আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে…

Featured Video Play Icon

“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে,
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে!”


রবিঠাকুরের এই গানের সুরের বেসিক গড়নটা, ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের শিক্ষার্থী-কয়েরের গাওয়া, উপরের আইরিশ গানে সামান্য হলেও পাওয়া যায় কিনা, দেখুন তো! তালসুরকানা আমার কানে মনে হচ্ছে দুটোর কোরাসের মীটার কাছাকাছি, তাল-স্কেল আলাদা।


রবীন্দ্রনাথের বহু দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশ আবির্ভূত মমতাময়ী-দুখী মাতা কিংবা সুন্দরী রমণী হিসাবে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতই তার বড় উদাহরণ। রবিঠাকুরের আগে কোন বাঙ্গালী এভাবে স্বদেশকে চিত্রায়িত করলে সেটা সম্ভবত একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র, বন্দে মাতরম কাব্যে। এ ধরনের অ্যালেগরি বা রূপকের আঙ্গিকে উপরের ‘মো গিলা মার’ নামের আইরিশ গ্যালিক ভাষার গানটাও রচিত।


আইরিশ গীতি-কাব্যে এই ধরনের স্বদেশ-রূপকের সাহিত্য পরিচিত ‘আশলিং’ হিসাবে। তাতে কবি নিদ্রাচ্ছন্ন, আর তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হন আয়ারল্যান্ডের স্বদেশদেবী এইরু। দেবী প্রায়শ তরুণী, কখনো জীর্ণশীর্ণ বয়োবৃদ্ধ, তাঁর বসন শতছিন্ন, তিনি কাঁদছেন ইংরেজ প্রটেস্ট্যান্ট শাসনে আইরিশ জাতির দুর্দশা দেখে, কিন্তু আশার বাণী শোনাচ্ছেন যে শীঘ্রই তারা আবার সুদিন দেখবে।


অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা ‘মো গিলা মার’ গানটিও গাচ্ছেন এইরু দেবী, তিনি জর্জরিত তাঁর প্রেমিকের বিরহবেদনায়। তাঁর সুদর্শন বীরপুরুষ, ‘সীজ়ার’ সাতসাগরের ওপারে চলে গেছে। তাই এখন তিনি বিধবার ন্যায় বিলাপরত। আয়ারল্যান্ডে কোকিল আর ডাকে না, সারা দেশের ওপর একটা কালো শোকের ছায়া।


দেবী এইরুর এই বীরপুরুষ কল্পিত নয়, তিনি ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্টবংশীয় ক্যাথলিক রাজকুমার ‘বনি প্রিন্স চার্লি’। ১৬০৩ সালে স্টুয়ার্টবংশ ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে ইংল্যান্ডে চলেছে ক্যাথলিক-অ্যাংলিকান-পিউরিটান ধর্মগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। স্টুয়ার্টরা প্রথমদিকে জনপ্রিয় থাকলেও তাদের ক্যাথলিক-সহমর্মিতাকে দেশের সাধারণ মানুষ আর অভিজাতরা, যারা অ্যাংলিকান খ্রীষ্টান, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। রাষ্ট্রের ক্যাথলিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত আইরিশরা, সেই বিদ্বেষের শিকার ছিল। ইংরেজরা স্টুয়ার্টবংশকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দেয়ার পরে আইরিশরা তাদের পড়শী তুতো ভাই হাইল্যান্ড স্কটিশদের হাতে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করে স্টুয়ার্টদের নির্বাসিত বংশধরদের পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে।


সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৫ সালে ইতালিস্থিত সিংহাসনহীন ‘প্রেটেন্ডার রাজা’ জেমস স্টুয়ার্টের পক্ষে তাঁর ছেলে চার্লস স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ডের উপকূলে ফরাসী-স্প্যানিশদের সহায়তায় সেনাবাহিনীসহ অবতরণ করেন। হাইল্যান্ড স্কটিশ আর আইরিশরা বিপুল উৎসাহে তাঁকে বরণ করে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে এটা জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ বলে পরিচিত। প্রথম প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জিতলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, আর তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, সেখানেই তাঁর বাকি জীবন কাটে।


তাঁর এই ব্যর্থতার পরেও আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মানুষ আশায় ছিল যে তিনি আবার ফিরে আসবেন, প্রটেস্ট্যান্ট হ্যানোভারবংশের শাসন থেকে তাদের মুক্ত করবেন। এই ফোক্ সঙ্গীতটি বনি প্রিন্সকে হারানোর শোক আর ভবিষ্যতের সেই আশা থেকে লেখা। ‘মুনস্টারের কবিসম্রাট’ শন মাকহোনালের বাঁধা গানটি পরে পল্লীঐতিহ্যের সংরক্ষক শন ও’রিয়াদা পুনরায় রেকর্ড করেন, তারপর এটি নতুন করে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। আমার ধারণা, রবি ঠাকুর দু’তিনবার বিলেত ভ্রমণের সময় আইরিশ কবি ইয়েটসের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য স্কটিশ-আইরিশ ফোক্ কবিতা-গানের পাশাপাশি এই আশলিং ঐতিহ্য আর সঙ্গীতের সাথেও পরিচিত হন।


এই গানটিতে শুধুমাত্র বো’রান বলে একটা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ড্রামের মত এই সঙ্গতের কারণে গানটা একটা মিলিটারি মার্চের রূপ পেয়েছে। ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের সময় আশলিং সাহিত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় এধরনের সামরিক সঙ্গীতে। আমাদের সূর্যসেনের চট্টগ্রাম ১৯৩০ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা কিন্তু সেই আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকেই! তাঁর সংগঠিত দলটির নাম ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, যদিও তাঁর আদর্শ রোম্যান্টিক সোশ্যালিজ়ম ছিল আইরিশদের থেকে ভিন্ন।


বহুকাল সুশীল সমাজে অবহেলিত হবার পরে এখন আইরিশ ভাষা-সংস্কৃতি-সঙ্গীতের একটা পুনর্জাগরণের শতাব্দী চলছে। তাদের নতুন প্রজন্ম এখন গ্যালিক ভাষা-গান শেখে, ট্যাপ ড্যান্সও শেখে। গ্যালিক কিন্তু ইংরেজীর থেকেও প্রাচীন, আড়াই হাজার বছরের পুরনো কেল্টিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে জার্মানের পরেই আইরিশ বংশোদ্ভূতদের স্থান, তাদেরও অনেকে আদি ভাষা-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। এদের সেই শিকড়ে ফেরার চেষ্টাকে অনেকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের লক্ষণ ধরতে পারেন, আমার ধারণা সেটা ভাবা ভুল। যদি তাই হয়, আমরা কোন অংশে কম বাঙালী জাতীয়তাবাদী নই! আর সত্যিকারের আইরিশ জাতীয়তাবাদীর দেখা পেলে রবিঠাকুর-সূর্যসেনের গল্প শুনিয়ে দিতে ভুলবেন না!

(গানটির কথা ও অর্থ পাবেন এখানে।)

 

মে সোয়াজন্তুইত

Featured Video Play Icon

এখন থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমাদের মাবাবারা সে সময় স্কুল-কলেজের ছাত্র। সময়টা ছিল খুবই উত্তাল, বেবি বুমারস জেনারেশনের বড় হয়ে ওঠার সময়। সমাজতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সব দেশেই চলছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমেরিকায় ভিয়েতনামযুদ্ধবিরোধী আর সিভিল রাইটস আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়াতে চেতনার স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্রবিক্ষোভ (এ দুটো দেশে কিভাবে পুলিশ, দলীয় পেটোয়াবাহিনী আর মিথ্যে প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহার হয় নব্য বামরা ঘেঁটে দেখুন; সোভিয়েতরা শেষমেশ চেকে দখলদার সেনাবাহিনী পাঠায়)। ফ্রান্স-ইতালিতেও বিশ্ববিদ্যালয়-হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সেই আন্দোলন ‘মে সোয়াজ়ন্তুইত’ নামে এখনও স্মরণ করে ফরাসীরা। রোলিং স্টোনসের নিচের গানটা সেই উত্তাল সময়ের পটভূমিতে লেখা (পিজি-১৩!)। স্ট্রীট ফাইটিং ম্যান বলে গানটাও শুনে দেখুন।

কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মে’৬৮ ব্যর্থ বিপ্লব হিসাবে গণ্য!

ফ্রান্সে তখন ক্ষমতায় ছিল প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোলের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই ফরাসীরা লড়াই করে, তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অনেক। কিন্তু যুদ্ধজয়ের পঁচিশ বছর পরে রক্ষণশীল হিসাবে বাম ‘প্রোগ্রেসিভ’ ছাত্র আর শ্রমিক সমাজের কাছে তারা ছিল ঘৃণিত। তাদের কাছে গোলিস্টদের যুদ্ধকালীন ফ্রঁস লিব্র্ ‘চেতনার নামে বাকস্বাধীনতাহরণ’ ছিল নাৎসি বাহিনীর সমতুল্য। টেলিভিশনও তখন সবার ঘরে ঘরে আসা শুরু হয়েছে, তাই সবাই জানতে-দেখতে পারলো নন্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রদের উপর পুলিশের আক্রমণ। কার্তিয়ে লাত্যানে শুরু হয়ে গেল ব্যারিকেড যুদ্ধ, সেটাও এল টিভিতে। গুজব রটল একজন ছাত্র নিহত (আসলে হয়নি), আর পুলিশই নাকি রাস্তায় গাড়ি উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে ছাত্রদের দোষ দিচ্ছে।

ছাত্রদের ডাকে শ্রম ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যরা তাদের নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বামপন্থী ছাত্রদের সাথে ধর্মঘটে যোগ দেয় দেশের সোয়া এক কোটি সাধারণ শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষদের ইউনিয়ন, সংখ্যায় তারা জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। দেশের দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, প্যারিসে দশ লাখ মানুষের ঢল নেমে আসে, বিখ্যাত গায়ক-অভিনেতারাও তাদের সাথে যোগদান করে। সরকারপতন ছিল সময়ের ব্যাপার, দ্য গোলও কিছু সময়ের জন্যে গোপনে জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন!

এতকিছুর পরেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় মে’৬৮! কয়েকটা কারণে। ধর্মঘটীদের লক্ষ্য কি ছিল সেটা মানুষকে বোঝাতে তারা ব্যর্থ হয়। টিভিতে তাদের ইন্টারভিউ নেয়া হলে তারা বলা শুরু করে হিপি গোছের অ্যান্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট অ্যান্টি-কনজিউমারিস্ট ইউটোপিয়ান সাম্যবাদী বুলি, যার সাথে সাধারণ মানুষ একাত্মতা খুঁজে পায়নি। তাদের সাথে যোগ দেয়া শ্রমিকদের লক্ষ্যও পরে হয়ে যায় ভিন্ন, তাদের বেতন বাড়ানো আর অন্যান্য বেনেফিটস দেয়ার ঘোষণা করা হলে তারা ধীরে ধীরে রাস্তা থেকে পাততাড়ি গুটায়।

আর নেতৃত্বেও ছিল সমস্যা। কে যে প্রপার নেতা তা কেউ জানত না। নোবেলবিজয়ী (কিন্তু প্রত্যাখ্যানকারী প্রথম ব্যক্তি!) দার্শনিক ঝ়ঁপল সার্ত্র হন তাদের প্রতীকী নেতা। তাঁকে ‌অ্যারেস্ট করা হয়, আর তখন তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। তাঁর লেখনীতে ধার ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনিও ছিলেন কম্যুনিজমের সমর্থনকারী মূলত বাম চিন্তাবিদ, যারা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র — সোভিয়েত এজেন্ট।

আর পুরনো আমলের মানুষ যারা দ্য গোলের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের স্বাক্ষী, আর রক্ষণশীল, তারা ছাত্রদের ‘ইনডিসিপ্লিন’, খোলামেলা পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের একত্রে অবাধ মেলামেশা, মাদকের ব্যবহার — এসব দেখে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকে। বামপন্থী বিপ্লবের খারাপ ফলের কথাও তারা জানত বলশেভিকদের অত্যাচারের ইতিহাস থেকে।

এর উপরে দ্য গোল যখন জানতে পারলেন আর্মি তাঁর পক্ষে, তিনি ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী পম্পিদু যাদের জেলে ভরা হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দিলেন, আর দ্য গোলকে অনুরোধ করলেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডাকতে। সবাই রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল। আর সেই নির্বাচনে গোলিস্ট পার্টি আরো বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ করল। কম্যুনিস্ট-সোশ্যালিস্টরা অনেক সীট হারাল।

মে’৬৮এর কালচারাল ইমপ্যাক্ট অবশ্য ছিল বিশাল। আমার মনে হয় আমরা সেই লেগ্যাসি এখনও বহন করছি। ফ্যাশনে বিশাল পরিবর্তন আসে, কোটপ্যান্ট ছেড়ে বেলবটম প্যান্ট জনপ্রিয় হয়। রক এন্ড রোল পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদী সঙ্গীতে, বব ডিল্যান তার প্রডাক্ট। ফেমিনিজ়মের আবির্ভাব ঘটে নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন মুখ হিসাবে। সারা বিশ্বে ছাত্ররা আইডিয়ালিস্ট প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমি বলবো সে কারণেই বোধহয় বাঙাল জাত একটু সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা পায়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন (ভুলে যাবেন না, এতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও শামিল ছিল) আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলবো মে’৬৮রই একরকম ধারাবাহিকতা! সেগুলির সকল কৃতিত্ব কেউ একাই ছিনতাই করলে ইতিহাসের অবমাননা হবে, এগুলো ছিল সফল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের চূড়ান্ত ফল।

আমরা কিছুটা শিক্ষা পেতে পারি মে’৬৮ থেকে। বিপ্লব সফল করতে লাগে প্র্যাগমাটিক লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর সাপোর্ট, আর লটস্ অফ স্কিন ইন দ্য গেম! আর দ্য গোল সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে গালি দেয়া হলেও তারা স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় সঠিক পদক্ষেপগুলো নেয়, দেশপ্রেমী হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়।

দ্য এলেমেন্টস অফ এ সাক্সেসফুল রেভোল্যুশন বলে এনপিআরে একটা সেগমেন্ট শুনছিলাম, নিন তার লিংক। ২০১১এর মিশরের তাহরির আন্দোলনের সময়ে ধারণকৃত এই সেগমেন্টে কলম্বিয়া প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সফলভাবেই সেই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে জানলে যে পরিমাণ জ্ঞানার্জন সম্ভব, ফরাসী-রুশ-মার্কিন শত সফল বিপ্লব সম্বন্ধে পড়েও এত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়!

 

মধ্যযুগীয় কারবার

Featured Video Play Icon

“সত্য অবদমিত, বিভ্রান্ত, আর বিক্রিত;
ন্যায়বিচারও আজ বেশ্যার ন্যায় বিক্রির পণ্য।
বিচারপ্রার্থী দৌড়ে ফেরে কোর্ট-কাচারিতে,
কোন ফলই মেলে না, যতক্ষণ না হয় সে কপর্দকশূন্য!”

(ভেরিতাস সুপ্রিমিতুর, দিসত্রা’ইতুর এত্ ভ়েন্দিতুর;
য়্যুস্তিৎসিয়া প্রস্তান্তে, ইতুর এত্ রেকুর্রিতুর
আদ্ কুরিয়াম, নেক আন্তে, কুইদ কনসেকিতুর,
কোয়াম এক্সুইতুর কুয়াদ্রান্তে!)

কথাগুলি একালের নয়! কমপক্ষে নয়শ’ বছর আগের মধ্যযুগীয় ইউরোপে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে এই লাতিন গান-সুর বাঁধা। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে ১৮০৩ সালে আবিষ্কৃত ‘কার্মিনা বুরানা’ নামে পরিচিত পান্ডুলিপির একটি গান এটি। গানের সুরসঙ্গতও লিপির সাথে ছিল। এই সংগ্রহের আরেকটা বিখ্যাত গান ‘ও ফরতুনা’র কার্ল ওর্ফকৃত কম্পোজিশন অনেক পপ কালচারে ব্যবহৃত হয়েছে।

একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীকে পশ্চিম ইউরোপের মধ্যযুগ ধরলেও এসময়ের সমাজ ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। নবম-দশম শতকের নর্ম্যান-ভাইকিংদের আক্রমণ বন্ধ হয়, স্পেনের মুসলিম রাজ্যগুলির সাথেও একটা শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়ায় আসে শার্লম্যানের ক্যাথলিক ফ্রাংক সাম্রাজ্য। রোম সাম্রাজ্যের পতনের জন্যে দায়ী ভ্যান্ডাল-গথিক জার্মান গোত্রগুলিও নিজেদের রাজত্ব গুছিয়ে থিতু হয়ে বসেছে। ফলে জ্ঞান-প্রযুক্তির আদানপ্রদান কিছুটা হলেও শুরু হলো। এতে করে দ্বাদশ শতাব্দীতে পঞ্চদশ শতকের আগেই একটা রেনেসঁস হয়ে যায়। গথিকশৈলীর বড় বড় গির্জা-ক্যাথেড্রাল তৈরি শুরু হয়, যেমন ফ্রান্সের নত্র দাম আর জার্মানির কল্ন ক্যাথেড্রাল। এসময়ের সঙ্গীতের ছন্দ-মাত্রা-বাদ্যযন্ত্রও নতুন সংস্কারের ছোঁয়া পায়, বিশেষত প্রাচীন গ্রীকদের আর তাদের সুরজ্ঞানের রক্ষক আরব সঙ্গীতবিজ্ঞানীদের প্রভাবে। স্থিতিশীলতার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, নগরকেন্দ্রিক বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে, আর ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও যাত্রা শুরু হয়।

এই আপাত সমৃদ্ধির বিপরীতে ছিল ক্ষমতাসীন অভিজাত গোষ্ঠীর অর্থলিপ্সা আর দুর্নীতি। এসময়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ, বিশপ, কার্ডিনাল — এরা ছিল সকল ক্ষমতার উৎস। ইউরোপের রাজবংশগুলি পোপের কাছ থেকে ঈশ্বরপ্রদত্ত বৈধতার সীলমোহর নিয়ে আসত — কখনো অর্থ, কখনো জমিজমা বা অন্য কোন সুবিধার বিনিময়ে। সাধারণ মানুষ যদি কিছুমাত্র ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি অর্জন করতো, তাতে অভিজাতশ্রেণীর নজর পড়লে তাদের পক্ষে পোপের দলবল দাঁড়িয়ে যেত জাজ-জুরি-এক্সেকিউশনার হয়ে। কখনো কখনো পোপ আর রাজারা নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া করত সম্পত্তি নিয়ে। (মিস্টার বীনের প্রথম কমেডি শো ব্ল্যাক অ্যাডারের তৃতীয় পর্ব দ্রষ্টব্য!) এসময়ের দুর্নীতির সবচে’ বড় উদাহরণ পোপ নবম বেনেডিক্ট। তাঁর বাবা জায়গামত ঘুষ দিয়ে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তাঁর জন্যে পোপের আসন ক্রয় করেন। একইভাবে তিন-তিনবার পোপ হন তিনি। বেনেডিক্ট ব্যতীত আর কোন পোপ একবারের বেশি ধর্মগুরু হতে পারেননি। তিনি আসন ছেড়ে দেওয়ার সময়ও পরবর্তী পোপের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করেন!

শিক্ষিত একটা প্রতিবাদী শ্রেণী ছিল বটে। তারা সংখ্যায় গৌণ আর নির্ধন হলেও সমাজে একটা ভূমিকা ছিল তাদের। এদের শিক্ষাজীবন শুরু হত চার্চ পরিচালিত মঠে, সাধারণ শিক্ষানবিশ যাজক হিসাবে। কিন্তু চার্চের দুর্নীতি দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই যুবাবয়সী শিক্ষার্থীরা ভিখারি হয়ে পথে নেমে পড়ে, আর বিদ্রূপাত্মক গান বানিয়ে-গেয়ে ঘুনেধরা সমাজ আর শাসকগোষ্ঠীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা শুরু করে। এধরনের পল্লীগায়ক বা ত্রুবাদোরদের একটা গ্রুপের নাম গোলিয়ার্। কার্মিনা বুরানার প্রায় আড়াইশ’ বিদ্রূপাত্মক, নৈতিকতামূলক আর প্রেমের গান এরাই লিখে — শুধু লাতিন নয়, ‘অপবিত্র’ পুরনো ফরাসী-জার্মান ভাষাতেও। আর সেসব গানে আহামরি কত নিষিদ্ধ শব্দ আর বিষয়বস্তুর ছড়াছড়ি! সেসব শুনলে তথাকথিত ধর্মীয় নৈতিক চেতনার তল্পিতল্পাবাহী পোপগোষ্ঠীর কর্ণ রক্তিম হতে বাধ্য ছিল!

বলা বাহুল্য সাধারণ মানুষ ত্রুবাদোরদের গান শুনে পুলকিত হলেও গণজাগরণের অবস্থায় তারা ছিল না। তাদের অধিকাংশ ছিল ভূমিদাস আর তাদের গড় আয়ু ছিল পয়ত্রিশের কোঠায়। কোনমতে সেটুকু জীবন পার করে পরবর্তী প্রজন্মকে একই ভাগ্যে সপে দিয়ে অন্তর্ধান করতো তারা। স্বভাবতই এই গানটিতে গোলিয়ার্ ত্রুবাদোরও তাদের উপদেশ দিচ্ছেন বিচারককে নিজের ন্যায্য অধিকারের প্রমাণ দেখিয়ে কালক্ষেপণ না করে অর্থসামর্থ্য থাকলে ঘুষের আশ্রয় নিতে।

কিন্তু গানটার শেষে গীতিকার ঠান্ডা রোষ নিয়ে সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন, ক্রাসুস বলে জুলিয়াস সীজারের সমসাময়িক এক প্রাচীন রোমান সেনানায়কের উদাহরণ দিয়ে। ক্রাসুস ক্ষমতাশালী কন্সাল হিসাবে বহু নামী রোমান পরিবারকে রাজনৈতিক প্যাঁচে ফেলে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ গলাধঃকরণ করেছিলেন, সাধারণ নাগরিকদের হিসাব তো ধর্তব্যেই পড়ে না। এসব করে তিনি হয়েছিলেন রোমের সবচে’ বেশি পরিমাণ স্বর্ণের মালিক। উদ্ধত ক্রাসুস সমরক্ষেত্রে সংখ্যায় দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও শত্রু পার্থিয়ানদের কাছে পরাজিত হন। আর পার্থিয়ানরা তাঁকে বন্দি করে আগুনে গলানো তরল সোনা ঢেলে দেয় তাঁর গলায়।

“স্বর্ণের থেকে মধুর, মূল্যবান, শক্তিমান আর কিছু নেই। এমনকি তর্কবিশারদ সিসেরোর কাছেও বিপরীত কোন যুক্তি পাবে না। কিন্তু সোনা যাকে করে সম্ভ্রান্ত, বেদনাদায়কভাবে তাকে পুড়িয়ে মারেও সেই একই ধাতু। ক্রাসুসের ক্ষুধার জন্যে তাই সবচে’ উপযুক্ত তপ্ত স্বর্ণ! তাই সুবিচার!” (আউরো নিল পতেনৎসিউস …)

সময় লাগলেও গোলিয়ারদের সেই পোয়েটিক জাস্টিস ইউরোপে এসেছিল ঠিকই। প্লেগ-মহামারি হিসাবে, যুদ্ধ-বিগ্রহের আকারে। রাজা-প্রজা কাউকেই অসম চোখে দেখেনি সেই পোয়েটিক জাস্টিস। রোমান ক্যাথলিক চার্চও রক্ষা পায়নি। মার্টিন লুথারসহ অন্যান্য প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকদের অনুপ্রাণিত জনরোষের মুখে তারা উড়ে গেছিল তাসের ঘরের মত!

গানটার ভালো ইংরেজী অনুবাদ কমেন্টস সেকশনে দিলাম। সাবটাইটেলেরটা বেশি আক্ষরিক।

‘ডিকেন্জিয়ান ডিস্টোপিয়া’

Featured Video Play Icon

আজকের গানটা ১৯৬৮ সালের ব্রিটিশ মিউজিক্যাল ‘অলিভার!’ থেকে। মনে হয় ৯২-৯৩এর দিকে এটা বিটিভিতে পরিবেশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়ার আগেই এটা দেখেছিলাম। আর গানগুলির কথা না বুঝেই গল্পটা আর সুরগুলি খুব মনে ধরেছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অনেক খুঁজে ডিভিডি সংগ্রহ করি।

এটা সেলেক্ট করার কারণ মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া, ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমনতর ছিল। ডিকেন্স এ কাহিনী লিখেন ১৮৩৭এ। রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের বছর সেটা। যুক্তরাজ্য সাম্রাজ্যের উচ্চতম শিখরে তখন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না, কথাটা এই সময়েই চালু হয়; কারণ তাদের কোন না কোন উপনিবেশে যখন সূর্য অস্তগামী, অন্য কোনটাতে তখন সূর্যোদয়। ভারতে ১৮৫৭র সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে সরিয়ে সম্রাজ্ঞী হিসাবে সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নেন ভিক্টোরিয়া।

আমরা ভাবতে পারি যে এসময় ভারতসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলিকে শোষণ করে ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ বিপুল সমৃদ্ধি ‌অর্জন করেছিল। বাস্তবতা এই সরল সত্যের থেকে জটিলতর! ভিক্টোরিয়ান যুগ যেমন ব্রিটিশ আভিজাত্যের নাক-উঁচু এটিকেটের জন্যে পরিচিত, ঠিক ততটা পরিচিত ‘ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়া’ হিসাবে! ডিকেন্সের আবাসস্থল লন্ডনে তখন শিল্পবিপ্লবের হাওয়া লেগেছে। শহরের বায়ু ভারি, আকাশ কালো — কয়লা পুড়িয়ে ফ্যাক্টরি-রেল চালানোর ধোঁয়ায়।

সে শহরের নিম্নবিত্ত আর উঠতি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ছিল সেরকম নিম্নমানের। তাদের পোশাকআশাক ছেঁড়া, তাপ্পিমারা, ধূলিধূসরিত, বে-সাইজের। যাদের ভাগ্যে খাদ্য-পানীয় নিয়মিত জুটত, তাও ছিল অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা। অনেকে থাকত পরিত্যক্ত বাড়িতে বস্তি করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা অসুস্থ হয়ে পড়ত, তাদের ডাক্তার পাঠাত সমুদ্রতীরের বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্যে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা আর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্লেগ-মহামারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি নিয়মকানুনও অতটা চটপটে হয়ে উঠেনি যে দ্রুত পতনমুখী জীবনযাত্রার মান আর উচ্চগামী আয়বৈষম্যকে আয়ত্তে আনবে।

এই দৃশ্যে দেখবেন এতিম অলিভার কপালের ফেরে ফেগিন নামে এক পকেটমার সর্দারের আস্তানায় এসে পড়েছে। ডিকেন্সের নিজের ছোটবেলার একটা ছায়া আছে অলিভারের মধ্যে। তাঁর ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবাকে জেল খাটতে হয় অপরিশোধিত ঋণের কারণে। তখন পরিবারের ঘানি টানতে স্কুল ছেড়ে ফ্যাক্টরিতে কাজে যেতে হয় ডিকেন্সকে।

এই গানটিতে অলিভার ভাবছে ফেগিনদের লন্ড্রির ব্যবসা, কারণ একটা ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে তাদের গোপন আখড়ায় অনেকগুলি সিল্কের রুমাল শুকাতে দেয়া হয়েছে। নিষ্পাপ-সরল অলিভারকে খেলাচ্ছলে ফেগিন আর তার বালক সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝাচ্ছে কিভাবে পকেট কাটতে হয়। সে দৃশ্যে ফেগিন সেজেছে অভিজাত উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ — কিছুটা কমিক তার সেই ভোল, কারণ উচ্চবিত্তের এটিকেট থাকলে কী হবে, সত্যিকার অর্থে তারাও ছিল লোভী-হিংসুক গোছের! অলিভারকে শিখাতে ফেগিনকে বোকা বানিয়ে আর্টফুল ডজার আর তার দোস্তরা সমানে মাল সরিয়ে চলেছে!

ডিকেন্স ছিলেন মানবচরিত্রের ভাল পর্যবেক্ষক, আর জটিল ক্যারিকেচার তৈরির বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাহিনীগুলির কোন ক্যারেক্টারই সোজাসাপ্টা খারাপ বা ভাল ছিল না — সাদাও নয়, কালোও নয়, ধূসর। যেমন এই মুভির ফেগিন চরিত্রটা — সে লোভাতুর বটে, কিন্তু সে যে সেটা করছে পেটের দায়ে! বুড়ো বয়েসে তাকে দেখার কেউ নেই, এসব চিন্তায়। আর বালকবয়সী চামচাদের সে বাবা না হলেও গার্জেনের মত, আগলে রাখার মত কিছুটা দায়িত্ববোধ আছে।

ভিক্টোরিয়ান সমাজে এত শ্রেণীবিভেদ, এত অসমতা থাকা সত্ত্বেও সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল। ডিকেন্সের ক্যারেক্টারগুলি কখনো কখনো সৌভাগ্যবানও হত। বাস্তবেও যারা সুযোগসন্ধানী ছিল, তারা খোদ ব্রিটেনে না পারলেও জাহাজের খালাসী হিসাবে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে, নয়ত ভারতে — যেখানে ভদ্রলোকে যেতে চাইত না — সেখানে সেনা-নৌ অফিসার হিসাবে গিয়ে রাতারাতি একটা কূলকিনারা করে ফেলতে পারত। তারপর বাড়ি ফিরে জমিজমা কিনে, ব্যবসা বানিয়ে ভবিষ্যতটা আরেকটু পাকাপোক্ত করে ফেলত।

শেষ করি একটা কন্ট্রাস্ট দেখিয়ে। সোশ্যালিজম-কম্যুনিজমের পিতৃদেব কার্ল মার্ক্সও ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ অব্দি লন্ডনে ছিলেন। ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়ার প্রতক্ষদর্শী তিনিও। তাঁর ১৮৬৭তে লেখা ‘ডাস কাপিটাল’এ ব্যাখ্যা করেছেন শ্রমিকশ্রেণীর ওপর পুঁজিবাদী শোষণের পদ্ধতি, আর সেই শ্রেণীবিষম সিস্টেম ভাঙার লক্ষ্যে প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু সেই বিপ্লব ব্রিটেনে হয়নি। হয়েছিল শিল্পবিপ্লবে পিছিয়ে থাকা ইউরোপের সবচে’ কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়াতে, যেখানে তা হবারই কথা নয়, তাও আরো ৫০ বছর পরে। মার্ক্সের থিওরি নানা প্যাঁচঘোঁচ মেরে তৈরি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ‌অতিরিক্ত সিম্প্লিস্টিক ছিল, তাই ভুলও ছিল। হয়ত বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করে আর গলা হাঁকড়িয়ে নিম্নবিত্তগোষ্ঠীর ‘সায়েন্টিফিক প্রফেট’ হওয়াটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য!

সেখানে কিন্তু ডিকেন্স শুধু উপন্যাস-বই লিখেই দমে থাকেননি। রাজনীতিতে সরাসরি যোগ না দিয়েও লেখনী দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমটার উৎকর্ষসাধন করেছেন। খাদ্য-পানীয় আর শিশুশ্রম সংক্রান্ত অনেক মানবিক আইন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অক্লান্ত অ্যাকটিভিজমের কারণেই হয়। অনেকগুলি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সহায়তা করেন। সেসব কর্মকান্ডের সুফল তাঁর পরবর্তীপ্রজন্ম এখনো ভোগ করছে। তাঁর ভাষায়, ‘দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হেড, অ্যান্ড… দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হার্ট!’ উচিত কথা!

(এখানে পাবেন গানটির কথা।)

শুকনো পাতার নুপূর পায়ে…

Featured Video Play Icon

নিচের গানটির সুর বাঙ্গালী সবারই জানার কথা। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ আর ‘শুকনো পাতার নুপূর পায়ে’ গান দু’টি একই সুরে বাঁধা। কিন্তু কাতালান কন্ডাক্টর জোর্ডি সাভালের হেসপেরিওন অনসম্বলের এই পারফরম্যান্সে সেই সুরটার সাথে যে ভাষাগুলিতে গান গাওয়া হচ্ছে, সেটা বাংলা নয় — তুর্কী, আরবী, হিব্রু, গ্রীক, আর লাদিনো!

এধরনের ভৌগোলিকসীমাহীন জনপ্রিয় সুরকে মিউজিকোলজিস্টরা ডাকনাম দিয়েছে ওয়ান্ডারিং মেলোডীজ — যাযাবর সুর। উপরের ভাষাগুলি ছাড়াও সার্বিয়ান, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, রোমানিয়ান, ম্যাসিডোনিয়ান, আর্মেনিয়ান ভাষার গানেও এই সুর ব্যবহার হয়েছে। মার্কিন জ্যাজ় শিল্পী আর্থা কিটও পঞ্চাশের দশকে গানটা গেয়েছিলেন।

সুদূর নিকট-প্রাচ্য থেকে এই সুরটা বাংলা গানে আনা নজরুলের কৃতিত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হাবিলদার হিসাবে তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২০ করাচি সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু প্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া হয়নি তাঁর। তাও কোন না কোনভাবে সুরটি তাঁর সামনে এইসময়ই এসে পড়ে ধারণা করলে মনে হয় না খুব একটা ভুল করব।

গানটার বিষয়বস্তুও এক ভাষা থেকে আরেক ভাষাতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। হিব্রুতে সেটা প্রার্থনাগীতি, গ্রীক, লাদিনো আর আরবীতে সেটা প্রেমের গান বা চপলা কিশোরীর স্তুতি; আবার আর্মেনিয়ান-বুলগেরিয়ানে দেশাত্মবোধক। ওসমানলি সাম্রাজ্যের সময় লেখা মূল তুর্কী গানটার কথা পড়লে মনে হবে, তরুণী গায়িকা তার সুদর্শন ‘কতিব’ বা কেরানির সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে। বেচারার লেজওয়ালা কোট জলেকাঁদায় নোংরা হয়ে গেছে বলে তার বিমর্ষবদন দেখে তরুণী পুলকিত বোধ করছে।

আজকের নব্য ওসমানলি জাতীয়তাবাদীরা হয়ত আপনাকে বুঝ দিবে যে, মূল তুর্কী গানটারও উদ্দেশ্য প্রেমনিবেদন, আর তুর্কীদেশ সেসময় মুসলিম সাম্রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও সেদেশে সমসাময়িক পশ্চিমাদেশের তুলনায় নারীস্বাধীনতা বেশি ছিল। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝবেন তা আসলে নয়! ওসমানলি সাম্রাজ্যে কেবল হারেমের মেয়েরা আর রাজমাতারাই ছিলেন ক্ষমতাবান নারী, সাধারণ মেয়েদের অধিকার ছিল পুরুষের অর্ধেক।

‘কতিবিম’ নামে মূল গানটার আসল উদ্দেশ্য ছিল ঊনবিংশ শতকে সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদের চাপিয়ে দেয়া সংস্কারকে নিয়ে বিদ্রূপ করা। ১৮৫০এর দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রুশদের আগ্রাসনের মুখে ইউরোপের ‘সিক ম্যান’ তুরস্ককে ইংরেজ, ফরাসী আর সার্ডিনিয়ানরা সহায়তা করে। রুশরা সেযুদ্ধে পরাজিত হয়, আর পশ্চিমাদের অনুকরণে সুলতান তুরস্কে তানজ়িমাত বলে একটা সংস্কার চালু করেন। অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল নীতির সাথে সাথে নিয়ম করে রাজকর্মচারীদের পোশাকও পরিবর্তন করে কোট-প্যান্টালুন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী ঢোলা জামাকাপড়ে অভ্যস্ত রক্ষণশীল তুর্কীরা সেটা পছন্দ করেনি। তাই এরকম বিদ্রূপাত্মক গান চালু হয়ে গেল, যেন কমবয়েসী মেয়েরা পর্যন্ত সরকারি কেরানিদের পরনের কাপড় নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করছে!

তুর্কী জনগণের অসন্তুষ্টির মুখে তানজ়িমাত সংস্কার বেশিদিন চলতে পারেনি। আব্দুল মজিদের মৃত্যুর পনেরো বছর পরে আবার যেমনকার তেমন। তবে কিছু জিনিস টিকে গিয়েছিল। যেমন, সাম্রাজ্যে ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম-দ্রুজ আরব-তুর্কী-আর্মেনিয়ান নানাগোত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে তাদের ওসমানলি দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পরিচয়টাকে ভাষা-জাতি-ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। নাগরিকত্ব আর সম্পত্তি মালিকানা আইনেও কিছুটা সমাধিকার আনা হয়। (ইতিহাসবিদরা বলবেন, ১৮৮০র দিকে রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া রুশ ইহুদীরা সেসব আইনের ব্যবহার করে প্যালেস্টাইন প্রদেশে জমি কেনা শুরু করে।) বহুজাতিক দেশ হিসাবে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পায় ওসমানলি রাষ্ট্র, সেজন্যেই হয়ত তাদের প্রাক্তন প্রদেশগুলিতে এধরনের তুর্কী সুরসংস্কৃতি এখনো প্রচলিত। শুধু সেসময়ের সাধারণ তুর্কীরা এরকম ইনক্লুজিভিটি পছন্দ করেনি, বিদ্রূপ করেছে।

ইতিহাস যাই হোক না কেন, সুরটা যে ‌অনেক দেশের অনেক ভাষার মানুষের হৃদয়জয় করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ এক জলজ্যান্ত প্রমাণ যে, ধর্ম-ভাষা-জাত-বর্ণের ওপর সুরসঙ্গীত মনুষ্যত্বের মৌলিক সার্বজনীন পরিচয়গুলির একটি!

***

[পারফর্মারদের গুরুগম্ভীর ভাব দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাঁরা রেনেসাঁস বারোক সঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের ভোল ধরেছেন! ঘুমপাড়ানি লাদিনো গানের মহিলাকণ্ঠ রেকর্ডেড, জোর্ডি সাভালের প্রয়াত স্ত্রী মন্টসেরাত ফিগেরাসের।]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!