সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের পুঁজিবাদী তরিকা


সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক অস্তিত্ব সংকটগুলি কেটে যায় বিশের দশকের মাঝ নাগাদ। রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে লালবাহিনী জয়লাভ করে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক হারালেও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র শ্বেতবাহিনী ও স্থানীয় বিরোধিতা শক্তহাতে নিষ্ঠুরতার সাথে নির্মূল করতে সক্ষম হয় ত্রতস্কির সেনাদল।

ভল্গায় যখন ১৯২১এর দুর্ভিক্ষ চলমান, তখন কিন্তু লেনিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রকে কিভাবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা সম্ভব, সে চিন্তায় বেশি প্যারানয়েড। কারণ, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েতকে ঘিরে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলিকে তারা “শ্রেণীশত্রু” হিসাবে দেখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও প্রযুক্তিতে সেসব দেশ এগিয়ে আছে পঞ্চাশ বছর! তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকা সম্ভব, আর কিভাবেই বা সম্ভব সেসব দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে দেয়া?

সোভিয়েত প্রপাডান্ডা পোস্টারে কটাক্ষ করা হয়েছে ফরাসী, মার্কিন ও ব্রিটিশ পুঁজিবাদীদের, ১৯২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগেই প্রতিবেশীদের আগ্রাসনের ভয়ে শিল্পায়ন শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯২৯

বলশেভিক রাশিয়ার অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে তাই লেনিনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দ্রুত রাশিয়ার শিল্পায়ন সম্পন্ন করা। তাছাড়াও কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে শিল্পায়িত দেশে, কৃষিকাজনির্ভর দেশে নয়। রাশিয়া তখনো কৃষিভিত্তিক দেশ। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আদর্শবাদী পথে শিল্পায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাঁপ। ৎসারের আমলে যে অর্গানিক শিল্পায়ন শুরু হয়েছিল, সেটা যুদ্ধ ও বিপ্লবের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। লেনিন এবার যে শিল্পায়নের জন্য সচেষ্ট হলেন, সেটা বলপূর্বক শিল্পায়ন। ব্যক্তিগত পুঁজি নয়, রাষ্ট্র কিংবা সমবায় সমিতি হবে সে শিল্পায়নের মূল কান্ডারী।

স্বপ্ন এক কথা আর সেটা বাস্তব বানানো আরেক। বিপ্লবের পর রাশিয়ার খুব করুণ অবস্থা। শিল্পায়ন নতুন করে শুরু করবে কাকে দিয়ে? “বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু” প্রকৌশলী-বিজ্ঞানীরা হয় বিপ্লবীদের হাতে নিহত, নয়ত তাদের জীবনের সঞ্চয় নিয়ে অন্যদেশে পলাতক। আর লেনিন স্বয়ং দুটো স্টীমারে করে অগ্রগণ্য চিন্তাবিদদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। কেবল দুই স্যুটকেসে সারা জীবন ভরে নিয়ে দেশান্তরী হন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈর্ব্যক্তিক শিক্ষার জায়গা ততদিনে নিয়েছে আদর্শবাদী রাজনৈতিক বুলি আর শ্লোগান।

স্টীমশিপ হাকেন, দুটো জাহাজের একটি যাতে করে রুশ ১৯২২ সালে বিরুদ্ধমতের দার্শনিকদের আজীবন নির্বাসনে পাঠান লেনিন

হ্যাঁ, সমাজতন্ত্রীদের পেশীশক্তি আছে, অদক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু প্রযুক্তি নেই, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভাব। যেসব ব্যবস্থাপক ও সংগঠক ৎসারের আমলে শ্রমিকদের সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত করে কারখানা চালু রাখত, তারা এখন মৃত নয়ত নিগৃহীত।

ঠিক এমন অবস্থাতেই উপায়ান্তরহীন কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব — লেনিন, ত্রতস্কি, স্তালিন স্বয়ং — অনেক সাধারণ সদস্য ও লেবার ইউনিয়নের বিরোধিতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে বৈদেশিক সাহায্য দরকার। পুঁজিবাদী শ্রেণীশত্রুদের শরণাপন্ন হলেও সমস্যা নেই। তারা কম্যুনিস্ট হলেও সে আহ্বানে সাড়া দেয় পশ্চিমের নামীদামী প্রাইভেট কম্পানি — পশ্চিমা সরকাররা নয়, বরং সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু প্রাইভেট অন্টরপ্রনররা! এসকল কম্পানির অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ছিল মার্কিন ধনকুবেরদের পরিচালিত।

ফ্রেডেরিক টেইলর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনজিনিয়ারিংএর জনক, কারখানার কর্মীর সাথে
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল মিলে “টেইলরাইজড” অ্যাসেম্বলি লাইন
টেইলরের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের চিত্রীয় ব্যাখ্যা

বিস্তারিত বলার আগে লেনিন মার্কিন প্রযুক্তি, শ্রমদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে কতটা মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন সেটা না বললেই নয়। ফ্রেডরিক টেইলর নামে এক মার্কিন স্টীল কারখানার ফোরম্যান ও ইনজিনিয়ারিং ম্যানেজারের ভক্ত ছিলেন তিনি। এই টেইলর সাহেব কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইনজিনিয়ারিংয়ের জনক হিসাবে স্বীকৃত। কারখানার একেকটি বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙে শ্রমিকদের দক্ষতা ও দ্রুততা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া টেইলর বের করেন। শ্রমজীবীদের নেতা লেনিন অদক্ষ শ্রমিকদের রোবটের মত মবিলাইজ ও ইউটিলাইজ করতে এরকম থিওরিই খুঁজছিলেন। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল, বলশেভিক বিপ্লবকে শক্ত খুঁটিতে দাঁড়া করাতে প্রয়োজন এমন মার্কিন ধাঁচের উৎপাদনশীলতা। তবে সেখানে দক্ষ জনবল “লোভাতুর” পুঁজিবাদকে নয়, শক্তিশালী করবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত চালু “ওয়ার কম্যুনিজমের” ব্যাপক বিফলতার পর লেনিন চালু করেন “নিউ ইকনমিক পলিসি।” কারখানায় আবার অধিষ্ঠিত হয় ৎসারের আমলের প্রশিক্ষিত ম্যানেজার ও ইনজিনিয়াররা। ব্যক্তিপুঁজিকেও হালাল করা হয় কিছু খাতে। তবে ভারিশিল্প, তড়িত অবকাঠামো, আর পরিবহন ক্ষেত্র ছিল সরকারের একছত্র নিয়ন্ত্রণে। এসকল খাতেই নিয়ে আসা হল বাইরের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী কন্ট্রাক্টরদের।

“দাও শিল্পায়ন” — সোভিয়েত পোস্টার, ত্রিশের দশক
সারা দেশে তড়িতায়নের সপক্ষে লেনিনের চিত্রসহ প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯৩০
স্তালিনের চিত্রসম্বলিত প্রপাগান্ডা পোস্টারে সমাজতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত এ দাবির সাথে পাওয়ার প্ল্যান্টের ছবি, ১৯৩২

প্রথম বৃহদাকার যে প্রজেক্টটা শুরু হয় সেটি বর্তমান ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর জলপ্রপাতের ওপর বিশাল একটি বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। দ্নিপ্রোগেস নামের এই প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করা হয় মার্কিন কর্নেল হিউ কুপারকে। তিনি ছিলেন টেনেসি ভ্যালীতে ১৯২৪ সালে সমাপ্ত দৈত্যাকার মাসল শোলস পানিবিদ্যুত প্রকল্পেরও প্রধান। সোভিয়েতরা দ্নিপ্রো নদীর ওপর এত বিশাল প্রজেক্ট শুরু করল যেটা মাসল শোলসকেও হার মানায়। অথচ রাশিয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। যেখানে মার্কিন পুঁজিবাদীরা শুরু করে ছোট থেকে, তারপর চাহিদা অনুযায়ী আয়তন বাড়ায়, সেখানে লেনিনের স্বপ্ন একবারে চাঁদে লাফ দেয়া। এ কারণে পরে সমস্যা তৈরি হয়। লোড-ব্যালেন্স ঠিকমত না হলে সবসময় লাভজনকভাবে এসকল প্ল্যান্ট চালানো যায় না।

ইউক্রেনের কসাকদের একসময়কার দুর্ভেদ্য দুর্গ দ্নিপ্রো নদীর প্রপাতে মাসল শোলসের আরো বড় কপি এই বাঁধ তৈরিতে সাহায্য করে অসংখ্য পশ্চিমা কম্পানি। জেনারেল ইলেক্ট্রিক বানায় পাঁচটি বিশালকায় জেনারেটর। নিউপোর্ট নিউজ শিপবিল্ডিং তৈরি করে নয়টি ৮৫,০০০ অশ্বশক্তির টারবাইন — সেসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ। জার্মান ও সুইডিশদের অংশগ্রহণ থাকলেও ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ছিল মার্কিন। স্টীম শভেল, ক্রেন, ট্রেন ইঞ্জিন, ড্রীল, কন্স্ট্রাকশন স্টীল — সবকিছু আসে আমেরিকা থেকে। পুরো সাইটটি দেখে এক পরিদর্শক এর নাম দিয়েছিলেন “লিটল আমেরিকা।”

ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর ওপর সেকালের সর্ববৃহৎ দ্নিপ্রো বাঁধ ও পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র, ১৯৩২ সালে সম্পূর্ণ হয়
দ্নিপ্রো বাঁধ নির্মাণে তদারকি করছেন যুকরাষ্ট্রে মাসল শোলস বাঁধের প্রধান পরিচালক কর্নেল কুপার, ১৯৩২
আমেরিকার আলাবামা স্টেটের মাসল শোলস বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র, যেটি দ্নিপ্রোর মূল ডিজাইন

১৯৩২ সালে দ্নিপ্রোগেস চালু হয় লেনিনের নাম নিয়ে। সেসময়ে সেটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী এখানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা দিয়ে উন্নত বিশ্ব থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রযুক্তিশিক্ষার গ্যাপ পুরো হয়ে যায়। ১৯১৩ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রাশিয়ার ছিল, ১৯৩২ সালে সেটা বেড়ে হয় ৭ গুণ। সে বছরই হিউ কুপারকে স্তালিন রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অফ দ্য রেড স্টার প্রদান করেন। কুপারই ছিলেন সে মেডেলের প্রাপক প্রথম বিদেশী।

১৯২৮ সাল নাগাদ রুশদের কাছে টেইলরের থেকেও অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অটোমোবাইল শিল্পের পথিকৃত শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড। ১৯২৬ নাগাদ রাশিয়ায় আমদানি হয় ২৫ হাজার ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর। ১৯২৭এ রাশিয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক ও ট্র্যাক্টরের ৮৫ শতাংশই ছিল ফোর্ডের তৈরি। ১৯২৪এ যেখানে মোটে ১,০০০ ট্র্যাক্টর ছিল রাশিয়ায়, সেখানে ১৯৩৪এর সংখ্যাটা ২ লাখ, অধিকাংশ তৈরি যুক্তরাষ্ট্রে। রাশিয়ার একাধিক গ্রামের নামকরণ হয় ফোর্ডসন নামে। ত্রতস্কির ভাষ্যে “দেশের প্রগতিশীল কৃষক সমাজের মুখে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম ফোর্ডসন।”

মডেল টি মোটরগাড়ীর সাথে মার্কিন শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড
ডেট্রয়েট নদীর পাশে রিভার রুজে বিশাল একটি ফোর্ড মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট তৈরি হয় ১৯১৭ থেকে ১৯২৮এর মধ্যে, সোভিয়েত বহু প্রজেক্ট একে নকল করে
ফোর্ড প্ল্যান্টের অ্যাসেম্বলি লাইনে কর্মীদের চিত্র

ফোর্ডের লক্ষ্য যেমন ছিল সস্তায় অ্যাসেম্বলি লাইন প্রডাকশন আর মাস কনজামশন, সেই একই লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। স্তালিনগ্রাদের একটি বিশাল ফ্যাক্টরির পরিকল্পনা দেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান। মস্কোতে তার অফিসে কার্যরত ছিল ২৫ মার্কিনের পাশাপাশি ৪,০০০ পর্যন্ত রুশ প্রকৌশলী। তার কম্পানি ডিজাইন করে কমপক্ষে ৫০০টি রুশ প্রকল্প। স্তালিনগ্রাদের কারখানাটি পুরো তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর পার্ট বাই পার্ট স্তালিনগ্রাদে নিয়ে এসে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টার নামের মার্কিন কম্পানি থেকেও আসে উপদেষ্টার দল। কাল্ডার নামে মার্কিন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ মার্কিন কর্মচারীর সহায়তায় ১৯৩০ সালে প্ল্যান্টটি উৎপাদন শুরু করে। কাল্ডার চেলিয়াবিনস্কেও আরেকটি ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে সেটি স্তালিনেতস নামে মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি ট্র্যাক্টর তৈরি শুরু করে। এ সবের রয়্যাল্টি বাবদ কোন অর্থ মার্কিন পেটেন্ট হোল্ডারদের সোভিয়েত সরকার দেয়নি। লেনিনগ্রাদ ও খারকভেও ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টারের কপি বানানোর প্ল্যান্ট গড়ে ওঠে।

রাশিয়ায় ফোর্ড কম্পানির অফিস
মিশিগানের ফোর্ড ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর, যেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নে রপ্তানি হত।
১৯২৯ সালে রাশিয়ায় মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট বানানোর চুক্তি সইয়ের পর সোভিয়েত প্রতিনিধিদের সাথে হেনরি ফোর্ড

অশিক্ষিত চাষীদের ট্র্যাক্টর চালানোতে পারদর্শী করতেও প্রশিক্ষকদল আমেরিকা থেকে আসে। আবাদী জমির যৌথখামারীকরণের স্তালিনী পরিকল্পনায় মার্কিন ট্র্যাক্টর পালন করে অনস্বীকার্য অবদান।

ট্র্যাক্টরের পাশাপাশি মোটরগাড়িরও চাহিদা তৈরি হয় সোভিয়েত নগরগুলিতে। ফোর্ড কম্পানির সাথে স্তালিন সরকার চুক্তি করে নিঝনি নভগোরদ শহরে একটি বিশাল কারখানা বানানোর। মিশিগানের রিভার রুজের বিশাল ফোর্ড কারখানার আদলে এর পরিকল্পনা হয়। অস্টিন কম্পানিও আরেকটি গাড়ির কারখানার চুক্তি করে। আলবার্ট কান পরিকল্পনা দেন মস্কোর একটি কারখানারও।

এসব কারখানায় মার্কিন যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল করে তৈরি হয় মার্কিন মডেলের কপি মোটরগাড়ি। শত শত মার্কিন প্রকৌশলীর সাথে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদানপ্রদান হয় সোভিয়েত প্রকৌশলীদের। নিঝনি নভগোরদের প্ল্যান্ট যখন ১৯৩০এ শুরু হয়, তখন সোভিয়েতরা ষড় করে মার্কিন প্রকল্প পরিচালককে দুই মাসের বিলাসবহুল ছুটিতে কৃষ্ণসাগর উপকূলে পাঠিয়ে দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ছাড়া সোভিয়েত প্রকৌশলীরা প্ল্যান্ট চালাতে পারছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

রাশিয়ায় বিশের দশকে জনপ্রিয় ছিল এই ফোর্ডসন ট্র্যাক্টরের নাম
১৯৩২ সালে সোভিয়েত সরকারে সাথে চুক্তি সই করেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান
আলবার্ট কানের তৈরি স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট

১৯৩২ সালে যখন ফোর্ড মডেল এ উৎপাদন শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে সোভিয়েতরা মার্কিন ম্যানেজারদের সরিয়ে সে জায়গায় বসায় তাদের সোভিয়েত সহকারীদের। এভাবে সম্পূর্ণ হয় এক অভাবনীয় আকারের টেক ট্রান্সফার। সেবছর থেকে মার্কিন ট্র্যাক্টর আমদানি বন্ধ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৩৪ থেকে নিজেরাই সেটা রপ্তানি শুরু করে বিশ্বের অন্যত্র। আর নিঝনি নভগোরদের সেই কারখানায় বানানো ক্যাপাসিটির মোটে অর্ধেক বিক্রি হওয়ায় ফোর্ড কম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। (সাউন্ডস ফ্যামিলিয়ার?!)

শুধু মোটরগাড়ি, ট্রাক, ট্র্যাক্টর ও বিদ্যুৎ নয়, ধাতব ও ভারিশিল্পেও মার্কিনদের পুরোপুরি কপি করে সোভিয়েতরা। ইন্ডিয়ানার গ্যারী শহরের স্টীল মিলের আদলে উরাল পর্বতের মাগনিতোগোরস্কে তৈরি হয় বিশাল এক কমপ্লেক্স। এই মহাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টর ছিল মার্কিন ম্যাককী কম্পানি। লৌহআকরিক পরিশোধনের জন্য ৮টি ১,৫০০ টন ব্লাস্ট ফার্নেস সরবরাহ করে ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিং নামে মার্কিন ফার্ম। একই ফার্ম কুজনেতস্কের একটি আয়নওয়ার্কস তৈরিতেও সাহায্য করে। মাগনিতোগোরস্কে ৩টি রোলিং মিল তৈরি করে দেয় জার্মান একটি কম্পানি। ৩টি বেসেমার কনভার্টার ও ৪৫টি কোক ওভেন আসে মার্কিন ফার্ম কপার্স এন্ড কম্পানি থেকে। সোভিয়েতদের দায়িত্বে ছিল কেবল নিম্নপ্রযুক্তির ২৮টি ওপেন হার্থ ফার্নেস, পরিবহনব্যবস্থা আর পানিসরবরাহব্যবস্থা।

মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি রুশনির্মিত স্তালিনেতস ট্র্যাক্টর
নিঝনি নভগোরদ, বর্তমান গোর্কি, শহরে নির্মিত ট্রাক ও মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি
সোভিয়েত প্রপাগান্ডা পোস্টারে কর্মীদের উত্সাহিত করা হচ্ছে ৮০ লাখ টন ধাতব অ্যালয় তৈরির লক্ষ্যে, ১৯৩১

এই বিশাল কমপ্লেক্সে থাকার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নকশা তৈরি করে দেন জার্মান স্থপতি এর্নস্ট মে। গোটা রাশিয়া থেকে অদক্ষ শ্রমিক, ক্ষুধার্ত চাষীর দল, সাইবেরিয়ার ভবঘুরে আর যৌথখামার থেকে পলাতক পরিবারের স্থান হয় এখানে। গমগম করতে থাকে উরালের বিরানভূমি।

১৯৩৪ থেকে এই কম্প্লেক্সের দায়িত্ব ধীরে ধীরে হস্তান্তরিত হয় সোভিয়েত ম্যানেজারদের হাতে। বিদেশী ম্যানেজারদের দোষারোপ করা হয় যে তারা সে কাজে ধীরতা দেখাচ্ছে। তরুণ সোভিয়েত প্রকৌশলীরা বিদেশীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশী গ্রেডের বেতনের চাকরি দখল করতেই মুখিয়ে ছিল।

মাগনিতোগোর্স্ক যখন শতভাগ কাজ শুরু করে আরো কয়েক বছর পর, তখন এখানে উৎপন্ন স্টীল ছিল চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি আর পোল্যান্ড সকলের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। শুধু স্টীল নয়, এর আশপাশে ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, তামা, নিকেল, দস্তা আর অ্যালুমিনামেরও খনি। এই বিশাল কম্প্লেক্সের নাম দেয়া হয় উরাল-কুজনেতস্ক-কম্বিনাত। এখান থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার শিল্পায়িত শহরগুলিতে যেত ভারি অস্ত্র, ট্র্যাক্টর, রেলওয়ে কার, পরিশোধিত তেল, কয়লা।

মার্কিন অস্টিন কম্পানির ডিজাইন করা নিঝনি নভগোরদের মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স
মাগনিতোগর্স্কের স্টীল সিটিতে মার্কিন ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিংয়ের করে দেয়া ব্লাস্ট ফার্নেস প্ল্যান্ট, ত্রিশের দশক
জার্মান স্থপতি এর্ন্সট মে’র পরিকল্পিত মাগনিতোগর্সকের কর্মীদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট, ত্রিশের দশক

মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা যে শুধু শিল্পক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা নয়। রেড আর্মিকে সুসংহত করতে ত্রতস্কিও টেইলরিজমের শরণাপন্ন হন। লালবাহিনীর কঠিন সময়টাতে তার পাশে ছিল কেলী নামে এক মার্কিন প্রকৌশলী। অস্ত্র কারখানাগুলির উৎপাদনদক্ষতা বাড়াতে তিনি সাহায্য করেন।

আর সোভিয়েত সোশালিস্ট রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর জন্মও এ সময়ে। গুস্তেভ নামে এক কবি সৈনিক-শ্রমিকের একটা পূজনীয় ইমেজ তৈরি করেন। সেই ইমেজে যন্ত্রের সাথে পেশী মিলিয়ে মানুষ হয়েছে অদম্য — ঈশ্বরেরও অধিক কিছু। গুস্তেভ জিনভিয়েভদের মত লেখকদের কল্পনায় জন্ম হয়েছিল নতুন এক মানবপ্রজাতির — হোমো সোভিয়েতিকাস। তবে, পেশীর সাথে সংযুক্ত যন্ত্রশক্তির এনেবলাররা হোমো সোভিয়েতিকাস নন, হোমো আমেরিকানাস! এবং যেনতেন আমেরিকান নন, পুঁজিবাদী শিল্পপতি আমেরিকান।

আর ইতিহাসের এই দ্রুততম টেক ট্রান্সফারের কাহিনী আজকের রুশ তো বাদ দিলাম, খোদ মার্কিনদেরই মনে নেই!

সোশালিস্ট রিয়েলিজম ধাঁচের উদাহরণ, কারখানা শ্রমিক ও যৌথখামারের নারী, তৈরি ১৯৩৭এ, মস্কো

হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।

লাইবেরিয়া – ৫, গৃহযুদ্ধ, ১৯৩০-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাইবেরিয়ার ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১৯৮০ পর্যন্ত প্রথমভাগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে মার্কিন ও ডাচ বিনিয়োগের ফলে। ফায়ারস্টোন টায়ারের রাবারশিল্প, ডাচ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনা ও লৌহআকরিক উত্তোলনশিল্প, আর মার্কিনদের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সুবাদে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসে লাইবেরিয়াতে। সরকারী পয়সায় পশ্চিম আফ্রিকার তথাকথিত ‘সুইজারল্যান্ডের’ প্রচুর যুবক উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিনে পাড়ি জমায়।

প্রেসিডেন্ট টাবম্যান ১৯৪৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশশাসন করেন। টাবম্যান চাটুকারপরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার আমলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, সবের কৃতিত্ব নিজে দাবি করতেন। মতবিরোধীদের যৎসামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও নেই, একথা বলে বেড়াতেন সবার কাছে। তার জন্মদিন পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে। আমেরিকো সেটলার ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির ‘পূজো’ তো চলতই।

লাইবেরিয়ার ঊনিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টাবম্যান (১৮৯৫-১৯৭১)। রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
ডাচ রাজপরিবারের সাথে প্রেসিডেন্ট টাবম্যান, ১৯৫৫।

মার্কিন সিভিল রাইটস আন্দোলনের জোয়ারে অবশ্য টাবম্যান ১৯৬৪তে ‘ইউনিফিকেশন অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফলে দেশের যে ৯৮ শতাংশ মানুষ এতদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল, তারা সে অধিকার পায়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে দেশ ছেড়ে আমেরিকোদের লাইবেরিয়ায় আসা মুক্তির সন্ধানে, সেদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, স্বাধীনতার একশ’ কুড়ি বছর পর!

১৯৭১এ টাবম্যানের মৃত্যুর পর তার উপরাষ্ট্রপতি টলবার্ট হন প্রেসিডেন্ট। এসময় ভিন্নমুখী পরিবর্তন আসতে শুরু করে লাইবেরিয়াতে। মার্কিনফেরত ছাত্ররা লাইবেরিয়ায় ফিরে চাকরি পেতে বেশ বেগ পায়। কারণ ততদিনে ইকনমির বুম শেষ হয়ে বাস্টের দিকে চলছে। এসকল ছাত্রদের অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়।

তাছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশও তখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ঘানার নেতা কওয়ামে ন্ক্রুমা সোভিয়েত সমর্থিত ছিলেন, স্বদেশে তিনি সমাজতন্ত্র আর বিদেশে প্যান-আফ্রিকানিজমের জজবা তোলেন। লাইবেরিয়ার যুবসমাজ সমাজতন্ত্র আসলে কতটুকু বুঝত, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে মার্কসবাদের বাণীতেই তারা থিওরিটিকাল সমাধান খুঁজে ফেরে।

ষাটের দশকে লগিং ছিল লাইবেরিয়ার বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শিল্প।
লৌহআকরিক উত্তোলনে লাইবেরিয়া ষাটের দশকে ছিল অগ্রগণ্য একটি দেশ।
সত্তরের দশকে আখমাড়াই করে চিনি প্রস্তুত ও রপ্তানি হত লাইবেরিয়া থেকে।

দু’টি ‘প্রগতিশীল’ সংগঠন গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে। সত্তরের দশকের শেষে চালের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এদের একটির সমর্থকরা মনরোভিয়াতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সত্তরজনের মত মারা যায়।

পুরো দেশে থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। টলবার্ট ভেবেছিলেন একটা বামপন্থী বিপ্লব হবে আর তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেটা হল, তা বোধহয় কারো আন্দাজে ছিল না। বামপন্থী সংগঠনগুলি স্বজাতির মজলুমদের কথা বললেও গ্রামাঞ্চলে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারা একটা পরাবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গোত্রীয় উপজাতিগুলিকে বিচার করত। আর লাইবেরিয়ান আর্মির অর্ধশিক্ষিত উপজাতীয় পেটি অফিসার, জওয়ান এদেরকে দীক্ষিত করত প্রগতিশীল চেতনায়। এসকল সেনাসদস্য বেশির ভাগই ছিল ক্রান গোত্রের।

বিদেশী অর্থায়নে মনরোভিয়া আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হলেও ১৯৬৯এ এটি ছিল বিশ্বের সবচে কম জনবহুল রাজধানী।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টলবার্ট (বামে) জাইর বা বর্তমান ডিআর কংগোর একনায়ক প্রেসিডেন্ট মবুতুর সাথে। এদের মাথায় সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রতীকী টুপি।
১৯৭৩এর মনরোভিয়া।

এই সেনাবাহিনীর একটা দল ১৯৮০র এপ্রিলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে রক্তাক্ত একটি ক্যুদেতা করে বসে। প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে তার প্রাসাদে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে তার ক্যাবিনেটের তেরজন সদস্যকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে সেনাসদস্যরা। সেটা দেখে স্থানীয় জনগণ আনন্দ-উল্লাস করে। স্যামুয়েল ডো বলে এক মাস্টার সার্জ্যান্ট হয়ে বসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি হন স্থানীয় উপজাতীয় গোত্রগুলো থেকে নিযুক্ত প্রথম রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান রহিত করে সামরিক শাসন জারি করেন ডো। বামপন্থী দলগুলির একটিকে নিজের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলে পরিণত করলেও আসলে তিনি ছিলেন মার্কিন আর সিআইএর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। ক্রান উপজাতীয়রা এসময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় অগ্রাধিকার পায়। একটি বিফল ক্যু সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে। ১৯৮৫তে কারচুপির নির্বাচন করে ডো রাষ্ট্রপতির আসনে পাকাপোক্তভাবে বসেন।

লাইবেরিয়াতে ১৯৭৯ সালে চালের দাম নিয়ে রায়টে সত্তরের মত মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
১৯৮০তে ক্ষমতার দখল করে ক্রান উপজাতীয় সেনানায়ক স্যামুয়েল ডো
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামনে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ডো

এরও ফল যা হবার হলো। ১৯৮৯ সালে চার্লস টেইলর বলে আরেক ওয়ারলর্ড অন্যান্য উপজাতির সহায়তায় আইভরি কোস্ট থেকে বিদ্রোহীবাহিনী নিয়ে লাইবেরিয়াতে ঢোকেন। পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। টেইলর ডো’র সরকারকে হঠাতে সক্ষম হন। ডো’র ভাগ্যও হয় তার পূর্বসূরীর মত। তার নগ্ন মৃতদেহ প্রদর্শিত হয় জনপথে।

টেইলর হয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে ‘ক্যান অফ ওয়ার্মস’ একবার খোলা হয়ে গেছে, তা আর বন্ধ করার উপায় নেই। টেইলরের বিরুদ্ধেও দু’তিনটি ভিন্নগোত্রীয় উপজাতি যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত ত্রিমুখী প্রথম যুদ্ধটি চলার পর আবার ১৯৯৯এ শুরু হয় দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৩এ চার্লস টেইলর নাইজেরিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারপর জাতিসংঘের পীসকিপিং মিশনের মাধ্যমে দেশটিতে শান্তি আসে। সেটা এখনো চলছে।

মনরোভিয়া, ২০০৯
চার্লস টেইলর, আইসিসির ট্রিব্যুনালে বিচারকালে, ২০০৯
২০১৮ সাল পর্যন্ত লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন নোবেল শান্তিজয়ী এলেন জনসন সারলীফ

চৌদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধের শুরুতেই যারা দেশটি ছেড়ে প্রথমে ভাগে, তারা হলো আমেরিকো পরিবারগুলি। দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে যে দেশটিকে তারা শাসন করে এসেছে, তার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেখানে আশ্রয় নেয় তারা, সে তাদের ক্রীতদাস পূর্বপুরুষদের মনিবের ভিটা আমেরিকা! ঈস্ট কোস্টের যেসব প্ল্যান্টেশন থেকে তাদের বাপদাদাদের মুক্তি ও লাইবেরিয়া যাত্রা, ভাগ্যচক্রে সেখানেই তারা ফিরে যায় দেড়শ বছর পর।

আর আমেরিকোরা পেছনে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারে নিমজ্জমান একটি দেশ। ষোলটি যুধ্যমান উপজাতি, পনের হাজার শিশুসৈন্য, আড়াই থেকে নয় লাখ মৃত, ষাট থেকে নব্বই শতাংশ নারী জনসংখ্যা ধর্ষিত — এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমেরিকো ক্রীতদাসবংশধরদের অত্যাচারের কাহিনী, স্বজাতিকে অধিকারবঞ্চিত করার ইতিহাস, আর গণতান্ত্রিক প্রথার আড়ালে-আবডালে ক্ষমতালিপ্সা আর দুর্নীতির খেলা।

তাদের এই অধঃপতনের পেছনে কোন পশ্চিমা সরকার, কোন ঔপনিবেশিক শক্তির তেমন কোন হাত ছিল না। পুরো দেড়শ বছর ধরে মু্ক্ত দাসের বংশধররাই স্বাধীন দেশে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে একটু একটু করে।

মে সোয়াজন্তুইত

Featured Video Play Icon

এখন থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমাদের মাবাবারা সে সময় স্কুল-কলেজের ছাত্র। সময়টা ছিল খুবই উত্তাল, বেবি বুমারস জেনারেশনের বড় হয়ে ওঠার সময়। সমাজতান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সব দেশেই চলছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমেরিকায় ভিয়েতনামযুদ্ধবিরোধী আর সিভিল রাইটস আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়াতে চেতনার স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্রবিক্ষোভ (এ দুটো দেশে কিভাবে পুলিশ, দলীয় পেটোয়াবাহিনী আর মিথ্যে প্রোপ্যাগান্ডার ব্যবহার হয় নব্য বামরা ঘেঁটে দেখুন; সোভিয়েতরা শেষমেশ চেকে দখলদার সেনাবাহিনী পাঠায়)। ফ্রান্স-ইতালিতেও বিশ্ববিদ্যালয়-হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকে রাস্তায় নেমে আসে। প্যারিসের সেই আন্দোলন ‘মে সোয়াজ়ন্তুইত’ নামে এখনও স্মরণ করে ফরাসীরা। রোলিং স্টোনসের নিচের গানটা সেই উত্তাল সময়ের পটভূমিতে লেখা (পিজি-১৩!)। স্ট্রীট ফাইটিং ম্যান বলে গানটাও শুনে দেখুন।

কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মে’৬৮ ব্যর্থ বিপ্লব হিসাবে গণ্য!

ফ্রান্সে তখন ক্ষমতায় ছিল প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোলের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই ফরাসীরা লড়াই করে, তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অনেক। কিন্তু যুদ্ধজয়ের পঁচিশ বছর পরে রক্ষণশীল হিসাবে বাম ‘প্রোগ্রেসিভ’ ছাত্র আর শ্রমিক সমাজের কাছে তারা ছিল ঘৃণিত। তাদের কাছে গোলিস্টদের যুদ্ধকালীন ফ্রঁস লিব্র্ ‘চেতনার নামে বাকস্বাধীনতাহরণ’ ছিল নাৎসি বাহিনীর সমতুল্য। টেলিভিশনও তখন সবার ঘরে ঘরে আসা শুরু হয়েছে, তাই সবাই জানতে-দেখতে পারলো নন্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রদের উপর পুলিশের আক্রমণ। কার্তিয়ে লাত্যানে শুরু হয়ে গেল ব্যারিকেড যুদ্ধ, সেটাও এল টিভিতে। গুজব রটল একজন ছাত্র নিহত (আসলে হয়নি), আর পুলিশই নাকি রাস্তায় গাড়ি উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে ছাত্রদের দোষ দিচ্ছে।

ছাত্রদের ডাকে শ্রম ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যরা তাদের নেতাদের আদেশ উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বামপন্থী ছাত্রদের সাথে ধর্মঘটে যোগ দেয় দেশের সোয়া এক কোটি সাধারণ শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষদের ইউনিয়ন, সংখ্যায় তারা জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। দেশের দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, প্যারিসে দশ লাখ মানুষের ঢল নেমে আসে, বিখ্যাত গায়ক-অভিনেতারাও তাদের সাথে যোগদান করে। সরকারপতন ছিল সময়ের ব্যাপার, দ্য গোলও কিছু সময়ের জন্যে গোপনে জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন!

এতকিছুর পরেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় মে’৬৮! কয়েকটা কারণে। ধর্মঘটীদের লক্ষ্য কি ছিল সেটা মানুষকে বোঝাতে তারা ব্যর্থ হয়। টিভিতে তাদের ইন্টারভিউ নেয়া হলে তারা বলা শুরু করে হিপি গোছের অ্যান্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট অ্যান্টি-কনজিউমারিস্ট ইউটোপিয়ান সাম্যবাদী বুলি, যার সাথে সাধারণ মানুষ একাত্মতা খুঁজে পায়নি। তাদের সাথে যোগ দেয়া শ্রমিকদের লক্ষ্যও পরে হয়ে যায় ভিন্ন, তাদের বেতন বাড়ানো আর অন্যান্য বেনেফিটস দেয়ার ঘোষণা করা হলে তারা ধীরে ধীরে রাস্তা থেকে পাততাড়ি গুটায়।

আর নেতৃত্বেও ছিল সমস্যা। কে যে প্রপার নেতা তা কেউ জানত না। নোবেলবিজয়ী (কিন্তু প্রত্যাখ্যানকারী প্রথম ব্যক্তি!) দার্শনিক ঝ়ঁপল সার্ত্র হন তাদের প্রতীকী নেতা। তাঁকে ‌অ্যারেস্ট করা হয়, আর তখন তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। তাঁর লেখনীতে ধার ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনিও ছিলেন কম্যুনিজমের সমর্থনকারী মূলত বাম চিন্তাবিদ, যারা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র — সোভিয়েত এজেন্ট।

আর পুরনো আমলের মানুষ যারা দ্য গোলের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের স্বাক্ষী, আর রক্ষণশীল, তারা ছাত্রদের ‘ইনডিসিপ্লিন’, খোলামেলা পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের একত্রে অবাধ মেলামেশা, মাদকের ব্যবহার — এসব দেখে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকে। বামপন্থী বিপ্লবের খারাপ ফলের কথাও তারা জানত বলশেভিকদের অত্যাচারের ইতিহাস থেকে।

এর উপরে দ্য গোল যখন জানতে পারলেন আর্মি তাঁর পক্ষে, তিনি ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী পম্পিদু যাদের জেলে ভরা হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দিলেন, আর দ্য গোলকে অনুরোধ করলেন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ডাকতে। সবাই রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল। আর সেই নির্বাচনে গোলিস্ট পার্টি আরো বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ করল। কম্যুনিস্ট-সোশ্যালিস্টরা অনেক সীট হারাল।

মে’৬৮এর কালচারাল ইমপ্যাক্ট অবশ্য ছিল বিশাল। আমার মনে হয় আমরা সেই লেগ্যাসি এখনও বহন করছি। ফ্যাশনে বিশাল পরিবর্তন আসে, কোটপ্যান্ট ছেড়ে বেলবটম প্যান্ট জনপ্রিয় হয়। রক এন্ড রোল পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রতিবাদী সঙ্গীতে, বব ডিল্যান তার প্রডাক্ট। ফেমিনিজ়মের আবির্ভাব ঘটে নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন মুখ হিসাবে। সারা বিশ্বে ছাত্ররা আইডিয়ালিস্ট প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমি বলবো সে কারণেই বোধহয় বাঙাল জাত একটু সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা পায়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন (ভুলে যাবেন না, এতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও শামিল ছিল) আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলবো মে’৬৮রই একরকম ধারাবাহিকতা! সেগুলির সকল কৃতিত্ব কেউ একাই ছিনতাই করলে ইতিহাসের অবমাননা হবে, এগুলো ছিল সফল স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের চূড়ান্ত ফল।

আমরা কিছুটা শিক্ষা পেতে পারি মে’৬৮ থেকে। বিপ্লব সফল করতে লাগে প্র্যাগমাটিক লক্ষ্য, নেতৃত্ব, সংগঠন, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর সাপোর্ট, আর লটস্ অফ স্কিন ইন দ্য গেম! আর দ্য গোল সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে গালি দেয়া হলেও তারা স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় সঠিক পদক্ষেপগুলো নেয়, দেশপ্রেমী হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়।

দ্য এলেমেন্টস অফ এ সাক্সেসফুল রেভোল্যুশন বলে এনপিআরে একটা সেগমেন্ট শুনছিলাম, নিন তার লিংক। ২০১১এর মিশরের তাহরির আন্দোলনের সময়ে ধারণকৃত এই সেগমেন্টে কলম্বিয়া প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সফলভাবেই সেই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্বন্ধে জানলে যে পরিমাণ জ্ঞানার্জন সম্ভব, ফরাসী-রুশ-মার্কিন শত সফল বিপ্লব সম্বন্ধে পড়েও এত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়!

 

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!