রূপকথার শহর জাফা

এক বছর আগের সূর্যাস্তের স্মৃতি — ইজরাইলের তেল আবিব শহরের নিকটস্থ পুরনো জাফা শহরতলীতে। পর্যটকদের জন্যে পাথরে তৈরি পুরনো সব ঘরবাড়ি, দুই তিন তলা সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অলিগলি সব অক্ষত রাখা হয়েছে।

সারি বেঁধে তিন চারটে কামান সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখা। অটোমান তু্র্কী আমলের সিটাডেলের প্রতিরক্ষাব্যূহের অংশ। ১৭৯৯ সালে স্বয়ং নাপোলেওনের জাহাজবহর সে প্রতিরক্ষাভেদ করে জাফা শহরে সফল আক্রমণ চালায়।

ঊনবিংশ শতকে স্থানীয় ও নবাগত অভিবাসী ইহুদীরা যখন অনতিদূরে তেলআবিব শহরের গোড়াপত্তন করছে, তখন জাফা নগরী কমপক্ষে ৩৭০০ বছরের পুরনো। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী জাফার বন্দর থেকেই ইউনুস নবী — বাইবেলের জোনাহ — সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে বৃহৎকায় মাছের পেটস্থ হন।

মিশরের নিউ কিংডম আমলেও জাফা ছিল কৌশলগত একটি অবস্থান। সেসময়ের জাফাকে ঘিরে একটি ঘটনাই হয়তবা রূপকথার পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আরব্যরজনীর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পটি। খ্রীষ্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে ফারাও তৃতীয় তুথমোসের শক্তিমান সেনাপতি জেহুতি ইজরাইল-কানানের স্বাধীন নগররাজ্যগুলোর ওপর সাম্রাজ্য কায়েম করেন। তখনো ইহুদী রাজ্য ইজরাইল-জুদার গোড়াপত্তন হয়নি। মিশরীদের তদকালীন শত্রু ছিল উত্তরে তুরস্কের হিট্টাইটরা। ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের নগররাজ্যগুলি দুই সাম্রাজ্যের মাঝে এক রকম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




জাফা দখলের জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন জেহুতি। নগরপতিকে নিজের ক্যাম্পে দাওয়াত করে নিয়ে এসে আটকে ফেলেন। তারপর দু’শ সৈন্যকে গমের বস্তার মত সাজিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে দুর্গের দরজায় পাঠানো হয়। ঘোষণা করা হয়, রাজ্যপালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন জেহুতি। আর নগরবাসীদের উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে গাধায় করে। উল্লসিত জনগণ দরজা খুলে গাধার কাফেলাকে বরণ করে নেয়ার পর রূপকথার চিচিঙ ফাঁক!

এ গল্প রয়েছে মিশরে প্রাপ্ত বিখ্যাত হ্যারিস প্যাপিরাস ৫০০তে, যেটি এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। প্রাক-আধুনিক যুগেই এই প্যাপিরাসসহ অনেক বস্তু মিশরীয় কোন না কোন রাখাল খুঁজে পেয়ে বিক্রি করে দেয় ইউরোপীয় ধনাঢ্য সংগ্রহকারীর কাছে।

বর্তমান জাফায় রয়েছে অটোমান যুগের বহু নিদর্শন। কিছুই ধ্বংস করা হয়নি। একটা ক্লক টাওয়ার। লাইটহাউজ, জেলখানা — সেটি এখন ফাইভস্টার হোটেল। তিনটা মসজিদঃ মাহমুদিয়া মসজিদ, আল বাহর মসজিদ, আজামি মসজিদ। সবগুলি সাগরতীরে প্রাইম প্রপার্টিতে। আরো আছে সেন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চ, সেন্ট অ্যান্টনিস ম্যারোনাইট চার্চসহ অগণিত ছোটবড় গীর্জা-ক্যাথেড্রাল। এগুলিতে উপাসনা করে মূলত আরব ফিলিস্তিনীরাই। বিশেষত লেবাননী আরবরা ম্যারনাইট তরিকার খ্রীষ্টান। এতগুলি চার্চ থাকার কারণ, যীশু খ্রীষ্টের অন্যতম শিষ্য সেন্ট পিটার নাকি এখানে মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার মাজেজা ঘটিয়েছিলেন।

রূপকথা আর মাজেজার শেষ এখানেই নয়। বন্দর থেকে সামান্য দূরে সাগরের বুকে জেগে থাকা একটা বড় পাথরের নাম অ্যান্ড্রমেডা রক। গ্রীক মিথে জাফার রাজা সিফিয়াস, তার কন্যা অ্যান্ড্রমিডা — যার নামে একটা গ্যালাক্সির নাম। আর তার বউ ক্যাসিওপিয়া — যার নামে একটি তারকামন্ডলের নাম। সিফিয়াস গর্ব করত এ দুজন নাকি জলকন্যাদের থেকেও রূপবতী। জলকন্যারা তাদের বাপ দেবতা পসাইডনের কাছে বিচার দিলে পসাইডন বিশাল এক সমুদ্রদানব পাঠিয়ে জাফাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তখন অনন্যোপায় সিফিয়াস শহরবাসীদের সাথে ষড় করে ঠিক করেন পসাইডনের কাছে বলি দিতে হবে অ্যান্ড্রমিডাকে। তারপর এই পাথরেই শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা হয় অ্যান্ড্রমিডাকে। তাকে দানবের হাত থেকে বাঁচায় পার্সিয়াস — গ্রীক মিথের অন্যতম হিরো।

রূপকথার এ নগরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে এসব খেলে গেল মাথার ভেতরে। রোমহর্ষক ব্যাপার! আধুনিক কালে ফিরিয়ে আনল মোটে চৌদ্দশ বছরের পুরনো আযানের ধ্বনি। মাগরিবের পরে দেখা গেল বহু আরব মুসলিম নরনারী — অনেকে আবায়া পরে — সাগরতীরে হাওয়া খাচ্ছে, সেলফি তুলছে। এসইউভির নাম্বারপ্লেট ওয়েস্ট ব্যাংকের। কে বলবে মোটে এক ঘন্টার রাস্তার ওপারে পবিত্র ভূমি নিয়ে এরা এবং এদের প্রতিবেশীরা বাস করছে অনিশ্চয়তার অন্য এক জগতে?



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!