রাষ্ট্রবিহীন জাতি

আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দীঅধ্যুষিত এলাকার মানচিত্র

কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।

ইরাকী কুর্দিস্তান রোডসাইন, তিন ভাষায়
সিরিয়ার ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত রোজাভা এলাকায় লাতিন হরফে কুর্দী সিনিয়েজ

অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আ‌ইয়ুবী শাসনামলে।

সালাউদ্দিনের চিত্রসম্বলিত আইয়ুবী মুদ্রা

প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি ‌অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের ‌অন্যান্য জাতির মত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের ‌অন্যান্য ‌অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।

তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।

‌আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।

অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরব প্রতিনিধি ভবিষ্যৎ জর্দানী রাজা ফয়সাল, সৌদী নন, হাশেমী

যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।

প্যারিস শান্তি আলোচনার ‌অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।

উইলসনিয়ান আরমেনিয়া
কিং ক্রেন কমিশনের রিপোর্ট

কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, ‌অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।

এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।

লোজান চুক্তি পরবর্তী মানচিত্রে উইলসনিয়ান আর্মেনিয়া ও কুর্দীস্তান অনুপস্থিত

১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।

মাহমুদ বারজানজী — “কিং ‌অফ কুর্দীস্তান”

বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।

আদি ইসলামী মুদ্রা – ৩

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে সিরিজের তৃতীয় লেখা এটি। প্রথম পর্বে ছিল উমাইয়া খেলাফতের পতন ও আব্বাসিয়াদের উত্থানের ইতিহাস। দ্বিতীয় পর্বে ছিল আরব-বিজ্যান্টিন মুদ্রার কথা, যেগুলিতে ক্রুশ, মানব অবয়ব ও অন্যান্য অনৈসলামিক প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে বিসমিল্লাহ ইত্যাদি লেখা।

আজকের পাঁচটি রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম আর একটি তাম্রমুদ্রা বা ফালস সাসানী রাজবংশ থেকে শুরু করে উমাইয়া খলীফাদের গভর্নরদের আমলের — ইরাক ও ‌অন্যান্য প্রদেশের। সাসানীদের সাম্রাজ্যের দ্রুত অধঃপতনের পেছনের কাহিনীর পাশাপাশি লিখছি নতুন আরব প্রশাসনিক নীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণী।

ছয়টি মুদ্রা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। আপাতদৃষ্টিতে সবগুলি দেখতে প্রায় একই। কিন্তু এরা আলাদা আলাদা সময়ের। প্রথম দুটি সাসানী সাম্রাজ্যে আর শেষের চারটি উমাইয়া খেলাফতের পূর্বাংশের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে প্রচলিত ছিল।

১। সাসানী শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরুর দিরহাম, ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ
২। সাসানী শাহেনশাহ তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের দিরহাম, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ

সাসানী মুদ্রাগুলো যথাক্রমে শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরু (মুদ্রার তারিখ ৬২০ খ্রীষ্টাব্দ) আর তার পৌত্র তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের (৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। দুটোতেই তাদের প্রোফাইল অংকিত। মাথার ওপর ‘ফারাভাহার’ — পাখাওয়ালা সূর্য — জোরোয়াস্ত্রিয়ান মঙ্গল দেবতা আহুরা মাজদা অথবা শাহেনশাহের গার্ডিয়ান এঞ্জেল ফেরেশতার প্রতীক। চার ধারে চাঁদতারা — ঊর্বরতা ও জ্ঞানের দেবী অনাহিতার (ভারতের সরস্বতী) প্রতীক। সম্রাটের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়বের সামনে পিছনে পাহলভী হরফে তার নাম-পদবী লেখা। অপরপিঠে দুই গদাধারী রক্ষকের মাঝে জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মমতের পবিত্র অগ্নিপ্রজ্জ্বলিত মশালের বেদী। সাথে পাহলভী হরফে টাঁকশালের নামের আদ্যাক্ষর।

৩। ইরাকের মুসলিম গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আমিরানের দিরহাম, ৬৬৩/৬৬৮ সাল
৪। ইরাকের মুসলিম গভর্নর জিয়াদ ইবনে আবি সুফিয়ানের দিরহাম, ৬৬৮/৬৬৯ সাল

তৃতীয় ও চতুর্থ মুদ্রার ডিজাইন আগেরগুলোর মতই। কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, সম্রাটের ছবির ফ্রেমের ঠিক বাইরে আরবী কুফী হরফে বিসমিল্লাহ লেখা। চতুর্থটিতে বিসমিল্লাহ রাব্বী। সম্রাটের মুখচ্ছবির আশপাশ দিয়ে লেখা নাম আর সাসানী সম্রাটের নয়, আরব গভর্নরদের! প্রথমটায় পাহলভী হরফে লেখা ‘প্দুল ‘জিজ ঈ প্দুল ঈ মীল’ন’ — আব্দুল আজিজ ই আব্দুল্লাহ ই আমিরান (৬৬৩/৬৬৪)। দ্বিতীয়টিতে জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান (৬৬৮/৬৬৯)।

দু’জনেই বেশ পরাক্রমশালী উমাইয়া গভর্নর। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় থেকে মুয়াবিয়ার আমল পর্যন্ত সে আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তুতো ভাই উসমানের গুপ্তহত্যার পর শুরু হওয়া প্রথম গৃহযুদ্ধের সময় (৬৫৬-৬৬১) হযরত আয়েশা, তালহা ও জুবায়েরের আলীবিরোধী দলকে বসরাতে আশ্রয় দেন তিনিই। আর জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান ছিলেন আলীর মনোনীত গভর্নর, তার হত্যার পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে শুরুতে আলীপন্থীদের সমর্থন দিলেও মুয়াবিয়া তাকে সৎভাইয়ের মর্যাদা দিয়ে দলে টেনে নেন।

৫। দ্বিতীয় খসরুর দিরহামের চার ধার কেটে তাকে খেলাফতের মাপে নিয়ে আসা হয়েছে
৬। ইরাকের মুসলিম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের তামার ‘পাশিজ’ বা ‘ফালস’, ৬৯৪/৬৯৫ সাল

আর শেষ দুটি মুদ্রার প্রথমটির চারধার থেকে বাড়তি ধাতু কেটে ফেলা হয়েছে। যদি তা না করা হত, আলাদা করে আরব মুদ্রা হিসাবে বোঝা সম্ভব ছিল না। চারধার কাটার কারণ তার ওজনটাকে নতুন আরব খেলাফতের দিরহামের ওজনের স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসা। আর শেষ মুদ্রাটি তামার ‘ফালস’ (৬৯৪/৬৯৫)। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নামে আরেক শক্তিশালী ইরাকী গভর্নরের। তিনি ছিলেন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের খুবই বিশ্বাসযোগ্য এক সেনাপতি। মুদ্রার এক পিঠে সাসানী সম্রাটের প্রতিকৃতি, অপর পিঠে একটি ঘোড়ার ছবি!

পারস্য সাম্রাজ্যে আরব সেনাভিযানের প্রাক্কালে সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। মুদ্রায় দেখানো দ্বিতীয় খসরুকে সিংহাসনে বসার সাথে সাথে বাহরাম চোবিন নামে এক সেনাপতির বিদ্রোহ সামাল দিতে হয়। বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে জাতশত্রু বিজ্যান্টিনদের সাহায্যের জন্যে হাত পাতেন তিনি। সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সফলতার পর বিজ্যান্টিনদের হাতে মেসোপটেমিয়ার কয়েকটি সমৃদ্ধ শহর ছেড়ে দেন খসরু।

দ্বিতীয় খসরুর সময় সাসানী সাম্রাজ্যের বিস্তার, আনুমানিক ৬১০ সাল

বিজ্যান্টিনদের সাথে শান্তির সুযোগ নিয়ে নিজের গদি পাকাপোক্ত করতে মনোনিবেশ করেন খসরু। যে দুই চাচা তাকে রাজক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করেন খসরু। তার ফলে এতদিনের যে সাসানী-আর্শাকী রাজবংশের একতার ওপর ইরানী সাম্রাজ্য দাঁড়িয়েছিল, তাতে চিঁড় ধরতে শুরু করে। অভিজাতবংশীয় সেনানায়ক ও জমিদাররা (দেহগান) দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

একই সময়ে নিজের হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইরাকের পাপেট রাষ্ট্র আল-হিরার আরব লাখমীবংশীয় রাজা আল-নুমানকে বন্দী করে হত্যা করেন খসরু। এই রাষ্ট্রের যাযাবর ও অর্ধযাযাবররা এতদিন শত্রু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে সৈন্য-সামন্ত ও সামরিক বাফার এলাকার নিয়ন্ত্রণ যুগিয়ে এসেছে সাসানীদের। এভাবে বিজ্যান্টিন ও মরু এলাকার আরব ট্রাইবগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যূহ রাতারাতি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

খসরুর ভাগ্য পাল্টে যেতে শুরু করে ৬০২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। তার মিত্র বিজ্যান্টিন সম্রাট মরিস নিজ সেনাপতি ফোকাসের হাতে খুন হন। ফোকাস নিজেকে সম্রাট দাবি করলে মরিসের পুত্রকে সিংহাসনে আসীন করার ‘ন্যায়সঙ্গত’ লক্ষ্য নিয়ে খসরু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। প্রথম প্রথম খুব দ্রুততার সাথে আগের হারানো শহরগুলি পুনরুদ্ধার করে ফেলেন। ঈজিয়ান সাগরে নৌযুদ্ধেও সফলতা পায় সাসানীরা, মিশরও তাদের দখলে আসে। বিজ্যান্টিন সম্রাটের প্রাসাদে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। ফোকাসকে সরিয়ে সম্রাট হন হেরাক্লিয়াস আর খসরুকে শান্তির প্রস্তাব পাঠান। খসরু তাতে কান না দিয়ে উল্টো মরিসের পুত্র থিওডসিয়াসকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেবার দাবি করেন। তার সেনাপতি শহরবরাজ/সরফরাজ দামেস্ক ও জেরুজালেম দখল করে যীশুখ্রীষ্টের ট্রু ক্রস লুট করে নিয়ে যান।

৬২৬এ হেরাক্লিয়াস সাসানীদের কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হন। এ সময় থেকে যুদ্ধের মোড় বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। পূর্ব ফ্রন্টে তুর্কী ও হেফথালাইটদের সাথে মিত্রতাস্থাপনের পর দ্রুত সিরিয়া-মেসোপটেমিয়ায় বেশ কিছু যুদ্ধে বিজয় পান হেরাক্লিয়াস। এরপর একেবারে সাসানী রাজধানী ক্টেসিফোনে এসে হাজির হয় বিজ্যান্টিন সেনাদল। এবার খসরুর সময় এল অতীতের সব অত্যাচারের মাসুল দেবার। তার বিরোধী পাহলভী বনেদী পরিবারগুলো বিদ্রোহ শুরু করে। এদের মধ্যে ছিলেন শাহনামাখ্যাত রুস্তম ও তার পরিবার। তারা খসরুর কারাবন্দী পুত্র শেরোয়েকে মুক্ত করে তাকে শাহেনশাহ ঘোষণা করে। শেরোয়ে রাজকীয় নাম নেন কাভদ। বিজ্যান্টিনদের হারানো রাজ্যগুলি ফিরিয়ে দেন, পাশাপাশি উত্তর ইরাক তাদের কাছে ছেড়ে দেন। বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে শান্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতার তাড়নায় নিজ পিতাকে তো হত্যা করেনই, স্বপরিবারের আপন ভাই, সৎ ভাই সকলকে নিকেশ করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। ফলে সাসানী পরিবার প্রায় নির্বংশ হয়ে যায়, রাজা হবার যোগ্য কোন বংশধর আর থাকে না।

কাভদকেও অচিরেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। তাকে সরানোর পর চার বছরে দশবার সম্রাট পরিবর্তন হয়। শেষমেশ শাহেনশাহ হন খসরুর এক নাতি তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ। ৬৩২ সালে রাজাভিষেকের সময় তার বয়স ছিল মোটে আট বছর। তিনিই ছিলেন ইসলামী বিজয়াভিযানের সময় সাসানী সম্রাট। তার রাজত্বের শুরুতে পুরো সাম্রাজ্যের ওপর তার তেমন কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত তার দেশ। নানা প্রদেশে প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছে বিভিন্ন গভর্নররা। ধীরে ধীরে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে আবার সাসানী সাম্রাজ্যকে একীভূত করতে হয় তাকে। কিন্তু ততদিনে আরবদের উত্থান শুরু হয়ে গেছে। ৬৫১ সালে পলায়নরত অবস্থায় এক মিলার তাকে চিনে ফেলে, তাকে হত্যা করে মুসলিম সেনাদল নয়, বরং বিরোধীবংশীয় এক সামন্ত।

এ হলো সাসানীদের সমসাময়িক অবস্থা। আরব মুসলিমদের মাঝে এ সময়ে কি ঘটছিল তা বুঝতে হলে শুরু করতে হবে ইরাক ও তার ডেমোগ্রাফি দিয়ে।

এ সময়ের এক হাজার বছর আগের আকিমেনিদ আমল থেকেই ইরাক বা মেসোপটেমিয়া ইরানী গোত্র ও রাজবংশগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু অতীতে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে ছিল অ্যাসিরীয়-ব্যাবিলোনীয় সাম্রাজ্যের জন্মভূমি। এদের মহান রাজা নেবুকাদনেজার বা বখত-নসর ইন্দোআর্য পারসিক ছিলেন না, ছিলেন আরব ও হিব্রুদের মতই সেমিটিক গোত্রীয়। পারসিকরা যখন অতীতে ছিল স্তেপের শিকারী ও মেষপালক গোত্র, তখন ব্যাবিলোনিয়ার সাম্রাজ্য ছিল নাগরিক সভ্যতার পুরোধা। কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে এরা ছিল পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি।

অর্থাৎ ইরানী বনেদী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও ইরাকের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ তখনো সেমিটিক আরামাইক ভাষায় কথা বলত, ঠিক যেমনটা ছিল বিজ্যান্টিন সিরিয়ার সিরিয়াকভাষীরা। এদের ভাষার সাথে ফারসীর মিল নেই, মিল আছে আরবী ও হিব্রুর।

এসকল আরামায়িকভাষী মানুষের বসবাস ছিল ইরাকের বড় শহরগুলিতে। তাদের পাশাপাশি ছিল ফারসীভাষী সরকারী কর্মচারী ও সৈনিক। শ্রেণী ও গোত্রভিত্তিক বিভাজন ছিল সেসব শহরে। জোরোয়াস্ত্রিয়ান ফায়ার টেম্পল ছিল পারসিকদের শক্তির প্রতীক। কিন্তু অধিকাংশ জনগণের ধর্ম ছিল নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি। পাশাপাশি কিছু ইহুদী ছিল যারা ড্যানিয়েল-এজেকিয়েলের সময় থেকে ইরাকের বাসিন্দা।

আর দুই নদীর উপত্যকার ঠিক পশ্চিমে যেখানে ঊর্বরভূমির সাথে মরুভূমির মিলন ঘটেছে, সেখানে আবাস ছিল বহু অর্ধ-যাযাবর মেষপালক আরব গোত্রের। এদের অধিপতি ছিল বনু লাখম বলে একটি বড় গোত্র, ঠিক যেমন সিরিয়াতে বনু ঘাসান ছিল বিজ্যান্টিনদের মনোনীত আরব নেতৃত্বস্থানীয় গোত্র। ভিনদেশী সাসানীদের হয়ে আরব গোত্রগুলো থেকে করসংগ্রহের দায়িত্ব ছিল লাখমীদের। এছাড়াও দক্ষিণে পারস্যোপসাগরের তীরবর্তী খুজেস্তান থেকে শুরু করে উত্তরের জাগ্রোস পর্বত পর্যন্ত আরো নানা আরব গোত্রের বসবাস ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাইবান, তাগলীব, তানুখ প্রমুখ। এদের অধিকাংশ ছিল নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান। ইরাকের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছিল জরথুস্ত্রবাদ থেকে বিবর্তিত নিষিদ্ধঘোষিত মাজদাকী-মানিকেয়ান, আর আধ্যাত্মিক ভক্তিবাদী মান্দিয়ানরা।

আরব গোত্রদের কাছে হযরত মুহাম্মদ(সা)এর ইসলাম প্রচারের অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল তাদেরকে একতাবদ্ধ করা। তার জীবদ্দশায় কুরাইশশাসিত মক্কা ও মুসলিমশাসিত মদীনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফসল হিসাবে আরবের বেদুঈন ও শহরবাসী ট্রাইবগুলোর কনসলিডেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে। মক্কাবিজয়ের পরও একই প্রক্রিয়া আরো বড় মাপে চলতে থাকে, আর তার বিস্তার হয় দক্ষিণে ইয়েমেন-ওমান, উত্তরে আল-ইয়ামামা, আর পূর্বে বাহরাইন পর্যন্ত। হযরত মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আবু বকরের খলীফা হবার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তিনি সকল আরব ট্রাইবের পুংক্ষানুপুংক্ষ বংশপরিচয় জানতেন, অর্থাৎ তাদের সাথে কূটনীতিতে সফলতার চাবিকাঠি ছিল তার হাতে। তাই রিদ্দা নামক বিদ্রোহগুলিকে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে তার দু’বছরের বেশি সময় লাগেনি।

আবু বকরের শাসনামলেই ইয়ামামার ‘ভন্ডনবী’ মুসায়লামাকে পরাজিত করতে সেনাদল পাঠানো হয়। সে সংগ্রাম চলাকালীন অবস্থাতেই ইরাকে অভিযান চালান মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি দক্ষিণ ইরাকের বনু শাইবান গোত্রের নেতাকে তার সাথে হাত মেলানোর প্রস্তাব দেন। ততদিনে বনু শাইবান নিজেরাই মরুভূমি থেকে আক্রমণ চালিয়ে দজলা-ফোরাতের পশ্চিম তীরে মোটামুটি একটা স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে। সাসানীরা হয় তখনো সামরিক দুর্বলতার শিকার, নয়ত শাইবানদের ছোটখাট আক্রমণে গা না করে বড় কোন সমস্যা নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত।

খালিদ বিন ওয়ালিদ ৬৩৩/৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ইরাকের স্থানীয় বেদুঈন আরবদের সাহায্য নিয়ে মরুসংলগ্ন এলাকা আর বসরার কাছে আল-উবুল্লা আর কুফার নিকটবর্তী আলহিরার মত আরবঅধ্যুষিত শহরগুলিকে ইসলামী রাজত্বের আওতায় আনেন। এ সময়ে সাসানী সেনাবাহিনীর কোন প্রতিরোধ তাদের বিরুদ্ধে আসেনি। খালিদ সিরিয়া বিজয়ের যুদ্ধে অংশ নিতে ইরাক ত্যাগ করে বিশাল মরুযাত্রা করেন আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যান শাইবানদের গোত্রপতি আল-মুসান্নার হাতে।

ইসলামী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা ‌অবশ্য আসে স্থানীয় আরব গোত্রগুলোর থেকে। এদের অনেকে লাখমীদের জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিল। নতুন পাওয়া ক্ষমতা ছাড়তে তারা ছিল নারাজ। এদের বিরুদ্ধে আল-মুসান্না ইসলামী খেলাফতের নামে দু’একটা সফল অভিযান চালালেও শীঘ্রই সরাসরি সাসানী বিরোধিতার সম্মুখীন হন। আল-জিসরের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন তিনি।

এর প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় খলীফা উমার স্বল্পকিছু রিইনফোর্সমেন্ট পাঠান বাজিলা গোত্রের জারীর ইবনে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে। তাদের সাথে পরে যোগ দেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বড় সৈন্যদল। ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এরা সকলে মিলে ঘাঁটি গাড়ে আলহিরার নিকটবর্তী আল-ক্বাদিসিয়ার প্রাঙ্গনে। সেখানে পারসিক সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংখ্যায় অপ্রতুলতা সত্ত্বেও আরবরা কয়েকদিনের প্রচেষ্টায় যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। এখানেই নাকি রুস্তমের সাথে মোলাকাত হয় আরবদের, আর রুস্তম তাদের চরম অপমান করেন।

ক্বাদিসিয়ার যুদ্ধে সাসানীরা হারার পর তাদের তেমন কোন প্রতিরক্ষা আর অবশিষ্ট থাকে না। তারা পিছু হটে আশ্রয় নেয় মাদাইন শহরে তাদের রাজধানীতে, তারপর সেখান থেকে পালিয়ে চলে যায় জাগ্রোস পর্বতের পাদদেশে। সেখানে ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জালুলার যুদ্ধে আরেকবার শোচনীয় পরাজয় ঘটে সাসানীদের। ইয়াজদেগার্দ তার নিকটস্থদের নিয়ে আরো পূর্বে খোরাসান ও সগডিয়ার দিকে পালিয়ে যান, আর সুযোগ খুঁজতে থাকেন তার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের। সে উদ্দেশ্যে চীনাদেরও সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। কিন্তু তার সেই সংগ্রাম ৬৫১ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপে চললেও শেষ পর্যন্ত সাসানী সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বিফল হয়। তার পুত্র চীনের সম্রাটের দরবারে আশ্রয় নেন নির্বাসিত রাজা হিসাবে। আর কখনোই ইরানে ফিরে যেতে পারেনি সাসানীদের বংশধররা।

পারসিক সেনাদলের সংখ্যাধিক্য আর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আরবদের যুদ্ধে বিজয়ের কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কারো ধারণা পারসিকদের হস্তীবাহিনীকে আরব তীরন্দাজরা দূর থেকে ধরাশায়ী করে ফেলে। আবার তাদের সাংগঠনিক একতার কারণও দেন অনেকে। তাদের বিপরীতে সাসানী বাহিনী ছিল বহু জাতি-গোত্রে বিভক্ত আর তারা মোটে জটিল গৃহবিবাদ কাটিয়ে উঠেছে। আর ইরানী সেনাদলের স্বাভাবিক আকারের তুলনায় তারা ছিল স্বল্প। আরবরা যে সংখ্যায় দুর্বল ছিল আর তাদের তীরন্দাজ, পদাতিক আর ঊষ্ট্রারোহী ছাড়া তেমন কোন সৈন্য ছিল না, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এই সৈন্যসংখ্যা কম হবার কারণেই উমার রিদ্দার সময়কার বিদ্রোহী আরব গোত্রগুলিকে না চাইতেও ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। ‘ভন্ডনবী’ তুলায়হাকেও তার ট্রাইবসহ ইরাকে পাঠান তিনি। তুলায়হাকে সেনানেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি দেননি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার কৌশলগত উপদেশ ঠিকই মুসলিমদের কাজে লেগেছে। এ ছিল সাসানীদের অন্তর্কলহের ঠিক বিপরীত। আরব সেনাদলে যে সকলে মুসলিম ছিল তাও নয়, ইরাকের খ্রীষ্টান ট্রাইবগুলোর কিছু সদস্যও যুদ্ধে আরব পক্ষ নেয়। সিরিয়ার যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ ও মদীনার আনসারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও দেখা যায় যে ইরাকে সে প্রক্রিয়াটায় বেশি অংশ নিয়েছে মধ্য আরব ও ইরাকের অ-কুরাইশ স্থানীয় আরব ট্রাইবগুলি।

এভাবে ইরাকবিজয় ছিল নেহাত আরব ট্রাইবগুলির কনসলিডেশনের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সিরিয়াতে মক্কার কুরাইশদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল, জেরুজালেমের কারণে সেখানকার একটা ধর্মীয় গুরুত্বও ছিল। সেসব কোন কিছু ইরাকের বেলায় ছিল না। আরব কনসলিডেশন ও এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে যখনই সাসানী বা তাদের সমর্থকদের বাঁধা এসেছে, তখনই আরবদের সুযোগ চলে এসেছে আরো এলাকা হস্তগত করার। এভাবে ইরাক থেকে শুরু করে ক্রমে সাসানী সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের খোরাসান-হেরাতে ছড়িয়ে পড়ে আরব সেনাদল। আর সেভাবে তারা এসে হাজির হয় সিন্ধু উপত্যকায় — ঠিক ভারতের দোরগোড়ায়।

সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের জীবদ্দশাতেই ইরাকের রাজধানী ক্টেসিফোন বা আল-মাদাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় আলহিরার নিকটবর্তী নতুন সৃষ্ট গ্যারিসন টাউন কুফাতে। এর মূল কারণ সম্ভবত মরু এলাকার নিজস্ব পাওয়ার বেসের কাছাকাছি থাকা, আর মরুর ট্রাইবগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার সুবিধা। এতে বোঝা যায়, ইরাকে সাম্রাজ্যবিস্তারের মূল লক্ষ্য সাসানী সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকেন্দ্র দখল করা নয়, বরং ছিল আরব গোত্রগুলিকে একীভূত করে একই সিস্টেমের আওতাধীন করা।

উমার ও পরবর্তী খলীফারা ইরাকে বিভিন্ন আরব যাযাবর ট্রাইবকে ‘হিজরত’ কিংবা ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে হিজরত ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে ইসলামের একটি অনানুষ্ঠানিক স্তম্ভ হিসাবে। হিজরতে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে খেলাফতের নেতৃত্বস্থানীয়দের মূল লক্ষ্য ছিল পরিবর্তনশীল মানসিকতার বেদুঈনদেরকে আরবের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা, আর সম্ভব হলে সাসানীদের অবশিষ্ট সেনাদলের বিরুদ্ধে এদের ব্যবহার করা। এসকল বেদুঈন ট্রাইব কুফা কিংবা বসরার মত নতুন শহরে এসে বসতি গাড়ে। একেকটি ট্রাইবের জন্যে নির্ধারিত ছিল একেকটি মহল্লা। কোন ক্ষেত্রে বনেদী পারসিক মিত্র ‘দেহগান’ জমিদার আর ‘সাওয়ারী’ অশ্বারোহীদের জন্যেও নতুন এলাকা ছেড়ে দিতে তাদের বাধ্য করা হয়।

আরব ট্রাইবগুলি মরুতে বসবাসরত অবস্থায় মদীনায় ট্যাক্স পাঠাত, আর ইরাকে অভিবাসনের পর এখন তারা উল্টো পায় সরকারী ভর্তুকি। এরা কিন্তু ইরাকের আদি অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিজমা দখল করেনি। চাষাবাদে আরব বেদুঈনদের কোন আগ্রহ ছিল না, আগের চাষীদের থেকে কর আদায় করেই তারা ক্ষান্ত হয়েছে। যে করটা এসব আরামায়িকভাষী চাষীরা ইরানিদের দিত, তা এখন পাওয়া শুরু করে আরব গোত্রগুলো। আরবদের জনসংখ্যা বাড়া শুরু করলে কুফা-বসরা শহরে ধীরে ধীরে অশান্তি-অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধে তার একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সে ব্যাপারে পরে বলব।

ইসলামী সরকার কেবল সেসব জমিগুলির অধিগ্রহণ করে যেগুলি শান্তিচুক্তিঅনুযায়ী স্থানীয়রা তাদের কাছে ছেড়ে দেয়, নয়ত যেগুলি আগে ছিল সাসানী সরকারের মালিকানাধীন, নতুবা তাদের মালিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিংবা দেশান্তরী হয়েছে। সেসব জমির চাষাবাদ থেকে পাওয়া কর দিয়ে সরকার পরিচালিত হত।

সরকারী কাজে যেসব ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও অন্যান্য জাত-ধর্মের কর্মচারী ছিল, তাদের অবস্থানও অটুট থাকে। সরকারী ভাষা তখনও পাহলভী। উমারের সময় থেকে আশি বছর পরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাষাসংস্কারের আগে কোন খলীফা বা গভর্নর এসব প্রক্রিয়ার ওপর কোন হস্তক্ষেপ করেননি। সে ব্যাপারটা এই মুদ্রাগুলির মধ্যেও উঠে এসেছে।

সাসানী সম্রাটের মুখাবয়বওয়ালা এই মুদ্রা রাশিদুন খেলাফতের আমলে চালু তো ছিলই, উমাইয়া শাসনামলেও তার পরিবর্তন হয়নি। উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক সিরিয়ার মুদ্রার সংস্কার করে তার থেকে মানব অবয়ব বাদ দিয়ে দেন ৬৯৬ সালে। কিন্তু ইরাকের এই মুদ্রার কোন পরিবর্তন তিনি করেননি। উমাইয়াদের পর আব্বাসিয়া খেলাফতের বেশ কিছু প্রদেশেও এমন মুদ্রা চালু ছিল। অর্থাৎ ৬৩৪ থেকে শুরু করে ৭৮৬ পর্যন্ত দেড়শ বছর ইসলামী সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের মুদ্রায় শুধু রাজার মুখচ্ছবি নয়, জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মের চাঁদতারা প্রতীক ও অগ্নিবেদী শোভা পেয়েছে।

আজ এ পর্যন্ত। আগামী পর্বে আসবে স্ট্যান্ডিং কালিফ অর্থাৎ দন্ডায়মান খলীফার অবয়ব ও বিকৃত ক্রুশ অংকিত সিরিয়ার তামার ফালস, যেটা ছিল প্রথম ইসলামী মৌলিক ডিজাইনের মুদ্রা। ঐ যে আব্দুল মালিকের কথা বললাম, তারই নির্দেশে মুদ্রিত। মানুষের ছবি তো বটেই, বিজ্যান্টিন বা সাসানী সম্রাটের নয়, স্বয়ং ইসলামের খলীফার! আর সাথে লিখব তার সেই সংস্কারের পটভূমি।

আদি ইসলামী মুদ্রা – ১

আব্বাসী খেলাফতের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আস-সাফ্ফাহর রাজত্বকালের রৌপ্য দিরহাম এটি। সময়কাল ১৩৪ হিজরী, ৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ। বর্তমান ইরাকের বসরা শহরের টাঁকশালে মুদ্রিত। আমার সংগ্রহের। এটি মোটামুটি সহজলভ্য।

এক পিঠে আরবী কুফী হরফে লেখা ‘আল্লাহ ব্যতীত ঈশ্বর নেই, সাক্ষ্য দিচ্ছি তাঁর কোন শরীক (সমকক্ষ) নেই’, চারপাশে লেখা ‘আল্লাহর নামে এটি মুদ্রিত হয়েছে বসরায়, সাল চার ত্রিশ একশ।’ অপর পিঠে লেখা, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর বার্তাবাহক (রসুল)’, আর চক্রাকারে চারপাশে ‘মুহাম্মদ রাসুলাল্লাহকে আমি প্রেরণ করেছি পথনির্দেশনা ও প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসসহকারে, অন্যান্য সকল ধর্মকে প্রতিস্থাপনের জন্যে, যদিও শরীককারীরা তা অপছন্দ করে।’

প্রথম আব্বাসী খলিফা আস-সাফফাহর আমলের দিরহাম

দেখার মত দুটো জিনিস এখানে। এক, হরফগুলোর কোন হরকত বা ভাওয়েল মার্ক নেই। এমনকি নুক্তা কিংবা কনসোন্যান্ট ডিস্টিংশন মার্কও নেই। কেউ সঠিক সূত্র না জানলে, দ (দাল) আর ধ/জ (জাল) গুবলেট করতে পারে। একইভাবে, ব (বা), ত (তা), থ/ছ (থা) এগুলির জন্যেও একটাই হরফ। দ (দদ), ছ/স (সদ) এদেরও একই হাল। স (সিন), শ (শিন) এর অ্যাম্বিগুইটি ‘লা সা/শারিকালাহু’তে পরিপূর্ণরূপে দৃশ্যমান।

আদিতে লিপিবদ্ধ কুরআনেরও একই অবস্থা ছিল। ইসলামী বিবরণীমতে, কুরআনের অর্থ পাল্টে যাবার ভয়ে তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় এগুলি ঠিকঠাক করা হয়। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, সে সংস্কারের কৃতিত্ব ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের। কিন্তু আমার আন্দাজে কাগজের ব্যবহার পুরোমাত্রায় শুরু হবার আগে এ সংস্কার সম্পূর্ণ হয়নি। সেকথায় পরে আসছি। মক্কা থেকে মদিনায় আদি মুসলিমদের অভিবাসনের দীর্ঘ ১৩৪ বছর পরের এ মুদ্রা এ থিওরির একটা সম্ভাব্য প্রমাণ।

আরেকটা চোখে লাগার মত ব্যাপার হল, কুরআনের ৯:৩৩ আয়াত যে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। শুরুটা সামান্য মডিফাই করে মুদ্রিত হয়েছে। এই নগণ্য পরিবর্তনটাও সম্ভবত কুরআন পরিবর্তনের বর্তমান ইসলামী ট্যাবুর পরিপন্থী।

এই মু্দ্রাটি ইসলাম ধর্ম ও আরব খেলাফতের ইতিহাসের খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ সময়কার। ১৩০ হিজরী নাগাদ পূর্ববর্তী উমাইয়্যা খেলাফতের আসন টলায়মান। উমাইয়্যাদের পারিবারিক ‌অন্তর্কলহ থেকে গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে এক দফা। তাছাড়াও বিভিন্ন সুদূর প্রদেশের গ্যারিসন টাউনগুলিতেও বিদ্রোহ। এসব সামাল দিয়ে খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান রাজধানী হার্রানে এসে পৌঁছনোর মাসখানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ‘আব্বাসী বিপ্লব।’

একে বিপ্লব নাম দেবার মূল কারণ বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-জাতের একটা বৈচিত্রময় মোর্চা উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এদের নেতৃত্বে যদিও ছিল মুহাম্মদ(সা)এর চাচা আব্বাসের বংশনামধারী এক আরব পরিবার, বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল আরবদেরই বর্ণভেদী রাজত্ব উচ্ছেদ করা। উমাইয়্যা বংশটি তৃতীয় রাশিদুন খলীফা উসমানের পরিবারের সাথে জড়িত। উমাইয়্যা প্রথম খলীফা মু্য়াবিয়ার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত বাঁধে। আলীর মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের নেতৃত্বে আদি শিয়ারা কুফা শহরে সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় উমাইয়্যা খলীফা ইয়াজিদ কারবালার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এদের নিষ্ঠুরভাবে নিকেশ করে দেন। শিয়া-সুন্নী বিবাদের সেটা শুরুমাত্র।

উমাইয়্যা শাসনামলে বিজিত দেশগুলোতে আরবরা ছিল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। বিদেশী-বিধর্মীদের জানমাল ‘রক্ষার’ বিনিময়ে পোল ট্যাক্স (জিজিয়া) আর ভূমিকর (খারাজ) আদায় করে আরব সৈন্য আর সেনাপতিদের খরচ ওঠানো হত। এ কারণে বিধর্মীদের ইসলামে দীক্ষিত করতে উমাইয়্যাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। যতক্ষণ বিজিত জনগণের প্রতিনিধিরা কড়ায় গন্ডায় কর বুঝিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পদবী-ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর কোন আগ্রাসন হত না। পুরো উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের অনারব জনগণের ১০ শতাংশের নিচে ছিল নতুন মুসলিম।

কিন্তু এসকল মুসলিমরা পরিগণিত হত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। কোন ক্ষেত্রে কর তো দিতে হতই, তার পাশাপাশি পুরনো নাম পরিত্যাগ করে আরবী নাম নিতে হত। আর ‘অ্যাটাচড’ থাকতে হত কোন না কোন আরব ট্রাইবের সাথে। এসব ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নাম ছিল ‘মাওয়ালি’, ইংরেজীতে ‘ক্লায়েন্ট’। আদিযুগের অনেক সাম্রাজ্যেই বিজিত রাজ্যের বনেদী বংশের সন্তানদের সম্রাটের দরবারে হাজির থেকে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে নিতে হত। এ ‌অনেকটা সেরকম।

সাধারণ অনারবদের সাথে আরবদের বিয়েশাদীর ব্যাপারেও উমায়্যাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদি কোন বড় শহর ইসলামী সৈন্যদলের দখলে আসত, আরব সৈন্যদের অনুমতি ছিল না সে শহরের ভেতরে বসবাসের। তাদের জন্যে অন্যত্র আলাদা ক্যাম্প তৈরি করা হত, যেগুলি পরবর্তীতে দুর্গশহরে রূপান্তরিত হয়। এভাবে আরব জাতিগোষ্ঠীকে ‘সংমিশ্রণ’ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে উমাইয়্যারা।

অন্যদিকে বিজিত বিশাল এলাকা শাসন আরব দলপতিদের পক্ষে একলা সম্ভব ছিল না। খলীফা আর তার দোসররা শিক্ষিত হলেও সৈন্যদের অধিকাংশ ছিল অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত। বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে উমাইয়্যাদের দরকার ছিল আগের আমলের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাহায্য। সেভাবে সিরিয়ার প্রাক্তন বিজ্যান্টিন প্রদেশগুলিতে তারা প্রচুর আরামায়িক, গ্রীক ও লাতিন ভাষায় শিক্ষিত মনোফিসাইট খ্রীষ্টান কেরানী পায়। মনোফিসাইটদের সাথে আবার মুসলিমদের মিল হলো তারাও হোলি ট্রিনিটি কনসেপ্টটা বিশ্বাস করে না। আর ইরাকের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে আরব নেতৃত্বকে সাহায্য করে পাহলাভী-ফার্সী ভাষায় শিক্ষিত আরেকদল বুদ্ধিজীবী। এদের ধর্ম ছিল জোরোয়াস্ট্রিয়ান, মানিকেইজম, মাজদাকিজম, কিংবা নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি।

সিরিয়ার ঐ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই কিন্তু পুরনো গ্রীক ক্লাসিকগুলি ইউরোপের অন্ধকার যুগে বেঁচে গিয়েছিল। তারা প্লেটো-অ্যারিস্টোটল প্রমুখের দর্শনতত্ত্বের বইগুলো আরামায়িক-আরবী ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করে। পরে সেগুলি ছড়িয়ে যায় আরব খেলাফতের আনাচেকানাচে। স্পেন থেকে আবার সেগুলি ফিরে যায় পশ্চিম ইউরোপে।

কিন্তু পর্যায়ক্রমে উমাইয়্যারা এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। তাদের খেলাফতের শেষ নাগাদ সরকারী চাকরি পাবার জন্যে আরবীনামধারী মুসলিম হওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সরকারী ভাষা হিসাবে আরবীকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে উমাইয়্যারা। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নাকি এ ব্যাপারে এত গোঁড়ামি করেন যে, খওয়ারিজমি ভাষায় লেখাপড়াজানা সকল বুদ্ধিজীবীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আর ভাষাটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।

অর্থাৎ, উমাইয়্যা শাসনে অসন্তুষ্ট-ক্ষুব্ধ ছিল বেশ কটি দল। সর্বাগ্রে, বিভিন্ন শিয়া বা শিয়াঘেঁষা দল, যাদের বিশ্বাস খেলাফতের অধিকার কেবলমাত্র মুহাম্মদ(সা)এর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের, অর্থাৎ আলীর বংশধরদের। তারপর, বিভিন্নদেশীয় অনারব মুসলিম, যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক (আজামী) হিসাবে গঞ্জনা ভোগ করে আসছে — এদের মধ্যে স্বপরিচয়ের ব্যাপারে সবচে একগুঁয়ে ছিল ইরানীরা। তৃতীয়ত, ইসলামভিন্ন অন্যান্য ধর্মের বনেদী বংশগুলি, বিশেষ করে সিপাহবদ নামে তাবারিস্তানের জোরোয়াস্ট্রিয়ান সামন্তরা। চতুর্থত, উমাইয়্যা সরকারী কর্মচারীদের একটা বড় অংশ, যারা অনেকে ছিল অমুসলিম কিংবা মুসলিম হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর।

আব্বাসী বিপ্লবের ডামাডোল প্রথমে শুরু হয় প্রত্যন্ত খুরাসান প্রদেশে। উত্তর আফগানিস্তান ও বর্তমান তাজিকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান-উজবেকিস্তানের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এই প্রদেশ। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় উমাইয়্যাদের এখানে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় জনশূন্য এলাকায় আরব-অনারবরা অবাধে মেলামেশা করত। আরবীর পাশাপাশি ফার্সীতেও বাতচিত শুরু করে দেয় আরবরা, পারসিক পোশাকও পড়তে শুরু করে। খোরাসানের কোন আরব ইরাকে গেলে নাকি তার ভাষা সম্পূর্ণ বোঝার ক্ষমতা ছিল না কারো।

এই খোরাসান ছিল নানা ধরনের অভিনব বিশ্বাসে ভরপুর। প্রাক্তন সাসানী সাম্রাজ্যের প্রজা ইরানী নব মুসলিমরা ধর্মান্তরের পরও তাদের পুরনো ঐতিহ্যগত পরিচয় ধরে রেখেছিল। জোরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের ‘মিলেনারিয়ান’ বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে কোন এক ত্রাতার উত্থান ঘটবে, যিনি আলোর পক্ষে যুদ্ধ করে অন্ধকারকে পরাজিত করবেন, এসব বিশ্বাস তখনো প্রগাঢ়ভাবে বেঁচে গেছে এদের মধ্যে। বিশেষ করে তাদের‌ই অতীত সভ্যতার ধ্বজাধারী পারসিক সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিক্রিয়ায় এদের মনস্তত্ত্বে কোন এক ‘মাহদীর’ আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১২৫ হিজরী সালটিও এদের কাছে মাহদীর আগমনের নিয়ামক হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

এসকল নওমুসলিম এবং মানিকেইজম ধর্মের অনুসারীদের সমতুল্য মিলেনারিয়ান বিশ্বাসকে ভালভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় কায়সানি হাশেমী বলে এক শিয়া দল। উমাইয়্যারা যেখানে ইসলামধর্মপ্রচারে ছিল বিমুখ, সেখানে এরা মূলধারার ইসলামের সাথে শিয়া ও মানেকইজমের সিনক্রেটিজম ঘটিয়ে খোরাসানের বিশাল জনসাধারণকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর তাদের লুক্বায়িত ইমাম আবির্ভূত হয়ে সারা বিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করবেন। এই শিয়াদের নেতা ছিল আবু মুসলিম আল খোরাসানী বলে এক রহস্যাবৃত সেনাপতি।

অপরদিকে, আবুল আব্বাস ও তার চাচাদের পরিচিতি ছিল পুরো ইসলামী জগতে। আবু মুসলিমের সাথে আব্বাসী পরিবার গোপনে যোগাযোগ করে। আবু মুসলিমের দৃষ্টিতে, বিপ্লবে আব্বাসীদের নেতৃত্ব আর শিয়া সেনাদলের মূল যৌথ লক্ষ্য হল শিয়া ইমামত প্রতিষ্ঠা। আব্বাসী পরিবারের সদস্যরা কুফা-বসরার মত বড় শহরে তাদের পরিচিতদের মাধ্যমে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়। খোরাসানের উমাইয়্যা গভর্নরকে পরাস্ত করে আবু মুসলিম পূর্বদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকেন ইরাকের দিকে।

আবু মুসলিম আর আব্বাসীদের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে উমাইয়্যা সেনাদল পরাজিত হয়, আর মূল শহরগুলিতে তাদের নিযুক্ত গভর্নরদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় বিপ্লবীরা। ৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইরাকসহ খেলাফতের পূর্বাঞ্চল চলে আসে আব্বাসীদের দখলে। সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে তাদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন দ্বিতীয় মারওয়ান। মিশরে পালিয়ে যাবার পথে ধরা পড়েন পরিবারসহ। নতুন খলীফার নির্দেশে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়। বেঁচে যাওয়া উমাইয়্যা রাজপরিবারের সদস্যদের চালাকি করে নেমন্তন্ন করে এনে খাবার টেবিলে হত্যা করেন আবুল আব্বাস। এভাবে উমাইয়্যাদের পুনরুত্থানের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন তিনি। একমাত্র একজন উমাইয়্যা রাজপুত্র কোনরকমে স্পেনে পালিয়ে যান। সেখানে আন্দালুসিয়ার উমাইয়্যা রাজ্য চালু থাকে আরো তিনশ বছর।

খলীফা হিসাবে আবুল আব্বাস যে দাপ্তরিক নাম গ্রহণ করেন তা হল আস-সাফ্ফাহ, যার অর্থ শেডার অব ব্লাড, রক্তপাতকারী। প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করতে এ নাম নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তার থেকেও বড় তাৎপর্য হলো এটি একটি ‘মেসায়ানিক’ নাম। অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার জন্য যে যোদ্ধা-ত্রাতার আবির্ভাব হবে, তার সম্মাননাকর নাম এটি। বোঝা যাচ্ছে, আস-সাফ্ফাহর অনুসারীদের চিন্তাচেতনার ওপর মিলেনারিয়ানিস্ট প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু তিনি নন, দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর (‘বিজয়ী’), তৃতীয় খলীফা আল-মাহদী (‘ঐশ্বরিকপথনির্দেশিত’), প্রমুখের নামেও মিলেনারিয়ান প্রভাব উল্লেখযোগ্য।

আবার দু’দলের যুদ্ধে আব্বাসীদের কালো পতাকার বিপরীতে উমাইয়্যাদের সাদা পতাকার ব্যবহারটাও পারসিক সংস্কৃতির নওমুসলিমদের জন্যে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ইরানী সভ্যতায় সাদা রং মরণশোকের প্রতীক। এরকম ছোটখাট ব্যাপারগুলি যে শুধু আব্বাসী সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলে তা নয়। আব্বাসী বিপ্লবের প্রথমভাগে শিয়া প্রপাগান্ডা হিসাবে কারবালার যুদ্ধের শোকাবহ রিএন্যাক্টমেন্টও চালু ছিল। এখনো ইরানে সে ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হয়। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব আব্বাসীদের সমসাময়িক অনারব সুন্নি নওমুসলিমদের ওপরও চলে আসে। সেকারণে আজকের মূল আরব ভূখন্ডে কারবালার তাৎপর্য খুব বেশি নেই, অথচ ইরান-ইরাক ও ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।

আস-সাফ্ফাহ পাঁচ বছর শাসনের পর গুঁটিবসন্তে মারা যান। তারপর খেলাফতের শাসনভার নিয়ে আরো এক দফা রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত ঘটে। তার ভাই ও চাচাদের সাথে এক ভাতিজা আর শিয়া সেনাপতি আবু মুসলিমের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। নতুন খলীফা আল-মনসুর চক্রান্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন। শিয়া ইমামতের স্বপ্ন সেখানেই আপাতত মাটিচাপা পড়ে। আব্বাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার বদলার প্রস্তুতি নিতে শিয়া গোত্রগুলি আবারো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের সকলেই ধর্মপ্রচার বা দাওয়া’র মাধ্যমে অভূতপূর্ব রিক্রুটমেন্ট চালায়। এর আগে ইসলাম ধর্মে অফিশিয়ালি ধর্মপ্রচার তেমন ছিল না। ইসলাম ছিল শুধুমাত্র আরব বিজেতা ও তাদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্মান্তরিত মাওয়ালি ক্লায়েন্টদের প্রিভিলেজ।

আব্বাসী খেলাফতের প্রশাসনব্যবস্থায় আরবদের পাশাপাশি অনারব, এমনকি অমুসলিম বা নামমাত্র মুসলিম কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল। বার্মাকী বলে একটা বনেদী পরিবার হয় আব্বাসীদের বংশানুক্রমিক উজির। এদের পূর্বপুরুষ ছিল হয় পারসিক জোরোয়াস্ট্রিয়ান নয়ত আফগানিস্তানের ভারতীয় বৌদ্ধসংঘের প্রধান। আল-মুকাফ্ফা নামে জোরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিতদের এক বংশধর ও দ্বিতীয় জেনারেশনের মুসলিম মনীষী ভারতীয় শাস্ত্র ‘পঞ্চতন্ত্রের’ ফারসী সংস্করণের আরবী অনুবাদ করেন। সাসানী আমলে রাজাদের রাজকার্য পরিচালনার গাইড হিসাবে এ বইয়ের প্রচলন ছিল। এদের প্রভাবে সিরিয়াভিত্তিক উমাইয়্যাদের বিজ্যান্টিন স্টাইল থেকে উল্টো আরো বেশি প্রাচ্যধর্মী হয়ে পড়ে প্রশাসনব্যবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা হয় আরো বেশি কেন্দ্রীভূত। সাসানী শাহেনশাহদের মত খলীফার অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় খেলাফতের সুদূরতম প্রদেশের কাজকর্ম। অর্থাৎ যেখানে উমাইয়্যারা পছন্দমত ট্রাইবাল চীফদের ওপর প্রাদেশিক শাসনভার পুরোপুরি ছেড়ে দিতেন, সেখানে আব্বাসী প্রশাসন হয় সাসানী পারসিকদের মত কেন্দ্রীভূত, আর একনায়কতান্ত্রিক। অবশ্য দুই খেলাফতের আমলেই ধর্ম থেকে রাজকার্য পৃথক ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।

আব্বাসী খেলাফতে ইরানী এমন প্রভাবের পাশে পুরনো আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যেসব আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে শহুরে হতে পেরেছে তারা বর্তে গেছে, আর বাকিরা সম্ভবত ফিরে গেছে তাদের আদি মরুময় বাসস্থানে, নয়ত আরো দূরদূরান্তে কোন নতুন রাজ্যজয়ে।

ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও আব্বাসী বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলছিলাম, এই মুদ্রার কুফী হরফের কথা। এর আবির্ভাবের এক বছর আগেই মধ্য এশিয়ায় চীনা তাং সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন আবু মুসলিম। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল চীনা কাগজের কারিগর। তাদের মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে কাগজ। এর ফলে আরবী লিপির চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। আগে পাথরে-চামড়ায় লিখতে হত কষ্ট করে। আর এখন কলম দিয়ে কয়েক খোঁচায় কাজ হয়ে যায়। নুক্তা-হরকত ইত্যাদি দিয়ে অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ বোঝানোর বাঁধা আর থাকে না। সাথে উদ্ভব ঘটে আরবী ক্যালিগ্রাফীর। কুরআনের সাথে সাথে হাদীস ও গ্রীক ক্লাসিকগুলিও প্রথমবারের মত সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

আব্বাসী আমল পর্যন্ত কিন্তু সুন্নাহ বলতে শুধু মুহাম্মদ(সা) নয়, তার যত সঙ্গীসাথী, অন্যান্য আদি মুসলিম, প্রাক্তন ধর্মপরায়ণ চার খলীফা, এমনকি কিছু ন্যায়বিচারক উমাইয়্যা খলীফা, তাদের ট্র্যাডিশনকে একটা ব্ল্যাংকেট টার্ম দিয়ে বোঝানো হত। ১৫০ হিজরীতে ইমাম শাফিয়ীর হাত ধরে আজকের হাদীস সংগ্রহগুলির সূচনা হয়। সুন্নাহ টার্মটা আরো নির্দিষ্ট হয়ে মুহাম্মদ(সা)এর ট্রাডিশন বোঝাতে শুরু করে। এ পর্যন্ত হাদীসগুলি লোকমুখে বেঁচে ছিল। অর্থাৎ, ইসলামের প্রথম ১৫০ বছরে হাদীস জানা ও পালন করার কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেসব প্রমাণ রেট্রোস্পেক্টিভ। ইসলামের ইতিহাসসংক্রান্ত প্রথম বইগুলিও লিখিত হয় আব্বাসী শাসনামলে। সেগুলিও ছিল শ্রুতিনির্ভর, কোন ক্ষেত্রে বহুলাংশে বাইবেল-তোরার বিষয়বস্তু দ্বারা সাপ্লেমেন্টেড। এধরনের ইহুদী ঐতিহাসিক প্রভাবকে নাম দেয়া হয়েছে ইসরাইলিয়াত।

আব্বাসী খলীফাদের আমলে আজকের সুন্নী মতবাদের শুরু হলেও অন্যান্য অনেক যুক্তি ও দর্শননির্ভর বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। তার পাশাপাশি সুফী বিশ্বাসের যাত্রা শুরুও এদের সময়। অনেকভাবে উমাইয়্যা শাসনামলের চিন্তাধারার আড়ষ্টতাগুলি কেটে যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও চিন্তার মোটামুটি স্বাধীনতা ছিল। সিল্ক রোডের বাণিজ্যের মাধ্যমেও বহু কিছুর চালাচালি হয়। শেষ পর্যন্ত আব্বাসীদের সাসানী স্টাইলের অ্যাবসলুট পাওয়ারই ছিল তাদের অধঃপতনের মূল কারণ। পরের দিকের অকর্মন্য খলীফাদের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত মানুষ ধর্মের মাঝে ন্যায়বিচার খুঁজে ফেরে। তার সুযোগ নিতে তৈরিও ছিল কিছু ধর্মীয় নেতা। এদের টানাপোড়েনের রাজনীতির বলি হন ইসলামের স্বর্ণযুগের মনীষীদের অনেকে, তাদের বহু কাজ হয় বিস্মৃত, বহু গ্রন্থাগার হয় ভস্মীভূত। উমাইয়্যা-আব্বাসী দু’খেলাফতের ক্ষেত্রেই সমান খাঁটে এই প্রবাদবাক্য, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি!’

সিরিয়া ও সাইকস-পিকো

নিচের তিনটি ডাকটিকেট সিরিয়ার জন্মলগ্নের। প্রথমটা আসলে তুর্কী সাম্রাজ্যের, কিন্তু ১৯১৯ সালে এর উপরে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার)। দ্বিতীয়টা ১৯২০এর, নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা এর প্রকাশের উপলক্ষ্য। আর শেষটা ১৯২১এর, আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর এবার ছাঁপ ফরাসীতে — ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার।

তুর্কী সাম্রাজ্যের ডাকটিকেটের উপরে ১৯১৯ সালে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ম্যাপে ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র দেখানো হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে সংঘাতের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি যতটুকু ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সমরাঙ্গনে। ইউরোপের থিয়েটারে সার্বিয়ার পক্ষ নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে অস্ট্রিয়ার মিত্র জার্মানি ও রাশিয়ার মিত্র ফরাসী-ব্রিটিশরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সেরকম, তুরস্ক-জার্মানির গোপন আঁতাঁতের পরে একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ তুর্কী সহায়তায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ওডেসা বন্দরের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনা ছিল তুর্কী যু্দ্ধমন্ত্রী আনওয়ার পাশার যুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র, কারণ সুলতানসহ ওসমানী সরকারের অনেকের যুদ্ধে সায় ছিল না। এরপর রুশদের আহ্বানে আবার সেই ফরাসী-ব্রিটিশদের তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা।

ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সুয়েজ় প্রণালী সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যের যুধ্যমান সকল পক্ষের চোখের মণি। সুয়েজ়বিজয়ের লক্ষ্যে জার্মান উপদেশ নিয়ে তুর্কীরা সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সুয়েজ়ের প্রতিরক্ষার খাতিরে ব্রিটিশ ক্যাম্পেন শুরু করার পাশাপাশি মক্কার ‘শরীফ’ হুসেইন বিন আলীর সাথে গোপন পত্রযোগাযোগ শুরু করেন মিশরের ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাকম্যাহন।

১৯২০এর সিরিয়া আরব রিপাবলিকের এই ডাকটিকেটের প্রকাশের উপলক্ষ্য নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শরীফ হুসেইন ছিলেন বিখ্যাত বনি হাশেম গোত্রের গোত্রপতি । সাতশ বছর ধরে তাঁর বংশ মক্কা ও মদিনার শাসন পরিচালনা করে আসছিল — অবশ্য ওসমানী সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল হেজাজ়।

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপর হেজাজ়ের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। তুর্কীদের সাথে হুসেইন বিন আলীর বহুদিনের ভাল সম্পর্ক থাকার পরেও যখন মক্কায় হজ্জ্বযাত্রীদের আগমনে ভাঁটা পড়া শুরু করলো, মিশর থেকে খাদ্যশস্য আসা গেল বন্ধ হয়ে, আর শেষে যখন তিনি খবর পেলেন ওসমানীরা তাঁকে সরানোর মতলব করছে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেবার।

১৯২১এর আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর ফরাসীতে ছাঁপ ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, যার অর্থ ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার

তিনি ম্যাকম্যাহনের সাথে চুক্তি করলেন যে তুরস্কের বিরুদ্ধে বেদুইন সৈন্যদলের সাহায্যের বিনিময়ে ব্রিটিশরা উত্তরে হালাব (আলেপ্পো) থেকে দক্ষিণে আদেন পর্যন্ত আরব এলাকায় তাঁকে স্বাধীন রাজ্যগঠনে সমর্থন দেবে। অবশ্য মধ্যোপসাগর তীরের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চল, আর দক্ষিণ আরবের আদেন-কাতার-কুয়েত ইত্যাদি ইউরোপীয়দেরই থাকবে। হুসেইন আরো দাবি করলেন বেদুইনদের সমর্থন কেনার জন্য লাখ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, যাতে ম্যাকম্যাহন রাজি হলেন। (এসময় এই এলাকায় তেল আবিষ্কার হয়নি।) সে চুক্তির পরে টি.ই. লরেন্স বা ‘লরেন্স অফ আরাবিয়া’ ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহীদের উপদেষ্টা হিসাবে এসে হাজির হন।

এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিদের সহায়তায় আরব স্বাধীনতাকাংক্ষীদের ডি ফ্যাক্টো প্রতিনিধি হয়ে যান হুসেইন। ওসমানী সাম্রাজ্যের মধ্যবিত্ত আরব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৩ সালে প্রথম আরব কংগ্রেসের মাধ্যমে যে আরব জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা করেন, রাতারাতি তার রাজনৈতিক ঝান্ডা হাইজ্যাক হয়ে যায়। ওসমানী আরব প্রদেশগুলিতে যেসকল বেদুইন গোত্রের আবাস ছিল, তারাও উৎকোচ নিয়ে তু্র্কীদের সাহায্য করে। অর্থাৎ আরবের নেতা হিসাবে হুসেইন বিন আলীর সমর্থন সব জায়গায় ছিল না। এসুযোগে এক সময় ওসমানীরা মক্কা দখল করে নেয় আর পবিত্র শহরটির বিপুল ধ্বংসসাধন করে।

ম্যাপে দেখানো হেজাজ় রেলওয়ে ছিল ইস্তাম্বুল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ওসমানী সেনাবাহিনীর সাপ্লাই লাইন। ব্রিটিশ ও ফরাসীদের অর্থ ও প্রযুক্তির সাহায্যে হুসেইন বিন আলীর পুত্র ফয়সাল এই রেললাইনের ওপর চোরাগোপ্তা মাইন হামলা, লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর গেরিলাদল ছিল ট্রাইবাল বেদুইন আর ওসমানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী আরবদের নিয়ে সংগঠিত। টি.ই. লরেন্স ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনায় তাঁর শরিক। পূর্বদিকে ফয়সালের এক ভাই আব্দুল্লাহ তুর্কী মিত্র রাশিদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করেন। আরেক ভাই আলী দক্ষিণে মদিনায় তুর্কীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন।

এভাবে হেজাজ় রেলওয়ে ধরে ধীরে ধীরে উত্তরদিকে অগ্রসর হয় আরব সেনাদল। ফয়সাল একে একে জেদ্দা, ইয়ানবো, আকাবা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নগর জয় করেন। অন্যদিকে মিশর থেকে ব্রিটিশ-ফরাসী ফৌজও সিনাই হয়ে ফিলিস্তিন-লেবাননে ঢুকে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯১৮এর সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ঈজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স সিরিয়ার দামেস্ক দখল করে নেয়। ফয়সালও তাদের পিছু পিছু দামেস্কে প্রবেশ করে আরবদের জন্যে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। সে রাজ্যে ধর্মনির্বিশেষে সকল আরবদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

কিন্তু এর পরপরই ফয়সাল ও হুসেইন একের পর এক দুঃসংবাদ পাওয়া শুরু করলেন। জানতে পারলেন ১৯১৭তে ব্রিটিশদের ঘোষিত বালফুর ডিক্লারেশনের কথা — যাতে ফিলিস্তিনের অংশবিশেষে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইহুদীদের জন্যে আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার অধিকার স্বীকৃত হয়। আরো তাঁদের কানে এলো ব্রিটিশ-ফরাসীদের গোপন সাইকস-পিকো চুক্তির কথা। এর শর্তানুযায়ী সিরিয়া-লেবানন আর ইরাক হবে যথাক্রমে ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক বলয়ের অংশ, স্বাধীন আরব বাসভূমি নয়। ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে বিশ্বাস হারালেন না অবশ্য ফয়সাল। ভাবলেন, সাইকস-পিকোর বাস্তবায়ন হবে যুদ্ধের সমাপ্তিতে, ততদিনে তিনি ব্রিটিশদের মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।… এর এক মাস পরেই অক্ষশক্তি আত্মসমর্পণের ফলে যুদ্ধের যবনিকাপাত হয়ে যায়।

যুদ্ধের পরে তুরস্কের দখলকৃত এলাকাগুলির কি হবে সে নিয়ে প্যারিসে মিত্রশক্তির আলোচনা বসে। তাতে যোগ দেন ফয়সাল। মার্কিনরা ব্রিটিশ আর ফরাসীদের রাজি করায় স্বাধীন কিং-ক্রেইন কমিশনের মাধ্যমে ফয়সালের সমস্যাটি সমাধান করতে। সে কমিশন ১৯২০এ সিরিয়ায় এসে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন শহরে গিয়ে আরব জনগোষ্ঠীর মতামত নেয়া শুরু করে। তাদের মতে পৌঁছতে বছর খানেক সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত যখন সে কমিশনের রিপোর্টও এল যে এসব এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী কোন না কোন প্রকার স্বাধীনতা চায় আর এদের সকলে স্বাধীন আবাসভূমির যোগ্য না হলেও সিরিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব, ততদিনে ব্রিটিশ-ফরাসীরা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছে, আর লীগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সাইকস-পিকো চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাগিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র লীগের সদস্য হয়নি, কংগ্রেসের বাগড়া দেয়ার কারণে। তাই কিং-ক্রেইন কমিশনের রিপোর্টও বস্তাবন্দি হলো।

এসব ঘটনার বিপরীতে সিরিয়ায় ফয়সালপন্থী বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান আর দক্ষিণ সিরিয়ার দ্রুজরা অবশ্য ফয়সালবিরোধী ছিল। ফরাসীরা সেনাদল পাঠিয়ে জোরপূর্বক নিজেদের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সাথে এক দফা যুদ্ধে ফয়সালের সেনাদল পরাজিত হয়। ফয়সাল হার মেনে যুক্তরাজ্যে নির্বাসন চলে যান। এখানে শুরু হয় তৃতীয় ডাকটিকেটটির ইতিহাস।

অবশ্য ফয়সালকে বেশিদিন রাজ্যবিহীন রাজা থাকতে হয়নি। ব্রিটিশরা তাদের ম্যান্ডেটরাজ্য ইরাকে তাঁকে রাজসিংহাসনে বসায়। আর ট্রান্সজর্ডান ম্যান্ডেটের রাজা হন তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ। হেজাজ় রাজ্যে তাঁদের বড় ভাই আলী কিছুদিন রাজা থাকার পর সৌদী আক্রমণের মুখে ১৯২৫এ তাঁকে গদি ছাড়তে হয়। সেখানে শুরু হয় ইতিহাসের নতুন এক পাতা।


(১) মিডল ঈস্ট থিয়েটার ছিল পাঁচটি সমরাঙ্গন জুড়ে: সিনাই-ফিলিস্তিন, মেসোপটেমিয়া, ককেশাস, পারস্য, আর গালিপোলি। মেসোপটেমিয়া বা ইরাক অভিযানে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অংশগ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুল এ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে লাহোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নেন, কিন্তু সে যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়নি। [Middle Eastern theatre of World War I]

(২) ইজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স বা ই.ই.এফ. ছিল মিশরভিত্তিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, ফ্রান্স ও ইতালীর সম্মিলিত সেনাদল। কমনওয়েলথ সেনাদলের অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডার কোরের ডাকনাম আনজ়াক — এরা গালিপোলি সমরাঙ্গনে সাহসিকতার সাথে লড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরেক ক্যাজুয়াল্টি ছিল মিশর। ১৮৬৭ থেকে নামে মাত্র তুরস্কের অধীন ছিল মিশরের স্বাধীন শাসক খদিভরা, ইউরোপীয়দের সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। ১৯১৪ সালে খদিভ আব্বাসকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা সরাসরি মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করে, এর মূল কারণ ছিল ভারতের সাথে যোগাযোগের অবলম্বন সুয়েজকে রক্ষা করা। [Egyptian Expeditionary Force]

(৩) মক্কার শরাফা বা আমিরাত, এ ছিল হুসেইন বিন আলীর রাজ্যের আনুষ্ঠানিক নাম। হেজাজ়ের আগে এটি সার্বভৌম রাজ্য ছিল না। ৯৬৮ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত এই রাজ্যটি নানা আকারে বহাল ছিল। [Sharifate of Mecca]

(৪) বনি হাশেম গোত্র প্রাচীন কুরাইশ বংশের অন্তর্গত, এর নাম হযরত মুহম্মদের(স.) প্রপিতামহের নামে। অর্থাৎ হুসেইনের একটা ধর্মীয় বংশগত মর্যাদা ছিল। তিনি সৌদী ছিলেন না। সৌদীরা এসময় ছিল মরুভূমির সীমিত গুরুত্বের বেদুঈন গোত্রমাত্র। আর তাদের শত্রুতা ছিল হুসেইনের সাথে। হুসেইনের তিন পুত্র আলী, ফয়সাল ও আবদুল্লাহ পর্যায়ক্রমে হেজাজ, সিরিয়া-ইরাক আর জর্দানের রাজা হন। ১৯২৫এ ইবন সৌদ নজদ রাজ্য থেকে আক্রমণ চালিয়ে হেজাজ় দখল করে নিয়ে সৌদী আরব রাজ্যের সূচনা করেন। আলী জর্দানে ফিলিস্তিন আততায়ীর হাতে মারা যান ১৯৫১তে। আর ফয়সালের পৌত্র ইরাকের রাজা দ্বিতীয় ফয়সাল মিলিটারি কুতে ১৯৫৮ সালে নিহত হন। এখন একমাত্র জর্দানে হাশেমী রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে অনেকদিন হুসেইন ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাঁর পুত্রদের রাজমুকুট পড়িয়েও ব্রিটিশরা তাঁর রাগ ভাঙ্গাতে পারেনি। শেষে তাঁকে ছেড়ে সৌদবংশের সাথে মিত্রতাচুক্তি করে ব্রিটিশরা। [Hussein bin Ali, Sharif of Mecca]

(৫) টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স তাঁর ডাকনাম অর্জন করেন ব্রিটিশ খবরের কাগজে আরব বেদুঈনদের স্বাধীন একরোখা জীবনের রোমান্টিক চিত্র অঙ্কন করে। গুপ্তচর-কূটনীতিক-সেনাপ্রধানের পাশাপাশি শখের প্রত্নতত্ত্ববিদও ছিলেন। ১৯৬২তে তাঁর জীবনের ঘটনা নিয়ে তৈরি অনবদ্য ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের রূপ দেন অভিনেতা পিটার ও’টুল। ফয়সালের সাথে তাঁর ভাল সখ্য থাকলেও বাকি দু’ভাইকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি লরেন্স। [T. E. Lawrence]

(৬) (৬) ওসমানী সাম্রাজ্যের আরবদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয়দের তুলনায় অধুনার ধারণা। ১৯০৮এ বিপ্লবের মাধ্যমে তুরস্কের শাসনক্ষমতা নেয় ইয়াং টার্ক বলে একদল প্রগতিশীল কর্মজীবী নেতা। তাদের শাসনামলে সংসদীয় প্রথার পুনর্প্রবর্তন হলেও বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তার ওপর বাল্কানের যুদ্ধের ডামাডোল। ফলে ১৯১৩তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তিন পাশার ত্রিনায়কতন্ত্র। প্রতি ক্ষেত্রেই তুর্কীরা স্বহস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় ইউরোপে অবস্থানরত একদল বীতশ্রদ্ধ আরব শিক্ষার্থী ১৯১৩তে প্যারিসে একটি আরব কংগ্রেস ডাকে। এতে ওসমানী সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি এলাকার বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে আরবদের সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, বরং স্বাধিকার। ফিলিস্তিনে তুর্কী অভিবাসন আইনের সদ্ব্যবহার করে ইহুদীদের আগমন আর ব্রিটিশ-ফরাসীদের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল আরবদের সংগঠিত হবার আরেক কারণ। আরব কংগ্রেস থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড, বাথ পার্টি, ফ্রী অফিসারস, প্রভৃতি মুভমেন্টের ধারার বিবর্তন। অর্থাৎ হাশেমী-সৌদী রাজতন্ত্রের ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা বাহুল্য, এসময় অধিকাংশ অশিক্ষিত বেদুঈন গোত্রীয় যোদ্ধার দল এত কিছু বুঝত না। প্রাচীনকালের নিয়মানুযায়ী যে দল বেশি উৎকোচ দিত, তাদেরই পক্ষ নিত তারা। [Arab Congress of 1913]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!