কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৩

দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত যা কিছু বললাম, শুনতে ভয়াবহ মনে হলেও বেআইনি নয়, আর অনেকে হয়ত গায়েও লাগাবে না, কারণ মার্কিনে এসব নিত্যনৈমিত্তিক। আপনার যদি সর্পতৈলে আসক্তি থাকে, তিতাস মলমে আপনার আগ্রহ জন্মাতেই পারে। ফেসবুক যদি সেটার খবর আপনাকে দিয়ে দু’পয়সা কামিয়ে নেয়, ক্ষতি কি? যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব অবৈধ নয়, যতক্ষণ না আপনি (বা আপনার পক্ষে সরকার) প্রতারণার মামলা ঠুকে দিচ্ছে।

এপর্বে বলবো পরের ধাপটা কি, আর কিভাবে দুষ্ট লোকেরা আমার-আপনার-সবার ক্ষতি করছে।

অ্যানালিটিকার মত ফার্ম সম্ভবত এখনো এক কোটির মধ্যে একজনকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিনপয়েন্ট করে চিহ্নিত করতে পারে না, কিন্তু সমমনা মানুষদের একটা কম্যুনিটিকে পারে। সোজা উদাহরণ দিই। তারা তাদের তথ্যভান্ডারের উপর মেশিন লার্নিং কোরিলেশন অ্যালগরিদম চালিয়ে বের করলো যে যেসব পুরুষদের গোলাপীরং ভীষণ অপছন্দ তাদের অধিকাংশই গেদের ঘৃণা করে, তার সাথে যদি তারা রংধনুপতাকাওলা পোস্টে রাগের ইমো দেয়, তাহলে তো মিলেই গেল। তারা বের করলো যে আপনার জিপকোডে এরকম মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশ, কিন্তু ভোট দিতে যায় মাত্র ২০ শতাংশ। মার্সারপরিবারও গেদের দেখতে পারে না। তারা অ্যানালিটিকাকে বলল আপনার ভোটটা কব্জা করতে। অ্যানালিটিকা ফেসবুকের অ্যাডভার্টাইজিং প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আপনার জিপকোডকে টার্গেট করলো। একে বলে মাইক্রোটার্গেটিং, জিপকোডের সাথে অন্যান্য ক্যাটেগরির সেটের ইন্টারসেকশন করে তারা আপনার এলাকার সমমনা মানুষকে মাইক্রোটার্গেট করতে পারে।

তো সেই উপায়ে আজকে আপনার ফেসবুক ফীডের স্পন্সরড কন্টেন্টে দেখালো এমন একটা খবর যাতে আপনার পিত্তি জ্বলে যায়, ধরুন আপনার এলাকার কোন পদে একজন ডেমোক্র্যাট গে বা লেজ (উল্টোদিক থেকে চিন্তা করলে রিপাবলিকান তথাকথিত হোমোফোব) নির্বাচনপ্রার্থী। খবরটা সত্য হতে পারে, আর অসত্য হলেও আপনি জাংক মেইলের মত ট্র্যাশ করবেন না, মনে মনে একটা রাগের সুড়সুড়ি অনুভব করবেন এবং আপনি এটা মনে রাখবেন। হয়ত আপনার প্রোফাইলে শেয়ারও করবেন, অসত্য বলে আপনাকে কেউ চ্যালেন্জ করবে না, কেউ যেচে পড়ে ঝগড়া করতে যায় না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পরের হপ্তায় আপনাদের দেখানো হলো ট্রাম্পমামু ইলেকশানে জিতলে বলেছেন কোনো গে-লেজের সাধ্য নাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। মনে একটু আনন্দের সুড়সুড়ি লাগলো, লাইক দিলেন এবং ফেসবুকের অ্যালগরিদমও বুঝে নিল পরেরবার আপনি কি লাইক করবেন। অর্থাৎ এবার হয়ত স্পন্সর্ড কন্টেন্টও লাগবে না, আপনার সমমনা কোন ফ্রেন্ডের ফীড থেকেই এর পরের হপ্তায় পড়বেন নিউইয়র্ক বা ক্যালি, সে যেখানেই হোক, স্কুলের পাঠ্যসূচীতে গে-লেজবিষয়ে জ্ঞানদান করা হবে! সেসব জায়গার বাসিন্দা না হলেও, একজন দায়িত্ববান গার্জেন হিসাবে আপনার কলিজা কেঁপে উঠবে। সত্যাসত্য যাচাই না করে মনে মনে ঠিক করে ফেলবেন কে আপনার ভোটের যোগ্য।

শুধু ইন্টারনেট-ফেসবুক নয়, আপনার লোক্যাল টিভিচ্যানেলেও সমানে আপনাকে সুড়সুড়ি দেয়া হলে আপনি রান্নাঘরের ক্যালেন্ডারে ইলেকশানের তারিখটাকে লাল কালিতে বড় করে কয়েকবার দাগিয়ে ফেলবেন। যদি হাতে খুচরা পয়সা থাকে, সেটাও দান করবেন পছন্দের প্রার্থীর প্রচারণা তহবিলে। আর এই পুরো ব্যাপারটা যে ঘটে চলছে, আপনার পাশের জিপকোডের মানুষ হয়ত টেরও পাবে না! হয়তো তাদের উপর চলছে উল্টো ব্যবস্থা, আর তা নাহলে ভোটের দিন লেজ গুটিয়ে বসে থাকার চিকিৎসা।

উপরের সবকিছুই কিন্তু গে-লেজের সামনে ‘এন্টি’ বসালেও সত্য। যে ঘরানার প্রতিই আপনি সহানুভূতিশীল হোন না কেন, অ্যানালিটিকা না হলেও অন্য কম্পানির থেকে আপনার নিস্তার নেই! মানুষ আকৃষ্ট হয় যেটা তার কাছে জেল্লাদার বা ভয়ের তার দিকে। সত্যকে নয়, সে বিশ্বাস করে সেটাই যা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সত্য জিনিস বলতে গেলে কখনোই জেল্লাদার হয় না। দিনের পর দিন সমানে সুড়সুড়ির পর পাশাপাশি দুই জিপকোডের মানুষ হয়ে যাবে পদ্মার এপার আর ওপার, শুধু চাই বারুদে দিয়াশলাই! শার্লটসভিলে আর বার্কলীতে নির্বাচনের পরপর অনেকটা সেটাই হয়েছে। মানুষ মরেছে এদের এসব খেলার জন্যে!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের পুতিনের রঁসুইঘরের মত বদেরা এসবের থেকেও দু’কাঠি সরেস! আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ আর দৃঢ়বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এক ঘন্টার নোটিসে দাঁড়া করিয়ে ফেলবে ভুয়া খবরভরা বিশ্বাসযোগ্য দেখতে খবরের কাগজের ওয়েবসাইট। সত্য খবর বের করা আর লেখা কিন্তু অনেক কঠিন কাজ আর ব্যয়বহুল, সাংবাদিকতায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় (সেকাজটার ০.১ শতাংশমাত্র আমি এমুহূর্তে করছি!)। মিথ্যা খবর বানানো বহুত সস্তা আর সহজ, একটা ল্যাপটপ নিয়ে কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতে আপনিও বানিয়ে ফেলতে পারবেন।

তাই ধরুন, কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক নামকরা কাগজ না ঘাঁটিয়ে গুগলে হয়ত খুঁজতে গেলেন মিশিগানে হিজাবধারীদের পেটানো হচ্ছে নাকি না, গুগল তাকে হাজারখান ভুয়া খবর দেখাবে তার ধারণার স্বপক্ষে, একটা সত্যও দেখাবে না কারণ খবরটা সত্য নয় — কিন্তু সে কিন্তু বুঝবে উল্টো! আমাদের অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী এধরনের বানোয়াট খবর এসইওর মাধ্যমে গুগলে সবার উপরে বসাবে আর উপরের ফেসবুকীয় পন্থায় পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে। সেসব মিথ্যা খবরকে পরখ করে সত্যটা বের করে জানাতে কিন্তু আসল সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে যাবে, সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, কারণ ‌অসত্যের তো কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, সত্যেরও মা-বাপ নেই, কী বের করবে তারা! ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ভু্য়াখবরের সাথে সাথে অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী চটকদার ডায়ালগসমৃদ্ধ রাজনৈতিক কার্টুন, ভিডিও, জেপেগ বা জিফও বানায় (এগুলিকে বলে ‘মীম’), তাতে তো আরো মহা সুড়সুড়ি! আর দুনিয়ার কোটি কোটি সস্তা চীনা মোবাইল থেকে হ্যাক করে চুরি করা অন্য মানুষের ছবি আর তথ্যও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলি দিয়েও অ্যানালিটিকা বানিয়ে রেখেছে হাজারো ফেক প্রোফাইল (এ ব্যাপারে পরে সুযোগ হলে প্র্যাকটিক্যাল দেখাব), তাদের মাধ্যমে হাজারো লাইক দিয়ে দিয়ে কোন একটা অসত্য খবর বা মীমকে ভাইরাল বানিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।

আপনি হয়তো ফেক নিউজের ব্যাপারে খুবই, মানে খু-উ-ব-ই সাবধানি। এর থেকেও বিশ্বাসযোগ্য চান? শুনুন সিইও নিক্স সাহেবের বাণী। লিংক: https://youtu.be/mpbeOCKZFfQ

যুক্তরাজ্যের দু’তিনজন সাংবাদিক এই ভিডিওতে সেজেছেন শ্রীলংকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তার সহকারী, যাদের বাসনা সেদেশে রাজনীতি করে সফল হওয়া। সে উসিলা নিয়ে কথা বলতে গেছেন কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কর্মকর্তাদের সাথে, সাথে গোপনে রেকর্ড করেছেন কথোপকথন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




তাতে নিক্স সাহেব উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কিছু উপায়। উপরেরগুলিতো বলেছেনই, তার ওপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে যদি প্রতিপক্ষ খুব ভালো হয় আর তার নোংরামির কোন প্রমাণ না থাকে তাহলে কি করবেন। উত্তরে নিক্স বলছেন যে তারা প্রতিপক্ষের কাছে ভিনদেশী ব্যবসায়ী সেজে যাবেন, দেখাসাক্ষাত করে তাদের আস্থাঅর্জনের পরে কোন বেআইনি সুবিধার বিনিময়ে উৎকোচের প্রস্তাব করবেন। কিংবা উক্রেনীয় সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে যাবেন মিটিংয়ে, সেই জল আরো কিছুদূর, হয়ত বেডরুম পর্যন্ত, গড়াবে। আর গোপন ক্যামেরাতে এসব রেকর্ড করার পরে সেটা জমা থাকবে ইলেকশানের আগের রাতে ফেসবুক বা ইউটিউবে ছাড়ার অপেক্ষায়। জল যদি বেশিদূর নাও গড়ায়, ভিডিও এডিট করে অন্তত নোংরা একটা রূপ দেয়া সম্ভব। এবং সেটুকুই হয়ত সামান্য ভোটের মার্জিনে জেতার জন্য যথেষ্ট। পুতিনের আগের জীবনের কর্মস্থল সোভিয়েত গোয়েন্দাসংস্থা কেজিবি স্নায়ুযুদ্ধের সময় এপন্থার নিশ্ছিদ্র সদ্ব্যবহার করে, একে তাদের ভাষায় বলে কমপ্রোমাত (অনেকের সন্দেহ পুতিন সরকারের কাছে ট্রাম্পের কেলেংকারিময় কমপ্রোমাত আছে)।

ঐ একই আন্ডারকাভার ভিডিওতে ‌অ্যানালিটিকা দাবি করছে যে তারা সফলভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নামে-বেনামে এসব নোংরামির পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। তার মধ্যে তারা বলেছে আমেরিকা, কেনিয়া-নাইজেরিয়ার মত আফ্রিকার দেশ, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, চীন আর পূর্ব ইউরোপের ‌অনুল্লিখিত একটি দেশের কথা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!