বায়তুল মাকদিস – ২

জুম্মার নামাজের পর বায়তুল মুকাদ্দাসে নারী-পুরুষের আর কোন ভেদাভেদ নেই। কুব্বাত আস সাখরার “মহিলা” অংশে এসে ঢুকছে তীর্থযাত্রীর দল। মসজিদুল আকসার ভেতরেও মহিলাদের ঢোকার কোন বাঁধা নেই। ছবি উঠাচ্ছে সকলে। চলছে গাইডদের ধারাভাষ্য। ভিড় আছে কিন্তু গায়ে লাগালাগির মত নয়।

কুব্বাত আস সাখরার প্রবেশে এক মুরুব্বী শ্রেণীর মানুষ তদারকি করছে। জুতা খুলে ব্যাগে ভরে নিলাম। ভেতর থেকে বেরুচ্ছে মহিলা মুসল্লীর দল। কেউ কেউ তখনো ভেতরে প্রার্থনারত। তার মধ্যেই চলছে জনতার সমাগম।

বাইরে থেকে এই ডোম অফ দ্য রক দেখতে যতটা অসাধারণ, ভেতর থেকে আরো বেশি। এই কম্পাউন্ডের সবচে আদি স্থাপনা এই গম্বুজসহ আটকোনা দালান — যেটা ছিল প্রথম কিবলা, তার পার্শ্ববর্তী কুব্বাত আস সিলসিলা (ডোম অফ দ্য চেইন) আর দক্ষিণপশ্চিমের মসজিদুল আকসা।

এগুলি ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয় উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাকি সব তৈরি হয়েছে পরবর্তী মুসলিম ফাতিমী-মামলুক-আইয়ুবী-অটোমান প্রভৃতি বংশের শাসনামলে। একেকটি সময়ে যুক্ত হয়েছে নতুন-পুরনো বিশ্বাসের নানা লেজেন্ড, সাথে স্থাপনা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ভবনগুলির ভিত্তি ও কাঠামো আদি উমাইয়া আমলের হলেও আদি অলংকরণ বিশেষ একটা অবশিষ্ট নেই। যেমন, সোনালী যে গম্বুজ দিয়ে সকলে এটিকে চেনে সেটির বয়স বেশি নয়, ষাটের দশকে জর্দানী কর্তৃপক্ষ সে সংস্কারটা করে। আগে সীসার আচ্ছাদন ছিল। বাইরের আটটি দেয়াল ও চারটি প্রবেশদ্বারে নানা রঙের আরাবেস্ক নকশা আর কুরআনের আয়াত লেখা।

ডোম অফ দ্য রকের একেকটি স্তম্ভ মার্বেলে তৈরি। দেয়ালের প্রায় সর্বত্র মার্বেলের ব্যবহার। মোজাইক টাইল দিয়ে তৈরি নকশা বসানো। স্তম্ভগুলি গ্রীক আয়োনিয়ান বা ডোরিক ধাঁচের। মোজাইক ও গ্রীক কলাম উভয়েই মূলে পশ্চিমা শিল্প। এর কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ের সময় এ এলাকার অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বণিক, স্থপতি ও শিল্পীরা সকলেই ছিল বিজ্যান্টাইন ঐতিহ্যের অনুসারী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। যাযাবর আরব মুসলিমদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আব্বাসী খিলাফতের আগ পর্যন্ত ধর্মান্তরকরণের খুব একটা ইনসেন্টিভ ছিল না।

ডোমের ভেতরেও ইসলামী শৈল্পিক কারুকার্য ভর্তি সর্বত্র। এখানেও বিজ্যান্টাইন প্রভাব চোখে পড়ার মত। বিশেষত, রঙীন কাঁচে তৈরি জানালা, যেগুলি এখনো প্রাচ্য-প্রতীচ্যের গথিক ঘরানার চার্চগুলিতে দেখা যায়, শুধু সেসবে যীশু-মেরীর অবয়বঅংকিত। ডোমের ভেতরে দুটো চক্র, একটা বাইরের অষ্টভূজ দেয়াল ধরে, আরেকটা চার কলামের মাঝে স্থাপিত সাখরা পাথর ঘিরে। গম্বুজটি ঠিক সাখরার ওপর। কোন দেয়াল ফাঁকা নেই, সব জায়গায় নীল-সোনালী, লাল-সবুজ-সোনালী অলংকরণ। কোথাও ভাসের চিত্র, কোথাও লতানো গাছ, কোথাও অ্যাবস্ট্রাক্ট আরাবেস্ক। তার মাঝে কনট্রাস্ট উজ্জ্বল রঙের স্টেইনড গ্লাসের জানালা।

কোন কোন কলামের নিচে কুরআনভর্তী বুকশেল্ফ। ধার করে পড়ার জন্য এমন প্রার্থনাপুস্তক দেখেছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনেও, আর তার লাগোয়া সিনাগগে। গম্বুজের ঠিক নিচে ভেতরের সার্কলে আধুনিক আরবী ক্যালিগ্রাফিতে আয়াতুল কুরসি লেখা। আর বাইরের অষ্টভূজের ভেতর অংকিত সার্কলে প্রাচীন কুফী হরফে প্রতিষ্ঠাতা-প্রতিষ্ঠাসাল এগুলি লেখা। এই লেখাটি একেবারে আদি সময়ের। কুফী হরফে যের-যবর-পেশ যেমন নেই, নেই নুক্তাও। কালিমার পাশাপাশি কুরআনের কয়েকটি আয়াত একটু আনকনভেনশনাল উপায়ে জোড়াতালি লাগিয়ে একটি মেসেজ দেয়া হয়েছে। বর্তমান যুগে এমন জোড়াতালি লাগানোটা সম্ভবত মূলধারা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মালিকের নামটিকে বিকৃত করে অবশ্য আব্বাসী খলিফা আল মামুন নিজের নাম বসিয়েছিলেন। কিন্তু তারিখটা পরিবর্তন করেননি। আব্দুল মালিক কুরআনের যে সকল আয়াত বেঁছে এখানে বসিয়েছেন, তার মূল কথা কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট বা হযরত ঈসা (আ) কে নিয়ে। সে অনুযায়ী যীশু কেবল মর্ত্যলোকের মানুষই ছিলেন, একক খোদার বাণী নিয়ে এসেছিলেন। খোদা এক, তার অন্য কোন রূপ নেই প্রভৃতি। নির্দ্বিধায় বলা যায় এ মেসেজটা তখনকার খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস খন্ডনের জন্যে। আর একই সাথে ইসলামে ঈসা (আ) এর পাকাপোক্ত সম্মানের আসনটি দেখানোর জন্যে। সে আমলে কিন্তু মুসলিমদের মত আরো একটি খ্রীষ্টান গ্রুপ ছিল যাদের যীশু সম্পর্কে ধর্মীয় দর্শন প্রায় এক ছিল। এদের নাম মনোফিজাইট, যীশুর একটিমাত্র রূপেই যারা বিশ্বাস করে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পাথরটির পাশে একটি টংয়ের মত জায়গা, তাতে হাত ঢোকানোর একটা ফোঁকর। সেখানে হাত ঢুকিয়ে পাথরটি স্পর্শ করা যায়। হয়তবা বহু শতকের কোটি কোটি হস্তস্পর্শ পড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল আকারের ছাঁপ। যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, লেজেন্ড অনুযায়ী এ ছাঁপটি নাকি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পায়ের ছাঁপ, স্বর্গারোহণের সময় এখানে পদচিহ্ন ফেলে যান। আবার অনেকে বলছে ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) এর হাতের ছাঁপ, পাথরটি মুহাম্মদ (সা) কে অনুসরণ করে উপরে উঠে যাচ্ছিল বলে নাকি সেটা ধরে থামিয়ে দেন। এসব অবশ্য মূলধারার বিশ্বাসে নেই।

পাথরটি উপরে উঠে যাবার কারণেই নাকি তার ঠিক নিচে একটি ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। সে গুহাটি এখনো বিদ্যমান। এর নাম “ওয়েল অফ সোলস।” পৃথিবীর অন্তিমকালে নাকি এখানে এসে জড়ো হবে সকল মৃতদের আত্মা। একটা সিঁড়ি বেয়ে সেই গুহার ভেতরে গেলাম। পুরুষ-মহিলাদের জন্যে আলাদা করে নামাজ পড়ার জায়গা সেখানে। স্বল্প জায়গার মধ্যে নামাজ কিংবা কোরআন পড়ছে অনেকে। স্বভাবতই আধভূঁতুড়ে আধ্যাত্মিক একটা আবহাওয়া।

ডোম অফ দ্য রক থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে কয়েকশ গজ হেঁটে পৌঁছলাম মসজিদুল আকসায়। মসজিদটির গম্বুজ রূপালী রঙের। এর ভিত্তি আর কাঠামো আদি যুগের হলেও এর কলাম, বাইরের ফাসাদ, ভেতরের কারুকার্য আরেকটু আধুনিক। বিশেষ করে ফাসাদের স্থাপত্য মধ্যযুগীয় ফাতিমী শৈলীর সাথে মেলে, অনেকটা ইউরোপীয় গথিকের মত। মসজিদের ভেতরটাও অসম্ভব সুন্দরভাবে অলংকৃত, অটোমান প্রভাব দৃশ্যমান। এখানে বলে রাখা ভাল, জেরুজালেমে খ্রীষ্টান ধর্মালয়গুলিতেও এমন অলংকরণের ঐশ্বর্য আছে। কিন্তু সে তুলনায় সিনাগগ আর ইহুদী তীর্থস্থানগুলি বেশ সাদামাটা।

এই দুই বড় ভবনের পর সবচেয়ে বড় স্থাপনাটি হচ্ছে কুব্বাত আস সিলসিলা। ডোম অফ চেইনস। এটিও আব্দুল মালিকের তৈরি। ডোম অফ দ্য রকের ছোট প্রোটোটাইপ ভার্শন বলা চলে একে। এর তাৎপর্য ঠিকমত জানা নেই। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনী অনুযায়ী নাকি এখানে একটি চেইন ঝোলানো ছিল, যেটা দৈব প্রক্রিয়ায় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর তফাত করতে পারত। কিং ডেভিড বা দাউদ (আ) সেটিকে ব্যবহার করে ন্যায্য রায় দিতেন। পরে ঘটনাচক্রে সেটি স্বর্গে ফিরে যায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আব্দুল মালিক এই চেইনের ব্যাপারটাকে হয়ত একটু ব্যবহার করতে চেয়েছেন নিজ শাসনকে বৈধতা দিতে। ইসলামের সে সংঘাতময় সময়ে তার বিপরীতে খলীফা ছিলেন আরো দু তিনজন, মক্কা-মদীনার দখল তার হাতে ছিল না। জেরুজালেমের দাউদ-সুলায়মানের লেগ্যাসি দাবি করে তিনি স্বরাজ্যের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করেন। এক ছেলের নামও রাখেন সুলায়মান। হয়ত বাব আস সিলসিলা আর কুব্বাত আস সিলসিলার চেইনের ব্যাপারটা ডেভিড-সলোমনের বংশপরম্পরার ধারাবাহিকতা দাবি করার গূঢ় উদ্দেশ্য।

এছাড়া রয়েছে ডোম অফ দ্য অ্যাসেনশন, কুব্বাত আল মি’রাজ। মক্কা থেকে জেরুজালেমে ইসরার যাত্রাশেষে বুরাককে নাকি এখানে বেঁধে রাখেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। কিন্তু এই স্থাপনাটি সম্ভবত আব্দুল মালিকের তৈরি নয়। আরো আছে ডোম অফ দ্য প্রফেট, কুব্বাত আন নাবী। স্বর্গে আরোহণের আগে নাকি এখানে পূর্বের সকল নবী আর ফেরেশতাদের জামাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা)। আরো আছে কুব্বাত আস সুলায়মান, কুব্বাত আল মুসা, কুব্বাত আল খাদর, কুব্বাত আল ইউসুফ প্রভৃতি নানা ছোট খাঁট গম্বুজ। একেকটির একেক ধর্মীয় তাৎপর্য। সবগুলি যে অথেনটিক তা কিন্তু নয়। একেক যুগের ইসলামী শাসক নিজেদের লেগ্যাসি লেজিটিমেসি দাঁড়া করাবার জন্যে এগুলি তৈরি করেছেন।

কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের বাইরেও বেশ কিছু বড় ভবন, মিনার ও গেট আছে। এগুলিরও রয়েছে বলা না-বলা ইতিহাস। তখতে সুলায়মান বলে একটি ভবনে নাকি সুলায়মানের সিংহাসন সংরক্ষিত। সেটি বন্ধ থাকায় দেখা হল না। মসজিদুল আকসার লাগোয়া ইসলামী জাদুঘরটিও বন্ধ। তবে সেসবের কাছে বিশাল প্রাঙ্গণে কিছুদূর পর পর বিশাল সব প্রাচীন স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ রাখা। বিভিন্ন যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের অভাব নেই। নতুন কনস্ট্রাকশনের সময় এখানে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে সেকেন্ড টেম্পল থেকে শুরু করে অটোমান তুর্কী শাসনামল পর্যন্ত ব্যাপ্ত প্রত্ননিদর্শন। বিশেষ করে স্টেবল অফ সলোমন বলে উত্তর পূর্বের একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের ব্লক দিয়ে ভর্তি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্যে এ জায়গাটা রীতিমত সোনার খনি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আজ শেষ করি একটা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়ে। কুরআনে একটা সূরা আছে, আত ত্বীন। ওয়াত্বীনি ওয়াজ জাইতুন, ওয়া তূরে সীনিন। সূরার শুরু কসম কেটে, মানে সাক্ষী রেখে। সাক্ষী ডুমুর ফল, জলপাই ফল, সিনাই পর্বত, ও এই পবিত্র শহর (তফসিরকারীরা বলছেন মক্কা)। কিসের সাক্ষী? তারা সাক্ষী যে মানুষকে তৈরি করা হয়েছে সর্বোত্তম রূপে, কিন্তু তাতে দোজখের আগুন থেকে তাদের রেহাই নেই, শুধু তারা বাদে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আর উত্তম কাজ করে। তাদের জন্যে রয়েছে সর্বোচ্চ পুরস্কার। শেষ বিচারের দিন অস্বীকারের স্পর্ধা কে রাখে? আল্লাহ কি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?

মক্কা-মদীনা শহরের আশপাশে কিন্তু একটাও ডুমুর কিংবা জলপাই গাছ খুঁজে পাবেন না। সেটা পাবেন এ জেরুজালেম শহরে (আর জর্দান-সিরিয়ায়)। এই হারাম আল শরীফের জায়গায় জায়গায় জলপাই গাছ। জলপাই মধ্যোপসাগরীয় অঞ্চলের স্টেপল। গ্রীক প্যাগান ধর্মেও অলিভ পবিত্র ফল। গ্রীক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের খাওয়া মানেই জলপাই, মক্কার খেঁজুর নয়। জেরুজালেমের নানা জায়গায় দেখা মেলে এ গাছের। ডোম অফ দ্য রকের বিপরীতে ইহুদী সমাধিক্ষেত্র মাউন্ট অফ অলিভসও ভর্তি সে গাছে।

আমার মনে তাই প্রশ্ন, হাজাল বালাদিল আমিন, “এ পবিত্র শহর” বলতে কি আসলে মক্কা বোঝানো হয়েছে? সেটি আসলে জেরুজালেম হবার সম্ভাবনা বেশি নয় কি?



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!