“ভূতের রাজা দিল বর, জবরে জবরে তিন বর!” বাল্যকালের আর সবকিছু এখন দেখলে পুরনো মনে হয়। কিন্তু যত দিন যায়, গুপী-বাঘা ততই জোয়ান হয়!
ছোটবেলায় গুপী-বাঘার যে দৃশ্যটা সবচে’ মন কাড়ত, সেটা মনে হয় ভূতের নাচ। সত্যজিৎ ভূতের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তাদের দেখে ভয়ে চোখ-কান বন্ধ করার মত কিছুই ছিল না। এখনো যখন দেখি, মনে হয় সত্যজিতের অন্যতম অসামান্য কারুকার্য এটা। হয়ত ছোটবেলায় ভাবতাম এটা কার্টুনছবি!
মজার ব্যাপার হল, গুপী গাইন বাঘা বাইনের হবার কথা ছিল রঙীন চলচ্চিত্র। ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে সাদা-কালো। রঙীন হলে আর ভূতনৃত্য দেখতে হত না!
অনেকে বলবেন এই দৃশ্যটা বাকি কাহিনীর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে ছোটখাটো অনেক কিছু চোখে পড়বে, আবার কিছু জিনিস বুঝতে সাহায্য দরকার হবে। আজকে আমি সেই চেষ্টাটা একটু করি।
অনেকে বলেন যে এই দৃশ্যে হিন্দু বর্ণবিভেদের অথবা পুঁজিবাদী শ্রেণীসংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমার হিসাবে তা নয়। কারণ চারটি গোত্রের ভূত থাকলেও, তারা নিজেদের মধ্যেই মারামারি করে পটল তুলছে, একে অন্যের সাথে যুঝছে না। বর্ণপ্রথারও কোন অর্থ হতে পারে না। ম্লেচ্ছ ফিরিঙ্গি বেনিয়াদের টেনেটুনে বৈশ্যের সারিতে ফেলার কোন মানে নেই। শ্রেণীসংগ্রাম হলে শোষণের চিহ্ন কোথায়? এদের সংঘাতটাও অসম শক্তির মনে হয় না।
বরং আমার মনে হয়, সত্যজিৎ যেটা দেখাতে চেষ্টা করেছেন সেটা একরকম অন্তর্দ্বন্দ্ব। সমশ্রেণীর, সমপরিচয়ের মানুষের — যারা জাতি, ধর্ম, পেশাগত বা বাণিজ্যিক স্বার্থ, এধরনের কোনদিক দিয়ে একটু আলাদা — তাদের কলহ। দ্রুত লয়ের সাথে সাথে সেই বাকবিতন্ডা তারা নিয়ে গেছে অন্তিম পর্যায়ে। ফলাফল, পরস্পরের হাতে নির্মম মৃত্যু!
শেষ দৃশ্যটাতে আবার পুনরুত্থিত ভূতের দল একে অন্যের হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি নাচছে। ছাত্রাবস্থায় কোনার্কের সূর্যমন্দিরে সত্যজিৎ দেখেছিলেন এরকম কয়েক সারিতে খোদাই করা প্রাচীন ভারতীয় নর্তক-নর্তকীর চিত্র। আবহসংগীতে সব বাদ্যযন্ত্র একসাথে ঐকতান করছে। বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গীত বিভিন্ন গোত্রের ভূতকে আবার মিলিয়ে-মিশিয়ে দিয়েছে, তারা ভুলে গেছে তাদের ঝগড়াঝাঁটি।
ভূত হওয়ায় এদের না হয় দৈবজ্ঞান হয়েছে! মর্ত্যলোকের মানুষের জ্ঞান হতে কী ভূত হতে হবে?
এখন একে একে বলি চার গোত্র কারা।
প্রথম দলটা শ্বেতশুভ্র পোশাকপরিহিত, রাজরাজড়া বা অভিজাত না হয়েই যায় না! তারা নাচছে মৃদঙ্গমের রাজকীয় তালের সাথে। নাচের ভঙ্গি আর তাদের মুখোশের ইঙ্গিত দেখে মনে হচ্ছে, এর অনুপ্রেরণা দক্ষিণ ভারতের কথাকলি নৃত্য। এদের মধ্যে দু’একটা মুখাবয়ব দেখে মনে হয় যে তারা জীবদ্দশায় মুসলিম সুলতান গোছের কিছু একটা ছিল।
দ্বিতীয় গ্রুপ শ্যামলা বা কালো রঙের ভূত, কারো উদোম শরীর। এরা সাধারণ খেটে-খাওয়া বলেই ঠাউর হয়। এদের কারো পোশাক-তরবারি-ঢাল দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমের রাজস্থানী, আবার কাউকে দেখে মনে হচ্ছে বাংলার লাঠিয়াল। এরা নাচছে কাঞ্জিরার তালে। রাজপুতদের তলোয়ার নাচ আর মারাঠাদের মার্শাল আর্টের কিছুটা প্রভাব আছে বলে মনে হয়।
তারপরেরটা চেনা সবচে’ সোজা। এদের পোশাক-আশাক যতটা না বিলাতী, তার থেকে বেশি সাধারণ ইউরোপীয়। এদের কাঠখোট্টা নড়াচড়ার সাথে জুতসই হয়েছে ভাতের পাত্র ঘটমের উপর চাঁটের আওয়াজ। এরা হুকাবাহী নেটিভকে চপেটাঘাত করলেও আমার হিসাবে ঔপনিবেশিকতার প্রদর্শন এখানে গৌণ। এই দলে ব্রিটিশদের সাথে ওলন্দাজ-ফরাসীরাও আছে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে তারা নিজেদের মধ্যে দেদারসে যুদ্ধ করেছে।
আর শেষের বিশালবপুর দল হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত গোষ্ঠী। ধর্মীয় বেশভূষা থাকলেও তারা আবশ্যিকভাবে ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রচারক নয়, কিন্তু ধর্ম আর ধর্মের মত বিভিন্ন ইজ়ম তাদেরকে ব্যাপক টানে। আর একে অন্যের উপর মতামত চাপিয়ে দিতে এদের জুড়ি নেই। তাই এদের কৌতুকপ্রদ অঙ্গভঙ্গির সাথে মানানসই বাদ্যযন্ত্র মোরসিং, যার আরেক নাম জিউ’স হার্প।
মিউজ়িকটা ষাটের দশকের সাইকিডেলিয়া হিসেবে ভাল চলবে। দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীত-ঐতিহ্য থেকে বাদ্যযন্ত্র আর নৃত্যের কিছু আইডিয়া ধার নিয়েছেন সত্যজিৎ। পারকাশন ছাড়া আর অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র না রাখার কারণ বোধহয় আদিমতা-সরলতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। ক্যামেরা আর এডিটিংএ স্পেশাল এফেক্টস সে যুগে কিভাবে করলেন সেটা অবাককরা ব্যাপার। আলোছায়ার খেলার সাথে নাচের কোরিওগ্রাফীও মিলেছে ভালো। অবশ্য সত্যজিৎ ভয়ে ছিলেন যে, সাধারণ দর্শক তাঁর এই অ্যাবস্ট্রাক্ট, আভঁ-গার্ড শিল্প গিলবে কিনা!
আর এটা আশা করি মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, ছবিটার শেষটা হলো হাল্লা-শুন্ডির দুই রাজার ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ থামানোর দৃশ্য। অর্থাৎ ভূতনৃত্যের সংঘাতবিরোধী বাণী বাকি ছবির সাথে অতীব সঙ্গতিপূর্ণ!
মুলোর মত দাঁত আর ভাঁটার মত রক্তলাল চোখেও বান্ধবসুলভ যে আধো-রহস্যময় হাসি ভূতের রাজার ঠোঁটে, তার রহস্য ভেদ করে ফেললাম!