পেপার ট্রেইল

“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।

অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

চীনের তাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।

মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।

সিল্ক রোডের ভারতীয়, পারসিক, চীনা অংশ

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।

সিল্ক রোডের অন্যতম স্থলবন্দর চীনের দুনহুয়াংএর গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে দেয়ালচিত্র। এখানে ভারতীয় প্রভাবে আঁকা বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী চিত্রিত।
বানর রাজা সুন উখোং, সম্ভবত চরিত্রটি ভারতের হনুমানজির অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট

তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।

নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।

আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।

সিল্ক রোডের পশ্চিম চীন প্রান্তের তুরপান শহরের প্রাচীন ভবন। তাকলা মাকান মরুভূমি পেরিয়ে চীনা তুর্কীস্তান কিংবা শিনজিয়াংএ এসে এই মরুদ্যান শহরে পৌঁছত সওদাগরি কাফেলা।

চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।

পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।

৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।

আব্বাসী খেলাফতের মানচিত্র

৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।

তিব্বতী সাম্রাজ্য, ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ
বর্তমান কাজাখস্তানে অবস্থিত তালাস নদী

তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।

আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।

তালাসের যুদ্ধ, ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ

অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।

তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।

মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।

চীনা ‘চান’ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম নিদর্শন ‘হাস্যরত বুদ্ধ’। আসলে ইনি লোককাহিনীতে বর্ণিত এক চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মে এরকম কিছু নেই। অর্থাৎ চীনা বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে স্বতন্ত্র।

এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।

চীনের ফাং মাতানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন, আনুমানিক দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ।

তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।

১১৮০তে পূর্ব ইরানে কাগজে তৈরি কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক ফোলিও (নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়াম)
ডানে একাদশ শতকের চীনা সং রাজবংশের সময়কালীন কাগজে আঁকা ক্যালিগ্রাফি (তাইওয়ানের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম)

একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৫ (শেষ)

আমি চতুর্থ পর্বে ব্যাখ্যা করেছি কেন আমি বিটকয়েনের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান, আবার প্রথম পর্বে বলেছি আমার কিছু টাকা এসবে আছে। এটা পরস্পরবিরোধী নয়। ইনভেস্টমেন্টে সব সময় অপরচুনিটি কস্ট বলে একটা জিনিস চিন্তা করতে হয়। লাখে একটা লটারি লাগলেও সেটা কারো না কারো লাগে। ধরুন লটারিই কিনেছি, ভবিষ্যতে দশগুণ হলে মনে মনে আক্ষেপ থাকবে না যে অপরচুনিটিটা নিইনি। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা সবসময় মনে রাখবেন সাফল্যের মূলমন্ত্র ডাইভার্সিফিকেশন, পরস্পরবিরোধী জিনিসে টাকা রাখলে সব মিলিয়ে লাভই হবে, যদি না অর্থনৈতিক মন্দার সময় হয়।

যারা টেকি টাইপের মানুষ, নতুন টেকনোলজি দেখলে উত্তেজিত হয়ে যান, তা হোন। কিন্তু দশপা পিছনে গিয়ে ভাল করে পুরো চিত্রটা একবার দেখবেন। সব টেকনোলজি সময়মত আসে না আর সবকিছুই ভাল বাজার পায় না। আইপ্যাডের পূর্বসুরী একটা প্রোটোটাইপ বোধহয় মটোরোলা আশির দশকে বানিয়েছিল, কিন্তু তখন মার্কেট রিসার্চে তার লাভজনকতা কেউ দেখেনি। ফাইন্যান্সিয়াল ইনডিকেটরগুলি সম্পর্কে ভাল করে জানবেন, কাজে দিবে। টেকিদের জন্য এসব বোঝা কঠিন নয়।

বিটকয়েনজাতীয় মুদ্রাকে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চীনের মত ব্যান করবে না, এটা আমি লিখে দিতে পারি। কিন্তু তারা স্পেক্যুলেশন আর মানি লন্ডারিংয়ের যথাযোগ্য প্রতিষেধক না পেলে তাকে সরকারি নিয়মনীতি ছাড়াই যেভাবে পারে আটকাবে। যেমন অনেক ক্রেডিট কার্ড কম্পানি বলেছে তারা কয়েন কেনার ট্রানজ্যাকশন অনুমোদন করবে না। ফেডারেল সরকার না করলেও অনেক স্টেট সরকার তাদের নাগরিকদের জালিয়াতি থেকে রক্ষার জন্য নতুন আইনকানুন প্রণয়ন করছে। গুগল-ফেসবুক-টুইটারও বলেছে তারা কয়েনওয়ালাদের অ্যাড তাদের সাইটে দেখাবে না। অথচ এদের মাধ্যমেই কয়েনওয়ালারা তাদের অধিকাংশ ক্রেতা খুঁজে পায়।

মানি লন্ডারিং সবচে’ বড় ভয়ের কারণ, যেহেতু বিটকয়েনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীরা বিদেশে তাদের তহবিল যেমন সংগ্রহ করতে পারে, তেমন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের লুক্কায়িত সদস্যদেরও টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করতে পারে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিটকয়েনের ভবিষ্যত অন্ধকার। এদেশের মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা ভালবাসলেও এখনকার যুগে নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তার ওপর আবার রাশিয়া বিটকয়েনের মাধ্যমে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করেছে, সেরকমটা খবর বেরুলেও আমি অবাক হব না। শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, কর্পোরেট এস্পিওনাজের উদ্দেশ্যে হ্যাককরা ইমেল বা ডকুমেন্টও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া দৈনন্দিন ব্যাপার।

এসব নানাকারণে বিটকয়েনে মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারাবে এবং আগামী অর্থনৈতিক মন্দার সময় পুরোপুরি নেই হয়ে যাবে, এরকমটা আমার ধারণা। এর আগেও ডিজিটাল টোকেনের ব্যবসাকারী বেশ কিছু কম্পানি ডটকম বাবল বাস্টের সময়ে পটল তুলেছিল। সে মন্দাটা কবে হবে তা বলতে পারি না। কোন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদও বলতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও হডলাররা একে ধরে বসে থাকবে ভবিষ্যত লাভের আশায়! (আবার বলছি, আমার ধারণা ভুল হয়ে এর দশগুণ মূল্যবৃদ্ধি হলেই আমার লাভ!)

বিটকয়েন বিলুপ্ত হলেও দুটো জিনিস থাকবে। এক, ব্লকচেইন টেকনোলজি, আর দুই, একটা সত্যিকারের বৈশ্বিক মুদ্রার সম্ভাবনা। ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক আছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের সেরা ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেরা গবেষণা করে বের করছে কিভাবে একে তাদের বর্তমান ব্যবস্থার সাথে একীভূত করে মক্কেলদের লেনদেনকে ত্বরান্বিত করা যায়। তারা এসব ব্যাপারে সরাসরি কাজ করছে আইবিএমের মত নামী টেক কম্পানিগুলির সাথে। এরা ওপেন সোর্সওয়ালাদের মত অ্যামেচার নয়। আমার ধারণা এদের নতুন প্রযুক্তিরই বিস্তার হবে তাড়াতাড়ি আর সাধারণ মানুষ বিটকয়েনের অনেক সুবিধা এদের মাধ্যমে পাবে, অধিকাংশ ক্ষতিকর দিকগুলি বাদ দিয়ে। সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামধারী বেনামী প্রোগ্রামারদের থেকে এসব নামঠিকানাধারী বড় কম্পানিকেই আমি আপাতত বিশ্বাস করি একটু বেশি। আর বিশ্বাস ভাঙ্গলে জাকারবার্গের মত সোজা ওয়াশিংটনে বুড়োবুড়ি সিনেটরদের আখড়ায় হাজিরা! (ওয়েলস-ফারগোও গুগলিয়ে দেখুন।)

ব্যাংকিং ছাড়াও অন্যান্য অনেক খাতে ব্লকচেইনের ব্যবহার বাড়বে। যেমন মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলি রোগীর স্বাস্থ্যতথ্য নিরাপদভাবে রাখতে এবং শেয়ার করতে পারবে রোগী আর তার অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে। স্টক ব্রোকার আর ইনশুরেন্স কম্পানিরাও এর থেকে লাভবান হতে পারে। বাড়ির মর্টগেজ আর অন্যান্য ধারের কাজও আগের থেকে দ্রুত সম্ভব হতে পারে। এগুলি সবই ধীরে ধীরে চলে আসতে দেখবেন। কিন্তু সাধারণ এনক্রিপশন টেকনোলজির সাথে ব্লকচেইনকে মেলাবেন না। ইন্টারনেটে নানা রকম কম্পানি আছে যারা নামে ‘ব্লকচেইন’ শব্দটা লাগিয়ে ইনভেস্টরদের ধোঁকা দিচ্ছে। দুটো টেকনোলজির তফাতও ভাল করে বুঝবেন। এনক্রিপশন কোন নতুন কিছু নয়।

শেষপর্যন্ত বলি, সীমানাবিহীন, সমান-সুযোগের একটা মুক্ত বিশ্ব অনেক মানুষের আকাঙ্ক্ষা। হয়ত সেরকম সীমানাবিহীন একটা মুদ্রাব্যবস্থা তার আগে এসে পৃথিবীর মানুষকে তার জন্যে প্রস্তুত করবে। বিটকয়েন দিয়ে তার কিছুটা আস্বাদন যখন মানুষ করতে পেরেছে, তখন এ ব্যাপারটা নিয়ে অনেকেই আরো গভীর চিন্তা করবে, এখনকার ক্রিপটোকারেন্সিগুলির সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করবে। হয়ত ক্রিপটোকারেন্সি ২.০ আমাদেরকে সেই ইউটোপিয়ার দিকে একঘর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজ না হলেও হয়ত বছর কুড়ি পরে। বিটকয়েনের দশগুণ দরবৃদ্ধি নয়, আমি সেই ইউটোপিয়ান আশাতেই থাকলাম!

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ৪

বিটকয়েনের দেখাদেখি এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মত ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে চালু হয়েছে। তার মধ্যে বিটকয়েনের পরেই বাজারমূল্যের হিসাবে উপরে আছে রিপল, ইথারিয়াম, বিটকয়েন ক্যাশ, কারডানো আর লাইটকয়েন। এদের সম্পূর্ণ বাজারদর বলা হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি ডলারের উপরে! মনে রাখবেন, মানুষ এগুলোকে টাকা দিয়ে কিনছে বলেই এদের দাম আছে, নাহলে তারা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র! সবগুলি যে একইরকম তাও নয়, প্রত্যেকটির বিশেষ বিশেষ গুণাগুণ আছে, যেমন ইথারিয়ামকে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আসল টাকার প্লেসহোল্ডার হিসাবে ব্যবহার করছে, তার কিছু সুবিধার কারণে। কিন্তু বাজারে প্রচলিত বেশির ভাগ ক্রিপটোকারেন্সিই ‘প্লেইন ভ্যানিলা’ ওপেন সোর্সের উপর তৈরি, আর যে কেউই নতুন একটা বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহুল প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে সেটা কিনতে আগ্রহী করে তুলতে পারে, আর সে সুযোগে বিশাল অংকের টাকা অনবহিত ক্রেতার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য একারণে নতুন নীতি এসেছে এক্সচেঞ্জগুলির জবাবদিহিতার জন্যে। অপরদিকে চীনে এক্সচেঞ্জ এবং মাইনিং এখন নিষিদ্ধ।

এসব নানা নিয়মনীতির ভয়ে এখন ক্রিপটোকারেন্সিগুলি একটু দামে কম। যদি আপনি বিনিয়োগের চিন্তা করে থাকেন, তাহলে এখন ভাল সময়। কিন্তু আমি সে উপদেশ দেব না। ফটকাবাজি বা স্পেক্যুলেশনের কারণে বিটকয়েন আর অন্যান্য কারেন্সির দাম অনেক উঠা-নামা করে, আর সেটা করে সকলে একসাথেই কোরিলেটেড-ভাবে, অর্থাৎ সত্যিকারের ডাইভার্সিফিকেশনের অভাব। ওয়ালস্ট্রীটের বড় বড় ফার্মও এ ব্যবসায় নেমেছে। তাদের পকেট অনেক গভীর, আর কম্প্যুটার অ্যালগরিদমের সহায়তায় হাই ফ্রিকুয়েন্সি ট্রেডিং করে তারা এদের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাঝখান থেকে পকেট কাটা পড়বে আপনার-আমার মত চুনোপুঁটির। অনেকে বলছে সীমিত সাপ্লাইয়ের কারণে এগুলোর দাম এমনিতেই স্বর্ণের মত ঊর্ধ্বমুখী হবে। আমার প্রশ্ন, সোনার গয়নাও তো মানুষ হাতে-গলায় পড়ে পার্টিতে যেতে পারে, বিটকয়েনের ব্যবহারটা কি, সার্টিফিকেট বানিয়ে বাঁধিয়ে রাখবেন? (খেয়াল করুন, ব্লকচেইন টেকনোলজির গুষ্টি উদ্ধার করছি না! ৫ম পর্ব দ্রষ্টব্য।) স্টক মার্কেটের কম্পানিগুলির তো লাভ না থাকলেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, আছে ভবিষ্যত লাভের সম্ভাবনা, টেসলার কথাই ধরুন – বিপুল ক্ষতিতে বহুদিন থাকার পরে এখন লাভ করা শুরু করেছে। সেসব ছেড়ে কেন বিটকয়েনে জুয়া খেলা?

কম্প্যুটার প্রোগ্রামারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও আমি বলবো যে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক আর ওপেন সোর্স মডেলে টাকাপয়সা লেনদেন করার সমস্যা আছে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারে বাগ থাকে অনেক, সেগুলি ঠিকঠাক করে আর কোড মেইনটেইন করে ভলান্টিয়াররা। যদি সেসব দুর্বলতার কারণে কারো কোটি টাকা মার যায়, তাহলে তাকে টাকা ফেরত দিবে কে? ব্যাংকের টাকা মার গেলেও তো বীমার কারণে সেটা ফেরত পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগোষ্ঠীর দরকার অবশ্যই আছে, কারণ তাদের জবাবদিহিতা করতে হয়! জনগণের অর্থলেনদেনব্যবস্থা যদি বিটকয়েন হয়, তাহলে তার এদিক-সেদিক হবার জবাবদিহিতা করবে কে? তার ওপর, আপনার প্রাইভেট কী গোপন থাকলেও আপনার কম্প্যুটার হ্যাক করে যে কেউ সেটা বেহাত করে নিয়ে টাকাপয়সা সরিয়ে নিবে না, তার কি নিশ্চয়তা? এভাবে তো ইতিমধ্যেই কয়েকটা এক্সচেঞ্জে হ্যাকাররা আক্রমণ করে পয়সা গায়েব করে ফেলেছে।

আপনি যদি ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারক-বাহক হন আর সে কারণে বিটকয়েন ব্যবহার করেন, তাহলে নগদ ব্যবহার করতে সমস্যা কোথায়? এটিএম থেকে টাকা তুলে আপনি গাঁজা-হেরোইন-পর্ন যা খুশি কিনুন, দেখতে আসছে কে? আর আপনি যদি রকেট লঞ্চার একখান কিনতে চান, তাহলে তো অবশ্যই সেটা সরকারের নাক গলানোর মত বিষয়! আর বিটকয়েন দিয়ে লেনদেন করে যে পার পাওয়া সম্ভব নয়, এফবিআই কর্তৃক উলব্রিখ্টের পরিচয় উদ্ঘাটন তার বড় প্রমাণ। তাছাড়া, যত দিন যাবে, বিটকয়েন মাইনিংয়ের পুরস্কার তত কমবে, অর্থাৎ লাভজনকভাবে মাইনিং করতে পারবে কেবল সেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান যারা একসাথে অনেকগুলি কম্প্যুটার নিয়ে সর্বাধিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। তারাই তখন হবে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক আর চাইলে ব্লকচেইনের হিসাবে গরমিল করতে পারবে। অর্থাৎ ‘ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান’, সেই সেন্ট্রাল ব্যাংকের মনোপোলি আর ডলার-ইউরোর কারবার (অথবা তার থেকেও খারাপ)!

আর অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেও বিটকয়েনজাতীয় মুদ্রার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশাল অর্থনীতির মুদ্রা হিসাবে বিটকয়েন কতটুকু সফল হতে পারে? খুব একটা নয়! প্রথমত, সাপ্লাই সীমিত থাকার অর্থ এই কারেন্সি ডিফ্লেশনারি। অথচ, আধুনিক সব কারেন্সি উচিত কারণে ইনফ্লেশনারি, প্রথম পর্বে বলেছি। যত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তত সম্পদের সাথে সাথে কয়েনের সংখ্যা না বাড়লে প্রতিটা বিটকয়েনের ক্রয়ক্ষমতা হবে অত্যধিক। তখন মানুষ সেটা লেপের নিচে পোরা শুরু করবে, সেটা এখনই হচ্ছে, যাকে কয়েনপ্রেমীরা বলে HODLing। তো, যে লেনদেনের কাজের জন্য বিটকয়েনের উদ্ভব, সে কাজ না করে যদি তা হয়ে যায় সংগ্রহবস্তু, তাহলে কারেন্সি হলো কিভাবে?

দ্বিতীয়ত, আস্থা! যেকোন মুদ্রার বেলায় এটা সবচে’ জরুরী। কিন্তু বিটকয়েন নিয়ে মানুষ এক্সচেঞ্জে কেনাবেচায় এতই পাগল যে আজ বিটকয়েনের দাম ১৭,০০০ ডলার তো কাল ৭,০০০। কিভাবে এ মুদ্রা ক্রয়ক্ষমতার আধার হয়? লোকে বলছে মানুষ যত একে লেনদেনে ব্যবহার করবে তত তার মূল্য স্থিতিশীল হবে। মানুষ কি আসলেই বিটকয়েন লেনদেনে ব্যবহার করছে, নাকি লেপের নিচে ভরছে?

তৃতীয়ত, যেকোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন না কোন সময় ধ্বস নামে, নানাকারণেই। সবসময় যে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষ দেয়া যায়, তা না। তখন যদি মুদ্রার সাপ্লাই বাড়িয়ে-কমিয়ে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে অর্থনীতি পাগলা ঘোড়ার মত একদিকে ছুটবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে আপনি ফীডব্যাক ব্যাপারটা বুঝবেন। ফীডব্যাকের অবশ্যই দরকার আছে, মুক্তবাজারের সরকার-কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু আপৎকালেই হস্তক্ষেপ করে বলে সবসময় আমাদের অবস্থা জিম্বাবুয়ে-ভেনেজুয়েলার মত দাঁড়ায় না। সে হিসাবে আমি বলবো ২০০৮এ ফেডারেল রিজার্ভ আর ইসিবির নামী অর্থনীতিবিদরা ডলার-ইউরো প্রিন্ট করে বিশ্বের অর্থনীতিকে রক্ষাই করেছেন, এখন স্থিতিশীলতার পরে সে ডলারগুলো (বা সমকক্ষ বন্ড) আবার বাজার থেকে তুলে নিয়ে ‘ধ্বংস’ করে ফেলা হচ্ছে। বিটকয়েনের ব্যবস্থায় তো কম্প্যুটার অ্যালগরিদম বানায় নতুন পয়সা। সে তো নিয়মে বাঁধা, সে কীভাবে বুঝবে কখন কি ফীডব্যাক দেয়া দরকার?

সকল পর্বের লিংকঃ

বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ২

বিটকয়েনের অসাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হল এই মুদ্রা একই নামের একটা ‘পিয়ার-টু-পিয়ার’ পেমেন্ট নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত, এমনকি এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আরো নতুন মুদ্রা তৈরি হয়, স্রেফ হাওয়ার থেকে! ডলার-ইউরোও অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকরা এরকম ‘ম্যাজিক’ করেই তৈরি করে।

বিটকয়েন নেটওয়ার্কের কাজ হল ‘দবিরের কাছে সগিরকে দেয়ার মত দশটাকা আছে কিনা, আর সে যে আবার জমিরকে একইসাথে সেই একই দশটাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠগবাজি করছে না’ তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ এটাকে গণিতের একটা সমস্যা হিসাবে সংগঠিত করে তার সমাধান বের করা। গণিতের এই ধাঁধা তৈরির পেছনে আছে ক্রিপটোগ্রাফি বলে একটা বিষয়, যার কারবার হলো প্রাইভেট কী আর পাবলিক কী বলে দু’টো সংখ্যা নিয়ে চালাচালি করা, বা এনক্রিপশন-ডিক্রিপশন। এই এনক্রিপশন টেকনোলজি প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো।

ধরুন, আপনি — দবির — সগিরের কাছে বিটকয়েন পাঠাবেন। সেজন্য আপনাকে উল্লেখ করতে হবে সগিরের পাবলিক কী, অর্থাৎ তার সাংখ্যিক পরিচয়, প্রাপ্য টাকার পরিমাণ, আর সগির যখন হবে প্রেরক তখন কি শর্ত অনুযায়ী প্রমাণিত হবে যে সে একই অংকের টাকা অন্য কাউকে পাঠানোর অধিকার রাখে।

সগির যখন জমিরকে টাকা পাঠানোর জন্য নতুন একটি লেনদেনের সূচনা করবে, তখন বিটকয়েন নেটওয়ার্ক তন্নতন্ন করে সগিরের আগের সব লেনদেনের হিসাব খুঁজে দেখে তার পাবলিক কী দিয়ে পরিচয় মেলাবে। তারপর যদি সে ঐ পরিমাণ অর্থ খরচের অধিকার রাখে বলে নির্ধারিত হয়, তখন সগিরকে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করতে হবে যে তার কাছে সেই পাবলিক কী-এর যমজ প্রাইভেট কী আছে কিনা, যেটা কেবলমাত্র সেই জানে। এ প্রমাণ দেখানোর জন্য সগিরের প্রাইভেট কী নেটওয়ার্কে প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই, তার দেখানো ‘পরোক্ষ প্রমাণ’ই যথেষ্ট, আর সে প্রমাণ থেকে উল্টো হিসাব করে তার গোপন প্রাইভেট কী বের করা অসম্ভব।

হাতে-কলমে এ জটিল হিসাব কষা যেনতেন কাজ নয়। সে জন্য আছে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের লাখো লাখো কম্প্যুটার। দুনিয়ার সব জায়গায় এসব কম্প্যুটার ছড়িয়ে আছে, আপনিও চাইলে আপনার কম্প্যুটারে বিটকয়েনের সফটওয়্যার চালিয়ে এতে অংশ নিতে পারেন। একেই বলে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের কম্প্যুটারগুলি সবসময় একসাথে কয়েকটা বৈধ লেনদেনের সমন্বয়ে তৈরি কোন না কোন ‘ব্লকের’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে। তাদের কাজ হলো এমন একটা সংখ্যা খুঁজে বের করা, যেটা ব্লকে যোগ করলে ব্লক একটা বিশেষ গাণিতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। যে এই সমাধান সবার আগে বের করবে, সে বাকিদের সেটা জানান দিবে, আর তারা সেটা যাচাই করে দেখবে। যাচাইয়ে পাশ হলে এই ব্লকটি আগের ব্লকের শেষে গিয়ে যুক্ত হবে আর নেটওয়ার্কের সবাই তাদের লেনদেনের পুরো হিসাব হালনাগাদ করে নিবে। এই পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ব্লক দিয়ে তৈরি ডিজিটাল হিসাবখাতাকে বলে ব্লকচেইন।

যে কম্প্যুটারটা সফলভাবে একটা ব্লক ‘ক্লোজ’ করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের পারিশ্রমিকস্বরূপ নতুন তৈরি বিটকয়েন, যেটা ‘বায়বীয়’(!) উপায়ে হিসাবখাতার মধ্যে যোগ করে ফেলা হয়। এটি হচ্ছে এই ‘মাইনার’ কম্প্যুটারের কাজের প্রমাণ। বিটকয়েনের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই, সেটা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র। গাণিতিক যে সমস্যাটি মাইনারদের সমাধান করতে হয়, তার জটিলতাও বিটকয়েনের কোডে এমনভাবে পরিবর্তিত হয়, যেন গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক ক্লোজ় করা যায়। ব্লক ক্লোজ় করল যে, তার পুরস্কার চার বছর পর পর অর্ধেক হয়ে যায়, এখন সেটা প্রতি ব্লকে সাড়ে বারো বিটকয়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকশ’ কম্প্যুটার মিলে একসাথে একটা ব্লক ক্লোজ় করার চেষ্টা করে, আর তাতে সফল হলে পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেয়। এ ধরনের সমন্বয়কারী মাইনারদের গোষ্ঠীকে বলে ‘মাইনিং পুল’। যেভাবেই মাইন করা হোক না কেন, সর্বমোট ২.১ কোটি বিটকয়েনের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়, আর প্রায় ১.৭ কোটি ইতিমধ্যেই মাইন করা হয়ে গেছে।

কতটুকু বোঝাতে পারলাম জানি না। হয়ত আপনার কাছে মনে হচ্ছে এ এক মনোপোলি বোর্ড গেম! অনেকটা তাই-ই! কিন্তু অনেকগুলো সুবিধা পাচ্ছেন এই খেলায়।

যেমন, টাকায় তো মানুষের আস্থা আছে বলেই তারা তা ব্যবহার করে। বিটকয়েনের উদ্ভাবকরাও ঐ আস্থার ব্যাপারটা এখানে তৈরি করে দিয়েছেন পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের মধ্যে। কেউ যদি দু’নম্বরী করে নেটওয়ার্কে দাবি করে যে সে কয়েকটা বিটকয়েনের মালিক, তাহলে নেটওয়ার্ক সেটা গাণিতিকভাবে যাচাই করতে গিয়ে ধরে ফেলবে, আর সেই দাবিটা ব্লকচেইনে যুক্ত করা হবে না।দুনিয়ার অধিকাংশ বিকেন্দ্রীভূত মাইনারের উপরে চোরবাবাজীর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সে এটা করতে পুরোপুরি অপারগ। হ্যাকারদেরও সাধ্যে নেই লাখ লাখ কম্প্যুটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাতারাতি হিসাব পরিবর্তন করে ফেলা।

তারপরে ধরুন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে কোন ব্যাংকের বালাই নেই, নেই দু’দিন ধরে অপেক্ষার প্রয়োজন, নেই বড় অংকের ফী। আর আপনার বা প্রাপকেরও পরিচয় দাখিল করার জন্য সোশ্যাল সিক্যুরিটি নম্বর বা পরিচয়পত্রের কোন দরকার নেই। প্রাপকের পাবলিক কী জানলেই হবে, তার নাম-পরিচয়-অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে কোনই কাজ নেই।

এসব সুবিধার পরেও ব্যাপারটা খেলাই থাকতো, যতক্ষণ না বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় এতে অংশ নিচ্ছে আর পদ্ধতিটাকে আস্থাস্থাপনের যোগ্য করে তুলছে।

তো, খেলার থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস রূপ নেওয়া শুরু করলো সিল্করোড নামে এক ওয়েবসাইটের কারণে।

সকল পর্বের লিংকঃ

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!