ট্রেইল অফ টিয়ারস

আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। ইউরোপীয়রা জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত ১২ শতাংশ, ভারতীয়-চীনা ইত্যাদি সকল এশিয়ান ৫ শতাংশ। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায় আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের অস্তিত্ব, যারা এখন জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম, দোআঁসলা মিলিয়ে মাত্র ৫০ লাখের মত। তাই আজকে এদের ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান নাম দিয়ে আমরা যাদের সবাইকে এক বাক্সে বন্দী করি, তাদের কিন্তু প্রায় ৫০০টি স্বতন্ত্র ট্রাইব আর তারা ৯টি আলাদা পরিবারের ৩০০টি ভাষায় কথা বলে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক রীতিনীতিও সেরকম বৈচিত্রময়। অ্যারিজ়োনার হোপিরা মাতৃতান্ত্রিক, ওকলাহোমার ওসেজরা পুরুষশাসিত। মিডওয়েস্টের প্রেইরি ইন্ডিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর শিকারী গোত্র, আবার নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার আনাসাজ়ি-পুয়েবলোরা কৃষিপ্রধান নগরসভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

এ সকল জাতেরই পিতৃপুরুষ পূর্ব এশিয়া বা সাইবেরিয়ায় বাস করত। ত্রিশ হাজার বছর আগে — বরফযুগের শেষে — তারা শিকার তাড়া করতে করতে বরফাবৃত বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে আলাস্কায় ঢুকে পড়ে। বরফ গলে যাবার পরে প্রশান্ত মহাসাগরের অকূল পাথার তাদেরকে এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর কয়েক হাজার বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। অন্যান্য বিশ্বসভ্যতা, বাণিজ্যপথ, আর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান থেকে আলাদা হয়ে পড়ায় ১৪৯২এ ক্রিস্টোফার কলাম্বাস তাদেরকে পান প্রস্তরযুগীয়, বড়জোর ব্রোঞ্জ প্রযুক্তির পর্যায়ে। এমনকি চাকার ব্যবহারটা পর্যন্ত কেউ জানত না!

দক্ষিণে আজ়তেক, মায়া, ইন্কারা যখন পাথর কেঁটে অতিকায় পিরামিড বানাতে ব্যস্ত, তখন উত্তরের নেটিভ আমেরিকান ট্রাইবগুলি অতটা অগ্রসর ছিল না। তারপরেও তাদের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় ইলিনয়ের ক্যাহোকিয়া, কলোরাডোর মেসা ভের্দে, আর নিউমেক্সিকোর টাওসচাকোর ধ্বংসাবশেষগুলোর মাঝে। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা ষোড়শ শতকে মেক্সিকোতে লোকমুখে শুনেছিল উত্তরের সাতটি স্বর্ণমণ্ডিত নগরীর কথা। সেগুলো খুঁজে বের করতে তারা অভিযানও পাঠিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে এ সকল জনপদ ক্ষয়িষ্ণু।

১৬২১এর হেমন্তে মেফ্লাওয়ার জাহাজে আগত ইংরেজ সেটলার আর তাদের পড়শি ওয়াম্পানোগ ট্রাইব নবান্নের খাবার একসাথে ভাগাভাগি করে খায়। থ্যাংকসগিভিং ঐতিহ্যের সূত্রপাত এখানেই। কথিত আছে ১৬১৪ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে জন স্মিথ বলে এক ইংরেজ সেটলারের প্রেমে পড়ে স্থানীয় ইন্ডিয়ান চীফের মেয়ে পোকাহোন্তাস। আমেরিকার ইতিহাসে নাকি সেই প্রথম ইন্টাররেশিয়াল বিয়ে। তাদের প্রেমকাহিনী নিয়েই অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘পোকাহোন্তাস’ তৈরি করে ডিজ়নি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




অন্যদিকে ইউরোপীয়রা বাজে যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল আমেরিকায়, তা হলো গুটিবসন্তের জীবাণু। পুরনো পৃথিবীর এ রোগের সাথে অপরিচিত নেটিভদের ইম্যুন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে ছিল অকার্যকরী। ফলে মহামারিতে বিপুলসংখ্যক ইন্ডিয়ান মারা যায়।

আমেরিকার গোড়াপত্তনের পরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্বন্ধে মার্কিন প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা ছিল ভাল-খারাপ মিশ্রিত। তাদের হিসাবে নেটিভরা জংলী জাত হলেও নৈতিক মূল্যবোধ টনটনে, আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব তাদেরকে সভ্যতা শেখানো। (ব্যতিক্রমঃ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।)  এ কারণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ট্রাইব, যেমন চেরোকিরা, তাদের আদিভাষা, পোশাক-আষাক, কৃষ্টি ছেড়ে আমেরিকান হতে শুরু করে।

তারপরও যখনই নেটিভদের জমিজমার উপর ইউরোপীয়দের দৃষ্টি পড়েছে, তখনই তারা প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে। চেরোকিদের এলাকায় স্বর্ণ আবিষ্কৃত হলে বাইবেলের এক্সোডাসের ইহুদীদের মত তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে শ’ শ’ মাইল পায়ে দলে চেরোকিদের চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিমের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিতে। যাত্রাপথে খাদ্যাভাবে, ঠান্ডায় মৃত্যুবরণ করেছিল অনেকে। তার উপরে ভিন্নগোষ্ঠীর নেটিভরাও তাদের উপরে আক্রমণ করে। যারা আদিনিবাস ছাড়তে অরাজি ছিল, তাদের সাথেও ইউরোপীয়দের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৮৩০এর দশকের এসব ঘটনা ইতিহাসে পরিচিত ‘ট্রেইল অফ টিয়ারস’ হিসাবে।

গৃহযুদ্ধের পরে শিল্পবিপ্লবের সস্তা প্রডাক্ট মদ্যপানীয় আর আগ্নেয়াস্ত্রও নেটিভদের হাতে আসা শুরু করে। সাদাদের বিরুদ্ধে তো ইন্ডিয়ানরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেই, একে অন্যের বিরুদ্ধেও অপ্রতুল গোচারণভূমি নিয়ে ঝগড়াঝাটিতে লেগে থাকে তারা। ফলে যুদ্ধে, নেশায়-বিষণ্ণতায়, অনাহারে-অপুষ্টিতে নেটিভ আমেরিকান জনসংখ্যা আরো কমতে থাকে।

১৮৯০এ এক মার্কিন সেনাদল সাউথ ডাকোটার উন্ডেড নী ক্রীকের কাছে লাকোটা ইন্ডিয়ানদের একটা গ্রুপকে  তাদের নির্ধারিত রিজ়ারভেশনে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় ভুল বুঝাবুঝি থেকে ঝগড়ার সুত্রপাত হয় আর সৈন্যরা গুলি করে প্রায় তিনশ’ লাকোটাকে মেরে ফেলে। তাদের মধ্যে নারী-শিশু মৃতের সংখ্যা ছিল ২০০। উন্ডেড নী এখন মার্কিন ইতিহাসে সবচে’ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড হিসাবে স্বীকৃত।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ১৯২৪ সালে। সে বছর আমেরিকার সকল আদিবাসীকে জাতিগোষ্ঠীনির্বিশেষে মার্কিন নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার দেয়া হয়। ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত চার্লস কার্টিস ১৯২৯এ রিপাবলিকান পার্টির টিকেটে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট রোজ়ভেল্টের আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচুর নেটিভ আমেরিকান জওয়ান সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিল। সেনাজীবনকে নেটিভরা সেসময়ে সম্মানজনক হিসাবে দেখতো। ২০০২এর উইন্ড-টকারস মুভিটাতে দেখতে পারবেন নাভ়াহো ট্রাইবের নেটিভরা কিভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীকে গোপন সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ করতে সাহায্য করেছিল।

আজ অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকান শহুরে, কিছু থাকে রিজ়ারভেশনে। রিজ়ারভেশনগুলি স্বায়ত্ত্বশাসিত, তাদের ক্ষেত্রে স্টেটের আইন খাঁটে না। তার সুযোগ নিয়ে কিছু রিজ়ারভেশন জুয়া আর টাকা ধারের ব্যবসা বসিয়ে টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলছে। সবসময় সেগুলি যে সৎ ব্যবসা তা নয়। নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার কিছু নেটিভ জীবিকানির্বাহ করে চিত্তাকর্ষক স্যুভনির হস্তশিল্প বানিয়ে। আবার মন্টানা-ডাকোটার অনেক রিজ়ারভেশন আছে, যারা সরকারী অনুদানের উপর নির্ভরশীল। তাদের ভালো স্কুল-কলেজ নেই, বেকারত্ব-মাদকাসক্তির হার অতিরিক্ত।

২০০৯এ ওবামা সরকার নেটিভ আমেরিকানদের ওপর অতীতের দুর্ব্যবহারের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এখন অনেক নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মকে তাদের আদিভাষা-সংস্কৃতি শিখানোর ব্যাপারে সচেতন। ওকলাহোমার চেরোকিদের অঞ্চলে গেলে ইংরেজির পাশাপাশি তাদের ভাষারও রোডসাইন দেখা যায়। মতপ্রকাশ আর সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বাসস্থান আর খাদ্যসংস্থানের নিরাপত্তার জন্যে এখনও অনেক সম্প্রদায়কে সংগ্রাম করতে হয়।

নেটিভ আমেরিকান বংশোদ্ভূত একজনকে আমি চিনি। ইউএস আর্মিতে বহুদিন থাকার পরে সফ্টওয়্যার সেক্টরে চাকরি করে সফল হয়, আর্লি রিটায়ার করে। সে অবশ্য ব্যতিক্রম। নেটিভ আমেরিকানদের মোটে ১৫% স্নাতক ডিগ্রিধারী। তবে বেকারত্বের হার সাদাদের তুলনায় একটু বেশি হলেও এখন আগের তুলনায় বেশি নেটিভ সার্ভিস সেক্টরের পেশায় আসে। কিছু বছর আগেও তারা ট্রাডিশনাল সমাজব্যবস্থা আর জীবনযাত্রা ছেড়ে চাকরীতে খুব একটা আসতো না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়ে নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে খ্রীষ্টান যেমন আছে, সেরকম স্থানীয় একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীও আছে। পেয়োটে বলে এই ধর্মে ওয়াখান থানকা, অর্থাৎ ‘মহান আত্মা’, নামে এক নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। প্রকৃতির জীব-জড় সবকিছু ওয়াখান থানকার আত্মার ধারক, তাই বুনো গাছপালা আর জানোয়ারদের সংরক্ষণ করা পেয়োটে অনুসারীদের ধর্মীয় কর্তব্য। নেটিভ আমেরিকানদের নাচ-গানও মূলত প্রাকৃতিক শক্তি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তাদের প্রসিদ্ধ নাচগুলি হল গোস্ট ডান্সরেইন ডান্সসান ডান্স, প্রভৃতি।

মা’ক্ চি বলে এই গানটির ভাষা অধুনাবিলুপ্ত টুটেলো-সাপোনি। মোহক-বংশোদ্ভূত রোবি রবার্টসন কানাডার মূলধারার স্বনামধন্য শিল্পী। আর মার্কিন ইউলালি ব্যান্ডটার সদস্যরাও ইন্ডিয়ান ঐতিহ্যের। নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা গানটির বিষয়বস্তু। উত্তরপ্রজন্মকে সাহস যোগাতে তাদের আত্মা ফিরে ফিরে আসে, যেন নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধে তারা অটল থাকে, যেন তারা ভুলে না যায় আত্মপরিচয় আর স্বজাতির শিকড়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!