সাহারার তুয়ারেগ

উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরোক্কো — এই দেশগুলিকে আমরা জানি আরব-অধ্যুষিত হিসাবে। কিন্তু এই এলাকার আদিবাসীরা আরব নয়, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানও নয়। গ্রীক-রোমান-যুগ থেকে তাদেরকে ভিনদেশীরা চেনে ‘বেরবের’ নামে; যদিও তারা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ — যার অর্থ মুক্ত মানুষ। এখন মূলত আরবী বা ফরাসীতে কথা বললেও উপরের দেশগুলির একটা বড় জনসংখ্যা বেরবের।


জ়িনেদিন জ়িদানের বাবা-মা আলজেরিয়ার কাবিল উপজাতির আমাজ়িগ। মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও ছিলেন আমাজ়িগ বংশোদ্ভূত। খ্রীষ্টান সেন্ট অগাস্টিনও তাই। রোমসম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের ধমনীতেও ছিল বেরবের বংশধারার রক্ত। রোমের সৈন্যদলের একটা অংশও একসময় ছিল বেরবের মাউরি যোদ্ধাদের দিয়ে তৈরি, যাদের নাম থেকে পরে মুর বা মোরো শব্দটা এসেছে।


তারিক ইবনে জ়িয়াদ ছিলেন আরব-বিজিত ইফ্রিক্বিয়া (এখনকার তিউনিসিয়ায়) প্রদেশের গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইরের ক্রীতদাস। জ়ানাতি বেরবের বংশে তার জন্ম, তাঁকে মুক্তিদানের পরে অষ্টম শতকে আরব-বেরবের সৈন্যদল নিয়ে উমাইয়্যা খলিফাদের হয়ে স্পেনবিজয় করেন। তার নামেই জিব্রাল্টার (জাবাল-আল-তারিক)।


স্পেনের দ্বাদশ শতাব্দীর রাজবংশ আলমোহাদ-আলমুরাবিতরা ছিল আরবীকৃত বেরবের। এসময় স্পেনের জামিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপীয়রা দর্শন-বিজ্ঞানের শিক্ষা পেয়েছে মাইমোনিডিস-ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের মত মনীষীদের লেখা পড়ে। আলহামরা প্রাসাদের মুরিশ শিল্পশৈলী বেরবের-আরবদের যৌথ অবদান। আরব-বেরবের রান্নাও বিশ্বখ্যাত, যেকোন মরোক্কান রেঁস্তোরাতে সেটা আস্বাদন করতে পারবেন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...





উমাইয়্যা আরব শাসনের সময় এই মুক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে আরবী কৃষ্টি আর অনারব দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে ফরাসী-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী চাপিয়েছে ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতি। প্রতিবারই তারা বিদ্রোহ করেছে।


নিচের গানটা তু্য়ারেগ নামে আমাজ়িগদের একটা বড় উপজাতির শিল্পীদের গাওয়া, সাথে মার্কিন ব্লুজ মিশানো, মালির কৃষ্ণাঙ্গ ঘরানারও প্রভাব আছে। দলটার নাম তিনারিওয়েন, গানের ভাষা তামাশেক। তুয়ারেগদের বাস আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, মালি, নিঝ়ের, বুরকিনা ফাসোর দেশসীমাবিহীন সাহেল নামে সাহারা মরুভূমির পশ্চিমাংশে। যাযাবর এই গোত্রের অন্নসংস্থানের উপায় গোচারণ আর ‘সাবসিস্টেন্স ফার্মিং’।


তিনারিওয়েনের সদস্যরা উত্তর মালির সাহারার বাসিন্দা। ষাটের দশকে মালি স্বাধীন হবার সময়ে তামাশেকরা চেয়েছিল নিজেদের জন্যে আলাদা দেশ — আজ়াওয়াদ। তার পরিবর্তে সোভিয়েত-সমর্থিত মালির কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান একদলীয় শাসকরা তুয়ারেগদের অধিকার পদদলিত করার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রাণ হারায় অনেক নির্দোষ তুয়ারেগ, গৃহহারা হয় আরো অনেক।


এই গানটার ভোক্যাল ইব্রাহিম আগ্ আলহাবিবের চার বছর বয়সে তার বাবা সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই এতিমরা ঘুরে বেড়ায় আলজেরিয়া-লিবিয়ার এক রেফ্যুজি ক্যাম্প থেকে আরেকে। গীটার শিখে পশ্চিমাগানের সাথে তুয়ারেগ সঙ্গীত মিলিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সাথে সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয় নব্বইয়ের দশকের আরেক বিদ্রোহে। ২০০০এর দশকেও আরেকটা বিদ্রোহ হয়। এরপরে একটা শান্তিচুক্তির ফলে তুয়ারেগদের অধিকার মালিতে মোটামুটি স্বীকৃত এখন। এই শান্তিচুক্তির পিছনে তিনারিওয়েনের মত দলের সাংস্কৃতিক গ্লোবাল আউটরীচের অবদান অনেক বড়।


তারপরেও ইউরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ সংগ্রহ আর খরা-মরুকরণের ফলে চাষের সামান্যতম জমি ধ্বংস হওয়ায়, আর অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে, দরিদ্র সুন্নি সুফীমতানুসারী তুয়ারেগদের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক অভিযোগ আর কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরত সালাফী ইসলামী জিহাদীরা গাদ্দাফীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত-অস্ত্রসজ্জিত স্বাধীনতাকামী তুয়ারেগদের সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে আরেকটা বিদ্রোহ করে, যার ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় ৬ লাখ মূলত তুয়ারেগই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...





সেসময় ইসলামী কট্টরপন্থীরা মালির ঐতিহাসিক তিমবাক্তু শহর দখল করে নেয়, ‘শরিয়া আইন’ চাপিয়ে দেয় আর শহরটির ইউনেস্কোচিহ্নিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মিনার-মাজার এগুলোর ধ্বংসসাধন করে। ২০১০এ দক্ষিণ আফ্রিকার ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গানপরিবেশনকারী তিনারিওয়েনের এক সদস্যকেও তারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে আর গানবাজনা বন্ধ করে দেয়। ফরাসী সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মালির সরকার অবশেষে এদের হটাতে সমর্থ হয়। আর আজ়াওয়াদপন্থী স্বাধীনতাকামীরাও দল বদলে মালির সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এখনো মালিতে ফরাসী আর নিঝ়েরে মার্কিন সৈন্য আছে এসব দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখার জন্যে।


এই গানটিতে দেখবেন মুসলিম তুয়ারেগ পুরুষদের মুখ ঢাকা, কারণ তাদের আদি ঐতিহ্যে নারী নয়, পুরুষরাই মুখ ঢাকে! তুয়ারেগ নারীরা মাথায় কাপড় দিলেও সাধারণত পুরো মুখমন্ডল আবৃত করে না, আর সকল ধরনের কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ করে। অতীতের কোন এক সময় তুয়ারেগ পরিবারব্যবস্থা মাতৃকুলভিত্তিক ছিল বলেই নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা। এই গানে তেনেরে বলে সাহারার এক এলাকার অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে মরুবাসী তুয়ারেগের অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে দুই শব্দে — আমান ইমান, পানিই জীবন।

গানের কথা আর অর্থ এখানে পাবেন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!