ভারতীয় ভক্তিবাদ – ৩

Featured Video Play Icon

সাব আয়া একহি ঘাটসে, উৎরা একহি বাট, বীছ মে দুৰিধা পাড় গা’ই, হো গায়ি বারা বাট — সন্ত কবীরের পঞ্চদশ শতকের মলৰী ভাষায় গাওয়া ভজন। সবাই আসছিল একই ঘাট থেকে, সবার একই পথ, মাঝে পড়ল দ্বিধায় সকলে, হয়ে গেল বারো পথ।

কবীরের একশ’টি ভজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ইংরেজী সংকলন বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। রবীন্দ্রনাথ যে কবীরকেই তুলে ধরেছেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস কবীরের দর্শনের মতই নিরাকার একত্ববাদী। এখনও কবীরপন্থা বলে একটি ধর্মবিশ্বাস বহু ভারতীয় অনুসরণ করে।

আগেই বলেছি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক ভারতের জন্যে ক্রান্তিকাল। উত্তর ভারতে মুসলিম দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ হলেও আগের সেই স্থিতিশীলতা নেই। দিল্লী সুলতানাতের মত বড় রাজ্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে অনেক সামন্ত রাজ্য। রাজনৈতিক ভাগ্য ও সামাজিক অধিকারের অবস্থা ক্রমপরিবর্তনশীল।

ইসলাম ধর্ম ভারতীয় স্থানীয় দর্শনগুলোর জন্যে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারতে যে সময় ইসলামের আগমন, তখন মোটে বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। এর পুরোভাগে ছিল বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজবংশ, যাদের মধ্যে পড়ে বাংলার সেনরা।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধর্মগুলির প্রতিযোগী। অন্তত থিওরিতে ইসলামে জাতপাত নেই, সবার জন্যে খোদার করুণা সমান। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীদের বাদ দিলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার জন্যে এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মত সীমান্তবর্তী জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণবাদে নিষ্পেষিত বহু প্রাক্তন বৌদ্ধ ও অসবর্ণ মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মের চোখে অস্পৃশ্য, তাদের জন্যে ইসলাম ছিল আকর্ষণীয় একটি বিকল্প।

যারা নিচু শ্রেণীর খেঁটে খাওয়া মানুষ, তাদের সকলে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়। ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে মার্কেট এক্সপানশন হয়েছে অনেক কুটিরশিল্পের। ব্রাহ্মণদের চোখে চন্ডাল হলেও নিম্নবর্ণের শূদ্ররা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এ ধরনের নিম্ন মধ্যবিত্ত অত সহজে ধর্মান্তরিত হয়নি, হলেও তা হয়েছে নামে মাত্র। ইসলামগ্রহণ যদি নাও করে, নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বর্ণপ্রথায় তাদের তেমন কোন সম্মানজনক স্থান নেই। অর্থাৎ, এরা না ঘরকা, না ঘাটকা। এরকম আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী প্রতিবাদ ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

দরিদ্র তাঁতী পরিবারের কবীর সেই নিষ্পেষিত শ্রেণীরই প্রতিনিধি। তিনি মুসলিম ছিলেন না হিন্দু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে স্ব-স্ব ধর্মের সন্ত বানাতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সকলে এক পায়ে খাঁড়া। অথচ জীবদ্দশায় সম্ভবত তাকে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

কবীরের ভজন গবেষণা করে যতটুকু মনে হয়, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও সে ধর্মের খুব বেশি জ্ঞান তার ছিল না। সম্ভবত তার পরিবার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের কনভার্ট। কিন্তু সাবালক বয়েসে কবীরের হাতেখড়ি বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সমসাময়িক সাধক রামানন্দের হাত ধরে।

কবীরের দর্শনকে সহজিয়া বলা যেতে পারে। সহজ ভাষায় তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, বাইরে দিয়ে ধার্মিক হয়ে কোন মোক্ষ নেই, অন্তরে থাকতে হবে ভক্তি। দেবমূর্তি তো কোন কথা বলে না, তাকে কেন পূজবো? ঈশ্বরের বাস সে তো মন্দির-কাবায় নয়, মানুষের অন্তরে। মুসলিম কাজী সে একদিকে কুরআন বাঁছে, আরেকদিকে কেড়ে নেয় গরীব মানুষের জমি। তেমন তিলকছাঁপা হিন্দু ব্রাহ্মণ যতই বেদপাঠ করুক না কেন, আত্মার মধ্যে যদি সেটা সে ধারণ না করে, তারও নেই পাপমোচন। অন্তর ভাল না হলে বাইরের পাকপবিত্রতার কোন মূল্য নেই।

দু’হাজার বছর আগে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গৌতমবুদ্ধের যে বিপ্লব, সে ছিল আর্য উচ্চবর্ণের ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের বিরুদ্ধে আরেক উচ্চবর্ণেরই প্রগতিশীল প্রতিবাদ। আর কবীরের প্রতিবাদ একেবারে তৃণমূল থেকে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি-অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তার দর্শনে রয়েছে সাম্যবাদের ইউটোপিয়া, যেখানে কোন নিষ্পেষন নেই, জাতপাত নেই, সরকার-রাষ্ট্র নেই, কর নেই।

এভাবে কবীর ভারতীয় মানুষের মোহভঙ্গ হওয়া একটা বিশাল অংশের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। আর তার পথ ধরেই আবার হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ভারতীয় সিনক্রেটিজম-সিনথেসিসের বীজ বপন হয়। পরবর্তী সন্ত-সাধু সন্ন্যাসী-ফকির ইসলামের নামেই হোক, আর হিন্দু ধর্মের নামেই হোক, একই রকম হৃদয়গ্রাহ্য সার্বজনীন মানবিক ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন।

কবীরপন্থার একটা বৈশিষ্ট্য অনেকান্তবাদ, অর্থাৎ মোক্ষলাভের উপায় কেবল একটি নয়, বহু — কিন্তু সকলের লক্ষ্য ঐ একই।

কবীরের ভক্তিবিপ্লব প্রসঙ্গে আরো দুটি জিনিস মাথায় এল, যা না বললে নয়। এক, মধ্যযুগের শেষে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন কিছু ভিন্ন ছিল না। ক্যাথলিক পাদ্রীকূলও ছিলেন মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানেও খ্রীষ্টান জগতে কবীরের মতই এক জ্ঞানবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার নাম প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে খুঁজে পাওয়া রিফর্মেশনপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের কারমিনা বুরানা নামের পান্ডুলিপি ঘাঁটালে একই রকম প্রতিবাদী ভক্তিবাদ চোখে পড়বে। এব্যাপারে এখানে আগে লিখেছি।

আর দুই, অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তিবাদ! হ্যাঁ, এ বস্তুও আছে। তার একটা ধারা সাদার্ন কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের থেকে এসেছে, যাকে বলে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলিকে সমসাময়িক দাসত্বশৃংখলের সাথে যুক্ত করে একটা খোদাভক্তি ও প্রতিবাদ সেখানে উঠে এসেছে। ওয়েড ইন ওয়াটার গানটা মনে আসল। এ গানটি বাপ্টিজমের রেফারেন্সে ভক্তিমূলক হলেও দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ রয়েছে। পানিতে সাঁতরালে পলায়নপর দাসের গায়ে আর কোন গন্ধ থাকে না, মনিবের কুকুরও তাকে আর অনুসরণ করতে পারে না।

Let’s wade in the water,
Wade in the water,
Listen to me now, wade in the water.
I wanna know that you’re mine,
Because your love is so fine.

আরেকটি হলো শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান মূলধারার ফোক গসপেল সঙ্গীত। এটিও সাউথের। এর উদাহরণ মনে হলো ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ ছবির একটা গান:

As I went down in the river to pray
Studying about that good ol’ way
And who shall wear the robe & crown?
Good Lord show me the way

সুতরাং কবীরের ঐ অনেকান্তবাদ আসলে লার্জার কনটেক্সটে খুবই সত্য। পৃথিবীতে আজ ‘বারো’ পথ, কিন্তু সবার সেই একই ঘাট, একই পথ, একই গন্তব্য। কাহাঁ সে আয়া কাঁহা যাওগে, খাবার কারো আপনে তান কি, কোয়ি সাদগুরু মিলে তো ভেদ বাতাৰে, খুল যাৰে অন্তর খিড়কী…

পুরানো সেই দিনের কথা…

Featured Video Play Icon

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”

রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।

রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।

সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।

আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।

পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।

সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে ‌অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।

এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।

এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।

আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। ‌এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। ‌অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।

শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।

আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!

অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে…

Featured Video Play Icon

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে,
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে!”


রবিঠাকুরের এই গানের সুরের বেসিক গড়নটা, ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের শিক্ষার্থী-কয়েরের গাওয়া, উপরের আইরিশ গানে সামান্য হলেও পাওয়া যায় কিনা, দেখুন তো! তালসুরকানা আমার কানে মনে হচ্ছে দুটোর কোরাসের মীটার কাছাকাছি, তাল-স্কেল আলাদা।


রবীন্দ্রনাথের বহু দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশ আবির্ভূত মমতাময়ী-দুখী মাতা কিংবা সুন্দরী রমণী হিসাবে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতই তার বড় উদাহরণ। রবিঠাকুরের আগে কোন বাঙ্গালী এভাবে স্বদেশকে চিত্রায়িত করলে সেটা সম্ভবত একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র, বন্দে মাতরম কাব্যে। এ ধরনের অ্যালেগরি বা রূপকের আঙ্গিকে উপরের ‘মো গিলা মার’ নামের আইরিশ গ্যালিক ভাষার গানটাও রচিত।


আইরিশ গীতি-কাব্যে এই ধরনের স্বদেশ-রূপকের সাহিত্য পরিচিত ‘আশলিং’ হিসাবে। তাতে কবি নিদ্রাচ্ছন্ন, আর তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হন আয়ারল্যান্ডের স্বদেশদেবী এইরু। দেবী প্রায়শ তরুণী, কখনো জীর্ণশীর্ণ বয়োবৃদ্ধ, তাঁর বসন শতছিন্ন, তিনি কাঁদছেন ইংরেজ প্রটেস্ট্যান্ট শাসনে আইরিশ জাতির দুর্দশা দেখে, কিন্তু আশার বাণী শোনাচ্ছেন যে শীঘ্রই তারা আবার সুদিন দেখবে।


অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা ‘মো গিলা মার’ গানটিও গাচ্ছেন এইরু দেবী, তিনি জর্জরিত তাঁর প্রেমিকের বিরহবেদনায়। তাঁর সুদর্শন বীরপুরুষ, ‘সীজ়ার’ সাতসাগরের ওপারে চলে গেছে। তাই এখন তিনি বিধবার ন্যায় বিলাপরত। আয়ারল্যান্ডে কোকিল আর ডাকে না, সারা দেশের ওপর একটা কালো শোকের ছায়া।


দেবী এইরুর এই বীরপুরুষ কল্পিত নয়, তিনি ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্টবংশীয় ক্যাথলিক রাজকুমার ‘বনি প্রিন্স চার্লি’। ১৬০৩ সালে স্টুয়ার্টবংশ ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে ইংল্যান্ডে চলেছে ক্যাথলিক-অ্যাংলিকান-পিউরিটান ধর্মগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। স্টুয়ার্টরা প্রথমদিকে জনপ্রিয় থাকলেও তাদের ক্যাথলিক-সহমর্মিতাকে দেশের সাধারণ মানুষ আর অভিজাতরা, যারা অ্যাংলিকান খ্রীষ্টান, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। রাষ্ট্রের ক্যাথলিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত আইরিশরা, সেই বিদ্বেষের শিকার ছিল। ইংরেজরা স্টুয়ার্টবংশকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দেয়ার পরে আইরিশরা তাদের পড়শী তুতো ভাই হাইল্যান্ড স্কটিশদের হাতে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করে স্টুয়ার্টদের নির্বাসিত বংশধরদের পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে।


সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৫ সালে ইতালিস্থিত সিংহাসনহীন ‘প্রেটেন্ডার রাজা’ জেমস স্টুয়ার্টের পক্ষে তাঁর ছেলে চার্লস স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ডের উপকূলে ফরাসী-স্প্যানিশদের সহায়তায় সেনাবাহিনীসহ অবতরণ করেন। হাইল্যান্ড স্কটিশ আর আইরিশরা বিপুল উৎসাহে তাঁকে বরণ করে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে এটা জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ বলে পরিচিত। প্রথম প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জিতলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, আর তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, সেখানেই তাঁর বাকি জীবন কাটে।


তাঁর এই ব্যর্থতার পরেও আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মানুষ আশায় ছিল যে তিনি আবার ফিরে আসবেন, প্রটেস্ট্যান্ট হ্যানোভারবংশের শাসন থেকে তাদের মুক্ত করবেন। এই ফোক্ সঙ্গীতটি বনি প্রিন্সকে হারানোর শোক আর ভবিষ্যতের সেই আশা থেকে লেখা। ‘মুনস্টারের কবিসম্রাট’ শন মাকহোনালের বাঁধা গানটি পরে পল্লীঐতিহ্যের সংরক্ষক শন ও’রিয়াদা পুনরায় রেকর্ড করেন, তারপর এটি নতুন করে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। আমার ধারণা, রবি ঠাকুর দু’তিনবার বিলেত ভ্রমণের সময় আইরিশ কবি ইয়েটসের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য স্কটিশ-আইরিশ ফোক্ কবিতা-গানের পাশাপাশি এই আশলিং ঐতিহ্য আর সঙ্গীতের সাথেও পরিচিত হন।


এই গানটিতে শুধুমাত্র বো’রান বলে একটা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ড্রামের মত এই সঙ্গতের কারণে গানটা একটা মিলিটারি মার্চের রূপ পেয়েছে। ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের সময় আশলিং সাহিত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় এধরনের সামরিক সঙ্গীতে। আমাদের সূর্যসেনের চট্টগ্রাম ১৯৩০ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা কিন্তু সেই আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকেই! তাঁর সংগঠিত দলটির নাম ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, যদিও তাঁর আদর্শ রোম্যান্টিক সোশ্যালিজ়ম ছিল আইরিশদের থেকে ভিন্ন।


বহুকাল সুশীল সমাজে অবহেলিত হবার পরে এখন আইরিশ ভাষা-সংস্কৃতি-সঙ্গীতের একটা পুনর্জাগরণের শতাব্দী চলছে। তাদের নতুন প্রজন্ম এখন গ্যালিক ভাষা-গান শেখে, ট্যাপ ড্যান্সও শেখে। গ্যালিক কিন্তু ইংরেজীর থেকেও প্রাচীন, আড়াই হাজার বছরের পুরনো কেল্টিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে জার্মানের পরেই আইরিশ বংশোদ্ভূতদের স্থান, তাদেরও অনেকে আদি ভাষা-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। এদের সেই শিকড়ে ফেরার চেষ্টাকে অনেকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের লক্ষণ ধরতে পারেন, আমার ধারণা সেটা ভাবা ভুল। যদি তাই হয়, আমরা কোন অংশে কম বাঙালী জাতীয়তাবাদী নই! আর সত্যিকারের আইরিশ জাতীয়তাবাদীর দেখা পেলে রবিঠাকুর-সূর্যসেনের গল্প শুনিয়ে দিতে ভুলবেন না!

(গানটির কথা ও অর্থ পাবেন এখানে।)

 

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!