বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ২

বিটকয়েনের অসাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হল এই মুদ্রা একই নামের একটা ‘পিয়ার-টু-পিয়ার’ পেমেন্ট নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত, এমনকি এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আরো নতুন মুদ্রা তৈরি হয়, স্রেফ হাওয়ার থেকে! ডলার-ইউরোও অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকরা এরকম ‘ম্যাজিক’ করেই তৈরি করে।

বিটকয়েন নেটওয়ার্কের কাজ হল ‘দবিরের কাছে সগিরকে দেয়ার মত দশটাকা আছে কিনা, আর সে যে আবার জমিরকে একইসাথে সেই একই দশটাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠগবাজি করছে না’ তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ এটাকে গণিতের একটা সমস্যা হিসাবে সংগঠিত করে তার সমাধান বের করা। গণিতের এই ধাঁধা তৈরির পেছনে আছে ক্রিপটোগ্রাফি বলে একটা বিষয়, যার কারবার হলো প্রাইভেট কী আর পাবলিক কী বলে দু’টো সংখ্যা নিয়ে চালাচালি করা, বা এনক্রিপশন-ডিক্রিপশন। এই এনক্রিপশন টেকনোলজি প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো।

ধরুন, আপনি — দবির — সগিরের কাছে বিটকয়েন পাঠাবেন। সেজন্য আপনাকে উল্লেখ করতে হবে সগিরের পাবলিক কী, অর্থাৎ তার সাংখ্যিক পরিচয়, প্রাপ্য টাকার পরিমাণ, আর সগির যখন হবে প্রেরক তখন কি শর্ত অনুযায়ী প্রমাণিত হবে যে সে একই অংকের টাকা অন্য কাউকে পাঠানোর অধিকার রাখে।

সগির যখন জমিরকে টাকা পাঠানোর জন্য নতুন একটি লেনদেনের সূচনা করবে, তখন বিটকয়েন নেটওয়ার্ক তন্নতন্ন করে সগিরের আগের সব লেনদেনের হিসাব খুঁজে দেখে তার পাবলিক কী দিয়ে পরিচয় মেলাবে। তারপর যদি সে ঐ পরিমাণ অর্থ খরচের অধিকার রাখে বলে নির্ধারিত হয়, তখন সগিরকে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করতে হবে যে তার কাছে সেই পাবলিক কী-এর যমজ প্রাইভেট কী আছে কিনা, যেটা কেবলমাত্র সেই জানে। এ প্রমাণ দেখানোর জন্য সগিরের প্রাইভেট কী নেটওয়ার্কে প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নেই, তার দেখানো ‘পরোক্ষ প্রমাণ’ই যথেষ্ট, আর সে প্রমাণ থেকে উল্টো হিসাব করে তার গোপন প্রাইভেট কী বের করা অসম্ভব।

হাতে-কলমে এ জটিল হিসাব কষা যেনতেন কাজ নয়। সে জন্য আছে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের লাখো লাখো কম্প্যুটার। দুনিয়ার সব জায়গায় এসব কম্প্যুটার ছড়িয়ে আছে, আপনিও চাইলে আপনার কম্প্যুটারে বিটকয়েনের সফটওয়্যার চালিয়ে এতে অংশ নিতে পারেন। একেই বলে পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের কম্প্যুটারগুলি সবসময় একসাথে কয়েকটা বৈধ লেনদেনের সমন্বয়ে তৈরি কোন না কোন ‘ব্লকের’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে। তাদের কাজ হলো এমন একটা সংখ্যা খুঁজে বের করা, যেটা ব্লকে যোগ করলে ব্লক একটা বিশেষ গাণিতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। যে এই সমাধান সবার আগে বের করবে, সে বাকিদের সেটা জানান দিবে, আর তারা সেটা যাচাই করে দেখবে। যাচাইয়ে পাশ হলে এই ব্লকটি আগের ব্লকের শেষে গিয়ে যুক্ত হবে আর নেটওয়ার্কের সবাই তাদের লেনদেনের পুরো হিসাব হালনাগাদ করে নিবে। এই পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ব্লক দিয়ে তৈরি ডিজিটাল হিসাবখাতাকে বলে ব্লকচেইন।

যে কম্প্যুটারটা সফলভাবে একটা ব্লক ‘ক্লোজ’ করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের পারিশ্রমিকস্বরূপ নতুন তৈরি বিটকয়েন, যেটা ‘বায়বীয়’(!) উপায়ে হিসাবখাতার মধ্যে যোগ করে ফেলা হয়। এটি হচ্ছে এই ‘মাইনার’ কম্প্যুটারের কাজের প্রমাণ। বিটকয়েনের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই, সেটা ব্লকচেইনে উল্লেখিত একটা সংখ্যামাত্র। গাণিতিক যে সমস্যাটি মাইনারদের সমাধান করতে হয়, তার জটিলতাও বিটকয়েনের কোডে এমনভাবে পরিবর্তিত হয়, যেন গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক ক্লোজ় করা যায়। ব্লক ক্লোজ় করল যে, তার পুরস্কার চার বছর পর পর অর্ধেক হয়ে যায়, এখন সেটা প্রতি ব্লকে সাড়ে বারো বিটকয়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকশ’ কম্প্যুটার মিলে একসাথে একটা ব্লক ক্লোজ় করার চেষ্টা করে, আর তাতে সফল হলে পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেয়। এ ধরনের সমন্বয়কারী মাইনারদের গোষ্ঠীকে বলে ‘মাইনিং পুল’। যেভাবেই মাইন করা হোক না কেন, সর্বমোট ২.১ কোটি বিটকয়েনের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়, আর প্রায় ১.৭ কোটি ইতিমধ্যেই মাইন করা হয়ে গেছে।

কতটুকু বোঝাতে পারলাম জানি না। হয়ত আপনার কাছে মনে হচ্ছে এ এক মনোপোলি বোর্ড গেম! অনেকটা তাই-ই! কিন্তু অনেকগুলো সুবিধা পাচ্ছেন এই খেলায়।

যেমন, টাকায় তো মানুষের আস্থা আছে বলেই তারা তা ব্যবহার করে। বিটকয়েনের উদ্ভাবকরাও ঐ আস্থার ব্যাপারটা এখানে তৈরি করে দিয়েছেন পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের মধ্যে। কেউ যদি দু’নম্বরী করে নেটওয়ার্কে দাবি করে যে সে কয়েকটা বিটকয়েনের মালিক, তাহলে নেটওয়ার্ক সেটা গাণিতিকভাবে যাচাই করতে গিয়ে ধরে ফেলবে, আর সেই দাবিটা ব্লকচেইনে যুক্ত করা হবে না।দুনিয়ার অধিকাংশ বিকেন্দ্রীভূত মাইনারের উপরে চোরবাবাজীর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সে এটা করতে পুরোপুরি অপারগ। হ্যাকারদেরও সাধ্যে নেই লাখ লাখ কম্প্যুটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাতারাতি হিসাব পরিবর্তন করে ফেলা।

তারপরে ধরুন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে কাউকে টাকা পাঠাতে গেলে কোন ব্যাংকের বালাই নেই, নেই দু’দিন ধরে অপেক্ষার প্রয়োজন, নেই বড় অংকের ফী। আর আপনার বা প্রাপকেরও পরিচয় দাখিল করার জন্য সোশ্যাল সিক্যুরিটি নম্বর বা পরিচয়পত্রের কোন দরকার নেই। প্রাপকের পাবলিক কী জানলেই হবে, তার নাম-পরিচয়-অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে কোনই কাজ নেই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এসব সুবিধার পরেও ব্যাপারটা খেলাই থাকতো, যতক্ষণ না বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় এতে অংশ নিচ্ছে আর পদ্ধতিটাকে আস্থাস্থাপনের যোগ্য করে তুলছে।

তো, খেলার থেকে ব্যাপারটা সিরিয়াস রূপ নেওয়া শুরু করলো সিল্করোড নামে এক ওয়েবসাইটের কারণে।

সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




বিটকয়েন ও ডিজিটাল কারেন্সি – ১

বিটকয়েনের ভবিষ্যত সম্পর্কে শুরু থেকেই আমি সন্দিহান। অনেককিছু দেখেশুনেই সেটা। তবে বলে রাখি আমার খুব সামান্য অংকের টাকা বিটকয়েন, লাইটকয়েন আর ইথারিয়াম হিসাবে আছে। কিন্তু তার মূল্য আমার মূল ইনভেস্টমেন্টের তুলনায় নগণ্য। এটা আমার ‘গ্যাম্বলিং মানি’, যা হারালে ক্ষতি নেই। যদি ডিজিটাল কারেন্সির সমর্থকরা যা বলে মানুষকে বুঝ দিচ্ছেন তা সত্য হয়, তাহলে সেটা ১০০ গুণ হয়ে ফেরত আসলে দোষ কী! ১,০০০ টাকা বেড়ে ১০০,০০০ হলেই আমি সন্তুষ্ট, ১,০০০,০০০ বানানোর লোভে মূলধন আরো ৯,০০০ ফেলার রিস্ক নিতে আমি রাজি নই।

আবার এটা বলাও জরুরী যে আমি পেশাদার অর্থনীতিবিদ বা ক্রিপটোগ্রাফার নই, আমার যুক্তিতে ভুল থাকতে পারে বা প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে। আর এটা অবশ্যই এমন একটা আলোচনা যেখানে আমার ভিন্নমতের মানুষও পুরোপুরি ভুল নাও হতে পারেন।

টাকার উৎপত্তি কিভাবে, এর প্রয়োজনই বা কেন, আর কেন আমরা আড়াই হাজার বছর ধরে এর কোন না কোন রূপের উপর নির্ভরশীল? বিটকয়েন বোঝার আগে এই মৌলিক ব্যাপারটা বোঝা দরকার।

প্রস্তরযুগের মানুষ কোনরকম খেয়ে পড়ে বাঁচতো, কেউ ছিল শিকারী বা মেষপালক, আবার কেউ কৃষক বা ফলমূলসংগ্রহকারী। যেসময় থেকে মানুষ প্রস্তর বা তাম্রনির্মিত সহায়ক সরঞ্জাম ব্যবহার করা শিখল, আর বছরের পর বছর ধরে তার উন্নতিসাধন করতে থাকল, তত তার জীবিকা হয়ে উঠল বিশেষায়িত। অর্থাৎ মৎস্যজীবী শুধু মাছ ধরতে জানে, লাঙ্গলের ল-ও বোঝে না। একই সাথে তৈরি হল তাদের পণ্যের উদ্বৃত্ত, যার হয়ত ভোক্তা আছে অন্য কোন পেশাজীবীদের মধ্যে। তারা শুরু করল নিজেদের মধ্যে পণ্যবিনিময়। সময়ে এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ল, যেমন কোন এক বছরে কৃষকের ঘরে খরার কারণে শস্য কম, সে জেলে ভাইকে অনুরোধ করল বাকিতে মাছ দিতে। জেলের আপত্তি নেই, শুধু সাক্ষী রাখলো দু’জনকে, আর হয়ত কাগজের অভাবে গাছের বাকলে কোন একটা চিহ্ন খোদাই করে রাখল ঋণের প্রমাণস্বরূপ। বলতে পারেন এটাই কারেন্সির আদিরূপ।

এরপরে আরো হাজার বছর পেরোনোর পর শ্রমের বিশেষায়নের কারণে উদ্ভব হল ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ রাজা-পুরোহিতশ্রেণীর। তারা বলল, আমরাই তোমাদের উদ্বৃত্ত কিনে নিয়ে হব সেন্ট্রাল ব্যাংক, বিনিময়ে দেব সোনামানিক। কারণ সোনার সাপ্লাই কম, মানুষের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসাবেও দাম আছে, আর স্বল্পপরিসরে অনেককিছুর দাম দেয়ার মত পরিমাণ পরিবহন করা যায়। রাজা-প্রজার মধ্যে সম্পর্ক যে শুধু শাসনের তা নয়, আস্থারও, কারণ রাজার একটা কাজ হলো এই সাপ্লাই-ডিমান্ডের ভারসাম্য অনুযায়ী মুদ্রা সাপ্লাই করা, আর তার অবমূল্যায়ন রোধ করা। রাজ্যপালেরা স্বর্ণমুদ্রা বানানো শুরু করেন প্রাচীন তুরস্কের পশ্চিম উপকূলের লিডিয়া রাজ্যে, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে।

মুদ্রার কাজ মোটামুটি তিনরকম। এক, ক্রয়ক্ষমতার আধার হিসাবে কাজ করা, যেন আগামী বছর যে গাড়িটা আমি কিনতে চাই, সেটার জন্য একবছর ধরে টাকা জমাতে পারি। দুই, পণ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে কাজ করা, টাকা না থাকলে সমপরিমাণ অন্য সম্পদ আমাকে দিতে হত গাড়ির বিনিময়ে, যেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হত। আর তিন, মূল্যায়নের একক বা ইউনিট হিসাবে কাজ করা, যে কারণে গাড়ির দাম কাউকে আন্দাজ করতে বললে সে হাজার টাকার ঘরে চিন্তা না করে করে লাখ টাকার হিসাব।

সুতরাং আড়াই হাজার বছর ধরে আমরা টাকা ব্যবহার করছি সঙ্গত সুবিধার কারণেই। আজ আমাদের অর্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত আরো অনেক কিছুর সাথে।আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংকব্যবস্থা চল্লিশ বছর আগেই সোনার সাথে ডলারের যোগাযোগ কেটে দিয়েছে, যার কারণ মূলত আমাদের পণ্যউৎপাদন যে হারে বেড়েছে সোনার সেভাবে বাড়েনি, অর্থাৎ দুনিয়ার তাবৎ সোনা দিয়েও বাকি বিষয়-আশয়ের দাম দেয়া সম্ভব নয়।

তার ফলে ফিয়াত কারেন্সি ব্যাপারটা আবার বিংশ শতকে শুরু হল চীনাদের সপ্তম খ্রীষ্টাব্দে প্রথম বিফল প্রচেষ্টার পরে। এর অর্থ “চাহিবামাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাগজে লিখিত অর্থের সমপরিমাণ ‘কিছু একটা’ দিতে বাধ্য থাকিবে”। ঐ কিছু একটা হয়ত অন্য কোন মুদ্রা বা কোন পণ্য, যার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা সমপরিমাণ। সবই কারো না কারো ওপর স্থাপিত ঐ প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সোজা কথায় মানুষ বিশ্বাস রাখে বলেই ডলার-ইউরো আজ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক কারেন্সি, তাদের ইস্যুকারী ব্যাংকরাও আস্থা হারানোর মত কাজ না করার চেষ্টা করে। যেমন মাঝেমধ্যে নতুন নোট প্রিন্ট করতে হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত হলে আস্থা নষ্ট হয়ে যেতে পারে (যেমন জিম্বাবু্য়ে ডলার!)। সেকারণে তারা ততটুকুই সাপ্লাই বাড়ায়, যতটুকু তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করে, তার সামান্য বেশি। সাপ্লাই সামান্য বেশি না রাখলে স্ফীতিহ্রাসের সম্ভাবনা, তাতে মানুষ অর্থখরচ না করে বেশি বেশি টাকা লেপের নিচে লুকিয়ে রাখবে! অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে তাতে কমতি হতে পারে।

তো মাঝেমধ্যে পুঁজিবাদী সমাজে স্বাভাবিক কারণেই মন্দা আসে। শেষবার হল ২০০৮এ। বিটকয়েনের উৎপত্তি সে সময়েই, ‘সাতোশি নাকামোতো’ ছদ্মনামধারী এক কম্প্যুটার প্রোগ্রামার আরো ক’জনার সাথে এ জিনিস শুরু করেন। এর কম্প্যুটার কোডও ওপেন সোর্স, অর্থাৎ যে কেউ সেটাকে নিয়ে নতুন নিয়মের আঙ্গিকে নতুন ধরনের ডিজিট্যাল কারেন্সি বানাতে পারে। বিটকয়েনের আবিষ্কর্তারা সরকার আর ব্যাংকগুলির উপর ভালরকম বীতশ্রদ্ধ ছিলেন আর সেসময়ের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য এদেরকে দায়ী করতেন। তারা বিটকয়েন বানান একারণেই যেন টাকা-ডলারের পরিবর্তে মানুষ ধীরে ধীরে বিটকয়েনে বিশ্বাসস্থাপন করে, আর তাতে সরকার-ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত জনগণের একটা মুদ্রা প্রতিষ্ঠা পায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সকল পর্বের লিংকঃ



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৫

আমার মতে, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করতে সরকারের থেকে জনগণের ক্ষমতা বেশি। তাদের এই সচেতনতা আসা দরকার যে তারা নিজেরাই ইন্টারনেটে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ছেড়ে দিচ্ছে, আর তারা কি রং পছন্দ বা অপছন্দ করে এধরনের সামান্য তথ্যই হয়ত অ্যানালিটিকার জন্য যথেষ্ট। ফেসবুকগুগলের মত কম্পানিগুলি কিন্তু এখন গ্রাহকদের কি কি তথ্য তাদের কাছে আছে সেটা ডাউনলোড করার সুযোগ দেয়। তা করলেও সে তথ্য কতটুকু গূঢ় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে, সেটা কিন্তু বোঝা সহজ নয়। আর ফেসবুকের সুবিধাগুলি ছেড়ে দিতেও কেউ চায় না। সুতরাং সবচে’ বড় কাজ যেটা করতে পারেন সেটা হলো নিজের মনে বাইরে থেকে কি ঢুকছে তার উপর ফিল্টার বসানো। ফেসবুকে আপনার ফ্রেন্ডের শেয়ার করা পোস্ট, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, টিভিতে যেটাই দেখবেন বা শুনবেন না কেন, পরখ করে দেখবেন আগে যে, কোন একটা খবরের উদ্দেশ্য কি আপনার পিলে চমকে দেয়া? যদি তাই মনে হয়, খবরটা নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন তুলবেন, প্রগতিশীলই হোন, কিংবা রক্ষণশীল। সঠিক প্রশ্ন তুললে সঠিক জবাবের খোঁজ করবেন আর তা খুঁজে পাবেন, আর তখন হয়ত মনে হবে এতে পিলে চমকানোর কিছুই নেই! যদি আপনি গ্রাজুয়েট স্কুলে পড়ে থাকেন, তাহলে জানেন যে একাডেমিক পেপার লিখলে তার কিরকম কড়া রিভিউ হয়। সেরকম রিভিউটা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে, করাটা এখন খুবই দরকারী। আর রাজনৈতিক বা অন্যান্য ব্যাপার যত ইন্টারনেটে শেয়ার করবেন কম, আর সেসবে লাইক যত কম দিবেন, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থাগুলো আপনার ও আপনার সমমনাদের প্রোফাইল করার প্রয়োজনীয় তথ্যও ততটা কম পাবে।

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্যসংগ্রহের মত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেডারেল সরকার অনেক আগে থেকেই নানা পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে ২০১১তে ফেডারেল ট্রেড কমিশন ফেসবুক-গুগলসহ ১১টি কম্পানির কনজিউমার ড্যাটা সংক্রান্ত আচরণ তদন্ত করে এবং অনেক ফাঁকফোকর বের করে। সেসময় এ কম্পানিগুলি প্রাইভেসি জোরদার করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা ঘোষণা করলেও ফেসবুক ভুজুং-ভাজুং প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পেয়ে যায়, কারণ তাদের পয়সাই আসে মানুষের নাড়িনক্ষত্রের খবর আর অ্যাডভার্টাইজিং থেকে। ‘১১র পরে ২০১৩তে যখন এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দেন যে এনএসএ মানুষের ওপর ইন্টারনেটে নজরদারি করে, তখন সিলিকন ভ্যালির কম্পানিগুলি সরকার থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরার চেষ্টা করে। এর ফলে ড্যাটা প্রাইভেসি সংক্রান্ত আলোচনা আর বেশি গঠনমূলক দিকে আগায়নি। সুযোগটা নিয়ে ফেসবুক-গুগলের মত কম্পানিরা আরো পয়সা বানিয়েছে। যাই হোক, এ বছর মার্কিন সরকারের চাপে না হলেও ইউরোপ থেকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কারণে যথেষ্ট চাপ এসেছে এদের ওপর, আর শেয়ারহোল্ডাররাও এদের বিজনেস মডেল নিয়ে সন্দিহান হওয়া শুরু করেছে। ফেসবুকের গত কয়েক সপ্তাহের শেয়ারের দামের পতন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। মার্কিন কংগ্রেস, রবার্ট ম্যুলার আর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে সাথে এদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকছে। এই জল কোথায় গিয়ে গড়ায়, সেটা সময়ই বলে দেবে। এটা মানতেই হবে, ইন্টারনেট দেশসীমাবিহীন একটা মাধ্যম, আর কোন তথ্য হওয়া উচিত গোপনীয়, কোন স্তরের গোপনীয়, আর কি ধরনের রাজনৈতিক ইন্টারনেট প্রোপাগান্ডা বাকস্বাধীনতা পাওয়ার উপযুক্ত, এসব নির্ধারণ করা আর সে ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ঐকমত্যে পৌঁছানো অবশ্যই সময়সাপেক্ষ।

এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। মানুষের গত একশ’ বছরের ইতিহাসে ইন্টারনেট যেমন এসেছে, সেরকম রেডিওও এসেছে, টিভিও বেশিদিন আগে আসেনি। অনেক মানুষ, বিশেষ করে একটু পুরনো প্রজন্মের যারা অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তারা, সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে এখনো খুব বেশি পরিচিত নন। মিলেনিয়ালদের পরে যারা আসবে, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হবে বলে আমার ধারণা।

আরেকটা ব্যাপার স্বীকার করা দরকার। সত্যমিথ্যা বলে ভোটারদের যতটাই ট্রাম্পের দিকে টানা হোক না কেন, ট্রাম্প কিন্তু যথাযথভাবেই গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রতিবাদ-সমাবেশ সমানে চললেও ট্রাম্পকে ষড়যন্ত্র করে কেউ ঠেকায়নি। ট্রাম্পের বিজয় সেদিক থেকে চিন্তা করলে মার্কিন গণতন্ত্রের একটা পরীক্ষিত সাফল্য। কম ব্যবধানে জিতলেও অনেক মানুষই তাকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছে, এবং তার প্রতিপক্ষ সেটা মেনে নিয়েছে। আর ট্রাম্পের আমলে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে যতটা সক্রিয়, সচেতন আর প্রতিবাদী হয়েছে, এটা অনেকদিন এদেশে হয়নি। এদেশের স্বাধীনতাগুলি যে সত্যি সত্যি আছে, তার পরীক্ষা এখনই চলছে, মাঝেমধ্যে এই পরীক্ষাটা জরুরী। ট্রাম্প চাইলেই মানুষের কন্ঠরোধ করতে পারবেন না। এদেশের প্রাইভেট সেক্টর, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, স্টেট ও স্থানীয় সরকার, বিচারালয় — এরা স্বাধীন, শক্তিশালী আর কেউই ট্রাম্পের মুখাপেক্ষী নয়। ট্রাম্প-ব্যাননগোষ্ঠী চাইলেও দেশের সামাজিক মূল্যবোধ আর রাজনৈতিক আলাপচারিতার ধ্যানধারণা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারবে না, এমনকি ইন্টারনেট আর কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা দিয়েও না।

আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা দু’টোই বহুলাংশে গণতান্ত্রিক, আমাদের দেশের মত শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখানো গণতন্ত্রের মত নয়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানুষের জাতীয়তা, মতামত, মূল্যবোধ যেমনটা সমসত্ত্ব, এখানকার মানুষের — এমনকি সাদাদের মধ্যেও — সেরকমটা নয়। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল আর তাদের মাঝখানের সবারই কথা বলার সত্যিকারের স্বাধীনতা আছে। তাদের মধ্যে ইতিহাসের ক্রান্তিকালে বিতর্ক-বিতন্ডা হয়, এদেশে এ নতুন কিছু নয়। এদেশের নতুন অভিবাসীরা সম্ভবত জানেন না, মতপ্রকাশের এ স্বাধীনতা রাখার জন্য আমেরিকা অনেক টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। তাই শুধু সে স্বাধীনতা উপভোগ নয়, সেসবের ইতিহাস আর সমঝোতার কাহিনী আমাদের জানা বিশেষ কর্তব্য। বিশেষ করে ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, সত্তরের দশকে নিক্সনের সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ সমাবেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শান্তিকামী আর বাস্তবতাবাদীদের বিতর্ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর আইসোলেশনিজমের উত্থান, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ — এগুলির মধ্যে অনেক ছোট ছোট জরুরী বৃত্তান্ত আছে যেগুলি হেডলাইনের কারণে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এদেশে সরকার থেকে চাপিয়ে দেয়া সংস্কার কখনো সুখপ্রদভাবে সফল হয়নি; যখন সমাজে আসলেই পরিবর্তন চলে এসেছে, যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীলতার বাঁধা অতিক্রম করেই সেসব নতুন মূল্যবোধ একসময় না একসময় সরকারি বৈধতা পেয়েছে। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্র চলে, দু’পা এগুলে একপা পিছুতে হয়, নতুন ‘সঠিক’ মূল্যবোধ খুঁজে পেতে আর প্রতিস্থাপন করতে সময় লাগে। আজকের মত বিভক্তি ঝগড়াঝাঁটি আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থা এ বিভাজনকে ব্যবহার করলেও এই সৎ ও সমালোচনামূলক বিতর্ক যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য খুবই জরুরী। আর এখনকার খারাপ সময় পার করার পর একসময় না একসময় সামাজিক মূল্যবোধে একটা কনভার্জেন্স আসবে।

যারা বর্ণবাদের উত্থান নিয়ে শংকিত তাদের কিছু আশ্বাস দেই। ট্রাম্পের কারণে ‘১৭র শুরুর দিকে বর্ণবাদী আর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা একটু শোরগোল তুললেও এখন কিন্তু তাদের যারা বেশি কট্টর তারা অনেক ধারায় বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ এমন এক ধরনের মতবাদ যার ‌অনুগামী যত বাড়বে তত তারা নিজেদের মধ্যে মারকাট করবে কার জাত বেশি শুদ্ধ তাই নিয়ে। ট্রাম্পের কারণে এরা যে সাংগঠনিকভাবে একীভূত হয়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিশেষ করে স্টীভ ব্যাননকে সরিয়ে দেয়ার পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে তেমন একটা আতংকিত নই। ট্রাম্পভোটার সাদাদের অনেকের মনের মধ্যে অভিবাসীবিরোধী বা কিঞ্চিৎ বর্ণবাদী মনোভাব দেখলেও আমার হিসাবে তারা সেটাকে উগ্র হিংসাত্মক পর্যায়ে নেয়ার মত মানুষ নয়।

এককভাবে আর গোষ্ঠীগতভাবে যেটা করণীয় সেটা হলো আমাদের যার যার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাধারণ মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলা। শুরুতে মনে হবে তাদের মস্তিষ্ক প্রক্ষালিত। যত বেশি কথা বলবেন, আর রাজনীতি পেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গেও যাবেন, ততই বুঝতে পারবেন এরা কিন্তু আপনার মতই কোন না কোন কারণে ভীত। তাদের ভয়টাকেই আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতারা চাগিয়ে তুলছে, বাড়িয়ে তুলছে, যেমনটা হয়ত আপনার রাজনৈতিক ঘরানা করছে আপনার সাথে। যখন এদের সাধারণ সমর্থকদের সাথে কথা বলবেন, জিজ্ঞেস করবেন তারা ব্যক্তিগতভাবে আসলে কি চায়, দেখবেন যে তারাও চায় আপনার মত একটা ভাল জীবিকা, আবাসস্থল, নিজেদের মত করে জীবনযাপনের স্বাধীনতা আর পরের প্রজন্মের জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ। তারা ভয়ে আছে যে আপনার রাজনৈতিক ঘরানা তাদের এসব চাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আর এ ভয়টাই তাদের পরিচালনা করছে। সেখানে তাদের প্রার্থী নৈতিকতার সীমালংঘন করছেন কিনা তার থেকে বেশি তাকে মূল্যায়ন করা হয় তিনি তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করছেন কিনা তা দিয়ে। কথোপকথনের পরের ধাপে গিয়ে যদি আপনি তাদের সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন, তাদের আস্থা অর্জন করতে পারেন এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে আপনার ব্যক্তিগত চাওয়াটাও মূলত একই আর মতের অমিল থাকলেও বন্ধুত্ব করতে আপনি রাজি, তখন তাদের এবং আপনার নিজেরও ভয়ভীতিগুলি কিছুটা লাঘব হবে, আর অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর পূর্ণচক্র তখনই ভাঙবে। এই কথোপকথনের সময় এখনই! আদর্শবাদ নিয়ে বুলি কপচানোর কিংবা প্রতিপক্ষের ‘পশ্চাদমুখী’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাসাহাসি বা নাক-সিঁটকানোর সময় এখন নয়!

কথোপকথনের মূল বিষয়বস্তু যতদিন থাকবে শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প, ততদিনই প্রগতিশীলতার নামে চলবে অসহিষ্ণুতা আর রক্ষণশীলতার নামে অসাধুতা। আমরা যতক্ষণ না চেষ্টা করব আমাদের ‘প্রতিপক্ষ’কে জানার-বোঝার, তাদের সাথে কথা বলার, ততদিন এই প্রগতিশীল-রক্ষণশীল ভন্ডের দল আমাদেরকে ইন্টারনেট আর টিভির মাধ্যমে আলাদা করে রাখবে, আর বুঝ দেবে যে আমরা একে অপরের শত্রু। যতক্ষণ না আমরা নিজেরা সেই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে সক্ষম হচ্ছি, ততদিন আমাদের ভবিষ্যতে আসতে থাকবে আরো ‘ট্রাম্প’ এবং আরো খারাপ ‘ট্রাম্প’।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৪

আগের পর্বগুলোতে বলেছি অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর নোংরা পদ্ধতির বৃত্তান্ত। এপর্বে বলবো ২০১৬-এর ব্রেক্সিট নির্বাচন আর মার্কিন সাধারণ নির্বাচনে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর অসত্য প্রচারণার ভূমিকা। আর আগামী পর্বে তাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের করণীয় কি তাই বলে শেষ করব।

উপরের দুই নির্বাচনের আগেই কিন্তু অ্যানালিটিকার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়েছে। পুতিনের রাশিয়াতে এটি পেয়েছে শৈল্পিক রূপ, তার ওপর সেখানে টেলিভিশন-রেডিওও সরকারের (বা পুতিনের নিকটজনের) একচেটিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে, আর ফেসবুকের পরিবর্তে আছে তার ক্লোন ভ্কন্তাক্তিয়ে, যেটা পুতিনের ট্রোলে ভর্তি। তার ফলে আপনারা এমাসেই দেখলেন রুশে পুতিনের ৭৫% ভোটে জয়লাভের নির্বাচন নামের ভং। চীনসরকারও এসব পদ্ধতি ২০০৮-এ তাদের তিব্বত আর শ্শিনজিয়াং-উইগুর প্রদেশের প্রতিবাদ দমাতে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশ, যাদের গণতন্ত্র এদের থেকে বেশি টেকসই আর পরীক্ষিত, ২০১৬তে তাদের ওপরে এসব পদ্ধতি প্রথম সফলতা পায়।

ব্রেক্সিট নির্বাচন হয় ২০১৬র জুনে। তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাবার (বা ব্রেক্সিটের) স্বপক্ষে প্রায় ৫২% ভোট পড়ে, ৭২% ভোটার ভোট দেয়, আর দু’দলে ভোটের তফাত ছিল মোটে ৬লাখ, সাড়ে চার কোটি ভোটের মধ্যে। অর্থাৎ মোটামুটি ১%-এর মধ্যে ফটোফিনিশ। এ নির্বাচনের আগেও দু’দলে বিতর্ক-বিভক্তি হয়েছে অনেক, বিদেশী অভিবাসী-রেফ্যুজি, অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘অন্যায্য’ দাবি-দাওয়া, এসব ছিল হট টপিক। বিশেষজ্ঞরা অনেকভাবেই দেশের মানুষকে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলেন যে এর ফলে যুক্তরাজ্যের যারপরনাই অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্রেক্সিটের স্বপক্ষে ছিল এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসনের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির এক সুবিধাবাদী বিদ্রোহী গ্রুপ, তদ্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন ছিলেন এর বিপক্ষে। আরো স্বপক্ষে ছিল ইউকিপ নামে কট্টর জাতীয়তাবাদী এক পার্টি আর তার নেতা নাইজেল ফারাজ।

ফারাজকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সেই একই ভিলেন রবার্ট মার্সার! তারা ইউকিপকে সাহায্য করে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, কিন্তু তার বিনিময়ে অ্যানালিটিকা নাকি কোন পয়সা নেয়নি। অর্থাৎ এই সার্ভিস ছিল মার্সারের দেয়া ‘উপহার’। যুক্তরাজ্যের আইনে এ অবৈধ, কারণ মার্সার ব্রিটিশ নাগরিক নন। এনিয়ে সেদেশের পার্লামেন্টে এখন তদন্ত চলছে। অপরদিকে বোরিস জনসন গিয়ে ধরেন অ্যাগ্রেগেট আইকিউ বলে এক কানাডিয়ান কম্পানিকে, একই কাজের জন্য। যেটা পরে বেরিয়েছে সেটা হল অ্যাগ্রেগেট আইকিউ হলো গিয়ে কানাডায় কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মাতৃসংস্থা এসসিএলের নাম-ভাঁড়ানো ফ্রন্ট কম্পানি! জনসনের ভোট লীভ প্রচারণীদল তাদের পয়ত্রিশ লাখ পাউন্ড দেয়। দুইদলের মধ্যে নির্বাচনী তহবিল নিয়ে যোগসাজশের সম্ভাবনা আছে, এবং তারা আইনের সীমালংঘন করে বেশি অর্থ খরচ করেছে কিনা পার্লামেন্ট এ নিয়েও তদন্ত করছে।

এপ্রসঙ্গে দু’টো বৃত্তান্ত না বললেই নয়। ইউকিপের ফারাজ মিথ্যা প্রচারণা চালান একটি চটকদার পোস্টারের মাধ্যমে, যেটায় কিছু সংবেদনশীল শ্লোগানের সাথে দেখানো হয় হাজার হাজার আরব-এশিয়ান চেহারার অভিবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ডার ক্রসিংয়ে। এই চিত্র দেখিয়ে ব্রিটেনের যারা খেঁটে খাওয়া মানুষ (যাদের সামান্যসংখ্যকই বর্ণবাদী) তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, এরা ব্রিটেনে ঢুকলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পোস্টার দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ভোটারদের মাইক্রোটার্গেট করা হয়। বোরিস জনসনেরও প্রচারণার অংশ ছিল একটা ডাবলডেকার বাস যার গায়ে লেখা যে ব্রিটেন নাকি ইইউকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড পাঠায়, সে টাকা তাদের এনএইচএস নামের সরকারি গণস্বাস্থ্য প্রকল্পে ব্যয় করলে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার হত। বোরিসের সাথে লন্ডনের গর্বের প্রতীক ডাবলডেকার ব্রিটেনময় ঘুরে বেড়ায়, তার ছবিও ইন্টারনেটে মধ্যবিত্ত ব্রিটিশদের টার্গেট করে ছাড়া হয়।

বলা বাহুল্য দু’টোই মিথ্যাপ্রচারণা। সেই ‘অভিবাসীচিত্র’ আসলে ছিলো ক্রোয়েশিয়া-স্লোভেনিয়া বর্ডারে শরণার্থীশিবিরের ছবি, যারা দাতব্য সংস্থা ও জাতিসংঘের অর্থসাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আর ইইউকে ব্রিটেন যত টাকা পাঠায় তার থেকে বেশি অংকের সুবিধা তাদের থেকে পায়, অর্থের আকারে না হলেও। যথারীতি মানুষের মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিটের স্বপক্ষদল কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের সাহায্যে অবিশ্বাস্যজনকভাবে জিতে যায়।

ট্রাম্পের বিজয় ছিল সেরকমই অবিশ্বাস্যকর। বলছি কিভাবে সে কাহিনী অন্যরকম হতে পারত, তার আগে বলি কেম্ব্রিজ অ্যানালাটিকার সম্পর্ক। ট্রাম্পের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করে অ্যানালিটিকা। ট্রাম্পের সাথে কাজ শুরু করার আগেই তাদের নেটওয়ার্ক ১৭টি স্টেটে বিস্তৃত ছিল। রিপাবলিকান প্রাইমারির পরে তারা এই নেটওয়ার্ক আরো বাড়ায় আর ট্রাম্পের পক্ষে অনলাইন অ্যাডভার্টাইজিং করে, ফেসবুক-টুইটারে ফেক প্রোফাইল দিয়ে সম্ভাব্য ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেকসময় পার্সোন্যাল মেসেজও পাঠায়। পুতিনের রুশ ট্রোলরাও একই ভাবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে। ‌অ্যানালিটিকার কর্মকর্তারা প্রায়শই গর্ব করে বলেছে যে তারা ট্রাম্পের ডিজিটাল প্রচারণা থেকে দেশের কোন অঞ্চলে তার নির্বাচনী সমাবেশ করতে হবে, এসবকিছুই নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। তারা উইকিলিকসের জুলিয়ান আসাঞ্জের সাথে যোগাযোগ করে ক্লিনটনের কেলেংকারিময় ইমেল সংগ্রহের জন্য। রুশ হ্যাকারদের থেকে আসাঞ্জ এগুলোর কিছু পেয়েছিলেন, এখন তিনি দাবি করছেন যে তিনি নাকি অ্যানালিটিকাকে এগুলি দেননি। কিন্তু পরে ঠিকই ব্যক্তিগত আক্রোশবসত সময়মত (ট্রাম্পের হলিউড অ্যাক্সেসের কেলেংকারি ভিডিও যেদিন বেরুলো) এগুলো প্রকাশ করেন।

আমরা ‌অনেকেই জানি না যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা মোটামুটি বড় মাইনরিটি সাধারণত ভোট দেয় না, তারা ভাবে কোন পার্টিই তাদের স্বার্থ দেখে না। এদের কিছু হয়ত বর্ণবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যপাদী, স্রেফ বাইকার বা দন্তনখরহীন কন্সপিরাসি থিওরিস্ট। এরাও কিন্তু ইন্টারনেটে যাওয়া-আসা করে এবং তাদের ওয়েবসাইট-ফোরাম ইন্টারনেটের কোনা-কাঞ্চিতে বিপুল পরিমাণে আছে। গুগল-ফেসবুকের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বে বোঝানো পদ্ধতিতে তাদের চিন্তাধারা কি আর তারা আসলে কি চায় তা জানা সম্ভব, এবং তৃতীয় পর্বের পদ্ধতিতে তাদেরকে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ‘রিইনফোর্সিং মেসেজ’ দিয়ে কোন নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে রাজি করানো সম্ভব। ট্রাম্প যখন দাবি করেছেন যে তাঁর কারণে বিপুল পরিমাণ ভোটার রিপাবলিকান পার্টিতে এসেছে, কথাটা সত্য। সাধারণ রিপাবলিকানদের সাথে ওপরের ঐ গোষ্ঠীর ভোটও যোগ হয়েছে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা এই কাজটা সফলভাবে করেছে, আর ট্রাম্প তাদের এজন্য ৬২ লাখ ডলার দেন। আমার ধারণা ট্রাম্প সত্যিকার অর্থে কট্টর রেসিস্ট নন, কিন্তু তার পক্ষে বর্ণবাদী লেবেলটা অস্বীকার করাটাও সোজা নয়, কারণ তিনি সে ধরনের ভোটারদের ব্যবহার করেছেন। তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা — যারা তার সুরে আকৃষ্ট হয়েছে, তাদের একটা ছোট্ট অংশ ইঁদুর হতে পারে, কিন্তু তিনি নিজে সম্ভবত তা নন, তিনি স্রেফ একজন সেলসম্যান।

একথাও এখানে বলা জরুরী যে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণারও একটা বড় অংশ ছিল ডিজিটাল। কিন্তু তার অ্যানালিটিকাবাহিনীর পদ্ধতি নিয়ে কেউ এখনো প্রশ্ন তোলেনি, তুললে ট্রাম্পই সবার আগে গলাবাজি করে টুইটারে সত্য-মিথ্যা কিছু একটা দাবি করতেন। তার মানে এই নয় যে জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরিতে ক্লিন্টনের প্রচারণী ফার্মের কোনই ভূমিকা নেই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এখন বলি এরকম অসম্ভাব্য ফলাফল কিভাবে হলো। অনেকেই হয়ত জানেন ক্লিনটন পপুলার ভোটে ট্রাম্পের থেকে প্রায় ৩০লাখ বেশি পেয়েছেন, সেটা মোট ভোটের ২.১%। ইলেক্টরাল কলেজ বলে একটা ব্যাপার আছে এদেশে, যার কারণে প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। একেকটা স্টেটের জন্য বরাদ্দকৃত কিছুসংখ্যক ইলেক্টরাল ভোট আছে, বেশিরভাগ স্টেটের নিয়মানুযায়ী যিনি সেখানে সবচে বেশি ভোট পাবেন, সে যতটুকু ব্যবধানেই হোক, তিনিই পাবেন সে স্টেটের সকল ইলেক্টরাল ভোট। আমেরিকার রাষ্ট্রনির্মাতারাই ইচ্ছা করে এরকমটা বানিয়ে দিয়ে গেছেন, এভাবেই দু’শতাধিক বছর ধরে চলছে, আর এটাকে পরিবর্তন করাও সহজ নয়। এধরনের ‘অন্যায্যতা’ রাখার কারণ হলো যেন কোন অসদুদ্দেশ্যের প্রার্থী চাইলেই জনগণের ভাবপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে পপুলার ভোটে বিজয়ী না হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পুরনো নিয়মটিকেই পুরোপুরি ‘গেম’ করা হয়েছে।

অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী তাদের তহবিলের অধিকাংশ টার্গেট করে ‘রাস্ট বেল্ট’ বলে জনবহুল একটি অঞ্চলে। সেখানকার জনগোষ্ঠী নানাকারণে খারাপ সময় পার করছে। পঞ্চাশ বছর আগে তাদের বাপ-দাদারা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে সমৃদ্ধি পেয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মান। অনেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ধরনের চাকুরিদক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেরকে পুরনোদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা ছিল সহজ। ট্রাম্পও অ্যানালিটিকার হিসাব অনুযায়ী এসব জায়গায় গিয়ে বিশাল সমাবেশ করেন, কিন্তু ক্লিনটন বলতে গেলে সেসব জায়গায় যানই নি, ভেবেছেন গত দু’নির্বাচনের মত এরা ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেবে। অথচ এরাই সুইং স্টেট, যাদের ভোটে শেষ ফলাফল নির্ধারিত হয়। সেসব জায়গায় অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা তাই চলেছে বেশি, ডেমোক্র্যাট শ্বেতাঙ্গ খেঁটে খাওয়া মানুষদের ব্রেক্সিটের উপায়ে কব্জা করা হয়েছে, আর ডেমোক্র্যাট কৃষ্ণাঙ্গদের বোঝানো হয়েছে কালো প্রেসিডেন্টের আমলে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, তাই তারা ভোটই দিতে যায়নি

হিসাব দেখুন। পেন্সিলভানিয়াতে ট্রাম্প জিতেছেন মাত্র ৪৪,০০০ ভোটের ব্যবধানে, সেটা সেখানের মোট ভোট ৬৩ লাখের ০.৭% মাত্র, সেখানের ইলেক্টরাল ভোট পেয়েছেন ২০টি। উইস্কনসিনে জিতেছেন ২৩,০০০ ব্যবধানে, সেটা মোট ভোট ৩০ লাখের ০.৩% মাত্র, ইলেক্টরাল ভোট ১০টি। মিশিগানে জিতলেন মা-আ-ত্র ১১,০০০ বেশি পেয়ে, মোট ভোট ৪৭ লাখের ০.৩%! ইলেক্টরাল ভোট ১৬টি। তার সাথে যদি আরেকটা ছোট স্টেট নিউ হ্যাম্শায়ারকে যোগ করি, সেখানে আড়াই হাজার ব্যবধান, মোট ৮ লাখের ০.৩%, ইলেক্টরাল ভোট ৪টি। অর্থাৎ ৫০টি ইলেক্টরাল ভোট খুবই চুলচেরা ব্যবধানে জিতেছেন। পুরো ইলেক্টরাল ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩০৪, ক্লিনটন ২২৭। ৫০ ইলেক্টরাল ভোট আর সাড়ে ৮০ হাজার পপুলার ভোট (মোট ভোটের ০.০৬%!) এদিক-ওদিক হলে ট্রাম্প পেতেন ২৫৪ ভোট আর ক্লিনটন ২৭৭ পেয়ে আজ থাকতেন মার্কিনের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৩

দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত যা কিছু বললাম, শুনতে ভয়াবহ মনে হলেও বেআইনি নয়, আর অনেকে হয়ত গায়েও লাগাবে না, কারণ মার্কিনে এসব নিত্যনৈমিত্তিক। আপনার যদি সর্পতৈলে আসক্তি থাকে, তিতাস মলমে আপনার আগ্রহ জন্মাতেই পারে। ফেসবুক যদি সেটার খবর আপনাকে দিয়ে দু’পয়সা কামিয়ে নেয়, ক্ষতি কি? যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব অবৈধ নয়, যতক্ষণ না আপনি (বা আপনার পক্ষে সরকার) প্রতারণার মামলা ঠুকে দিচ্ছে।

এপর্বে বলবো পরের ধাপটা কি, আর কিভাবে দুষ্ট লোকেরা আমার-আপনার-সবার ক্ষতি করছে।

অ্যানালিটিকার মত ফার্ম সম্ভবত এখনো এক কোটির মধ্যে একজনকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিনপয়েন্ট করে চিহ্নিত করতে পারে না, কিন্তু সমমনা মানুষদের একটা কম্যুনিটিকে পারে। সোজা উদাহরণ দিই। তারা তাদের তথ্যভান্ডারের উপর মেশিন লার্নিং কোরিলেশন অ্যালগরিদম চালিয়ে বের করলো যে যেসব পুরুষদের গোলাপীরং ভীষণ অপছন্দ তাদের অধিকাংশই গেদের ঘৃণা করে, তার সাথে যদি তারা রংধনুপতাকাওলা পোস্টে রাগের ইমো দেয়, তাহলে তো মিলেই গেল। তারা বের করলো যে আপনার জিপকোডে এরকম মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশ, কিন্তু ভোট দিতে যায় মাত্র ২০ শতাংশ। মার্সারপরিবারও গেদের দেখতে পারে না। তারা অ্যানালিটিকাকে বলল আপনার ভোটটা কব্জা করতে। অ্যানালিটিকা ফেসবুকের অ্যাডভার্টাইজিং প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আপনার জিপকোডকে টার্গেট করলো। একে বলে মাইক্রোটার্গেটিং, জিপকোডের সাথে অন্যান্য ক্যাটেগরির সেটের ইন্টারসেকশন করে তারা আপনার এলাকার সমমনা মানুষকে মাইক্রোটার্গেট করতে পারে।

তো সেই উপায়ে আজকে আপনার ফেসবুক ফীডের স্পন্সরড কন্টেন্টে দেখালো এমন একটা খবর যাতে আপনার পিত্তি জ্বলে যায়, ধরুন আপনার এলাকার কোন পদে একজন ডেমোক্র্যাট গে বা লেজ (উল্টোদিক থেকে চিন্তা করলে রিপাবলিকান তথাকথিত হোমোফোব) নির্বাচনপ্রার্থী। খবরটা সত্য হতে পারে, আর অসত্য হলেও আপনি জাংক মেইলের মত ট্র্যাশ করবেন না, মনে মনে একটা রাগের সুড়সুড়ি অনুভব করবেন এবং আপনি এটা মনে রাখবেন। হয়ত আপনার প্রোফাইলে শেয়ারও করবেন, অসত্য বলে আপনাকে কেউ চ্যালেন্জ করবে না, কেউ যেচে পড়ে ঝগড়া করতে যায় না।

পরের হপ্তায় আপনাদের দেখানো হলো ট্রাম্পমামু ইলেকশানে জিতলে বলেছেন কোনো গে-লেজের সাধ্য নাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। মনে একটু আনন্দের সুড়সুড়ি লাগলো, লাইক দিলেন এবং ফেসবুকের অ্যালগরিদমও বুঝে নিল পরেরবার আপনি কি লাইক করবেন। অর্থাৎ এবার হয়ত স্পন্সর্ড কন্টেন্টও লাগবে না, আপনার সমমনা কোন ফ্রেন্ডের ফীড থেকেই এর পরের হপ্তায় পড়বেন নিউইয়র্ক বা ক্যালি, সে যেখানেই হোক, স্কুলের পাঠ্যসূচীতে গে-লেজবিষয়ে জ্ঞানদান করা হবে! সেসব জায়গার বাসিন্দা না হলেও, একজন দায়িত্ববান গার্জেন হিসাবে আপনার কলিজা কেঁপে উঠবে। সত্যাসত্য যাচাই না করে মনে মনে ঠিক করে ফেলবেন কে আপনার ভোটের যোগ্য।

শুধু ইন্টারনেট-ফেসবুক নয়, আপনার লোক্যাল টিভিচ্যানেলেও সমানে আপনাকে সুড়সুড়ি দেয়া হলে আপনি রান্নাঘরের ক্যালেন্ডারে ইলেকশানের তারিখটাকে লাল কালিতে বড় করে কয়েকবার দাগিয়ে ফেলবেন। যদি হাতে খুচরা পয়সা থাকে, সেটাও দান করবেন পছন্দের প্রার্থীর প্রচারণা তহবিলে। আর এই পুরো ব্যাপারটা যে ঘটে চলছে, আপনার পাশের জিপকোডের মানুষ হয়ত টেরও পাবে না! হয়তো তাদের উপর চলছে উল্টো ব্যবস্থা, আর তা নাহলে ভোটের দিন লেজ গুটিয়ে বসে থাকার চিকিৎসা।

উপরের সবকিছুই কিন্তু গে-লেজের সামনে ‘এন্টি’ বসালেও সত্য। যে ঘরানার প্রতিই আপনি সহানুভূতিশীল হোন না কেন, অ্যানালিটিকা না হলেও অন্য কম্পানির থেকে আপনার নিস্তার নেই! মানুষ আকৃষ্ট হয় যেটা তার কাছে জেল্লাদার বা ভয়ের তার দিকে। সত্যকে নয়, সে বিশ্বাস করে সেটাই যা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সত্য জিনিস বলতে গেলে কখনোই জেল্লাদার হয় না। দিনের পর দিন সমানে সুড়সুড়ির পর পাশাপাশি দুই জিপকোডের মানুষ হয়ে যাবে পদ্মার এপার আর ওপার, শুধু চাই বারুদে দিয়াশলাই! শার্লটসভিলে আর বার্কলীতে নির্বাচনের পরপর অনেকটা সেটাই হয়েছে। মানুষ মরেছে এদের এসব খেলার জন্যে!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের পুতিনের রঁসুইঘরের মত বদেরা এসবের থেকেও দু’কাঠি সরেস! আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ আর দৃঢ়বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এক ঘন্টার নোটিসে দাঁড়া করিয়ে ফেলবে ভুয়া খবরভরা বিশ্বাসযোগ্য দেখতে খবরের কাগজের ওয়েবসাইট। সত্য খবর বের করা আর লেখা কিন্তু অনেক কঠিন কাজ আর ব্যয়বহুল, সাংবাদিকতায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় (সেকাজটার ০.১ শতাংশমাত্র আমি এমুহূর্তে করছি!)। মিথ্যা খবর বানানো বহুত সস্তা আর সহজ, একটা ল্যাপটপ নিয়ে কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতে আপনিও বানিয়ে ফেলতে পারবেন।

তাই ধরুন, কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক নামকরা কাগজ না ঘাঁটিয়ে গুগলে হয়ত খুঁজতে গেলেন মিশিগানে হিজাবধারীদের পেটানো হচ্ছে নাকি না, গুগল তাকে হাজারখান ভুয়া খবর দেখাবে তার ধারণার স্বপক্ষে, একটা সত্যও দেখাবে না কারণ খবরটা সত্য নয় — কিন্তু সে কিন্তু বুঝবে উল্টো! আমাদের অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী এধরনের বানোয়াট খবর এসইওর মাধ্যমে গুগলে সবার উপরে বসাবে আর উপরের ফেসবুকীয় পন্থায় পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে। সেসব মিথ্যা খবরকে পরখ করে সত্যটা বের করে জানাতে কিন্তু আসল সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে যাবে, সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, কারণ ‌অসত্যের তো কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, সত্যেরও মা-বাপ নেই, কী বের করবে তারা! ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ভু্য়াখবরের সাথে সাথে অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী চটকদার ডায়ালগসমৃদ্ধ রাজনৈতিক কার্টুন, ভিডিও, জেপেগ বা জিফও বানায় (এগুলিকে বলে ‘মীম’), তাতে তো আরো মহা সুড়সুড়ি! আর দুনিয়ার কোটি কোটি সস্তা চীনা মোবাইল থেকে হ্যাক করে চুরি করা অন্য মানুষের ছবি আর তথ্যও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলি দিয়েও অ্যানালিটিকা বানিয়ে রেখেছে হাজারো ফেক প্রোফাইল (এ ব্যাপারে পরে সুযোগ হলে প্র্যাকটিক্যাল দেখাব), তাদের মাধ্যমে হাজারো লাইক দিয়ে দিয়ে কোন একটা অসত্য খবর বা মীমকে ভাইরাল বানিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।

আপনি হয়তো ফেক নিউজের ব্যাপারে খুবই, মানে খু-উ-ব-ই সাবধানি। এর থেকেও বিশ্বাসযোগ্য চান? শুনুন সিইও নিক্স সাহেবের বাণী। লিংক: https://youtu.be/mpbeOCKZFfQ

যুক্তরাজ্যের দু’তিনজন সাংবাদিক এই ভিডিওতে সেজেছেন শ্রীলংকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তার সহকারী, যাদের বাসনা সেদেশে রাজনীতি করে সফল হওয়া। সে উসিলা নিয়ে কথা বলতে গেছেন কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কর্মকর্তাদের সাথে, সাথে গোপনে রেকর্ড করেছেন কথোপকথন।

তাতে নিক্স সাহেব উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কিছু উপায়। উপরেরগুলিতো বলেছেনই, তার ওপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে যদি প্রতিপক্ষ খুব ভালো হয় আর তার নোংরামির কোন প্রমাণ না থাকে তাহলে কি করবেন। উত্তরে নিক্স বলছেন যে তারা প্রতিপক্ষের কাছে ভিনদেশী ব্যবসায়ী সেজে যাবেন, দেখাসাক্ষাত করে তাদের আস্থাঅর্জনের পরে কোন বেআইনি সুবিধার বিনিময়ে উৎকোচের প্রস্তাব করবেন। কিংবা উক্রেনীয় সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে যাবেন মিটিংয়ে, সেই জল আরো কিছুদূর, হয়ত বেডরুম পর্যন্ত, গড়াবে। আর গোপন ক্যামেরাতে এসব রেকর্ড করার পরে সেটা জমা থাকবে ইলেকশানের আগের রাতে ফেসবুক বা ইউটিউবে ছাড়ার অপেক্ষায়। জল যদি বেশিদূর নাও গড়ায়, ভিডিও এডিট করে অন্তত নোংরা একটা রূপ দেয়া সম্ভব। এবং সেটুকুই হয়ত সামান্য ভোটের মার্জিনে জেতার জন্য যথেষ্ট। পুতিনের আগের জীবনের কর্মস্থল সোভিয়েত গোয়েন্দাসংস্থা কেজিবি স্নায়ুযুদ্ধের সময় এপন্থার নিশ্ছিদ্র সদ্ব্যবহার করে, একে তাদের ভাষায় বলে কমপ্রোমাত (অনেকের সন্দেহ পুতিন সরকারের কাছে ট্রাম্পের কেলেংকারিময় কমপ্রোমাত আছে)।

ঐ একই আন্ডারকাভার ভিডিওতে ‌অ্যানালিটিকা দাবি করছে যে তারা সফলভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নামে-বেনামে এসব নোংরামির পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। তার মধ্যে তারা বলেছে আমেরিকা, কেনিয়া-নাইজেরিয়ার মত আফ্রিকার দেশ, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, চীন আর পূর্ব ইউরোপের ‌অনুল্লিখিত একটি দেশের কথা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!