আদি ইসলামী মুদ্রা – ১

আব্বাসী খেলাফতের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আস-সাফ্ফাহর রাজত্বকালের রৌপ্য দিরহাম এটি। সময়কাল ১৩৪ হিজরী, ৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ। বর্তমান ইরাকের বসরা শহরের টাঁকশালে মুদ্রিত। আমার সংগ্রহের। এটি মোটামুটি সহজলভ্য।

এক পিঠে আরবী কুফী হরফে লেখা ‘আল্লাহ ব্যতীত ঈশ্বর নেই, সাক্ষ্য দিচ্ছি তাঁর কোন শরীক (সমকক্ষ) নেই’, চারপাশে লেখা ‘আল্লাহর নামে এটি মুদ্রিত হয়েছে বসরায়, সাল চার ত্রিশ একশ।’ অপর পিঠে লেখা, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর বার্তাবাহক (রসুল)’, আর চক্রাকারে চারপাশে ‘মুহাম্মদ রাসুলাল্লাহকে আমি প্রেরণ করেছি পথনির্দেশনা ও প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসসহকারে, অন্যান্য সকল ধর্মকে প্রতিস্থাপনের জন্যে, যদিও শরীককারীরা তা অপছন্দ করে।’

প্রথম আব্বাসী খলিফা আস-সাফফাহর আমলের দিরহাম

দেখার মত দুটো জিনিস এখানে। এক, হরফগুলোর কোন হরকত বা ভাওয়েল মার্ক নেই। এমনকি নুক্তা কিংবা কনসোন্যান্ট ডিস্টিংশন মার্কও নেই। কেউ সঠিক সূত্র না জানলে, দ (দাল) আর ধ/জ (জাল) গুবলেট করতে পারে। একইভাবে, ব (বা), ত (তা), থ/ছ (থা) এগুলির জন্যেও একটাই হরফ। দ (দদ), ছ/স (সদ) এদেরও একই হাল। স (সিন), শ (শিন) এর অ্যাম্বিগুইটি ‘লা সা/শারিকালাহু’তে পরিপূর্ণরূপে দৃশ্যমান।

আদিতে লিপিবদ্ধ কুরআনেরও একই অবস্থা ছিল। ইসলামী বিবরণীমতে, কুরআনের অর্থ পাল্টে যাবার ভয়ে তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় এগুলি ঠিকঠাক করা হয়। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, সে সংস্কারের কৃতিত্ব ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের। কিন্তু আমার আন্দাজে কাগজের ব্যবহার পুরোমাত্রায় শুরু হবার আগে এ সংস্কার সম্পূর্ণ হয়নি। সেকথায় পরে আসছি। মক্কা থেকে মদিনায় আদি মুসলিমদের অভিবাসনের দীর্ঘ ১৩৪ বছর পরের এ মুদ্রা এ থিওরির একটা সম্ভাব্য প্রমাণ।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আরেকটা চোখে লাগার মত ব্যাপার হল, কুরআনের ৯:৩৩ আয়াত যে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। শুরুটা সামান্য মডিফাই করে মুদ্রিত হয়েছে। এই নগণ্য পরিবর্তনটাও সম্ভবত কুরআন পরিবর্তনের বর্তমান ইসলামী ট্যাবুর পরিপন্থী।

এই মু্দ্রাটি ইসলাম ধর্ম ও আরব খেলাফতের ইতিহাসের খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ সময়কার। ১৩০ হিজরী নাগাদ পূর্ববর্তী উমাইয়্যা খেলাফতের আসন টলায়মান। উমাইয়্যাদের পারিবারিক ‌অন্তর্কলহ থেকে গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে এক দফা। তাছাড়াও বিভিন্ন সুদূর প্রদেশের গ্যারিসন টাউনগুলিতেও বিদ্রোহ। এসব সামাল দিয়ে খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান রাজধানী হার্রানে এসে পৌঁছনোর মাসখানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ‘আব্বাসী বিপ্লব।’

একে বিপ্লব নাম দেবার মূল কারণ বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-জাতের একটা বৈচিত্রময় মোর্চা উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এদের নেতৃত্বে যদিও ছিল মুহাম্মদ(সা)এর চাচা আব্বাসের বংশনামধারী এক আরব পরিবার, বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল আরবদেরই বর্ণভেদী রাজত্ব উচ্ছেদ করা। উমাইয়্যা বংশটি তৃতীয় রাশিদুন খলীফা উসমানের পরিবারের সাথে জড়িত। উমাইয়্যা প্রথম খলীফা মু্য়াবিয়ার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত বাঁধে। আলীর মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের নেতৃত্বে আদি শিয়ারা কুফা শহরে সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় উমাইয়্যা খলীফা ইয়াজিদ কারবালার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এদের নিষ্ঠুরভাবে নিকেশ করে দেন। শিয়া-সুন্নী বিবাদের সেটা শুরুমাত্র।

উমাইয়্যা শাসনামলে বিজিত দেশগুলোতে আরবরা ছিল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। বিদেশী-বিধর্মীদের জানমাল ‘রক্ষার’ বিনিময়ে পোল ট্যাক্স (জিজিয়া) আর ভূমিকর (খারাজ) আদায় করে আরব সৈন্য আর সেনাপতিদের খরচ ওঠানো হত। এ কারণে বিধর্মীদের ইসলামে দীক্ষিত করতে উমাইয়্যাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। যতক্ষণ বিজিত জনগণের প্রতিনিধিরা কড়ায় গন্ডায় কর বুঝিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পদবী-ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর কোন আগ্রাসন হত না। পুরো উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের অনারব জনগণের ১০ শতাংশের নিচে ছিল নতুন মুসলিম।

কিন্তু এসকল মুসলিমরা পরিগণিত হত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। কোন ক্ষেত্রে কর তো দিতে হতই, তার পাশাপাশি পুরনো নাম পরিত্যাগ করে আরবী নাম নিতে হত। আর ‘অ্যাটাচড’ থাকতে হত কোন না কোন আরব ট্রাইবের সাথে। এসব ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নাম ছিল ‘মাওয়ালি’, ইংরেজীতে ‘ক্লায়েন্ট’। আদিযুগের অনেক সাম্রাজ্যেই বিজিত রাজ্যের বনেদী বংশের সন্তানদের সম্রাটের দরবারে হাজির থেকে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে নিতে হত। এ ‌অনেকটা সেরকম।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সাধারণ অনারবদের সাথে আরবদের বিয়েশাদীর ব্যাপারেও উমায়্যাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদি কোন বড় শহর ইসলামী সৈন্যদলের দখলে আসত, আরব সৈন্যদের অনুমতি ছিল না সে শহরের ভেতরে বসবাসের। তাদের জন্যে অন্যত্র আলাদা ক্যাম্প তৈরি করা হত, যেগুলি পরবর্তীতে দুর্গশহরে রূপান্তরিত হয়। এভাবে আরব জাতিগোষ্ঠীকে ‘সংমিশ্রণ’ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে উমাইয়্যারা।

অন্যদিকে বিজিত বিশাল এলাকা শাসন আরব দলপতিদের পক্ষে একলা সম্ভব ছিল না। খলীফা আর তার দোসররা শিক্ষিত হলেও সৈন্যদের অধিকাংশ ছিল অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত। বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে উমাইয়্যাদের দরকার ছিল আগের আমলের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাহায্য। সেভাবে সিরিয়ার প্রাক্তন বিজ্যান্টিন প্রদেশগুলিতে তারা প্রচুর আরামায়িক, গ্রীক ও লাতিন ভাষায় শিক্ষিত মনোফিসাইট খ্রীষ্টান কেরানী পায়। মনোফিসাইটদের সাথে আবার মুসলিমদের মিল হলো তারাও হোলি ট্রিনিটি কনসেপ্টটা বিশ্বাস করে না। আর ইরাকের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে আরব নেতৃত্বকে সাহায্য করে পাহলাভী-ফার্সী ভাষায় শিক্ষিত আরেকদল বুদ্ধিজীবী। এদের ধর্ম ছিল জোরোয়াস্ট্রিয়ান, মানিকেইজম, মাজদাকিজম, কিংবা নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি।

সিরিয়ার ঐ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই কিন্তু পুরনো গ্রীক ক্লাসিকগুলি ইউরোপের অন্ধকার যুগে বেঁচে গিয়েছিল। তারা প্লেটো-অ্যারিস্টোটল প্রমুখের দর্শনতত্ত্বের বইগুলো আরামায়িক-আরবী ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করে। পরে সেগুলি ছড়িয়ে যায় আরব খেলাফতের আনাচেকানাচে। স্পেন থেকে আবার সেগুলি ফিরে যায় পশ্চিম ইউরোপে।

কিন্তু পর্যায়ক্রমে উমাইয়্যারা এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। তাদের খেলাফতের শেষ নাগাদ সরকারী চাকরি পাবার জন্যে আরবীনামধারী মুসলিম হওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সরকারী ভাষা হিসাবে আরবীকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে উমাইয়্যারা। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নাকি এ ব্যাপারে এত গোঁড়ামি করেন যে, খওয়ারিজমি ভাষায় লেখাপড়াজানা সকল বুদ্ধিজীবীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আর ভাষাটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




অর্থাৎ, উমাইয়্যা শাসনে অসন্তুষ্ট-ক্ষুব্ধ ছিল বেশ কটি দল। সর্বাগ্রে, বিভিন্ন শিয়া বা শিয়াঘেঁষা দল, যাদের বিশ্বাস খেলাফতের অধিকার কেবলমাত্র মুহাম্মদ(সা)এর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের, অর্থাৎ আলীর বংশধরদের। তারপর, বিভিন্নদেশীয় অনারব মুসলিম, যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক (আজামী) হিসাবে গঞ্জনা ভোগ করে আসছে — এদের মধ্যে স্বপরিচয়ের ব্যাপারে সবচে একগুঁয়ে ছিল ইরানীরা। তৃতীয়ত, ইসলামভিন্ন অন্যান্য ধর্মের বনেদী বংশগুলি, বিশেষ করে সিপাহবদ নামে তাবারিস্তানের জোরোয়াস্ট্রিয়ান সামন্তরা। চতুর্থত, উমাইয়্যা সরকারী কর্মচারীদের একটা বড় অংশ, যারা অনেকে ছিল অমুসলিম কিংবা মুসলিম হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর।

আব্বাসী বিপ্লবের ডামাডোল প্রথমে শুরু হয় প্রত্যন্ত খুরাসান প্রদেশে। উত্তর আফগানিস্তান ও বর্তমান তাজিকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান-উজবেকিস্তানের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এই প্রদেশ। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় উমাইয়্যাদের এখানে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় জনশূন্য এলাকায় আরব-অনারবরা অবাধে মেলামেশা করত। আরবীর পাশাপাশি ফার্সীতেও বাতচিত শুরু করে দেয় আরবরা, পারসিক পোশাকও পড়তে শুরু করে। খোরাসানের কোন আরব ইরাকে গেলে নাকি তার ভাষা সম্পূর্ণ বোঝার ক্ষমতা ছিল না কারো।

এই খোরাসান ছিল নানা ধরনের অভিনব বিশ্বাসে ভরপুর। প্রাক্তন সাসানী সাম্রাজ্যের প্রজা ইরানী নব মুসলিমরা ধর্মান্তরের পরও তাদের পুরনো ঐতিহ্যগত পরিচয় ধরে রেখেছিল। জোরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের ‘মিলেনারিয়ান’ বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে কোন এক ত্রাতার উত্থান ঘটবে, যিনি আলোর পক্ষে যুদ্ধ করে অন্ধকারকে পরাজিত করবেন, এসব বিশ্বাস তখনো প্রগাঢ়ভাবে বেঁচে গেছে এদের মধ্যে। বিশেষ করে তাদের‌ই অতীত সভ্যতার ধ্বজাধারী পারসিক সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিক্রিয়ায় এদের মনস্তত্ত্বে কোন এক ‘মাহদীর’ আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১২৫ হিজরী সালটিও এদের কাছে মাহদীর আগমনের নিয়ামক হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এসকল নওমুসলিম এবং মানিকেইজম ধর্মের অনুসারীদের সমতুল্য মিলেনারিয়ান বিশ্বাসকে ভালভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় কায়সানি হাশেমী বলে এক শিয়া দল। উমাইয়্যারা যেখানে ইসলামধর্মপ্রচারে ছিল বিমুখ, সেখানে এরা মূলধারার ইসলামের সাথে শিয়া ও মানেকইজমের সিনক্রেটিজম ঘটিয়ে খোরাসানের বিশাল জনসাধারণকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর তাদের লুক্বায়িত ইমাম আবির্ভূত হয়ে সারা বিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করবেন। এই শিয়াদের নেতা ছিল আবু মুসলিম আল খোরাসানী বলে এক রহস্যাবৃত সেনাপতি।

অপরদিকে, আবুল আব্বাস ও তার চাচাদের পরিচিতি ছিল পুরো ইসলামী জগতে। আবু মুসলিমের সাথে আব্বাসী পরিবার গোপনে যোগাযোগ করে। আবু মুসলিমের দৃষ্টিতে, বিপ্লবে আব্বাসীদের নেতৃত্ব আর শিয়া সেনাদলের মূল যৌথ লক্ষ্য হল শিয়া ইমামত প্রতিষ্ঠা। আব্বাসী পরিবারের সদস্যরা কুফা-বসরার মত বড় শহরে তাদের পরিচিতদের মাধ্যমে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়। খোরাসানের উমাইয়্যা গভর্নরকে পরাস্ত করে আবু মুসলিম পূর্বদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকেন ইরাকের দিকে।

আবু মুসলিম আর আব্বাসীদের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে উমাইয়্যা সেনাদল পরাজিত হয়, আর মূল শহরগুলিতে তাদের নিযুক্ত গভর্নরদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় বিপ্লবীরা। ৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইরাকসহ খেলাফতের পূর্বাঞ্চল চলে আসে আব্বাসীদের দখলে। সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে তাদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন দ্বিতীয় মারওয়ান। মিশরে পালিয়ে যাবার পথে ধরা পড়েন পরিবারসহ। নতুন খলীফার নির্দেশে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়। বেঁচে যাওয়া উমাইয়্যা রাজপরিবারের সদস্যদের চালাকি করে নেমন্তন্ন করে এনে খাবার টেবিলে হত্যা করেন আবুল আব্বাস। এভাবে উমাইয়্যাদের পুনরুত্থানের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন তিনি। একমাত্র একজন উমাইয়্যা রাজপুত্র কোনরকমে স্পেনে পালিয়ে যান। সেখানে আন্দালুসিয়ার উমাইয়্যা রাজ্য চালু থাকে আরো তিনশ বছর।

খলীফা হিসাবে আবুল আব্বাস যে দাপ্তরিক নাম গ্রহণ করেন তা হল আস-সাফ্ফাহ, যার অর্থ শেডার অব ব্লাড, রক্তপাতকারী। প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করতে এ নাম নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তার থেকেও বড় তাৎপর্য হলো এটি একটি ‘মেসায়ানিক’ নাম। অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার জন্য যে যোদ্ধা-ত্রাতার আবির্ভাব হবে, তার সম্মাননাকর নাম এটি। বোঝা যাচ্ছে, আস-সাফ্ফাহর অনুসারীদের চিন্তাচেতনার ওপর মিলেনারিয়ানিস্ট প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু তিনি নন, দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর (‘বিজয়ী’), তৃতীয় খলীফা আল-মাহদী (‘ঐশ্বরিকপথনির্দেশিত’), প্রমুখের নামেও মিলেনারিয়ান প্রভাব উল্লেখযোগ্য।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আবার দু’দলের যুদ্ধে আব্বাসীদের কালো পতাকার বিপরীতে উমাইয়্যাদের সাদা পতাকার ব্যবহারটাও পারসিক সংস্কৃতির নওমুসলিমদের জন্যে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ইরানী সভ্যতায় সাদা রং মরণশোকের প্রতীক। এরকম ছোটখাট ব্যাপারগুলি যে শুধু আব্বাসী সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলে তা নয়। আব্বাসী বিপ্লবের প্রথমভাগে শিয়া প্রপাগান্ডা হিসাবে কারবালার যুদ্ধের শোকাবহ রিএন্যাক্টমেন্টও চালু ছিল। এখনো ইরানে সে ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হয়। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব আব্বাসীদের সমসাময়িক অনারব সুন্নি নওমুসলিমদের ওপরও চলে আসে। সেকারণে আজকের মূল আরব ভূখন্ডে কারবালার তাৎপর্য খুব বেশি নেই, অথচ ইরান-ইরাক ও ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।

আস-সাফ্ফাহ পাঁচ বছর শাসনের পর গুঁটিবসন্তে মারা যান। তারপর খেলাফতের শাসনভার নিয়ে আরো এক দফা রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত ঘটে। তার ভাই ও চাচাদের সাথে এক ভাতিজা আর শিয়া সেনাপতি আবু মুসলিমের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। নতুন খলীফা আল-মনসুর চক্রান্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন। শিয়া ইমামতের স্বপ্ন সেখানেই আপাতত মাটিচাপা পড়ে। আব্বাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার বদলার প্রস্তুতি নিতে শিয়া গোত্রগুলি আবারো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের সকলেই ধর্মপ্রচার বা দাওয়া’র মাধ্যমে অভূতপূর্ব রিক্রুটমেন্ট চালায়। এর আগে ইসলাম ধর্মে অফিশিয়ালি ধর্মপ্রচার তেমন ছিল না। ইসলাম ছিল শুধুমাত্র আরব বিজেতা ও তাদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্মান্তরিত মাওয়ালি ক্লায়েন্টদের প্রিভিলেজ।

আব্বাসী খেলাফতের প্রশাসনব্যবস্থায় আরবদের পাশাপাশি অনারব, এমনকি অমুসলিম বা নামমাত্র মুসলিম কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল। বার্মাকী বলে একটা বনেদী পরিবার হয় আব্বাসীদের বংশানুক্রমিক উজির। এদের পূর্বপুরুষ ছিল হয় পারসিক জোরোয়াস্ট্রিয়ান নয়ত আফগানিস্তানের ভারতীয় বৌদ্ধসংঘের প্রধান। আল-মুকাফ্ফা নামে জোরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিতদের এক বংশধর ও দ্বিতীয় জেনারেশনের মুসলিম মনীষী ভারতীয় শাস্ত্র ‘পঞ্চতন্ত্রের’ ফারসী সংস্করণের আরবী অনুবাদ করেন। সাসানী আমলে রাজাদের রাজকার্য পরিচালনার গাইড হিসাবে এ বইয়ের প্রচলন ছিল। এদের প্রভাবে সিরিয়াভিত্তিক উমাইয়্যাদের বিজ্যান্টিন স্টাইল থেকে উল্টো আরো বেশি প্রাচ্যধর্মী হয়ে পড়ে প্রশাসনব্যবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা হয় আরো বেশি কেন্দ্রীভূত। সাসানী শাহেনশাহদের মত খলীফার অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় খেলাফতের সুদূরতম প্রদেশের কাজকর্ম। অর্থাৎ যেখানে উমাইয়্যারা পছন্দমত ট্রাইবাল চীফদের ওপর প্রাদেশিক শাসনভার পুরোপুরি ছেড়ে দিতেন, সেখানে আব্বাসী প্রশাসন হয় সাসানী পারসিকদের মত কেন্দ্রীভূত, আর একনায়কতান্ত্রিক। অবশ্য দুই খেলাফতের আমলেই ধর্ম থেকে রাজকার্য পৃথক ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।

আব্বাসী খেলাফতে ইরানী এমন প্রভাবের পাশে পুরনো আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যেসব আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে শহুরে হতে পেরেছে তারা বর্তে গেছে, আর বাকিরা সম্ভবত ফিরে গেছে তাদের আদি মরুময় বাসস্থানে, নয়ত আরো দূরদূরান্তে কোন নতুন রাজ্যজয়ে।

ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও আব্বাসী বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলছিলাম, এই মুদ্রার কুফী হরফের কথা। এর আবির্ভাবের এক বছর আগেই মধ্য এশিয়ায় চীনা তাং সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন আবু মুসলিম। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল চীনা কাগজের কারিগর। তাদের মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে কাগজ। এর ফলে আরবী লিপির চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। আগে পাথরে-চামড়ায় লিখতে হত কষ্ট করে। আর এখন কলম দিয়ে কয়েক খোঁচায় কাজ হয়ে যায়। নুক্তা-হরকত ইত্যাদি দিয়ে অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ বোঝানোর বাঁধা আর থাকে না। সাথে উদ্ভব ঘটে আরবী ক্যালিগ্রাফীর। কুরআনের সাথে সাথে হাদীস ও গ্রীক ক্লাসিকগুলিও প্রথমবারের মত সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

আব্বাসী আমল পর্যন্ত কিন্তু সুন্নাহ বলতে শুধু মুহাম্মদ(সা) নয়, তার যত সঙ্গীসাথী, অন্যান্য আদি মুসলিম, প্রাক্তন ধর্মপরায়ণ চার খলীফা, এমনকি কিছু ন্যায়বিচারক উমাইয়্যা খলীফা, তাদের ট্র্যাডিশনকে একটা ব্ল্যাংকেট টার্ম দিয়ে বোঝানো হত। ১৫০ হিজরীতে ইমাম শাফিয়ীর হাত ধরে আজকের হাদীস সংগ্রহগুলির সূচনা হয়। সুন্নাহ টার্মটা আরো নির্দিষ্ট হয়ে মুহাম্মদ(সা)এর ট্রাডিশন বোঝাতে শুরু করে। এ পর্যন্ত হাদীসগুলি লোকমুখে বেঁচে ছিল। অর্থাৎ, ইসলামের প্রথম ১৫০ বছরে হাদীস জানা ও পালন করার কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেসব প্রমাণ রেট্রোস্পেক্টিভ। ইসলামের ইতিহাসসংক্রান্ত প্রথম বইগুলিও লিখিত হয় আব্বাসী শাসনামলে। সেগুলিও ছিল শ্রুতিনির্ভর, কোন ক্ষেত্রে বহুলাংশে বাইবেল-তোরার বিষয়বস্তু দ্বারা সাপ্লেমেন্টেড। এধরনের ইহুদী ঐতিহাসিক প্রভাবকে নাম দেয়া হয়েছে ইসরাইলিয়াত।

আব্বাসী খলীফাদের আমলে আজকের সুন্নী মতবাদের শুরু হলেও অন্যান্য অনেক যুক্তি ও দর্শননির্ভর বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। তার পাশাপাশি সুফী বিশ্বাসের যাত্রা শুরুও এদের সময়। অনেকভাবে উমাইয়্যা শাসনামলের চিন্তাধারার আড়ষ্টতাগুলি কেটে যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও চিন্তার মোটামুটি স্বাধীনতা ছিল। সিল্ক রোডের বাণিজ্যের মাধ্যমেও বহু কিছুর চালাচালি হয়। শেষ পর্যন্ত আব্বাসীদের সাসানী স্টাইলের অ্যাবসলুট পাওয়ারই ছিল তাদের অধঃপতনের মূল কারণ। পরের দিকের অকর্মন্য খলীফাদের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত মানুষ ধর্মের মাঝে ন্যায়বিচার খুঁজে ফেরে। তার সুযোগ নিতে তৈরিও ছিল কিছু ধর্মীয় নেতা। এদের টানাপোড়েনের রাজনীতির বলি হন ইসলামের স্বর্ণযুগের মনীষীদের অনেকে, তাদের বহু কাজ হয় বিস্মৃত, বহু গ্রন্থাগার হয় ভস্মীভূত। উমাইয়্যা-আব্বাসী দু’খেলাফতের ক্ষেত্রেই সমান খাঁটে এই প্রবাদবাক্য, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি!’



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




২ Replies to “আদি ইসলামী মুদ্রা – ১”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!

preload imagepreload image