বায়তুল মাকদিস – ১

জেরুজালেমে বৃহস্পতিবার রাতে এসে পৌঁছালাম। আগের থেকেই ইচ্ছে ছিল জুম্মার নামাজটা পড়ব বায়তুল মুকাদ্দিস প্রাঙ্গণে। চীনা সহকর্মীদেরও আগ থেকে বলে রেখেছি শুক্রবার দুপুরে তাদের সাথে হয়ত থাকতে পারব না। মনে অবশ্য খুঁতখুঁতানি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে। এখানে বড়সড় গোলমাল বেঁধেছিল এপ্রিল মাসে।

লিওনার্দো বুটিক নামের যে হোটেলে আমরা থাকছি, সেটি ফাত্তাল গ্রুপের পরিচালিত। এই চেইনের মালিক ইরাকী বংশোদ্ভূত। রিসেপশনে কাজ করছে এক যুগল। দাঁড়িওয়ালা যুবকটির নেমট্যাগে লেখা “হাসান আয়ন” — আয়ন সম্ভবত আসলে আইয়ুন। আর মেয়েটির নাম “কমার”, আরবী অর্থ চাঁদ। দুজনে অবশ্যই আরব। কিন্তু এদের অধিকাংশ গেস্ট মাথায় কিপ্পাপরা ধার্মিক ইহুদী, এসেছে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের “মোনাজাতে” অংশ নিতে।

রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে রিসেপশনে পেলাম কেবল কমারকে। তার থেকে উপদেশ নিলাম কিভাবে আল-আকসায় নামাজ পড়তে পারি, জানালাম চীনা সঙ্গীদেরও শখ তারা যেতে চায়। চীনাদের ব্যাপারে কমার তেমন আগ্রহ দেখানো না। বলল, যদি মুসলিম হও তাহলে তো তোমার যাওয়া অত্যাবশ্যক। অমুসলিমদের ঢোকার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করো না। জুম্মার জামাতে লাখ খানেক মানুষ হয়। সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ সময়।

পরদিন সকালে ইসরাইল মিউজিয়াম হয়ে দুপুরে ডোম অফ দ্য রকে যেতে যে দুই উবার/ট্যাক্সি চালক পেলাম, তারা উভয়েই ফিলিস্তিনী আরব। প্রথমজন বলল, চীনারা আজ ঢুকতে পারবে না, কালও নয়। অমুসলিমদের গেট আলাদা, সেটার নিয়ন্ত্রণে ইসরাইলী পুলিশ। শুক্র-শনি তারা ছুটিতে। যদি তোমাদের কাজ দু’ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, আমিই তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। আমিও যাচ্ছি জুম্মার জামাতে। যেহেতু ‌অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি ডাকছি, তাই ফিরতি পথে আর একে পেলাম না।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ইসরাইল মিউজিয়ামের বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ দেখতে হল বেশ তাড়াহুড়ো করে। এসব ব্যাপারে সঙ্গীরা আমার কৌতূহল শতভাগ শেয়ার করে না। ফিরতি ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিল ওল্ড জেরুজালেম শহরের জাফা গেটের কাছে। চীনারা গেল দুপুরের খাওয়া সারতে। আমি জোর কদমে সোজা হাঁটা দিলাম বায়তুল মোকাদ্দিসের দিকে। প্রাচীন অলিগলি বেয়ে হাঁটাপথে সঙ্গী আরো অসংখ্য আরব নারী-শিশু-পুরুষ। সকলের গন্তব্য এক।

বায়তুল মুকাদ্দিসের বাব-আল সিলসিলা বা চেইন গেটের কাছে ইসরাইলী পুলিশের একটা ছোটখাট দল, গেট থেকে সামান্য দূরত্বে। এরা কিছু চেক করছে না। গেটে বসে আছে ফিলিস্তিনী/জর্দানী ইসলামী ওয়াকফের পান্ডারা। এরা যাকে ইচ্ছে হয় থামাচ্ছে। আমাকেও থামালো, কারণটা অবশ্যই আমার অনারব চেহারা। প্রশ্ন, আর ইউ মুসলিম। হ্যাঁ উত্তরের বিপরীতে নির্দেশ কুরআন থেকে কিছু মুখস্থ শোনাতে। ছোটবেলা থেকে যেটার চর্চা রয়েছে সেটা তো আমার জন্য জলবৎ তরলং! বুকে হাত রেখে চোস্ত উচ্চারণে ফাতিহার অর্ধেক শুনাতে না শুনাতে হাসতে হাসতে যাও যাও বলে পার করে দিল রক্ষী। এই ইসলামী ওয়াকফ জর্দানী সরকারকর্তৃক নিযুক্ত, পুরো কম্পাউন্ডের প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপালন করে এরা। ইসরাইলী পুলিশ গেটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে, সার্বিক নিরাপত্তার দেখভাল করে।

বাব আল সিলসিলা

দক্ষিণের দোর থেকে ডোম অফ দ্য রক প্রথমবারের মত কাছে থেকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। এই পবিত্রভূমি নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত যুদ্ধ, রক্তপাত। ভেতরে ঢুকে ওজুর স্থানের দিকে যেতে আবার গেট থেকে আরেক পান্ডা এল দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নিতে। পরীক্ষায় পাশ করার কিছু পরে এক দশ-বারো বছরের ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, হয়ের ইউ ফ্রম! উত্তরে বললাম, আমেরিকা। এমন অনিশ্চয়তার জায়গায় আমেরিকার নাগরিকত্ব আর পাসপোর্টই হয়ত সবচে বেশি নিরাপত্তা দেবে। তবে হয়তবা এ ক্ষেত্রে ভুল করেছি। পরবর্তীতে জেরুজালেমের পুরনো শহরে যেসব আরব দোকানে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়েছি, তারা বেশি সমাদর করেছে। তারা বাংলাদেশী পর্যটক কালেভদ্রে পায়ও বটে।

ছেলেটি প্রায় আধা ঘন্টা আমার আশপাশে ঘুরঘুর করল। বেশিরভাগ মানুষ যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছায়ার মধ্যে বসেছে সেখানে আমি অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে মাস্তাবার ওপর বসেছি। কড়া রোদে। তাতেও ছেলেটি পাশ ছাড়ছে না। হয়ত মুরুব্বীদের থেকে নির্দেশ আছে বিদেশীকে চোখে চোখে রাখার জন্য, নয়ত ভালমন্দের খোঁজ নেবার জন্য। একবার বোতলের পানিও সাধল।

মসজিদে প্রবেশের দুখলুল মসজিদ নামাজ আদায় করে অবশ্য আমি এই ফেঁউকে ছাড়িয়ে কেটে পড়লাম। খুতবা চলছে একাধিক মাইকে। তার মাঝেই মানুষজন বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। ভিড়ে মিশে হেঁটে চলে গেলাম মসজিদুল আকসার সামনাসামনি। ‌



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




অনেকে হয়ত জানেন যে বায়তুল মুকাদ্দিস কম্পাউন্ডটি বিশাল এবং এখানে একাধিক ছোটখাট স্থাপনা। পুরো ওল্ড জেরুজালেম শহরের এক তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে এ কম্পাউন্ড। এর ভেতর কেবল দুটি চালু মসজিদ। একটি পশ্চিম ধারে অবস্থিত মসজিদুল আকসা, যেখানে মি’রাজের পর হযরত মুহাম্মদ (সা) অন্যান্য সকল নবীর সাথে নামাজে ইমামতি করেছিলেন বলে মুসলিমদের বিশ্বাস। আরেকটি তার থেকে কিছু দূরে মারওয়ানি মসজিদ। আল-আকসা শব্দের আক্ষরিক অর্থ দূরবর্তী স্থান। সে স্থানটি যে জেরুজালেমই, তার সরাসরি প্রমাণ কিন্তু কুরআনে নেই। তফসীরকারকরা অন্যান্য তথ্যের যোগসাজশে সেটা বলেছেন।

কম্পাউন্ডের কেন্দ্রে যে ডোম অফ দ্য রক নামে সোনালী গম্বুজের স্থাপনা, সেটি কিন্তু আদতে মসজিদ নয়। আরবীতে কুব্বাত আস-সাখরা নামের অসম্ভব সুন্দর অলংকৃত আটকোনা এই দালানটির মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল পাথর (সাখরা, ফাউন্ডেশন স্টোন), যেটির ওপর থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের যাত্রা শুরু। এ ভবনের স্থাপত্যশৈলী মসজিদের নয়, এ ব্যাপারে পরে বলছি।

জুম্মার সময় যেহেতু মানুষ বেশি হয়, মসজিদুল আকসার ভেতর সকলের ঠাঁই মেলে না। কম্পাউন্ডের ভেতরে নানা জায়গায় পাথরের উঁচু মঞ্চ বা মাস্তাবা করে দেয়া আছে, সেগুলি ব্যবহৃত হয়। মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ ডোম অফ দ্য রকের পুরো উঁচু প্ল্যাটফর্মটা।

মসজিদ উল আকসা ফাসাদ
কুব্বাত আস সাখরা থেকে দেখা মসজিদ উল আকসা
কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক

জামাত ভাঙার পর আরো বহু মানুষের সাথে আমিও ঘুরে ঘুরে দেখলাম কুব্বাত-আস সাখরা আর মসজিদুল আকসার ভেতরটা। বাইরের আর ভেতরের প্ল্যাটফর্মের কোন অংশই বাদ রাখলাম না। নামাজের পর মসজিদের ভেতরে অনেক মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। হয় বাইরের গরম থেকে বাঁচতে, নয়ত পবিত্র মসজিদের ভেতর যদি কোন স্বপ্নদর্শন হয় সে প্রত্যাশায়। বাইরের কম্পাউন্ডে তখন কিশোর-যুবাবয়সীরা ফুটবল খেলে। আরব সংস্কৃতিতে মসজিদ আসলে কম্যুনিটি সেন্টার। সকল প্রকার সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকান্ড সেখানে চলে। আর কম্পাউন্ডের ভেতরে একটা জায়গায় কেবল সশস্ত্র ইসরাইলী পুলিশ রয়েছে, চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ইথিওপিয়ান যেমন রয়েছে, তেমন আছে প্রাচ্যের আরব চেহারা। সম্ভবত ইয়েমেন বা ইরাকের মিজরাহী ঐতিহ্যের ইসরাইলী এরা।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কম্পাউন্ড ঘুরে দেখার সময়েই খেয়াল করলাম মসজিদুল আকসা ও কুব্বাত আস-সাখরার ভেতরে-বাইরে গাইডসহ অসংখ্য বিদেশী পর্যটক গ্রুপ। এরা সকলেই মুসলিম দেশ থেকে এসেছে। তুর্কী, জার্মান, ঊর্দু-হিন্দী, সোমালি প্রভৃতি নানা ভাষার সমাহার। কোন দল বেশি হুজুর টাইপ, ছেলেরা পরেছে জোব্বা, মেয়েদের চেহারাসহ আপাদমস্তক আবৃত। আর ইউরোপীয় যারা তাদের বেশভূষা তুলনামূলক পশ্চিমা, মেয়েরাও অত কঠোরভাবে আবৃত নয়। তাজিকিস্তানের একটি গ্রুপ সিঁড়িতে বসে পতাকা হাতে ছবি তুলছে। এদের সকলে ইসরাইল ইমিগ্রেশন ও সিকুরিটি ‌অতিক্রম করেই কিন্তু এখানে এসেছে। বাংলা ভাষারই অভাব চোখে পড়ার মত। দুনিয়ার যেখানে গেছি, কোন না কোনভাবে বাঙালী কারো সাথে দেখা হয়ে গেছে। জেরুজালেমে পেলাম শূন্য।

কুব্বাত আস সাখরা — ডোম অফ দ্য রক
কুব্বাত আল ইউসুফ
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলছে আরব ছেলেরা
এক কিনারায় সামান্য কিছু ইসরাইলী পুলিশ পাহারায় নিয়োজিত
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে প্রচুর পায়রা
মসজিদ উল আকসার সামনে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
বায়তুল মাকদিস প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশি মুসলিম ট্যুরিস্ট
জর্ডান সরকারের ইসলামী ওয়াকফের দাপ্তরিক প্রতীক
তাজিকিস্তান থেকে আগত মুসলিম ট্যুরিস্ট
মারওয়ানি মসজিদের সামনে সিঁড়িতে চেয়ার নিয়ে স্লাইড করে নামার খেলা করছে দুই আরব মেয়ে
বেরুবার গেটে ইসরাইলী পুলিশের কড়া প্রহরা


আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!