স্বদেশে পরদেশী উইগুর

আজ যে জাতির সঙ্গীত নিয়ে লিখছি, তারা যে কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত হচ্ছে, এটা মনে হয় বাকি পৃথিবী ভুলে যেতে বসেছে। গানটা যে ‌অ্যালবাম থেকে নেয়া, তার নাম ‘লিসেন টু দ্য ব্যানড’ — এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে যেসব শিল্পীদের গান নিষিদ্ধ, তাদের নিয়ে এটা করা। গানটার ভাষা উইগুর, দুতারনামক বাদ্যযন্ত্রবাদক গায়কের  নাম কুরাশ সুলতান। তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে নির্বাসনে প্রয়াত হয়েছেন।

উইগুররা চীনের উত্তরপশ্চিমের শ়িনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজিয়নের বাসিন্দা। তাদের খবরাখবর বহির্বিশ্বে খুবই কম পাবেন, বিশেষ করে ২০০৯এর হান-উইগুর দাঙ্গার পর। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বাইরে থেকে কোন সাংবাদিক সেখানে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখে, বেশির ভাগ সময় ঢুকতে দেয় না, আবার নেটিভদের সাথে বেশি মেলামেশা করলে তাদেরকে এস্কর্ট করে প্রদেশের বাইরে বের করে দেয়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানকার সত্য খবর রিপোর্ট করে। প্রাদেশিক সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারেরই সাজানো, যতই তারা স্বায়ত্তশাসিত বলে নিজেদের দাবি করুক। এরকম আরো দুটো এলাকা আছে চীনে — তিব্বতকে সবাই চিনে দালাই লামার খাতিরে, আরেকটা নেই মেংগু বা ইনার মংগোলিয়া

উইগুরদের ইতিহাসটাও খুব চমকপ্রদ। এরা আসলে তুর্কী জাতি। তুর্কীরা তুরস্কে ঘাঁটি গাঁড়ার আগে ছিল মোঙ্গলদের পড়শি, আর তাদের মতই গরু-ভেড়া-চড়ানো যাযাবর গোষ্ঠী। মোঙ্গল, তিব্বতী, পারসিক আর চৈনিক রাজ্য দিয়ে চারিদিক ঘেরা তুর্কীরা মোঙ্গলদেরও আগে একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছিল, যার নাম গোকতুর্ক। এরা উপাসনা করত তেংরি বলে এক আকাশদেবতার, মোঙ্গলদের মতই। এদের নয়টি ট্রাইব দোকুজ়-ওগুজ়দের একটা উইগুররা। উইগুরদের তুতো ভাইয়েরা আরো পশ্চিমে গিয়ে সফল সাম্রাজ্য গড়েছে, আর উইগুররা ছিল সিল্ক রোডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকলা-মাকান মরুভূমি আর তিয়ানশান পর্বতমালার রক্ষক। কুবলাই খানের কজ়মোপলিটান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরকারে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য তুর্কী জাতের শত্রুদের বিরুদ্ধে এরা  চীনের প্রতাপশালী সুই সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। বাঙ্গালীদের মত উইগুররাও একেক সময় একেক ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমে অ্যানিমিস্ট থাকলেও, পরে মানিকেয়ান হয়েছে, বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ করেছে, নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টানও ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছে মুসলিম। এখনও অনেক উইগুর ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু প্রাচীন নিয়মকানুনের ছায়া রয়ে গেছে।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার অনুন্নত-বিভক্ত-পশ্চাদপর খানশাসিত ছোট ছোট পারসিক-তুর্কী রাজ্যগুলিকে রাশিয়ার রোমানভ় সাম্রাজ্য আর চীনের চ়িং সাম্রাজ্য একের পর এক দখল করে করদ রাজ্য অথবা উপনিবেশ বানানো শুরু করে। উইগুরদের দেশ এসময় চ়িংদের আয়ত্ত্বে আসে। এসময় করদরাজ্য হিসাবে আর দূরত্বের কারণে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রার উপর চীনাদের প্রভাব খুব কমই ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে চীনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রুশ কম্যুনিস্ট সরকারের প্ররোচনায় ১৯৩৩ আর ১৯৪৪এ দু’বার তারা স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিলেও প্রথমটা কয়েক মাস আর দ্বিতীয়টা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯৪৯এ রুশসমর্থিত দ্বিতীয় স্বাধীন তুর্কেস্তান সরকারের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদেরই ষড়যন্ত্রে প্লেনক্র্যাশে মারা যাওয়ার পর শেষ কম্যুনিস্ট সদস্য মাওৎসেতুংএর কাছে রাজাকারি করে রাজ্য সপে দেয়



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এরপর মাওয়ের কালচারাল রেভোল্যুশনের সময় বাকি চীনবাসীদের সাথে সাথে এরাও ভুক্তভোগী হয়েছে। ১৯৪৯এ হানগোষ্ঠীর চীনাদের জনসংখ্যা উইগুরিস্তানে ৬% হলেও সরকারী নীতির কারণে ধীরে ধীরে বেড়ে এখন প্রায় ৪০%। হানরা ব্যবসাবাণিজ্য-চাকরিক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু তারা উইগুরদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে না, সম্মান করে না। স্বভাবতই শ়িনজিয়াং জাতিগত সংঘাতের একটা ঊর্বরক্ষেত্র।

দেং শ়িয়াও পিংএর সংস্কারের আমলে কিছুটা স্বাধিকারচর্চার সুযোগ পেলেও শ়ি জিন পিংএর চাইনিজ় এক্সেপশনালিজ়মের মুখোশপরা চীনা জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসরণের কারণে উইগুররা একটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডারিন না শিখলে তাদের জীবিকা নেই, লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ, মসজিদে অনূর্ধ্ব-আঠারো প্রবেশ নিষেধ, জায়গায়-জায়গায় সারভেইল্যান্স ক্যামেরা বসানো। এমনকি তাদের নিজ দেশের ইতিহাসকেও হানজাতির স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে ইন্জিনিয়ার করা হচ্ছে। অল্প কিছু উইগুর মুক্তির সন্ধানে  কট্টরপন্থী জিহাদী ইসলামে ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ভুলের অজুহাতে পুরো জাতটাকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামলেই তাদের টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘রিএডুকেশন ক্যাম্পে’ নাকি দশ লাখ উইগুর বন্দী, সেখানে নাকি তাদের জোর করে শুকরের মাংস, অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তের ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি। ইলহাম তোহতী বলে এক অর্থনীতিবিদ উইগুর অনলাইন বলে একটা সাদামাটা ওয়েবসাইট চালাতেন, তাঁর সাথে লাদেনকে জড়িয়ে দিয়ে এখন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রেখেছে। আবলাজান আইউব বলে এক অরাজনৈতিক জনপ্রিয় পপ গায়ককেও জুনমাসে লাপাত্তা করে দিয়েছে। দালাই লামার মত উইগুরদেরও স্বেচ্ছানির্বাসিত নেত্রী আছেন যার নাম রাবিয়া কাদির, কয়েকবার শান্তির নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েছেন।

ইউটিউবে উইগুর মিউজ়িক সন্ধান করলে অনেক নাচগান দেখবেন, এদের অধিকাংশই শো, বাইরের মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টা যে উইগুররা সুখেশান্তিতে নাচাগানা করে আছে। কামাল আতাতুর্ক একদিকে যেমন সুফী জিকির অবৈধ করেছিলেন, অন্যদিকে দরবেশদের সুফী ঘূর্ণিনৃত্য সমানে চলেছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে — চীন সরকারের এ প্রয়াস তার থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং আরো ভয়ানক কারণ এভাবে উইগুরদের জাতিগত পরিচয়টাকেই তারা ইনজিনিয়ার করে ফেলছে। সোভিয়েতরাও তাদের অনেক সংখ্যালঘু জনসত্ত্বাকে একইভাবে রিডিফাইন করেছিল।

মুসলিম দেশের সরকারগুলি ফিলিস্তিন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও উইগুরদের নিয়ে রহস্যজনকভাবে মৌন থাকে, সম্ভবত চীনের সাথে খাতিরের সম্পর্ক বজিয়ে চলার জন্যে। তুরস্কে অনেক উইগুর নির্বাসনে থাকলেও তুরস্কের সরকারও চুপচাপ, কথা বললেই কুর্দী-আরমেনিয়ানদের পুরনো কংকাল সিন্দুক থেকে বেরিয়ে নাচানাচি করবে। মার্কিন আর ইউরোপিয়ানরাই কিন্তু বছরের পর বছর তিব্বতী-উইগুরদের স্বাধিকারের পক্ষে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। ২০০৮এ একটা গণসংগ্রামের প্রচেষ্টা হলেও ইন্টারনেটে ইনজিনিয়ারড গুজব ছেড়ে চীনারা টেরোরিজ়মের জুজু দেখিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেসময় বাইরে থেকে বিবৃতির বেশি সাহায্য আসেনি। তাই অনেক তরুণ উইগুর স্বাধিকার-সংস্কৃতি-মানবাধিকার ভুলে কষে ম্যান্ডারিন শিখছে। অতএব আপাতত সিপিসি সফল।

গানের ভিডিওটিতে কিছু দৃশ্য ভায়োলেন্ট, ২০০৯এর উরুমচি শহরের দাঙ্গার যেটুকু পাবলিক ভিডিও রেকর্ড আছে তার কিছুটা। বাকি অংশ আগের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। ইলহাম তোহতীর একটা হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ পাবেন এখানে



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!