মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় প্রভাব

আজকে লিখছি মুঘল আমলের চিত্রকর্মের ওপর ইউরোপীয় প্রভাব নিয়ে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পর্তুগীজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজদের আগমন ঘটেছে, আর সে বাণিজ্যের ফলে স্বভাবতই নতুন ধ্যানধারণার মুক্তবিস্তার হয়েছে, সে ইতিহাস আজ ঢাকা পড়ে গেছে শুধুমাত্র ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক ইতিহাসের পুরু প্রলেপে। আমার বিচারে সেটা ইউরোপীয় প্রভাব পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়নের পথে একটা অন্তরায়।

মুঘল আমলে অংকিত এই চিত্রে কাগজের ওপর রঙ ও সোনার ব্যবহার। নবাব পরিচারকসহ প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৭৩০-৪০। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

প্রথম ছবিটা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্টে সংরক্ষিত। মোটরগাড়ির ব্যবসা করে বড়লোক এক শিল্পপতি চার্লস ফ্রিয়ার বিশের দশকে তাঁর সমস্ত এশিয়ান আর্ট দান করে দেন স্মিথসোনিয়ানকে। এমনকি সেগুলি রাখার জন্যে দালান বানানোর খরচটাও দিয়ে দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। বাকি ছবিগুলোর অনেকগুলিও একই স্থানে সংরক্ষিত।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রথম ছবিটি ১৭৩০-৪০এ আঁকা। অশ্বারোহী এক নবাব ফুল শুঁকতে শুঁকতে পরিচারকসহকারে প্রমোদভ্রমণ করছেন। ছবিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এতে অনেকখানি রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম উঠে এসেছে, যা মুঘলপূর্ববর্তী আমলে দেখা যায়নি। পার্স্পেকটিভ, ডেপথ অফ ফীল্ড, ধর্মীয় ও পৌরাণিক সাবজেক্ট ছেড়ে দৈনন্দিন কার্যকলাপকে ফুঁটিয়ে তোলা — এসবই ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন ব্যাপারস্যাপার। পারসিক শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় মুঘল চিত্রকলা প্রথম প্রথম সনাতনই ছিল। ন্যাচারালিস্টিক ছবি না আঁকার কারণ, অনেক শিল্পরসিক বলেন, ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ যে একেবারে প্রাণবন্ত ছবি আঁকা হলে খোদার ওপর খোদকারি করার প্রচেষ্টা হবে সেটা, আর ফলাফল জাহান্নামের আগুন!

এখন বলি রিয়ালিজমে রূপান্তরের পিছনে ইউরোপীয় মিশনারী ও মুঘলদের অবদানের কথা।

সম্ভবত বিজাপুরের শিল্পী ফররুখ বেগের আঁকা এই চিত্রে মাতা মেরি ও যীশু। ১৫৮০-১৬১৯। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

১৫৪২ সালে গোয়াতে এসে উপস্থিত হন সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের। তাঁর লক্ষ্য ছিল সেখানকার পর্তুগীজ খ্রীষ্টানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা, আর তার লেজুড় ধরে নেটিভদের কাছে ধর্মপ্রচার। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজাপুর ছিল আদিলশাহী সুলতানদের শাসিত। সেখানেও মিশনারীদের কার্যক্রম বিস্তার পায়। এর সাথে সাথে চলে আসে ধর্মীয় চিত্রকলা। যেমন, দ্বিতীয় ছবিটা বিজাপুরের ফররুখ বেগের আঁকা মাতা মেরী ও যীশুর ছবি। এ যতটা না ধর্মবিশ্বাস থেকে আঁকা, তার থেকে বেশি নতুন বিষয় নতুন ভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ফররুখ বেগ অবশ্যই এ ছবির নাম ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড দেননি, কিন্তু বিষয়বস্তু রেনেসাঁস যুগের ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তৃতীয় ছবিটিও সেরকম মুঘল আমলে করা হোলি ফ্যামিলির চিত্রায়ন। ফররুখ বেগ পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের শিল্পকলা কর্মশালার সদস্য হন।

ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে ভারতীয় শিল্পী এঁকেছেন হোলি ফ্যামিলির ছবি। সপ্তাদশ শতক। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

সম্রাট আকবর ছিলেন সকল প্রকার চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ শৈল্পিক শিখরে ওঠে। আকবর একই সাথে ছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহী, আর সুফীবাদে বিশ্বাসী। এমনকি প্রচলিত ধারার চিত্রকলার পরিবর্তনের ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল বেশ প্রগতিশীল। বিশেষ করে, তাঁর মতে চিত্রকররা যদি লাইফলাইক ছবি আঁকেও, তাদের অবশ্যই এই অনুধাবন অবশ্যম্ভাবী যে, তাদের ন্যুনতম ক্ষমতা নেই স্রষ্টার মত জড় বস্তুতে জীবন দেবার। একার্থে, এভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আত্মগরিমা পরিত্যাগ করে স্রষ্টার অপার মহিমার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব। সুতরাং চিত্রকর্ম ধর্মীয় দিক থেকেও শিক্ষণীয় একটি কাজ। এ ছিল আকবরের সুফী ঘরানার চিন্তা।

সুফী ধর্মানুরাগী আকবর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা বলে একটি সম্মেলনকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে মুসলিম-সুফী-হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের গুরুদের আমন্ত্রণ জানান। গোয়ার পর্তুগীজ জেসাইটরাও বাদ পড়লো না নিমন্ত্রণ থেকে। তারা আকবরের ধর্মীয় ঔদার্যের ব্যাপারে ভালমতই জানত। দু’জন পাদ্রী আকবরের ইবাদতখানায় গেলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তাদের আশা, আকবর কোন না কোনভাবে যীশুর দেবত্ব মানবেনই।

সে আশা গুঁড়ে বালি। আকবর তাদের থাকার জায়গা দিলেন, নিয়মিত তাদের সাথে আলোচনা করলেন। এমনকি, একটি বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধেও এদের একজনকে নিয়ে গেলেন। আকবরের বহু কৌতূহল নিবৃত করার পরও পাদ্রীদের লক্ষ্য বিফল হলো। আকবর নিজেরই এক সুফী তরিকা চালু করলেন, দ্বীন-ই-ইলাহী নামে। তাতে যীশু নয়, স্বয়ং আকবরই একরকম দেবত্বের আসনে আসীন!

কিন্তু যে তিন-চার বছর জেসাইট পাদ্রীরা আকবরের দরবারে কাটালেন, সে সময়ের মধ্যে তারা বহু মেরী-যীশুর ছবি, রেনেসাঁস শিল্পীদের মাস্টারপীসের প্রতিলিপি, ইত্যাদি আকবরকে স্বাড়ম্বরে দেখিয়েছেন। আকবরও সেসব দেখতে যাবার সময় নিজের শিল্পীগোষ্ঠীকে সাথে নিতে ভোলেননি। তাঁরাই সেসব দেখে এসে আঁকা শুরু করলেন নতুন ধরনের ছবি। সেসবে যীশুর জায়গা নিলেন মুঘল সম্রাট নিজেই।

তুলনার জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম ছবি দিলাম। এগুলি চতুর্দশ শতকের প্রাকরেনেসাঁস যুগের ইতালীয় চিত্রকর জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা ফ্রেস্কো। প্রথমটি যীশুর জন্মের চিত্র, দ্বিতীয়টি মৃত্যুর। দু’টিততেই লক্ষ্য করুন, আকাশে ফেরেশতার দল, আর পবিত্র আলোকচ্ছটা বা হেলো যীশু-মেরী প্রমুখের মাথার চারদিকে।

১৩২০ সালের আশপাশ দিয়ে আঁকা জোত্তো দি বোন্দোনের অ্যাডোরেশন অফ দ্য মেজাই। মেট মিউজিয়াম
১৩০৫ সালের আশপাশ দিয়ে জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা দ্য ল্যামেন্টেশন অফ ক্রাইস্ট। স্ক্রোভেনি চ্যাপেল

এর সাথে মেলান ষষ্ঠ ছবিটি, যাতে সম্রাট আকবরের মাথার চারপাশেও সেই একই আলোকচক্র। আর ওপরে ছবির ফ্রেমে দুই ফেরেশতা (ইতালীয় ভাষায় পুত্তি)। সন্দেহাতীতভাবে রেনেসাঁস আর্টের প্রভাব!

এই স্টাইল যে শুধু সম্রাটের ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সাত নম্বর ছবিটিতে এক মোল্লার ছবিতেও একই ব্যাপার।

১৬৫০ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের ছবি, মাথার চারপাশে ইউরোপীয় ধাঁচে হেলো।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
উনবিংশ শতকে মুঘল চিত্রকরদের আঁকা এক সুফি সাধকের ছবি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

পরবর্তী সম্রাট জাহাংগীরের সময় ভারতে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। রেনেসাঁস আর্টের সাথে কিছুটা হলেও এসে মিলে উত্তর ইউরোপীয় প্রভাব। আট নম্বর ছবিটি বাদশা জাহাংগীরের। এতে দেখানো হয়েছে সম্রাট ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বন্ধুতার প্রস্তাব পাশে ফেলে এক সুফী সন্তের নিকট থেকে পুস্তক গ্রহণ করছেন। ‘হেলো-পুত্তিও’ আছে জায়গামতই। জেমসের পোশাক-আষাকও নিখুঁত ইংরেজ।

১৬১৫ থেকে ১৬১৮এর মধ্যে শিল্পী বিচিত্রের আঁকা ছবিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির দরবারে সুফি সন্তদের স্বাগত জানাচ্ছেন। নিচে বাম কোনায় ইংরেজ রাজা জেমস অপেক্ষমান। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

নয় নম্বর ছবিটি ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের। এতে রাণী হাতে নিয়েছেন রাজদন্ড আর ‘গ্লোবাস ক্রুসিজের’। এই ব্রহ্মাণ্ডগোলক  বা সেলেস্টিয়াল অর্ব হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপক, আর ক্রসটি যীশুর। অর্থাৎ এলিজাবেথ হলেন যীশুর স্বর্গীয় রাজক্ষমতার লৌকিক প্রতিনিধি। শুধু এলিজাবেথ নয়, বহু ইউরোপীয় রাজরাজড়াদের একইরকম পোর্ট্রেট ছবি আছে।

এর সাথে মিলান দশ নম্বর ছবিটিকে। জাহাংগীর বসে আছেন চেয়ারে, এ কিন্তু পুরোপুরি ইউরোপীয় ভঙ্গিমার চেয়ার। তার ওপর, জাহাংগীরের হাতে সেই সেলেস্টিয়াল অর্ব। ব্রহ্মান্ডের প্রতীক।

আনুমানিক ১৬০০ সালে নাম-না-জানা শিল্পীর আঁকা ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ। হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারী।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইউরোপীয় ঘরানার চেয়ারে বসে আছেন, হাতে ব্রহ্মাণ্ড-গোলক। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ।

লেখা শেষ করি তিনটি মুঘল ছবি দিয়ে। এ তিনটিতেই রেনেসাঁস আর্টের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি দৃশ্যমান। এক, আলোছায়ার খেলা, এমনকি কালো পটভূমিতেও সঠিক রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর দুই, পারস্পেক্টিভ, ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ডের ইলিউশন। একটিতে নৈশকালীন হরিণশিকারের দৃশ্য, আরেকটিতে ইব্রাহীম ইবনে আদম বল্খী নামক এক আদি সুফির ধ্যানের দৃশ্য, তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা করছে ফেরেশতার দল।

আর শেষ ছবিটিতে আকবরের স্কেচ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারত কারো! অর্ধনিমিলিত চোখে আকবর বিভোর হয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন। চেহারায় খুব প্রশান্তির ছাপ। জুলফি-গোঁফ খুব পরিচর্যা করে স্কেচ করা।

রাতের আঁধারে হরিণ শিকারের দৃশ্য, এঁকেছেন মুঘল শিল্পী মীর কালান খান। অষ্টাদশ শতক।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
বলখের সুলতান ইব্রাহিম ইবনে আযাম জঙ্গলে ধ্যান করছেন, তার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছে ফেরেশতার দল। মুঘল মিনিয়েচার, অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।
মুঘল শিল্পীদের আঁকা মহামতি আকবরের স্কেচ, আনুমানিক ১৬০৫ সাল।

ফার্সী-তুর্কীদের চিত্রকর্মও এসময় নানাভাবে ইউরোপীয় আর্ট দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। মুঘলদের যাত্রা যদিও শুরু ইরানী-মধ্য এশীয় ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায়, খুব দ্রুত তারা ভারতীয় আর ইউরোপীয় উপাদান গ্রহণ করে, আর জন্ম দেয় নতুন একটি ধারার, যা পরে বিভিন্ন স্থানীয় রাজা ও নবাবদের শিল্পরস আর রুচিকে প্রভাবিত করে।

সুতরাং, কলোনিয়ালিজমের দোষ দেবার পরেও বেশকিছু পজিটিভ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সামান্যতম ক্রেডিট না দিলেই নয়!

স্টারি নাইট – ২

Featured Video Play Icon

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ়ের জন্ম নেদারল্যান্ডের এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৮৫৩ সালে। বাবা ডাচ রিফর্মড চার্চের পাদ্রী ছিলেন। ভিনসেন্টের ছোটবেলা কেটেছে কড়া ধর্মীয় অনুশাসনে। খুব একটা আনন্দময় ছিল না সেটা।

আর্ট ডীলার ফার্মের চাকরিতে আর্থিক সফলতা পেলেও বেশিদিন সেখানে মন টেকেনি ভিনসেন্টের। সেটা প্রথম প্রেমে বিফলতার কারণে, নাকি সৃজনশীলতার অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ দেখে, তা গবেষণার ব্যাপার! নতুন ঝোঁক এল ধর্মকর্মে।

বাবা-মা-খালুর পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন ভ্যান গঘ়। কিন্তু তাতে না দমে প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীর চাকরী নিয়ে পাড়ি জমান বেলজিয়ামের দরিদ্র বোরিনাঝ় এলাকায়। সেখানে কয়লাখনির মজুরদের হাঁড়ভাঙ্গা কষ্টের জীবন দেখে ভিনসেন্টের মনটা আকুল হয়ে পড়ে। কিন্তু চাকরিচ্যুত হতে বেশি সময় লাগল না। চার্চের বরাদ্দ করা আরামদায়ক বাসা এক গৃহহীনকে ছেড়ে দিয়ে নিজে থাকা শুরু করলেন কুঁড়েঘরে। চার্চের হর্তাকর্তাদের হিসাবে এ ছিল মিশনারী পদমর্যাদার অবমাননা!

তারপরও ভ্যানগঘ় থেকে যান গরিব মানুষদের মাঝখানে। তাদের দৈনন্দিন পরিশ্রমের চিত্র আঁকার জন্যে পেন্সিল-চারকোল হাতে তুলে নেন। অনুপ্রেরণা আর সাহায্য আসে স্বচ্ছল আর্ট ডীলার ছোটভাই থিওর কাছ থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দু’চোখে দেখতে না পারলেও থিওর উপদেশে ব্রাসেলসের আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেন।

ধর্ম থেকে ভিনসেন্টের মন শেষ পর্যন্ত উঠে গেল যাজক খালুর মেয়ে কর্নেলিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। সাত বছরের বড় সদ্যবিধবা কর্নেলিয়ার পিছনে এর পরেও অনেকদিন লেগে ছিলেন ভ্যান গঘ়। পরিবারের কারো মনে আর কোন সন্দেহ রইলো না যে ভিনসেন্ট ‘বদ্ধ উন্মাদ’। এ ঘটনার পরে ভ্যান গঘ় পতিতালয়ে যাতায়াত শুরু করেন! অবশ্য শিল্পবিপ্লবের যুগের ইউরোপে নানা যৌক্তিক সামাজিক কারণে এধরনের ব্যাপারস্যাপার হরহামেশা চলত।

চিত্রকলার প্রশিক্ষণ চলতে থাকলো, এবার হেগ শহরে তুতো-বোনজামাই আন্তন মভ়ের কাছে। কিন্তু সে সম্পর্কেও চিড় ধরলো ভিনসেন্টের ছন্নছাড়া জীবনযাত্রার কারণে। বাবার নতুন কর্মস্থল ন্যুনেন গ্রামে চলে আসলেন ভ্যান গঘ়। এখানে দুটো ঘটনা মোটা দাগ কাটে ভিনসেন্টের মনে। মার্গো বলে এক পড়শীকন্যার প্রেমনিবেদনে সাড়া দিলেন তিনি। কিন্তু বিয়েতে বাদ সাধলো দু’পক্ষ। মার্গো বিষ খেয়ে মরতে বসেছিলেন, ভ্যান গঘ় সময়মত তাঁকে হাসপাতালে নেয়াতে প্রাণরক্ষা হল তাঁর। এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ভিনসেন্টের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ভিনসেন্ট মনে মনে তাঁর মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী করতেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।

ন্যুনেনে থাকার সময়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভ্যান গঘ় প্রায় দু’শো তৈলচিত্র আঁকেন, যার একটা এখনকার সুপরিচিত ‘দ্য পটেটো ঈটারস’। থিও চেষ্টা করেন সেসব বিক্রি করতে। কিন্তু ছবির বিষয়বস্তু আর নিষ্প্রাণ কাঠখোট্টা রঙের কম্বিনেশন ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। থিও ভাইকে উপদেশ দিলেন উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার বাড়াতে।

একটা অপ্রীতিকর ঘটনায় দোষী সন্দেহ করে ন্যুনেনবাসীরা গ্রামছাড়া করে ভ্যান গঘ়কে। বন্দর শহর আন্টওয়ের্প হয় তাঁর পরবর্তী গন্তব্য। জাহাজীদের কাছ থেকে কেনা কিছু জাপানী উডকাট ভিনসেন্টের ভীষণ মনে ধরে। সেসবের কপি এঁকে রঙের কম্বিনশনের প্র্যাকটিসটা আরো জুঁতসই হয় তাঁর। একই সাথে আন্টওয়ের্পের ফাইন আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন, পাশও করেন। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে অঙ্কনশৈলী নিয়ে বচসা বেঁধে যায়। তারপর সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে ফ্রান্সের পার়িতে থিওর কাছে চলে যান তিনি।

পার়ি ছিল ভ্যান গঘ়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। সারা বিশ্বের আর্ট ক্যাপিটাল সেসময় নিউ ইয়র্ক নয়, ছিল পার়ি। থিওর সুবাদে ফের়নঁ কর়মোনের আর্টস্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। আর সে সুযোগে পরবর্তীকালের খ্যাতিমান অনেক চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচয়-বন্ধুত্ব হয় তাঁর। এঁদের মধ্যে ছিলেন এমিল বেরনার্, অঁর়ি দ্য তুলুজ়-লোত্রেক, কামিয়্যি পিসার়ো, ঝ়র্ঝ় স্যর়া, পোল সিনিয়াক, আর, হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে, পোল গোগ্যাঁ। ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের পাশাপাশি স্যরা়র বিশেষত্ব পোয়াঁতিয়িস্মে হাতে-খড়ি হয় ভ্যান গঘ়ের।

পার়ির পার্টি লাইফে ভিনসেন্টের হাঁপ ধরতে বেশিদিন লাগলো না। ভাইয়ের সাথেও লেগে যাচ্ছিল প্রায়! ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ‌অজুহাতে ভ্যান গঘ় এবার পাড়ি জমালেন দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট্ট আর্ল শহরে। ভাবলেন, বন্ধু চিত্রশিল্পীদের নিয়ে সেখানকার নির্জনতায় একটা আর্ট কলোনি চালু করবেন। ভূমধ্যসাগরীয় আরামদায়ক আবহাওয়া আর নয়নাভিরাম সিনারিও তাঁর আঁকাআঁকির রঙের জেল্লা খুলে দিল। দুই বছরের কম সময়ে দু’শরও বেশি ছবি আঁকলেন। স্টারি নাইট নিয়ে হাত পাকানোও এসময়ে। র়োন নদীতীর আর কাফে টেরাসের ওপর তারকাখচিত আকাশ নিয়ে দু’টো স্টারি নাইট এসময়েই আঁকা।

সব ভালই চলছিল। আর্লের অধিকাংশ বাসিন্দা বিদেশী লালচুলো ভিনসেন্টকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেও দু’একটা বন্ধু ঠিকই জুটেছিল তাঁর, যার একজন পোস্টম্যান রুল্যাঁর ছবি এঁকে দিয়েছিলেন তিনি।

সমস্যার শুরু হলো যখন থিওর অনুরোধে পোল গোগ্যাঁ এসে হাজির হলেন ভ্যান গঘ়ের তথাকথিত আর্ট কলোনির দ্বিতীয় সদস্য হিসাবে। প্রথম কয়েকদিন ভালই কাটল, দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু ছবি আঁকলেন। কিন্তু গোগ্যাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ভ্যান গঘ়ের পুরোপুরি বিপরীত। দাম্ভিক তো ছিলেনই, পার়ির আরামদায়ক বিলাসী জীবন ফেলে আর্লে এসে ভিনসেন্টের সাথে গরীবী হালে জীবনযাপনও তাঁর মনঃপূত হলো না। ভিনসেন্টকে তাচ্ছিল্য করতেও তাঁর বাঁধলো না। ভিনসেন্টও সহজ পাত্র নন। গোগ্যাঁকে শুরুতে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখলেও শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে পারলেন না অতিরিক্ত সংবেদনশীল ভ্যান গঘ়। ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। ভ্যান গঘ়ের মানসিক অবস্থারও অবনতি হওয়া শুরু করলো।

১৮৮৮র বড়দিনের দু’দিন আগে এক ঝড়ো রাত। ভিনসেন্ট আর পোলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। ভিনসেন্ট ছুরি বের করে পোলকে শাসানো শুরু করলেন। পোল ভিনসেন্টের মুখের ওপর হয়ত বলে ফেললেন যে তিনি আর্লে আর এক দন্ডও থাকবেন না। এই জিনিসটারই ভয় করছিলেন যে ভ্যান গঘ়! যে গোগ্যাঁ তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। তাঁর অন্যান্য সব ব্যর্থতার মত আর্ট কলোনির স্বপ্নটারও অকাল সমাধি হবে। হয়ত মনে মনে ভিনসেন্ট একাকীত্বেরই ভয়ে ছিলেন। তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল ভ্রাতৃতুল্য কোন চিত্রকর তাঁকে সঙ্গ দেবে, অনুপ্রেরণা দেবে, আর তাঁর আঁকা ছবি দেখে বুঝবে তাঁর মনের ভাষা।

এরপর ঠিক কি হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই।কাটা বাম কানটা কাগজে মুড়ে ভ্যান গঘ় দিয়ে এসেছিলেন শহরের পতিতালয়ে এক মেয়ের হাতে। নতুন গবেষণায় বেরিয়েছে সে মেয়ে রেচেল দুশ্চরিত্রা ছিল না, ছিল কর্মচারী মাত্র। ভ্যান গঘ়ের সাথে বন্ধুত্ব ছিল তার। (বাজারে প্রচলিত আছে এক প্রস্টিটিউটকে প্রেম নিবেদন করে ছ্যাঁকা খেয়ে ভ্যান গঘ় কানকাটা হন, সেটা খুব সম্ভব সত্য নয়!)

এ ঘটনার পরে আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি ভ্যান গঘ়। থিও তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করেন। কাছের সাঁরেমি শহরে এক পাগলা গারদে ভর্তি হন ভিনসেন্ট। নামে অ্যাসাইলাম হলেও জেলখানার থেকে খুব একটা তফাৎ ছিল না সেটার। চলাফেরার না হলেও আঁকাআঁকির স্বাধীনতা সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে দেয়া হয়েছিল। এ সময়েই আধ ঘোরে আধ জাগরণে শেষ স্টারি নাইটটা আঁকেন তিনি। বিষণ্ণতা আর হ্যালুসিনেশনে ভুগতে ভুগতে আরো বেশ কিছু বিখ্যাত ছবি এসময়ে আঁকেন ভিনসেন্ট।

একটু সুস্থ বোধ করা শুরু করলে সাঁরেমি ছেড়ে চলে যান ওভ়ের়-স্যুর়-ওয়াজ় শহরে। পোল গাশে বলে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের নাম শুনেছিলেন পিসারোর কাছ থেকে। সে ভদ্রলোক অনেক নামীদামী শিল্পীদের আপ্যায়ন করতেন, আর চিকিৎসা দিয়ে, সঙ্গ দিয়ে মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের সাহায্য করতেন। এখানে এসে ভ্যান গঘ় প্রায় সত্তরটা ছবি আঁকেন। ‘থ্যাচড কটেজেস বাই আ হিল’ বলে এখানে আঁকা অসমাপ্ত একটা কাজ — তিন গোয়েন্দার পুরনো শত্রু গল্পের কটেজ পেইন্টিংয়ের সাথে এর সন্দেহাতীত মিল।

প্রথম প্রথম ভাল বোধ করলেও মনে এতকালের যত ক্ষত নিয়ে এসেছিলেন ভ্যান গঘ়, ডাক্তার গাশের কাছে তার কোন প্রতিষেধক আসলে ছিল না। মলমের ক্ষণস্থায়ী প্রভাব কেটে যেতে ভ্যান গঘ় সম্ভবত আবার বিষণ্ণতা, একাকীত্বের ছোবলে দুর্বল হতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত ১৮৯০এর ২৭শে জুলাই রিভলবার দিয়ে নিজের হৃদয় বরাবর গুলি চালিয়ে দেন। বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুশয্যায় ঢলে পড়েন ভিনসেন্ট। হয়ত স্টারি নাইটের সাইপ্রেস বেয়ে তাঁর আত্মা পৌঁছে যায় স্বর্গপিতার কাছে, শেষ শান্তির নীড়ে!

ভাই থিওও এরপর বেশিদিন বাঁচেননি! ভিনসেন্টের মৃত্যুর ছয় মাস পর ৩৩ বছর বয়সে তাঁরও ডাক চলে আসে। হয়ত তিনি ভিনসেন্টের নন, ভিনসেন্টই তাঁর খুঁটি ছিলেন। যত্ন করে বড়ভাইয়ের যে চিঠিপত্র রেখে দিয়েছিলেন থিও, তার থেকেই আমরা আজ ভিনসেন্টের ব্যক্তিগত জীবন আর মানসিক অবস্থার অনেক বিস্তারিত খুঁটিনাটি জানতে পারি।

ভিনসেন্ট কি রোগে ভুগেছিলেন সে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেক রকম থিওরি আছে, যার শুরু হ্য়ত বাইপোলার ডিজ়অর্ডার দিয়ে, আর শেষ টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি দিয়ে। ডন ম্যাকলীনের গানের মত আমার ভাবতে ইচ্ছে করে ভ্যান গঘ় আসলে অসুস্থ ছিলেন না। তাঁর মানসপটে পৃথিবী ও মানুষ ছিল অন্যরকম, অনেকটা তাঁর ছবির প্যালেটের মত। তাঁর সাথে অনেকেরই খাপ খায়নি, ঝগড়া বেঁধেছে। কিন্তু খেটে খাওয়া দুর্ভাগা মানুষের পাশে দাঁড়াতে তো তাঁর কখনো বাঁধেনি। তাঁর প্রথাবিরোধী স্বভাব আর বিদেশী পরিচয়কে অনেক স্বদেশী, ফরাসী সন্দেহের চোখে দেখেছে। তারপরও তো নানা শহরে-গ্রামে তাঁর হাতে গোনা হলেও বন্ধু জুটেছে। ভ্যান গঘ়ের কোন মানসিক বিকৃতি ছিল না, তাঁর মন ছিল পরিষ্কার। সেখানে মানুষের আচার, ধর্ম, ধন, সামাজিক অবস্থান তাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় না। গরিমা-লালসা-ছলনার স্থান নেই সেখানে। সেখানে ঈশ্বর পথহারা দুর্ভাগাদের নিশ্চিত শেষ আশ্রয়! শিল্পের অনুপ্রেরণা সেখানে খ্যাতি কিংবা অর্থ নয়, বরং অনন্যোপায়ের মর্মপ্রকাশের একমাত্র উপায়! আর সেই নিষ্কলুষ চিত্তেই পরিপূর্ণরূপে অনুভব করা সম্ভব নীল-হলদে স্টারি নাইটের মাহাত্ম্য!

স্টারি নাইট – ১

ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই গোগ্রাসে গিলতাম। প্রথম পড়েছিলাম কাকাতুয়া রহস্য। পরের দিকে পুরনো শত্রু। হয়ত সমবয়সী কারো কারো মনে পড়বে দু’টোরই কাহিনী মূল্যবান চিত্রকর্ম নিয়ে।

পুরনো শত্রুতে একই কটেজের কুড়িটি পারসপেক্টিভ থেকে আঁকা ছবি দিয়ে রহস্যের শুরু। আর রহস্যাবৃত যে চিত্রকরের বেগুনী পাহাড় আর নীল ঘোড়ার অদ্ভূত মাস্টারপীস দিয়ে কাহিনীর শেষ, তার অনুপ্রেরণা ভ্যান গঘ় ছাড়া আর কেউ নন! (ডাচ ভাষায় নামের উচ্চারণটা কিন্তু যথেষ্ট কঠিন — ফান ঘ়ুফ়!)

ভ্যান গঘ়ও সিরিজ়ে ছবি আঁকতেন। এদের মধ্যে সবচে’ পরিচিত হলো বিভিন্নভাবে আঁকা ফ্লাওয়ারভাজ়ে সাজানো সূর্যমুখীর সিরিজ়টা। তিন গোয়েন্দা কাহিনীর কল্পিত আর্টিস্ট ফ্রাঁসোয়া ফরতুনারের মত তাঁরও কয়েকটি চিত্রকর্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমার আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। ভ্যান গঘ়ও শারীরিক আর মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা।

কিন্তু স্টারি নাইট নামে গানটায় ডন ম্যাকলীন ভ্যান গঘ়ের বিভিন্ন চিত্রকর্মের বর্ণনা দেয়ার সাথে সাথে তাঁর মননশীলতাকে খুবই সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গানের কথায় বুঝবেন যে এই প্রতিভাবান শিল্পী মানসিক রোগী মোটেও ছিলেন না! অনেক সংবেদনশীল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কপালের ফেরে একাধিক প্রিয়জনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ভাই থিও আর বোন উইল বাদে পরিবারের আর সবাই তাঁকে পাগল ঠাউরাতো। ভ্রাতৃতুল্য চিত্রকর ও চিত্ররসিকদের কাছেও যে সম্মান-স্বীকৃতি আশা করেছিলেন, জীবদ্দশায় তা পাননি। নিজের কাছে তিনি ছিলেন ব্যর্থতার চূড়ান্ত। তারপরও তাঁর রংতুলি এঁকে গেছে সমানে, কারণ এই একটা জিনিসেই তিনি পারতেন নিজের মনের অবস্থা সুক্ষ্ণভাবে তুলে ধরতে।

ভ্যান গঘ় যে ধারার শিল্পী ছিলেন তাকে বলে পোস্ট-ইমপ্রেশনিজ়ম। তাঁর আগের প্রজন্মের ইমপ্রেশনিস্টরা ছিলেন প্রকৃতি ও মানুষের দক্ষ পর্যবেক্ষক। সুচিকন তুলির সাহায্যে তেলরঙে জীবন্ত করে তুলতে পারতেন যেকোন দৃশ্যকে। তাদের মনোযোগ ছিল নিখুঁত প্রতিলিপি তৈরিতে। এর সবচে’ বড় উদাহরণ ক্লোদ মোনের ওয়াটার লিলিজ় সিরিজ়, নিউ ইয়র্কের মিউজ়িয়াম অফ মডার্ন আর্টে (মোমা) দেখেছি তার কয়েকটা।

পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্টরা ছিলেন সনাতন ইমপ্রেশিনজ়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোভাগে। তাঁরা বললেন, নিখুঁত প্রতিলিপি দেখতে ভাল, কিন্তু মানুষের মন আর আবেগকে সমুচিত নাড়া দেয় না। শিল্পীর মানসপটে একটা দৃশ্য কী অনুভূতি জাগ্রত করেছিল তা আঁকতে হলে চাই রং আর কাঠামোর পরিবর্তন। তাঁরা মোটা তুলি ধরলেন, বাঁছাই করলেন এমনসব রংয়ের কম্বিনেশন, যেগুলি সনাতনরা দেখে সংয়ের পোশাক বলে গালি দিবেন। কিন্তু তাঁদের সাহসী রংতুলিতে যেসব ছবি ফুঁটে উঠলো, সময় লাগলেও রসিকরা বোঝা শুরু করলেন সেগুলির মর্যাদা। ততদিনে ভ্যান গঘ় মনের বোঝা সইতে না পেরে ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছেন।

পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আর্টের একটা সুন্দর উদাহরণ ভ্যান গঘ়ের স্টারি নাইট বলে সাঁ-রেমি শহরের রাতের দৃশ্যের ছবি। মোমাতে এটি সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর একটা প্রতিলিপিও পোস্টার আকারে ঝুলছে আমার ঘরে। এতে যে দৃশ্য ভ্যান গঘ় এঁকেছেন, সেটা কিন্তু তাঁর পাগলা গারদের জানালা থেকে দেখা। ১৮৮৮এর কানকাটার ঘটনার পরের বছর ১৮ই জুন তিনি এটি আঁকা শেষ করেন। (ঘটনাচক্রে তার ঠিক ৯০ বছর পরে আমার জন্ম!)

স্টারি নাইটের দৃশ্যটি পার্থিব নয়। কোন তারাজ্বলা রাতে এরকম প্রুশিয়ান ব্লু আকাশে ইন্ডিয়ান ইয়েলো রঙের তারা, সেগুলি আবার বিশাল আকারের — এসব দেখতে পাবেন না। তার মাঝখানে আবার একটা ঘূর্ণাবর্তের ছবি।

কিন্তু চোখটা বন্ধ করে ভাবুন আপনি দক্ষিণ ফ্রান্সে। যদি সেথায় না গিয়ে থাকেন, ভাবুন আপনি উত্তরবঙ্গের কোন মফস্বল শহরে, যেখানে ঢাকার কংক্রীট-জঙ্গল নেই। তারাভরা পরিষ্কার আকাশ। ফ্রান্সের গ্রীষ্মকাল, হয়ত আমাদের শরৎ বা হেমন্ত। আরামদায়ক আবহাওয়া, ঝিরঝিরে বাতাস। মনটাকে ছেড়ে দিন। আপনার কল্পনার জগতে যে অনুভূতিটা আসবে, স্টারি নাইট ঠিক সেটাই তুলে ধরেছে। ঘূর্ণাবর্তটা হতে পারে দক্ষিণ ফ্রান্সের ঝড়ো মিস্ত্রাল বায়ুর চিত্ররূপ, আবার হতে পারে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। আপনি ভেবে নিতে পারেন অকাল কালবৈশাখীর পূর্বাভাষ। কোনটা যে কি বস্তু সেটা জরুরী নয়, আপনার মনে যে অনুভবটা আসছে ছবিটি দেখার পরে, সেটাকে যথোপযুক্ত প্রাণ দেয়াটাই ভ্যান গঘ়ের অভিপ্রায়!

এর মধ্যেও চিত্রশিল্পের বেসিক নিয়মগুলি মেনেছেন ভ্যান গঘ়। সাইপ্রেস বৃক্ষের ঊর্ধ্বমুখী অবয়বকে ব্যালেন্স করেছেন ছোট্ট আর্ল শহরের ভূসমান্তরাল বিস্তৃতি দিয়ে। শহরের চার্চের চূড়াটাও বাস্তবের আর্লের থেকে আলাদা, সেটার শৈলী ভ্যান গঘ়ের কৈশোরের বাসস্থান নেদারল্যান্ডের ধাঁচে। অর্থাৎ চিত্রকর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত।

কিছুটা আধ্যাত্মিক সিম্বোলিজ়মও আছে। সাইপ্রেসকে মেডিটেরেনিয়ান কালচারে ধরা হয় পরকালের প্রতীক হিসাবে। আর হলুদ রং হলো জীবনের প্রতীক। সাইপ্রেস গাছকে বাহন বানিয়ে ভ্যান গঘ় যেন যেতে চাইছেন স্বর্গালয়ে। তাঁকে বুঝবার, তাঁর আত্মাকে শান্তি দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র স্বর্গপিতারই আছে।

হলুদ আর প্রুশিয়ান ব্লুর কম্বিনেশনটা কিন্তু অনেক প্রাচীন। প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন শিল্পকর্মে লাপিস-লাজ়ুলি নামের নীলরত্ন আর হলদে সোনার বিস্তর ব্যবহার হত। ফারাও তুতানখামেনের মমিমুখোশ তার সবচে বিখ্যাত উদাহরণ। মধ্যযুগে যীশুখ্রীষ্টের বাইজ়্যান্টাইন চিত্রেও এধরনের কালার কম্বিনেশন রয়েছে।

জীবদ্দশায় কেন বিখ্যাত হননি ভ্যান গঘ়? তার মূল কারণ, চিত্রকর্ম আঁকার লক্ষ্য তাঁর কাছে অর্থ উপার্জন কিংবা খ্যাতির প্রলোভন ছিল না। তিনি আঁকতেন কারণ তাঁর কাছে সেটাই ছিল তাঁর মনের অনুভূতি যোগাযোগের উপযোগ্য মাধ্যম। তাঁর টেকনিক-কম্পোজ়িশন কাউকে খুশি করার জন্যে নয়, নিজের আত্মতুষ্টির জন্যে। সেকারণেই বোধহয় এখন তাঁর চিত্রকর্ম সমসাময়িক পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্টদের তুলনায় অনেক বেশি দরে নিলামে বিক্রি হয়।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!