেল এ উৎপাদন শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে সোভিয়েতরা মার্কিন ম্যানেজারদের সরিয়ে সে জায়গায় বসায় তাদের সোভিয়েত সহকারীদের। এভাবে সম্পূর্ণ হয় এক অভাবনীয় আকারের টেক ট্রান্সফার। সেবছর থেকে মার্কিন ট্র্যাক্টর আমদানি বন্ধ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৩৪ থেকে নিজেরাই সেটা রপ্তানি শুরু করে বিশ্বের অন্যত্র। আর নিঝনি নভগোরদের সেই কারখানায় বানানো ক্যাপাসিটির মোটে অর্ধেক বিক্রি হওয়ায় ফোর্ড কম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। (সাউন্ডস ফ্যামিলিয়ার?!)

শুধু মোটরগাড়ি, ট্রাক, ট্র্যাক্টর ও বিদ্যুৎ নয়, ধাতব ও ভারিশিল্পেও মার্কিনদের পুরোপুরি কপি করে সোভিয়েতরা। ইন্ডিয়ানার গ্যারী শহরের স্টীল মিলের আদলে উরাল পর্বতের মাগনিতোগোরস্কে তৈরি হয় বিশাল এক কমপ্লেক্স। এই মহাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টর ছিল মার্কিন ম্যাককী কম্পানি। লৌহআকরিক পরিশোধনের জন্য ৮টি ১,৫০০ টন ব্লাস্ট ফার্নেস সরবরাহ করে ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিং নামে মার্কিন ফার্ম। একই ফার্ম কুজনেতস্কের একটি আয়নওয়ার্কস তৈরিতেও সাহায্য করে। মাগনিতোগোরস্কে ৩টি রোলিং মিল তৈরি করে দেয় জার্মান একটি কম্পানি। ৩টি বেসেমার কনভার্টার ও ৪৫টি কোক ওভেন আসে মার্কিন ফার্ম কপার্স এন্ড কম্পানি থেকে। সোভিয়েতদের দায়িত্বে ছিল কেবল নিম্নপ্রযুক্তির ২৮টি ওপেন হার্থ ফার্নেস, পরিবহনব্যবস্থা আর পানিসরবরাহব্যবস্থা।

মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি রুশনির্মিত স্তালিনেতস ট্র্যাক্টর
নিঝনি নভগোরদ, বর্তমান গোর্কি, শহরে নির্মিত ট্রাক ও মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি
সোভিয়েত প্রপাগান্ডা পোস্টারে কর্মীদের উত্সাহিত করা হচ্ছে ৮০ লাখ টন ধাতব অ্যালয় তৈরির লক্ষ্যে, ১৯৩১

এই বিশাল কমপ্লেক্সে থাকার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নকশা তৈরি করে দেন জার্মান স্থপতি এর্নস্ট মে। গোটা রাশিয়া থেকে অদক্ষ শ্রমিক, ক্ষুধার্ত চাষীর দল, সাইবেরিয়ার ভবঘুরে আর যৌথখামার থেকে পলাতক পরিবারের স্থান হয় এখানে। গমগম করতে থাকে উরালের বিরানভূমি।

১৯৩৪ থেকে এই কম্প্লেক্সের দায়িত্ব ধীরে ধীরে হস্তান্তরিত হয় সোভিয়েত ম্যানেজারদের হাতে। বিদেশী ম্যানেজারদের দোষারোপ করা হয় যে তারা সে কাজে ধীরতা দেখাচ্ছে। তরুণ সোভিয়েত প্রকৌশলীরা বিদেশীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশী গ্রেডের বেতনের চাকরি দখল করতেই মুখিয়ে ছিল।

মাগনিতোগোর্স্ক যখন শতভাগ কাজ শুরু করে আরো কয়েক বছর পর, তখন এখানে উৎপন্ন স্টীল ছিল চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি আর পোল্যান্ড সকলের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। শুধু স্টীল নয়, এর আশপাশে ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, তামা, নিকেল, দস্তা আর অ্যালুমিনামেরও খনি। এই বিশাল কম্প্লেক্সের নাম দেয়া হয় উরাল-কুজনেতস্ক-কম্বিনাত। এখান থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার শিল্পায়িত শহরগুলিতে যেত ভারি অস্ত্র, ট্র্যাক্টর, রেলওয়ে কার, পরিশোধিত তেল, কয়লা।

মার্কিন অস্টিন কম্পানির ডিজাইন করা নিঝনি নভগোরদের মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স
মাগনিতোগর্স্কের স্টীল সিটিতে মার্কিন ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিংয়ের করে দেয়া ব্লাস্ট ফার্নেস প্ল্যান্ট, ত্রিশের দশক
জার্মান স্থপতি এর্ন্সট মে’র পরিকল্পিত মাগনিতোগর্সকের কর্মীদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট, ত্রিশের দশক

মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা যে শুধু শিল্পক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা নয়। রেড আর্মিকে সুসংহত করতে ত্রতস্কিও টেইলরিজমের শরণাপন্ন হন। লালবাহিনীর কঠিন সময়টাতে তার পাশে ছিল কেলী নামে এক মার্কিন প্রকৌশলী। অস্ত্র কারখানাগুলির উৎপাদনদক্ষতা বাড়াতে তিনি সাহায্য করেন।

আর সোভিয়েত সোশালিস্ট রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর জন্মও এ সময়ে। গুস্তেভ নামে এক কবি সৈনিক-শ্রমিকের একটা পূজনীয় ইমেজ তৈরি করেন। সেই ইমেজে যন্ত্রের সাথে পেশী মিলিয়ে মানুষ হয়েছে অদম্য — ঈশ্বরেরও অধিক কিছু। গুস্তেভ জিনভিয়েভদের মত লেখকদের কল্পনায় জন্ম হয়েছিল নতুন এক মানবপ্রজাতির — হোমো সোভিয়েতিকাস। তবে, পেশীর সাথে সংযুক্ত যন্ত্রশক্তির এনেবলাররা হোমো সোভিয়েতিকাস নন, হোমো আমেরিকানাস! এবং যেনতেন আমেরিকান নন, পুঁজিবাদী শিল্পপতি আমেরিকান।

আর ইতিহাসের এই দ্রুততম টেক ট্রান্সফারের কাহিনী আজকের রুশ তো বাদ দিলাম, খোদ মার্কিনদেরই মনে নেই!

সোশালিস্ট রিয়েলিজম ধাঁচের উদাহরণ, কারখানা শ্রমিক ও যৌথখামারের নারী, তৈরি ১৯৩৭এ, মস্কো


আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




হার্বার্ট হুভার ও ক্ষুধার্ত রাশিয়া


১৯২১ সালের জুলাই মাস। রুশ সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির একটি ছোট্ট লেখা প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্ক টাইমসে—

“অন্নদাত্রী স্তেপভূমি খরাগ্রস্ত। কোটি মানুষের রুশ জনপদ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। উপর্যুপরি যুদ্ধ ও বিপ্লবে জনগণ ক্লান্ত, রোগজরার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেই। … দুনিয়ার সকল সৎ ও সংস্কৃতিবান ইউরোপীয় ও মার্কিন মানুষের নিকট আমার প্রার্থনাঃ তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, মেন্দেলেভ, পাভলভ, মুসর্গস্কি, হ্লিংকার দেশের মানুষকে দ্রুত রুটি আর ওষুধ দিয়ে সাহায্য করুন।…”

ম্যাক্সিম গোর্কি ও ১৯২১এ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার আর্জি

এই আকুল আবেদনটি আরো অনেকের মত নজর কাড়ে মার্কিন কমার্স সেক্রেটারি হার্বার্ট হুভারের। তিনি পরবর্তীতে হন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১তম প্রেসিডেন্ট। গোর্কির এই আবেদনে সাড়া দেবার মত বিশ্বে আর কেউ সেসময় থেকে থাকলে ছিল আমেরিকা — আর হার্বার্ট হুভার।

গোটা ইউরোপ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। গোর্কির আবেদনে সাড়া দেবার মত অবস্থায় নেই। ওদিকে হার্বার্ট হুভারের নেতৃত্বেই ইউরোপে বিপুল পরিমাণে খাদ্যবন্টন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তিনি বিভিন্ন মার্কিন ত্রাণকর্মের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ চলাকালে বেলজিয়ামে, যুদ্ধের পর অস্ট্রিয়া-পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রক্ষা করে তার বদান্যতা।

হার্বার্ট হুভার, পশ্চিম ইউরোপে প্রেরিত ত্রাণসাহায্যের সামনে, ১৯১৯

অবশ্য এসবের পেছনে গূঢ় একটা লক্ষ্য তো ছিলই। যুদ্ধে পরাজিত দেশগুলি এত দুর্বল যে নাগরিকদের দেখভালের যথেষ্ট সামর্থ তাদের নেই। উল্টো ভের্সাই চুক্তিতে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বিশাল ক্ষতিপূরণের বোঝা। এ ব্যাপারে উইলসনের সাথে দ্বিমত ছিল হুভারের। তিনি নিলেন অন্য পথ। এসব দেশের ন্যুব্জ অর্থনীতি থেকে যদি খাদ্যাভাব সাধারণ মানুষকে পীড়িত করে, তাহলে আর দেখতে হবে না! রুশ দেশের মত পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের প্রতিটি দেশ একে একে বলশেভিক ধাঁচের বিপ্লবের সম্মুখীন হবে। যেমনটা প্রায় হয়ে গেছিল হাঙেরিতে।

আমেরিকায় তখন চলছে “রেড স্কেয়ার।” মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগে সেখানেও আছে কম্যুনিস্ট ও লেবার পার্টি। রাশিয়ায় বলশেভিকদের বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারখানা শ্রমিকরা এদের সাথে যোগসাজশে ধর্মঘট, রায়ট, ভাঙচুর শুরু করে। মার্কিন সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন এতে খুব বেশি ছিল না। তাদের আশা ছিল সরকার এ অরাজকতা বন্ধ করবে। তাই হয়।

বিশের দশকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সন্ত্রস্ত ছিল কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট ও অরাজকতা দেখে, রাশিয়ার বিপ্লবপরবর্তী পরিণতির কথা চিন্তা করে এ ধরনের কার্টুনচিত্রও অংকিত হয়
হাঙেরিতে খাদ্যত্রাণ পাঠানোর জন্যে আমেরিকায় প্রচারিত হার্বার্ট হুভারের সংস্থার পোস্টার, ১৯১৯

সে কারণে গোর্কির এই আবেদন দেখার পর হুভার একটু সাবধানতার সাথে জবাব দেন। রুশদেশে বলশেভিকদের বন্দী মার্কিনদের মুক্তি দেয়া হলে ত্রাণকার্য পরিচালনা করবে তার সংস্থা। তিনি ছিলেন প্রাইভেট নন প্রফিট এ আর এ — আমেরিকান রিলীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান।

তাছাড়া গোর্কির থেকে আনঅফিশাল এ চিঠিটি আসলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পালের গোদা লেনিনের থেকে তো কোন আনুষ্ঠানিক অনুরোধ আসেনি। তবে নেগোসিয়েশনের পাল্টা প্রস্তাব আসল গোর্কির মধ্যস্থতাতেই — লেভ কামেনেভের কাছ থেকে। আগস্টে বন্দীমুক্তির পর শুরু হল সে আলাপ।<

হুভার প্রথম প্রথম দোনমনায় ছিলেন। তার চিন্তা ছিল কম্যুনিজমের মত আদর্শের দ্রুত পতন জরুরী। এসময় তাকে টিকিয়ে দেয়া ঠিক নয়। আবার উইলসনের সরকার যেমন বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ১৩,০০০ মার্কিন সৈন্য পাঠিয়ে রাশিয়ায় গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা অভিযানে অংশ নিয়েছিল, সেটার পক্ষেও সম্পূর্ণরূপে ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করেন, সোভিয়েতদের বিনাশ করতে হবে, তবে অস্ত্র দিয়ে নয়, ত্রাণ ও দয়াদাক্ষিণ্য দিয়ে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশু, ১৯২১
রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে এআরএ পরিচালিত চিলড্রেনজ হাউজে রুশ শিশুর দল, ১৯২১

প্রথম দিকে ত্রাণকার্যের লক্ষ্য ছিল কেবল সোভিয়েত শহরগুলির অনাথাশ্রম। যুদ্ধ ও বিপ্লবের ডামাডোলে যে সকল শিশু এতিম হয়েছে, নয়ত পরিত্যাজ্য হয়েছে, তাদের জন্য শুরু হল ফান্ড কালেকশন। শুরুতে বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। পত্রিকা, সিনেমা হলে রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে সংগৃহীত হল বিশাল অংকের অনুদান। সামান্য কয়েক সেন্ট থেকে শুরু করে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত দান করেন বহু মার্কিন।

সে দানে কেনা খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ নিয়ে পেত্রোগ্রাদ — পরবর্তী লেনিনগ্রাদ — শহরে হাজির হল হুভারের প্রতিনিধিরা। সেখানে শিশুদের কংকালসার অবস্থা দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ! শুধু যে দু্র্ভিক্ষপীড়িত এরা তা নয়, অনেক ভুগছে মরণব্যাধি টাইফাসে। এসকল শিশুদের দিয়েই ক্লান্ত গলার স্বাগতম গীতি গাওয়ালো আশ্রমের সরকারী কর্মচারীরা। ভেজা চোখে অন্যদিকে চাইলেন এআরএ কর্মকর্তা বিল শ্যাফ্রথ ও তার সহকর্মীরা।

শিশুটির দাঁড়ানোর শক্তি নেই, হামাগুঁড়ি দিতে দিতে মাটি থেকে পোকামাকড়, ময়লা কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে খাচ্ছে, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
টাইফয়েডে আক্রান্ত রুশ শিশু, রুশ মহাদু্র্ভিক্ষ, ১৯২১

শহরের এ করুণ অবস্থা দেখে গ্রামাঞ্চলের ব্যাপারে কৌতূহল হল শ্যাফ্রথের। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভল্গা নদীর উপত্যকায় সামারা, কাজান, উরাল, উফা প্রভৃতি বিস্তীর্ণ দুর্গম অঞ্চলে স্কাউটিংয়ের জন্য পাড়ি জমালো তার দলের লোকজন। যেমনটা সন্দেহ ছিল তার থেকে খারাপ অবস্থা গ্রাম্য মানুষের। তাদের নিজেদের ফলানো যা শস্য ছিল তা রিকুইজিশন করে নিয়ে গেছে লালবাহিনী, নিয়ে গেছে পরের মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বেছে রাখা গমের দানা।

এ অঞ্চলের অধিবাসী শুধু রুশ নয়, কাজাখ-বাশকির প্রভৃতি মুসলিমপ্রধান জনপদও। সকলে কমবেশি দুর্ভিক্ষগ্রস্ত। গাছের ছাল, গুঁড়োকরা হাঁড়, খড় প্রভৃতি কাঁদার সাথে মিশিয়ে স্যুপ বানিয়ে খাচ্ছে এরা। নোংরা বাসস্থানের উঁকুন আর অপুষ্টি থেকে টাইফাস রোগের প্রাদুর্ভাব। যত দিন যাচ্ছে, তত রিপোর্ট আসছে ক্যানিবালিজমের — কোন ক্ষেত্রে কবর খুঁড়ে টাইফয়েডে মারা যাওয়া মৃতদেহের অবশেষ খাচ্ছে দুর্ভিক্ষপীড়িতরা। যাদের বাড়িতে বাচ্চা আছে তারা সন্ধ্যার পর তালা মেরে দরজা লক করে রক্ষা করছে বাচ্চাদের। কারণ ক্যানিবালিজমের প্রথম শিকার এরা। দুয়েকটা এমন কেসও বেরিয়েছে যেখানে মা তার অন্য শিশুর খাদ্যসংস্থানের জন্য হত্যা করেছে বড় সন্তানকে। এসকল হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল আসলেই। প্রপাগান্ডা নয়। রুশ রিপোর্ট আবিষ্কৃত হয়েছে পরে।

কংকালসার রুশ শিশু, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো শিশুদের কংকালসার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঠেলাগাড়ি করে, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১
দুর্ভিক্ষপীড়িত ভল্গার মুসলিম জনপদ, রুশ মহাদুর্ভিক্ষ, ১৯২১

এ রিপোর্ট যখন হুভারের কাছে গেল তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে শুধু শহরের শিশুদের সাহায্য করে খাদ্যের চাহিদা মিটবে না। খাওয়াতে হবে কয়েক কোটি জনগণকে, রোপন করতে হবে পরবর্তী মৌসুমের বীজ। কংগ্রেসে দ্রুত রাশান ফ্যামিন রিলীফ অ্যাক্ট পাশ হল ডিসেম্বর ১৯২১এ। প্রথম ধাঁপে অনুমোদন হল ২০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য। পরের বছরে সেটি বেড়ে হল ৬০ মিলিয়ন ডলার। এখনকার হিসাবে সব মিলিয়ে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

প্রায় ৩০০ জন মার্কিন কর্মকর্তা আর ১,২০,০০০ ইংরেজীতে পারদর্শী স্থানীয় রুশ সহকারীদের নিয়ে মধ্য রাশিয়ার বিশাল এলাকাকে কয়েকটি ডিস্ট্রিক্টে ভাগ করে কাজ শুরু করল এআরএ। বাল্টিক সাগরে মার্কিন জাহাজে করে এল টনকে টন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত গম ও ভুট্টা। কৃষ্ণসাগরের বন্দরেও নোঙর করল খাদ্যবাহী জাহাজ। ট্রেনে করে ভল্গার উজানে যেতে শুরু করল ত্রাণ। প্রতিদিন প্রায় ১.১ কোটি মানুষের খাদ্যসংস্থান হল আট-নয় মাসব্যাপী। লঙ্গরখানা খোলা হল ১৯ হাজার।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ১৯২১ সালের রিপোর্টে বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্ররা এক বেলা না খেয়ে থেকে সে টাকা দান করেছে হুভারের রুশ ত্রাণ তহবিলে
হুভারের এআরএ পোস্টার প্রচারণায় বলা হচ্ছে ১০ ডলারের একটি অনুদান পেলে তারা কি ধরনের খাবার রাশিয়ায় পাঠাবে, ১৯২১
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ভোটে তদকালীন মুদ্রামানের ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ হয় রুশ মানুষের ত্রাণে, ১৯২১
তদকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান বেলারুশের মিনস্কে অবস্থিত এআরএ অফিসের সামনে তার মার্কিন কর্মকর্তারা, ১৯২১
কৃষ্ণসাগরের নভোরসিস্ক বন্দরে এআরএ’র খাদ্যত্রাণ খালাস হচ্ছে, ১৯২১-২২
এআরএ’র ত্রাণবাহী ট্রাকের সামনে তার কর্মচারীরা, ১৯২১-২২
ভল্গার পূর্ব তীরের দুর্গম স্তেপে রেল ছিল না, ছিল না গাড়ি চলার রাস্তা। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাতে এআরএ’কে ব্যবহার করতে হয় ঊটের কাফেলা। ১৯২১-২২।
এআরএ’র উফা-উরাল ডিস্ট্রিক্টের পরিসংখ্যান বোর্ডে দেখানো হয়েছে হিসাব, নিয়মিত ত্রাণ যাচ্ছে দেড় মিলিয়নের বেশি মানুষের কাছে। ১৯২১-২২।
এআরএ’র উফা-উরাল ডিস্ট্রিক্টের পরিসংখ্যান বোর্ডে দেখানো হয়েছে হিসাব, নিয়মিত ত্রাণ যাচ্ছে দেড় মিলিয়নের বেশি মানুষের কাছে। ১৯২১-২২।

হুভারের এই ত্রাণকার্য যে কোন প্রকার বাঁধা ব্যতিরেকে হয়েছে তা কিন্তু নয়। স্মরণ করুন যে গোর্কি স্বয়ং হাটে হাঁড়ি না ভেঙে দিলে এ খবর পশ্চিমে বেরুতও না। দুর্ভিক্ষের আভাষ পাওয়া সত্ত্বেও অহেতুক বিলম্ব করে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় প্রশাসন। ততদিনে মানুষ মারা যেতে শুরু করেছে। তারপর ট্রেনে করে কৃষ্ণসাগর থেকে এআরএ’র খাদ্য আনতে গিয়ে দেখা গেল অনেকগুলি কার লাপাত্তা। রাস্তাতেই গায়েব করে দিয়েছে রেলশ্রমিকেরা। সে ব্যাপারে অভিযোগ তুলতে রেল ইউনিয়ন পুরো রেলব্যবস্থায় এমন একটা জ্যাম তৈরি করে রাখল যে কয়েক সপ্তাহ ত্রাণ যেতে পারল না ভল্গায়। ট্রেনে উল্টো রাস্তায় ইউক্রেনে আসতে শুরু করল ক্ষুধার্ত মানুষ। ভল্গায় খাবার না পেয়ে মারা গেল কয়েক লাখ।

এ অবস্থায় শ্যাফ্রথ হুভারকে একটি আনএনক্রিপটেড চিঠি পাঠান। এর বক্তব্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ঠিকমত সাহায্য করছে না, যতদিন সে সাহায্য না আসে ত্রাণ পাঠানোতে যেন বিরতি দেয়া হয়। এটি পাঠানোর পরপরই লেনিন তদকালীন রেল কমিসারকে পদচ্যুত করে তার জায়গায় আসীন করেন ফেলিক্স জেরঝিনস্কিকে। রেল ব্যবস্থা আয়রন ফেলিক্সের ভয়ে আবার ঠিকমত চালু হয়। পুরো দুর্ভিক্ষে এভাবে প্রায় ৬ থেকে ১০ মিলিয়ন প্রাণ হারায়, যদিও এআরএ তার থেকে বেশি প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়।

শুধু যে এ ধরনের লজিস্টিকাল সমস্যার সম্মুখীন হয় এআরএ, তা নয়। গোর্কির সুপারিশে তাদের রাশিয়ায় ঢুকতে দিলেও লেনিন এদের ব্যাপারে ভীষণ সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন। ত্রাণ বিলানোর অন্তরালে এরা গুপ্তচরবৃত্তি করছে কিনা, সাধারণ মানুষকে “প্রতিবিপ্লবী” বানানোর ষড়যন্ত্র করছে কিনা — এসব চোখে চোখে রাখার জন্য গুপ্ত পুলিশ চেকা থেকে লোক এসে তদারকি শুরু করে।

এআরএ অফিসে কার্যরত রুশ শিক্ষিত অভিজাত নারী। বিপ্লবে এরা সর্বস্ব খোয়ায়, কিন্তু ৎসারের আমলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাজে লেগে যায় মার্কিনদের সাহায্য করতে। বলশেভিকদের সন্দেহ পড়েছিল এ সকল “প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীদের” ওপর। ১৯২১-২২।
খাদ্য বিতরণরত এআরএ কর্মকর্তা, ত্রাণ নিচ্ছে দাঁড়ি-টুপিওয়ালা এক কসাক গোছের রুশ। ১৯২১-২২।
এআরএ পরিচালিত চিলড্রেনজ হাউজ ও কিচেনে রুশ শিশুর দল, ১৯২১-২২।

অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় রুশদের সাথেই চেকার টক্কর লেগে যায়। যেহেতু এআরএ’এর দরকার ছিল ইংরেজীভাষী ফীল্ড এজেন্ট এবং একমাত্র ৎসারের আমলের শিক্ষিত অভিজাত মানুষদের মধ্যেই এদের সংখ্যা বেশি, সেহেতু চেকার সাথে একটা সংঘাত লেগে থাকত এআরএ’র। এ ধরনের রাজনীতির ফাঁকে গোপনে এআরএ’র একটি জেলার ত্রাণকার্যের নিয়ন্ত্রণ চেকা নিয়ে নেয়। এবং এআরএ’র পুরো ত্রাণপ্রচেষ্টাকে বলশেভিক সরকারের বদান্যতা হিসাবে প্রচার করে। এই অপপ্রচার হটাতে এআরএ’কে তৈরি করতে হয় প্রচারণা পোস্টার। যাতে সাধারণ মানুষ বোঝে এই ত্রাণ বলশেভিকদের কিংবা তথাকথিত “মার্কিন প্রলেতারিয়াতের” কাছ থেকে আসেনি।<

লেনিন শেষ পর্যন্ত এতটা ক্ষিপ্ত হন যে মলোতভকে চিঠি লিখে বলেন যে কোন মূল্যে হুভারকে শাস্তি দিতে হবে। গুপ্তচর বলে কোন কিছু এআরএ’র মধ্যে তো ছিলই না, বরং স্থানীয় রুশদের সাথে তাদের এত সখ্যতা ছিল যে খুব সহজে গুপ্তচরবৃত্তির বানোয়াট দোষ চাপিয়ে তাদের উৎপাটন সম্ভব নয়। তখন নতুন দোষারোপ করা হল এআরএ’র ওপর। তারা নাকি অর্থডক্স চার্চের সোনায় বাঁধানো আইকন ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে আনছে খাদ্য। চার্চগুলোর ওপর এই আক্রমণও আসলে বলশেভিকদের কাজ। কিন্তু ধার্মিক সাধারণ মানুষকে এআরএ বিমুখ করাটাই উদ্দেশ্য।

এআরএ’র প্রচারণা পোস্টার। রুশে লেখা দুর্ভিক্ষপীড়িত রাশিয়ার নিকট আমেরিকা। বলশেভিকদের অপপ্রচারণা খন্ডন করতে এগুলি ছাপাতে হয়। ১৯২১-২২।
এআরএ’র প্রচারণা পোস্টার। রুশে লেখা আমেরিকার জনগণের উপহার। বলশেভিকদের অপপ্রচারণা খন্ডন করতে এগুলি ছাপাতে হয়। ১৯২১-২২।
রুশ শিশুদের টাইফয়েডের টীকা দিচ্ছে এআরএ’র ডাক্তার, ১৯২১-২২।

লেনিনের আশা ছিল যে এআরএ’এর সাথে এই “সহযোগিতার” বিনিময়ে মার্কিনদের থেকে তার সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে। ১৯২২এ এসে যখন পরিষ্কার হল সেটা হবে না, তখন এআরএ বিরোধিতা আরো তুঙ্গে উঠল। ততদিনে এআরএ ৩.৪ কোটি টন খাদ্যত্রাণ সরবরাহ করেছে। টাইফাস, প্যারাটাইফয়েডের বিরুদ্ধে টীকা দিয়েছে কয়েক মিলিয়ন শিশুকে। পরবর্তী মৌসুমের গমের বীজ বপন শেষ।

এর ওপর বেরুল যে সোভিয়েত সরকার ইউক্রেন থেকে গোপনে শস্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেছে। অর্থাৎ একদিকে করছে রপ্তানি, আরেকদিকে চলছে দুর্ভিক্ষ। এ পর্যায়ে এসে এআরএ মিশনের আর কোন অর্থ হয় না। ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ সালে তারা অফিস গুঁটিয়ে ফিরে যায় মার্কিন দেশে। রেখে যায় দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচানো এক পুরো জেনারেশন, তাদের সাহায্য করতে এসে টাইফয়েডে মৃত্যুবরণ করা স্বেচ্ছাসেবকদের কবর, আর কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায় রুশ ভার্যা। সোভিয়েত সরকার তাদের পুরো কার্যক্রমকে ডিসক্রেডিট করে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি অপারেশন হিসাবে।

তবে এআরএ’এর স্মৃতি রয়ে গেছিল রুশদের মাঝে। কর্নেল বেল নামে এক এআরএ কর্মকর্তা উরালের নিকটবর্তী রুশ, বাশকির ও কাজাখদের এতটাই স্নেহভাজন হন যে স্থানীয় মুসলিম ইমামরা তাকে অনুমতি দেন তাদের মসজিদে থাকা বহু শতকের পুরনো একটি কুরআনে চোখ বুলানোর। বহির্বিশ্বের আর কেউ, এমনকি কোন রুশও এ সম্মানের অংশীদার কখনো হয়নি। বহুদিন ভল্গা উপত্যকার মানুষ খাদ্যত্রাণের নাম মনে রেখেছে “আমেরিকা” নামে। কারণ ঐ লেবেলেই ত্রাণ আসত। খাদ্য মানে আমেরিকা, আমেরিকা মানে খাদ্য।

দুর্ভিক্ষপীড়িত বাশকির পরিবার, উফা অঞ্চল, ১৯২১-২২।
বাশকির-তাতার মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সাথে করমর্দন করছেন এআরএ’র কর্নেল বেল, ১৯২১-২২।

এভাবে মধ্যযুগের ব্ল্যাক প্লেগের পর ইউরোপের সবচেয়ে মরণঘাতী দুর্যোগ থেকে উত্তরণ ঘটে রাশিয়ার। হুভার ভেবেছিলেন, উই উইল কিল দ্য বলশিজ উইথ কাইন্ডনেস। তা কিন্তু হ্য়নি! পরবর্তীতে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন যে, সোভিয়েতদের বরং দাঁড়া করে দিয়ে গেছে তার মানবিক ত্রাণকর্ম।

আরেকটা ব্যাপার মনে করুন। আজকের যুগে অনেকে ভাবেন যুক্তরাষ্ট্রের টাকার কি অভাব! যতখুশি সাহায্য করতে পারে! ডলার ফরেন রিজার্ভ কারেন্সি হবার কারণে যত খুশি তারা তো “টাকা ছাপাতেই” পারে! সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। বর্তমানে তো নয়ই, অতীতেও ছিল না। সে যুগে ইউএস ডলার ফরেন রিজার্ভ ছিল না, আর আমেরিকার জনগণ প্রবেশ করতে যাচ্ছে গ্রেট ডিপ্রেশনের অনিশ্চয়তার যুগে। তার মধ্যেও আজকের মানের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্য এবং স্বদেশী এক্সপার্টদের মার্কিনরা পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়নে। এভাবে সে যাত্রা মার্কিন বদান্যতায় বেঁচে যায় লেনিনের ইউটোপিয়ার স্বপ্ন আর পাকাপোক্ত হয় স্তালিনের স্বৈরাচারের ভবিষ্যৎ।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




চীনের আপৎকালে যুক্তরাষ্ট্র


ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রাক-আধুনিক যুগের বহু সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল করুণ। ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানী আব্বাসী সাম্রাজ্য, চীনের চিং, ভারতের মুঘল — এরা সকলেই ইউরোপীয়, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী, অস্ট্রোহাঙেরীয়, রুশ, কিংবা জাপানী আগ্রাসনের সম্মুখীন। আফ্রিকার পুরনো রাজ্যগুলিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের ভাগাভাগি করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করছে ব্রিটিশ-ফরাসী-জার্মানরা। ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রাও দ্বিতীয় কাতারে।

ফরাসী পত্রিকা ল্য পতি জু্র্নালে চীন ভাগাভাগির কার্টুন, ১৮৯৮

একটা ব্যাপার মাথায় এল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল সুবিধাভোগী হল ব্রিটিশরা। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে অস্ট্রীয়, ব্রিটিশ ও রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা পেল কিংবা বিচ্ছিন্ন হল গ্রীস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু চীনের ভাগ্য কেন এমন টুকরোটুকরো হল না? ইউরোপীয় ও জাপানীদের চীন নামের কেক কেটে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কার্টুন তো সে সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আসলে তো তা হয়নি।

হ্যাঁ, হংকং ও মাকাউ ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। চীনের বিভিন্ন বন্দরে পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীদের বিশেষ সুবিধা ছিল। শাংহাইয়ে ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের মত এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের মত ফরেন কলোনাইজেশনের সম্মুখীন হয়নি চীন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ তুরস্ক ও অস্ট্রোহাঙেরি যেভাবে বিভক্ত হয়ে “ডিকলোনাইজেশন”ধাঁচের ব্রেকআপের মাধ্যমে নতুন কিছু দেশের জন্ম দিয়েছিল, সেরকম ভাগ্যও চীনের হয়নি। যদিও সেটিও মূলে মাল্টিএথনিক এম্পায়ার রুলড বাই আ মাইনরিটি পীপল। হংকং-মাকাউয়ের মত কলোনি পর্তুগীজদের গোয়া-দমন-দিউ কিংবা ব্রিটিশদের ফোর্ট উইলিয়ামের থেকে তেমন কিছু বেশি ছিল না। বাকি চীনের আয়তনের তুলনায় এ সকল উপনিবেশ নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তবে ফোর্ট উইলিয়াম যেমন ব্রিটিশ বেঙ্গলের ভবিষ্যতের দিকেই নির্দেশ করছিল, চিং শাসনামলের এক পর্যায়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সেইরকম শেষ পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল চীন। সে থেকে ঘটনাচক্রে তারা রক্ষা পায় এক উঠতি স্থানীয় পরাশক্তির কারণে। সে পরাশক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র!

এ বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল শুভানুধ্যায়ী হিসাবে চীনের পাশে এসে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়ায়। সেটা অবশ্যই একটা লেভেলে ছিল। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের “নিকট” প্রতিবেশী হিসাবে চীনের ভাগ্য নিয়ে কিংবা চীনে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে মার্কিনদের মাথাব্যথা আর সক্ষমতা দুটোই যথেষ্ট ছিল, যেটা তুরস্ক কিংবা ভারতের বেলায় অতটা ছিল না। ইউরোপীয় ও জাপানীদের ওজনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা দাঁড়িপাল্লায় বিশাল এক ব্যালেন্স হিসাবে কাজ করে।

একটু ব্যাখ্যা করে বলি চীনকে সম্পূর্ণ উপনিবেশায়নের হাত থেকে কিভাবে একার্থে মার্কিনরা রক্ষা করে।

চীনের সাথে ইউরোপীয়দের সরাসরি বাণিজ্য শুরুর অনেক পরে মার্কিনদের আবির্ভাব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুয়েকটা সরকারী মিশন সরাসরি যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা চীনে আফিমের ব্যবসায় বেশি জড়িত ছিল। ব্রিটিশরা যেখানে ভারত থেকে একচেটিয়া আফিম রপ্তানী করত, সেখানে মার্কিনরা পারস্য থেকে কিনে সে বস্তু চীনে বিক্রি করত। চীনে এ বাণিজ্যের সিংহভাগ অবশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাতে।

চীনে স্থানীয় পোশাকপরিহিত মার্কিন মিশনারি, ঊনবিংশ শতক

এর পাশাপাশি মার্কিন মিশনারিদের আনাগোনা হতে শুরু করে চীনে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের জনগণের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে তারা। মিশনারিদের অনেকে এখনো খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। আমি, আমার পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষিত হয়েছি ক্যাথলিকপরিচালিত স্কুল বা কলেজে। ধর্মপ্রচারণার বিন্দুমাত্র অন্তত আমি দেখিনি। চীনের কিছু সাধারণ মানুষও মিশনারিদের শিক্ষার সে সুফল ভোগ করে।

আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিং সাম্রাজ্যকে অনেক ছাড় দিতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। বাণিজ্যে তারা পায় মোস্ট ফেভারড নেশনের সম্মান। পাঁচটি বন্দরে মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পায়। এর আগে সরকারীভাবে চীনের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি বাণিজ্য ছিল নিষিদ্ধ, তবে চোরাকারবারী ঠিকই চলত। ব্রিটিশরা এই লাভজনক সরকারী সুবিধাটি পাওয়ার কারণে ‌অন্যান্য বাণিজ্যিক শক্তিরাও একই ন্যায্য দাবি নিয়ে চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠায়। সামরিক হুমকি দিয়ে হোক, উপঢৌকনের বিনিময়ে হোক, সে দাবি আদায় করে নেয় ফরাসী, রুশ, জাপানী, ও অন্যান্য দেশ। সাথে মার্কিনরাও।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় রেললাইন তৈরিতে নিযুক্ত চীনা শ্রমিক, ঊনবিংশ শতক

মার্কিন বণিকরা যখন চীনা বন্দরে ব্যবসারত, তখন চীনা শ্রমিকদেরও আগমন হতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য মার্কিন টেরিটরিতে। প্যাসিফিক রেলওয়ে লাইনে কাজ করে অনেকে, আবার নতুন আবিষ্কৃত স্বর্ণখনিতেও। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি চীনা আসে যে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনাবিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে চীনা শ্রমিকদের প্রবেশ কয়েক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও এখনো সান ফ্রান্সিস্কোতে অনেক পরিবারের দেখা মিলবে যারা সেই চীনাবংশোদ্ভূত।

শুধু যে শ্রমিকের আগমন হয় তা নয়। ১৮৫০ ও ১৮৬০এর দশকে তাইপিং নামে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ হয় চীনে। চিং সাম্রাজ্য ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। মার্কিন ও ইউরোপীয়দের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় হান জনগোষ্ঠীর ওপর শাসনরত বহিরাগত মাঞ্চুরিয়ান রাজপরিবার। এর পর তাদের উপলব্ধি হয় যে পশ্চিমা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ না পেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। চায়নিজ এডুকেশন মিশন নামে একটি প্রজেক্টে দেড়শ’র মত টীনেজ বয়েসী চীনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসে। এসব সাংস্কৃতিক লেনদেনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন আদিতে চীনে বাণিজ্যকরা মার্কিন ব্যবসায়ীরা আর তদকালীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

কানেকটিকাটে চায়নিজ এডুকেশন মিশনের চীনা ছাত্রদের বেসবল টীম, ১৮৭৮
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চিং সম্রাটের রাষ্ট্রদূত লিয়াং চেং, চায়নিজ এডুকেশন মিশনে শিক্ষিত, বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, বিংশ শতকের প্রথমভাগ

চায়নিজ এডুকেশন মিশনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, এদের অধিকাংশ আর ফিরে যায়নি। চিং সম্রাট এদের পাঠালেও সম্রাটের হর্তাকর্তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলই। এরা তাইপিং বিদ্রোহের জন্যে তাইপিং নেতার পশ্চিমা মিশনারি শিক্ষা, আর তার খ্রীষ্টান সিনক্রেটিক ধর্মকে দোষারোপ করে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাবিদ্বেষী মনোভাব থেকে ইমিগ্রেশনের ওপর কড়াকড়ি হবার কারণেও চায়নিজ এডুকেশন মিশন বন্ধ করার একটা চাপ আসে। ছাত্ররা বেশি বেশি পশ্চিমা ও “বিলাসী” হয়ে যাচ্ছে এমন জজবা তোলা হয়। তবে এদের মধ্যে যারা ফিরে গেছিল, তাদের অনেকেই চীনে পজিটিভ একটা অবদান রাখে। প্রজাতন্ত্রী চীনের একাধিক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনেতা ছিলেন মার্কিনশিক্ষিত। সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে নারীদের পা-বাঁধার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও আমাদের দেশের বিদ্যাসাগরের মত ভূমিকা রাখেন এসকল মার্কিনশিক্ষিত চীনারা।

১৯০৫এ কোরিয়ায় মোতায়েন জাপানী সৈন্য, লক্ষ্য করুন পশ্চিমা পোশাক ও অস্ত্রসজ্জা

জাপান সাগরের অপর পারে কিন্তু চলছিল চিংদের সংস্কারবিমুখতার বিপরীত চিত্র। জাপানীরা খুব দ্রুত পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পাশ্চাত্যদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নইলে তারা ১৮৫০এর দশক নাগাদ চীনের মতই বন্ধ দেশ ছিল। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কম্পানিকেও পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে তারা নিজেদের আখেরটা গুছিয়ে নেয়। খুব দ্রুত একটা রাজনৈতিক ও শিল্পসংস্কার ঘটে যায় সে দেশে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয় জাপান।

পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনে “অধিকার আদায়ের” প্রতিযোগিতায় শামিল হয় জাপানও। নানা ছুঁতোয় কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ হয় জাপানের। সেটা ১৮৯৪/৯৫ সাল। পরাজিত চীন কোরিয়ায় জাপানের অধিকার মেনে নেয়, সাথে আরো কিছু সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।

কাঁচি দিয়ে চীনের মানচিত্র কাটতে উদ্যত জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স। মাঝখানে ওপেন ডোর পলিসির কাগজ হাতে বাগড়া বেঁধে দাঁড়িয়েছে আংকল স্যাম, পাক ম্যাগাজিন, ১৮৯৯

এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবতীর্ণ হয় চীনের অখন্ডতা রক্ষায়। চীনের এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী, রুশ সকলে। ল্য পতি জু্র্নাল নামের ম্যাগাজিনে তখনই সেই কেক কাটার কার্টুন প্রকাশিত হয়। এ সকল পরাশক্তি চীনকে টুকরো টুকরো করে যার যার নিজের “স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স” বানানোর স্বপ্নে গোপনে এক অন্যের সাথে মোলাকাত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার মত বড় একটা ভূখন্ড নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন ডোর পলিসি নিয়ে ব্রিটিশ কার্টুন যে রুশ ভল্লুক ভদ্রভাবে মার্কিন ফ্রী ট্রেড লেডিকে চীনের ওপেন ডোর দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেবে (সার্কাজম অর্থে!), ১৮৯৯ পাঞ্চ ম্যাগাজিন

কিন্তু বাদ সাঁধে মার্কিনরা। তাদের নীতি ছিল “ওপেন ডোর পলিসি।” সে নীতি অনুযায়ী চীনে মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান অধিকার ভোগ করবে। চীনের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অখন্ডতা বজিয়ে থাকবে। বাণিজ্যকর আদায়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিং সরকারের। বাংলায় ব্রিটিশরা যেমন মুঘল সম্রাটকে ঘুষ দিয়ে সে লাভজনক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছিল, সেটি হবে না। অন্যান্য পরাশক্তি মার্কিনদের এই ওপেন ডোর পলিসির সাথে একমত না হলেও নতুন পরাশক্তিটির ভৌগোলিক নিকটতা আর সামরিক শক্তির ভয়ে চুপচাপ সেটা মেনে নেয়। সে যাত্রা বেঁচে যায় চীন।

জাপানের সাথে যুদ্ধে হারার পর আবার একটা বোধোদয় ঘটে চীনের নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ সম্রাট গুয়াংশু রাজ্যের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট দল নিয়ে নতুন করে একটি সংস্কার আন্দোলন দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি! একশ’ দিনের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও সেনানায়করা বিধবা রাণীমাতা সিশিএর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থীদের ক্যুয়ের মাধ্যমে পদচ্যুত করে। অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হন, গুয়াংশু হন প্যালেস প্রিজনার। আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যায় চীন।

চীনের অশীতিপর বৃদ্ধা বিধবা রাণীমাতা সিশি, চীনের সকল আধুনিকায়ন ও সংস্কার রহিত করেন, বক্সারদের উস্কানি দেন, ফলশ্রুতিতে চিং সাম্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে, ১৯০০

প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ আর বিদেশীবিদ্বেষ। শহরে শহরে গড়ে ওঠে কুংফুএর মুগুরভাঁজা “বক্সার” ষন্ডাদের ক্লাব — অনেকটা অনুশীলন সমিতির মত। এবার চিং সাম্রাজ্যের প্রকাশ্য সমর্থন ও সহায়তায় প্রতিটি প্রদেশে এসকল বক্সার মব আক্রমণ করতে থাকে বিদেশী যে কোন কিছু। হোক খ্রীষ্টান মিশন, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল। এ অবস্থায় চিং সম্রাট ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকার কারণে বিদেশী চৌদ্দটি দেশ একসাথে একটি শান্তিরক্ষীবাহিনী পাঠায় চীনে। অনুপ্রবেশের দোহাই দেখিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিশির প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। যেসব সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন সিশি, সেগুলির অভাবেই দ্রুত পরাজিত হয় কুস্তিগীর বক্সার বিপ্লবী আর চিং সেনাদল।

১৯১১ সালের পূর্বের মাঞ্চুরিয়ার মুগুরভাজা বক্সারদের চিত্র
১৮৯৯ সালের বক্সার বিদ্রোহের সময় বক্সার ও চিং সেনাদল পশ্চিমা, সন্দেহজনক পশ্চিমা চর ও খ্রীষ্টানদের ওপর বেধড়ক হত্যাকান্ড চালায়, ধ্বংস হয় তাদের জীবিকা

কিন্তু যে বিদেশী কনসার্নগুলির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বক্সার বিদ্রোহ থেকে হয়, তার পুরো ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে মুক্তি পেলেন না সিশি। চিং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে বিশাল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হতে হল। এ ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। চিং সাম্রাজ্যের বাকি দিন ছিল হাতেগোনা।

বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাকি পরাশক্তিগুলোর থেকে ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করে। বক্সারের ক্ষতিপূরণ থেকে একটা বিশাল অংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। ১৯০৮ সালে কংগ্রেস ঠিক করে যে এ টাকা চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ চিন্তাটি আর কোন পরাশক্তি করেওনি। যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ নামে একটি বিখ্যাত এডুকেশন ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রচুর চীনা ছাত্র আবারও পড়তে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেই পরে প্রজাতন্ত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী কম্যুনিস্ট চীনা মূল ভূখন্ড আর তাইওয়ানে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ড থেকে বেজিংএ একটি প্রযুক্তি কলেজও শুরু হয়, যার নাম ছিংহুয়া। এটি কিন্তু এখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এক নাম্বার বিদ্যাপীঠ।

বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, ১৯০৯ সাল। সামনের সারিতে বসা ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট চৌ জিচি।
বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপের টাকায় প্রতিষ্ঠিত চীনের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছিংহুয়ার বর্তমান চিত্র

ওদিকে ১৯০৫এ রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর আবারও জাপান মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-পূর্ব চীনে রুশদেরকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। তখনো মার্কিনরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কূটনীতির মাধ্যমে চীনের অখন্ডতা নিশ্চিত করে। চীনের চলমান সংস্কারেও মার্কিন সাহায্য আসতে থাকে। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ওপেন ডোর পলিসির প্রতি নতুন করে আস্থা ব্যক্ত করে।

১৯১১ সালের শিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের চিং সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্রী সরকার
চীনা বিপ্লবের পুরোধা সুন ইয়াত সেন, ১৯১০, ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত হাওয়াইয়ে মার্কিন শিক্ষায় শিক্ষিত হন
ইউয়ান শিকাই, চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, ১৯১৫। সুন ইয়াত সেনের পরিবর্তে তাকে আপোষে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে গিয়ে পুরো দেশে বিশৃংখলা অরাজকতার জন্ম দেন এই পুরনো ধাঁচের চিং জেনারেল।

তবে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে যায় চীন। ব্রিটিশদের অনুরোধে জাপান মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কারণ আর কিছুই না। চীনের যে স্বল্প কিছু অংশে জার্মান কলোনি ছিল সেগুলি কব্জা করা। ব্রিটিশরা সেটা মেনে নেয়। কিন্তু জাপানীদের লোভ ছিল আরো বিস্তৃত। একুশ দফা নামে ১৯১৫ সালে তারা একটি আলটিমেটাম দেয়। এর সারবত্তা ছিল চীনের সকল কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক আর প্রশাসনিক দায়িত্ব জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সোজা কথায় চীন পরিণত হবে জাপানীপ্রশাসিত চীনে। যেখানে চীন নামটা ঠিক থাকবে, কিন্তু আসলে পরিচালিত হবে জাপানীদের দ্বারা।

ইউরোপের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা জাপানীদের সুযোগ নিয়ে এমন খাইখাই করাটা একদম সহ্য করেনি। তারা এই আল্টিমেটাম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিনরা উল্টো চীনা সরকারকে বলে দেয় যেকোন মূল্যে জাপানকে রুখতে, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে সমর্থন থাকবে। অবস্থা বেগতিক দেখে জাপানীরা পিছপা হয়। খুব সামান্য অর্জনের বিনিময়ে তারা খোয়ায় ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বিশ্বাসভাজনতা। এ ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঘটনাবলীতে প্রভাব রাখে।

অর্থাৎ এ যাত্রাও চীন বেঁচে যায়। তবে তাদের মূল্যও দিতে হয়। ১৯১৭ সালে সেদেশে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেসব এলাকা স্থানীয় “ওয়ারলর্ডদের” শাসনাধীন হয়। তারা নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নামে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করতে থাকে। এই অবস্থায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে। আর রুশ-জাপানীদের পলিসি ছিল একেক ওয়ারলর্ডকে পয়সা খাইয়ে নয়ত একের বিরুদ্ধে আরককে লড়িয়ে নিজেদের সুবিধা উদ্ধার।

১৯১৯এর ভের্সাই ট্রীটিতেও চীন ব্যর্থ হয় শানদং উপদ্বীপে প্রাক্তন জার্মান, এখন জাপানের শাসনাধীন কলোনি পুনরুদ্ধার করতে। এর জন্য বহু চীনা নাগরিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে দোষারোপ করে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, চীনা সরকার ভের্সাই ট্রীটির আগেই জাপানীদের সাথে আলদা গোপন চুক্তি করে সে দাবি ছেড়ে দেয়ায় উইলসনের আর কিছু করার ছিল না।

১৯২০/৩০এর দশকে শাংহাইয়ে মার্কন ধাঁচের জ্যাজ ব্লুজ সঙ্গীত ছিল জনপ্রিয়। চীনা সঙ্গীতের সাথে মিলে নতুন ধরনের মিশ্র গীতিবাদ্যের জন্ম হয়।

তবে বিশের দশকে কূটনীতির জোরে জাপানের এসকল আগ্রাসী কার্যকলাপকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনসহ অন্যান্য পরাশক্তি। বিশ-ত্রিশের দশক ছিল পাশ্চাত্য আর চীনা প্রগতিশীল নেতৃত্বের সুসম্পর্কের স্বর্ণযুগ। শাংহাই ছিল চীনা জ্যাজ-ব্লুজ সিনক্রেটিজমের ক্যাপিটাল, আর পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। হংকংয়ের সাথে পাল্লা দেবার মত শহর ছিল সেটি।

১৯২৭-২৮ সালের মধ্যে প্রায় পুরো চীনকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় কুওমিনতাং পার্টি। তাদের রাজধানী ছিল নানজিংয়ে। নতুন করে এরা পাশ্চাত্য ও মার্কিনদের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু হয় জাপানের চক্ষুশূল। ১৯৩১ সালে জাপানী সেনাবাহিনীর একদল ষড়যন্ত্র করে মাঞ্চুরিয়াতে মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের ছুঁতোয় চীনের ওপর একতরফা আক্রমণ করে। জাপানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে আসে ব্রিটিশ লর্ড লিটনের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকারী দল। চীনের পক্ষে তাদের রায় গেলে লীগ অফ নেশনস থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে জাপান। এসব ঘটনা টিনটিনের কমিক পাতাতেও এসেছে।

১৯৩৩ সালে লীগ অফ নেশনস থেকে জাপানের ওয়াক আউটের দৃশ্য এভাবে কমিক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন বেলজিয়ান শিল্পী এর্জে।

মাঞ্চুরিয়ায় একতরফা জাপানী দখলদারিত্ব আর প্রাক্তন চীনা সম্রাট পু’য়ীর পুতুল সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মহলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জাপান বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে তাদের অনেক লাভজনক লেনদেন ছিল। জাপানের এমন কট্টরপন্থার পেছনে ছিল তাদের আর্মির এক অতি-জাতীয়তাবাদী ফ্যাকশন, যারা ত্রিশের দশকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়।

১৯৩৭ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে চীনা রাজধানী নানকিংয়ে ব্যাপক জাপানী বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতিতে আহতদের সহায়তায় কিভাবে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মার্কিনরা।

মাঞ্চুরিয়ান ইনসিডেন্টের কপি-পেস্ট ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ ইনসিডেন্ট ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। চীনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা চীনা সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ প্রচেষ্টার আয়োজন করে। বহুর্বিশ্বে জাপানীদের নিষ্ঠুরতাকে হেডলাইনে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। “নানজিংয়ের ধর্ষণের” মত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আন্তর্জাতিক মহলের আর ভাবনার অবকাশ থাকে না যে, সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষুধিত ক্ষমতালিপ্সু জাপানী মিলিটারি হুন্তা কতদূর যেতে পারে। পরবর্তীতে অ্যাটম বোমা ফেলার মত সিদ্ধান্তে এসব ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলে।

জাপানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে চীনের প্রজাতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী সরকার নয় শুধু, মাওজেদংয়ের কম্যুনিস্টদেরও সহায়তা দেয় মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও রুশদের যে লেন্ডলীজ পদ্ধতিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেয়া হয়েছিল, তার শুরু আসলে এই চীনা সহায়তার মধ্য দিয়ে। সামরিক রসদের চালান যেত দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে। ব্রিটিশ কনভয়ে যেত মার্কিন অস্ত্র। জাপানীরা বার্মা দখল করলে সে কাজের দায়িত্ব নেয় ফ্লায়িং টাইগারস নামে ব্রিটিশ ও মার্কিন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক পাইলটদের দল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই চীনের সাথে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অসম চুক্তি রদ করা হয়, সকল ট্রীটি পোর্ট ফিরে যায় চীনের কাছে। শাংহাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল লেগেশনও। যুদ্ধের পর মার্কিন সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘে স্থায়ী আসনটি পায় প্রজাতন্ত্রী চীন।

দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ রসদ যেত জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত চীনা সেনাবাহিনীর কাছে, ১৯৪১
বার্মা জাপানী দখলে চলে যাবার পর দুর্গম পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চীনাদের কাছে রসদ নিয়ে পৌঁছে দিত ফ্লায়িং টাইগার্স নামে এই মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক পাইলটের দল, ১৯৪৩

কম্যুনিস্টদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধেও মধ্যস্থতার একটা ইনিশিয়াল প্রচেষ্টা হয় মার্কিনদের থেকে। কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব আর কোল্ড ওয়ার ডায়নামিক্সের কারণে সেগুলি সাফল্য পায়নি। কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওপেন ডোর পলিসির আর কোন প্রয়োজন থাকে না। বাকি বিশ্ব থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চীনের মূল ভূখন্ড।

কোরিয়ান যুদ্ধে প্রথম চীনা কম্যুনিস্ট লালফৌজ আর মার্কিন সামরিক শক্তি মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া আর কখনো দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি। চীনাদের হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণের বিরুদ্ধে জেনারেল ম্যাকার্থার অ্যাটম বোমা আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামো থামানোর জন্য তাকে পদচ্যুত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান স্বয়ং — জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলার দায় চাপানো হয় যার ওপর।

সত্তর দশকে চীন-সোভিয়েত শত্রুতা চরমে উঠলে তার সুবিধাটা বাগিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক মানবিক অবস্থানটি ভেতরে ভেতরে থাকলেও নিক্সন প্রশাসন গোপনে চীনের সাথে চ্যানেল তৈরি করে ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যস্থতায়। সে কারণে সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা তারা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান ছিল খোলাখুলিরকম স্বাধীনতাবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা ছিল না।

চীন-মার্কিন এই দেতঁতের কারণেই কম্যুনিস্ট চীন জাতিসংঘে প্রজাতন্ত্রী চীনের স্থায়ী আসনটি পায়। নইলে সে ভোটটি ছিল তাইওয়ানের হাতে। সেই ওপেন ডোর পলিসির উত্তরাধিকার ধরেই তাইওয়ানকে এখনও অখন্ড চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের কোন দূতাবাস ও অফিশাল কূটনৈতিক মিশন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। আছে কেবল কালচারাল মিশন।

সারমর্মে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের নাম ধরে যে মড়াকান্নাটা চীনারা এখনো দেয়, সে সেঞ্চুরিটি আরো খারাপ হতে পারত তাদের জন্য। বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ শুধু দেখতে পেয়েছে তা নয়। ১৮৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত প্রাক্তন স্পেনীয় কলোনিগুলিকে হস্তগত করে নিজেদের একটা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বানানোর অবস্থানে ছিল। অন্যান্য পরাশক্তির সাথে যোগসাজশে চীনকেও কেটেছিঁড়ে খাবার একটা সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। সেটা ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকে ওরিয়েন্টাল সভ্যতা বিশেষত চীনা সভ্যতার ব্যাপারে মার্কিনদের একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। রোমান বা গ্রীক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণের থেকে সেটা কম ছিল না। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই চীনা সভ্যতার প্রশংসা করে গেছেন। এ সম্মানটার কারণেই চীন প্রচুর সহমর্মিতা সমবেদনা আর সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়।

বর্তমান যুগের চীনা-মার্কিন শত্রুতার নেপথ্যে চীনা সংস্কৃতি-সভ্যতা বাঁধা নয়। বাঁধা কম্যুনিজম, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চীনা সম্প্রসারণবাদ ও বাণিজ্যে অসম সুবিধাভোগ। যদি চীনে কোন এক স্বপ্নের যুগে সিসিপি’র বিনাশ ঘটে, যুক্তরাষ্ট্র আর সে দেশটি নিঃসন্দেহে বন্ধুতার বহু প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!