মে সোয়াজন্তুইত

এখন থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমাদের মাবাবারা সে সময় স্কুল-কলেজের ছাত্র। সময়টা ছিল খুবই উত্তাল, বেবি বুমারস জেনারেশনের বড় হয়ে ওঠার সময়। সমাজতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সব দেশেই চলছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমেরিকায় ভিয়েতনামযুদ্ধবিরোধী আর সিভিল রাইটস আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়াতে চেতনার স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্রবিক্ষোভ (এ দুটো দেশে কিভাবে পুলিশ, দলীয় পেটোয়াবাহিনী আর মিথ্যে প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহার হয় নব্য বামরা ঘেঁটে দেখুন; সোভিয়েতরা শেষমেশ চেকে দখলদার সেনাবাহিনী পাঠায়)। ফ্রান্স-ইতালিতেও বিশ্ববিদ্যালয়-হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সেই আন্দোলন ‘মে সোয়াজ়ন্তুইত’ নামে এখনও স্মরণ করে ফরাসীরা। রোলিং স্টোনসের নিচের গানটা সেই উত্তাল সময়ের পটভূমিতে লেখা (পিজি-১৩!)। স্ট্রীট ফাইটিং ম্যান বলে গানটাও শুনে দেখুন।

কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মে’৬৮ ব্যর্থ বিপ্লব হিসাবে গণ্য!

ফ্রান্সে তখন ক্ষমতায় ছিল প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোলের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই ফরাসীরা লড়াই করে, তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অনেক। কিন্তু যুদ্ধজয়ের পঁচিশ বছর পরে রক্ষণশীল হিসাবে বাম ‘প্রোগ্রেসিভ’ ছাত্র আর শ্রমিক সমাজের কাছে তারা ছিল ঘৃণিত। তাদের কাছে গোলিস্টদের যুদ্ধকালীন ফ্রঁস লিব্র্ ‘চেতনার নামে বাকস্বাধীনতাহরণ’ ছিল নাৎসি বাহিনীর সমতুল্য। টেলিভিশনও তখন সবার ঘরে ঘরে আসা শুরু হয়েছে, তাই সবাই জানতে-দেখতে পারলো নন্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রদের উপর পুলিশের আক্রমণ। কার্তিয়ে লাত্যানে শুরু হয়ে গেল ব্যারিকেড যুদ্ধ, সেটাও এল টিভিতে। গুজব রটল একজন ছাত্র নিহত (আসলে হয়নি), আর পুলিশই নাকি রাস্তায় গাড়ি উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে ছাত্রদের দোষ দিচ্ছে।

ছাত্রদের ডাকে শ্রম ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যরা তাদের নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বামপন্থী ছাত্রদের সাথে ধর্মঘটে যোগ দেয় দেশের সোয়া এক কোটি সাধারণ শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষদের ইউনিয়ন, সংখ্যায় তারা জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। দেশের দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, প্যারিসে দশ লাখ মানুষের ঢল নেমে আসে, বিখ্যাত গায়ক-অভিনেতারাও তাদের সাথে যোগদান করে। সরকারপতন ছিল সময়ের ব্যাপার, দ্য গোলও কিছু সময়ের জন্যে গোপনে জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এতকিছুর পরেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় মে’৬৮! কয়েকটা কারণে। ধর্মঘটীদের লক্ষ্য কি ছিল সেটা মানুষকে বোঝাতে তারা ব্যর্থ হয়। টিভিতে তাদের ইন্টারভিউ নেয়া হলে তারা বলা শুরু করে হিপি গোছের অ্যান্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট অ্যান্টি-কনজিউমারিস্ট ইউটোপিয়ান সাম্যবাদী বুলি, যার সাথে সাধারণ মানুষ একাত্মতা খুঁজে পায়নি। তাদের সাথে যোগ দেয়া শ্রমিকদের লক্ষ্যও পরে হয়ে যায় ভিন্ন, তাদের বেতন বাড়ানো আর অন্যান্য বেনেফিটস দেয়ার ঘোষণা করা হলে তারা ধীরে ধীরে রাস্তা থেকে পাততাড়ি গুটায়।

আর নেতৃত্বেও ছিল সমস্যা। কে যে প্রপার নেতা তা কেউ জানত না। নোবেলবিজয়ী (কিন্তু প্রত্যাখ্যানকারী প্রথম ব্যক্তি!) দার্শনিক ঝ়ঁপল সার্ত্র হন তাদের প্রতীকী নেতা। তাঁকে ‌অ্যারেস্ট করা হয়, আর তখন তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। তাঁর লেখনীতে ধার ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনিও ছিলেন কম্যুনিজমের সমর্থনকারী মূলত বাম চিন্তাবিদ, যারা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র — সোভিয়েত এজেন্ট।

আর পুরনো আমলের মানুষ যারা দ্য গোলের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের স্বাক্ষী, আর রক্ষণশীল, তারা ছাত্রদের ‘ইনডিসিপ্লিন’, খোলামেলা পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের একত্রে অবাধ মেলামেশা, মাদকের ব্যবহার — এসব দেখে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকে। বামপন্থী বিপ্লবের খারাপ ফলের কথাও তারা জানত বলশেভিকদের অত্যাচারের ইতিহাস থেকে।

এর উপরে দ্য গোল যখন জানতে পারলেন আর্মি তাঁর পক্ষে, তিনি ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী পম্পিদু যাদের জেলে ভরা হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দিলেন, আর দ্য গোলকে অনুরোধ করলেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডাকতে। সবাই রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল। আর সেই নির্বাচনে গোলিস্ট পার্টি আরো বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ করল। কম্যুনিস্ট-সোশ্যালিস্টরা অনেক সীট হারাল।

মে’৬৮এর কালচারাল ইমপ্যাক্ট অবশ্য ছিল বিশাল। আমার মনে হয় আমরা সেই লেগ্যাসি এখনও বহন করছি। ফ্যাশনে বিশাল পরিবর্তন আসে, কোটপ্যান্ট ছেড়ে বেলবটম প্যান্ট জনপ্রিয় হয়। রক এন্ড রোল পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদী সঙ্গীতে, বব ডিল্যান তার প্রডাক্ট। ফেমিনিজ়মের আবির্ভাব ঘটে নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন মুখ হিসাবে। সারা বিশ্বে ছাত্ররা আইডিয়ালিস্ট প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমি বলবো সে কারণেই বোধহয় বাঙাল জাত একটু সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা পায়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন (ভুলে যাবেন না, এতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও শামিল ছিল) আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলবো মে’৬৮রই একরকম ধারাবাহিকতা! সেগুলির সকল কৃতিত্ব কেউ একাই ছিনতাই করলে ইতিহাসের অবমাননা হবে, এগুলো ছিল সফল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের চূড়ান্ত ফল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আমরা কিছুটা শিক্ষা পেতে পারি মে’৬৮ থেকে। বিপ্লব সফল করতে লাগে প্র্যাগমাটিক লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর সাপোর্ট, আর লটস্ অফ স্কিন ইন দ্য গেম! আর দ্য গোল সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে গালি দেয়া হলেও তারা স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় সঠিক পদক্ষেপগুলো নেয়, দেশপ্রেমী হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়।

দ্য এলেমেন্টস অফ এ সাক্সেসফুল রেভোল্যুশন বলে এনপিআরে একটা সেগমেন্ট শুনছিলাম, নিন তার লিংক। ২০১১এর মিশরের তাহরির আন্দোলনের সময়ে ধারণকৃত এই সেগমেন্টে কলম্বিয়া প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সফলভাবেই সেই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে জানলে যে পরিমাণ জ্ঞানার্জন সম্ভব, ফরাসী-রুশ-মার্কিন শত সফল বিপ্লব সম্বন্ধে পড়েও এত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়!

 



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!