বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৪

বিটকয়েনের দেখাদেখি এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে চালু হয়েছে। তার মধ্যে বিটকয়েনের পরেই বাজারমূল্যের হিসাবে উপরে আছে রিপল, ইথারিয়াম, বিটকয়েন ক্যাশ, কারডানো আর লাইটকয়েন। এদের সম্পূর্ণ বাজারদর বলা হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি ডলারের উপরে! মনে রাখবেন, মানুষ এগুলোকে টাকা দিয়ে কিনছে বলেই এদের দাম আছে, নাহলে তারা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র! সবগুলি যে একইরকম তাও নয়, প্রত্যেকটির বিশেষ বিশেষ গুণাগুণ আছে, যেমন ইথারিয়ামকে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আসল টাকার প্লেসহোল্ডার হিসাবে ব্যবহার করছে, তার কিছু সুবিধার কারণে। কিন্তু বাজারে প্রচলিত বেশির ভাগ ক্রিপটোকারেন্সিই ‘প্লেইন ভ্যানিলা’ ওপেন সোর্সের উপর তৈরি, আর যে কেউই নতুন একটা বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহুল প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে সেটা কিনতে আগ্রহী করে তুলতে পারে, আর সে সুযোগে বিশাল অংকের টাকা অনবহিত ক্রেতার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য একারণে নতুন নীতি এসেছে এক্সচেঞ্জগুলির জবাবদিহিতার জন্যে। অপরদিকে চীনে এক্সচেঞ্জ এবং মাইনিং এখন নিষিদ্ধ।

এসব নানা নিয়মনীতির ভয়ে এখন ক্রিপটোকারেন্সিগুলি একটু দামে কম। যদি আপনি বিনিয়োগের চিন্তা করে থাকেন, তাহলে এখন ভাল সময়। কিন্তু আমি সে উপদেশ দেব না। ফটকাবাজি বা স্পেক্যুলেশনের কারণে বিটকয়েন আর অন্যান্য কারেন্সির দাম অনেক উঠা-নামা করে, আর সেটা করে সকলে একসাথেই কোরিলেটেড-ভাবে, অর্থাৎ সত্যিকারের ডাইভার্সিফিকেশনের অভাব। ওয়ালস্ট্রীটের বড় বড় ফার্মও এ ব্যবসায় নেমেছে। তাদের পকেট অনেক গভীর, আর কম্প্যুটার অ্যালগরিদমের সহায়তায় হাই ফ্রিকুয়েন্সি ট্রেডিং করে তারা এদের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাঝখান থেকে পকেট কাটা পড়বে আপনার-আমার মত চুনোপুঁটির। অনেকে বলছে সীমিত সাপ্লাইয়ের কারণে এগুলোর দাম এমনিতেই স্বর্ণের মত ঊর্ধ্বমুখী হবে। আমার প্রশ্ন, সোনার গয়নাও তো মানুষ হাতে-গলায় পড়ে পার্টিতে যেতে পারে, বিটকয়েনের ব্যবহারটা কি, সার্টিফিকেট বানিয়ে বাঁধিয়ে রাখবেন? (খেয়াল করুন, ব্লকচেইন টেকনোলজির গুষ্টি উদ্ধার করছি না! ৫ম পর্ব দ্রষ্টব্য।) স্টক মার্কেটের কম্পানিগুলির তো লাভ না থাকলেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, আছে ভবিষ্যত লাভের সম্ভাবনা, টেসলার কথাই ধরুন – বিপুল ক্ষতিতে বহুদিন থাকার পরে এখন লাভ করা শুরু করেছে। সেসব ছেড়ে কেন বিটকয়েনে জুয়া খেলা?

কম্প্যুটার প্রোগ্রামারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও আমি বলবো যে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক আর ওপেন সোর্স মডেলে টাকাপয়সা লেনদেন করার সমস্যা আছে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারে বাগ থাকে অনেক, সেগুলি ঠিকঠাক করে আর কোড মেইনটেইন করে ভলান্টিয়াররা। যদি সেসব দুর্বলতার কারণে কারো কোটি টাকা মার যায়, তাহলে তাকে টাকা ফেরত দিবে কে? ব্যাংকের টাকা মার গেলেও তো বীমার কারণে সেটা ফেরত পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগোষ্ঠীর দরকার অবশ্যই আছে, কারণ তাদের জবাবদিহিতা করতে হয়! জনগণের অর্থলেনদেনব্যবস্থা যদি বিটকয়েন হয়, তাহলে তার এদিক-সেদিক হবার জবাবদিহিতা করবে কে? তার ওপর, আপনার প্রাইভেট কী গোপন থাকলেও আপনার কম্প্যুটার হ্যাক করে যে কেউ সেটা বেহাত করে নিয়ে টাকাপয়সা সরিয়ে নিবে না, তার কি নিশ্চয়তা? এভাবে তো ইতিমধ্যেই কয়েকটা এক্সচেঞ্জে হ্যাকাররা আক্রমণ করে পয়সা গায়েব করে ফেলেছে।

আপনি যদি ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারক-বাহক হন আর সে কারণে বিটকয়েন ব্যবহার করেন, তাহলে নগদ ব্যবহার করতে সমস্যা কোথায়? এটিএম থেকে টাকা তুলে আপনি গাঁজা-হেরোইন-পর্ন যা খুশি কিনুন, দেখতে আসছে কে? আর আপনি যদি রকেট লঞ্চার একখান কিনতে চান, তাহলে তো অবশ্যই সেটা সরকারের নাক গলানোর মত বিষয়! আর বিটকয়েন দিয়ে লেনদেন করে যে পার পাওয়া সম্ভব নয়, এফবিআই কর্তৃক উলব্রিখ্টের পরিচয় উদ্ঘাটন তার বড় প্রমাণ। তাছাড়া, যত দিন যাবে, বিটকয়েন মাইনিংয়ের পুরস্কার তত কমবে, অর্থাৎ লাভজনকভাবে মাইনিং করতে পারবে কেবল সেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান যারা একসাথে অনেকগুলি কম্প্যুটার নিয়ে সর্বাধিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। তারাই তখন হবে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক আর চাইলে ব্লকচেইনের হিসাবে গরমিল করতে পারবে। অর্থাৎ ‘ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান’, সেই সেন্ট্রাল ব্যাংকের মনোপোলি আর ডলার-ইউরোর কারবার (অথবা তার থেকেও খারাপ)!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আর অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও বিটকয়েনজাতীয় মুদ্রার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশাল অর্থনীতির মুদ্রা হিসাবে বিটকয়েন কতটুকু সফল হতে পারে? খুব একটা নয়! প্রথমত, সাপ্লাই সীমিত থাকার অর্থ এই কারেন্সি ডিফ্লেশনারি। অথচ, আধুনিক সব কারেন্সি উচিত কারণে ইনফ্লেশনারি, প্রথম পর্বে বলেছি। যত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তত সম্পদের সাথে সাথে কয়েনের সংখ্যা না বাড়লে প্রতিটা বিটকয়েনের ক্রয়ক্ষমতা হবে অত্যধিক। তখন মানুষ সেটা লেপের নিচে পোরা শুরু করবে, সেটা এখনই হচ্ছে, যাকে কয়েনপ্রেমীরা বলে HODLing। তো, যে লেনদেনের কাজের জন্য বিটকয়েনের উদ্ভব, সে কাজ না করে যদি তা হয়ে যায় সংগ্রহবস্তু, তাহলে কারেন্সি হলো কিভাবে?

দ্বিতীয়ত, আস্থা! যেকোন মুদ্রার বেলায় এটা সবচে’ জরুরী। কিন্তু বিটকয়েন নিয়ে মানুষ এক্সচেঞ্জে কেনাবেচায় এতই পাগল যে আজ বিটকয়েনের দাম ১৭,০০০ ডলার তো কাল ৭,০০০। কিভাবে এ মুদ্রা ক্রয়ক্ষমতার আধার হয়? লোকে বলছে মানুষ যত একে লেনদেনে ব্যবহার করবে তত তার মূল্য স্থিতিশীল হবে। মানুষ কি আসলেই বিটকয়েন লেনদেনে ব্যবহার করছে, নাকি লেপের নিচে ভরছে?

তৃতীয়ত, যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন না কোন সময় ধ্বস নামে, নানাকারণেই। সবসময় যে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষ দেয়া যায়, তা না। তখন যদি মুদ্রার সাপ্লাই বাড়িয়ে-কমিয়ে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে অর্থনীতি পাগলা ঘোড়ার মত একদিকে ছুটবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে আপনি ফীডব্যাক ব্যাপারটা বুঝবেন। ফীডব্যাকের অবশ্যই দরকার আছে, মুক্তবাজারের সরকার-কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু আপৎকালেই হস্তক্ষেপ করে বলে সবসময় আমাদের অবস্থা জিম্বাবুয়ে-ভেনেজুয়েলার মত দাঁড়ায় না। সে হিসাবে আমি বলবো ২০০৮এ ফেডারেল রিজার্ভ আর ইসিবির নামী অর্থনীতিবিদরা ডলার-ইউরো প্রিন্ট করে বিশ্বের অর্থনীতিকে রক্ষাই করেছেন, এখন স্থিতিশীলতার পরে সে ডলারগুলো (বা সমকক্ষ বন্ড) আবার বাজার থেকে তুলে নিয়ে ‘ধ্বংস’ করে ফেলা হচ্ছে। বিটকয়েনের ব্যবস্থায় তো কম্প্যুটার অ্যালগরিদম বানায় নতুন পয়সা। সে তো নিয়মে বাঁধা, সে কীভাবে বুঝবে কখন কি ফীডব্যাক দেয়া দরকার?

সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!