(জাপানের মেইজি যুগ সম্পর্কে এ লেখাটি লিখতে গিয়ে চীনা-ভারতীয় আফিমের ডালপালা গজিয়ে গেল!)
ব্রিটিশদের সাথে চিং সাম্রাজ্যের দু’দু’টো যুদ্ধ হয়েছিল আফিমব্যবসাকে কেন্দ্র করে (প্রথম, ১৮৩৯-৪২; দ্বিতীয়, ১৮৫৬-৬০)। এর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের সর্বাধিক, আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে অসম অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা হয়ে যায় অর্ধেক। চীনের মানুষ এখনও মনে করে যে তারা এসময় পশ্চিমের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। আফিম যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আর ফলশ্রুতি অবশ্য এভাবে এক লাইনে বর্ণনা করলে দু’পক্ষের প্রতিই অবিচার করা হবে। তাই আমি আরেকটু বড় করে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি।
(এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় জাপানের একতরফা আগ্রাসনের মুখে চীনের নতুন প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা সরকারদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর সহানুভূতিশীলতা পেয়েছিল।)
আফিমের ওষধি গুণাগুণ আর আসক্তিকর প্রভাবের কথা প্রাচীন চীন ও ভারত দুই এলাকারই মানুষ জানত। আমরা রান্নায় যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি সীড বা আফিম গাছেরই বীজ। মধ্যযুগে চীনে স্থানীয়ভাবে আফিমের চাষ তেমন একটা হত না। মূলত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদের পর চীনে রপ্তানি হত আর কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হত। আকবরের সময় মুঘলরা ছিল চীনে আফিমব্যবসার একচেটিয়া সত্ত্বাধিকারী। মুঘলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (ইআইসি) উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যবসা পায়। অবশ্য সপ্তদশ শতকে ইআইসি নয়, ভিওসি (ডাচ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) ছিল চীনের মূল আফিম সরবরাহকারী।

সপ্তদশ শতকের শেষে চিবিয়ে খাবার বদলে ধূম্রপানের মাধ্যমে আফিমসেবনের নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। আফিমের ধোঁয়া ছিল আরো বেশি আসক্তিকর। ভারতের থেকে চীনেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবে আফিমসেবন। এ কারণে চিংসম্রাট ফরমান জারি করে ১৭২৯ সালে আফিমের ব্যবহার ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেন। প্রথম প্রথম তাতে আফিমের আমদানি কমলেও দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়। সরকারি দুর্নীতি আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে।
অষ্টাদশ শতকের শেষে আফিমব্যবসার চাবিকাঠি ইআইসির হাতে এসে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে ভারতের সবচে’ বেশি আফিমউৎপাদনকারী দুই এলাকা — বাংলা ও বিহার। আর পশ্চিমে ছিল মলওয়া রাজ্য। কলকাতায় বাঙ্গালী জমিদার আর মারোয়াড়ি বণিকরা কম্পানি খুলে বসে ইআইসির জাহাজে আফিম সাপ্লাইয়ের জন্যে। আফিমচাষীদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে এসব দালালরা বহুগুণ লাভে ইআইসির কাছে বিক্রি করত (বাংলার ১৭৭০এর দুর্ভিক্ষের একটি কারণ আফিমচাষের ওপর জমিদারদের ভারসাম্যহীন গুরুত্বপ্রদান)। এভাবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বহু জমিদার আর বণিক কলকাতায় প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিরলা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শিবনারায়ণ, আর অনেক প্রভাবশালী পার্সী শিল্পপতিদের পূর্বপুরুষ। মুজতবা আলীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে সিলেটেও মুসলিম জমিদাররা আফিমচাষে অর্থলগ্নি করত। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় উৎপন্ন আফিমের এক-তৃতীয়াংশ চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে।
ইআইসির আফিমভর্তি জাহাজ নোঙর ফেলত চীনের একমাত্র বৈদেশিক বন্দর ক্যান্টনে (গুয়াংচৌ) গিয়ে। সেখান মালখালাসের পর চীনা কালোবাজারিদের কাছে আফিম বিক্রি করে দেয়া হত। তারা সেসব নিয়ে লুকিয়ে বেচত স্থানীয় বাজারে। এভাবে সরাসরি চীনে আফিমের বাজারে ইআইসি যুক্ত না থাকলেও সাপ্লাই লাইনের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা। এই কালোবাজারির লাভের মাধ্যমে চীনের সাথে বিশাল ট্রেডগ্যাপের ব্যালেন্স করে ব্রিটিশরা, কারণ চীন থেকে বিলাসদ্রব্য ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণে কিনলেও বিলাতি বিলাসদ্রব্য চীনে বিক্রি করা ছিল নিষিদ্ধ।

১৮৩০এর দশকে আফিমব্যবসায় ইআইসি ও ভারতীয় আফিমের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয় মার্কিন চোরাকারবারীরা (জন কেরি আর ফ্রাংকলিন রোজভেল্টের পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন)। তাদের জাহাজ পারস্য-তুরস্ক থেকে আফিম কিনে চীনে বিক্রি শুরু করে। প্রতিযোগিতার ফলে দরপতন হতে থাকে। লাভ ধরে রাখতে তাই জাহাজীরা বাধ্য হয় আরো বেশি পরিমাণে আফিম পরিবহন করতে। চীনাদের মধ্যে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে আফিম-আসক্তি।
১৮৩১ সালে চীনের সম্রাট নতুন করে আফিমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এতেও যখন কাজ হল না, তখন ১৮৩৯এ সম্রাটের নির্দেশে চীনা সরকারী কর্মচারীরা ক্যান্টনের সকল আড়ত থেকে আফিম জব্দ করা শুরু করে। ব্রিটিশ আর অন্যান্য বিদেশীদের মজুদও রেহাই পেল না। বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হল ইআইসি ও ভারতীয় লগ্নিকাররা। অপমানের জবাব দিতে ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ পাঠাল দক্ষিণ চীন সাগরে। জাহাজের কামান থেকে দূরপাল্লার গোলানিক্ষেপ করা হল উপকূলের বন্দরগুলিতে। ক্যান্টন বন্দর দখল করে নিল তারা। চীনারা বাধ্য হলো শান্তিচুক্তি করতে। সে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা পেল হংকংয়ের মালিকানা, আর পাঁচটি সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার।
কিন্তু আফিম ব্যবসার ব্যাপারে কোন সুরাহা সে চুক্তিতে হয়নি। চীনে তখনও তা বেআইনী। এ সুযোগে হংকংয়ের চীনা কালোবাজারিরা নিজেদের জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় আফিম আনানেয়া করতে থাকে। ১৮৫৬ সালে এরকম একটি জাহাজ আটক করে চিং কর্মচারীরা, আর তারা জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এতে ফরাসী ও ব্রিটিশদের জয়লাভের পরে আফিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন সম্রাট, এবং আরো আশিটির মত বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, পারস্য, বল্কানে উৎপন্ন আফিমে সয়লাব হয়ে যায় চীন।

আফিম আসক্তি নিরসনে চিংদের ভুল পদক্ষেপগুলি জাপানসহ অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা হয়ে ছিল। যদি চীনা বন্দরগুলিতে সাধারণ বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য করতে দেয়া হত, তাহলে হয়ত আফিম কালোবাজারির খুব একটা দরকার পড়ত না পশ্চিমা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। আফিমকে বেআইনী করার কারণেও অনিচ্ছাকৃতভাবে তার দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটিকে লোভনীয় রূপ দেয় তারা। তারা চাইলে আফিম ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সপ্রদান করে আর উচ্চশুল্ক আরোপ করে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। শুল্ক থেকে সরকারী আয় নিয়ে স্থানীয় আফিমখোরদের বালাই সারাতে খরচ করতে পারত। শুধু মুনাফাখোর ব্রিটিশদের সকল দোষের ভাগীদার করা মনে হয় ন্যায়সঙ্গত নয়। চীনাদের ভুল পদক্ষেপ আর মিথ্যে সামরিক গর্বের কারণে তারা তো যুদ্ধে হেরে অর্থনৈতিক শক্তি হারায়ই, তার ওপর ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে ওঠে আফিমাসক্ত।
আর আফিম-আসক্তি যে শুধু চীনাদের সমস্যা ছিল তা নয়। পৃথিবীর সকল সভ্য স্থানেই আফিম চলত সে আমলে, কোথাওই বেআইনী ছিল না। বাদশা জাহাংগীর আর তাঁর পুত্র মুরাদ আফিমে আসক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আর মার্কিন প্রচুর বিখ্যাত মানুষেরও এরকম আসক্তি ছিল। যেমন, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (অসমাপ্ত ‘কুবলা খান’ মহাকাব্য লিখেছিলেন নেশার প্রভাবে!), চার্লস ডিকেন্স, মেরি শেলী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, এলিজাবেথ ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান পো, জন কীটস, লিউয়িস ক্যারল, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখের আফিমসেবনের বদভ্যাস ছিল।
আমেরিকায় এখন আফিমের ডেরিভেটিভ ওপিয়েট পেইনকিলার বড়িতে প্রচুর সাধারণ মানুষ আসক্ত। এর দোষ যদিও মুনাফাখোর ওষুধ কম্পানিগুলিকে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত আসল ঘটনা তার থেকে জটিলতর — আফিম যুদ্ধের ইতিহাসের মতই।