গঙ্গা বইছো কেন?

Featured Video Play Icon

 

“বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছো কেন?”

সবার পরিচিত এই গানটা ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন বাংলা ছাড়াও হিন্দী আর অসমীয়াতে (উচ্চারণঃ অহমিয়া)। অনেকেই হয়ত জানেন যে গানের সুরটা আসলে অনেক পুরনো একটা মার্কিন মিউজ়িক্যালের সুর অবলম্বনে।

আসল গানটার নাম “ওল´ ম্যান রিভার” — ওপরের ভার্শনটা “শোবোট” বলে ১৯৩৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। গেয়েছেন সেসময়কার বহুলপ্রতিভাসম্পন্ন আমেরিকান-ফুটবল খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, সামাজিক-রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট পল রোবসন

বহু চড়াই-উৎরাই পার করা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের ছেলে এই বাস ব্যারিটোন শিল্পীর সাথে হাজারিকার দেখা হয় নিউ ইয়র্কে। পঞ্চাশের দশকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূপেন যখন পিএইচডি করছেন, তখন রোবসন সম্ভবত নিউ ইয়র্কের হারলেমের বাসিন্দা। রোবসন বিশের দশকে নিউ জার্সির রাটগারসে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া থেকে এলএলবি পাশ। তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে ছিল ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে। ভূপেনের সাথে যখন তাঁর দেখা হয়, তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় আর প্রকাশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিনের প্রশংসা করার কারণে তিনি একঘরে

“শোবোট” চলচ্চিত্রটা ব্রডওয়ে মিউজ়িক্যাল থিয়েটারের একটা নাটক অবলম্বনে তৈরি। নাটকটার কাহিনীও এডনা ফার্বার রচিত একই নামের বেস্টসেলার উপন্যাস থেকে নেয়া। গল্পটা ১৮৮০এর দিককার মিসিসিপি নদীর ভ্রাম্যমান জাহাজ-থিয়েটার নিয়ে, যাকে সবাই চিনত শোবোট হিসাবে। অনেকটা আমাদের দেশের ভ্রাম্যমাণ সার্কাস বা যাত্রাদলের মত এরা মিসিসিপি ধরে সারা বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিড-ওয়েস্ট আর সাউথের মধ্যে আপ-ডাউন করত। গ্রামে-গঞ্জে মুভি থিয়েটার গজিয়ে উঠেনি তখনও। নদীতীরের কোন গ্রামে একটা শোবোট আসলে তাই সাড়া পড়ে যেত, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলে ছুটে আসত মজা দেখতে।

সেই কাহিনীর একটা চরিত্র জো, তাকে এই দৃশ্যে রূপ দিয়েছেন পল রোবসন। সে শোবোটের কুলি। জাহাজে যতরকম সাপ্লাই লাগে, সেসব ভারি ভারি জিনিসপত্র কূল থেকে নিয়ে আসতে হয় তাকেই। এখানে সে গান ধরেছে মিসিসিপি নদকে উদ্দেশ্য করে। লিংকনের ১৮৬৩এর ইম্যানসিপেশন প্রক্ল্যামেশনের পরেও তার মত কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে মুক্তি নেই। জমি-জমা নেই, ভোটাধিকার নেই, নেই শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরির গ্যারান্টি। সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সাদাদের থেকে অনেক বেশি হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি করতে হয়। জো তাই মিসিসিপি নদকে একরকম আদর করেই বকছে ওল’ ম্যান বলে, কারণ হাজার বছর ধরে সে বুড়ো বয়েই চলেছে, কোনদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে জানে অনেক কিছুই, কিন্তু মুখটি খুলবে না!

আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তরের ইউনিয়নের সেনাবাহিনী দক্ষিণের বিদ্রোহী কনফ়েডারেটদের বিরুদ্ধে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জিতেছিল। দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক উচ্ছেদও করেছিলেন লিংকন। কিন্তু সে বিজয়ের মূল্যবোধটাকে ধরে রাখা বোধ হয় যুদ্ধে জেতার থেকে বেশি কঠিন ছিল।

যু্দ্ধের পরে রাজনৈতিক একতার খাতিরে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্রাটদের সাথে আপোসরফার ভিত্তিতে সংস্কার করতে চাইলেন। আর সেসবের একটা ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকাররোধ। তার ওপরে দক্ষিণের স্টেটগুলির ডেমোক্রাট সরকার ব্ল্যাক কোডস বলে বর্ণবাদী আইন প্রণয়নের কারণে র‍্যাডিক্যাল রিপাবলিকানরা গেল খেপে। ১৮৬৮এর নির্বাচনে জেতার পরে তারা ফ়েডারেল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে একরকম মার্শাল ল’ জারি করলো দক্ষিণের স্টেটগুলোতে। সেখানে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, মুক্ত ক্রীতদাস, দক্ষিণের কিছু রিপাবলিকান সমর্থক আর দক্ষিণাদের কাছে কার্পেটব্যাগার নামে কুখ্যাত উত্তর থেকে আসা সুযোগসন্ধানীরা একত্র হয়। তারা স্টেট পর্যায়ে রাজনৈতিক আর শিক্ষা অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদারনৈতিক সংস্কার করে। এই সংস্কার ইতিহাসে পরিচিত ‘রিকনস্ট্রাকশন’ নামে।

কিন্তু একে সাদার্ন ডেমোক্রাট আর তাদের সমর্থিত বর্ণবাদী গুপ্তসংস্থা কু ক্লাক্স ক্লান সেকেলে সাদার্ন সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসাবে চিত্রায়িত করে। তারা রিপাবলিকান আর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা আর গুপ্তহত্যা শুরু করে। এদের মোক্ষম সুযোগ আসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের দ্বিতীয় টার্মের শেষে। ১৮৭৬এর নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ ভোটচুরি করে আর কালোদেরকে ভয় দেখিয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখে তারা। সেভাবে এরা স্টেট সরকারগুলির দখল নেয়, আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রাদারফ়োর্ড হেইজ়কে প্রায় হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট পদের বিনিময়ে কমপ্রমাইজ়স্বরূপ রিপাবলিকানরা দক্ষিণের শেষ তিনটা স্টেট থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে। রিকনস্ট্রাকশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর সাদার্ন ডেমোক্রাট সরকারদের শাসনে কালোদের অবস্থা আবার যেমনকার তেমন, শুধু দাসত্বশৃংখল বাদে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলিতে নতুন আইনকানুন জারি হল যাদের বলে ‘জিম ক্রো ল’জ়’। সেগুলির মূল লক্ষ্য ছিল কালোদের (আর আইনী ভাষায়, কিছু গরীব সাদাদেরও!) ‘সমান কিন্তু আলাদা’ বন্দোবস্ত রাখা। সোজা কথায় বর্ণবিভেদ বা সেগ্রেগেশন!

গৃহযু্দ্ধের পরপরই কালোদের যেটা দরকার ছিল সেটা হলো, ক্রীতদাস থেকে যাতে তারা শেয়ারক্রপার ভূমিদাস না হয়ে যায় তার জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য। লিংকন তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁকে মেরে ফেলে জন উইল্কস বুথ। আর সদ্য-নিঃস্ব শ্বেতাঙ্গ তুলাচাষীদেরও দরকার ছিল ফ্রী মার্কেট লেবারের কিছুটা গ্যারান্টি। কিন্তু সবকিছু রাজনীতির প্যাঁচে ওলট-পালট হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো সাত-আট দশক

শোবোট ছবিটাতে আরো অনন্য কিছু ব্যাপার দেখবেন, যেমন ১৮৮০র দিকে সাদা-কালো মিশ্র বিয়ের ব্যাপারটা কিভাবে দেখা হত। ছবিটি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা শতবর্ষের সেরা একশো মার্কিন ফিল্মের তালিকায় প্রায় প্রতিবছরই থাকে।

আমেরিকার মিসিসিপি থেকে বাংলার গঙ্গা — গণমানুষের গায়ক হিসাবে ভূপেন হাজারিকা  একটা চমৎকার দেশ-কালাতিক্রমী  সমান্তরাল গান-সুর নিয়ে এসে উপহার দিয়েছেন আমাদেরকে। ৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধা তাঁর আর তাঁর প্রতিভাবান বন্ধুর প্রতি!

স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার উন্মুক্ত…

Featured Video Play Icon

ইজ়রায়েলের সর্বকালের সবচে’ জনপ্রিয় শিল্পী ওফ়রা হাজ়া গাইছেন এই গানটা। ১৯৭৮এর টিভি সম্প্রচারের ভিডিও এটা। গানটার ১৯৮৪এর ভার্শন পরে ইউরোপ-আমেরিকার চার্টে প্রথম স্থানে ছিল। এই রেকর্ডিংএর সময় ওফ়রা ২১ বছরের তরুণী, কিন্তু ১৯ বছরেই তিনি খ্যাতি কুড়নো শুরু করেন। পরে ইজ়রায়েলের হয়ে ইউরোভিশন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেন। যেসব বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে একসাথে গান করেছেন, তাদের মধ্যে নুসরাত ফতেহ আলী খানও আছেন।

ওফ়রা হাজ়ার ছোটবেলা কেটেছিল তেল আবিবের হাতিকভ়া নামের এক বস্তিতে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ইয়েমেন থেকে আসা কপর্দকশূন্য রেফ্যুজি। সপ্তদশ শতকের ইয়েমেনী কবি সালাম শাবাজ়ির লেখা কবিতায় সুর করা এই গানটা গাইছেন হাতিকভ়ার মিউজ়িক ওয়ার্কশপের সাথে। দলটা তৈরি হয়েছিল তাঁদের মহল্লার গরীব ছেলেমেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুযোগ দেয়ার জন্য।

লঘুচিত্তে গাওয়া এই গানটার বিষয়বস্তু নির্ধনের প্রতি স্রষ্টার মমতার গুণকীর্তন। “যদি ন্যায়পরায়ণের দানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তবে মনে রেখো স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত।” আর খোদার কাছে অনুনয় করা হচ্ছে তাঁকে ‘এল হা’ঈ’ নামে ডেকে, যেটা মুসলিমদের কাছেও স্রষ্টার নিরানব্বই নামের একটা। সপ্তদশ শতকে মধ্যমপন্থী সুন্নি ওসমানী তুর্কীদের সাহায্য করার সন্দেহে ইয়েমেনের জ়াইদী শিয়া বংশীয় ইমাম বা শাসক শাবাজ়ি আর তাঁর ইয়েমেনী ইহুদী গোত্রকে মাওজ়া বলে এক মরুএলাকায় নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তাদের এক-পঞ্চমাংশ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। স্বগোত্রকে সাহস আর আশা যোগানোর জন্যে শাবাজ়ির এ কাব্য রচনা।

গরীবের প্রতি যেমন ইসলামে জ়াকাত দেয়া কর্তব্য, ইহুদী ধর্মেও সেরকমটা আছে। ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের আয়ের এক-দশমাংশ দান-খয়রাতে দিয়ে দেবার নিয়ম কোন কোন তরিকায়। হিব্রু ভাষায় এই বাধ্যতামূলক নিয়মকে বলে স়দাকা, যেটা ইসলামে ঐচ্ছিক দানক্রিয়ারও নাম। ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম মনীষী ইহুদী ধর্মসংস্কারক মুসা বিন মাইমুনের তরিকায় আট শ্রেণীর মধ্যে প্রথম সারির স়দাকা হলো, সত্যিকারের অভাবী কাউকে অনুদান বা সুদহীন ঋণ দেয়া, বিশেষ করে যদি সে অর্থটাকে নিজের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের কাজে লাগায়। আর তাঁর নিয়মাবলীতে ধনী-গরীব সবারই কিছু পরিমাণ দান-খয়রাত করা বাধ্যতামূলক।

বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্রতাকে দেখা হয় স্বর্গীয় গুণ হিসাবে। যে কারণে সন্ন্যাসব্রত নেয়ার একটা ঐতিহ্য তাদের আছে। ইহুদীধর্মে তেমনটা নেই। গরীবদের দয়া করার কথা বলা হলেও ধর্মীয়ভাবে ছোটবেলা থেকে ইহুদীদের এটাই শেখানো হয় যে স্বেচ্ছায় দরিদ্র-পরনির্ভর হওয়া অবাঞ্ছনীয়, সবার উচিত নিজের সাধ্যমত কারিগরি কাজ শিখে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি করা। কারণ আব্রাহাম, জেকব, সলোমন, আইজ়্যাক — ইহুদী ঐতিহ্যে এ সকল নবীই স্বনির্ভর ছিলেন। হয়ত এই মানসিকতার কারণেই পৃথিবীর ইহুদী জনসংখ্যার একটা বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।

সুদখোর ইহুদীর যে স্টেরেওটাইপটা সুপরিচিত, সেটা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত, আর সেটা মুসলিম বিশ্ব নয়, এসেছে পশ্চিমাবিশ্ব থেকে — শেক্সপীয়ারের শাইলক দ্রষ্টব্য। ধনী ইহুদীদের মধ্যে রথ্সচাইল্ড পরিবার সুপরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন রকাফেলার, কার্নেগী, জেপি মর্গান, এরাও ইহুদী ছিলেন — সে ধারণা ভুল। আর দারিদ্র্য থেকে ইহুদীরাও মুক্ত নয়। আল্ট্রা-কনজ়ার্ভেটিভ ইহুদী ‌অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক স্টেটের কিরিয়াস জোয়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে’ গরীব শহর।

ইয়েমেনে ইহুদীদের বসবাস ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে, তারা ঈশ্বরকে ডাকত রহমান নামে, তাদের ধর্মীয় আচারব্যবস্থাও ছিল অন্য এলাকার ইহুদীদের থেকে স্বতন্ত্র। তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দ থেকে ষষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রীষ্টান বিজ়্যান্টাইন সাম্রাজ্য আর আহুরা-মাজ়দার উপাসক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্যের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে, তাতে ইয়েমেনের খ্রীষ্টান আরব আর ইহুদীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে। জ়ু নুওয়াস বলে ইয়েমেনের হিমইয়ার রাজ্যের এক ইহুদী রাজা ইসলামের আবির্ভাবের একশ’ বছর আগে খ্রীষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালান। তাদেরকে ইহুদীধর্মগ্রহণ অথবা মৃত্যু বেছে নিতে বাধ্য করেন, আর যারা ধর্মান্তরিত হয়নি, তাদেরকে চার্চের মধ্যে আটকে রেখে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। সে অত্যাচার থেকে খ্রীষ্টানরা রক্ষা পায় আবিসিনিয়ার খ্রীষ্টান আক্সুম সাম্রাজ্যের সামরিক হস্তক্ষেপে। কিন্তু সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইয়েমেনী ইহুদীদের করতে হয়েছে অধুনাকাল পর্যন্ত।

এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামে ইহুদীদের স্বাধিকার দেবার বিরুদ্ধে কোন নিয়ম নেই। খ্রীষ্টানদের মত তাদেরকে ‘আহলাল কিতাব’ বা খোদাপ্রদত্ত পুস্তকের অনুসারী হিসাবে যথোপযুক্ত ধর্মীয় অধিকার দেয়া আর তাদের সম্পত্তি রক্ষার কথা বলা আছে। হিজরতের পরে মদিনাসনদ বলে একটা চুক্তিনামায় সকলপক্ষের সহমতে এ সকল গ্যারান্টি দেয়া হয়। তাতে একটা রাষ্ট্রেরও গঠনতন্ত্র রূপ পায়, যার সকল সদস্যকে ধর্মগোত্রনির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট অধিকার দেয়া হয়। পরে চুক্তিভঙ্গের কারণে তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্রকে তখনকার সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হয়। তারপরেও অন্যান্য ইহুদীগোত্র মদিনায় মুসলিমদের সাথে দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল পর্যন্ত সহাবস্থান করেছে। অন্যধর্মাবলম্বীদের মত জিজ়িয়া কর তাদের দিতে হত, কিন্তু মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জ়াকাত কর তাদের জন্যে ছিল মওকুফ।

হাজার বছরের বেশি ধরে মুসলিম-ইহুদীরা একসাথে বসবাস করেছে, এটাই স্বাভাবিক যে সে ইতিহাস মিশ্র। মুসলিম রাজ্যগুলি তাদের ইহুদী প্রজাদের সাথে কিরকম আচরণ করেছে, সেটা নির্ভর করে কোন গোত্র-বংশ-ধর্মীয় গ্রুপ ক্ষমতায় ছিল তার ওপর। স্পেনের গ্রানাদাতে একবার যেমন ইহুদীদের ওপর গণহত্যা চলেছে, আবার সেরকমই কোন দূরদর্শী রাজা সেখানে তাদেরকে মুসলিমদের সমান অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগে নিঃসন্দেহে ইউরোপের খ্রীষ্টান রাজ্যগুলির থেকে মুসলিম রাজ্যে ইহুদীরা নিরাপত্তা বেশি পেত। ওসমানী সাম্রাজ্যেও ইহুদীরা যথেষ্ট ইন্টেগ্রেটেড ছিল, শাসন আর করব্যবস্থায় তাদের অনেক অবদান ছিল।

এখন আবারও মুসলিম সমাজ একটা ইহুদীবিদ্বেষী ফেইজ়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কারণ দু’টো। এক, ঊনবিংশ-বিংশ শতকে ইহুদীবিদ্বেষী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির কলোনিতে ইউরোপীয়দেরই প্রভাবে গুজব-ভুল ধারণার বিস্তার ঘটেছে বেশি। সেটা তুঙ্গে উঠেছিল নাৎসিদের ছড়ানো প্রপ্যাগান্ডার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ইজ়রায়েলের আবির্ভাব, আর তার বিরুদ্ধে আরবদের তিনটা যুদ্ধ (খেয়াল করুন, এখনকার ইজ়রায়েলের প্রাণের শত্রু ইরান সেগুলির কোনটাতেই অংশ নেয়নি)। সেই রাজনীতির মধ্যে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে তিরিশ-চল্লিশের দশকে মিশর, লিবিয়া, ইরাক, আর ইয়েমেনে এসবের প্রভাবে কয়েকটি মুসলিম-ইহুদী দাঙ্গা হয়েছে, দু’পক্ষেই বহু ক্ষয়ক্ষতি-মৃত্যু ঘটেছে।

ইয়েমেনে দীর্ঘকালের জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার ইহুদীরা ১৯৪৭এর ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিন বিভাজনের জাতিসংঘ রেজ়োল্যুশনের পরে আরেকবার আক্রান্ত হয়। তাদের ধর্মালয়-বিদ্যালয়-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয় মুসলিম মব্। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বদলে আদেনের মুসলিম পুলিশই লুটতরাজে যোগ দেয়। দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় দু’শ মানুষ প্রাণ হারায়। ‌

অতঃপর শেষবারের মত ইয়েমেনী ইহুদীরা নিঃস্ব হয় ১৯৪৯/৫০এ অপারেশন ম্যাজিক কার্পেটের সময়। সেটা ছিল ইজ়রায়েলের জুয়িশ এজেন্সীর একটা অপারেশন, যার মাধ্যমে এরিত্রিয়া, সাউদি, জিবুতি, ইয়েমেন আর ব্রিটিশ আদেন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে গোপনে আকাশপথে ইজ়রায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এদের বেশিরভাগই দূর-দূরান্ত থেকে স্থাবর সম্পত্তি জমিজমা ছেড়ে আদেনে এসে প্লেনে উঠে পড়ে। তাদের স্থিরচিত্র ইন্টারনেটে আছে, আর সেগুলি দেখে আমার মধ্যে মানবিক সহানুভূতি জাগ্রত হয়, কারণ আমার পিতৃপুরুষও রেফ্যুজি হিসাবে জমিজমা ছেড়ে প্লেনে চড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

ওফ়রা হাজ়ার বাবা-মাও এভাবে ম্যাজিক কার্পেটে করে ইজ়রায়েলে এসে পড়েন। সেখানে পৌঁছে কিন্তু ইয়েমেনী ইহুদীরা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তাদের স্বকীয় ধর্মীয় পরিচয় খুইয়ে বসেছিল, সেটা একটা আয়রনি! এখন মধ্যপ্রাচ্যের তুরস্ক আর ইরানে কয়েক হাজার বাদ দিলে ইজ়রায়েল ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন ইহুদী জনসংখ্যা নেই।

ও আরেকটা ব্যাপার… এই গানটা ১৯৭৮এ গাওয়া। এসময় একটা বড় আশা নিয়ে ইজ়রায়েল-মিশর দু’দেশের মানুষই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ১৯৭৭এ সারা আরব বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাত ইজ়রায়েলে এসে প্রেসিডেন্ট মেনাহিম বেগিনের সাথে দেখা করেন। ১৯৭৮এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিশরকে ইজ়রায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকরা সিনাই উপদ্বীপের বিশাল ভূখন্ড ফেরত দিয়ে দেয় (গাজ়া বাদে)। কিন্তু দু’দেশেরই কট্টরপন্থীরা একে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ফলশ্রুতিতে সাদাতকে ১৯৮১তে নিজের জীবন দিয়ে তার মাশুল দিতে হয়।

এই গানটা ভাল লাগলে একই সময়ে ধারণকৃত  নেশিকোত বায়াম বলে হাজ়ার আরবী-হিব্রু গানটাও শুনে দেখুন! ইম নিন আ’লু গানটার কথা আর অনুবাদ আছে এখানে

স্বদেশে পরদেশী উইগুর

Featured Video Play Icon

আজ যে জাতির সঙ্গীত নিয়ে লিখছি, তারা যে কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত হচ্ছে, এটা মনে হয় বাকি পৃথিবী ভুলে যেতে বসেছে। গানটা যে ‌অ্যালবাম থেকে নেয়া, তার নাম ‘লিসেন টু দ্য ব্যানড’ — এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে যেসব শিল্পীদের গান নিষিদ্ধ, তাদের নিয়ে এটা করা। গানটার ভাষা উইগুর, দুতারনামক বাদ্যযন্ত্রবাদক গায়কের  নাম কুরাশ সুলতান। তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে নির্বাসনে প্রয়াত হয়েছেন।

উইগুররা চীনের উত্তরপশ্চিমের শ়িনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজিয়নের বাসিন্দা। তাদের খবরাখবর বহির্বিশ্বে খুবই কম পাবেন, বিশেষ করে ২০০৯এর হান-উইগুর দাঙ্গার পর। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বাইরে থেকে কোন সাংবাদিক সেখানে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখে, বেশির ভাগ সময় ঢুকতে দেয় না, আবার নেটিভদের সাথে বেশি মেলামেশা করলে তাদেরকে এস্কর্ট করে প্রদেশের বাইরে বের করে দেয়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানকার সত্য খবর রিপোর্ট করে। প্রাদেশিক সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারেরই সাজানো, যতই তারা স্বায়ত্তশাসিত বলে নিজেদের দাবি করুক। এরকম আরো দুটো এলাকা আছে চীনে — তিব্বতকে সবাই চিনে দালাই লামার খাতিরে, আরেকটা নেই মেংগু বা ইনার মংগোলিয়া

উইগুরদের ইতিহাসটাও খুব চমকপ্রদ। এরা আসলে তুর্কী জাতি। তুর্কীরা তুরস্কে ঘাঁটি গাঁড়ার আগে ছিল মোঙ্গলদের পড়শি, আর তাদের মতই গরু-ভেড়া-চড়ানো যাযাবর গোষ্ঠী। মোঙ্গল, তিব্বতী, পারসিক আর চৈনিক রাজ্য দিয়ে চারিদিক ঘেরা তুর্কীরা মোঙ্গলদেরও আগে একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছিল, যার নাম গোকতুর্ক। এরা উপাসনা করত তেংরি বলে এক আকাশদেবতার, মোঙ্গলদের মতই। এদের নয়টি ট্রাইব দোকুজ়-ওগুজ়দের একটা উইগুররা। উইগুরদের তুতো ভাইয়েরা আরো পশ্চিমে গিয়ে সফল সাম্রাজ্য গড়েছে, আর উইগুররা ছিল সিল্ক রোডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকলা-মাকান মরুভূমি আর তিয়ানশান পর্বতমালার রক্ষক। কুবলাই খানের কজ়মোপলিটান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরকারে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য তুর্কী জাতের শত্রুদের বিরুদ্ধে এরা  চীনের প্রতাপশালী সুই সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। বাঙ্গালীদের মত উইগুররাও একেক সময় একেক ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমে অ্যানিমিস্ট থাকলেও, পরে মানিকেয়ান হয়েছে, বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ করেছে, নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টানও ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছে মুসলিম। এখনও অনেক উইগুর ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু প্রাচীন নিয়মকানুনের ছায়া রয়ে গেছে।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার অনুন্নত-বিভক্ত-পশ্চাদপর খানশাসিত ছোট ছোট পারসিক-তুর্কী রাজ্যগুলিকে রাশিয়ার রোমানভ় সাম্রাজ্য আর চীনের চ়িং সাম্রাজ্য একের পর এক দখল করে করদ রাজ্য অথবা উপনিবেশ বানানো শুরু করে। উইগুরদের দেশ এসময় চ়িংদের আয়ত্ত্বে আসে। এসময় করদরাজ্য হিসাবে আর দূরত্বের কারণে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রার উপর চীনাদের প্রভাব খুব কমই ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে চীনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রুশ কম্যুনিস্ট সরকারের প্ররোচনায় ১৯৩৩ আর ১৯৪৪এ দু’বার তারা স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিলেও প্রথমটা কয়েক মাস আর দ্বিতীয়টা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯৪৯এ রুশসমর্থিত দ্বিতীয় স্বাধীন তুর্কেস্তান সরকারের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদেরই ষড়যন্ত্রে প্লেনক্র্যাশে মারা যাওয়ার পর শেষ কম্যুনিস্ট সদস্য মাওৎসেতুংএর কাছে রাজাকারি করে রাজ্য সপে দেয়

এরপর মাওয়ের কালচারাল রেভোল্যুশনের সময় বাকি চীনবাসীদের সাথে সাথে এরাও ভুক্তভোগী হয়েছে। ১৯৪৯এ হানগোষ্ঠীর চীনাদের জনসংখ্যা উইগুরিস্তানে ৬% হলেও সরকারী নীতির কারণে ধীরে ধীরে বেড়ে এখন প্রায় ৪০%। হানরা ব্যবসাবাণিজ্য-চাকরিক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু তারা উইগুরদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে না, সম্মান করে না। স্বভাবতই শ়িনজিয়াং জাতিগত সংঘাতের একটা ঊর্বরক্ষেত্র।

দেং শ়িয়াও পিংএর সংস্কারের আমলে কিছুটা স্বাধিকারচর্চার সুযোগ পেলেও শ়ি জিন পিংএর চাইনিজ় এক্সেপশনালিজ়মের মুখোশপরা চীনা জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসরণের কারণে উইগুররা একটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডারিন না শিখলে তাদের জীবিকা নেই, লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ, মসজিদে অনূর্ধ্ব-আঠারো প্রবেশ নিষেধ, জায়গায়-জায়গায় সারভেইল্যান্স ক্যামেরা বসানো। এমনকি তাদের নিজ দেশের ইতিহাসকেও হানজাতির স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে ইন্জিনিয়ার করা হচ্ছে। অল্প কিছু উইগুর মুক্তির সন্ধানে  কট্টরপন্থী জিহাদী ইসলামে ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ভুলের অজুহাতে পুরো জাতটাকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামলেই তাদের টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘রিএডুকেশন ক্যাম্পে’ নাকি দশ লাখ উইগুর বন্দী, সেখানে নাকি তাদের জোর করে শুকরের মাংস, অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তের ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি। ইলহাম তোহতী বলে এক অর্থনীতিবিদ উইগুর অনলাইন বলে একটা সাদামাটা ওয়েবসাইট চালাতেন, তাঁর সাথে লাদেনকে জড়িয়ে দিয়ে এখন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রেখেছে। আবলাজান আইউব বলে এক অরাজনৈতিক জনপ্রিয় পপ গায়ককেও জুনমাসে লাপাত্তা করে দিয়েছে। দালাই লামার মত উইগুরদেরও স্বেচ্ছানির্বাসিত নেত্রী আছেন যার নাম রাবিয়া কাদির, কয়েকবার শান্তির নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েছেন।

ইউটিউবে উইগুর মিউজ়িক সন্ধান করলে অনেক নাচগান দেখবেন, এদের অধিকাংশই শো, বাইরের মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টা যে উইগুররা সুখেশান্তিতে নাচাগানা করে আছে। কামাল আতাতুর্ক একদিকে যেমন সুফী জিকির অবৈধ করেছিলেন, অন্যদিকে দরবেশদের সুফী ঘূর্ণিনৃত্য সমানে চলেছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে — চীন সরকারের এ প্রয়াস তার থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং আরো ভয়ানক কারণ এভাবে উইগুরদের জাতিগত পরিচয়টাকেই তারা ইনজিনিয়ার করে ফেলছে। সোভিয়েতরাও তাদের অনেক সংখ্যালঘু জনসত্ত্বাকে একইভাবে রিডিফাইন করেছিল।

মুসলিম দেশের সরকারগুলি ফিলিস্তিন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও উইগুরদের নিয়ে রহস্যজনকভাবে মৌন থাকে, সম্ভবত চীনের সাথে খাতিরের সম্পর্ক বজিয়ে চলার জন্যে। তুরস্কে অনেক উইগুর নির্বাসনে থাকলেও তুরস্কের সরকারও চুপচাপ, কথা বললেই কুর্দী-আরমেনিয়ানদের পুরনো কংকাল সিন্দুক থেকে বেরিয়ে নাচানাচি করবে। মার্কিন আর ইউরোপিয়ানরাই কিন্তু বছরের পর বছর তিব্বতী-উইগুরদের স্বাধিকারের পক্ষে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। ২০০৮এ একটা গণসংগ্রামের প্রচেষ্টা হলেও ইন্টারনেটে ইনজিনিয়ারড গুজব ছেড়ে চীনারা টেরোরিজ়মের জুজু দেখিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেসময় বাইরে থেকে বিবৃতির বেশি সাহায্য আসেনি। তাই অনেক তরুণ উইগুর স্বাধিকার-সংস্কৃতি-মানবাধিকার ভুলে কষে ম্যান্ডারিন শিখছে। অতএব আপাতত সিপিসি সফল।

গানের ভিডিওটিতে কিছু দৃশ্য ভায়োলেন্ট, ২০০৯এর উরুমচি শহরের দাঙ্গার যেটুকু পাবলিক ভিডিও রেকর্ড আছে তার কিছুটা। বাকি অংশ আগের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। ইলহাম তোহতীর একটা হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ পাবেন এখানে

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে…

Featured Video Play Icon

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে,
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে!”


রবিঠাকুরের এই গানের সুরের বেসিক গড়নটা, ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের শিক্ষার্থী-কয়েরের গাওয়া, উপরের আইরিশ গানে সামান্য হলেও পাওয়া যায় কিনা, দেখুন তো! তালসুরকানা আমার কানে মনে হচ্ছে দুটোর কোরাসের মীটার কাছাকাছি, তাল-স্কেল আলাদা।


রবীন্দ্রনাথের বহু দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশ আবির্ভূত মমতাময়ী-দুখী মাতা কিংবা সুন্দরী রমণী হিসাবে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতই তার বড় উদাহরণ। রবিঠাকুরের আগে কোন বাঙ্গালী এভাবে স্বদেশকে চিত্রায়িত করলে সেটা সম্ভবত একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র, বন্দে মাতরম কাব্যে। এ ধরনের অ্যালেগরি বা রূপকের আঙ্গিকে উপরের ‘মো গিলা মার’ নামের আইরিশ গ্যালিক ভাষার গানটাও রচিত।


আইরিশ গীতি-কাব্যে এই ধরনের স্বদেশ-রূপকের সাহিত্য পরিচিত ‘আশলিং’ হিসাবে। তাতে কবি নিদ্রাচ্ছন্ন, আর তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হন আয়ারল্যান্ডের স্বদেশদেবী এইরু। দেবী প্রায়শ তরুণী, কখনো জীর্ণশীর্ণ বয়োবৃদ্ধ, তাঁর বসন শতছিন্ন, তিনি কাঁদছেন ইংরেজ প্রটেস্ট্যান্ট শাসনে আইরিশ জাতির দুর্দশা দেখে, কিন্তু আশার বাণী শোনাচ্ছেন যে শীঘ্রই তারা আবার সুদিন দেখবে।


অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা ‘মো গিলা মার’ গানটিও গাচ্ছেন এইরু দেবী, তিনি জর্জরিত তাঁর প্রেমিকের বিরহবেদনায়। তাঁর সুদর্শন বীরপুরুষ, ‘সীজ়ার’ সাতসাগরের ওপারে চলে গেছে। তাই এখন তিনি বিধবার ন্যায় বিলাপরত। আয়ারল্যান্ডে কোকিল আর ডাকে না, সারা দেশের ওপর একটা কালো শোকের ছায়া।


দেবী এইরুর এই বীরপুরুষ কল্পিত নয়, তিনি ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্টবংশীয় ক্যাথলিক রাজকুমার ‘বনি প্রিন্স চার্লি’। ১৬০৩ সালে স্টুয়ার্টবংশ ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে ইংল্যান্ডে চলেছে ক্যাথলিক-অ্যাংলিকান-পিউরিটান ধর্মগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। স্টুয়ার্টরা প্রথমদিকে জনপ্রিয় থাকলেও তাদের ক্যাথলিক-সহমর্মিতাকে দেশের সাধারণ মানুষ আর অভিজাতরা, যারা অ্যাংলিকান খ্রীষ্টান, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। রাষ্ট্রের ক্যাথলিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত আইরিশরা, সেই বিদ্বেষের শিকার ছিল। ইংরেজরা স্টুয়ার্টবংশকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দেয়ার পরে আইরিশরা তাদের পড়শী তুতো ভাই হাইল্যান্ড স্কটিশদের হাতে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করে স্টুয়ার্টদের নির্বাসিত বংশধরদের পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে।


সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৫ সালে ইতালিস্থিত সিংহাসনহীন ‘প্রেটেন্ডার রাজা’ জেমস স্টুয়ার্টের পক্ষে তাঁর ছেলে চার্লস স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ডের উপকূলে ফরাসী-স্প্যানিশদের সহায়তায় সেনাবাহিনীসহ অবতরণ করেন। হাইল্যান্ড স্কটিশ আর আইরিশরা বিপুল উৎসাহে তাঁকে বরণ করে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে এটা জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ বলে পরিচিত। প্রথম প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জিতলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, আর তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, সেখানেই তাঁর বাকি জীবন কাটে।


তাঁর এই ব্যর্থতার পরেও আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মানুষ আশায় ছিল যে তিনি আবার ফিরে আসবেন, প্রটেস্ট্যান্ট হ্যানোভারবংশের শাসন থেকে তাদের মুক্ত করবেন। এই ফোক্ সঙ্গীতটি বনি প্রিন্সকে হারানোর শোক আর ভবিষ্যতের সেই আশা থেকে লেখা। ‘মুনস্টারের কবিসম্রাট’ শন মাকহোনালের বাঁধা গানটি পরে পল্লীঐতিহ্যের সংরক্ষক শন ও’রিয়াদা পুনরায় রেকর্ড করেন, তারপর এটি নতুন করে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। আমার ধারণা, রবি ঠাকুর দু’তিনবার বিলেত ভ্রমণের সময় আইরিশ কবি ইয়েটসের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য স্কটিশ-আইরিশ ফোক্ কবিতা-গানের পাশাপাশি এই আশলিং ঐতিহ্য আর সঙ্গীতের সাথেও পরিচিত হন।


এই গানটিতে শুধুমাত্র বো’রান বলে একটা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ড্রামের মত এই সঙ্গতের কারণে গানটা একটা মিলিটারি মার্চের রূপ পেয়েছে। ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের সময় আশলিং সাহিত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় এধরনের সামরিক সঙ্গীতে। আমাদের সূর্যসেনের চট্টগ্রাম ১৯৩০ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা কিন্তু সেই আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকেই! তাঁর সংগঠিত দলটির নাম ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, যদিও তাঁর আদর্শ রোম্যান্টিক সোশ্যালিজ়ম ছিল আইরিশদের থেকে ভিন্ন।


বহুকাল সুশীল সমাজে অবহেলিত হবার পরে এখন আইরিশ ভাষা-সংস্কৃতি-সঙ্গীতের একটা পুনর্জাগরণের শতাব্দী চলছে। তাদের নতুন প্রজন্ম এখন গ্যালিক ভাষা-গান শেখে, ট্যাপ ড্যান্সও শেখে। গ্যালিক কিন্তু ইংরেজীর থেকেও প্রাচীন, আড়াই হাজার বছরের পুরনো কেল্টিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে জার্মানের পরেই আইরিশ বংশোদ্ভূতদের স্থান, তাদেরও অনেকে আদি ভাষা-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। এদের সেই শিকড়ে ফেরার চেষ্টাকে অনেকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের লক্ষণ ধরতে পারেন, আমার ধারণা সেটা ভাবা ভুল। যদি তাই হয়, আমরা কোন অংশে কম বাঙালী জাতীয়তাবাদী নই! আর সত্যিকারের আইরিশ জাতীয়তাবাদীর দেখা পেলে রবিঠাকুর-সূর্যসেনের গল্প শুনিয়ে দিতে ভুলবেন না!

(গানটির কথা ও অর্থ পাবেন এখানে।)

 

মে সোয়াজন্তুইত

Featured Video Play Icon

এখন থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমাদের মাবাবারা সে সময় স্কুল-কলেজের ছাত্র। সময়টা ছিল খুবই উত্তাল, বেবি বুমারস জেনারেশনের বড় হয়ে ওঠার সময়। সমাজতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সব দেশেই চলছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমেরিকায় ভিয়েতনামযুদ্ধবিরোধী আর সিভিল রাইটস আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়াতে চেতনার স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্রবিক্ষোভ (এ দুটো দেশে কিভাবে পুলিশ, দলীয় পেটোয়াবাহিনী আর মিথ্যে প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহার হয় নব্য বামরা ঘেঁটে দেখুন; সোভিয়েতরা শেষমেশ চেকে দখলদার সেনাবাহিনী পাঠায়)। ফ্রান্স-ইতালিতেও বিশ্ববিদ্যালয়-হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সেই আন্দোলন ‘মে সোয়াজ়ন্তুইত’ নামে এখনও স্মরণ করে ফরাসীরা। রোলিং স্টোনসের নিচের গানটা সেই উত্তাল সময়ের পটভূমিতে লেখা (পিজি-১৩!)। স্ট্রীট ফাইটিং ম্যান বলে গানটাও শুনে দেখুন।

কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মে’৬৮ ব্যর্থ বিপ্লব হিসাবে গণ্য!

ফ্রান্সে তখন ক্ষমতায় ছিল প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোলের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই ফরাসীরা লড়াই করে, তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অনেক। কিন্তু যুদ্ধজয়ের পঁচিশ বছর পরে রক্ষণশীল হিসাবে বাম ‘প্রোগ্রেসিভ’ ছাত্র আর শ্রমিক সমাজের কাছে তারা ছিল ঘৃণিত। তাদের কাছে গোলিস্টদের যুদ্ধকালীন ফ্রঁস লিব্র্ ‘চেতনার নামে বাকস্বাধীনতাহরণ’ ছিল নাৎসি বাহিনীর সমতুল্য। টেলিভিশনও তখন সবার ঘরে ঘরে আসা শুরু হয়েছে, তাই সবাই জানতে-দেখতে পারলো নন্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রদের উপর পুলিশের আক্রমণ। কার্তিয়ে লাত্যানে শুরু হয়ে গেল ব্যারিকেড যুদ্ধ, সেটাও এল টিভিতে। গুজব রটল একজন ছাত্র নিহত (আসলে হয়নি), আর পুলিশই নাকি রাস্তায় গাড়ি উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে ছাত্রদের দোষ দিচ্ছে।

ছাত্রদের ডাকে শ্রম ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যরা তাদের নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বামপন্থী ছাত্রদের সাথে ধর্মঘটে যোগ দেয় দেশের সোয়া এক কোটি সাধারণ শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষদের ইউনিয়ন, সংখ্যায় তারা জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। দেশের দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, প্যারিসে দশ লাখ মানুষের ঢল নেমে আসে, বিখ্যাত গায়ক-অভিনেতারাও তাদের সাথে যোগদান করে। সরকারপতন ছিল সময়ের ব্যাপার, দ্য গোলও কিছু সময়ের জন্যে গোপনে জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন!

এতকিছুর পরেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় মে’৬৮! কয়েকটা কারণে। ধর্মঘটীদের লক্ষ্য কি ছিল সেটা মানুষকে বোঝাতে তারা ব্যর্থ হয়। টিভিতে তাদের ইন্টারভিউ নেয়া হলে তারা বলা শুরু করে হিপি গোছের অ্যান্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট অ্যান্টি-কনজিউমারিস্ট ইউটোপিয়ান সাম্যবাদী বুলি, যার সাথে সাধারণ মানুষ একাত্মতা খুঁজে পায়নি। তাদের সাথে যোগ দেয়া শ্রমিকদের লক্ষ্যও পরে হয়ে যায় ভিন্ন, তাদের বেতন বাড়ানো আর অন্যান্য বেনেফিটস দেয়ার ঘোষণা করা হলে তারা ধীরে ধীরে রাস্তা থেকে পাততাড়ি গুটায়।

আর নেতৃত্বেও ছিল সমস্যা। কে যে প্রপার নেতা তা কেউ জানত না। নোবেলবিজয়ী (কিন্তু প্রত্যাখ্যানকারী প্রথম ব্যক্তি!) দার্শনিক ঝ়ঁপল সার্ত্র হন তাদের প্রতীকী নেতা। তাঁকে ‌অ্যারেস্ট করা হয়, আর তখন তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। তাঁর লেখনীতে ধার ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনিও ছিলেন কম্যুনিজমের সমর্থনকারী মূলত বাম চিন্তাবিদ, যারা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র — সোভিয়েত এজেন্ট।

আর পুরনো আমলের মানুষ যারা দ্য গোলের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের স্বাক্ষী, আর রক্ষণশীল, তারা ছাত্রদের ‘ইনডিসিপ্লিন’, খোলামেলা পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের একত্রে অবাধ মেলামেশা, মাদকের ব্যবহার — এসব দেখে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকে। বামপন্থী বিপ্লবের খারাপ ফলের কথাও তারা জানত বলশেভিকদের অত্যাচারের ইতিহাস থেকে।

এর উপরে দ্য গোল যখন জানতে পারলেন আর্মি তাঁর পক্ষে, তিনি ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী পম্পিদু যাদের জেলে ভরা হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দিলেন, আর দ্য গোলকে অনুরোধ করলেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডাকতে। সবাই রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল। আর সেই নির্বাচনে গোলিস্ট পার্টি আরো বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ করল। কম্যুনিস্ট-সোশ্যালিস্টরা অনেক সীট হারাল।

মে’৬৮এর কালচারাল ইমপ্যাক্ট অবশ্য ছিল বিশাল। আমার মনে হয় আমরা সেই লেগ্যাসি এখনও বহন করছি। ফ্যাশনে বিশাল পরিবর্তন আসে, কোটপ্যান্ট ছেড়ে বেলবটম প্যান্ট জনপ্রিয় হয়। রক এন্ড রোল পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদী সঙ্গীতে, বব ডিল্যান তার প্রডাক্ট। ফেমিনিজ়মের আবির্ভাব ঘটে নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন মুখ হিসাবে। সারা বিশ্বে ছাত্ররা আইডিয়ালিস্ট প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমি বলবো সে কারণেই বোধহয় বাঙাল জাত একটু সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা পায়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন (ভুলে যাবেন না, এতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও শামিল ছিল) আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলবো মে’৬৮রই একরকম ধারাবাহিকতা! সেগুলির সকল কৃতিত্ব কেউ একাই ছিনতাই করলে ইতিহাসের অবমাননা হবে, এগুলো ছিল সফল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের চূড়ান্ত ফল।

আমরা কিছুটা শিক্ষা পেতে পারি মে’৬৮ থেকে। বিপ্লব সফল করতে লাগে প্র্যাগমাটিক লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর সাপোর্ট, আর লটস্ অফ স্কিন ইন দ্য গেম! আর দ্য গোল সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে গালি দেয়া হলেও তারা স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় সঠিক পদক্ষেপগুলো নেয়, দেশপ্রেমী হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়।

দ্য এলেমেন্টস অফ এ সাক্সেসফুল রেভোল্যুশন বলে এনপিআরে একটা সেগমেন্ট শুনছিলাম, নিন তার লিংক। ২০১১এর মিশরের তাহরির আন্দোলনের সময়ে ধারণকৃত এই সেগমেন্টে কলম্বিয়া প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সফলভাবেই সেই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে জানলে যে পরিমাণ জ্ঞানার্জন সম্ভব, ফরাসী-রুশ-মার্কিন শত সফল বিপ্লব সম্বন্ধে পড়েও এত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়!

 

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!