থ্যাংকসগিভিংয়ের মার্কিন ঐতিহ্য

Featured Video Play Icon

আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হবে থ়্যাংকসগিভ়িং নামে রাষ্ট্রীয় ছুটি। প্রতি নভ়েম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার এ দিবস পালিত হয়। পরেরদিন শুক্রবারও অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। শুধু ব্যস্ত থাকে শপিং মল। ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত এ দিনে দোকানপাটে আপনি পাবেন বছরের সবচে’ বড় ছাড়। বিশেষ করে যারা দামী ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী কিনতে চান, তাদের তো পোয়াবারো! অনেক শহরে রঙচঙে ফ্লোট বা সজ্জিত ভেলাসহকারে মার্চিং ব্যান্ডের তালে তালে বেসামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচে’ নামকরা হলো নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে মেইসিজ় বলে চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের আয়োজিত মেইসিজ় থ়্যাংকসগিভ়িং প্যারেইড

মার্কিনদের জন্যে বড়দিনের মত থ়্যাংকসগিভ়িংও পারিবারিক পুনর্মিলনীর একটা বড় সুযোগ। মায়ের তৈরি (বা পছন্দ করে কেনা!) ক্র্যানবেরি সস, ম্যাশড পটেটো, গ্রেভ়ি, স্প্রাউটস, সুইট কর্ন, গ্রীনবীন ক্যাসরোল, পামকিন পাই আর ঐতিহ্যবাহী স্টাফ়ড টার্কী খেতে ছেলে-মেয়েরা দূরদূরান্তের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তাই এয়ারপোর্ট-হাইওয়েগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মানুরাগী পরিবারদের থ়্যাংকসগিভ়িং ডিনার শুরু হয় ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের ‘গ্রেইস’ প্রার্থনার মাধ্যমে। খাবার পর রাতে সবাই বের হয়ে পড়ে, দোকানপাটের লাইনে দাঁড়িয়ে যায় ‘ডোরবাস্টার ডীল’ ধরার লোভে!

ক’দিন আগে বলছিলাম যে অক্টোবর শেষের হ্যালোউইন আসলে একটি নবান্ন উৎসব বা হারভ়েস্ট ফ়েস্টিভ্যাল। থ়্যাংকসগিভ়িংএর মূলও নবান্নের মধ্যেই! কিভাবে বুঝিয়ে বলি।

চারশ’ বছর আগে, ১৬২০ সালে, মেফ্লাওয়ার নামক এক জাহাজে করে প্রায় একশ’ ‘পিলগ্রিম’ নারী-পুরুষ-শিশু ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পিলগ্রিমরা ছিল ক্যালভ়িনিস্ট প্রটেস্ট্যান্ট খ্রীষ্টানদের একটি গোত্র — এরা ক্যাথলিকদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস তো মানতই না, এমনকি ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট অ্যাংলিকান চার্চের আনুষ্ঠানিকতাতেও তাদের আপত্তি ছিল। নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীন চর্চার লক্ষ্যে তারা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে।

আমেরিকার দক্ষিণে আরামদায়ক ভার্জিনিয়া কলোনিতে যাবার কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারা উত্তরপূর্বের বর্তমান ম্যাসাচুসেটস স্টেটের প্লিমথে নোঙর ফেলতে বাধ্য হয়। যথেষ্ট খাবার মজুদ তাদের ছিল না, আর শীতের সময় বুনো ফলমূলেরও অভাব ছিল। ফলে ঠান্ডায়-অপুষ্টিতে দলটির সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর প্রায় অর্ধেক মারা যায়।

পিলগ্রিমদের নতুন পড়শী ওয়াম্পানোগ ট্রাইবের নেটিভ় আমেরিকানদের সাথে প্রথম প্রথম কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত দু’দলের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিষ্পত্তি হয়। ওয়াম্পানোগরা তাদের মজুদ ভান্ডার থেকে ভুট্টা, শিকারকরা পশুর মাংস, ইত্যাদি দিয়ে পিলগ্রিমদের সাহায্য করে।

শীত শেষে পিলগ্রিমরা নেটিভ়দের কাছ থেকে স্থানীয় জীবনযাত্রার শিক্ষাগুলি নিয়ে চাষাবাদ করে আর তাদের ফসলের ভালো ফলন হয়। সে এলাকায় টার্কী আর বুনো মুরগীর মত পাখিরও প্রাচুর্য ছিল। নবান্নে তাই পিলগ্রিমরা ওয়াম্পানোগদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। আর তাদের কাছ থেকে শীতের সময় নেয়া খাবারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়।

তিনদিনব্যাপী সেই মহাভোঁজে ওয়াম্পানোগরাও হরিণ শিকার করে নিয়ে আসে। ৯০জন নেটিভ় আর ৫০জন পিলগ্রিম মিলে সব খাবার ভাগাভাগি করে খায়। রান্নার দায়িত্বে ছিলেন পিলগ্রিমদের দলের চার মহিলা। ইতিহাসবিদদের ধারণা এ ভোঁজটি হয় ১৬২১এর অক্টোবরের শেষে, মানে হ্যালোউইনের ধারকাছ দিয়ে। অবশ্য পিলগ্রিমরা হ্যালোউইন-ক্রীসমাসের আনুষ্ঠানিকতা মানতো না।

প্লিমথে বসতির গোড়াপত্তনের পরে প্রায় নিয়মিত এই বাৎসরিক ভোঁজ আয়োজন করা হত, তারিখটা স্থির ছিল না। বিশেষ করে ১৬২৩এ খরার কারণে পিলগ্রিমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা খোদার কাছে প্রার্থনা করে, রোজা রাখে। তারপর ‘অলৌকিকভাবে’ দু’সপ্তাহ টানা বৃষ্টি হওয়ায় তাদের ফলন বিপন্মুক্ত হয়। সেবার তাদের থ়্যাংকসগিভ়িং ভোঁজ তাই ছিল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

এরপর শতবছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে পিলগ্রিমদের উত্তরসূরীরা থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। ১৭৭৭এ আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে হবু রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন একে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী সরকারী ছুটির স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফ়ারসন অবশ্য রাষ্ট্রীয় আর ধর্মীয় বিধানের পৃথকীকরণের যুক্তিতে থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ছুটি ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। পাকাপোক্তভাবে ছুটিটি আবার চালু করেন এব্রাহাম লিংকন।

তারিখটা নিয়ে অবশ্য একটু শোরগোল তুলেছিলেন ফ্র্যাংকলিন রোজ়াভ়েল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি নভ়েম্বরের শেষ পঞ্চম বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে চতুর্থ বৃহস্পতিবার (এ বছরের মত!) ছুটি ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যাতে ক্রীসমাস শপিংয়ের জন্যে একটা সপ্তাহ বেশি পাওয়া যায় — তাতে বিক্রিবাট্টা বেড়ে যদি গ্রেট ডিপ্রেশনের মন্দার অর্থনীতিটা একটু চাঙা হয়। এ ব্যাপারটা অনেক রিপাবলিকান মানতে পারেনি। পরে কংগ্রেস আইন করে চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছুটির দিন স্থির করে দেয়।

থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের সাথে মার্কিনদের দানশীলতার একটা ঐতিহ্যও জড়িত। ক্রীসমাসের একমাস আগে থেকে সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান মাঠে নেমে পড়ে তহবিল সংগ্রহের জন্যে। ছুটির আমেজে সাধারণ মানুষও থাকে দরাজদিল। শপিং করে মল থেকে বেরুনোর পথে ঘন্টি-বাজানো অর্থসংগ্রহকারীর সাজানো বালতিতে দু’-চার ডলার ফেলে দিতে কসুর করে না অনেকে — হোক সে অসুস্থ-অনাথ শিশুদের হাসপাতালের জন্যে, কিংবা যুদ্ধাহত অথর্ব সৈনিকের কল্যাণার্থে , অথবা হয়ত গৃহহীন মানুষের খাদ্যসংস্থানের ফ়ুড ড্রাইভ়ের জন্যে।

অনেক নেটিভ় আমেরিকান কলাম্বাস ডে’র মত থ়্যাংকসগিভ়িংকেও মনে করে তাদের জাতির ওপর অত্যাচারের ইতিহাসের অবমাননা হিসাবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, নেটিভ়দের ওপর গতানুগতিক নিষ্পেষণ তুলনামূলক অধুনার ঘটনা — ঊনবিংশ শতকের প্রায় পুরোভাগ জুড়ে। আর সেসময়টাতে নেটিভ়দের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা ছিল বিভক্ত, অসংগঠিত — যার সুযোগ নেয় শ্বেতাঙ্গ র‍্যাঞ্চার, কাউবয় আর আউটল’রা। কিন্তু তারও আগে নেটিভ়রা ব্রিটিশ-ফরাসী-আমেরিকান সব পক্ষে তাদের সমকক্ষ হয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পিলগ্রিমদের সাথে ওয়াম্পানোগদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনই নেটিভ়দের অন্য ট্রাইব কর্তৃক ভার্জিনিয়াতে সেটলারদের পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও ইতিহাস আছে। আর যদি ইউরোপীয়রা তাদের জমি চুরিই করে থাকে, তাহলে তো আমাদের আর্য-আরব-পারসিক পূর্বপুরুষরাও ইউরোপীয়দের মতই জবরদখলকারী — যাঁরা বাংলার সাঁওতাল, অস্ট্রোনেশিয়ান আদিবাসীদের আবাসভূমি বেদখল করেছিলেন — কতটুকু ছলে-বলে-কৌশলে সে কারো মনে নেই, কারণ সে ঘটনা ‌অধুনার নয়। বর্তমানের মূল্যবোধ দিয়ে অতীতের ‘অপরাধের’ বিচার করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আর নেটিভ় আমেরিকানদের বর্তমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সাড়ম্বরে থ়্যাংকসগিভ়িং উদযাপন করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডেকে অফিসিয়ালি কিন্তু ডাকা হয় নেটিভ় আমেরিকান হেরিটেজ ডে’ নামে।

শেষ করি এই লেখার জুড়ি গানটা নিয়ে কিছু কথা বলে। গানটা আইরিশ গেলিক ভাষায়, গেয়েছেন ময়রা ব্রেনান, প্রখ্যাত নিউ এইজ শিল্পী এনিয়ার বোন। এটি কিন্তু বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অফ় সামসের একটি সাম বা প্রার্থনাগীতি — ক্যাথলিকরা মাসের সময় এরকম গান গেয়ে খোদার প্রশংসাকীর্তন করে। বেশির ভাগ প্রটেস্ট্যান্টরা অবশ্য মাস পালন করে না, কিন্তু পিলগ্রিমরা মাস না করলেও সামগীতি গাইত বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এখনও থ়্যাংকসগিভ়িং থ়ার্সডে’র আগের বা পরের রোববার মার্কিনের চার্চগুলিতে বিশেষ থ়্যাংকসগিভ়িং প্রার্থনা হয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করলেও থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের প্রার্থনার মূল লক্ষ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

আমার কাছে ময়রা ব্রেনানের থ়্যাংকসগিভ়িং সামের সুর ও কথা দু’টিই খুব হৃদয়ছোঁয়া মনে হয়। প্রার্থনাকারীরা বলছেন: “ঈশ্বর, আমাদের করুণা করুন, আশীর্বাদ দিন।। পৃথিবীর সকল জাতি গাইছে আপনার প্রশস্তি।। সকল গোত্রের ন্যায়বিচারক, পথপ্রদর্শক আপনি।। এ ভূমির ফলন্ত ফসল আপনার আশীর্বাদ।। সকল দেশের মানুষের সকল প্রশংসা আপনার।।” সোজা আরবীতে: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বুল আলামীন, আর্ রাহমানির রাহীম — কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফ়াত়িহ়ার প্রথম দু’টি পংক্তি!

ট্রেইল অফ টিয়ারস

Featured Video Play Icon
আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। ইউরোপীয়রা জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত ১২ শতাংশ, ভারতীয়-চীনা ইত্যাদি সকল এশিয়ান ৫ শতাংশ। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায় আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের অস্তিত্ব, যারা এখন জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম, দোআঁসলা মিলিয়ে মাত্র ৫০ লাখের মত। তাই আজকে এদের ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান নাম দিয়ে আমরা যাদের সবাইকে এক বাক্সে বন্দী করি, তাদের কিন্তু প্রায় ৫০০টি স্বতন্ত্র ট্রাইব আর তারা ৯টি আলাদা পরিবারের ৩০০টি ভাষায় কথা বলে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক রীতিনীতিও সেরকম বৈচিত্রময়। অ্যারিজ়োনার হোপিরা মাতৃতান্ত্রিক, ওকলাহোমার ওসেজরা পুরুষশাসিত। মিডওয়েস্টের প্রেইরি ইন্ডিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর শিকারী গোত্র, আবার নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার আনাসাজ়ি-পুয়েবলোরা কৃষিপ্রধান নগরসভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

এ সকল জাতেরই পিতৃপুরুষ পূর্ব এশিয়া বা সাইবেরিয়ায় বাস করত। ত্রিশ হাজার বছর আগে — বরফযুগের শেষে — তারা শিকার তাড়া করতে করতে বরফাবৃত বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে আলাস্কায় ঢুকে পড়ে। বরফ গলে যাবার পরে প্রশান্ত মহাসাগরের অকূল পাথার তাদেরকে এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর কয়েক হাজার বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। অন্যান্য বিশ্বসভ্যতা, বাণিজ্যপথ, আর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান থেকে আলাদা হয়ে পড়ায় ১৪৯২এ ক্রিস্টোফার কলাম্বাস তাদেরকে পান প্রস্তরযুগীয়, বড়জোর ব্রোঞ্জ প্রযুক্তির পর্যায়ে। এমনকি চাকার ব্যবহারটা পর্যন্ত কেউ জানত না!

দক্ষিণে আজ়তেক, মায়া, ইন্কারা যখন পাথর কেঁটে অতিকায় পিরামিড বানাতে ব্যস্ত, তখন উত্তরের নেটিভ আমেরিকান ট্রাইবগুলি অতটা অগ্রসর ছিল না। তারপরেও তাদের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় ইলিনয়ের ক্যাহোকিয়া, কলোরাডোর মেসা ভের্দে, আর নিউমেক্সিকোর টাওসচাকোর ধ্বংসাবশেষগুলোর মাঝে। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা ষোড়শ শতকে মেক্সিকোতে লোকমুখে শুনেছিল উত্তরের সাতটি স্বর্ণমণ্ডিত নগরীর কথা। সেগুলো খুঁজে বের করতে তারা অভিযানও পাঠিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে এ সকল জনপদ ক্ষয়িষ্ণু।

১৬২১এর হেমন্তে মেফ্লাওয়ার জাহাজে আগত ইংরেজ সেটলার আর তাদের পড়শি ওয়াম্পানোগ ট্রাইব নবান্নের খাবার একসাথে ভাগাভাগি করে খায়। থ্যাংকসগিভিং ঐতিহ্যের সূত্রপাত এখানেই। কথিত আছে ১৬১৪ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে জন স্মিথ বলে এক ইংরেজ সেটলারের প্রেমে পড়ে স্থানীয় ইন্ডিয়ান চীফের মেয়ে পোকাহোন্তাস। আমেরিকার ইতিহাসে নাকি সেই প্রথম ইন্টাররেশিয়াল বিয়ে। তাদের প্রেমকাহিনী নিয়েই অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘পোকাহোন্তাস’ তৈরি করে ডিজ়নি।

অন্যদিকে ইউরোপীয়রা বাজে যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল আমেরিকায়, তা হলো গুটিবসন্তের জীবাণু। পুরনো পৃথিবীর এ রোগের সাথে অপরিচিত নেটিভদের ইম্যুন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে ছিল অকার্যকরী। ফলে মহামারিতে বিপুলসংখ্যক ইন্ডিয়ান মারা যায়।

আমেরিকার গোড়াপত্তনের পরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্বন্ধে মার্কিন প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা ছিল ভাল-খারাপ মিশ্রিত। তাদের হিসাবে নেটিভরা জংলী জাত হলেও নৈতিক মূল্যবোধ টনটনে, আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব তাদেরকে সভ্যতা শেখানো। (ব্যতিক্রমঃ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।)  এ কারণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ট্রাইব, যেমন চেরোকিরা, তাদের আদিভাষা, পোশাক-আষাক, কৃষ্টি ছেড়ে আমেরিকান হতে শুরু করে।

তারপরও যখনই নেটিভদের জমিজমার উপর ইউরোপীয়দের দৃষ্টি পড়েছে, তখনই তারা প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে। চেরোকিদের এলাকায় স্বর্ণ আবিষ্কৃত হলে বাইবেলের এক্সোডাসের ইহুদীদের মত তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে শ’ শ’ মাইল পায়ে দলে চেরোকিদের চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিমের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিতে। যাত্রাপথে খাদ্যাভাবে, ঠান্ডায় মৃত্যুবরণ করেছিল অনেকে। তার উপরে ভিন্নগোষ্ঠীর নেটিভরাও তাদের উপরে আক্রমণ করে। যারা আদিনিবাস ছাড়তে অরাজি ছিল, তাদের সাথেও ইউরোপীয়দের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৮৩০এর দশকের এসব ঘটনা ইতিহাসে পরিচিত ‘ট্রেইল অফ টিয়ারস’ হিসাবে।

গৃহযুদ্ধের পরে শিল্পবিপ্লবের সস্তা প্রডাক্ট মদ্যপানীয় আর আগ্নেয়াস্ত্রও নেটিভদের হাতে আসা শুরু করে। সাদাদের বিরুদ্ধে তো ইন্ডিয়ানরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেই, একে অন্যের বিরুদ্ধেও অপ্রতুল গোচারণভূমি নিয়ে ঝগড়াঝাটিতে লেগে থাকে তারা। ফলে যুদ্ধে, নেশায়-বিষণ্ণতায়, অনাহারে-অপুষ্টিতে নেটিভ আমেরিকান জনসংখ্যা আরো কমতে থাকে।

১৮৯০এ এক মার্কিন সেনাদল সাউথ ডাকোটার উন্ডেড নী ক্রীকের কাছে লাকোটা ইন্ডিয়ানদের একটা গ্রুপকে  তাদের নির্ধারিত রিজ়ারভেশনে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় ভুল বুঝাবুঝি থেকে ঝগড়ার সুত্রপাত হয় আর সৈন্যরা গুলি করে প্রায় তিনশ’ লাকোটাকে মেরে ফেলে। তাদের মধ্যে নারী-শিশু মৃতের সংখ্যা ছিল ২০০। উন্ডেড নী এখন মার্কিন ইতিহাসে সবচে’ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড হিসাবে স্বীকৃত।

এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ১৯২৪ সালে। সে বছর আমেরিকার সকল আদিবাসীকে জাতিগোষ্ঠীনির্বিশেষে মার্কিন নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার দেয়া হয়। ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত চার্লস কার্টিস ১৯২৯এ রিপাবলিকান পার্টির টিকেটে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট রোজ়ভেল্টের আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচুর নেটিভ আমেরিকান জওয়ান সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিল। সেনাজীবনকে নেটিভরা সেসময়ে সম্মানজনক হিসাবে দেখতো। ২০০২এর উইন্ড-টকারস মুভিটাতে দেখতে পারবেন নাভ়াহো ট্রাইবের নেটিভরা কিভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীকে গোপন সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ করতে সাহায্য করেছিল।

আজ অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকান শহুরে, কিছু থাকে রিজ়ারভেশনে। রিজ়ারভেশনগুলি স্বায়ত্ত্বশাসিত, তাদের ক্ষেত্রে স্টেটের আইন খাঁটে না। তার সুযোগ নিয়ে কিছু রিজ়ারভেশন জুয়া আর টাকা ধারের ব্যবসা বসিয়ে টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলছে। সবসময় সেগুলি যে সৎ ব্যবসা তা নয়। নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার কিছু নেটিভ জীবিকানির্বাহ করে চিত্তাকর্ষক স্যুভনির হস্তশিল্প বানিয়ে। আবার মন্টানা-ডাকোটার অনেক রিজ়ারভেশন আছে, যারা সরকারী অনুদানের উপর নির্ভরশীল। তাদের ভালো স্কুল-কলেজ নেই, বেকারত্ব-মাদকাসক্তির হার অতিরিক্ত।

২০০৯এ ওবামা সরকার নেটিভ আমেরিকানদের ওপর অতীতের দুর্ব্যবহারের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এখন অনেক নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মকে তাদের আদিভাষা-সংস্কৃতি শিখানোর ব্যাপারে সচেতন। ওকলাহোমার চেরোকিদের অঞ্চলে গেলে ইংরেজির পাশাপাশি তাদের ভাষারও রোডসাইন দেখা যায়। মতপ্রকাশ আর সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বাসস্থান আর খাদ্যসংস্থানের নিরাপত্তার জন্যে এখনও অনেক সম্প্রদায়কে সংগ্রাম করতে হয়।

নেটিভ আমেরিকান বংশোদ্ভূত একজনকে আমি চিনি। ইউএস আর্মিতে বহুদিন থাকার পরে সফ্টওয়্যার সেক্টরে চাকরি করে সফল হয়, আর্লি রিটায়ার করে। সে অবশ্য ব্যতিক্রম। নেটিভ আমেরিকানদের মোটে ১৫% স্নাতক ডিগ্রিধারী। তবে বেকারত্বের হার সাদাদের তুলনায় একটু বেশি হলেও এখন আগের তুলনায় বেশি নেটিভ সার্ভিস সেক্টরের পেশায় আসে। কিছু বছর আগেও তারা ট্রাডিশনাল সমাজব্যবস্থা আর জীবনযাত্রা ছেড়ে চাকরীতে খুব একটা আসতো না।

ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়ে নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে খ্রীষ্টান যেমন আছে, সেরকম স্থানীয় একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীও আছে। পেয়োটে বলে এই ধর্মে ওয়াখান থানকা, অর্থাৎ ‘মহান আত্মা’, নামে এক নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। প্রকৃতির জীব-জড় সবকিছু ওয়াখান থানকার আত্মার ধারক, তাই বুনো গাছপালা আর জানোয়ারদের সংরক্ষণ করা পেয়োটে অনুসারীদের ধর্মীয় কর্তব্য। নেটিভ আমেরিকানদের নাচ-গানও মূলত প্রাকৃতিক শক্তি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তাদের প্রসিদ্ধ নাচগুলি হল গোস্ট ডান্সরেইন ডান্সসান ডান্স, প্রভৃতি।

মা’ক্ চি বলে এই গানটির ভাষা অধুনাবিলুপ্ত টুটেলো-সাপোনি। মোহক-বংশোদ্ভূত রোবি রবার্টসন কানাডার মূলধারার স্বনামধন্য শিল্পী। আর মার্কিন ইউলালি ব্যান্ডটার সদস্যরাও ইন্ডিয়ান ঐতিহ্যের। নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা গানটির বিষয়বস্তু। উত্তরপ্রজন্মকে সাহস যোগাতে তাদের আত্মা ফিরে ফিরে আসে, যেন নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধে তারা অটল থাকে, যেন তারা ভুলে না যায় আত্মপরিচয় আর স্বজাতির শিকড়।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!