সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের পুঁজিবাদী তরিকা


সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক অস্তিত্ব সংকটগুলি কেটে যায় বিশের দশকের মাঝ নাগাদ। রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে লালবাহিনী জয়লাভ করে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক হারালেও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র শ্বেতবাহিনী ও স্থানীয় বিরোধিতা শক্তহাতে নিষ্ঠুরতার সাথে নির্মূল করতে সক্ষম হয় ত্রতস্কির সেনাদল।

ভল্গায় যখন ১৯২১এর দুর্ভিক্ষ চলমান, তখন কিন্তু লেনিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রকে কিভাবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা সম্ভব, সে চিন্তায় বেশি প্যারানয়েড। কারণ, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েতকে ঘিরে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলিকে তারা “শ্রেণীশত্রু” হিসাবে দেখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও প্রযুক্তিতে সেসব দেশ এগিয়ে আছে পঞ্চাশ বছর! তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকা সম্ভব, আর কিভাবেই বা সম্ভব সেসব দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে দেয়া?

সোভিয়েত প্রপাডান্ডা পোস্টারে কটাক্ষ করা হয়েছে ফরাসী, মার্কিন ও ব্রিটিশ পুঁজিবাদীদের, ১৯২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগেই প্রতিবেশীদের আগ্রাসনের ভয়ে শিল্পায়ন শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯২৯

বলশেভিক রাশিয়ার অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে তাই লেনিনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দ্রুত রাশিয়ার শিল্পায়ন সম্পন্ন করা। তাছাড়াও কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে শিল্পায়িত দেশে, কৃষিকাজনির্ভর দেশে নয়। রাশিয়া তখনো কৃষিভিত্তিক দেশ। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আদর্শবাদী পথে শিল্পায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাঁপ। ৎসারের আমলে যে অর্গানিক শিল্পায়ন শুরু হয়েছিল, সেটা যুদ্ধ ও বিপ্লবের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। লেনিন এবার যে শিল্পায়নের জন্য সচেষ্ট হলেন, সেটা বলপূর্বক শিল্পায়ন। ব্যক্তিগত পুঁজি নয়, রাষ্ট্র কিংবা সমবায় সমিতি হবে সে শিল্পায়নের মূল কান্ডারী।

স্বপ্ন এক কথা আর সেটা বাস্তব বানানো আরেক। বিপ্লবের পর রাশিয়ার খুব করুণ অবস্থা। শিল্পায়ন নতুন করে শুরু করবে কাকে দিয়ে? “বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু” প্রকৌশলী-বিজ্ঞানীরা হয় বিপ্লবীদের হাতে নিহত, নয়ত তাদের জীবনের সঞ্চয় নিয়ে অন্যদেশে পলাতক। আর লেনিন স্বয়ং দুটো স্টীমারে করে অগ্রগণ্য চিন্তাবিদদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। কেবল দুই স্যুটকেসে সারা জীবন ভরে নিয়ে দেশান্তরী হন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈর্ব্যক্তিক শিক্ষার জায়গা ততদিনে নিয়েছে আদর্শবাদী রাজনৈতিক বুলি আর শ্লোগান।

স্টীমশিপ হাকেন, দুটো জাহাজের একটি যাতে করে রুশ ১৯২২ সালে বিরুদ্ধমতের দার্শনিকদের আজীবন নির্বাসনে পাঠান লেনিন

হ্যাঁ, সমাজতন্ত্রীদের পেশীশক্তি আছে, অদক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু প্রযুক্তি নেই, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভাব। যেসব ব্যবস্থাপক ও সংগঠক ৎসারের আমলে শ্রমিকদের সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত করে কারখানা চালু রাখত, তারা এখন মৃত নয়ত নিগৃহীত।

ঠিক এমন অবস্থাতেই উপায়ান্তরহীন কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব — লেনিন, ত্রতস্কি, স্তালিন স্বয়ং — অনেক সাধারণ সদস্য ও লেবার ইউনিয়নের বিরোধিতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে বৈদেশিক সাহায্য দরকার। পুঁজিবাদী শ্রেণীশত্রুদের শরণাপন্ন হলেও সমস্যা নেই। তারা কম্যুনিস্ট হলেও সে আহ্বানে সাড়া দেয় পশ্চিমের নামীদামী প্রাইভেট কম্পানি — পশ্চিমা সরকাররা নয়, বরং সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু প্রাইভেট অন্টরপ্রনররা! এসকল কম্পানির অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ছিল মার্কিন ধনকুবেরদের পরিচালিত।

ফ্রেডেরিক টেইলর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনজিনিয়ারিংএর জনক, কারখানার কর্মীর সাথে
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল মিলে “টেইলরাইজড” অ্যাসেম্বলি লাইন
টেইলরের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের চিত্রীয় ব্যাখ্যা

বিস্তারিত বলার আগে লেনিন মার্কিন প্রযুক্তি, শ্রমদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে কতটা মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন সেটা না বললেই নয়। ফ্রেডরিক টেইলর নামে এক মার্কিন স্টীল কারখানার ফোরম্যান ও ইনজিনিয়ারিং ম্যানেজারের ভক্ত ছিলেন তিনি। এই টেইলর সাহেব কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইনজিনিয়ারিংয়ের জনক হিসাবে স্বীকৃত। কারখানার একেকটি বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙে শ্রমিকদের দক্ষতা ও দ্রুততা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া টেইলর বের করেন। শ্রমজীবীদের নেতা লেনিন অদক্ষ শ্রমিকদের রোবটের মত মবিলাইজ ও ইউটিলাইজ করতে এরকম থিওরিই খুঁজছিলেন। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল, বলশেভিক বিপ্লবকে শক্ত খুঁটিতে দাঁড়া করাতে প্রয়োজন এমন মার্কিন ধাঁচের উৎপাদনশীলতা। তবে সেখানে দক্ষ জনবল “লোভাতুর” পুঁজিবাদকে নয়, শক্তিশালী করবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত চালু “ওয়ার কম্যুনিজমের” ব্যাপক বিফলতার পর লেনিন চালু করেন “নিউ ইকনমিক পলিসি।” কারখানায় আবার অধিষ্ঠিত হয় ৎসারের আমলের প্রশিক্ষিত ম্যানেজার ও ইনজিনিয়াররা। ব্যক্তিপুঁজিকেও হালাল করা হয় কিছু খাতে। তবে ভারিশিল্প, তড়িত অবকাঠামো, আর পরিবহন ক্ষেত্র ছিল সরকারের একছত্র নিয়ন্ত্রণে। এসকল খাতেই নিয়ে আসা হল বাইরের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী কন্ট্রাক্টরদের।

“দাও শিল্পায়ন” — সোভিয়েত পোস্টার, ত্রিশের দশক
সারা দেশে তড়িতায়নের সপক্ষে লেনিনের চিত্রসহ প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯৩০
স্তালিনের চিত্রসম্বলিত প্রপাগান্ডা পোস্টারে সমাজতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত এ দাবির সাথে পাওয়ার প্ল্যান্টের ছবি, ১৯৩২

প্রথম বৃহদাকার যে প্রজেক্টটা শুরু হয় সেটি বর্তমান ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর জলপ্রপাতের ওপর বিশাল একটি বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। দ্নিপ্রোগেস নামের এই প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করা হয় মার্কিন কর্নেল হিউ কুপারকে। তিনি ছিলেন টেনেসি ভ্যালীতে ১৯২৪ সালে সমাপ্ত দৈত্যাকার মাসল শোলস পানিবিদ্যুত প্রকল্পেরও প্রধান। সোভিয়েতরা দ্নিপ্রো নদীর ওপর এত বিশাল প্রজেক্ট শুরু করল যেটা মাসল শোলসকেও হার মানায়। অথচ রাশিয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। যেখানে মার্কিন পুঁজিবাদীরা শুরু করে ছোট থেকে, তারপর চাহিদা অনুযায়ী আয়তন বাড়ায়, সেখানে লেনিনের স্বপ্ন একবারে চাঁদে লাফ দেয়া। এ কারণে পরে সমস্যা তৈরি হয়। লোড-ব্যালেন্স ঠিকমত না হলে সবসময় লাভজনকভাবে এসকল প্ল্যান্ট চালানো যায় না।

ইউক্রেনের কসাকদের একসময়কার দুর্ভেদ্য দুর্গ দ্নিপ্রো নদীর প্রপাতে মাসল শোলসের আরো বড় কপি এই বাঁধ তৈরিতে সাহায্য করে অসংখ্য পশ্চিমা কম্পানি। জেনারেল ইলেক্ট্রিক বানায় পাঁচটি বিশালকায় জেনারেটর। নিউপোর্ট নিউজ শিপবিল্ডিং তৈরি করে নয়টি ৮৫,০০০ অশ্বশক্তির টারবাইন — সেসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ। জার্মান ও সুইডিশদের অংশগ্রহণ থাকলেও ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ছিল মার্কিন। স্টীম শভেল, ক্রেন, ট্রেন ইঞ্জিন, ড্রীল, কন্স্ট্রাকশন স্টীল — সবকিছু আসে আমেরিকা থেকে। পুরো সাইটটি দেখে এক পরিদর্শক এর নাম দিয়েছিলেন “লিটল আমেরিকা।”

ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর ওপর সেকালের সর্ববৃহৎ দ্নিপ্রো বাঁধ ও পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র, ১৯৩২ সালে সম্পূর্ণ হয়
দ্নিপ্রো বাঁধ নির্মাণে তদারকি করছেন যুকরাষ্ট্রে মাসল শোলস বাঁধের প্রধান পরিচালক কর্নেল কুপার, ১৯৩২
আমেরিকার আলাবামা স্টেটের মাসল শোলস বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র, যেটি দ্নিপ্রোর মূল ডিজাইন

১৯৩২ সালে দ্নিপ্রোগেস চালু হয় লেনিনের নাম নিয়ে। সেসময়ে সেটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী এখানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা দিয়ে উন্নত বিশ্ব থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রযুক্তিশিক্ষার গ্যাপ পুরো হয়ে যায়। ১৯১৩ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রাশিয়ার ছিল, ১৯৩২ সালে সেটা বেড়ে হয় ৭ গুণ। সে বছরই হিউ কুপারকে স্তালিন রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অফ দ্য রেড স্টার প্রদান করেন। কুপারই ছিলেন সে মেডেলের প্রাপক প্রথম বিদেশী।

১৯২৮ সাল নাগাদ রুশদের কাছে টেইলরের থেকেও অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অটোমোবাইল শিল্পের পথিকৃত শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড। ১৯২৬ নাগাদ রাশিয়ায় আমদানি হয় ২৫ হাজার ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর। ১৯২৭এ রাশিয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক ও ট্র্যাক্টরের ৮৫ শতাংশই ছিল ফোর্ডের তৈরি। ১৯২৪এ যেখানে মোটে ১,০০০ ট্র্যাক্টর ছিল রাশিয়ায়, সেখানে ১৯৩৪এর সংখ্যাটা ২ লাখ, অধিকাংশ তৈরি যুক্তরাষ্ট্রে। রাশিয়ার একাধিক গ্রামের নামকরণ হয় ফোর্ডসন নামে। ত্রতস্কির ভাষ্যে “দেশের প্রগতিশীল কৃষক সমাজের মুখে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম ফোর্ডসন।”

মডেল টি মোটরগাড়ীর সাথে মার্কিন শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড
ডেট্রয়েট নদীর পাশে রিভার রুজে বিশাল একটি ফোর্ড মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট তৈরি হয় ১৯১৭ থেকে ১৯২৮এর মধ্যে, সোভিয়েত বহু প্রজেক্ট একে নকল করে
ফোর্ড প্ল্যান্টের অ্যাসেম্বলি লাইনে কর্মীদের চিত্র

ফোর্ডের লক্ষ্য যেমন ছিল সস্তায় অ্যাসেম্বলি লাইন প্রডাকশন আর মাস কনজামশন, সেই একই লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। স্তালিনগ্রাদের একটি বিশাল ফ্যাক্টরির পরিকল্পনা দেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান। মস্কোতে তার অফিসে কার্যরত ছিল ২৫ মার্কিনের পাশাপাশি ৪,০০০ পর্যন্ত রুশ প্রকৌশলী। তার কম্পানি ডিজাইন করে কমপক্ষে ৫০০টি রুশ প্রকল্প। স্তালিনগ্রাদের কারখানাটি পুরো তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর পার্ট বাই পার্ট স্তালিনগ্রাদে নিয়ে এসে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টার নামের মার্কিন কম্পানি থেকেও আসে উপদেষ্টার দল। কাল্ডার নামে মার্কিন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ মার্কিন কর্মচারীর সহায়তায় ১৯৩০ সালে প্ল্যান্টটি উৎপাদন শুরু করে। কাল্ডার চেলিয়াবিনস্কেও আরেকটি ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে সেটি স্তালিনেতস নামে মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি ট্র্যাক্টর তৈরি শুরু করে। এ সবের রয়্যাল্টি বাবদ কোন অর্থ মার্কিন পেটেন্ট হোল্ডারদের সোভিয়েত সরকার দেয়নি। লেনিনগ্রাদ ও খারকভেও ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টারের কপি বানানোর প্ল্যান্ট গড়ে ওঠে।

রাশিয়ায় ফোর্ড কম্পানির অফিস
মিশিগানের ফোর্ড ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর, যেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নে রপ্তানি হত।
১৯২৯ সালে রাশিয়ায় মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট বানানোর চুক্তি সইয়ের পর সোভিয়েত প্রতিনিধিদের সাথে হেনরি ফোর্ড

অশিক্ষিত চাষীদের ট্র্যাক্টর চালানোতে পারদর্শী করতেও প্রশিক্ষকদল আমেরিকা থেকে আসে। আবাদী জমির যৌথখামারীকরণের স্তালিনী পরিকল্পনায় মার্কিন ট্র্যাক্টর পালন করে অনস্বীকার্য অবদান।

ট্র্যাক্টরের পাশাপাশি মোটরগাড়িরও চাহিদা তৈরি হয় সোভিয়েত নগরগুলিতে। ফোর্ড কম্পানির সাথে স্তালিন সরকার চুক্তি করে নিঝনি নভগোরদ শহরে একটি বিশাল কারখানা বানানোর। মিশিগানের রিভার রুজের বিশাল ফোর্ড কারখানার আদলে এর পরিকল্পনা হয়। অস্টিন কম্পানিও আরেকটি গাড়ির কারখানার চুক্তি করে। আলবার্ট কান পরিকল্পনা দেন মস্কোর একটি কারখানারও।

এসব কারখানায় মার্কিন যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল করে তৈরি হয় মার্কিন মডেলের কপি মোটরগাড়ি। শত শত মার্কিন প্রকৌশলীর সাথে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদানপ্রদান হয় সোভিয়েত প্রকৌশলীদের। নিঝনি নভগোরদের প্ল্যান্ট যখন ১৯৩০এ শুরু হয়, তখন সোভিয়েতরা ষড় করে মার্কিন প্রকল্প পরিচালককে দুই মাসের বিলাসবহুল ছুটিতে কৃষ্ণসাগর উপকূলে পাঠিয়ে দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ছাড়া সোভিয়েত প্রকৌশলীরা প্ল্যান্ট চালাতে পারছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

রাশিয়ায় বিশের দশকে জনপ্রিয় ছিল এই ফোর্ডসন ট্র্যাক্টরের নাম
১৯৩২ সালে সোভিয়েত সরকারে সাথে চুক্তি সই করেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান
আলবার্ট কানের তৈরি স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট

১৯৩২ সালে যখন ফোর্ড মডেল এ উৎপাদন শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে সোভিয়েতরা মার্কিন ম্যানেজারদের সরিয়ে সে জায়গায় বসায় তাদের সোভিয়েত সহকারীদের। এভাবে সম্পূর্ণ হয় এক অভাবনীয় আকারের টেক ট্রান্সফার। সেবছর থেকে মার্কিন ট্র্যাক্টর আমদানি বন্ধ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৩৪ থেকে নিজেরাই সেটা রপ্তানি শুরু করে বিশ্বের অন্যত্র। আর নিঝনি নভগোরদের সেই কারখানায় বানানো ক্যাপাসিটির মোটে অর্ধেক বিক্রি হওয়ায় ফোর্ড কম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। (সাউন্ডস ফ্যামিলিয়ার?!)

শুধু মোটরগাড়ি, ট্রাক, ট্র্যাক্টর ও বিদ্যুৎ নয়, ধাতব ও ভারিশিল্পেও মার্কিনদের পুরোপুরি কপি করে সোভিয়েতরা। ইন্ডিয়ানার গ্যারী শহরের স্টীল মিলের আদলে উরাল পর্বতের মাগনিতোগোরস্কে তৈরি হয় বিশাল এক কমপ্লেক্স। এই মহাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টর ছিল মার্কিন ম্যাককী কম্পানি। লৌহআকরিক পরিশোধনের জন্য ৮টি ১,৫০০ টন ব্লাস্ট ফার্নেস সরবরাহ করে ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিং নামে মার্কিন ফার্ম। একই ফার্ম কুজনেতস্কের একটি আয়নওয়ার্কস তৈরিতেও সাহায্য করে। মাগনিতোগোরস্কে ৩টি রোলিং মিল তৈরি করে দেয় জার্মান একটি কম্পানি। ৩টি বেসেমার কনভার্টার ও ৪৫টি কোক ওভেন আসে মার্কিন ফার্ম কপার্স এন্ড কম্পানি থেকে। সোভিয়েতদের দায়িত্বে ছিল কেবল নিম্নপ্রযুক্তির ২৮টি ওপেন হার্থ ফার্নেস, পরিবহনব্যবস্থা আর পানিসরবরাহব্যবস্থা।

মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি রুশনির্মিত স্তালিনেতস ট্র্যাক্টর
নিঝনি নভগোরদ, বর্তমান গোর্কি, শহরে নির্মিত ট্রাক ও মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি
সোভিয়েত প্রপাগান্ডা পোস্টারে কর্মীদের উত্সাহিত করা হচ্ছে ৮০ লাখ টন ধাতব অ্যালয় তৈরির লক্ষ্যে, ১৯৩১

এই বিশাল কমপ্লেক্সে থাকার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নকশা তৈরি করে দেন জার্মান স্থপতি এর্নস্ট মে। গোটা রাশিয়া থেকে অদক্ষ শ্রমিক, ক্ষুধার্ত চাষীর দল, সাইবেরিয়ার ভবঘুরে আর যৌথখামার থেকে পলাতক পরিবারের স্থান হয় এখানে। গমগম করতে থাকে উরালের বিরানভূমি।

১৯৩৪ থেকে এই কম্প্লেক্সের দায়িত্ব ধীরে ধীরে হস্তান্তরিত হয় সোভিয়েত ম্যানেজারদের হাতে। বিদেশী ম্যানেজারদের দোষারোপ করা হয় যে তারা সে কাজে ধীরতা দেখাচ্ছে। তরুণ সোভিয়েত প্রকৌশলীরা বিদেশীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশী গ্রেডের বেতনের চাকরি দখল করতেই মুখিয়ে ছিল।

মাগনিতোগোর্স্ক যখন শতভাগ কাজ শুরু করে আরো কয়েক বছর পর, তখন এখানে উৎপন্ন স্টীল ছিল চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি আর পোল্যান্ড সকলের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। শুধু স্টীল নয়, এর আশপাশে ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, তামা, নিকেল, দস্তা আর অ্যালুমিনামেরও খনি। এই বিশাল কম্প্লেক্সের নাম দেয়া হয় উরাল-কুজনেতস্ক-কম্বিনাত। এখান থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার শিল্পায়িত শহরগুলিতে যেত ভারি অস্ত্র, ট্র্যাক্টর, রেলওয়ে কার, পরিশোধিত তেল, কয়লা।

মার্কিন অস্টিন কম্পানির ডিজাইন করা নিঝনি নভগোরদের মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স
মাগনিতোগর্স্কের স্টীল সিটিতে মার্কিন ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিংয়ের করে দেয়া ব্লাস্ট ফার্নেস প্ল্যান্ট, ত্রিশের দশক
জার্মান স্থপতি এর্ন্সট মে’র পরিকল্পিত মাগনিতোগর্সকের কর্মীদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট, ত্রিশের দশক

মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা যে শুধু শিল্পক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা নয়। রেড আর্মিকে সুসংহত করতে ত্রতস্কিও টেইলরিজমের শরণাপন্ন হন। লালবাহিনীর কঠিন সময়টাতে তার পাশে ছিল কেলী নামে এক মার্কিন প্রকৌশলী। অস্ত্র কারখানাগুলির উৎপাদনদক্ষতা বাড়াতে তিনি সাহায্য করেন।

আর সোভিয়েত সোশালিস্ট রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর জন্মও এ সময়ে। গুস্তেভ নামে এক কবি সৈনিক-শ্রমিকের একটা পূজনীয় ইমেজ তৈরি করেন। সেই ইমেজে যন্ত্রের সাথে পেশী মিলিয়ে মানুষ হয়েছে অদম্য — ঈশ্বরেরও অধিক কিছু। গুস্তেভ জিনভিয়েভদের মত লেখকদের কল্পনায় জন্ম হয়েছিল নতুন এক মানবপ্রজাতির — হোমো সোভিয়েতিকাস। তবে, পেশীর সাথে সংযুক্ত যন্ত্রশক্তির এনেবলাররা হোমো সোভিয়েতিকাস নন, হোমো আমেরিকানাস! এবং যেনতেন আমেরিকান নন, পুঁজিবাদী শিল্পপতি আমেরিকান।

আর ইতিহাসের এই দ্রুততম টেক ট্রান্সফারের কাহিনী আজকের রুশ তো বাদ দিলাম, খোদ মার্কিনদেরই মনে নেই!

সোশালিস্ট রিয়েলিজম ধাঁচের উদাহরণ, কারখানা শ্রমিক ও যৌথখামারের নারী, তৈরি ১৯৩৭এ, মস্কো

‘ডিকেন্জিয়ান ডিস্টোপিয়া’

Featured Video Play Icon

আজকের গানটা ১৯৬৮ সালের ব্রিটিশ মিউজিক্যাল ‘অলিভার!’ থেকে। মনে হয় ৯২-৯৩এর দিকে এটা বিটিভিতে পরিবেশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়ার আগেই এটা দেখেছিলাম। আর গানগুলির কথা না বুঝেই গল্পটা আর সুরগুলি খুব মনে ধরেছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অনেক খুঁজে ডিভিডি সংগ্রহ করি।

এটা সেলেক্ট করার কারণ মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া, ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমনতর ছিল। ডিকেন্স এ কাহিনী লিখেন ১৮৩৭এ। রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের বছর সেটা। যুক্তরাজ্য সাম্রাজ্যের উচ্চতম শিখরে তখন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না, কথাটা এই সময়েই চালু হয়; কারণ তাদের কোন না কোন উপনিবেশে যখন সূর্য অস্তগামী, অন্য কোনটাতে তখন সূর্যোদয়। ভারতে ১৮৫৭র সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে সরিয়ে সম্রাজ্ঞী হিসাবে সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নেন ভিক্টোরিয়া।

আমরা ভাবতে পারি যে এসময় ভারতসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলিকে শোষণ করে ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ বিপুল সমৃদ্ধি ‌অর্জন করেছিল। বাস্তবতা এই সরল সত্যের থেকে জটিলতর! ভিক্টোরিয়ান যুগ যেমন ব্রিটিশ আভিজাত্যের নাক-উঁচু এটিকেটের জন্যে পরিচিত, ঠিক ততটা পরিচিত ‘ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়া’ হিসাবে! ডিকেন্সের আবাসস্থল লন্ডনে তখন শিল্পবিপ্লবের হাওয়া লেগেছে। শহরের বায়ু ভারি, আকাশ কালো — কয়লা পুড়িয়ে ফ্যাক্টরি-রেল চালানোর ধোঁয়ায়।

সে শহরের নিম্নবিত্ত আর উঠতি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ছিল সেরকম নিম্নমানের। তাদের পোশাকআশাক ছেঁড়া, তাপ্পিমারা, ধূলিধূসরিত, বে-সাইজের। যাদের ভাগ্যে খাদ্য-পানীয় নিয়মিত জুটত, তাও ছিল অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা। অনেকে থাকত পরিত্যক্ত বাড়িতে বস্তি করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা অসুস্থ হয়ে পড়ত, তাদের ডাক্তার পাঠাত সমুদ্রতীরের বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্যে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা আর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্লেগ-মহামারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি নিয়মকানুনও অতটা চটপটে হয়ে উঠেনি যে দ্রুত পতনমুখী জীবনযাত্রার মান আর উচ্চগামী আয়বৈষম্যকে আয়ত্তে আনবে।

এই দৃশ্যে দেখবেন এতিম অলিভার কপালের ফেরে ফেগিন নামে এক পকেটমার সর্দারের আস্তানায় এসে পড়েছে। ডিকেন্সের নিজের ছোটবেলার একটা ছায়া আছে অলিভারের মধ্যে। তাঁর ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবাকে জেল খাটতে হয় অপরিশোধিত ঋণের কারণে। তখন পরিবারের ঘানি টানতে স্কুল ছেড়ে ফ্যাক্টরিতে কাজে যেতে হয় ডিকেন্সকে।

এই গানটিতে অলিভার ভাবছে ফেগিনদের লন্ড্রির ব্যবসা, কারণ একটা ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে তাদের গোপন আখড়ায় অনেকগুলি সিল্কের রুমাল শুকাতে দেয়া হয়েছে। নিষ্পাপ-সরল অলিভারকে খেলাচ্ছলে ফেগিন আর তার বালক সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝাচ্ছে কিভাবে পকেট কাটতে হয়। সে দৃশ্যে ফেগিন সেজেছে অভিজাত উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ — কিছুটা কমিক তার সেই ভোল, কারণ উচ্চবিত্তের এটিকেট থাকলে কী হবে, সত্যিকার অর্থে তারাও ছিল লোভী-হিংসুক গোছের! অলিভারকে শিখাতে ফেগিনকে বোকা বানিয়ে আর্টফুল ডজার আর তার দোস্তরা সমানে মাল সরিয়ে চলেছে!

ডিকেন্স ছিলেন মানবচরিত্রের ভাল পর্যবেক্ষক, আর জটিল ক্যারিকেচার তৈরির বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাহিনীগুলির কোন ক্যারেক্টারই সোজাসাপ্টা খারাপ বা ভাল ছিল না — সাদাও নয়, কালোও নয়, ধূসর। যেমন এই মুভির ফেগিন চরিত্রটা — সে লোভাতুর বটে, কিন্তু সে যে সেটা করছে পেটের দায়ে! বুড়ো বয়েসে তাকে দেখার কেউ নেই, এসব চিন্তায়। আর বালকবয়সী চামচাদের সে বাবা না হলেও গার্জেনের মত, আগলে রাখার মত কিছুটা দায়িত্ববোধ আছে।

ভিক্টোরিয়ান সমাজে এত শ্রেণীবিভেদ, এত অসমতা থাকা সত্ত্বেও সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল। ডিকেন্সের ক্যারেক্টারগুলি কখনো কখনো সৌভাগ্যবানও হত। বাস্তবেও যারা সুযোগসন্ধানী ছিল, তারা খোদ ব্রিটেনে না পারলেও জাহাজের খালাসী হিসাবে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে, নয়ত ভারতে — যেখানে ভদ্রলোকে যেতে চাইত না — সেখানে সেনা-নৌ অফিসার হিসাবে গিয়ে রাতারাতি একটা কূলকিনারা করে ফেলতে পারত। তারপর বাড়ি ফিরে জমিজমা কিনে, ব্যবসা বানিয়ে ভবিষ্যতটা আরেকটু পাকাপোক্ত করে ফেলত।

শেষ করি একটা কন্ট্রাস্ট দেখিয়ে। সোশ্যালিজম-কম্যুনিজমের পিতৃদেব কার্ল মার্ক্সও ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ অব্দি লন্ডনে ছিলেন। ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়ার প্রতক্ষদর্শী তিনিও। তাঁর ১৮৬৭তে লেখা ‘ডাস কাপিটাল’এ ব্যাখ্যা করেছেন শ্রমিকশ্রেণীর ওপর পুঁজিবাদী শোষণের পদ্ধতি, আর সেই শ্রেণীবিষম সিস্টেম ভাঙার লক্ষ্যে প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু সেই বিপ্লব ব্রিটেনে হয়নি। হয়েছিল শিল্পবিপ্লবে পিছিয়ে থাকা ইউরোপের সবচে’ কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়াতে, যেখানে তা হবারই কথা নয়, তাও আরো ৫০ বছর পরে। মার্ক্সের থিওরি নানা প্যাঁচঘোঁচ মেরে তৈরি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ‌অতিরিক্ত সিম্প্লিস্টিক ছিল, তাই ভুলও ছিল। হয়ত বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করে আর গলা হাঁকড়িয়ে নিম্নবিত্তগোষ্ঠীর ‘সায়েন্টিফিক প্রফেট’ হওয়াটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য!

সেখানে কিন্তু ডিকেন্স শুধু উপন্যাস-বই লিখেই দমে থাকেননি। রাজনীতিতে সরাসরি যোগ না দিয়েও লেখনী দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমটার উৎকর্ষসাধন করেছেন। খাদ্য-পানীয় আর শিশুশ্রম সংক্রান্ত অনেক মানবিক আইন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অক্লান্ত অ্যাকটিভিজমের কারণেই হয়। অনেকগুলি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সহায়তা করেন। সেসব কর্মকান্ডের সুফল তাঁর পরবর্তীপ্রজন্ম এখনো ভোগ করছে। তাঁর ভাষায়, ‘দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হেড, অ্যান্ড… দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হার্ট!’ উচিত কথা!

(এখানে পাবেন গানটির কথা।)

কাতিউশার বিশ্বযুদ্ধ

Featured Video Play Icon

রাশিয়া আর পুতিন নানা কারণে আজকাল হেডলাইন নিউজ। রুশ ইতিহাস-সাহিত্য-সংক্রান্ত বইপত্র পড়ে আর ডকুমেন্টারি দেখে যেটা বুঝি, সেটা হল রুশ জনগণের একটা সামগ্রিক কালচারাল ম্যাসোকিস্ট সাবকনশাস সেন্টিমেন্ট আছে, যেটা তাদেরকে শ্বেত-লোহিত সকল প্রকার ৎসারদের দাসত্বশৃংখল মেনে নিতে প্রবৃত্ত করে (শ্বেত=রোমানভ সম্রাট, লোহিত=কমিউনিস্ট ডিক্টেটর)। রুশবিপ্লব সত্যিকারের অর্থে জনবিপ্লব ছিল না, ছিল মূলত পাওয়ার ভ্যাকুয়ামের সুযোগ নেয়া ক্যু!


আমার মনে হয়, সাধারণ রুশরা একটু সাদাসিধা টাইপ। তাদের দুর্ভাগ্য তাদের ঘাড়ে কেবল চতুর-ধূর্ত ডিক্টেটররাই চাপে। অথবা খারাপ সময়ে খারাপের এত চরম সীমায় তারা পৌঁছায়, যেখানে তাদের মনে হয় বিশৃংখলার চেয়ে অত্যাচারী শক্ত হাতও ভাল।


নিচের গানটার সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলার এমন একটা সময়ে, যখন সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদ আমাকে টানত। মার্ক্স-এঙ্গেলসের দুর্বোধ্য পুস্তক পড়ে তখন ধনতন্ত্র খারাপ, এই সরল কথাটাই খালি বুঝতাম। পরে অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাসের আরো সুবোধ্য বই-পুস্তক পড়ে বুঝেছি যে, সেই দুর্বোধ্যতার উদ্দেশ্য অনেকাংশে মার্ক্সের মেডিয়োক্রিটিকে ঢাকা। যেমনটা ছাইপাঁশ টেকনিক্যাল পেপারের জার্গন!


কাতিউশা নামের এই গানটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লেখা-গাওয়া, এখনো পপুলার। দেশাত্মবোধক এ গণসঙ্গীতের সুর বিপ্লবী ধাঁচের মনে হলেও, এতে বিপ্লবের ব-ও নেই, সুরটাও ফোক্। এতে কাব্যিক ভাষায় বর্ণিত হয়েছে সুদূর যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত প্রেমিকের জন্যে কাতিউশা নামের এক তরুণীর ভালবাসার স্বীকারোক্তি।


বিশ্বযুদ্ধের আগের রুশ দেশাত্মবোধক গানগুলি বিপ্লবী হোয়াইটওয়াশে সয়লাব থাকলেও, যু্দ্ধের সময় স্তালিনগোষ্ঠীকে নিজেদের চামড়া বাঁচাতে জনগণের চেতনানিয়ন্ত্রণে কিছুটা ছাড় দিতে হয়েছিল — আমার মনে হয় এ গানটা তার একটা নমুনা, তাই এখনো জনপ্রিয়। যুদ্ধপূর্বযুগে স্তালিনের বিভিন্ন জোর করে চাপিয়ে দেয়া নিয়মের ফলে দুর্ভিক্ষে-লেবার ক্যাম্পে দু’কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তিরিশের দশকের ইউক্রেনে সোভিয়েত সরকারের তৈরি দুর্ভিক্ষের দিনগুলিকে হলোকস্টের মত বলে হলোদোমোর (যে কারণে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা নাৎসিদের হাতে হাত মিলিয়ে রাজাকারি করেছিল)।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি আগ্রাসনের ফলেও বিপুল প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার অনেকটা তাদের পোড়ামাটি স্ট্র্যাটেজির কারণে। সোভিয়েত সাধারণ জনগণও প্রাণ বাঁচাতে আর প্রতিশোধ নিতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপীয় যুদ্ধের ম্যানু্য়ালের প্রথম নিয়মটা ভেঙ্গে হিটলার নাপোলেওনের মত ভালমত ফেঁসে গেছিলেন — নিয়মটা হলো, নেভার এভার মার্চ অন মস্কো! অপরদিকে, জার্মানি দখলের সময় প্রতিশোধপরায়ণ রুশ সেনারাও সমানে সাধারণ জার্মানদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ চালায়।


গানের সাথে যে ভিডিওটা জোড়া লাগানো, সেটা একটা সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা ফিল্ম থেকে নেয়া। শুরুর ফ্রেমের তিন সেনার মাঝখানের জন সম্ভবত ফিল্ড মার্শাল ঝ়ুকভ — টি-৩৪ ট্যাংক আর ‘কাতিউশা’ নামেরই ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল ব্যবহার করে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের অন্যতম মহানায়ক। স্তালিনের বিরুদ্ধমতে অন্য কেউ কথা বলার সাহস না পেলেও ঝ়ুকভ বলতেন। জার্মানিবিজয়ের সময় রুশ সৈন্যদের প্রতি তিনি বলেছিলেন, নাৎসিবাদকে ঘৃণা করো, কিন্তু জার্মান জনতাকে নয়। পশ্চিমা সেনানায়ক মন্টগোমারি-আইজেনহাওয়ারের সাথেও তাঁর বহুদিন বন্ধুত্ব ছিল। যুদ্ধের পরে স্তালিন নিজের গদি অটুট রাখার জন্যে ঝ়ুকভকে সুদূর উরালে পাঠিয়ে দেন, যাতে রাজনীতিতে অংশ নিতে না পারেন। কমিউনিজমের পতনের পরে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির মানুষ লেনিন-স্তালিনের মূর্তি ভূপাতিত করলেও ঝ়ুকভকে সরায়নি।


ভিডিওটিতে আরো দেখবেন যে ফ্যাক্টরিতে বাচ্চারা-মেয়েরা কাজ করছে। সোভিয়েতসহ পশ্চিমা দেশগুলিতে ছেলেরা সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ফলে মেয়েদের ঘরকন্নাসহ চাকরিবাকরিও করতে হয়েছে। পশ্চিমাদেশে নারীস্বাধীনতা আন্দোলন এ সময়েই হালে পানি পাওয়া শুরু করে। রুশদেশে ততটা নয়।


ভিডিওর শেষে কাতিউশা নামের রকেট লঞ্চার থেকে রকেট উৎক্ষেপণের দৃশ্য শব্দসহ দেখানো হয়েছে। আর্টিলারি হিসেবে এই অস্ত্র ছিল খুবই কার্যকর, কারণ খুব দ্রুত অনেকগুলি রকেট ছুঁড়ে শত্রুর মনে ত্রাস সৃষ্টি করতো এটা। যদিও এদের টিপসই নির্ভুল ছিল না।


গানটা গেয়েছে আলেক্সান্দ্রভ রেড আর্মি কয়ের বলে একটা দল। ১৯২৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনামলে দলটির যাত্রা শুরু, মূল লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক মুখপাত্র হিসাবে কাজ করা। পূর্ব জার্মানিতে যুদ্ধের পরে একটা পীস কনসার্ট করেও বেশ জনপ্রিয় হয়। ৯০এর দশকে কমিউনিজমের পতনের পরেও টিকে ছিল। ২০১৬র ২৫শে ডিসেম্বরে সিরিয়ায় একটা ক্রিসমাস পারফরম্যান্স করে ফেরার পথে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিমান দুর্ঘটনায় দলটির ৬৪জন সদস্য প্রাণ হারায়।

(এখানে গানটির কথা ও মানে।)

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!