আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে…

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে,
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে!”


রবিঠাকুরের এই গানের সুরের বেসিক গড়নটা, ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের শিক্ষার্থী-কয়েরের গাওয়া, উপরের আইরিশ গানে সামান্য হলেও পাওয়া যায় কিনা, দেখুন তো! তালসুরকানা আমার কানে মনে হচ্ছে দুটোর কোরাসের মীটার কাছাকাছি, তাল-স্কেল আলাদা।


রবীন্দ্রনাথের বহু দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশ আবির্ভূত মমতাময়ী-দুখী মাতা কিংবা সুন্দরী রমণী হিসাবে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতই তার বড় উদাহরণ। রবিঠাকুরের আগে কোন বাঙ্গালী এভাবে স্বদেশকে চিত্রায়িত করলে সেটা সম্ভবত একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র, বন্দে মাতরম কাব্যে। এ ধরনের অ্যালেগরি বা রূপকের আঙ্গিকে উপরের ‘মো গিলা মার’ নামের আইরিশ গ্যালিক ভাষার গানটাও রচিত।


আইরিশ গীতি-কাব্যে এই ধরনের স্বদেশ-রূপকের সাহিত্য পরিচিত ‘আশলিং’ হিসাবে। তাতে কবি নিদ্রাচ্ছন্ন, আর তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হন আয়ারল্যান্ডের স্বদেশদেবী এইরু। দেবী প্রায়শ তরুণী, কখনো জীর্ণশীর্ণ বয়োবৃদ্ধ, তাঁর বসন শতছিন্ন, তিনি কাঁদছেন ইংরেজ প্রটেস্ট্যান্ট শাসনে আইরিশ জাতির দুর্দশা দেখে, কিন্তু আশার বাণী শোনাচ্ছেন যে শীঘ্রই তারা আবার সুদিন দেখবে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...





অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা ‘মো গিলা মার’ গানটিও গাচ্ছেন এইরু দেবী, তিনি জর্জরিত তাঁর প্রেমিকের বিরহবেদনায়। তাঁর সুদর্শন বীরপুরুষ, ‘সীজ়ার’ সাতসাগরের ওপারে চলে গেছে। তাই এখন তিনি বিধবার ন্যায় বিলাপরত। আয়ারল্যান্ডে কোকিল আর ডাকে না, সারা দেশের ওপর একটা কালো শোকের ছায়া।


দেবী এইরুর এই বীরপুরুষ কল্পিত নয়, তিনি ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্টবংশীয় ক্যাথলিক রাজকুমার ‘বনি প্রিন্স চার্লি’। ১৬০৩ সালে স্টুয়ার্টবংশ ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে ইংল্যান্ডে চলেছে ক্যাথলিক-অ্যাংলিকান-পিউরিটান ধর্মগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। স্টুয়ার্টরা প্রথমদিকে জনপ্রিয় থাকলেও তাদের ক্যাথলিক-সহমর্মিতাকে দেশের সাধারণ মানুষ আর অভিজাতরা, যারা অ্যাংলিকান খ্রীষ্টান, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। রাষ্ট্রের ক্যাথলিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত আইরিশরা, সেই বিদ্বেষের শিকার ছিল। ইংরেজরা স্টুয়ার্টবংশকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দেয়ার পরে আইরিশরা তাদের পড়শী তুতো ভাই হাইল্যান্ড স্কটিশদের হাতে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করে স্টুয়ার্টদের নির্বাসিত বংশধরদের পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে।


সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৫ সালে ইতালিস্থিত সিংহাসনহীন ‘প্রেটেন্ডার রাজা’ জেমস স্টুয়ার্টের পক্ষে তাঁর ছেলে চার্লস স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ডের উপকূলে ফরাসী-স্প্যানিশদের সহায়তায় সেনাবাহিনীসহ অবতরণ করেন। হাইল্যান্ড স্কটিশ আর আইরিশরা বিপুল উৎসাহে তাঁকে বরণ করে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে এটা জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ বলে পরিচিত। প্রথম প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জিতলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, আর তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, সেখানেই তাঁর বাকি জীবন কাটে।


তাঁর এই ব্যর্থতার পরেও আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মানুষ আশায় ছিল যে তিনি আবার ফিরে আসবেন, প্রটেস্ট্যান্ট হ্যানোভারবংশের শাসন থেকে তাদের মুক্ত করবেন। এই ফোক্ সঙ্গীতটি বনি প্রিন্সকে হারানোর শোক আর ভবিষ্যতের সেই আশা থেকে লেখা। ‘মুনস্টারের কবিসম্রাট’ শন মাকহোনালের বাঁধা গানটি পরে পল্লীঐতিহ্যের সংরক্ষক শন ও’রিয়াদা পুনরায় রেকর্ড করেন, তারপর এটি নতুন করে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। আমার ধারণা, রবি ঠাকুর দু’তিনবার বিলেত ভ্রমণের সময় আইরিশ কবি ইয়েটসের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য স্কটিশ-আইরিশ ফোক্ কবিতা-গানের পাশাপাশি এই আশলিং ঐতিহ্য আর সঙ্গীতের সাথেও পরিচিত হন।


এই গানটিতে শুধুমাত্র বো’রান বলে একটা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ড্রামের মত এই সঙ্গতের কারণে গানটা একটা মিলিটারি মার্চের রূপ পেয়েছে। ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের সময় আশলিং সাহিত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় এধরনের সামরিক সঙ্গীতে। আমাদের সূর্যসেনের চট্টগ্রাম ১৯৩০ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা কিন্তু সেই আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকেই! তাঁর সংগঠিত দলটির নাম ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, যদিও তাঁর আদর্শ রোম্যান্টিক সোশ্যালিজ়ম ছিল আইরিশদের থেকে ভিন্ন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...





বহুকাল সুশীল সমাজে অবহেলিত হবার পরে এখন আইরিশ ভাষা-সংস্কৃতি-সঙ্গীতের একটা পুনর্জাগরণের শতাব্দী চলছে। তাদের নতুন প্রজন্ম এখন গ্যালিক ভাষা-গান শেখে, ট্যাপ ড্যান্সও শেখে। গ্যালিক কিন্তু ইংরেজীর থেকেও প্রাচীন, আড়াই হাজার বছরের পুরনো কেল্টিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে জার্মানের পরেই আইরিশ বংশোদ্ভূতদের স্থান, তাদেরও অনেকে আদি ভাষা-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। এদের সেই শিকড়ে ফেরার চেষ্টাকে অনেকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের লক্ষণ ধরতে পারেন, আমার ধারণা সেটা ভাবা ভুল। যদি তাই হয়, আমরা কোন অংশে কম বাঙালী জাতীয়তাবাদী নই! আর সত্যিকারের আইরিশ জাতীয়তাবাদীর দেখা পেলে রবিঠাকুর-সূর্যসেনের গল্প শুনিয়ে দিতে ভুলবেন না!

(গানটির কথা ও অর্থ পাবেন এখানে।)

 



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!