স্টারি নাইট – ২

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ়ের জন্ম নেদারল্যান্ডের এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৮৫৩ সালে। বাবা ডাচ রিফর্মড চার্চের পাদ্রী ছিলেন। ভিনসেন্টের ছোটবেলা কেটেছে কড়া ধর্মীয় অনুশাসনে। খুব একটা আনন্দময় ছিল না সেটা।

আর্ট ডীলার ফার্মের চাকরিতে আর্থিক সফলতা পেলেও বেশিদিন সেখানে মন টেকেনি ভিনসেন্টের। সেটা প্রথম প্রেমে বিফলতার কারণে, নাকি সৃজনশীলতার অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ দেখে, তা গবেষণার ব্যাপার! নতুন ঝোঁক এল ধর্মকর্মে।

বাবা-মা-খালুর পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন ভ্যান গঘ়। কিন্তু তাতে না দমে প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীর চাকরী নিয়ে পাড়ি জমান বেলজিয়ামের দরিদ্র বোরিনাঝ় এলাকায়। সেখানে কয়লাখনির মজুরদের হাঁড়ভাঙ্গা কষ্টের জীবন দেখে ভিনসেন্টের মনটা আকুল হয়ে পড়ে। কিন্তু চাকরিচ্যুত হতে বেশি সময় লাগল না। চার্চের বরাদ্দ করা আরামদায়ক বাসা এক গৃহহীনকে ছেড়ে দিয়ে নিজে থাকা শুরু করলেন কুঁড়েঘরে। চার্চের হর্তাকর্তাদের হিসাবে এ ছিল মিশনারী পদমর্যাদার অবমাননা!

তারপরও ভ্যানগঘ় থেকে যান গরিব মানুষদের মাঝখানে। তাদের দৈনন্দিন পরিশ্রমের চিত্র আঁকার জন্যে পেন্সিল-চারকোল হাতে তুলে নেন। অনুপ্রেরণা আর সাহায্য আসে স্বচ্ছল আর্ট ডীলার ছোটভাই থিওর কাছ থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দু’চোখে দেখতে না পারলেও থিওর উপদেশে ব্রাসেলসের আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ধর্ম থেকে ভিনসেন্টের মন শেষ পর্যন্ত উঠে গেল যাজক খালুর মেয়ে কর্নেলিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। সাত বছরের বড় সদ্যবিধবা কর্নেলিয়ার পিছনে এর পরেও অনেকদিন লেগে ছিলেন ভ্যান গঘ়। পরিবারের কারো মনে আর কোন সন্দেহ রইলো না যে ভিনসেন্ট ‘বদ্ধ উন্মাদ’। এ ঘটনার পরে ভ্যান গঘ় পতিতালয়ে যাতায়াত শুরু করেন! অবশ্য শিল্পবিপ্লবের যুগের ইউরোপে নানা যৌক্তিক সামাজিক কারণে এধরনের ব্যাপারস্যাপার হরহামেশা চলত।

চিত্রকলার প্রশিক্ষণ চলতে থাকলো, এবার হেগ শহরে তুতো-বোনজামাই আন্তন মভ়ের কাছে। কিন্তু সে সম্পর্কেও চিড় ধরলো ভিনসেন্টের ছন্নছাড়া জীবনযাত্রার কারণে। বাবার নতুন কর্মস্থল ন্যুনেন গ্রামে চলে আসলেন ভ্যান গঘ়। এখানে দুটো ঘটনা মোটা দাগ কাটে ভিনসেন্টের মনে। মার্গো বলে এক পড়শীকন্যার প্রেমনিবেদনে সাড়া দিলেন তিনি। কিন্তু বিয়েতে বাদ সাধলো দু’পক্ষ। মার্গো বিষ খেয়ে মরতে বসেছিলেন, ভ্যান গঘ় সময়মত তাঁকে হাসপাতালে নেয়াতে প্রাণরক্ষা হল তাঁর। এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ভিনসেন্টের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ভিনসেন্ট মনে মনে তাঁর মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী করতেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।

ন্যুনেনে থাকার সময়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভ্যান গঘ় প্রায় দু’শো তৈলচিত্র আঁকেন, যার একটা এখনকার সুপরিচিত ‘দ্য পটেটো ঈটারস’। থিও চেষ্টা করেন সেসব বিক্রি করতে। কিন্তু ছবির বিষয়বস্তু আর নিষ্প্রাণ কাঠখোট্টা রঙের কম্বিনেশন ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। থিও ভাইকে উপদেশ দিলেন উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার বাড়াতে।

একটা অপ্রীতিকর ঘটনায় দোষী সন্দেহ করে ন্যুনেনবাসীরা গ্রামছাড়া করে ভ্যান গঘ়কে। বন্দর শহর আন্টওয়ের্প হয় তাঁর পরবর্তী গন্তব্য। জাহাজীদের কাছ থেকে কেনা কিছু জাপানী উডকাট ভিনসেন্টের ভীষণ মনে ধরে। সেসবের কপি এঁকে রঙের কম্বিনশনের প্র্যাকটিসটা আরো জুঁতসই হয় তাঁর। একই সাথে আন্টওয়ের্পের ফাইন আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন, পাশও করেন। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে অঙ্কনশৈলী নিয়ে বচসা বেঁধে যায়। তারপর সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে ফ্রান্সের পার়িতে থিওর কাছে চলে যান তিনি।

পার়ি ছিল ভ্যান গঘ়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। সারা বিশ্বের আর্ট ক্যাপিটাল সেসময় নিউ ইয়র্ক নয়, ছিল পার়ি। থিওর সুবাদে ফের়নঁ কর়মোনের আর্টস্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। আর সে সুযোগে পরবর্তীকালের খ্যাতিমান অনেক চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচয়-বন্ধুত্ব হয় তাঁর। এঁদের মধ্যে ছিলেন এমিল বেরনার্, অঁর়ি দ্য তুলুজ়-লোত্রেক, কামিয়্যি পিসার়ো, ঝ়র্ঝ় স্যর়া, পোল সিনিয়াক, আর, হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে, পোল গোগ্যাঁ। ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের পাশাপাশি স্যরা়র বিশেষত্ব পোয়াঁতিয়িস্মে হাতে-খড়ি হয় ভ্যান গঘ়ের।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পার়ির পার্টি লাইফে ভিনসেন্টের হাঁপ ধরতে বেশিদিন লাগলো না। ভাইয়ের সাথেও লেগে যাচ্ছিল প্রায়! ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ‌অজুহাতে ভ্যান গঘ় এবার পাড়ি জমালেন দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট্ট আর্ল শহরে। ভাবলেন, বন্ধু চিত্রশিল্পীদের নিয়ে সেখানকার নির্জনতায় একটা আর্ট কলোনি চালু করবেন। ভূমধ্যসাগরীয় আরামদায়ক আবহাওয়া আর নয়নাভিরাম সিনারিও তাঁর আঁকাআঁকির রঙের জেল্লা খুলে দিল। দুই বছরের কম সময়ে দু’শরও বেশি ছবি আঁকলেন। স্টারি নাইট নিয়ে হাত পাকানোও এসময়ে। র়োন নদীতীর আর কাফে টেরাসের ওপর তারকাখচিত আকাশ নিয়ে দু’টো স্টারি নাইট এসময়েই আঁকা।

সব ভালই চলছিল। আর্লের অধিকাংশ বাসিন্দা বিদেশী লালচুলো ভিনসেন্টকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেও দু’একটা বন্ধু ঠিকই জুটেছিল তাঁর, যার একজন পোস্টম্যান রুল্যাঁর ছবি এঁকে দিয়েছিলেন তিনি।

সমস্যার শুরু হলো যখন থিওর অনুরোধে পোল গোগ্যাঁ এসে হাজির হলেন ভ্যান গঘ়ের তথাকথিত আর্ট কলোনির দ্বিতীয় সদস্য হিসাবে। প্রথম কয়েকদিন ভালই কাটল, দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু ছবি আঁকলেন। কিন্তু গোগ্যাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ভ্যান গঘ়ের পুরোপুরি বিপরীত। দাম্ভিক তো ছিলেনই, পার়ির আরামদায়ক বিলাসী জীবন ফেলে আর্লে এসে ভিনসেন্টের সাথে গরীবী হালে জীবনযাপনও তাঁর মনঃপূত হলো না। ভিনসেন্টকে তাচ্ছিল্য করতেও তাঁর বাঁধলো না। ভিনসেন্টও সহজ পাত্র নন। গোগ্যাঁকে শুরুতে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখলেও শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে পারলেন না অতিরিক্ত সংবেদনশীল ভ্যান গঘ়। ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। ভ্যান গঘ়ের মানসিক অবস্থারও অবনতি হওয়া শুরু করলো।

১৮৮৮র বড়দিনের দু’দিন আগে এক ঝড়ো রাত। ভিনসেন্ট আর পোলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। ভিনসেন্ট ছুরি বের করে পোলকে শাসানো শুরু করলেন। পোল ভিনসেন্টের মুখের ওপর হয়ত বলে ফেললেন যে তিনি আর্লে আর এক দন্ডও থাকবেন না। এই জিনিসটারই ভয় করছিলেন যে ভ্যান গঘ়! যে গোগ্যাঁ তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। তাঁর অন্যান্য সব ব্যর্থতার মত আর্ট কলোনির স্বপ্নটারও অকাল সমাধি হবে। হয়ত মনে মনে ভিনসেন্ট একাকীত্বেরই ভয়ে ছিলেন। তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল ভ্রাতৃতুল্য কোন চিত্রকর তাঁকে সঙ্গ দেবে, অনুপ্রেরণা দেবে, আর তাঁর আঁকা ছবি দেখে বুঝবে তাঁর মনের ভাষা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এরপর ঠিক কি হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই।কাটা বাম কানটা কাগজে মুড়ে ভ্যান গঘ় দিয়ে এসেছিলেন শহরের পতিতালয়ে এক মেয়ের হাতে। নতুন গবেষণায় বেরিয়েছে সে মেয়ে রেচেল দুশ্চরিত্রা ছিল না, ছিল কর্মচারী মাত্র। ভ্যান গঘ়ের সাথে বন্ধুত্ব ছিল তার। (বাজারে প্রচলিত আছে এক প্রস্টিটিউটকে প্রেম নিবেদন করে ছ্যাঁকা খেয়ে ভ্যান গঘ় কানকাটা হন, সেটা খুব সম্ভব সত্য নয়!)

এ ঘটনার পরে আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি ভ্যান গঘ়। থিও তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করেন। কাছের সাঁরেমি শহরে এক পাগলা গারদে ভর্তি হন ভিনসেন্ট। নামে অ্যাসাইলাম হলেও জেলখানার থেকে খুব একটা তফাৎ ছিল না সেটার। চলাফেরার না হলেও আঁকাআঁকির স্বাধীনতা সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে দেয়া হয়েছিল। এ সময়েই আধ ঘোরে আধ জাগরণে শেষ স্টারি নাইটটা আঁকেন তিনি। বিষণ্ণতা আর হ্যালুসিনেশনে ভুগতে ভুগতে আরো বেশ কিছু বিখ্যাত ছবি এসময়ে আঁকেন ভিনসেন্ট।

একটু সুস্থ বোধ করা শুরু করলে সাঁরেমি ছেড়ে চলে যান ওভ়ের়-স্যুর়-ওয়াজ় শহরে। পোল গাশে বলে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের নাম শুনেছিলেন পিসারোর কাছ থেকে। সে ভদ্রলোক অনেক নামীদামী শিল্পীদের আপ্যায়ন করতেন, আর চিকিৎসা দিয়ে, সঙ্গ দিয়ে মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের সাহায্য করতেন। এখানে এসে ভ্যান গঘ় প্রায় সত্তরটা ছবি আঁকেন। ‘থ্যাচড কটেজেস বাই আ হিল’ বলে এখানে আঁকা অসমাপ্ত একটা কাজ — তিন গোয়েন্দার পুরনো শত্রু গল্পের কটেজ পেইন্টিংয়ের সাথে এর সন্দেহাতীত মিল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রথম প্রথম ভাল বোধ করলেও মনে এতকালের যত ক্ষত নিয়ে এসেছিলেন ভ্যান গঘ়, ডাক্তার গাশের কাছে তার কোন প্রতিষেধক আসলে ছিল না। মলমের ক্ষণস্থায়ী প্রভাব কেটে যেতে ভ্যান গঘ় সম্ভবত আবার বিষণ্ণতা, একাকীত্বের ছোবলে দুর্বল হতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত ১৮৯০এর ২৭শে জুলাই রিভলবার দিয়ে নিজের হৃদয় বরাবর গুলি চালিয়ে দেন। বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুশয্যায় ঢলে পড়েন ভিনসেন্ট। হয়ত স্টারি নাইটের সাইপ্রেস বেয়ে তাঁর আত্মা পৌঁছে যায় স্বর্গপিতার কাছে, শেষ শান্তির নীড়ে!

ভাই থিওও এরপর বেশিদিন বাঁচেননি! ভিনসেন্টের মৃত্যুর ছয় মাস পর ৩৩ বছর বয়সে তাঁরও ডাক চলে আসে। হয়ত তিনি ভিনসেন্টের নন, ভিনসেন্টই তাঁর খুঁটি ছিলেন। যত্ন করে বড়ভাইয়ের যে চিঠিপত্র রেখে দিয়েছিলেন থিও, তার থেকেই আমরা আজ ভিনসেন্টের ব্যক্তিগত জীবন আর মানসিক অবস্থার অনেক বিস্তারিত খুঁটিনাটি জানতে পারি।

ভিনসেন্ট কি রোগে ভুগেছিলেন সে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেক রকম থিওরি আছে, যার শুরু হ্য়ত বাইপোলার ডিজ়অর্ডার দিয়ে, আর শেষ টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি দিয়ে। ডন ম্যাকলীনের গানের মত আমার ভাবতে ইচ্ছে করে ভ্যান গঘ় আসলে অসুস্থ ছিলেন না। তাঁর মানসপটে পৃথিবী ও মানুষ ছিল অন্যরকম, অনেকটা তাঁর ছবির প্যালেটের মত। তাঁর সাথে অনেকেরই খাপ খায়নি, ঝগড়া বেঁধেছে। কিন্তু খেটে খাওয়া দুর্ভাগা মানুষের পাশে দাঁড়াতে তো তাঁর কখনো বাঁধেনি। তাঁর প্রথাবিরোধী স্বভাব আর বিদেশী পরিচয়কে অনেক স্বদেশী, ফরাসী সন্দেহের চোখে দেখেছে। তারপরও তো নানা শহরে-গ্রামে তাঁর হাতে গোনা হলেও বন্ধু জুটেছে। ভ্যান গঘ়ের কোন মানসিক বিকৃতি ছিল না, তাঁর মন ছিল পরিষ্কার। সেখানে মানুষের আচার, ধর্ম, ধন, সামাজিক অবস্থান তাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় না। গরিমা-লালসা-ছলনার স্থান নেই সেখানে। সেখানে ঈশ্বর পথহারা দুর্ভাগাদের নিশ্চিত শেষ আশ্রয়! শিল্পের অনুপ্রেরণা সেখানে খ্যাতি কিংবা অর্থ নয়, বরং অনন্যোপায়ের মর্মপ্রকাশের একমাত্র উপায়! আর সেই নিষ্কলুষ চিত্তেই পরিপূর্ণরূপে অনুভব করা সম্ভব নীল-হলদে স্টারি নাইটের মাহাত্ম্য!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!