রূপকথার শহর জাফা

Featured Video Play Icon

এক বছর আগের সূর্যাস্তের স্মৃতি — ইজরাইলের তেল আবিব শহরের নিকটস্থ পুরনো জাফা শহরতলীতে। পর্যটকদের জন্যে পাথরে তৈরি পুরনো সব ঘরবাড়ি, দুই তিন তলা সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অলিগলি সব অক্ষত রাখা হয়েছে।

সারি বেঁধে তিন চারটে কামান সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখা। অটোমান তু্র্কী আমলের সিটাডেলের প্রতিরক্ষাব্যূহের অংশ। ১৭৯৯ সালে স্বয়ং নাপোলেওনের জাহাজবহর সে প্রতিরক্ষাভেদ করে জাফা শহরে সফল আক্রমণ চালায়।

ঊনবিংশ শতকে স্থানীয় ও নবাগত অভিবাসী ইহুদীরা যখন অনতিদূরে তেলআবিব শহরের গোড়াপত্তন করছে, তখন জাফা নগরী কমপক্ষে ৩৭০০ বছরের পুরনো। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী জাফার বন্দর থেকেই ইউনুস নবী — বাইবেলের জোনাহ — সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে বৃহৎকায় মাছের পেটস্থ হন।

মিশরের নিউ কিংডম আমলেও জাফা ছিল কৌশলগত একটি অবস্থান। সেসময়ের জাফাকে ঘিরে একটি ঘটনাই হয়তবা রূপকথার পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আরব্যরজনীর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পটি। খ্রীষ্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে ফারাও তৃতীয় তুথমোসের শক্তিমান সেনাপতি জেহুতি ইজরাইল-কানানের স্বাধীন নগররাজ্যগুলোর ওপর সাম্রাজ্য কায়েম করেন। তখনো ইহুদী রাজ্য ইজরাইল-জুদার গোড়াপত্তন হয়নি। মিশরীদের তদকালীন শত্রু ছিল উত্তরে তুরস্কের হিট্টাইটরা। ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের নগররাজ্যগুলি দুই সাম্রাজ্যের মাঝে এক রকম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়।

জাফা দখলের জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন জেহুতি। নগরপতিকে নিজের ক্যাম্পে দাওয়াত করে নিয়ে এসে আটকে ফেলেন। তারপর দু’শ সৈন্যকে গমের বস্তার মত সাজিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে দুর্গের দরজায় পাঠানো হয়। ঘোষণা করা হয়, রাজ্যপালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন জেহুতি। আর নগরবাসীদের উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে গাধায় করে। উল্লসিত জনগণ দরজা খুলে গাধার কাফেলাকে বরণ করে নেয়ার পর রূপকথার চিচিঙ ফাঁক!

এ গল্প রয়েছে মিশরে প্রাপ্ত বিখ্যাত হ্যারিস প্যাপিরাস ৫০০তে, যেটি এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। প্রাক-আধুনিক যুগেই এই প্যাপিরাসসহ অনেক বস্তু মিশরীয় কোন না কোন রাখাল খুঁজে পেয়ে বিক্রি করে দেয় ইউরোপীয় ধনাঢ্য সংগ্রহকারীর কাছে।

বর্তমান জাফায় রয়েছে অটোমান যুগের বহু নিদর্শন। কিছুই ধ্বংস করা হয়নি। একটা ক্লক টাওয়ার। লাইটহাউজ, জেলখানা — সেটি এখন ফাইভস্টার হোটেল। তিনটা মসজিদঃ মাহমুদিয়া মসজিদ, আল বাহর মসজিদ, আজামি মসজিদ। সবগুলি সাগরতীরে প্রাইম প্রপার্টিতে। আরো আছে সেন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চ, সেন্ট অ্যান্টনিস ম্যারোনাইট চার্চসহ অগণিত ছোটবড় গীর্জা-ক্যাথেড্রাল। এগুলিতে উপাসনা করে মূলত আরব ফিলিস্তিনীরাই। বিশেষত লেবাননী আরবরা ম্যারনাইট তরিকার খ্রীষ্টান। এতগুলি চার্চ থাকার কারণ, যীশু খ্রীষ্টের অন্যতম শিষ্য সেন্ট পিটার নাকি এখানে মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার মাজেজা ঘটিয়েছিলেন।

রূপকথা আর মাজেজার শেষ এখানেই নয়। বন্দর থেকে সামান্য দূরে সাগরের বুকে জেগে থাকা একটা বড় পাথরের নাম অ্যান্ড্রমেডা রক। গ্রীক মিথে জাফার রাজা সিফিয়াস, তার কন্যা অ্যান্ড্রমিডা — যার নামে একটা গ্যালাক্সির নাম। আর তার বউ ক্যাসিওপিয়া — যার নামে একটি তারকামন্ডলের নাম। সিফিয়াস গর্ব করত এ দুজন নাকি জলকন্যাদের থেকেও রূপবতী। জলকন্যারা তাদের বাপ দেবতা পসাইডনের কাছে বিচার দিলে পসাইডন বিশাল এক সমুদ্রদানব পাঠিয়ে জাফাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তখন অনন্যোপায় সিফিয়াস শহরবাসীদের সাথে ষড় করে ঠিক করেন পসাইডনের কাছে বলি দিতে হবে অ্যান্ড্রমিডাকে। তারপর এই পাথরেই শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা হয় অ্যান্ড্রমিডাকে। তাকে দানবের হাত থেকে বাঁচায় পার্সিয়াস — গ্রীক মিথের অন্যতম হিরো।

রূপকথার এ নগরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে এসব খেলে গেল মাথার ভেতরে। রোমহর্ষক ব্যাপার! আধুনিক কালে ফিরিয়ে আনল মোটে চৌদ্দশ বছরের পুরনো আযানের ধ্বনি। মাগরিবের পরে দেখা গেল বহু আরব মুসলিম নরনারী — অনেকে আবায়া পরে — সাগরতীরে হাওয়া খাচ্ছে, সেলফি তুলছে। এসইউভির নাম্বারপ্লেট ওয়েস্ট ব্যাংকের। কে বলবে মোটে এক ঘন্টার রাস্তার ওপারে পবিত্র ভূমি নিয়ে এরা এবং এদের প্রতিবেশীরা বাস করছে অনিশ্চয়তার অন্য এক জগতে?

সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন

চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরী জাতীয়তাবাদী কুমিন্টাংয়ের বিরুদ্ধে ১৯৪৯এ গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। দাবি করা হয় যে, কম্যুনিস্ট শাসন শুরুর মাধ্যমে তারা চীনের “সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের” যবনিকাপাত করেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই টার্মটি আসলে চীনের কুমিন্টাং জাতীয়তাবাদীদেরই তৈরি ও ব্যবহৃত। অর্থাৎ চীনা কম্যুনিস্টরা কম্যুনিজমের শ্রমিক-চাষী-সৈনিক ইত্যাদি খেঁটে খাওয়া মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব কপচালেও পেতি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সোশালিস্ট মার্কেট পলিসি ছেড়ে দিলেও ঐ পেতি-বুর্জোয়া ন্যাশনালিজম রয়ে গেছে। এটা বলতে গেলে রাশিয়ার মত অবস্থা, স্তালিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিজম চলেছে ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে। আর কম্যুনিজমের পতনের পর সোশালিজম নাই হয়ে গেলেও ন্যাশনালিজম ষোল আনা বর্তমান।

দং শিওয়েনের অংকিত “জাতির গোড়াপত্তন অনুষ্ঠান” চিত্রকর্মে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণারত মাও জেদং, বর্তমান চীনা ন্যারেটিভে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি একই সাথে।

যা হোক, আজকে চীন ও রাশিয়া আপাত মিত্র। তবে সে মিত্রতায় চীনের পাল্লা অসামঞ্জস্যপূর্ণরকম ভারি। আর কোন বাজার না থাকায় রাশিয়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রান্তিক সম্ভাবনা। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে চীনের ওপর রাশিয়া অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ও ভোক্তাপণ্যের জন্য। দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।

কিন্তু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অন্য একটা ব্যাপারে খটকা লাগা স্বাভাবিক। সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি কি চীনা কম্যুনিস্টরা সম্পূর্ণ করেছে? তাইওয়ান তো এখন আর ভিনদেশীদের কলোনি নয়। আর হংকং-মাকাউ তো নব্বই দশকেই ফিরে গেছে, তাও তদকালীন কলোনিয়াল প্রভুদের ইচ্ছায় — সেসব স্থানের মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটে নয়।

সবুজ দাগে দেখানো “নাইন-ড্যাশ” লাইন বরাবর চীনা সমুদ্রসীমার দাবি, যেটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের লংঘন ও প্রতিবেশী দেশগুলির ন্যায্য হিস্যার পদদলন
চিং সাম্রাজ্যের শিখরে চীনের সীমান্তরেখা, ঊনবিংশ শতকের পূর্বার্ধ

এখনো নাইন ড্যাশ লাইন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চীন লেগে থাকে। চীনাদের দাবি অন্যায্যভাবে চিং রাজত্বকালে ও রিপাবলিক অফ চায়না শাসনামলে এসব এলাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নাকি গলাধঃককরণ করেছে। আসুন একটু সে অন্যায্যতার ফিরিস্তিটা দেখি। খেয়াল করে দেখবেন, ১৮৫৮ সালের ঘটনাটা!

১৮৩৯-৪২ঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। পাঁচটি বন্দরে বিশেষ শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশদের। হংকং ব্রিটিশদের দখলে (শুধু হংকং দ্বীপটি, আয়তন ৮০ বর্গ কিমি)। পরে লীজকৃত নিউ টেরিটরিসহ হংকং চীনের কাছে ফিরে যায় ১৯৯৭ সালে। সকল ট্রিটী পোর্টের বিশেষ সুবিধা ত্রিশের দশকের মধ্যে পশ্চিমারা হারায়, প্রথমে মার্কিন মধ্যস্থতায়, পরে চীন-জাপান সংঘাতের ডামাডোলে। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আসার আগেই। ট্রিটি পোর্টগুলিতে চীনা সার্বভৌমত্বই জারি ছিল, কিন্তু পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীরা বিশেষ সুবিধা পেত।

হংকং ও আশপাশের ব্রিটিশ উপনিবেশ পুরো চীনের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র

১৮৪৪ঃ ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশদের মত একই প্রকার আনইকুয়াল ট্রিটীর মাধ্যমে সে পাঁচটি বন্দরে বিশেষ সুবিধাপ্রদান।

১৮৫৬-৬০ঃ ব্রিটিশ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। হংকংয়ের সাথে কাউলুন যুক্ত, ৭০ বর্গ কিমি। এ সুযোগে রুশরা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র করে।

১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধপরবর্তী চিং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

১৮৫৮ঃ ট্রিটী অফ আইগুনের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের হাতে চিং সম্রাটকে ছেড়ে দিতে হয় আউটার মাঞ্চুরিয়া নামক এক বিশাল এলাকা। আমুর-উসুরি নদী দ্বারা সীমানা নির্ধারিত হয়। এলাকা ৬,০০,০০০ বর্গ কিমি, বর্তমান ইউক্রেন সাইজের। এ অঞ্চল এখনো রাশিয়ার হাতে। ভ্লাদিভস্তক মূল শহর, আরেক বড় শহর খাবারস্ক। অধিকাংশ জনসাধারণ মাঞ্চুরিয়ান, রুশ নয়। চীন এখনো এই বিশাল সম্পদশালী এলাকা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কবে চীনের এ হিউমিলিয়েশনের শেষ হবে তাও কারো জানা নেই। ষাটের দশকে সোভিয়েতদের সাথে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সকলে মুখ চেপে আছে।

১৮৫৮ সালে বিনা যুদ্ধে সামরিক হুমকি-ধামকি দিয়ে উত্তরপূর্ব মাঞ্চুরিয়ার বিশাল এলাকা চীনের থেকে হস্তগত করে রুশ সাম্রাজ্য, এলাকাটি এখনো রাশিয়ার অংশ

১৮৫৮ঃ ট্রিটি অফ তিয়েনৎসিনের মাধ্যমে ট্রিটি পোর্টের সংখ্যা ও সুবিধা আরো বৃদ্ধি। ব্রিটিশ-ফরাসীদের পাশাপাশি রুশ-মার্কিন নাগরিকদের এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। রুশরাও পাবে ট্রিটি পোর্টের সুবিধা। প্লাস যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ।

১৮৮৪-৮৫ঃ ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের তিনটি অঞ্চলের (আনাম — ১,৩০,০০০ বর্গ কিমি, তংকিন — ১,০৩,০০০ বর্গ কিমি, কোচিনচিন — ৬৯,০০০ বর্গ কিমি) ওপর ফরাসীদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার। তবে এ ভিয়েতনাম অতীতে বহুবার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। চীনই তাদের প্রাচীনতম শত্রু। ভিয়েতনাম স্বাধীনদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় ১৯৪৮ সালে। ফরাসী-মার্কিনদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধ করলেও চীন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ।

ভিয়েতনামের উত্তরাংশ চিং সাম্রাজ্যের প্রভাববলয়ে থাকায় ফ্রান্স ও চীনের মধ্যে ১৮৮০র দশকে যুদ্ধের মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়

১৮৮৮ঃ ব্রিটিশ ভারতের সিক্কিম অভিযান। তিব্বতের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ছোট রাজ্যটির সাথে প্রটেক্টরেটের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারত। সিক্কিমের আয়তন ৭,০০০ বর্গ কিমি। ওদিকে কিন্তু তিব্বতকে চিং সম্রাট সে অধিকার দেয়নি ইত্যাদি বলা হয়। তিব্বত নাকি চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও তিব্বত ছিল এ এলাকার সার্বভৌম একটি সাম্রাজ্য। কম্যুনিস্ট চীন ১৯৫০ সালে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিব্বতের ক্ষুদ্র প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে “হিউমিলিয়েশনের” সমাপ্তি ঘটায়। এখনো দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের একটি নির্বাসিত সরকার আছে ভারতে। তিব্বতের আয়তন ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি।

১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন তিব্বতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে “শান্তিপূর্ণ মুক্তি” এনে দেয় চীনের লালবাহিনী

১৮৯৪-৯৫ঃ নব্য পরাশক্তি জাপানের সাথে যুদ্ধ ও পরাজয়। তাইওয়ান দ্বীপটি (৩৬,০০০ বর্গ কিমি) জাপানের কাছে সোপর্দ। কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর জাপানী প্রটেক্টরেট, যদিও সেটির পোশাকি নাম এম্পায়ার অফ কোরিয়া। কোরিয়া স্ব অধিকারে একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য ছিল, তবে মোঙ্গল দিগ্বিজয়ের পর পর চীনের ইউয়ান, মিং ও চিং সাম্রাজ্যের লেজুড় হয়ে রয়। তবে সে সম্পর্কটা ছিল করদ রাজ্যের। ১৮৮০র দশকে কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব হরণ করে চিং সাম্রাজ্য। ফলশ্রুতিতে জাপানী আক্রমণ। এখন দুই দেশে বিভক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ (উত্তরঃ ১২০,০০০ বর্গ কিমি, দক্ষিণঃ ১০০,০০০ বর্গ কিমি)। চীন উত্তর কোরিয়ার ওপর বলতে গেলে এখনো সেরকম প্রাচীন প্রভাব খাঁটিয়ে চলেছে। তাইওয়ান ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও ছিল ডাচ-পর্তুগীজ ঘাঁটি। তাইওয়ানের মূল অধিবাসীরা চীনা নয়। চিং সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অন্তর্গত হলেও সেখানে স্থানীয়রা বিদ্রোহ করেছে, জাপানী শাসনের প্রাক্কালে ১৮৮০র দশকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে থাকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪৯এ রিপাবলিক অফ চায়না সরকার গৃহযুদ্ধে হেরে সেখানে পালিয়ে যায়।

১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে তাইওয়ান ও কোরিয়াসহ উত্তরের বেশ কিছু এলাকা চীনের প্রভাবমুক্ত হয়

১৮৯৫ঃ জাপান যুদ্ধে জিতে চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপের পোর্ট আর্থার ও সংলগ্ন অঞ্চলের (৩৫০,০০০ বর্গ কিমি) লীজ পেলেও তিন ইউরোপীয় শক্তি জার্মানি, রাশিয়া ও ফ্রান্স জবরদস্তি করে সে এলাকা লীজে তুলে দেয় রুশদের হাতে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শেষ মাথা বানানোর তাগিদে রুশরা জাপানীদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯০৫এ তাদের মধ্যে যুদ্ধে এবং রুশদের পরাজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সোভিয়েত দখলদারিত্ব। তারপর মাওয়ের কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে ফিরে যায় এ এলাকা।

১৯০৩ সালের রুশ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ের সাথে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়া রেললাইনের সংযুক্তি

১৮৯৯-০১ঃ বক্সার বিদ্রোহ। বিদেশীবিরোধী, খ্রীষ্টানবিরোধী এক পপুলিস্ট মিলিশিয়া যাদের নাম বক্সার, সমানে কচুকাটা করে পশ্চিমা আর তাদের স্থানীয় মিত্রদের। চিং সম্রাজ্ঞী সিশি গোপনে তাদের সমর্থন দেন। বিদ্রোহ দমনে আটটি দেশ অভিযান চালায়, যাদের মধ্যে রুশ ও জাপানীও ছিল। রাশিয়া এ সময় পুরো মাঞ্চুরিয়া (৯৮০,০০০ বর্গ কিমি) দখল করে রাখে ও লুটতরাজ চালায়। বিদ্রোহের পরও তারা সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, ফলশ্রুতিতে জাপানের সাথে ১৯০৫এর যুদ্ধ। জার্মানি দখল নেয় চিংদাওয়ের (৫০০ বর্গ কিমি) আর ফরাসীরা কুয়াংচৌওয়ান (৫০০ বর্গ কিমি)। আর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চিং সম্রাটকে। প্রসঙ্গত, মার্কিনদের যে ক্ষতিপূরণের ভাগ ছিল তা থেকে পরে আমেরিকায় চীনা ছাত্রদের পড়াশোনার ফান্ড তৈরি করে দেয়া হয়, বর্তমান ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও সে টাকায় শুরু।

১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহদমনে চীনে অনুপ্রবেশ করে ৮ জাতির শান্তিরক্ষীবাহিনী

১৯০৫ঃ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়। মাঞ্চুরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ও লিয়াদংয়ের দখল জাপানের হাতে। মাঞ্চুরিয়ার আদিবাসীদের নাম জুরচেন, এরা হান গোষ্ঠীর চীনা নয়।

১৯১১ঃ সপ্তদশ শতক থেকে “আউটার মঙ্গোলিয়া” (১,৫০০,০০০ বর্গ কিমি) চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হলেও ১৯১১তে বিপ্লবের গোলমালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৯এ চীনের প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও রুশ বিপ্লবের জোয়ার এসে পড়ে এখানে। ফলশ্রুতিতে রুশ সোভিয়েত পাপেট একটি পীপলস রিপাবলিক গঠিত হয়। সেই থেকে দুই দেশের বাফার হয়ে রয়েছে বর্তমান মঙ্গোলিয়া দেশটি। যদিও ইনার মঙ্গোলিয়া (১,২০০,০০০ বর্গ কিমি) এখনো চীনের অধীনস্থ তথাকথিত “স্বায়ত্ত্বশাসিত” অঞ্চল। তিব্বতের মত তাদেরও স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। আর মঙ্গোলিয়া দেশটি ধীরে ধীরে প্রকারান্তরে চীনের ইকনমিক কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।

বর্তমান মঙ্গোলিয়া চীন থেকে স্বাধীন হলেও ইনার মঙ্গোলিয়া বলে একটি বিশাল এলাকা এখনো চীনের অধীন

১৯১১ঃ তিব্বতেও একই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সিক্কিম নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে গোলমালের কারণে দক্ষিণ তিব্বতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। নামমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে এরপর তিব্বত ১৯৫০ পর্যন্ত চীনের প্রভাবমুক্ত থাকে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি অন্য কোন দেশ।

১৯২৯ঃ চীনের সাথে সোভিয়েতের প্রথম যুদ্ধ। নতুন চীনা রিপাবলিক মাঞ্চুরিয়ায় চায়নিজ ঈস্টার্ন রেলওয়েতে যে যৌথ প্রশাসন থাকার চুক্তি তা অগ্রাহ্য করে। সোভিয়েত সেনাদল দ্রুত চীনাদের হারিয়ে আগের লীজের চুক্তি পুনর্বহাল করে। এ সুযোগে উসুরি নদীতে একটি বড় দ্বীপ জবরদখল করে নেয়। বলশয় উসুরিস্কি নামের এ দ্বীপ (৩৫০ বর্গ কিমি) মোটে ২০০৪ সালে রাশিয়া ফিরিয়ে দেয় চীনকে।

দখলকৃত কোমিনতাং পতাকা হাতে রুশ লালবাহিনীর সৈন্য

১৯৩১-৩২ঃ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের আগ্রাসন। জার্মানি কর্তৃক ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট এই আক্রমণ। মাঞ্চুরিয়ায় একটি “স্বাধীন” পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জাপান। ক্ষমতাসীন করে ১৯১২তে ক্ষমতাচ্যুত চীনা চিং সম্রাটকে। ১৯৪৫এ সোভিয়েতরা জাপানীদের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও পরে মাওয়ের কম্যুনিস্টদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সঁপে দেয়। এখানকার ঘাঁটি থেকেই চীনা কম্যুনিস্টরা কোমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালায়।

মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের পর রেললাইনে “ক্ষয়ক্ষতি” পরিদর্শনে এসেছে জাপানী পরিদর্শকদল

১৯৩৪ঃ শিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কেস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন। এ সময় চীনে ছিল “স্বাধীন” বিভিন্ন ওয়ারলর্ডদের আধিপত্য। শিনজিয়াং বা উইগুর প্রদেশে কোমিনতাং সমর্থিত এক মুসলিম হুই চীনা ওয়ারলর্ড ও সোভিয়েত পাপেট আরেক ওয়ারলর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। উইগুর খানদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন পূর্ব তুর্কেস্তান রিপাবলিকও আবির্ভূত হয়, যেটা আসলে ছিল ইসলামিস্ট আখরা। কোমিনতাং ওয়ারলর্ড জিতে যাবার প্রাক্কালে সোভিয়েতরা আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয়জনের মাঞ্চু সৈন্যদলকে সহায়তা করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাঠানো লিটল গ্রীন মেনের মত উইগুরে পাঠানো এ সকল রুশ সৈন্যদের পোশাকে কোন পরিচয়ধারী প্রতীক ছিল না। মুসলিম সেই ওয়ারলর্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিনজিয়াংয়ে অপর ওয়ারলর্ডের সোভিয়েত পাপেট শাসন চলে ১৯৪২ পর্যন্ত।

১৯৩৪ সালে প্রথম “স্বাধীন” পূর্ব তুর্কেস্তান (শিনজিয়াং) সরকার

১৯৩৭-৪৫ঃ চীন-জাপান যুদ্ধ, যেটা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চলমান থাকে। এ সময়ে চীনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা ছিল জাপানের দখলে — প্রায় ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানী নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ লাখ মানুষ। চীনকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র — কম্যুনিস্ট ও কোমিনতাং উভয়কেই।

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানীরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে চীনাদের বিপক্ষে

১৯৪৫ঃ জাপানের পাপেট রাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সোভিয়েতরা, ‌হিরোশিমা-নাগাসাকির ঠিক পরপর। তারা জাপানী পাপেট সরকারের সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ করতে করতে সেখানে সোভিয়েতঅধিকৃত উত্তর কোরিয়া থেকে ঢুকে পড়ে বহু চীনা কম্যুনিস্ট, যারা রাশিয়া কিংবা কোরিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তাদের হাতে পড়ে মাঞ্চুকোর সেনাবাহিনীর অস্ত্র। কোমিনতাং সরকারের কাছে সোভিয়েতরা নামমাত্র মাঞ্চুরিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও কম্যুনিস্ট দোসরদের একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মাও সেতুং উত্তরের ঘাঁটি থেকেই কোমিনতাং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে চীনের সবচে শিল্পায়িত এলাকাটির কারখানার কলকব্জা ইত্যাদি খুলে লুট করে নিয়ে যায়। জাপান বা মাঞ্চুকো থেকে সরাসরি সোভিয়েতের ওপর যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও সোভিয়েতরা জাপানীদের সাথে সংযুক্ত সকল কম্পানিকে এমন “গনিমতের মাল” হিসাবে লুট করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে “নিরপেক্ষ” সোভিয়েতরা ঘোষণাব্যতিরেকে আক্রমণ চালিয়ে জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুকো’র দখল নেয়

১৯৪৪-৪৯ঃ শিনজিয়াং উইগুর প্রদেশে আরেকটা “স্বাধীন সোভিয়েত” পাপেট রাষ্ট্র গঠন করে সোভিয়েতরা। ১৯৪৯এ চীনের গৃহযুদ্ধে কম্যুনিস্টদের বিজয়ের পর সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে এ রাষ্ট্রের নেতারা। প্রদেশটি অংশ হয় চীন গণপ্রজাতন্ত্রের।

ছোটখাটর মধ্যে এই ফিরিস্তি আশা করি এ ধারণাটা আপনাদের দেবে যে পশ্চিমারা চীনকে যতটা হিউমিলিয়েট করেছে তার থেকে হাজার গুণে বেশি করেছে তাদের নিকট দুই প্রতিবেশী জাপান ও রাশিয়া — যাদের কোনটিকেই সে আমলে ঠিক পশ্চিমা কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। আর পশ্চিমাদের হাতে যে সকল ক্ষুদ্র এলাকা ছিল সব ফিরে পেয়েছে চীন। পায়নি কেবল রাশিয়ার দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকাগুলি। যেটুকু ফিরে পেয়েছে, তাও কম্যুনিস্ট আদর্শগত কারণে, ১৯৪৯এর পর, যখন মাও-স্তালিন দুই দিন পরপর হ্যান্ডশেক করতে ব্যস্ত, আর কোরিয়ার ভাগ্যনির্ধারণে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে কিছু শান্তি চুক্তি চীন সম্প্রতি করেছে। কিন্তু ভাবুন ইউক্রেনের সাথে দুই বার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি সত্ত্বেও রাশিয়া সেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে “ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভ্রাতৃত্বের” দোহাই দিয়ে — চুক্তিভঙ্গ করে। চাইলে চীন একইভাবে উত্তর মাঞ্চুরিয়ার “নিপীড়িত ‘চীনা’ বেরাদরদের” সাহায্যে এগিয়ে এসে ইউক্রেন সাইজের এলাকাটি বেদখল করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীনের যা লাগে সব পুতিনের রাশিয়া না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে। যদি পুতিনের মৃত্যু হয়, রাশিয়ান ফেডারেশন আলগা হয়ে আসে, তাহলে চীন সেসব এলাকা ফিরে চাইতেই পারে। ১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিপ্লবের পরেও রুশ সাম্রাজ্য আলগা হয়ে এসেছিল। সেসময় সুযোগের সদ্ব্যবহারের অবস্থানে চীন ছিল না, ছিল জাপান।

কদিন আগে একটা খবরে এসেছে যে চীন উত্তর মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন শহরের নাম নিজেদের সরকারী মানচিত্রে দেখানো শুরু করেছে চীনা নামে, সাথে ইংরেজী নাম, কিন্তু রুশে নয়। চীনের টেরিটরিয়াল ক্লেইম করার পন্থা এটাই। যে এলাকায় নিজেদের “ঐতিহাসিক সংযোগ” দাবি করতে চায়, সেখানকার একটি “প্রাচীন” চীনা নাম দেবে, এবং তারপর সেটিকে নিজেদের বলে দাবি করবে। এই কাজটি চীন করেছে ভারতের সাথেও — আকসাই চীন আর অরুণাচল প্রদেশে।

সুতরাং চীনের হিউমিলিয়েশনের শতক নিয়ে বেশি কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ না করে তার প্রতিবেশীদের তক্কে তক্কে থাকা উচিত। ভিয়েতনাম, কোরিয়াকে অতীত বহু শতকে যেভাবে করদ বা ঔপনিবেশিক রাজ্যের হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল, কিংবা মাঞ্চুরিয়া-তিব্বত-ইনার মঙ্গোলিয়া-শিনজিয়াংকে এখনো সহ্য করতে হয়, সেরকম হিউমিলিয়েশনের গিভিং এন্ডে না থাকলে রিসিভিং এন্ডে থাকতে হবে। এ শিক্ষাটা রাশিয়া অতি শীঘ্রই পাবে।

বায়তুল মাকদিস – ৩

জুম্মার নামাজের পর ডোম অফ দ্য রকে যে অভিজ্ঞতা, রোববারে চীনা সহকর্মীদের সাথে তার থেকে ভিন্ন রকম। আজ বলি সে কথা, আর ইসলামের ভেতরে-বাইরে এই টেম্পল মাউন্টের কি ইতিহাস, কি তাৎপর্য, তার কিছুটা।

টেম্পল মাউন্ট নামটা পশ্চিমা বিশ্বে ডোম অফ দ্য রকের মতই ভাল চলে। মুসলিম বিশ্বে অবশ্য নামটা একটু সংবেদনশীল। কারণ এই “টেম্পল” মানে হল ইহুদীদের কিং সলোমনের পবিত্র টেম্পল। এর প্রাচীন অস্তিত্ব বায়তুল মোকাদ্দাসের নিচে। ইহুদীদের হাতে গোনা ফ্রিঞ্জ কিছু গ্রুপের এ ব্যাপারে অ্যানাক্রনিস্টিক দাবি রয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে অনতিভবিষ্যতে এখানে তৃতীয় আরেকটি টেম্পল প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্য মুসলিম বা আরবদের সামনে টেম্পল মাউন্ট শব্দটা ব্যবহার না করাটাই শ্রেয়।

মরোক্কো গেট বায়তুল মাকদিসের একমাত্র ফটক যেখানে অমুসলিমদের প্রবেশের অনুমতি আছে, তবে মেটাল ডিটেক্টর ও এক্সরে স্ক্যানের কড়া নিরাপত্তা

আগে বলেছি, অমুসলিমদের ঢোকার জন্যে কেবল একটি ফটক। বাব এল মাগরেব বা মরক্কো গেট নামের এ দরজায় পৌঁছতে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দক্ষিণ প্রবেশপথে গিয়ে লাইন করতে হয়। একটা ফুটব্রীজ ওয়েস্টার্ন ওয়ালের প্রাঙ্গনের ওপর দিয়ে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে গেটটির সাথে। মুসলিমদের জন্যে বরাদ্দ বাকি ১১টি প্রবেশপথের মত এ রাস্তায় ঢোকা সোজা নয়। ইসরাইলী পুলিশ এখানকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। সকল দর্শনার্থীর ব্যাগ-শরীর চেক হচ্ছে মেটাল ডিটেক্টর আর এক্স রে স্ক্রীনে। সূরা-দোয়া পড়ে পার পাবার উপায় নেই।

সকালে যখন মাউন্ট অফ অলিভস আর সিটি অফ ডেভিড একলা ঘুরছি, তখন নাকি চীনা সহকর্মীরা এখানে লাইন করেছিল। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হবার পর তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, বলা হয় এ মুহূর্তে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অবশ্যই জোহরের কারণে এই বিরতি। নামাজের সময়টা অমুসলিম পর্যটকদের উপস্থিতি কাম্য নয়। দুপুরের খাবারের পর আবার চীনারা ফিরে এসেছে, আমিও হোটেলে বিশ্রাম করে এসে ওদের সাথে যুক্ত হয়েছি।

মাথায় টুপি পরে খালি পায়ে বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছে ধর্মপ্রাণ ইহুদী, পুরো কম্পাউন্ডে এরা খালি পায়ে হাঁটে, কোনায় কোনায় গিয়ে প্রার্থনা করে

আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে দু’ তিনজন কিপ্পা আর প্রেয়ার শাল’পরা ধার্মিক ইহুদী। এদের পা খালি। পবিত্র ভূমিতে জুতা পরে ঢোকা তো বটেই, বেশির ভাগ ইহুদীদের জন্য এখানে ঢোকাটাই ধর্মে মানা। এদের আসার রাস্তা পর্যটকদের সাথেই। আর ভেতরে ঢুকতে পারলেও ইসলামী ওয়াকফের নির্দেশ অনুযায়ী ধর্মীয় পোশাক পরা কিংবা প্রার্থনা করা বারণ।

এসব ইহুদী তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। ইসরাইলের চীফ রাবিনেট থেকে এখানে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞার কারণ, সলোমনের টেম্পলে যে “হোলি অফ হোলিজ” ছিল তাতে প্রবেশের অধিকার সাধারণ ইহুদীদের আদিকালেই ছিল না। ছিল কেবলমাত্র প্রধান পুরোহিতের। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসসাধনের পর আর সে বাস্তবতা নেই, যদি না ঈশ্বর দৈববলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান।

গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে ইসলামী ওয়াকফের তদারকি। তারা চেক করছে দর্শনার্থীদের পোশাকআশাকের শালীনতা। পুরুষ যারা শর্টস পরেছে তাদের দেয়া হচ্ছে ধূসর রঙের লুংগির মত ক্যানভাসের আবরণ। সে লুংগির প্যাঁচে পড়ে গেল এক সহকর্মী। জেরুজালেমে ঢোকামাত্রই আমি বুঝেছি শর্টস পরলে কোথাও না কোথাও আটকে যাব, তাই বাঁচলাম। মেয়েদের মাথা ঢাকা না থাকলে গরমের মধ্যেই ওয়াকফ সদস্যরা তাদের পরতে দিচ্ছে হুডিসহ জোব্বা।

আমাদের মেয়াদ মোটে এক ঘন্টা। আশপাশেই নজরদারিতে রয়েছে ওয়াকফের লোকজন। ভেতরের প্রাঙ্গনে সাধারণ অনেক মুসল্লী প্রার্থনারত। তবে শুক্রবারের মত মানুষ নেই। মসজিদুল আকসার প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি গেলেই সেখানকার দ্বাররক্ষী বিপরীত পথ প্রদর্শন করছে। কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকতে দিলেও মসজিদুল আকসা আর ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঢোকার অনুমতি অমুসলিমদের নেই।

একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় আমাদের দিকে এগিয়ে এল এক আরব। কিছু টাকার বিনিময়ে ট্যুর গাইড হবার অফার করল। তিন চীনা সঙ্গী আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, লাগবে না, এ আমাদের গাইড। তাতে ভদ্রলোক রাগে গজগজ করতে এক ইউরোপীয় দলের দিকে চলে গেল। সে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! তার থেকে বেশি জানবে আরেক “ট্যুরিস্ট?” তার বেশভূষা দেখে অবশ্য অধ্যাপক বলে মনে হয় না। শুক্রবার জুম্মার পরে দেখেছি বহু প্রফেশনাল ট্যুর গাইড মুসলিমদেরকে ফিরিস্তি দিচ্ছে। ইনি তাদের মত নন।

ডোম অফ দ্য রকের চারপাশ দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলাম। ইহুদীদের “হোলি অফ হোলিজ” নাকি ছিল এখানেই, সাখরা পাথরের ওপর। এই “হোলি অফ হোলিজের” হিব্রু নাম “কোদেশ হা’কোদাশিম।” হিব্রু কোদেশ আর আরবী কুদ্দুস একই শব্দ — পবিত্র। রুহুল কুদ্দুস বা হোলি স্পিরিট শব্দটা প্রায় হুবহু হিব্রুতে তালমুদে রয়েছে — রুয়াখ কোদেশ। হোলি অফ হোলিজ বস্তুটি আসলে একটি পর্দাঘেরা জায়গা বা টেবার্নেকল। তার ভেতরে রাখা ছিল আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট। আর আর্কের ভেতর খোদার কাছ থেকে টেন কমান্ডমেন্টসের যে পাথরে খোদাই ট্যাবলেট মোজেস পেয়েছিলেন, সেগুলি রাখা ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলাইটদের দৈব সহায়তা দিত এই আর্ক।

চীফ রাবিনেটের মতে ডোম অফ দ্য রকের ভেতরেই যে কোদেশ হা’কোদাশিম ছিল তার শক্ত কোন প্রমাণ নেই। সেটি পুরো টেম্পল মাউন্টের যে কোন জায়গায় হতে পারে। অষ্টম/সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব থেকে শুরু করে বহু ধর্মের বহু শাসক এই কম্পাউন্ডের পরিবর্ধন, পরিমার্জন আর ধ্বংসসাধন করেছে। তাই এখন ঠিক করে বলার উপায় নেই কোথায় ছিল সে “কোদেশ হা’কোদাশিম।” সুতরাং পুরো কম্পাউন্ডে ইহুদীদের প্রবেশ না করাটাই নিরাপদ। একই কারণে যারা প্রবেশের সাহস করেছে তারা পুরো কম্পাউন্ডে হাঁটছে খালি পায়ে।

ফাউন্ডেশন রকটি নিয়ে আরো কিছু বিশ্বাস রয়েছে ইহুদীদের। এই পাথরটিকে ভিত্তি করেই নাকি ঈশ্বর বিশ্বজগতের সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। এ পাথরের ওপরই নাকি এব্রাহাম তার পুত্র আইজ্যাককে বলিদান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন অবশ্য এই টেম্পলের অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে ছিল মাউন্ট মোরিয়া বলে একটা উঁচু পাহাড়, আর এই সমতল পাথুরে প্ল্যাটো। আরো নানাবিধ তাৎপর্য আছে এ পাথরের।

ডেভিডের নেতৃত্বে কেনানাইটদের ওপর বিজয়ের মাধ্যমে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ পায় আদি ইসরায়েলাইট জনগোষ্ঠী। ডেভিডের পুত্র সলোমন এই মাউন্ট মোরিয়ার চূড়ায় তৈরি করেন প্রথম টেম্পল প্রাঙ্গন। সেখানে ঈশ্বর “ইয়াওয়ের” উদ্দেশ্যে পশু বলি হত, যেটা ছিল এব্রাহামের উত্তরাধিকার। মুসলিমরাও ঈদুল আযহার সময় সে ঐতিহ্য অনুসরণ করে।

যদিও ইহুদী মত অনুযায়ী সলোমনের টেম্পল এক হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি, অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের হিসাবে সেটি আসলে সপ্তম/অষ্টম খ্রীষ্টপূর্ব শতকের আগে নয়। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, সুলায়মান এ “মসজিদ” তৈরি করেন মানুষ, জ্বীন ও পশুপাখির দৈব সাহায্য নিয়ে। এখানেই তার সাথে সাক্ষাত করেন কুইন অফ শেবা “বিলকিস।” ইহুদী ধর্মের বিশ্বাসও একই।

সলোমনের ঐক্যবদ্ধ রাজ্য শীঘ্রই ইসরাইল ও জুদাহ রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৫৮৭/৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে দু’রাজ্যের স্বাধীনতাহরণ করে ব্যাবিলনের রাজা নেবুকাদনেসার। তার সেনাদল টেম্পলটি লুটপাটের পর ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ইহুদীদের বশ্যতা স্বীকার না করার এ ছিল প্রতিশোধ। ইহুদী ধর্মমতে খোদা ছাড়া আর কারো আনুগত্যপালন গর্হিত অপরাধ। জেরুজালেমের এলিটদের ধরে নির্বাসনে পাঠানো হয় ব্যাবিলনে — যার থেকে বনি এম’এর বাই দ্য রিভার্স অফ ব্যাবিলন গান।

সলোমনের টেম্পল ধ্বংসের সত্তর বছর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান আকিমেনিদ পারসিক সম্রাট দারিয়ুস। তিনি ইহুদীদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেন। একই সাথে ফিরিয়ে দেন নেবুকাদনেসারের সময় লুন্ঠনকৃত ধর্মীয় অনুষঙ্গের অধিকাংশ। আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট অবশ্য হারিয়ে যায়। দারিয়ুসের সাহায্যে পারসিক ইয়েহুদ প্রদেশে নতুন একটি টেম্পল পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় অ-ইহুদী জনগণের বিরোধিতার মুখে কয়েক বছর সে কাজ স্থগিত থাকে। সম্পূর্ণ হয় সম্রাট সাইরাস বা কুরুশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। অনেক ইহুদী বিবরণীতে তিনিই নাকি তাদের মেসিয়া, ত্রাতা। যীশুর আগেই তার আবির্ভাব।

অমুসলিম দর্শনার্থীদের ভালমত চোখে চোখে রাখে ওয়াকফ সদস্যরা। অন্তত দু’বার স্থানীয় আরবরা এসে কিছু প্রশ্ন করল। আমাদের দু’জনের হাতে যেহেতু বড় লেন্সের ক্যামেরা, তাদের জিজ্ঞাসা “বেরেস?” আমরা কেউ বুঝি না সে কি। “তিভি?” না, না আমরা টিভি নই, প্রাইভেট ছবি তুলছি, টুরিস্ট। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে কেটে পড়লেও সামান্য দূরে দূরেই থাকল। তখন আমার মাথায় লাইটবাল্ব জ্বলে উঠল! আরবী “বেরেস”, ইকুয়াল টু ইংরেজী “প্রেস!”

এক ঘন্টা ফুরোতে না ফুরোতেই ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে সকলকে বের করে দেবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল ওয়াকফের লোকজন। হয়ত আসরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসছে বলে। দ্রুতপদে হাঁটা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম সবচে কাছের গেটটা দিয়ে। এসে পড়লাম খ্রীষ্টান কোয়ার্টারের ভিয়া দোলোরোসার কাছে। হাতে আছে আরো ঘন্টা দুয়েক। তারপর অ্যালেক্সের “শ্কডা” ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে যাবে তেল আবিব এয়ারপোর্টে। এবারের মত যাত্রা হবে সাঙ্গ!

সেকেন্ড টেম্পল আর বায়তুল মোকাদ্দাসের বাকি কাহিনী শেষ করি। পারসিক সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল ইহুদীদের। এই সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড তাদের ইতিহাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময়েই তাদের অধিকাংশ ধর্মীয় দর্শন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। বলা ভাল, বাইরের বিশ্ব থেকে অন্যান্য বহু সংস্কৃতির ম্যাচিওর প্রডাক্টও তাদের ধর্মে ইন্টেগ্রেট হয়।

বিশেষত, এঞ্জেলস, ডেমনস, ডেভিল, প্রিন্স অফ ডার্কনেস, হেভেন-হেল — এসব বিশ্বাসগুলি মূলে অনেকটাই পারসিক জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ঈশ্বর ও শয়তানের ডাইকোটমি পরিষ্কারভাবে তৈরি হয় এ সময়ে। এখনো কিন্তু ইহুদী ও ইসলাম ধর্মে এ ব্যাপারে দার্শনিক বিতর্ক রয়েছে। শয়তান কি ফ্রী এজেন্ট? নাকি কেবল খোদার গূঢ় উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের আনফ্রী এজেন্ট? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে শয়তান আর জোরোয়াস্ত্রিয়ান আহরিমানের মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই। এ ব্যাপারে ডেড সী স্ক্রলসের প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য কোন সময় বলব।

পারসিকদের পতন হয় ম্যাসেডনের রাজা মহামতি আলেকজান্ডারের হাতে। লেভান্ট অঞ্চল নিয়ে তার উত্তরসূরী টলেমি ও সেলুকাসের মধ্যে রেষারেষিতে জয় পায় সিরিয়ার সেলুসিড রাজ্য (গ্রীকে সেলেফকোস)। তাদের শাসনামলে সেকেন্ড টেম্পলটিকে পরিণত করা হয় পৌত্তলিক মন্দিরে। ইহুদী ধর্ম ও হিব্রু ভাষায় প্রচুর গ্রীক প্রভাব ঢোকে। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন শহুরে হিব্রুভাষীরা গ্রীক আচার গ্রহণে বাধ্য হয়। যারা একটু বেশি ধার্মিক, তারা এসব থেকে দূরে সরে পূর্বে ডেড সী’র কাছে একরকম সন্ন্যাসব্রত নেয়। ম্যাকাবি-ফ্যারিসি-এসেন-“জীলট” ইত্যাদি গ্রুপ এদের মধ্যে পড়ে।

গ্রীক শাসনের অবসান ঘটায় বিদ্রোহী ম্যাকাবি হাসমনিয়ান বংশ। তবে ক্রমে তারা রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়। আর যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আশপাশ দিয়ে রাজা হন হেরড। রোমানদের মিত্র হেরডই সেকেন্ড টেম্পলের বিশাল সংস্কার করেন। প্রচুর কর আরোপের মাধ্যমে তিনি টেম্পলটির আঙ্গিনা আরো বাড়ান। সে যুগে এই টেম্পল ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ তীর্থস্থান। গ্রীকদের প্রভাব কাটিয়ে ইহুদীরা আবার আগের মত উপাসনা করে এখানে। পূণ্যলাভ ও পাপস্খলনের প্রত্যাশায় রোমান বিশ্ব থেকে জাহাজে করে অগণিত ইহুদী আসত। প্রচুর অর্থ খরচ করে রিচুয়াল বাথের পর কোরবানীর পশুসহ প্রবেশ করত টেম্পলে। তারপর পবিত্র পাথরের নিকটে কোরবানি করে তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হত পশুর রক্ত। হিব্রু আর আরবী ভাষায় “কোরবান” হুবহু একই শব্দ।

নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী যীশু খ্রীষ্টেরও পদধূলিধন্য এই টেম্পল। তবে সমসাময়িক ইহুদী রিচুয়ালগুলোকে সারশূন্য বলে সমালোচনা করেছেন তিনি। কিন্তু টেম্পলের পবিত্রতাকে অস্বীকার করেননি। এই সেকেন্ড টেম্পলের একটা প্রমাণ সাইজ মডেল রয়েছে ইসরায়েল মিউজিয়ামে, যার ছবি দিয়েছি।

সত্তর খ্রীষ্টাব্দে ইহুদীদের চলমান রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহকে নির্মূল করে জেরুজালেমের দখল নেয় রোমসম্রাট টাইটাসের সেনাদল। সেকেন্ড টেম্পলের প্রায় সম্পূর্ণ বিলোপসাধন করে তারা। দ্বিতীয় ও শেষবারের মত টেম্পলের ইহুদী ধর্মীয় পবিত্র অনুষঙ্গগুলি হরণ করে বিদেশী সৈন্যরা। তার মধ্যে ছিল টেম্পল মেনোরা — সাত শাখাবিশিষ্ট মোমবাতিদানি। ইহুদী রাজনৈতিক মানসের মূর্তমান প্রতীক ছিল এটি।

এরপর আর কখনো স্বদেশ ফিরে পায়নি ইহুদীরা — ১৯৪৮ পর্যন্ত (আসলে ঊনবিংশ শতক!)। রোমানরা জেরুজালেম থেকে তাদের বহিষ্কার করে। অনেকে মিশর-সিরিয়া-জর্দান-ইরাক-ইয়েমেনে গিয়ে বসতি গাঁড়ে। প্রায় সন্দেহাতীতভাবে এদের কিছু গোত্র আরবে অভিবাসী হয়, যাদের উল্লেখ আমরা হাদীসে পাই মদীনা বা ইয়াথরিব শহরের অধিবাসী হিসাবে।

ইহুদীদের উচ্ছেদের পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত টেম্পল মাউন্টের ওপর জুপিটারের মন্দির তৈরি করে রোমানরা। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতক নাগাদ সে মন্দিরও হয় ধূলিসাৎ, কারণ সম্রাট কনস্ট্যান্টিনের খ্রীষ্টধর্মগ্রহণ ও তার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। পুরো টেম্পল মাউন্ট হয় রোমানদের গার্বেজ ডাম্প। তবে অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদরা বর্তমান মসজিদুল আকসার নিচে একটি খ্রীষ্টান ব্যাসিলিকার আংশিক ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন। হতে পারে ঐ দক্ষিণাংশে খ্রীষ্টানরা টেম্পলের স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের তাৎক্ষণিক পরে ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন আরব সেনাদল জেরুজালেমে এসে অবরোধ বসায়, তখন জেরুজালেম ছিল খ্রীষ্টান শহর, ইহুদী নয়। তবে এর পূর্ববর্তী তিন দশকের মধ্যে দু’বার হাতবদল হয়েছে এ শহর। পারসিক সাসানী শাহেনশাহ বিজ্যান্টাইন “রোমের” বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় পেয়ে সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল নেয়। খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া। এই যুদ্ধের সুযোগে সিরিয়ার ইহুদী ট্রাইবগুলিও রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। জেরুজালেম পুনরুদ্ধার ছিল তাদের জন্য ধর্মীয় কর্তব্য। অবশ্য তাদেরকে খুব একটা কদর সাসানীরা করেনি।

এই সংঘাতের ব্যাপারটা কুরআনের সূরা রূমে আছে। সেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে এবং রোম আবার জয়ী হবে। ক্রমে তাই হয়, এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশাতেই জেরুজালেমসহ সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল ফিরে আসে বিজ্যান্টাইনদের হাতে। তবে সে বিজয় আসলে পরবর্তী আরেকটি বিজয়ের অগ্রদূত। শীঘ্রই জেরুজালেমের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় আরব বেদুইন সেনাদল। তাদের নমিনাল নেতা নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রা)।

বিজ্যান্টাইন সেনাদল ইতিমধ্যে জেরুজালেম থেকে কেটে পড়েছে। শহরের খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস বাদে সেখানে কোন কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি নেই। অবরুদ্ধ শহরের দরজা মুসলিমদের জন্যে খোলার অনুমতি দিলেন তিনি, শর্তসাপেক্ষে। ওমর (রা) কে ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছ থেকে আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে হবে। আরেক শর্ত, জেরুজালেমে নতুন দিগ্বিজয়ীদের সাথে ইহুদীরা প্রবেশ করতে পারবে না। এটি লিপিবদ্ধ আছে সমসাময়িক খ্রীষ্টান পর্যবেক্ষকদের বিবরণীতে।

অর্থাৎ খুব সম্ভবত সিরিয়া ও আরবের ইহুদীদেরও একাংশ মুসলিম আরবদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এটা অসম্ভব কিছু নয়। এমন সম্ভাবনা ইসলামের আদি ইতিহাস পড়লেও আঁচ করা যায়। জেরুজালেম থেকে রোমানদের বিতাড়িত ইহুদীদের প্রত্যাবর্তনের শতভাগ প্রণোদনা তো ছিলই, তাছাড়াও মদীনা সনদের মত দলিল থেকেও জানতে পারি ইসলামের আদি যুগ থেকেই ইহুদী ও পীপল অফ দ্য বুকএর সাথে মুসলিমদের মিত্রতার উদাহরণ। যদিও বর্তমান রীডিং অনুযায়ী সেসব মিত্রতা স্থায়ী হয়নি।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কৌতূহলপ্রদ কথা বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে একটি আদি ইসলামী মুদ্রা আছে। উমাইয়া শাসনামলের ইলিয়া প্রদেশ অর্থাৎ ফিলিস্তিন/জেরুজালেমে এটি মুদ্রিত। এর এক পিঠে আরবী কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর অপর পিঠে পাঁচ শাখার মোমবাতিদানি। সেটা দেখতে হুবহু মেনোরা — ইহুদী জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা নানাজন নানাভাবে দিয়েছেন। অন্যতম ব্যাখ্যা অবশ্যই ইসলামী জেরুজালেমে ইহুদীদের আংশিক পুনর্বাসনের একটা বড় সম্ভাবনা। হযরত ওমর (রা) নাকি আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদীদের “বহিষ্কার” করেছিলেন। সেটা সত্য নাকি তাদের স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল — সেটা সত্য? এর সরাসরি প্রমাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র বহু শতাব্দীর এডিট করা ইসলামী ইতিহাসের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

যা হোক, উমর (রা) জেরুজালেমে প্রবেশের পর টেম্পল মাউন্টে এসে বিজ্যান্টাইন “আস্তাকুঁড়ের” সন্ধান পান। সেই প্রাচীন পাথুরে প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ পাশে একটি মেকশিফট মসজিদ তৈরি করা হয়। যেটা আদি মসজিদুল আকসা। হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের সময়ে অবশ্যই এখানে সেসব স্থাপনা ছিল না। উমর (রা)এর মসজিদটি এখনো বর্তমান আল আকসার লাগোয়া একটি ভবনে ছিল বলা হচ্ছে। তবে নিশ্চয় অনেক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে সেটি। এই অস্থায়ী মসজিদের কথা গথিক বিশপ আর্কউল্ফের বিবরণীতেও রয়েছে। তবে তার ভ্রমণকাল মুয়াবিয়ার সময়।

আরেকটা প্রসঙ্গ টানি। উমরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে দুই সাহাবী সচেষ্ট ছিল। তাদের একজন ইহুদী থেকে ধর্মান্তরিত, আরেকজন খ্রীষ্টান থেকে — ইসলামী ইতিহাস মতে। এ দু ধর্ম অবশ্যই জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণলাভের জন্যে প্রতিযোগী ছিল। সম্ভবত এরা আসলে ধর্মান্তরিত ছিল না। ছিল বিজয়ী সেনাদলে শামিল “আহলাল কিতাব।” আবার ইহুদী ধর্মান্তরিত এক দল নাকি উপদেশ দিয়েছিল মক্কার কিবলামুখী মসজিদুল আকসাটি টেম্পল মাউন্টের দক্ষিণে প্রতিষ্ঠা না করে উত্তরে প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে যেটা হত, তা হল মক্কার কিবলার মাঝে পড়ে যেত ইসলামের প্রথম আঠারো মাসের কিবলা সেই পবিত্র পাথরটিও। ইহুদী প্রভাব বা সমব্যথিতা না থাকলে মদীনায় মক্কামুখী কিবলা হবার পরেও এ সুপারিশ কিভাবে সম্ভব?

উমর (রা) টেম্পল মাউন্টে নতুন স্থাপনা তৈরির নির্দেশ দেন। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠতে শুরু করে নতুন ধর্মের পবিত্র ধর্মালয়। প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়াবিয়া তার খেলাফতের বায়াত নেন মসজিদুল আকসার ভেতর। ততদিনে আরব বিশ্বে গৃহযুদ্ধ চলমান। প্রথমে আলীর সাথে তালহা-জুবায়ের-আয়েশা, খারেজী ও মুয়াবিয়ার সিরীয় সেনাবাহিনীর। তারপর কারবালার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদের বিরুদ্ধে আদি শিয়া, খারেজী ও ইবনে জুবায়েরের। ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত মক্কা ও মদীনার পবিত্র নগরীর দখল উমাইয়াদের হাতে ছিল না।

তবে সুফিয়ানী উমাইয়ারা নির্বংশ হবার পর শক্তভাবে রাজ্যের হাল ধরে মারওয়ানী খলীফারা। তাদের নেতা সুচতুর মারওয়ান ও তার পুত্র আব্দুল মালিক নিষ্ঠুরতার সাথে বিভিন্ন কোন্দলের সমাপ্তি ঘটান। বিজ্যান্টাইনদের উপঢৌকন পাঠিয়ে কিছুদিনের জন্য উত্তরের সীমান্ত নিরাপদ রাখেন। তারপর বিশ্বস্ত সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাহায্যে ইবনে জুবায়রের পাল্টা খেলাফতের ইতি ঘটান। মক্কার কা’বা শরীফ এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ত্রেবুশে নামক আদি আর্টিলারির আঘাতে। মক্কা অবরোধে ইবনে জুবায়েরের মৃত্যুর পর তিন পবিত্র নগরীর শাসক হন আব্দুল মালিক। পুরো ইসলামী বিশ্ব হয় আবার ঐক্যবদ্ধ।

বিজয়ের পর কা’বা শরীফ পুনর্নির্মাণের কাজটি সমাধা করেন আব্দুল মালিক। তবে তার আগেই মুয়াবিয়ার শুরু করা টেম্পল মাউন্ট পুনর্গঠনের জটিল কাজটি প্রায় সম্পূর্ণ করে আনেন তিনি। মক্কা-মদীনার দখল না থাকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈধতা পেতে এ কাজটি করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তার। মসজিদুল আকসার বর্তমান ভিত্তি ও কাঠামো আব্দুল মালিক ও তার পুত্র ওয়ালিদের অবদান।

আর ডোম অফ দ্য রক — কুব্বাত আস সাখরা — এটি ইসলামী স্থাপত্যকলায় একক স্থান অধিকার করলেও প্রাচীন বিশ্বে এমন স্থাপত্যের অন্য উদাহরণ রয়েছে। হয়ত সেসবের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয় আব্দুল মালিকের লেভ্যান্টাইন খ্রীষ্টান স্থপতিরা।

যেমন, জেরুজালেম ও বেথলেহেমের মধ্যে তীর্থযাত্রা চলত। সেই পুরনো রোমান পথের পাশেই ক’বছর আগে আবিষ্কৃত হয় একটি ধ্বংসাবশেষ। এটি চার্চ অফ দ্য ক্যাথিজমা। গর্ভধারী মেরী নাকি বেথলহেম থেকে জেরুজালেমে যাত্রাপথে এখানে একটি পাথরের ওপর খেঁজুর গাছের পাতা ধরে বসে বিশ্রাম নেন। সে পাথরটি আছে এখনো, তার চারপাশে দুই স্তরের চক্রাকার অ্যাম্বুলেটরি, বা হাঁটার রাস্তা। ভেতরের অ্যাম্বুলেটরি পাথর ঘিরে, আর বাইরেরটা অষ্টভূজাকার দেয়াল ধরে। অর্থাৎ হুবহু ডোম অফ দ্য রকের নকশা! কিন্তু এ চার্চটির অস্তিত্বকাল পঞ্চম খ্রীষ্টীয় শতক, অর্থাৎ আরব দিগ্বিজয়ের পূর্বে।

এ ছাড়াও প্রাক-খ্রীষ্টান পাগান কিছু টেম্পল ছিল সিরিয়ার দামেস্ক ও এডেসা শহরে। সেসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোন না কোন পবিত্র পাথর, যেগুলিকে দেবপ্রদত্ত বলে সম্মান করত স্থানীয় আরব ও আরামায়িক অখ্রীষ্টান গোত্রগুলো। অর্থাৎ সেসবেরও একটা অবচেতন স্মৃতি সম্ভবত রয়ে গেছে ডোম অফ দ্য রকের নকশায়। আর যাই হোক, ডোম অফ দ্য রকের পরিকল্পনা সাদামাটা মসজিদের নয়। হয়ত মক্কার কা’বার মতই একটি তীর্থস্থল তৈরির পরিকল্পনা ছিল আব্দুল মালিকের। পরবর্তী যুগের অনেক ইতিহাসবিদ দোষারোপ করে যে কিনি নাকি কা’বার জায়গায় ডোম অফ দ্য রককে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন। আসলে বোধহয় তা নয়। ধর্মপ্রাণ ও আলেম হিসাবে আব্দুল মালিকের খ্যাতি ছিল।

উমাইয়া বংশের পতনের পর আব্বাসী খলীফারা এই স্থাপনাগুলির ব্যাপক সংস্কার করেন। একজন এমনকি আব্দুল মালিকের নাম উঠিয়ে নিজের নাম বসিয়ে দেন নির্মাতা হিসাবে। আব্বাসীদের পরে কায়রোর ফাতিমী শিয়া রাজবংশ তিন পবিত্র স্থানের পৃষ্ঠপোষকতা করে। জেরুজালেমের খ্রীষ্টান বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারের ধ্বংসসাধনের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষিত হয়। এরপর জেরুজালেম দ্বিতীয়বারের মত খ্রীষ্টান শাসনে আসে। ক্রুসেডার রাজারা টেম্পল মাউন্টকে সলোমনের টেম্পল হিসাবে স্বীকার করে। ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঝোলায় যীশু, মেরি ও সেন্টদের আইকন, আর বাইবেলের পদাবলী। আরবী কোন নকশা বা লেখার ক্ষতিসাধন অবশ্য তারা করেনি। তবে ক্রুসেডাররা পবিত্র পাথরটি থেকে স্যুভনির হিসাবে খন্ড ভেঙে নিয়ে যাবার কারণে সে জায়গাটি ঘিরে দেয়া হয়। এই টেম্পলের নামেই তৈরি হয় অর্ডার অফ দ্য নাইটস টেম্পলার।

দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডারদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হন আইয়ুবী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুর্দী সেনাপতি সালাহ উদ্দীন। আইয়ুবীদের পর আসে মামলুক, তারপর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য। বহু শতকে বহু সংস্কার হয়। এখনো নতুন কোন সংস্কারের সময় পাথরের মেঝে ভাংলেই বেরিয় পড়ে আরো বহু শতাব্দীর পুরনো নিদর্শন।

ইহুদীদের পবিত্র টেম্পলই যে এখানে ছিল তার কি প্রমাণ? সলোমনের তৈরি প্রথম টেম্পলের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেটা সবচে আদি স্থাপনা। কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু সন্দেহের অতীত নয়। তবে সেকেন্ড টেম্পলের অগণিত নিদর্শন এখানে পাওয়া গেছে। ঊনবিংশ শতকে পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয় যাতে গ্রীক ভাষায় লিখিত সাবধানবাণী, এ সীমানার ভেতরে অ-ইহুদী কেউ প্রবেশ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এমন দুটি ফলক বা অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির তারিখ বৈজ্ঞানিক পন্থায় নিরূপিত হয়েছে রাজা হেরডের শাসানামলে।

মসজিদ আল আকসার দক্ষিণপশ্চিম পাশে কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে আবিষ্কৃত হয়েছে ইহুদীদের ব্যবহৃত গোসলখানা, আর টেম্পলের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনোর সিঁড়ি। দক্ষিণে রয়েছে পাথর তুলে বন্ধ করে দেয়া প্রাচীন হুলদা গেট। দক্ষিণ-পূর্বে সলোমন’স স্টেবল এলাকায় কয়েক বছর আগে ইসলামী ওয়াকফ মারওয়ানী মসজিদ তৈরি করতে গিয়ে বড়সড় খননকার্য চালায়। তার থেকে খোঁড়া পাথর-মাটির অবশেষ ফেলা হয় সীমানার ঠিক বাইরে। ইসরাইলী প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো সেই আবর্জনা ঘাঁটিয়ে চলেছেন। প্রজেক্টটির নাম টেম্পল মাউন্ট সিফটিং প্রজেক্ট। সেকেন্ড টেম্পল যুগের গিল্ডেড মোজাইক ফ্লোরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ড সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়েছে খ্রীষ্টান আমল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ইসলামী আমলেরও নিদর্শন।

জুয়িশ কোয়ার্টারে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে সেকেন্ড টেম্পলে ঢোকার জন্যে হেরডের তৈরি আর্চের ধ্বংসাবশেষ। আর ষাটের দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত মরক্কো কোয়ার্টার পরিষ্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওয়েস্টার্ন ওয়াল। সেটুকু জায়গাই এখন ইহুদীদের ক্ষুদ্র তীর্থস্থান। মোরিয়া পাহাড়ের এ অংশে পুরো কম্পাউন্ডের সাপোর্টিং ওয়াল চলে গেছে বেশ গভীরে। সন্দেহ নেই এটি হেরডের প্রতিষ্ঠিত সেকেন্ড টেম্পলেরই পাথুরে সীমানা। কাছেই রয়েছে বিতর্কিত সুড়ঙ্গপথ। ওয়েস্টার্ন ওয়ালেরই উত্তরাংশ পৌঁছানো যায় এ টানেলের মধ্য দিয়ে। এসব সুড়ঙ্গ মুসলিম কোয়ার্টারের নিচ দিয়ে গেছে। স্বভাবতই আরব-ইহুদী দাঙ্গার ইতিহাস আছে এই টানেল প্রজেক্ট নিয়ে।

বর্তমান যুগে ইসরাইল বিদ্বেষ যে পরিমাণে ব্যাপ্ত মুসলিম বিশ্বে, তেমনটা সব সময় আসলে ছিল না। আদি উমাইয়া আমলের কিছু উদাহরণ টেনেছি। একই ব্যাপার ইসলামের স্বর্ণযুগেও। ইসলামী স্বর্ণযুগ একাধারে ছিল ইহুদী স্বর্ণযুগ। ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রভৃতি মুসলিম মনীষীদের মত মুসা ইবনে মাইমুন, মুসা ইবনে নাহমান নামের ইহুদী মনীষীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অবশ্য মুসলিমদের সমপরিমাণ সম্মান আরব বিশ্বে তাদের সে সময়েও ছিল না। তারপরও দুটো সম্প্রদায় একে অপরের দর্শন ও ইতিহাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। মানুষের মাঝে বিভক্তি এখন প্রাচীন যুগের থেকেও প্রকট। যেটা দেখলাম, শুধু পশুপাখির মধ্যে সে বাছবিচার নেই। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সর্বত্র শান্তির কবুতর। তারা নির্বাধ বিচরণ করছে মসজিদুল আকসার ফাসাদেও, ডোম অফ দ্য রকের প্রাঙ্গনে। উড়ে চলে যাচ্ছে অনতিদূরে খ্রীষ্টান জগতের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারে। কোথাও বাঁধা নেই। নেই মেটাল ডিটেক্টর চেক, কিংবা সূরা পড়ার বালাই।

ঐশ্বরিক শান্তির পায়রা ডানা ছড়িয়ে মানুষকে কবে তার ছায়াতলে আনবে, শুধু সে প্রশ্নের উত্তর এখনো রয়ে গেছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বায়তুল মাকদিস – ২

জুম্মার নামাজের পর বায়তুল মুকাদ্দাসে নারী-পুরুষের আর কোন ভেদাভেদ নেই। কুব্বাত আস সাখরার “মহিলা” অংশে এসে ঢুকছে তীর্থযাত্রীর দল। মসজিদুল আকসার ভেতরেও মহিলাদের ঢোকার কোন বাঁধা নেই। ছবি উঠাচ্ছে সকলে। চলছে গাইডদের ধারাভাষ্য। ভিড় আছে কিন্তু গায়ে লাগালাগির মত নয়।

কুব্বাত আস সাখরার প্রবেশে এক মুরুব্বী শ্রেণীর মানুষ তদারকি করছে। জুতা খুলে ব্যাগে ভরে নিলাম। ভেতর থেকে বেরুচ্ছে মহিলা মুসল্লীর দল। কেউ কেউ তখনো ভেতরে প্রার্থনারত। তার মধ্যেই চলছে জনতার সমাগম।

বাইরে থেকে এই ডোম অফ দ্য রক দেখতে যতটা অসাধারণ, ভেতর থেকে আরো বেশি। এই কম্পাউন্ডের সবচে আদি স্থাপনা এই গম্বুজসহ আটকোনা দালান — যেটা ছিল প্রথম কিবলা, তার পার্শ্ববর্তী কুব্বাত আস সিলসিলা (ডোম অফ দ্য চেইন) আর দক্ষিণপশ্চিমের মসজিদুল আকসা।

এগুলি ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয় উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাকি সব তৈরি হয়েছে পরবর্তী মুসলিম ফাতিমী-মামলুক-আইয়ুবী-অটোমান প্রভৃতি বংশের শাসনামলে। একেকটি সময়ে যুক্ত হয়েছে নতুন-পুরনো বিশ্বাসের নানা লেজেন্ড, সাথে স্থাপনা।

ভবনগুলির ভিত্তি ও কাঠামো আদি উমাইয়া আমলের হলেও আদি অলংকরণ বিশেষ একটা অবশিষ্ট নেই। যেমন, সোনালী যে গম্বুজ দিয়ে সকলে এটিকে চেনে সেটির বয়স বেশি নয়, ষাটের দশকে জর্দানী কর্তৃপক্ষ সে সংস্কারটা করে। আগে সীসার আচ্ছাদন ছিল। বাইরের আটটি দেয়াল ও চারটি প্রবেশদ্বারে নানা রঙের আরাবেস্ক নকশা আর কুরআনের আয়াত লেখা।

ডোম অফ দ্য রকের একেকটি স্তম্ভ মার্বেলে তৈরি। দেয়ালের প্রায় সর্বত্র মার্বেলের ব্যবহার। মোজাইক টাইল দিয়ে তৈরি নকশা বসানো। স্তম্ভগুলি গ্রীক আয়োনিয়ান বা ডোরিক ধাঁচের। মোজাইক ও গ্রীক কলাম উভয়েই মূলে পশ্চিমা শিল্প। এর কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ের সময় এ এলাকার অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বণিক, স্থপতি ও শিল্পীরা সকলেই ছিল বিজ্যান্টাইন ঐতিহ্যের অনুসারী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। যাযাবর আরব মুসলিমদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আব্বাসী খিলাফতের আগ পর্যন্ত ধর্মান্তরকরণের খুব একটা ইনসেন্টিভ ছিল না।

ডোমের ভেতরেও ইসলামী শৈল্পিক কারুকার্য ভর্তি সর্বত্র। এখানেও বিজ্যান্টাইন প্রভাব চোখে পড়ার মত। বিশেষত, রঙীন কাঁচে তৈরি জানালা, যেগুলি এখনো প্রাচ্য-প্রতীচ্যের গথিক ঘরানার চার্চগুলিতে দেখা যায়, শুধু সেসবে যীশু-মেরীর অবয়বঅংকিত। ডোমের ভেতরে দুটো চক্র, একটা বাইরের অষ্টভূজ দেয়াল ধরে, আরেকটা চার কলামের মাঝে স্থাপিত সাখরা পাথর ঘিরে। গম্বুজটি ঠিক সাখরার ওপর। কোন দেয়াল ফাঁকা নেই, সব জায়গায় নীল-সোনালী, লাল-সবুজ-সোনালী অলংকরণ। কোথাও ভাসের চিত্র, কোথাও লতানো গাছ, কোথাও অ্যাবস্ট্রাক্ট আরাবেস্ক। তার মাঝে কনট্রাস্ট উজ্জ্বল রঙের স্টেইনড গ্লাসের জানালা।

কোন কোন কলামের নিচে কুরআনভর্তী বুকশেল্ফ। ধার করে পড়ার জন্য এমন প্রার্থনাপুস্তক দেখেছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনেও, আর তার লাগোয়া সিনাগগে। গম্বুজের ঠিক নিচে ভেতরের সার্কলে আধুনিক আরবী ক্যালিগ্রাফিতে আয়াতুল কুরসি লেখা। আর বাইরের অষ্টভূজের ভেতর অংকিত সার্কলে প্রাচীন কুফী হরফে প্রতিষ্ঠাতা-প্রতিষ্ঠাসাল এগুলি লেখা। এই লেখাটি একেবারে আদি সময়ের। কুফী হরফে যের-যবর-পেশ যেমন নেই, নেই নুক্তাও। কালিমার পাশাপাশি কুরআনের কয়েকটি আয়াত একটু আনকনভেনশনাল উপায়ে জোড়াতালি লাগিয়ে একটি মেসেজ দেয়া হয়েছে। বর্তমান যুগে এমন জোড়াতালি লাগানোটা সম্ভবত মূলধারা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মালিকের নামটিকে বিকৃত করে অবশ্য আব্বাসী খলিফা আল মামুন নিজের নাম বসিয়েছিলেন। কিন্তু তারিখটা পরিবর্তন করেননি। আব্দুল মালিক কুরআনের যে সকল আয়াত বেঁছে এখানে বসিয়েছেন, তার মূল কথা কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট বা হযরত ঈসা (আ) কে নিয়ে। সে অনুযায়ী যীশু কেবল মর্ত্যলোকের মানুষই ছিলেন, একক খোদার বাণী নিয়ে এসেছিলেন। খোদা এক, তার অন্য কোন রূপ নেই প্রভৃতি। নির্দ্বিধায় বলা যায় এ মেসেজটা তখনকার খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস খন্ডনের জন্যে। আর একই সাথে ইসলামে ঈসা (আ) এর পাকাপোক্ত সম্মানের আসনটি দেখানোর জন্যে। সে আমলে কিন্তু মুসলিমদের মত আরো একটি খ্রীষ্টান গ্রুপ ছিল যাদের যীশু সম্পর্কে ধর্মীয় দর্শন প্রায় এক ছিল। এদের নাম মনোফিজাইট, যীশুর একটিমাত্র রূপেই যারা বিশ্বাস করে।

পাথরটির পাশে একটি টংয়ের মত জায়গা, তাতে হাত ঢোকানোর একটা ফোঁকর। সেখানে হাত ঢুকিয়ে পাথরটি স্পর্শ করা যায়। হয়তবা বহু শতকের কোটি কোটি হস্তস্পর্শ পড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল আকারের ছাঁপ। যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, লেজেন্ড অনুযায়ী এ ছাঁপটি নাকি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পায়ের ছাঁপ, স্বর্গারোহণের সময় এখানে পদচিহ্ন ফেলে যান। আবার অনেকে বলছে ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) এর হাতের ছাঁপ, পাথরটি মুহাম্মদ (সা) কে অনুসরণ করে উপরে উঠে যাচ্ছিল বলে নাকি সেটা ধরে থামিয়ে দেন। এসব অবশ্য মূলধারার বিশ্বাসে নেই।

পাথরটি উপরে উঠে যাবার কারণেই নাকি তার ঠিক নিচে একটি ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। সে গুহাটি এখনো বিদ্যমান। এর নাম “ওয়েল অফ সোলস।” পৃথিবীর অন্তিমকালে নাকি এখানে এসে জড়ো হবে সকল মৃতদের আত্মা। একটা সিঁড়ি বেয়ে সেই গুহার ভেতরে গেলাম। পুরুষ-মহিলাদের জন্যে আলাদা করে নামাজ পড়ার জায়গা সেখানে। স্বল্প জায়গার মধ্যে নামাজ কিংবা কোরআন পড়ছে অনেকে। স্বভাবতই আধভূঁতুড়ে আধ্যাত্মিক একটা আবহাওয়া।

ডোম অফ দ্য রক থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে কয়েকশ গজ হেঁটে পৌঁছলাম মসজিদুল আকসায়। মসজিদটির গম্বুজ রূপালী রঙের। এর ভিত্তি আর কাঠামো আদি যুগের হলেও এর কলাম, বাইরের ফাসাদ, ভেতরের কারুকার্য আরেকটু আধুনিক। বিশেষ করে ফাসাদের স্থাপত্য মধ্যযুগীয় ফাতিমী শৈলীর সাথে মেলে, অনেকটা ইউরোপীয় গথিকের মত। মসজিদের ভেতরটাও অসম্ভব সুন্দরভাবে অলংকৃত, অটোমান প্রভাব দৃশ্যমান। এখানে বলে রাখা ভাল, জেরুজালেমে খ্রীষ্টান ধর্মালয়গুলিতেও এমন অলংকরণের ঐশ্বর্য আছে। কিন্তু সে তুলনায় সিনাগগ আর ইহুদী তীর্থস্থানগুলি বেশ সাদামাটা।

এই দুই বড় ভবনের পর সবচেয়ে বড় স্থাপনাটি হচ্ছে কুব্বাত আস সিলসিলা। ডোম অফ চেইনস। এটিও আব্দুল মালিকের তৈরি। ডোম অফ দ্য রকের ছোট প্রোটোটাইপ ভার্শন বলা চলে একে। এর তাৎপর্য ঠিকমত জানা নেই। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনী অনুযায়ী নাকি এখানে একটি চেইন ঝোলানো ছিল, যেটা দৈব প্রক্রিয়ায় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর তফাত করতে পারত। কিং ডেভিড বা দাউদ (আ) সেটিকে ব্যবহার করে ন্যায্য রায় দিতেন। পরে ঘটনাচক্রে সেটি স্বর্গে ফিরে যায়।

আব্দুল মালিক এই চেইনের ব্যাপারটাকে হয়ত একটু ব্যবহার করতে চেয়েছেন নিজ শাসনকে বৈধতা দিতে। ইসলামের সে সংঘাতময় সময়ে তার বিপরীতে খলীফা ছিলেন আরো দু তিনজন, মক্কা-মদীনার দখল তার হাতে ছিল না। জেরুজালেমের দাউদ-সুলায়মানের লেগ্যাসি দাবি করে তিনি স্বরাজ্যের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করেন। এক ছেলের নামও রাখেন সুলায়মান। হয়ত বাব আস সিলসিলা আর কুব্বাত আস সিলসিলার চেইনের ব্যাপারটা ডেভিড-সলোমনের বংশপরম্পরার ধারাবাহিকতা দাবি করার গূঢ় উদ্দেশ্য।

এছাড়া রয়েছে ডোম অফ দ্য অ্যাসেনশন, কুব্বাত আল মি’রাজ। মক্কা থেকে জেরুজালেমে ইসরার যাত্রাশেষে বুরাককে নাকি এখানে বেঁধে রাখেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। কিন্তু এই স্থাপনাটি সম্ভবত আব্দুল মালিকের তৈরি নয়। আরো আছে ডোম অফ দ্য প্রফেট, কুব্বাত আন নাবী। স্বর্গে আরোহণের আগে নাকি এখানে পূর্বের সকল নবী আর ফেরেশতাদের জামাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা)। আরো আছে কুব্বাত আস সুলায়মান, কুব্বাত আল মুসা, কুব্বাত আল খাদর, কুব্বাত আল ইউসুফ প্রভৃতি নানা ছোট খাঁট গম্বুজ। একেকটির একেক ধর্মীয় তাৎপর্য। সবগুলি যে অথেনটিক তা কিন্তু নয়। একেক যুগের ইসলামী শাসক নিজেদের লেগ্যাসি লেজিটিমেসি দাঁড়া করাবার জন্যে এগুলি তৈরি করেছেন।

কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের বাইরেও বেশ কিছু বড় ভবন, মিনার ও গেট আছে। এগুলিরও রয়েছে বলা না-বলা ইতিহাস। তখতে সুলায়মান বলে একটি ভবনে নাকি সুলায়মানের সিংহাসন সংরক্ষিত। সেটি বন্ধ থাকায় দেখা হল না। মসজিদুল আকসার লাগোয়া ইসলামী জাদুঘরটিও বন্ধ। তবে সেসবের কাছে বিশাল প্রাঙ্গণে কিছুদূর পর পর বিশাল সব প্রাচীন স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ রাখা। বিভিন্ন যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের অভাব নেই। নতুন কনস্ট্রাকশনের সময় এখানে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে সেকেন্ড টেম্পল থেকে শুরু করে অটোমান তুর্কী শাসনামল পর্যন্ত ব্যাপ্ত প্রত্ননিদর্শন। বিশেষ করে স্টেবল অফ সলোমন বলে উত্তর পূর্বের একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের ব্লক দিয়ে ভর্তি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্যে এ জায়গাটা রীতিমত সোনার খনি।

আজ শেষ করি একটা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়ে। কুরআনে একটা সূরা আছে, আত ত্বীন। ওয়াত্বীনি ওয়াজ জাইতুন, ওয়া তূরে সীনিন। সূরার শুরু কসম কেটে, মানে সাক্ষী রেখে। সাক্ষী ডুমুর ফল, জলপাই ফল, সিনাই পর্বত, ও এই পবিত্র শহর (তফসিরকারীরা বলছেন মক্কা)। কিসের সাক্ষী? তারা সাক্ষী যে মানুষকে তৈরি করা হয়েছে সর্বোত্তম রূপে, কিন্তু তাতে দোজখের আগুন থেকে তাদের রেহাই নেই, শুধু তারা বাদে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আর উত্তম কাজ করে। তাদের জন্যে রয়েছে সর্বোচ্চ পুরস্কার। শেষ বিচারের দিন অস্বীকারের স্পর্ধা কে রাখে? আল্লাহ কি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?

মক্কা-মদীনা শহরের আশপাশে কিন্তু একটাও ডুমুর কিংবা জলপাই গাছ খুঁজে পাবেন না। সেটা পাবেন এ জেরুজালেম শহরে (আর জর্দান-সিরিয়ায়)। এই হারাম আল শরীফের জায়গায় জায়গায় জলপাই গাছ। জলপাই মধ্যোপসাগরীয় অঞ্চলের স্টেপল। গ্রীক প্যাগান ধর্মেও অলিভ পবিত্র ফল। গ্রীক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের খাওয়া মানেই জলপাই, মক্কার খেঁজুর নয়। জেরুজালেমের নানা জায়গায় দেখা মেলে এ গাছের। ডোম অফ দ্য রকের বিপরীতে ইহুদী সমাধিক্ষেত্র মাউন্ট অফ অলিভসও ভর্তি সে গাছে।

আমার মনে তাই প্রশ্ন, হাজাল বালাদিল আমিন, “এ পবিত্র শহর” বলতে কি আসলে মক্কা বোঝানো হয়েছে? সেটি আসলে জেরুজালেম হবার সম্ভাবনা বেশি নয় কি?

বায়তুল মাকদিস – ১

জেরুজালেমে বৃহস্পতিবার রাতে এসে পৌঁছালাম। আগের থেকেই ইচ্ছে ছিল জুম্মার নামাজটা পড়ব বায়তুল মুকাদ্দিস প্রাঙ্গণে। চীনা সহকর্মীদেরও আগ থেকে বলে রেখেছি শুক্রবার দুপুরে তাদের সাথে হয়ত থাকতে পারব না। মনে অবশ্য খুঁতখুঁতানি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে। এখানে বড়সড় গোলমাল বেঁধেছিল এপ্রিল মাসে।

লিওনার্দো বুটিক নামের যে হোটেলে আমরা থাকছি, সেটি ফাত্তাল গ্রুপের পরিচালিত। এই চেইনের মালিক ইরাকী বংশোদ্ভূত। রিসেপশনে কাজ করছে এক যুগল। দাঁড়িওয়ালা যুবকটির নেমট্যাগে লেখা “হাসান আয়ন” — আয়ন সম্ভবত আসলে আইয়ুন। আর মেয়েটির নাম “কমার”, আরবী অর্থ চাঁদ। দুজনে অবশ্যই আরব। কিন্তু এদের অধিকাংশ গেস্ট মাথায় কিপ্পাপরা ধার্মিক ইহুদী, এসেছে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের “মোনাজাতে” অংশ নিতে।

রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে রিসেপশনে পেলাম কেবল কমারকে। তার থেকে উপদেশ নিলাম কিভাবে আল-আকসায় নামাজ পড়তে পারি, জানালাম চীনা সঙ্গীদেরও শখ তারা যেতে চায়। চীনাদের ব্যাপারে কমার তেমন আগ্রহ দেখানো না। বলল, যদি মুসলিম হও তাহলে তো তোমার যাওয়া অত্যাবশ্যক। অমুসলিমদের ঢোকার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করো না। জুম্মার জামাতে লাখ খানেক মানুষ হয়। সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ সময়।

পরদিন সকালে ইসরাইল মিউজিয়াম হয়ে দুপুরে ডোম অফ দ্য রকে যেতে যে দুই উবার/ট্যাক্সি চালক পেলাম, তারা উভয়েই ফিলিস্তিনী আরব। প্রথমজন বলল, চীনারা আজ ঢুকতে পারবে না, কালও নয়। অমুসলিমদের গেট আলাদা, সেটার নিয়ন্ত্রণে ইসরাইলী পুলিশ। শুক্র-শনি তারা ছুটিতে। যদি তোমাদের কাজ দু’ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, আমিই তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। আমিও যাচ্ছি জুম্মার জামাতে। যেহেতু ‌অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি ডাকছি, তাই ফিরতি পথে আর একে পেলাম না।

ইসরাইল মিউজিয়ামের বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ দেখতে হল বেশ তাড়াহুড়ো করে। এসব ব্যাপারে সঙ্গীরা আমার কৌতূহল শতভাগ শেয়ার করে না। ফিরতি ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিল ওল্ড জেরুজালেম শহরের জাফা গেটের কাছে। চীনারা গেল দুপুরের খাওয়া সারতে। আমি জোর কদমে সোজা হাঁটা দিলাম বায়তুল মোকাদ্দিসের দিকে। প্রাচীন অলিগলি বেয়ে হাঁটাপথে সঙ্গী আরো অসংখ্য আরব নারী-শিশু-পুরুষ। সকলের গন্তব্য এক।

বায়তুল মুকাদ্দিসের বাব-আল সিলসিলা বা চেইন গেটের কাছে ইসরাইলী পুলিশের একটা ছোটখাট দল, গেট থেকে সামান্য দূরত্বে। এরা কিছু চেক করছে না। গেটে বসে আছে ফিলিস্তিনী/জর্দানী ইসলামী ওয়াকফের পান্ডারা। এরা যাকে ইচ্ছে হয় থামাচ্ছে। আমাকেও থামালো, কারণটা অবশ্যই আমার অনারব চেহারা। প্রশ্ন, আর ইউ মুসলিম। হ্যাঁ উত্তরের বিপরীতে নির্দেশ কুরআন থেকে কিছু মুখস্থ শোনাতে। ছোটবেলা থেকে যেটার চর্চা রয়েছে সেটা তো আমার জন্য জলবৎ তরলং! বুকে হাত রেখে চোস্ত উচ্চারণে ফাতিহার অর্ধেক শুনাতে না শুনাতে হাসতে হাসতে যাও যাও বলে পার করে দিল রক্ষী। এই ইসলামী ওয়াকফ জর্দানী সরকারকর্তৃক নিযুক্ত, পুরো কম্পাউন্ডের প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপালন করে এরা। ইসরাইলী পুলিশ গেটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে, সার্বিক নিরাপত্তার দেখভাল করে।

বাব আল সিলসিলা

দক্ষিণের দোর থেকে ডোম অফ দ্য রক প্রথমবারের মত কাছে থেকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। এই পবিত্রভূমি নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত যুদ্ধ, রক্তপাত। ভেতরে ঢুকে ওজুর স্থানের দিকে যেতে আবার গেট থেকে আরেক পান্ডা এল দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নিতে। পরীক্ষায় পাশ করার কিছু পরে এক দশ-বারো বছরের ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, হয়ের ইউ ফ্রম! উত্তরে বললাম, আমেরিকা। এমন অনিশ্চয়তার জায়গায় আমেরিকার নাগরিকত্ব আর পাসপোর্টই হয়ত সবচে বেশি নিরাপত্তা দেবে। তবে হয়তবা এ ক্ষেত্রে ভুল করেছি। পরবর্তীতে জেরুজালেমের পুরনো শহরে যেসব আরব দোকানে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়েছি, তারা বেশি সমাদর করেছে। তারা বাংলাদেশী পর্যটক কালেভদ্রে পায়ও বটে।

ছেলেটি প্রায় আধা ঘন্টা আমার আশপাশে ঘুরঘুর করল। বেশিরভাগ মানুষ যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছায়ার মধ্যে বসেছে সেখানে আমি অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে মাস্তাবার ওপর বসেছি। কড়া রোদে। তাতেও ছেলেটি পাশ ছাড়ছে না। হয়ত মুরুব্বীদের থেকে নির্দেশ আছে বিদেশীকে চোখে চোখে রাখার জন্য, নয়ত ভালমন্দের খোঁজ নেবার জন্য। একবার বোতলের পানিও সাধল।

মসজিদে প্রবেশের দুখলুল মসজিদ নামাজ আদায় করে অবশ্য আমি এই ফেঁউকে ছাড়িয়ে কেটে পড়লাম। খুতবা চলছে একাধিক মাইকে। তার মাঝেই মানুষজন বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। ভিড়ে মিশে হেঁটে চলে গেলাম মসজিদুল আকসার সামনাসামনি। ‌

অনেকে হয়ত জানেন যে বায়তুল মুকাদ্দিস কম্পাউন্ডটি বিশাল এবং এখানে একাধিক ছোটখাট স্থাপনা। পুরো ওল্ড জেরুজালেম শহরের এক তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে এ কম্পাউন্ড। এর ভেতর কেবল দুটি চালু মসজিদ। একটি পশ্চিম ধারে অবস্থিত মসজিদুল আকসা, যেখানে মি’রাজের পর হযরত মুহাম্মদ (সা) অন্যান্য সকল নবীর সাথে নামাজে ইমামতি করেছিলেন বলে মুসলিমদের বিশ্বাস। আরেকটি তার থেকে কিছু দূরে মারওয়ানি মসজিদ। আল-আকসা শব্দের আক্ষরিক অর্থ দূরবর্তী স্থান। সে স্থানটি যে জেরুজালেমই, তার সরাসরি প্রমাণ কিন্তু কুরআনে নেই। তফসীরকারকরা অন্যান্য তথ্যের যোগসাজশে সেটা বলেছেন।

কম্পাউন্ডের কেন্দ্রে যে ডোম অফ দ্য রক নামে সোনালী গম্বুজের স্থাপনা, সেটি কিন্তু আদতে মসজিদ নয়। আরবীতে কুব্বাত আস-সাখরা নামের অসম্ভব সুন্দর অলংকৃত আটকোনা এই দালানটির মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল পাথর (সাখরা, ফাউন্ডেশন স্টোন), যেটির ওপর থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের যাত্রা শুরু। এ ভবনের স্থাপত্যশৈলী মসজিদের নয়, এ ব্যাপারে পরে বলছি।

জুম্মার সময় যেহেতু মানুষ বেশি হয়, মসজিদুল আকসার ভেতর সকলের ঠাঁই মেলে না। কম্পাউন্ডের ভেতরে নানা জায়গায় পাথরের উঁচু মঞ্চ বা মাস্তাবা করে দেয়া আছে, সেগুলি ব্যবহৃত হয়। মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ ডোম অফ দ্য রকের পুরো উঁচু প্ল্যাটফর্মটা।

মসজিদ উল আকসা ফাসাদ
কুব্বাত আস সাখরা থেকে দেখা মসজিদ উল আকসা
কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক

জামাত ভাঙার পর আরো বহু মানুষের সাথে আমিও ঘুরে ঘুরে দেখলাম কুব্বাত-আস সাখরা আর মসজিদুল আকসার ভেতরটা। বাইরের আর ভেতরের প্ল্যাটফর্মের কোন অংশই বাদ রাখলাম না। নামাজের পর মসজিদের ভেতরে অনেক মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। হয় বাইরের গরম থেকে বাঁচতে, নয়ত পবিত্র মসজিদের ভেতর যদি কোন স্বপ্নদর্শন হয় সে প্রত্যাশায়। বাইরের কম্পাউন্ডে তখন কিশোর-যুবাবয়সীরা ফুটবল খেলে। আরব সংস্কৃতিতে মসজিদ আসলে কম্যুনিটি সেন্টার। সকল প্রকার সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকান্ড সেখানে চলে। আর কম্পাউন্ডের ভেতরে একটা জায়গায় কেবল সশস্ত্র ইসরাইলী পুলিশ রয়েছে, চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ইথিওপিয়ান যেমন রয়েছে, তেমন আছে প্রাচ্যের আরব চেহারা। সম্ভবত ইয়েমেন বা ইরাকের মিজরাহী ঐতিহ্যের ইসরাইলী এরা।

কম্পাউন্ড ঘুরে দেখার সময়েই খেয়াল করলাম মসজিদুল আকসা ও কুব্বাত আস-সাখরার ভেতরে-বাইরে গাইডসহ অসংখ্য বিদেশী পর্যটক গ্রুপ। এরা সকলেই মুসলিম দেশ থেকে এসেছে। তুর্কী, জার্মান, ঊর্দু-হিন্দী, সোমালি প্রভৃতি নানা ভাষার সমাহার। কোন দল বেশি হুজুর টাইপ, ছেলেরা পরেছে জোব্বা, মেয়েদের চেহারাসহ আপাদমস্তক আবৃত। আর ইউরোপীয় যারা তাদের বেশভূষা তুলনামূলক পশ্চিমা, মেয়েরাও অত কঠোরভাবে আবৃত নয়। তাজিকিস্তানের একটি গ্রুপ সিঁড়িতে বসে পতাকা হাতে ছবি তুলছে। এদের সকলে ইসরাইল ইমিগ্রেশন ও সিকুরিটি ‌অতিক্রম করেই কিন্তু এখানে এসেছে। বাংলা ভাষারই অভাব চোখে পড়ার মত। দুনিয়ার যেখানে গেছি, কোন না কোনভাবে বাঙালী কারো সাথে দেখা হয়ে গেছে। জেরুজালেমে পেলাম শূন্য।

কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক
কুব্বাত আল ইউসুফ
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলছে আরব ছেলেরা
এক কিনারায় সামান্য কিছু ইসরাইলী পুলিশ পাহারায় নিয়োজিত
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে প্রচুর পায়রা
মসজিদ উল আকসার সামনে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
জর্ডান সরকারের ইসলামী ওয়াকফের দাপ্তরিক প্রতীক
তাজিকিস্তান থেকে আগত মুসলিম ট্যুরিস্ট
মারওয়ানি মসজিদের সামনে সিঁড়িতে চেয়ার নিয়ে স্লাইড করে নামার খেলা করছে দুই আরব মেয়ে
বেরুবার গেটে ইসরাইলী পুলিশের কড়া প্রহরা
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!