পেপার ট্রেইল

“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।

অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

চীনের তাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।

মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।

সিল্ক রোডের ভারতীয়, পারসিক, চীনা অংশ

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।

সিল্ক রোডের অন্যতম স্থলবন্দর চীনের দুনহুয়াংএর গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে দেয়ালচিত্র। এখানে ভারতীয় প্রভাবে আঁকা বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী চিত্রিত।
বানর রাজা সুন উখোং, সম্ভবত চরিত্রটি ভারতের হনুমানজির অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট

তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।

নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।

আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।

সিল্ক রোডের পশ্চিম চীন প্রান্তের তুরপান শহরের প্রাচীন ভবন। তাকলা মাকান মরুভূমি পেরিয়ে চীনা তুর্কীস্তান কিংবা শিনজিয়াংএ এসে এই মরুদ্যান শহরে পৌঁছত সওদাগরি কাফেলা।

চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।

পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।

৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।

আব্বাসী খেলাফতের মানচিত্র

৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।

তিব্বতী সাম্রাজ্য, ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ
বর্তমান কাজাখস্তানে অবস্থিত তালাস নদী

তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।

আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।

তালাসের যুদ্ধ, ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ

অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।

তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।

মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।

চীনা ‘চান’ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম নিদর্শন ‘হাস্যরত বুদ্ধ’। আসলে ইনি লোককাহিনীতে বর্ণিত এক চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মে এরকম কিছু নেই। অর্থাৎ চীনা বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে স্বতন্ত্র।

এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।

চীনের ফাং মাতানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন, আনুমানিক দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ।

তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।

১১৮০তে পূর্ব ইরানে কাগজে তৈরি কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক ফোলিও (নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়াম)
ডানে একাদশ শতকের চীনা সং রাজবংশের সময়কালীন কাগজে আঁকা ক্যালিগ্রাফি (তাইওয়ানের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম)

একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।

সিরিয়া ও সাইকস-পিকো

নিচের তিনটি ডাকটিকেট সিরিয়ার জন্মলগ্নের। প্রথমটা আসলে তুর্কী সাম্রাজ্যের, কিন্তু ১৯১৯ সালে এর উপরে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার)। দ্বিতীয়টা ১৯২০এর, নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা এর প্রকাশের উপলক্ষ্য। আর শেষটা ১৯২১এর, আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর এবার ছাঁপ ফরাসীতে — ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার।

তুর্কী সাম্রাজ্যের ডাকটিকেটের উপরে ১৯১৯ সালে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ম্যাপে ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র দেখানো হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে সংঘাতের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি যতটুকু ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সমরাঙ্গনে। ইউরোপের থিয়েটারে সার্বিয়ার পক্ষ নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে অস্ট্রিয়ার মিত্র জার্মানি ও রাশিয়ার মিত্র ফরাসী-ব্রিটিশরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সেরকম, তুরস্ক-জার্মানির গোপন আঁতাঁতের পরে একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ তুর্কী সহায়তায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ওডেসা বন্দরের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনা ছিল তুর্কী যু্দ্ধমন্ত্রী আনওয়ার পাশার যুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র, কারণ সুলতানসহ ওসমানী সরকারের অনেকের যুদ্ধে সায় ছিল না। এরপর রুশদের আহ্বানে আবার সেই ফরাসী-ব্রিটিশদের তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা।

ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সুয়েজ় প্রণালী সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যের যুধ্যমান সকল পক্ষের চোখের মণি। সুয়েজ়বিজয়ের লক্ষ্যে জার্মান উপদেশ নিয়ে তুর্কীরা সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সুয়েজ়ের প্রতিরক্ষার খাতিরে ব্রিটিশ ক্যাম্পেন শুরু করার পাশাপাশি মক্কার ‘শরীফ’ হুসেইন বিন আলীর সাথে গোপন পত্রযোগাযোগ শুরু করেন মিশরের ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাকম্যাহন।

১৯২০এর সিরিয়া আরব রিপাবলিকের এই ডাকটিকেটের প্রকাশের উপলক্ষ্য নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শরীফ হুসেইন ছিলেন বিখ্যাত বনি হাশেম গোত্রের গোত্রপতি । সাতশ বছর ধরে তাঁর বংশ মক্কা ও মদিনার শাসন পরিচালনা করে আসছিল — অবশ্য ওসমানী সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল হেজাজ়।

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপর হেজাজ়ের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। তুর্কীদের সাথে হুসেইন বিন আলীর বহুদিনের ভাল সম্পর্ক থাকার পরেও যখন মক্কায় হজ্জ্বযাত্রীদের আগমনে ভাঁটা পড়া শুরু করলো, মিশর থেকে খাদ্যশস্য আসা গেল বন্ধ হয়ে, আর শেষে যখন তিনি খবর পেলেন ওসমানীরা তাঁকে সরানোর মতলব করছে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেবার।

১৯২১এর আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর ফরাসীতে ছাঁপ ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, যার অর্থ ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার

তিনি ম্যাকম্যাহনের সাথে চুক্তি করলেন যে তুরস্কের বিরুদ্ধে বেদুইন সৈন্যদলের সাহায্যের বিনিময়ে ব্রিটিশরা উত্তরে হালাব (আলেপ্পো) থেকে দক্ষিণে আদেন পর্যন্ত আরব এলাকায় তাঁকে স্বাধীন রাজ্যগঠনে সমর্থন দেবে। অবশ্য মধ্যোপসাগর তীরের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চল, আর দক্ষিণ আরবের আদেন-কাতার-কুয়েত ইত্যাদি ইউরোপীয়দেরই থাকবে। হুসেইন আরো দাবি করলেন বেদুইনদের সমর্থন কেনার জন্য লাখ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, যাতে ম্যাকম্যাহন রাজি হলেন। (এসময় এই এলাকায় তেল আবিষ্কার হয়নি।) সে চুক্তির পরে টি.ই. লরেন্স বা ‘লরেন্স অফ আরাবিয়া’ ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহীদের উপদেষ্টা হিসাবে এসে হাজির হন।

এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিদের সহায়তায় আরব স্বাধীনতাকাংক্ষীদের ডি ফ্যাক্টো প্রতিনিধি হয়ে যান হুসেইন। ওসমানী সাম্রাজ্যের মধ্যবিত্ত আরব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৩ সালে প্রথম আরব কংগ্রেসের মাধ্যমে যে আরব জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা করেন, রাতারাতি তার রাজনৈতিক ঝান্ডা হাইজ্যাক হয়ে যায়। ওসমানী আরব প্রদেশগুলিতে যেসকল বেদুইন গোত্রের আবাস ছিল, তারাও উৎকোচ নিয়ে তু্র্কীদের সাহায্য করে। অর্থাৎ আরবের নেতা হিসাবে হুসেইন বিন আলীর সমর্থন সব জায়গায় ছিল না। এসুযোগে এক সময় ওসমানীরা মক্কা দখল করে নেয় আর পবিত্র শহরটির বিপুল ধ্বংসসাধন করে।

ম্যাপে দেখানো হেজাজ় রেলওয়ে ছিল ইস্তাম্বুল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ওসমানী সেনাবাহিনীর সাপ্লাই লাইন। ব্রিটিশ ও ফরাসীদের অর্থ ও প্রযুক্তির সাহায্যে হুসেইন বিন আলীর পুত্র ফয়সাল এই রেললাইনের ওপর চোরাগোপ্তা মাইন হামলা, লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর গেরিলাদল ছিল ট্রাইবাল বেদুইন আর ওসমানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী আরবদের নিয়ে সংগঠিত। টি.ই. লরেন্স ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনায় তাঁর শরিক। পূর্বদিকে ফয়সালের এক ভাই আব্দুল্লাহ তুর্কী মিত্র রাশিদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করেন। আরেক ভাই আলী দক্ষিণে মদিনায় তুর্কীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন।

এভাবে হেজাজ় রেলওয়ে ধরে ধীরে ধীরে উত্তরদিকে অগ্রসর হয় আরব সেনাদল। ফয়সাল একে একে জেদ্দা, ইয়ানবো, আকাবা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নগর জয় করেন। অন্যদিকে মিশর থেকে ব্রিটিশ-ফরাসী ফৌজও সিনাই হয়ে ফিলিস্তিন-লেবাননে ঢুকে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯১৮এর সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ঈজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স সিরিয়ার দামেস্ক দখল করে নেয়। ফয়সালও তাদের পিছু পিছু দামেস্কে প্রবেশ করে আরবদের জন্যে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। সে রাজ্যে ধর্মনির্বিশেষে সকল আরবদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

কিন্তু এর পরপরই ফয়সাল ও হুসেইন একের পর এক দুঃসংবাদ পাওয়া শুরু করলেন। জানতে পারলেন ১৯১৭তে ব্রিটিশদের ঘোষিত বালফুর ডিক্লারেশনের কথা — যাতে ফিলিস্তিনের অংশবিশেষে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইহুদীদের জন্যে আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার অধিকার স্বীকৃত হয়। আরো তাঁদের কানে এলো ব্রিটিশ-ফরাসীদের গোপন সাইকস-পিকো চুক্তির কথা। এর শর্তানুযায়ী সিরিয়া-লেবানন আর ইরাক হবে যথাক্রমে ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক বলয়ের অংশ, স্বাধীন আরব বাসভূমি নয়। ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে বিশ্বাস হারালেন না অবশ্য ফয়সাল। ভাবলেন, সাইকস-পিকোর বাস্তবায়ন হবে যুদ্ধের সমাপ্তিতে, ততদিনে তিনি ব্রিটিশদের মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।… এর এক মাস পরেই অক্ষশক্তি আত্মসমর্পণের ফলে যুদ্ধের যবনিকাপাত হয়ে যায়।

যুদ্ধের পরে তুরস্কের দখলকৃত এলাকাগুলির কি হবে সে নিয়ে প্যারিসে মিত্রশক্তির আলোচনা বসে। তাতে যোগ দেন ফয়সাল। মার্কিনরা ব্রিটিশ আর ফরাসীদের রাজি করায় স্বাধীন কিং-ক্রেইন কমিশনের মাধ্যমে ফয়সালের সমস্যাটি সমাধান করতে। সে কমিশন ১৯২০এ সিরিয়ায় এসে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন শহরে গিয়ে আরব জনগোষ্ঠীর মতামত নেয়া শুরু করে। তাদের মতে পৌঁছতে বছর খানেক সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত যখন সে কমিশনের রিপোর্টও এল যে এসব এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী কোন না কোন প্রকার স্বাধীনতা চায় আর এদের সকলে স্বাধীন আবাসভূমির যোগ্য না হলেও সিরিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব, ততদিনে ব্রিটিশ-ফরাসীরা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছে, আর লীগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সাইকস-পিকো চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাগিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র লীগের সদস্য হয়নি, কংগ্রেসের বাগড়া দেয়ার কারণে। তাই কিং-ক্রেইন কমিশনের রিপোর্টও বস্তাবন্দি হলো।

এসব ঘটনার বিপরীতে সিরিয়ায় ফয়সালপন্থী বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান আর দক্ষিণ সিরিয়ার দ্রুজরা অবশ্য ফয়সালবিরোধী ছিল। ফরাসীরা সেনাদল পাঠিয়ে জোরপূর্বক নিজেদের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সাথে এক দফা যুদ্ধে ফয়সালের সেনাদল পরাজিত হয়। ফয়সাল হার মেনে যুক্তরাজ্যে নির্বাসন চলে যান। এখানে শুরু হয় তৃতীয় ডাকটিকেটটির ইতিহাস।

অবশ্য ফয়সালকে বেশিদিন রাজ্যবিহীন রাজা থাকতে হয়নি। ব্রিটিশরা তাদের ম্যান্ডেটরাজ্য ইরাকে তাঁকে রাজসিংহাসনে বসায়। আর ট্রান্সজর্ডান ম্যান্ডেটের রাজা হন তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ। হেজাজ় রাজ্যে তাঁদের বড় ভাই আলী কিছুদিন রাজা থাকার পর সৌদী আক্রমণের মুখে ১৯২৫এ তাঁকে গদি ছাড়তে হয়। সেখানে শুরু হয় ইতিহাসের নতুন এক পাতা।


(১) মিডল ঈস্ট থিয়েটার ছিল পাঁচটি সমরাঙ্গন জুড়ে: সিনাই-ফিলিস্তিন, মেসোপটেমিয়া, ককেশাস, পারস্য, আর গালিপোলি। মেসোপটেমিয়া বা ইরাক অভিযানে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অংশগ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুল এ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে লাহোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নেন, কিন্তু সে যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়নি। [Middle Eastern theatre of World War I]

(২) ইজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স বা ই.ই.এফ. ছিল মিশরভিত্তিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, ফ্রান্স ও ইতালীর সম্মিলিত সেনাদল। কমনওয়েলথ সেনাদলের অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডার কোরের ডাকনাম আনজ়াক — এরা গালিপোলি সমরাঙ্গনে সাহসিকতার সাথে লড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরেক ক্যাজুয়াল্টি ছিল মিশর। ১৮৬৭ থেকে নামে মাত্র তুরস্কের অধীন ছিল মিশরের স্বাধীন শাসক খদিভরা, ইউরোপীয়দের সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। ১৯১৪ সালে খদিভ আব্বাসকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা সরাসরি মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করে, এর মূল কারণ ছিল ভারতের সাথে যোগাযোগের অবলম্বন সুয়েজকে রক্ষা করা। [Egyptian Expeditionary Force]

(৩) মক্কার শরাফা বা আমিরাত, এ ছিল হুসেইন বিন আলীর রাজ্যের আনুষ্ঠানিক নাম। হেজাজ়ের আগে এটি সার্বভৌম রাজ্য ছিল না। ৯৬৮ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত এই রাজ্যটি নানা আকারে বহাল ছিল। [Sharifate of Mecca]

(৪) বনি হাশেম গোত্র প্রাচীন কুরাইশ বংশের অন্তর্গত, এর নাম হযরত মুহম্মদের(স.) প্রপিতামহের নামে। অর্থাৎ হুসেইনের একটা ধর্মীয় বংশগত মর্যাদা ছিল। তিনি সৌদী ছিলেন না। সৌদীরা এসময় ছিল মরুভূমির সীমিত গুরুত্বের বেদুঈন গোত্রমাত্র। আর তাদের শত্রুতা ছিল হুসেইনের সাথে। হুসেইনের তিন পুত্র আলী, ফয়সাল ও আবদুল্লাহ পর্যায়ক্রমে হেজাজ, সিরিয়া-ইরাক আর জর্দানের রাজা হন। ১৯২৫এ ইবন সৌদ নজদ রাজ্য থেকে আক্রমণ চালিয়ে হেজাজ় দখল করে নিয়ে সৌদী আরব রাজ্যের সূচনা করেন। আলী জর্দানে ফিলিস্তিন আততায়ীর হাতে মারা যান ১৯৫১তে। আর ফয়সালের পৌত্র ইরাকের রাজা দ্বিতীয় ফয়সাল মিলিটারি কুতে ১৯৫৮ সালে নিহত হন। এখন একমাত্র জর্দানে হাশেমী রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে অনেকদিন হুসেইন ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাঁর পুত্রদের রাজমুকুট পড়িয়েও ব্রিটিশরা তাঁর রাগ ভাঙ্গাতে পারেনি। শেষে তাঁকে ছেড়ে সৌদবংশের সাথে মিত্রতাচুক্তি করে ব্রিটিশরা। [Hussein bin Ali, Sharif of Mecca]

(৫) টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স তাঁর ডাকনাম অর্জন করেন ব্রিটিশ খবরের কাগজে আরব বেদুঈনদের স্বাধীন একরোখা জীবনের রোমান্টিক চিত্র অঙ্কন করে। গুপ্তচর-কূটনীতিক-সেনাপ্রধানের পাশাপাশি শখের প্রত্নতত্ত্ববিদও ছিলেন। ১৯৬২তে তাঁর জীবনের ঘটনা নিয়ে তৈরি অনবদ্য ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের রূপ দেন অভিনেতা পিটার ও’টুল। ফয়সালের সাথে তাঁর ভাল সখ্য থাকলেও বাকি দু’ভাইকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি লরেন্স। [T. E. Lawrence]

(৬) (৬) ওসমানী সাম্রাজ্যের আরবদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয়দের তুলনায় অধুনার ধারণা। ১৯০৮এ বিপ্লবের মাধ্যমে তুরস্কের শাসনক্ষমতা নেয় ইয়াং টার্ক বলে একদল প্রগতিশীল কর্মজীবী নেতা। তাদের শাসনামলে সংসদীয় প্রথার পুনর্প্রবর্তন হলেও বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তার ওপর বাল্কানের যুদ্ধের ডামাডোল। ফলে ১৯১৩তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তিন পাশার ত্রিনায়কতন্ত্র। প্রতি ক্ষেত্রেই তুর্কীরা স্বহস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় ইউরোপে অবস্থানরত একদল বীতশ্রদ্ধ আরব শিক্ষার্থী ১৯১৩তে প্যারিসে একটি আরব কংগ্রেস ডাকে। এতে ওসমানী সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি এলাকার বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে আরবদের সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, বরং স্বাধিকার। ফিলিস্তিনে তুর্কী অভিবাসন আইনের সদ্ব্যবহার করে ইহুদীদের আগমন আর ব্রিটিশ-ফরাসীদের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল আরবদের সংগঠিত হবার আরেক কারণ। আরব কংগ্রেস থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড, বাথ পার্টি, ফ্রী অফিসারস, প্রভৃতি মুভমেন্টের ধারার বিবর্তন। অর্থাৎ হাশেমী-সৌদী রাজতন্ত্রের ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা বাহুল্য, এসময় অধিকাংশ অশিক্ষিত বেদুঈন গোত্রীয় যোদ্ধার দল এত কিছু বুঝত না। প্রাচীনকালের নিয়মানুযায়ী যে দল বেশি উৎকোচ দিত, তাদেরই পক্ষ নিত তারা। [Arab Congress of 1913]

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

তুর্কীনাচন

Featured Video Play Icon
ইসলামের প্রসার ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফী চিন্তাধারার অবদান অনস্বীকার্য। আর সুফী সাধকদের মধ্যে মওলানা রুমী উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত — তুরস্ক-পারস্য-ভারতে তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাঁর কাব্য আজ বহুলপঠিত।

উপরের ভিডিওতে যেটা দেখছেন, তাকে নাচগানের পর্যায়ে ফেলাটা ভুল হবে। এই পারফরম্যান্সটা জনসমক্ষে করা হলেও অতীতে এ ধরনের প্রার্থনাগীতি আর ঘূর্ণিনৃত্যের সমাবেশ হত শুধু মৌলভীদের খানকায়। যে কেউ তাতে অংশ নিতে পারত বা দেখতে যেতে পারত, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা, দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন নয়।

এই ধরনের জ়িকর বা স্রষ্টার নামস্মরণ করাকে তুর্কী ভাষায় বলে সেমা, যেটার আরবী শব্দমূলের অর্থ শ্রবণ করা। প্রখ্যাত সুফী কবি জালালুদ্দিন রুমী ত্রয়োদশ শতকে মিস্টিসিজ়ম বা গূঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে সেমাসহ অন্যান্য সুফী ঐতিহ্যের সূচনা করেন, যেটা তুর্কী-ফার্সী-আরবী ভাষায় মৌলভী তরিকা বলে পরিচিত। মূলধারার অনেক মুসলিম মনীষীদের হিসাবে এগুলি ইসলামের বিপরীত নয়, নামাজ-রোজার প্রতিস্থাপকও নয়। রুমী কুরআন-হাদীসের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রকাশিত জানা নিয়মকানুন থেকে শুরু করার পরে ইসলামের আরেকটি গূঢ় অন্তর্মূলে যাওয়া সম্ভব, যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক প্রেমের। সেমার মত জ়িকর সুফী সাধককে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করে।

সুফী দর্শনের শুরু রুমীর মাধ্যমে নয়, তাঁর আগেও অনেক মনীষী ইসলামের মানবিক আধ্যাত্মিক দিকগুলি খুঁজে বের করে তার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত সাধক ছিলেন একজন নারী, তাঁর নাম রাবিয়া বসরী। আর ইমাম গাজ্জ়ালী — যাঁর মতাদর্শের প্রসারের কারণে ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের ইসলামী যুক্তিবাদী দর্শন জনপ্রিয়তা-পৃষ্ঠপোষকতা হারানো শুরু করে — তিনি আশারী নামক সুফী মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন। বিজ্ঞান দিয়ে স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে বোঝার থেকে তাঁর পছন্দ ছিল অন্তর্মুখী সাধনা আর ধ্যানের মাধ্যমে স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়া আর সৃষ্টির মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করা। তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী, যদি অন্তরের পবিত্রতা থাকে, তাহলে নাচ-গান-সুরের সাহায্য নিয়ে জ়িকর করা অবৈধ নয়।

এই পারফরম্যান্সে তাই দেখতে পাচ্ছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার — যার মধ্যে আছে নেই নামক বাঁশি, রিক্ক্ বলে খঞ্জনী, গীটারের মত উদ, আর আমাদের সন্তুরের মত কানুন। শিল্পীরা তাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফাতিহা দিয়ে শুরু করেছেন, কিন্তু সেমার বাকি অংশে কোন কুরআন-হাদীসের বাণী টানা হয়নি। সেটা ইচ্ছামূলক, যেন কেউ তাঁদের আবৃত্তিকে পবিত্র বাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলে পাপী না হয়।

কানুন বাদ্যযন্ত্রটি এখানে বাজাচ্ছেন জ়ুলিয়্যাঁ জালালুদ্দিন ওয়াইস বলে এক ফরাসী মিউজ়িশিয়ান, যিনি ইউরোপে সুফীসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ। সিরিয়ার দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়্যা মসজিদের শেখ শাক্কুর এখানে প্রধান গায়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন। খোদাকে স্মরণ করছেন কয়েক রকম নামে, আল্লাহু হা’ঈ অর্থ আল্লাহ সদাজীবিত, সর্বদা-জাগ্রত। ক’দিন আগে একটা হিব্রু ইয়েমেনী গান নিয়ে লিখেছিলাম, সেখানেও স্রষ্টাকে একই হা’ঈ নামে ভূষিত করেছেন ইহুদী গীতিকার। আরেকটা উপাধিতে খোদাকে স্মরণ করছেন শেখ শাক্কুর, আলিমুল সির্‌রি‍‍‍ ওয়া জাহরি, অর্থাৎ গুপ্ত আর প্রকাশিত সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ। এখানেই উঠে এসেছে সুফী চিন্তাধারার মূল প্রতিপাদ্য, যে, আক্ষরিকের পরেও কুরআন-হাদীসে ‘গুপ্ত’ একটা লেভেল আছে, সেটা হিউম্যানিজ়ম বা মানবতাবাদ থেকে খুব অভিন্ন কিছু নয়।

ঘূর্ণিনৃত্যের পোশাক আর একেকটা অঙ্গভঙ্গির মধ্যেও গুহ্য অর্থ রয়েছে। সিক্কা বলে ঊটের লোমের তৈরি লম্বা টুপি আসলে সমাধিস্তম্ভের রূপক, সে সমাধি আত্ম-অহমের। আর শিল্পীদের পরনে যে ঢোলা স্কার্টের মত সাদা পোশাক, সেটা যেন কাফনের কাপড়। তাঁরা শুরু করছেন বুকের উপরে দু’হাত রেখে বাউ করে, এই ভঙ্গি তওহীদ বা স্রষ্টার একত্বের প্রতীকী ঘোষণা। তাঁরা ঘুরছেন ডান থেকে বামে, ডান হাত কখনো উপরে ফেরানো, বাম হাত অধঃমুখী। যেন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসার বাহক হিসাবে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে এসে বিলিয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর বাকিসব প্রাণীকে। গ্রহনক্ষত্রের আবর্তনের প্রাচীন স্বর্গীয় নিয়মকে অনুকরণ করে সেমাজ়েনরা ঘুরে চলেছেন। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়া তাঁদের লক্ষ্য নয়।

রুমীর চিন্তাধারার মধ্যে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষেরই খোদার ভালবাসা ‌অর্জনের ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, অন্যান্য অনেক প্রাচীন আর আধুনিক ধর্মের মধ্যেও সুফীদের মত আধ্যাত্মিক দর্শনের উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টের আগমনের সময়ে গ্নস্টিসিজ়ম বলে একটা গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শন প্রচলিত ছিল, যেটা প্রাক-ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্মকেও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম কিংবা শ্রীকৃষ্ণলীলাও এধরনের গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উত্তম উদাহরণ। তাই বলে এটা ভাবাটা পুরোপুরি ঠিক নয় যে, রুমী ও অন্যান্য সুফীরা অনৈসলামিক চর্চাকে ইসলামী রূপ দিয়েছেন। তাঁরা স্বগরিমায় মূলধারার ইসলামী আইনকানুনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার বিবর্তন হয়েছে অনেক পড়াশোনা আর মেডিটেশনের মাধ্যমে।

সুতরাং সুফীবাদ ইসলামের থেকে আলাদা বিশেষ কিছু নয়। একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সুফীদের বহু তরিকা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। ভারতে ইসলামের বিস্তারের মূল কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে সুফী সাধকদের আগমন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ভারতবর্ষের নামীদামী মাদ্রাসাগুলো সুফী মতাদর্শেরই দিকপাল ছিল। বায়েজ়িদ বোস্তামী, হাফেজ়, শেখ সাদী, রুমী ইত্যাদি মনীষীর চিন্তাধারা পরবর্তীতে প্রভাবিত করেছে মির্জ়া গালিব, ইকবাল, নজরুলের মত কবিকে।

আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থার কারণে মুসলিমরা হয় পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদী ধারায় ফিরেছে, নয়ত সালাফী-ওয়াহহাবী অর্থায়নের কারণে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থটাকে গ্রহণ করে একটু কট্টরপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছে। দু’পক্ষের কেউই সুফী চিন্তাধারার শক্তিটাকে অনুধাবন করতে পারে না। অবহেলার কারণে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ভন্ডপীর আর মুরীদের দল সুফী মতবাদকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে।

বিশেষ করে সালাফীরা সুফীসাধনাকে অনৈসলামিক মনে করে। তারা সেমা, জ়িকর, নামাজের পর দোয়া — এসব সুফী প্রথাকে বলে বিদআত বা ধর্মবিচ্যুত উদ্ভাবন। সেকারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইসিস খুঁজে খুঁজে সুফী সাধকদের হত্যা করেছে। জালালুদ্দিন ওয়াইস তখন তাঁর দামেস্কের বাসস্থান থেকে পালাতে বাধ্য হন। এই ভিডিওতে অংশ নেয়া সেমাজ়েনদের অনেকে এখন গৃহহীন রেফ্যুজি, একজন পায়ে শ্রাপনেলের আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী।

আবার যুক্তিবাদী সেক্যুলারদের শাসনেও সুফীরা তাদের অনেক অধিকার হারিয়েছে। ১৯২৫ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে প্রকাশ্যে সুফী মতবাদের চর্চা আইন করে বন্ধ করে দেন, অভিযোগ ছিল এগুলো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার। ইস্তাম্বুলের প্রায় আড়াইশ’ তেক্কে বা খানকা বন্ধ করে দেয়া হয়, নয়ত তাদের জাদুঘর হিসাবে সরকারী মালিকানায় নিয়ে আসা হয়। তারপরেও অনেক সুফী গোপনে ব্যাক্তিগতভাবে চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সেমা পালন করার লাইসেন্স দেয়া হয়। ২০০০এর দশক থেকে এখন খুব একটা কড়াকড়ি নেই। মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলি থেকে অবশ্য সত্যিকারের সুফীবাদ পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে, আছে খালি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের খোলস হিসাবে। অথচ একসময় এরাই সুফীসাধনার অগ্রগণ্য কেন্দ্র ছিল।

পশ্চিমাবিশ্বে কিন্তু এখন সুফীদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পরে অনেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে সুফীবাদকে পুনরাবিষ্কার করেছে। আমেরিকায় কবিতার বইয়ের কাতারে রুমীর অনুবাদগুলো এখন বেস্টসেলার। ইউনেস্কোও ২০০৮এ সেমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানবসভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য হিসাবে।

মানবতার সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে রুমীর লেখা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করিঃ
“At times we are hidden, at times revealed;
We are Muslims, Christians, Jews; of any race.
Our hearts are shaped like any human heart,
But every day we wear a different face.”

স্বদেশে পরদেশী উইগুর

Featured Video Play Icon

আজ যে জাতির সঙ্গীত নিয়ে লিখছি, তারা যে কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত হচ্ছে, এটা মনে হয় বাকি পৃথিবী ভুলে যেতে বসেছে। গানটা যে ‌অ্যালবাম থেকে নেয়া, তার নাম ‘লিসেন টু দ্য ব্যানড’ — এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে যেসব শিল্পীদের গান নিষিদ্ধ, তাদের নিয়ে এটা করা। গানটার ভাষা উইগুর, দুতারনামক বাদ্যযন্ত্রবাদক গায়কের  নাম কুরাশ সুলতান। তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে নির্বাসনে প্রয়াত হয়েছেন।

উইগুররা চীনের উত্তরপশ্চিমের শ়িনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজিয়নের বাসিন্দা। তাদের খবরাখবর বহির্বিশ্বে খুবই কম পাবেন, বিশেষ করে ২০০৯এর হান-উইগুর দাঙ্গার পর। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বাইরে থেকে কোন সাংবাদিক সেখানে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখে, বেশির ভাগ সময় ঢুকতে দেয় না, আবার নেটিভদের সাথে বেশি মেলামেশা করলে তাদেরকে এস্কর্ট করে প্রদেশের বাইরে বের করে দেয়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানকার সত্য খবর রিপোর্ট করে। প্রাদেশিক সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারেরই সাজানো, যতই তারা স্বায়ত্তশাসিত বলে নিজেদের দাবি করুক। এরকম আরো দুটো এলাকা আছে চীনে — তিব্বতকে সবাই চিনে দালাই লামার খাতিরে, আরেকটা নেই মেংগু বা ইনার মংগোলিয়া

উইগুরদের ইতিহাসটাও খুব চমকপ্রদ। এরা আসলে তুর্কী জাতি। তুর্কীরা তুরস্কে ঘাঁটি গাঁড়ার আগে ছিল মোঙ্গলদের পড়শি, আর তাদের মতই গরু-ভেড়া-চড়ানো যাযাবর গোষ্ঠী। মোঙ্গল, তিব্বতী, পারসিক আর চৈনিক রাজ্য দিয়ে চারিদিক ঘেরা তুর্কীরা মোঙ্গলদেরও আগে একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছিল, যার নাম গোকতুর্ক। এরা উপাসনা করত তেংরি বলে এক আকাশদেবতার, মোঙ্গলদের মতই। এদের নয়টি ট্রাইব দোকুজ়-ওগুজ়দের একটা উইগুররা। উইগুরদের তুতো ভাইয়েরা আরো পশ্চিমে গিয়ে সফল সাম্রাজ্য গড়েছে, আর উইগুররা ছিল সিল্ক রোডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকলা-মাকান মরুভূমি আর তিয়ানশান পর্বতমালার রক্ষক। কুবলাই খানের কজ়মোপলিটান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরকারে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য তুর্কী জাতের শত্রুদের বিরুদ্ধে এরা  চীনের প্রতাপশালী সুই সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। বাঙ্গালীদের মত উইগুররাও একেক সময় একেক ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমে অ্যানিমিস্ট থাকলেও, পরে মানিকেয়ান হয়েছে, বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ করেছে, নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টানও ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছে মুসলিম। এখনও অনেক উইগুর ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু প্রাচীন নিয়মকানুনের ছায়া রয়ে গেছে।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার অনুন্নত-বিভক্ত-পশ্চাদপর খানশাসিত ছোট ছোট পারসিক-তুর্কী রাজ্যগুলিকে রাশিয়ার রোমানভ় সাম্রাজ্য আর চীনের চ়িং সাম্রাজ্য একের পর এক দখল করে করদ রাজ্য অথবা উপনিবেশ বানানো শুরু করে। উইগুরদের দেশ এসময় চ়িংদের আয়ত্ত্বে আসে। এসময় করদরাজ্য হিসাবে আর দূরত্বের কারণে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রার উপর চীনাদের প্রভাব খুব কমই ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে চীনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রুশ কম্যুনিস্ট সরকারের প্ররোচনায় ১৯৩৩ আর ১৯৪৪এ দু’বার তারা স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিলেও প্রথমটা কয়েক মাস আর দ্বিতীয়টা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯৪৯এ রুশসমর্থিত দ্বিতীয় স্বাধীন তুর্কেস্তান সরকারের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদেরই ষড়যন্ত্রে প্লেনক্র্যাশে মারা যাওয়ার পর শেষ কম্যুনিস্ট সদস্য মাওৎসেতুংএর কাছে রাজাকারি করে রাজ্য সপে দেয়

এরপর মাওয়ের কালচারাল রেভোল্যুশনের সময় বাকি চীনবাসীদের সাথে সাথে এরাও ভুক্তভোগী হয়েছে। ১৯৪৯এ হানগোষ্ঠীর চীনাদের জনসংখ্যা উইগুরিস্তানে ৬% হলেও সরকারী নীতির কারণে ধীরে ধীরে বেড়ে এখন প্রায় ৪০%। হানরা ব্যবসাবাণিজ্য-চাকরিক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু তারা উইগুরদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে না, সম্মান করে না। স্বভাবতই শ়িনজিয়াং জাতিগত সংঘাতের একটা ঊর্বরক্ষেত্র।

দেং শ়িয়াও পিংএর সংস্কারের আমলে কিছুটা স্বাধিকারচর্চার সুযোগ পেলেও শ়ি জিন পিংএর চাইনিজ় এক্সেপশনালিজ়মের মুখোশপরা চীনা জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসরণের কারণে উইগুররা একটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডারিন না শিখলে তাদের জীবিকা নেই, লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ, মসজিদে অনূর্ধ্ব-আঠারো প্রবেশ নিষেধ, জায়গায়-জায়গায় সারভেইল্যান্স ক্যামেরা বসানো। এমনকি তাদের নিজ দেশের ইতিহাসকেও হানজাতির স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে ইন্জিনিয়ার করা হচ্ছে। অল্প কিছু উইগুর মুক্তির সন্ধানে  কট্টরপন্থী জিহাদী ইসলামে ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ভুলের অজুহাতে পুরো জাতটাকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামলেই তাদের টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘রিএডুকেশন ক্যাম্পে’ নাকি দশ লাখ উইগুর বন্দী, সেখানে নাকি তাদের জোর করে শুকরের মাংস, অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তের ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি। ইলহাম তোহতী বলে এক অর্থনীতিবিদ উইগুর অনলাইন বলে একটা সাদামাটা ওয়েবসাইট চালাতেন, তাঁর সাথে লাদেনকে জড়িয়ে দিয়ে এখন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রেখেছে। আবলাজান আইউব বলে এক অরাজনৈতিক জনপ্রিয় পপ গায়ককেও জুনমাসে লাপাত্তা করে দিয়েছে। দালাই লামার মত উইগুরদেরও স্বেচ্ছানির্বাসিত নেত্রী আছেন যার নাম রাবিয়া কাদির, কয়েকবার শান্তির নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েছেন।

ইউটিউবে উইগুর মিউজ়িক সন্ধান করলে অনেক নাচগান দেখবেন, এদের অধিকাংশই শো, বাইরের মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টা যে উইগুররা সুখেশান্তিতে নাচাগানা করে আছে। কামাল আতাতুর্ক একদিকে যেমন সুফী জিকির অবৈধ করেছিলেন, অন্যদিকে দরবেশদের সুফী ঘূর্ণিনৃত্য সমানে চলেছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে — চীন সরকারের এ প্রয়াস তার থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং আরো ভয়ানক কারণ এভাবে উইগুরদের জাতিগত পরিচয়টাকেই তারা ইনজিনিয়ার করে ফেলছে। সোভিয়েতরাও তাদের অনেক সংখ্যালঘু জনসত্ত্বাকে একইভাবে রিডিফাইন করেছিল।

মুসলিম দেশের সরকারগুলি ফিলিস্তিন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও উইগুরদের নিয়ে রহস্যজনকভাবে মৌন থাকে, সম্ভবত চীনের সাথে খাতিরের সম্পর্ক বজিয়ে চলার জন্যে। তুরস্কে অনেক উইগুর নির্বাসনে থাকলেও তুরস্কের সরকারও চুপচাপ, কথা বললেই কুর্দী-আরমেনিয়ানদের পুরনো কংকাল সিন্দুক থেকে বেরিয়ে নাচানাচি করবে। মার্কিন আর ইউরোপিয়ানরাই কিন্তু বছরের পর বছর তিব্বতী-উইগুরদের স্বাধিকারের পক্ষে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। ২০০৮এ একটা গণসংগ্রামের প্রচেষ্টা হলেও ইন্টারনেটে ইনজিনিয়ারড গুজব ছেড়ে চীনারা টেরোরিজ়মের জুজু দেখিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেসময় বাইরে থেকে বিবৃতির বেশি সাহায্য আসেনি। তাই অনেক তরুণ উইগুর স্বাধিকার-সংস্কৃতি-মানবাধিকার ভুলে কষে ম্যান্ডারিন শিখছে। অতএব আপাতত সিপিসি সফল।

গানের ভিডিওটিতে কিছু দৃশ্য ভায়োলেন্ট, ২০০৯এর উরুমচি শহরের দাঙ্গার যেটুকু পাবলিক ভিডিও রেকর্ড আছে তার কিছুটা। বাকি অংশ আগের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। ইলহাম তোহতীর একটা হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ পাবেন এখানে

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!