আফিম যুদ্ধ

(জাপানের মেইজি যুগ সম্পর্কে এ লেখাটি লিখতে গিয়ে চীনা-ভারতীয় আফিমের ডালপালা গজিয়ে গেল!)

ব্রিটিশদের সাথে চিং সাম্রাজ্যের দু’দু’টো যুদ্ধ হয়েছিল আফিমব্যবসাকে কেন্দ্র করে (প্রথম, ১৮৩৯-৪২; দ্বিতীয়, ১৮৫৬-৬০)। এর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের সর্বাধিক, আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে অসম অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা হয়ে যায় অর্ধেক। চীনের মানুষ এখনও মনে করে যে তারা এসময় পশ্চিমের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। আফিম যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আর ফলশ্রুতি অবশ্য এভাবে এক লাইনে বর্ণনা করলে দু’পক্ষের প্রতিই অবিচার করা হবে। তাই আমি আরেকটু বড় করে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি।

(এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় জাপানের একতরফা আগ্রাসনের মুখে চীনের নতুন প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা সরকারদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর সহানুভূতিশীলতা পেয়েছিল।)

আফিমের ওষধি গুণাগুণ আর আসক্তিকর প্রভাবের কথা প্রাচীন চীন ও ভারত দুই এলাকারই মানুষ জানত। আমরা রান্নায় যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি সীড বা আফিম গাছেরই বীজ। মধ্যযুগে চীনে স্থানীয়ভাবে আফিমের চাষ তেমন একটা হত না। মূলত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদের পর চীনে রপ্তানি হত আর কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হত। আকবরের সময় মুঘলরা ছিল চীনে আফিমব্যবসার একচেটিয়া সত্ত্বাধিকারী। মুঘলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (ইআইসি) উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যবসা পায়। অবশ্য সপ্তদশ শতকে ইআইসি নয়, ভিওসি (ডাচ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) ছিল চীনের মূল আফিম সরবরাহকারী।

১৯০৮ সালে মার্কিন আলোকচিত্রী ভারতের সরকারী ফ্যাক্টরিতে আফিম ওজন করার দৃশ্য ধারণ করেছেন — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

সপ্তদশ শতকের শেষে চিবিয়ে খাবার বদলে ধূম্রপানের মাধ্যমে আফিমসেবনের নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। আফিমের ধোঁয়া ছিল আরো বেশি আসক্তিকর। ভারতের থেকে চীনেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবে আফিমসেবন। এ কারণে চিংসম্রাট ফরমান জারি করে ১৭২৯ সালে আফিমের ব্যবহার ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেন। প্রথম প্রথম তাতে আফিমের আমদানি কমলেও দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়। সরকারি দুর্নীতি আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতকের শেষে আফিমব্যবসার চাবিকাঠি ইআইসির হাতে এসে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে ভারতের সবচে’ বেশি আফিমউৎপাদনকারী দুই এলাকা — বাংলা ও বিহার। আর পশ্চিমে ছিল মলওয়া রাজ্য। কলকাতায় বাঙ্গালী জমিদার আর মারোয়াড়ি বণিকরা কম্পানি খুলে বসে ইআইসির জাহাজে আফিম সাপ্লাইয়ের জন্যে। আফিমচাষীদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে এসব দালালরা বহুগুণ লাভে ইআইসির কাছে বিক্রি করত (বাংলার ১৭৭০এর দুর্ভিক্ষের একটি কারণ আফিমচাষের ওপর জমিদারদের ভারসাম্যহীন গুরুত্বপ্রদান)। এভাবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বহু জমিদার আর বণিক কলকাতায় প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিরলা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শিবনারায়ণ, আর অনেক প্রভাবশালী পার্সী শিল্পপতিদের পূর্বপুরুষ। মুজতবা আলীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে সিলেটেও মুসলিম জমিদাররা আফিমচাষে অর্থলগ্নি করত। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় উৎপন্ন আফিমের এক-তৃতীয়াংশ চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে।

ইআইসির আফিমভর্তি জাহাজ নোঙর ফেলত চীনের একমাত্র বৈদেশিক বন্দর ক্যান্টনে (গুয়াংচৌ) গিয়ে। সেখান মালখালাসের পর চীনা কালোবাজারিদের কাছে আফিম বিক্রি করে দেয়া হত। তারা সেসব নিয়ে লুকিয়ে বেচত স্থানীয় বাজারে। এভাবে সরাসরি চীনে আফিমের বাজারে ইআইসি যুক্ত না থাকলেও সাপ্লাই লাইনের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা। এই কালোবাজারির লাভের মাধ্যমে চীনের সাথে বিশাল ট্রেডগ্যাপের ব্যালেন্স করে ব্রিটিশরা, কারণ চীন থেকে বিলাসদ্রব্য ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণে কিনলেও বিলাতি বিলাসদ্রব্য চীনে বিক্রি করা ছিল নিষিদ্ধ।

১৯০৬ সালে চীনের বেজিংয়ে তামাক ও আফিম সেবন চলছে আফিমের আখড়ায় — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

১৮৩০এর দশকে আফিমব্যবসায় ইআইসি ও ভারতীয় আফিমের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয় মার্কিন চোরাকারবারীরা (জন কেরি আর ফ্রাংকলিন রোজভেল্টের পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন)। তাদের জাহাজ পারস্য-তুরস্ক থেকে আফিম কিনে চীনে বিক্রি শুরু করে। প্রতিযোগিতার ফলে দরপতন হতে থাকে। লাভ ধরে রাখতে তাই জাহাজীরা বাধ্য হয় আরো বেশি পরিমাণে আফিম পরিবহন করতে। চীনাদের মধ্যে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে আফিম-আসক্তি।

১৮৩১ সালে চীনের সম্রাট নতুন করে আফিমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এতেও যখন কাজ হল না, তখন ১৮৩৯এ সম্রাটের নির্দেশে চীনা সরকারী কর্মচারীরা ক্যান্টনের সকল আড়ত থেকে আফিম জব্দ করা শুরু করে। ব্রিটিশ আর অন্যান্য বিদেশীদের মজুদও রেহাই পেল না। বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হল ইআইসি ও ভারতীয় লগ্নিকাররা। অপমানের জবাব দিতে ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ পাঠাল দক্ষিণ চীন সাগরে। জাহাজের কামান থেকে দূরপাল্লার গোলানিক্ষেপ করা হল উপকূলের বন্দরগুলিতে। ক্যান্টন বন্দর দখল করে নিল তারা। চীনারা বাধ্য হলো শান্তিচুক্তি করতে। সে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা পেল হংকংয়ের মালিকানা, আর পাঁচটি সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার।

কিন্তু আফিম ব্যবসার ব্যাপারে কোন সুরাহা সে চুক্তিতে হয়নি। চীনে তখনও তা বেআইনী। এ সুযোগে হংকংয়ের চীনা কালোবাজারিরা নিজেদের জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় আফিম আনানেয়া করতে থাকে। ১৮৫৬ সালে এরকম একটি জাহাজ আটক করে চিং কর্মচারীরা, আর তারা জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এতে ফরাসী ও ব্রিটিশদের জয়লাভের পরে আফিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন সম্রাট, এবং আরো আশিটির মত বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, পারস্য, বল্কানে উৎপন্ন আফিমে সয়লাব হয়ে যায় চীন।

বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট এরঝ়ে টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে ত্রিশের দশকের চীনের আফিম আখড়ার ছবি এঁকেছেন — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

আফিম আসক্তি নিরসনে চিংদের ভুল পদক্ষেপগুলি জাপানসহ অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা হয়ে ছিল। যদি চীনা বন্দরগুলিতে সাধারণ বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য করতে দেয়া হত, তাহলে হয়ত আফিম কালোবাজারির খুব একটা দরকার পড়ত না পশ্চিমা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। আফিমকে বেআইনী করার কারণেও ‌অনিচ্ছাকৃতভাবে তার দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটিকে লোভনীয় রূপ দেয় তারা। তারা চাইলে আফিম ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সপ্রদান করে আর উচ্চশুল্ক আরোপ করে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। শুল্ক থেকে সরকারী আয় নিয়ে স্থানীয় আফিমখোরদের বালাই সারাতে খরচ করতে পারত। শুধু মুনাফাখোর ব্রিটিশদের সকল দোষের ভাগীদার করা মনে হয় ন্যায়সঙ্গত নয়। চীনাদের ভুল পদক্ষেপ আর মিথ্যে সামরিক গর্বের কারণে তারা তো যুদ্ধে হেরে অর্থনৈতিক শক্তি হারায়ই, তার ওপর ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে ওঠে আফিমাসক্ত।

আর আফিম-আসক্তি যে শুধু চীনাদের সমস্যা ছিল তা নয়। পৃথিবীর সকল সভ্য স্থানেই আফিম চলত সে আমলে, কোথাওই বেআইনী ছিল না। বাদশা জাহাংগীর আর তাঁর পুত্র মুরাদ আফিমে আসক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আর মার্কিন প্রচুর বিখ্যাত মানুষেরও এরকম আসক্তি ছিল। যেমন, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (অসমাপ্ত ‘কুবলা খান’ মহাকাব্য লিখেছিলেন নেশার প্রভাবে!), চার্লস ডিকেন্স, মেরি শেলী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, এলিজাবেথ ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান পো, জন কীটস, লিউয়িস ক্যারল, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখের আফিমসেবনের বদভ্যাস ছিল।

আমেরিকায় এখন আফিমের ডেরিভেটিভ ওপিয়েট পেইনকিলার বড়িতে প্রচুর সাধারণ মানুষ আসক্ত। এর দোষ যদিও মুনাফাখোর ওষুধ কম্পানিগুলিকে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত আসল ঘটনা তার থেকে জটিলতর — আফিম যুদ্ধের ইতিহাসের মতই।

আইসিন জোরো পু-য়ী

ডাকটিকেটে যাঁর ছবি, তাঁর নাম আইসিন জোরো পু-য়ী। চীনের উথাল-পাথাল সময়ে দু’বার শিশুসম্রাট হয়েছেন, একবার পরেছেন মানচুকোর রাজমুকুট। আলোকচিত্রে তাঁকে দেখা যাচ্ছে বেজিংএর বোটানিক্যাল গার্ডেনে মালীর কাজ করতে !

মানচুকোর ১৯৩২ সালের ডাকটিকেটে শেষ চিং সম্রাট আইসিন জোরো ওরফে হেনরি পু-য়ীর ছবি — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

পু-য়ীর অবিশ্বাস্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে চীনের সমস্যাসংকুল সময়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের ইতিহাস।

ঊনবিংশ শতকের শেষে জাপান ইউরোপীয়প্রধান ‘উপনিবেশী ক্লাবে’ যোগ দেয়। রুদ্ধদ্বার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাপানে মেইজি যুগ আরম্ভ হয় ১৮৬৮তে। মেইজি রাষ্ট্রনায়করা সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখেই স্বদেশের ‘পশ্চিমাকরণ’ শুরু করেন। সে সূত্রে আসে ভূমিসংস্কার, সীমিত গণতন্ত্র, বৈদেশিক বাণিজ্য আর ভাড়াটে সামুরাইদের পরিবর্তে নিয়মিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রচলন।

জাপানে কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল কম, জনসংখ্যার অধিকতার কারণে অন্ন ও কর্মসংস্থানও ছিল সীমিত। পশ্চিমাদের দেখাদেখি শিল্পায়ন শুরু হলে জাপানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ পড়ে চীনের ওপর। বিশেষ করে চীনের ‌অধীন কোরিয়া আর মানচুরিয়া, দুটোই ছিল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা।

চীন সেসময় ছিল রক্ষণশীল, পশ্চাদপর, সামন্ততান্ত্রিক একটি সাম্রাজ্য। চীনের সমসাময়িক চিংবংশীয় শাসকরা ছিল দুর্বলচিত্ত, অন্দরমহলের রাজমাতা আর খোঁজাদের প্রভাবে চালিত, আর জনবিচ্ছিন্ন। তদোপরি, চিংরা ছিল বহিরাগত। মিং নামক একটি স্থানীয় হান রাজবংশ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীন শাসন করে। এরপর পূর্ব সাইবেরিয়ার মানচুরা নুরহাচির নেতৃত্বে চীনের বিভিন্ন অংশ একে একে জয় করে চিংএর গোড়াপত্তন করে।

১৯০৬ সালে নুরহাচির আইসিন জোরো বংশে জন্ম পু-য়ীর। ১৯০৮এ চীনসম্রাট ওয়ারিশহীন অবস্থায় মারা যাবার পর রাজমাতা তিনবছরবয়সী পু-য়ীকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট হিসাবে। বিধবা-সম্রাজ্ঞী ৎসিশির জবরজং পোশাক আর কুঁকড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে পু-য়ী বেদম কান্না করেছিলেন সবার সামনে। এর কিছুদিন পর ৎসিশিও মারা যান

১৯১২ সালে হান জাতীয়তাবাদীদের শিনহাই বিদ্রোহের মুখে পু-য়ীর বাবা রাজসিংহাসনের ওপর তাঁর অধিকার রদ করে দেন। সুন-ইয়াত-সেন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেও তাঁর দলের সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বিশৃংখলা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলির গভর্নর কিংবা সেনাপ্রধানরা নিজ এলাকায় প্রকারান্তরে স্বাধীন শাসন শুরু করেন। ছবির ম্যাপে চীনের চেহারা তাই দেখা যাচ্ছে পাজ়ল পীসের মত

এই সময়টা তক্কে তক্কে ছিল জাপানের সামরিক উগ্রপন্থীরা। ইতিমধ্যেই ১৮৯৭ সালে কোরিয়া জাপানী সাম্রাজ্যের আওতায় এসেছে। চীনের ওপর রুশদের লোলুপ দৃষ্টিকে জাপানীরা অন্ধ করে দেয় ১৯০৫এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে তাদেরকে হারিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকার সুবাদে জার্মানির চীনা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কলোনিগুলি জাপানের হস্তগত হয়।

এভাবে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জাপান ইউরোপীয়দের মতই চীনসম্রাটের কাছ থেকে ‘কনসেশন’ আদায় করা শুরু করে। তারা চিংদের আদিনিবাস মানচুরিয়া অঞ্চলে রেলরোড গড়ার আর পরিচালনার লীজ় বাগিয়ে নেয়।

কোমিনটাংদের সময় চীনের অবস্থা। কোরিয়া, তাইওয়ান জাপানের অংশ, মানচুকো তাঁবেদার রাষ্ট্র, ১৯৩৭এ উত্তর চীনের বাকি অংশও জাপানের দখলে। — মানচিত্র ইন্টারনেট থেকে।

এরকম সময়ে পু-য়ী তাদের হাতে এসে পড়েন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে।

বালক পু-য়ী সম্রাট না হলেও রাজদরবার তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি। ১৯১৭এ এক জেনারেল বেজিং দখল করে পু-য়ীকে আবার সম্রাট ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা নামমাত্র সম্রাট হবার বারো দিন পর আরেক ওয়ারলর্ডের বিরোধিতার মুখে সে দাবি পরিত্যক্ত হয়। তখন পু-য়ীর বয়স এগারো।

১৯২৪ সালে পু-য়ীকে ফরবিডেন সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসময় পু-য়ীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তাঁর ব্রিটিশ শিক্ষক রেজিনাল্ড জনস্টন। পু-য়ী চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে। জাপানপ্রেমী জনস্টনই তাঁকে সুপারিশ করেন ব্রিটেনে না গিয়ে তিয়ানজিন শহরে আশ্রয় নিতে, সেখানে জাপানীদের প্রভাব রয়েছে। তিয়ানজিনে পৌঁছনোর পর চিনিতে মাছি পড়ার মত সুবিধাবাদী জাপানী-চীনাদের ভীড় জুটে গেল পু-য়ীর চারপাশে। সম্রাটের মত জীবনযাপন করতে তাঁর কোন সমস্যা হল না।

১৯৩১ সালে রেলপ্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জাপানী বাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজান্তে মানচুরিয়াকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা মুকদেন শহরের কাছে রেললাইনের ওপর ডায়নামাইট ফাঁটিয়ে তার দোষ চাপায় চীনা ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ ওপর । অফিসার্স ক্লাব থেকে জাপানীরা চীনা সেনানিবাসে গোলানিক্ষেপ করে। স্থানীয় চীনা ওয়ারলর্ড কোন অর্থবহ প্রতিরোধ না করায় কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর চীনের তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ জাপানী সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

চীন এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লীগ অফ নেশন্সে। লীগ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্ল লিটনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন পাঠায়। তদন্ত শেষ না হতেই জাপানের চররা পু-য়ীকে অনুরোধ করে ‘স্বাধীন’ মানচুরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হতে। ২৫ বছরবয়সী পু-য়ী ছোটবেলা থেকেই পরিচারকদের কাছে শুনে এসেছেন নিজ রাজবংশের গৌরবের ইতিহাস। জেনেছেন আইসিন জোরোরা স্বর্গীয় অধিকারবলে চীনের সম্রাট। অপরিপক্ব সরলমনা পু-য়ী জাপানীদের আসল মতলব বোঝার পরিবর্তে ভাবলেন, এবার তিনি ন্যায্য স্থানে পুনরোধিষ্ঠিত হবেন।

জাপানীরা অবশ্য তাঁকে শুরুতেই সম্রাট না বানিয়ে নতুন ‘পাপেট’ রাষ্ট্র মানচুরিয়ার ‘চীফ এগজেকিউটিভ’ পদে বসায়। সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম জাপানীদেরই হাতে ছিল। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই হাজারে হাজারে জাপানী এসে হাজির হলো মানচুরিয়াতে, কাজ শুরু করলো নতুন কয়লাখনি, স্টীল ফ্যাক্টরিতে। চীনাদের রাজনৈতিক স্বাধিকার পায়ে দলে তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করলো জাপানী শিল্পপতিরা।

১৯৩২এ লিটনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পর আসল সত্য বেরিয়ে এল। লীগসদস্যরা জাপানকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব আনল। অপরাধস্বীকারের পরিবর্তে জাপানের প্রতিনিধি উল্টো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করছে জাপান, চীন তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে কী পরিমাণ অবহেলা করছে, ইত্যাদির ফিরিস্তি দেবার পর দলবলসহ সম্মেলনকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। ছবিতে দেখানো টিনটিন ‌অ্যান্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকসের কার্টুন স্ট্রিপে এই সত্যি ঘটনাটি অমর করে রেখেছেন কার্টুনিস্ট এরঝ়ে।

টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে দেখানো হয়েছে লীগ অফ নেশন্স থেকে জাপানের ওয়াক-আউটের ঐতিহাসিক দৃশ্য, যদিও এখানে কাহিনী আসল ইতিহাসের থেকে শেষমেশ একটু আলাদা। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপর ১৯৩৭এ জাপান চীনের বাকি উত্তরাংশও দখল করে নেয়। চীনাদের ওপর অভূতপূর্ব সিভিলিয়ান বমিং ও হত্যাযজ্ঞ ‘রেপ অফ নানকিং’ সংঘটিত হয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পু-য়ী হন সোভিয়েতদের রাজবন্দী। তারা আরামেই রাখে প্রাক্তন সম্রাটকে। টোকিওতে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দেন পু-য়ী। এরপর ১৯৫০এ চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে পু-য়ীকে হস্তান্তর করে সোভিয়েতরা। পু-য়ী ভেবেছিলেন রুশ কম্যুনিস্টরা যেমন ৎসার নিকোলাসকে সপরিবারে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল, তেমনটাই হবে তাঁর ভাগ্যলিখন। কিন্তু মাও আর চৌএনলাইয়ের ছিল অন্য ধান্ধা।

পু-য়ীকে একটি রিএডুকেশন ক্যাম্পে রাখা হল নয় বছর। এই প্রথমবার তিনি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। এতদিন তাঁর দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করে দিত কোন না কোন চাকর, এখন সব নিজের দায়িত্ব। এছাড়াও তাঁকে দেখানো হলো তাঁর পূর্বজীবনের অত্যাচারের চিত্র। দুর্বল মনস্তত্ত্বের সুযোগে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হল তাঁকে। ১৯৫৯এ পেলেন মুক্তি, সম্রাট হিসাবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে। মাও-চৌএনলাই প্রমুখের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হল তাঁর।

বেজিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যাকারীর কাজ করছেন সম্রাট আইসিন-জোরো পু-য়ী — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

কম্যুনিস্টরা পু-য়ীর পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের ঢোল বাজাতে ব্যবহার করলেও পু-য়ীর তাতে তেমন কিছু যায়-আসেনি। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশেছেন, তারাও তাঁকে ভালবেসেছে। বেজিংয়ে মালীর কাজ করেও লজ্জিত হননি। নিজের পুরনো রাজপ্রাসাদের ট্যুরিস্ট গাইডও হয়েছিলেন কিছুদিন। সম্রাটজীবনে বার চারেক রাজনৈতিক বিয়ের পর শেষ স্ত্রীর সাথে সুখেই ঘর বাঁধেন ১৯৬২তে। ১৯৬৭ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে মারা যান শেষ চীনসম্রাট।

মারা যাবার আগে স্বদেশের প্রগতিশীল সংস্কার দেখে যান পু-য়ী। তাঁর নিজেরও যে মোক্ষলাভ হয়েছিল, তা ফুঁটে উঠেছে তাঁর বইয়ের এই উক্তির মধ্যেঃ
“I was the number one prisoner of my palaces. Today, I enjoy real freedom and equality. I can go anywhere — something I never dreamed possible in the first fifty years of my life.”


(১) মাও আর চৌএনলাইএর উৎসাহ পাওয়ার পর নিজের একটা জীবনী লিখেন পু-য়ী। ‘দ্য ফার্স্ট হাফ অফ মাই লাইফ’ নামে এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ইতালীয় পরিচালক বেরতোলুচ্চি ১৯৮৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানান, নাম ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’। [The Last Emperor]

(২) মানচু (আরেক নাম জুরচেন) জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা মোঙ্গলদের কাছাকাছি। মানচুরিয়া বলে কখনো কোন আলাদা দেশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে জাপানী ‘গবেষণার’ উপর ভিত্তি করে মানচুরিয়া আর তার অধিবাসীদের আলাদা পরিচয় বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ‘মানচুরিয়ার’ অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল হান চীনা, মানচুরা ছিল সংখ্যালঘু। তাছাড়াও মানচুরা ইতিমধ্যে হান চীনা ভাষা-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছিল। পু-য়ী মানচু ভাষায় কথা বলতে একদমই পারতেন না, ম্যান্ডারিন আর ইংরেজী পারতেন অল্প অল্প। [Manchu people]

(৩) ৎসিশি ১৮৫০এর দশকে চীনা সম্রাটের রক্ষিতা ছিলেন। সম্রাট মারা যাবার পর তিনি হন এম্প্রেস-ডাউএজার। প্রথমে ছেলে, তারপর ভাগ্নেকে সম্রাট বানিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ৎসিশিই। নানা রকম অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ছিল চিং দরবারে দৈনন্দিন ঘটনা। চীনের বহির্দেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের সম্রাটদের আমলের রক্ষণশীলতা চলে আসছিল। কয়েকটি বিদ্রোহ-বিপ্লবের পর ৎসিশি শেষের দিকে চেষ্টা করলেও চীনের উদারীকরণ করতে ব্যর্থ হন। [Empress Dowager Cixi]

(৪) ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীন ছিল গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। সুন-ইয়াত-সেন কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরে তাঁকে সরিয়ে ইউয়েন-শি-কাই নিজে সম্রাট হবার চেষ্টা করেন। বিশের দশকে কুওমিনটাং পার্টিকে সুসংহত করেন চিয়াং-কাই-শেক, সে জন্যে নতুন রাজনৈতিক দল কম্যুনিস্টদের সাথেও হাত মেলান। এসময় চীনের বড় বড় প্রদেশ, যেমন সিনকিয়াং, তুরকেস্তান, ইয়ুনান, তিব্বত, প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট মিলিশিয়া দল একরকম চাঁদাবাজি করে বেড়াত, আর একে অন্যের সাথে আঁতাত করে অন্যান্য ওয়ারলর্ডদের সাথে যুদ্ধে লেগে থাকত। ১৯২৮এ চিয়াং-কাই-শেক চীনের অধিকাংশ এলাকা একীভুত করে ওয়ারলর্ড যুগের সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু তারপরও উত্তরে বহু দুর্গম অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজিয়ে রাখে। [Warlord Era]

(৫) উত্তর চীনের উন্নয়নের নামে রুশরা মাঞ্চুরিয়াতে রেলরোড গড়ে দেয়। তার সকল আয় ছিল রুশ সরকারের। তাছাড়াও রেলরোডের আশপাশের অঞ্চলে প্রতিরক্ষার নামে সৈন্য মোতায়েন করার অধিকার বাগিয়ে নেয় তারা। রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতার পর রেলরোডের দক্ষিণাংশ জাপানীদের দখলে আসে। ১৯২৯ সালে চীনারা সোভিয়েতদের কাছ থেকে রেলওয়ে ফেরত চায়। তারা দাবি করে যে ১৯১৭এর বিপ্লবের সময় এক রুশ সেনানায়কের সাথে চুক্তি হয়েছিল রেলওয়ে বিনা খরচে চীনকে ফিরিয়ে দেবে রাশিয়া। সোভিয়েতের সাথে এক দফা যুদ্ধে হারার পর চীন রেলরোডের পূর্বাংশের ওপর রুশদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। [Chinese Eastern Railway]

(৬) নিজেরাই শত্রুর সাজ নিয়ে নিজেদের ওপর আক্রমন করে দোষ শত্রুর উপর চাপিয়ে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার এই কৌশলকে বলা হয় ‘ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক’। জাপানীদের মানচুরিয়ার ঘটনার পরপরই ইতালীয়রা ইথিওপিয়াতে আর জার্মানি পোল্যান্ডে এধরনের আক্রমণের উসিলা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধায়। অধুনা সময়ে পুতিনের রাশিয়াও এধরনের আগ্রাসন করেছে। এফএসবি বলে রুশ গোয়েন্দা-সংস্থার এক সদস্য ১৯৯৯ সালে মস্কোর অ্যাপারট্মেন্টে বোমা পাতার সময় নাকি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়। বোমা হামলার দোষ চাপানো হয়েছিল চেচেন সন্ত্রাসবাদীদের উপর, আর এই উসিলায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পুতিনের গদি পাকাপোক্ত হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে রুশরা। [False flag]

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর সিংগাপুর, মালয়, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীনও জাপানের কব্জা হয়। ১৯৪১এ পার্ল হারবার আক্রমণ, তারপর জাপানীদের বিরুদ্ধে মার্কিনদের বিপুল রক্তক্ষয়ী একেকটা দ্বীপযুদ্ধ। তারপর মিত্রদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্তালিনের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। পশ্চিম দিকে সামরিকভাবে দুর্বল জাপানী সেনাশক্তির বিরুদ্ধে রুশদের জয়যাত্রা শুরু হয় মানচুরিয়া থেকে, আর শেষ হয় উত্তর কোরিয়া আর সাখালিন দ্বীপপুঞ্জ দখলের মাধ্যমে। [Soviet invasion of Manchuria]

হাইলে সেলাসি

ঊনবিংশ শতকে আফ্রিকার উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় উপনিবেশ গড়তে থাকে ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, জার্মানি ও ইতালি । ইতিহাসবিদরা এই উপনিবেশায়নের নাম দিয়েছেন ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’।

এসময় স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় দুটি দেশ, লাইবেরিয়া ও ইথিওপিয়া।

ইথিওপিয়ার মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বিশেষ করে লোহিত সাগরের দু’পারের আক্সুম সাম্রাজ্য আর আরব উপদ্বীপের সংস্কৃতি একে অপরকে প্রভাবিত করেছে কয়েকশ বছর ধরে

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে দেশে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট হন তেওদ্রোস। কিন্তু ব্রিটেনের সাথে বচসা বাঁধিয়ে যুদ্ধে হেরে শেষ পর্যন্ত তেওদ্রোস আত্মহত্যা করেন, আর ব্রিটিশরা তাঁর দুর্গ লুটতরাজ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাজপুত্র ও বিধবা রাণীকে রাজবন্দী করে তারা ব্রিটেনে নিয়ে যায়

ইথিওপিয়ার প্রথম ডাকটিকেটে (১৮৯৪) সম্রাট দ্বিতীয় মেনেলিকের ছবি। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপরের সম্রাট চতুর্থ ইউহানিস সুদানের মাহদী রাষ্ট্রের দরবেশ ফ্যানাটিকদের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৮৯এ সম্রাট হন দ্বিতীয় মেনেলিক। প্রথম ডাকটিকেটটিতে (১৮৯৪) তাঁরই ছবি।

ইউহানিসের সময় থেকেই অবশ্য আরেকটা নতুন বিদেশী শক্তির থাবা বিস্তৃত হচ্ছিল এ অঞ্চলে। সে হলো ইতালি।

ইতালি দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মোটে ১৮৬১ সালে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইতালির পুনরুত্থানের পর সেদেশের অভিজাতরা স্বদেশকে প্রাচীন রোমের আসনে পুনরোধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত প্রজাদের ব্যারামে আরাম দিতেও জাতীয়তাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ ছিল ভাল মলম। পূর্ব আফ্রিকা তাদের কাছে মনে হলো নতুন রোমান সাম্রাজ্য শুরু করার উপযুক্ত স্থান।

১৮৮৯এ দুয়েকটা খন্ডযুদ্ধে মেনেলিকের বিরুদ্ধে জিততে না পেরে ইতালি একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তাঁর সাথে, এর নাম ‘উচালের চুক্তি’। সে চুক্তির শর্তানুযায়ী এরিত্রেয়ার ওপর ইতালির অধিকার মেনে নেন মেনেলিক।

ইতালির প্রতিনিধি অবশ্য একটু চালাকি করেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল ইথিওপিয়াকে ইতালির প্রটেক্টরেট বানানোর। চুক্তির আমারিনিয়া ভাষার সংস্করণে লেখা হলো, সম্রাট যদি চান, তাহলে বহির্বিশ্বের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ার দায়িত্ব ইতালির প্রতিনিধিকে দিতে পারেন। কিন্তু ইতালীয় সংস্করণে ক্রিয়াপদ অনূদিত হলো বাধ্যতামূলক ‌‌অর্থে। অর্থাৎ সম্রাটের সকল বৈদেশিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ইতালির অনুমতিক্রমেই স্থাপন করা যাবে।

বিশ্বে মর্যাদার আসনে স্বদেশকে বসাতে ব্রিটেন-জার্মানির রাজা-রাণীর কাছে সমকক্ষ হিসাবে মেনেলিক সম্পর্কস্থাপনের চিঠি লিখলেন। কিন্তু দু’জনেই ইতালির সাথে চুক্তির শর্ত যেমনটি জেনেছেন তা জানিয়ে মেনেলিকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর অভিযোগের মুখে ইতালীয়রা ভুল শোধরানোর বদলে একরকম দাবি করলো, নীচ কৃষ্ণাঙ্গ জাতির জংলী রাজা মিথ্যে বলছে।

১৮৯৩ সালে উচালের চুক্তি রদ করে দিলেন মেনেলিক। ইতালীয় সেনাবাহিনী এরিত্রেয়া থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। তাদের সেনাপ্রধান ভেবেছিলেন, ইথিওপিয়ার জাতিগত বিভক্তির সুযোগে মেনেলিকের অবস্থান দুর্বল করা সম্ভব। কিন্তু বিধি বাম! মেনেলিকের পক্ষ নিয়ে গোটা দেশ থেকে তিগ্রে, আমহারা, সকল জাতের সৈন্যদল ছুটে এল। ১৮৯৬ সালে আদওয়ার যুদ্ধে ইতালীয়দের সারপ্রাইজ অ্যাটাক তাদের জন্যে উল্টো সারপ্রাইজ হয়ে দাঁড়ালো। মেনেলিকের নেতৃত্বে মূলত বর্শা-তলোয়ারধারী বিশাল সেনাদল হারিয়ে দিল কামান-বন্দুকধারী ইতালীয়দের। বন্দী হলো কয়েক হাজার। এরিত্রেয়ায় পালিয়ে ফেরার পথে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেছনে ফেলে গেল ইতালীয়রা

মেনেলিকের শাসনামলে ইথিওপিয়ার আধুনিকায়ন শুরু হয়। করব্যবস্থার সংস্কার ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়। ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদেরও প্রচেষ্টা চালান মেনেলিক । এই ডাকটিকেটটি তাঁর সেই উন্নয়নপ্রচেষ্টার সাক্ষাত প্রমাণ।

এরপরে ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে চলে যাই ১৯৩৫ সালে। এর মধ্যে ১৯৩০এ ইথিওপিয়ার সম্রাট হয়েছেন রাস তাফারি মিকোন্নেন, তাঁর রাজকীয় নাম হাইলে সেলাসি । ১৯২৩এ ইথিওপিয়া লীগ অফ নেশন্সের সদস্য হয়েছে। ১৯৩১এ সংবিধান প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কারের কিছুমাত্র হলেও ছোঁয়া পাচ্ছে ইথিওপিয়াবাসী।

ইতালি কিন্তু চল্লিশ বছর আগের সে অপমানের কথা ভুলে যায়নি। মুসোলিনির আস্ফালনের সাথে সেখানে তাল মিলিয়ে কুচকাওয়াজ করছে ফ্যাশিস্ট ব্ল্যাকশার্টের দল। মুসোলিনিরও বিংশ শতকের জুলিয়াস সীজ়ার হবার স্বপ্ন। গ্রেট ডিপ্রেশনের অর্থনৈতিক ধাক্কার পাল্টা শক থেরাপি হিসাবেও একটা জেতার মত যুদ্ধ দরকার ছিল মুসোলিনির।

পশ্চিমা শক্তিদের সাথে গোপন কূটনীতিতে জিতে মুসোলিনি ১৯৩৫এ সেনাপতিদের আদেশ দিলেন আগে বাড়ার। এই প্রথমবারের মত লীগের এক সদস্যদেশ আরেককে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ করলো। হাইলে সেলাসির ডাকে সারা দেশে যুদ্ধের সাজ পড়ে গেল। মজার ব্যাপার হলো, এসময় ইথিওপিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে হিটলারের জার্মানি

প্রথম প্রথম যুদ্ধ খুব মন্থরগতিতে চলছিল। দু’একটা সংঘর্ষে ইথিওপীয়রা বিজয়ী হয়। এরপর মুসোলিনির তাড়া খেয়ে ইতালীয়রা স্থানীয় এরিত্রীয় গোত্রগুলোকে ঘুষ দিয়ে দলে ভেড়ায়। বেশুমারে বোমাবর্ষণ করা হয় ইথিওপীয় শহরগুলির ওপর। এমনকি তারা রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে। এ অসম যুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৩৬ সালে। হাইলে সেলাসি আদ্দিস আবাবার প্রতিরক্ষাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে চলে যান জেরুজালেম।

১৯৩৬ সালে ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসিকে যুদ্ধে হারিয়ে দেশটির দখল নেয় ইতালি। এই ডাকটিকেটে ইতালির রাজা দ্বিতীয় ভিত্তোরিয়ো এম্মানুয়েলে হয়েছেন একাধারে ইথিওপিয়ার সম্রাট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ছবির দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি ১৯৩৬ সালের। এতে লেখা ‘ইতালীয় ঔপনিবেশিক ডাক’। ডাকটিকেটে ছবি ইতালির রাজার, তখন ইথিওপিয়ার সম্রাট তৃতীয় ভিত্তোরিয়ো এমানুয়েলের। ব্রিটেনের রাজা জর্জ যেমন একই সাথে ভারতের সম্রাট ছিলেন, সেরকম হবার শখ তাঁরও মিটলো।

জেরুজালেম থেকে হাইলে সেলাসি জেনেভায় এলেন লীগ অফ নেশন্সের হেডকোয়ার্টারে। ইতালীয় সাংবাদিকদের অকথ্য গালিগালাজ অগ্রাহ্য করে সেলাসি যা বললেন, তা অবস্মরণীয় এক ভাষণ। লীগের সদস্যদের তিনি ভর্ৎসনা করলেন লীগ চার্টারের দশম ধারার অবমাননা করে ইতালি যে একতরফা আগ্রাসন চালিয়েছে, তার প্রতিবাদ না করার জন্য। তিনি তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে ইথিওপিয়া আজ আক্রান্ত হচ্ছে, কাল আসবে তাদের পালা ১০

১৯৩৬ সালে জেনেভায় লীগ অফ নেশন্সের সামনে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ইতালির আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে ভাষণ দিচ্ছেন রাজ্যচ্যুত ইথিওপীয় সম্রাট হাইলে সেলাসি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

হাইলে সেলাসী পরবাসী হবার পরে আরো বেশি খ্যাতিমান হলেন। ১৯৩৬ সালে ম্যান অফ দ্য ইয়ার হিসাবে টাইমস পত্রিকা তাঁকে কাভার করে। সে আমলে মার্কিনে বর্ণবাদ চললেও কৃষ্ণাঙ্গ সেলাসিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল, আর তাঁর বক্তৃতাগুলিতে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ফ্রাংকলিন রোজ়ভেল্ট ইথিওপিয়াকে লেন্ড-লীজ় চুক্তির আওতায় আনেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকার মানচিত্র, ইথিওপিয়া, এরিত্রেয়া আর বর্তমান দক্ষিণ সোমালিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছিল এ সাম্রাজ্য। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

আমেরিকার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য, আর ব্রিটিশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সৈন্যদের সহায়তায় ১৯৪১এর মে মাসে ইথিওপিয়া হয় নাৎসি-ফ্যাশিস্টমুক্ত প্রথম দেশ। পাঁচ বছর নির্বাসনশেষে আদ্দিস আবাবায় ফিরে হাইলে সেলাসি যা বললেন, তাও স্মরণীয়, “Do not indulge in the atrocities which the enemy has been practicing in his usual way.”

১৯৭৪ পর্যন্ত হাইলে সেলাসি ইথিওপিয়া শাসন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ভাল কাজ যেমন করেছেন, বিতর্কিত ব্যাপারও কম ঘটেনি সেসময়। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের কথা কে না জানে। ১৯৭৪এ মিলিটারি কুয়ের মাধ্যমে সেলাসিকে অপসারণ করে একদল সোভিয়েতপন্থী সেনা। সেলাসিকে খুন করে লাশ গুম করে দেয় তারা। সারা দেশে গৃহযুদ্ধ চলে বিশ বছর ধরে। সামরিক জান্তার শাসনামল শেষ হলে ১৯৯২ সালে তাঁর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায়।

আজ ইথিওপিয়ায় গণতন্ত্র চলছে। শত বছরে যে জিনিস কল্পনা করা যেত না, ইথিওপিয়ার মানুষ তা করেছে। বহুদিনের তিগ্রে সংখ্যালঘু জাতির প্রাধান্যের সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু আমহারা-ওমোরোরা একত্রিত হয় ২০১৮তে প্রতিবাদ করে। প্রধানমন্ত্রী হন আবি আহমেদ বলে মুসলিম-খ্রীষ্টান মিশ্র পরিবারের সন্তান এক ওরোমো।এরিত্রেয়ার সাথে বহুদিনের যুদ্ধের ইতি টেনেছেন তিনি। মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নয়নেরও চেষ্টা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে আফ্রিকায় জাতি ও ধর্মগত সাম্যের আলোকবর্তিকা হতে পারে আজকের ইথিওপিয়া।


(১) স্পেইন ও পর্তুগালের সাম্রাজ্য এসময় অবক্ষয়ের পথে। মোজাম্বিক, গিনি, অ্যাংগোলা, ইত্যাদি ছাড়া আর তেমন আফ্রিকান কলোনি এদের ছিল না। ১৮২০-৫০এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার প্রায় সকল পর্তুগীজ-স্প্যানিশ রাজ্য স্বাধীনতালাভ করে। [Spanish American wars of independence]

(২) বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে আরব উপদ্বীপে তাঁদের জাতশত্রু পারসিকদের মোকাবিলা করে আক্সুম সাম্রাজ্য। আক্সুমের সেনাপতি আবরাহার ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআনের বিখ্যাত ফীল সূরায় উল্লেখিত আছে। আবরাহা ঐতিহাসিক চরিত্র, আরবে ইহুদী-খ্রীষ্টান দাঙ্গা-যুদ্ধ লেগে থাকত। খ্রীষ্টান আবরাহা অবিচারে ইহুদীনিধন করেন। মক্কা থেকে প্রথম মুসলিম হিজরত বা নির্বাসন মদিনায় নয়, হয় আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়ার নেগুশ বা আল-নাজাশী তাদেরকে উদারতার সাথে আশ্রয় দেন। [Migration to Abyssinia
]

(৩) তেওদ্রোস তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে উত্তর ও পশ্চিম থেকে মিশর-সুদান আর পূর্বে ওরোমো-সোমালিদের মুসলিম সেনাশক্তির মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এদের বিরুদ্ধে সংঘাতকে খ্রীষ্টান ধর্যুমদ্ধ আখ্যা দিয়ে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু এসময় ব্রিটিশদের সাথে মিশরী ও তুর্কীদের মিত্রতা ছিল, আর পশ্চিমা বিশ্বে তখন খ্রীষ্টান ধর্মযুদ্ধ বলে কোন কিছুর তাৎপর্য আর নেই। ব্রিটিশরা সে কারণে তেওদ্রোসকে নেতিবাচক জবাব পাঠায়। অপমানিত সম্রাট তেওদ্রোস তারপর ব্রিটেনের রাজপ্রতিনিধিদের আটক করে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখেন। পরাশক্তি ব্রিটেন এর সমুচিত জবাব দেবার জন্য বম্বে থেকে প্রখ্যাত সামরিক প্রকৌশলী রবার্ট নেপিয়েরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠায়। নেপিয়ের লোহিতসাগরের তীরে নেমে দ্রুত একটি বন্দর তৈরি করে ফেলেন ও স্থানীয় বিদ্রোহী গোত্রগুলোর সহায়তায় দুর্গম পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তেওদ্রোসের রাজধানী মাগদালায় এসে পৌঁছান। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরাস্ত্র আর নিয়মানুবর্তী সেনাদলের কাছে পরাজিত হয় তেওদ্রোসের ট্রাইবাল সেনাবাহিনী। বন্দী রাজপুত্র আলেমাইয়াহু রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রিয়পাত্র ছিলেন।[British Expedition to Abyssinia]

(৪) সুদান ১৮৮০র দশক পর্যন্ত মিশরের তুর্কীশাসিত রাজ্যের দখলে ছিল। এ সময় মোহাম্মদ আহমেদ বলে এক সুফী দরবেশ নিজেকে মাহদী (মুসলিমদের ‘কলির অবতার’) দাবি করে। সঙ্গীসাথী জুটিয়ে মিশরীদের শাসন উচ্ছেদ করে। মিশর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারাও এদের মুখোমুখি হয়। কিন্তু এদের পাগলা হামলায় ব্রিটিশ মিশরী সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সুদানের ব্রিটিশ গভর্নর গর্ডনকে মেরে তাঁর কাটা মাথা মাহদীর কাছে পাঠানো হয়। মাহদীপন্থী ‘আনসারবাহিনী’ সুদানে কঠোর ইসলামী শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করে, আর আশপাশের রাজ্যগুলিকে ‘জিহাদের’ নামে তটস্থ রাখে। সুদানে দাস কেনাবেঁচা আবার শুরু হয়। ধর্মীয় আইন-দর্শনের পুরনো বইপত্রও পুড়িয়ে ফেলে এরা। মোহাম্মদ আহমেদ দাবি করে খোদার সাথে নাকি তার কথোপকথন হয়, আর কলেমা শাহাদাতে মাহদী হিসাবে তার ওপর বিশ্বাসস্থাপনের শপথ যুক্ত করা হয়। মোহাম্মদ আহমেদ টাইফয়েডে মারা যাবার পর তার আরেক অনুসারী খলিফা হিসাবে ক্ষমতা দখল করে। ব্রিটেন ১৮৯৫এ মিশর ও সুয়েজ রক্ষার খাতিরে লর্ড কিচেনারের নেতৃত্বে আনসারদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেনাদল পাঠায়। তিনি এদেরকে ১৮৯৮এ পরাজিত করতে সমর্থ হন। ততদিনে সুদানের অর্থনীতির পঙ্গু অবস্থা। আঠারো বছরের মধ্যে সংঘাতে-দুর্ভিক্ষে সেখানের জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেছিল। [Mahdist State]

(৫) চতুর্থ শতকে গথজাতির আক্রমণে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের পতন হয়। তারপর থেকে ইতালির বিভিন্ন এলাকা বিদেশী নানা রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রেনেসঁসের সময় ধীরে ধীরে তাদের জাতিপরিচয়ের নতুন জাগরণ হতে থাকে। কিন্তু ছোট ছোট রাজ্যগুলি ছিল একে অপরের প্রতিযোগী আর বহির্দেশীয় শক্তিগুলোর সাথে তাদের অ্যালাইনমেন্ট ছিল। নাপোলেওনের সময় উত্তর ইতালিতে ফরাসী সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি ‘ইতালি’ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নাপোলেওনের পরাজয়ের পর ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র আগের অবস্থায় ফিরে গেলেও ইতালিতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে যায়। বহুদিন ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের দ্বারা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় ইতালির রাজ্যগুলি। তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে একক ইতালীয় পরিচয়ের বিকাশ হচ্ছিল, তা রোধ করার চেষ্টা করে অধিকাংশ ইতালীয় রাজবংশগুলি। কার্বোনেরি নামক একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে ওঠে। এদের এক সদস্য মাৎসিনি ইয়াং ইতালি বলে আরেকটি দল গড়েন, যার আদলে পরে ইয়াং টার্কি, ইয়াং সার্বিয়া ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ। আরেক কার্বোনেরি গারিবাল্দি স্বল্পসংখ্যক অনুসারী নিয়ে সামরিক অভিযান, কুয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যে ইতালীয় জনতার নামে ডিক্টেটরশীপ প্রতিষ্ঠা করছিলেন। প্রুশিয়ার সাথে কূটনীতির মাধ্যমে সার্দিনিয়া রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কাভুর উত্তরে অস্ট্রিয়াকে বাগে আনেন। আর দক্ষিণে গারিবাল্দি নাপোলি-সিসিলির রাজার শাসন উৎখাত করে তার রাজভার তুলে দেন সার্দিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ভিত্তোরিও এমানুয়েলের হাতে। রোমসহ পোপের রাজ্যগুলিও হস্তগত হয়। এভাবে ১৮৬০এর দশকে ইতালি বলে নতুন রাজ্যটি আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রক্রিয়াকে ইতালীয় ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে রিসর্জিমেন্তো বা পুনরুত্থান। [Italian unification]

(৬) এসময় ফরাসী-রুশরা মেনেলিককে সমর্থন দেয়। ইতালির পেছনে ব্রিটিশদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল জিবুতির ফরাসী ঘাঁটির মাধ্যমে সুয়েজ প্রণালী ও লোহিত সাগরের জাহাজপথের ওপর তাদের প্রভাব কাউন্টারব্যালেন্স করার জন্য। ইতালির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মেনেলিক ফরাসীদের সাহায্য চেয়ে পেলেন কেবল আদর্শিক সমর্থন। রুশ সম্রাট অবশ্য অর্থোডক্স খ্রীষ্টান ধর্মের ভ্রাতৃত্বের খাতিরে মেনেলিককে উপদেষ্টা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠালেন। আদওয়া যুদ্ধের লজ্জাস্কর পরাজয়ের পরপরই ইতালিতে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, জনবিক্ষোভের মুখে সরকারের পতন হয়। ইথিওপিয়াকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয় ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স। এরিত্রেয়া অবশ্য ইতালিরই থেকে যায়। [Second Italo-Ethiopian War]

(৭) ১৮৩৩এ ব্রিটেন আর ১৮৬৩ সালে আমেরিকা ক্রীতদাস কেনাবেঁচা আইন করে বন্ধ করার ফলে পশ্চিম আফ্রিকার দাসব্যবসায় ভাঁটা পড়ে। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায় ঊনবিংশ শতকের পুরোভাগে আর বিংশ শতকের শুরুতে দাসপ্রথা তখনও প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে আরবের বিভিন্ন রাজ্যে ইথিওপিয়া থেকে আনা দাসদের বেশ বড় বাজার ছিল। এদের বেশির ভাগই গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত হত, ক্ষেতখামারের হাড়ভাঙ্গা শ্রমে অতটা নয়। ওমানী, ইয়েমেনী, সোমালি দাসব্যবসায়ীদের ঘাঁটি ছিল জানজিবারের ওমানীশাসিত মুসলিম রাজ্য। হাবশী বা ইথিওপীয় দাসরা অতীতে ভারতবর্ষেও এসেছে। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন হাবশী দাস। মেনেলিক দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আইনকানুন প্রচলন করলেও সেগুলির তেমন একটা প্রয়োগ হয়নি। তিরিশের দশক পর্যন্ত আরবের সাথে দাসব্যবসা চলেছে। লীগ অফ নেশন্সের বেশ কটি রেজল্যুশনের পরেও তা কমেনি। আরবে দাসপ্রথা চালু থাকার একটা কারণ অনেকদিন পূর্ব আফ্রিকার সাপ্লাই সোর্স বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। [Arab slave trade]

(৮) রাস্তাফারি নামে জামাইকাতে একটি ধর্ম চালু আছে। বব মার্লি ছিলেন রাস্তাফারি আর তাঁর গানে সে ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন ব্যাপার আমাদের অজান্তে উঠে এসেছে। ১৯৩০এর দশক থেকে জামাইকার অনেক কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্বাস করা শুরু করে যে হাইলে সেলাসী হলেন মেসিয়া, যীশুর দ্বিতীয় অবতার, জীবন্ত ঈশ্বর বা জাহ। তাদের আরো বিশ্বাস আফ্রিকায় রয়েছে তাদের প্রতিশ্রুত আবাসভূমি জায়ন। এ ধরনের অল্টারনেটিভ ধর্মবিশ্বাসের জনপ্রিয়তা পাবার একটা কারণ জামাইকাতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে কারণে হাইলে সেলাসী আফ্রিকার একমাত্র স্বাধীন সম্রাট হিসাবে এই বিশেষ মর্যাদাটি পান। যদিও তিনি নিজে খ্রীষ্টান ছিলেন, তিনি রাস্তাফারিদের নিরুৎসাহিত করেননি। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে জামাইকার জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। [Rastafari]

(৯) ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ইতালির অন্যায় যুদ্ধে ব্রিটেন-ফ্রান্সের থেকে বিরোধিতা আসতে পেরে বলে মুসোলিনি তাদেরকে খেলালেন কূট চালে। গোপনে তাদের হুমকি দিলেন যে ইথিওপিয়া হবে ইতালীয়, আর যদি তা না হয়, তিনি জার্মানির হিটলারের সাথে সামরিক মিত্রতা চুক্তি করবেন (তখনও এ মিত্রতা ছিল না)। ব্রিটেন-ফ্রান্স এতে ভড়কে গিয়ে গোপনে তাঁর সাথে রফা করে, তাদের হোর-লাভাল প্রস্তাবনার মাধ্যমে রাজি হল যে ইতালি ইথিওপিয়ার সিংহভাগ পাবে, আর ছোট্ট একটা অংশ ইথিওপীয় রাষ্ট্র হিসাবে থেকে যাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপুল রক্তক্ষয়ের পরে ব্রিটিশ-ফরাসী সাধারণ মানুষ সংঘাতে যেতে চায় না, এটা তাদের রাজনীতিবিদরা ঠিকই বুঝেছিলেন। ইথিওপিয়ার মত নাম-না-জানা আফ্রিকান রাজ্যের সার্বভৌমত্বহানির বিপরীতে আদর্শগত যুদ্ধের আরোই কোন সমর্থন ছিল না। জার্মানি প্লেন, রাইফেল, গোলাবারুদ পাঠিয়ে মেনেলিককে সাহায্য করে এই উদ্দেশ্যে যে ইতালির সৈন্যদল সেখানে বহুদিন ব্যস্ত থাকবে, আর সে ফাঁকে জার্মানি ইতালির উত্তরে জার্মানভাষী অস্ট্রিয়াকে দখল করে নেবে। ১৯৩৮ সালে তা ঘটে, ইতালির সাথে আনঅফিশাল সমঝোতার পরপর।[Anschluss]

(১০) লীগ অফ নেশন্সের দশম আর্টিকল অনুযায়ী কোন সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে তার প্রতিরক্ষায় বাকি সদস্যরা এগিয়ে আসবে। একে বলে ‘কালেকটিভ সিক্যুরিটি’। বহির্দেশীয় সংঘাতে আরেকবার জড়িয়ে পড়তে অরাজি মার্কিনদের কংগ্রেসে এই ধারা প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র লীগে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে। লীগ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অল্প ক’টি বিবাদের সুরাহা করতে সমর্থ হয়েছিল। সিনিয়র সদস্যরা ক্রমাগত লীগের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ করছিল। ইউরোপের বেশ ক’টি স্থানীয় সংঘাতে লীগ অর্থবহ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় এবং অধিক শক্তিমান পক্ষ দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে। ইতালি-ফিউমে, ইতালি-গ্রীস, পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড-সোভিয়েত, ফ্রান্স-বেলজিয়ামের জার্মান রুহর উপত্যকা দখল, এগুলি কিছু ছোটখাট সংঘাতের উদাহরণ। ১৯৩১ সালে জাপান চীনের উত্তরের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে নিজেরাই ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক করে চীনাদের দোষ দেয়। তারা মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয় চীনাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। ১৯৩২ সালে তাদের চালাকির কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জাপানীরা লীগ থেকে পদত্যাগ করে। এটা ছিল বড় কোন সমস্যা মিটমাটে লীগের প্রথম বিফলতা। এরপর ইতালি পরিষ্কারভাবে দশম দফা লঙ্ঘন করে ইথিওপিয়ার ওপর চড়াও হয়। লীগ অফ নেশন্সের সদস্যরাষ্ট্ররা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে ইতালির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে ও অর্থনৈতিক স্যাংকশন আরোপ করে। কিন্তু সেগুলি খুব কার্যকর কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় ইতালির শাসন সব দেশই মেনে নেয়, সাতটি বাদেঃ চীন, নিউজীল্যান্ড, সোভিয়েত, স্পেইন, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া অভিযানের আগ থেকে জাপানের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। চীনে জাপানের দখলকৃত এলাকাগুলিরও স্বীকৃতি দেয়নি যু্ক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া ও ইথিওপিয়া সংকটের পর লীগ অফ নেশন্সের অর্থপূর্ণ আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। যে দেশ যার ইচ্ছেমত বৃহদশক্তিদের ব্ল্যাকমেল করে ছোট দেশের উপর আগ্রাসন চালায়। জার্মানি-অস্ট্রিয়া, জার্মানি-ডানজিগ, জার্মানি-চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি-আলবেনিয়া, জাপান-চীন, তারপর পোল্যান্ডকে সোভিয়েত ও জার্মানি ভাগাভাগি করে দখল করার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। এভাবে হাইলে সেলাসীর ভবিষদ্বাণী পাঁচ বছরের মধ্যে সত্য হয়। [League of Nations Failures]

হাওয়াই’য়ি রাজতন্ত্রের গোধূলি

প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে নয়নাভিরাম চিরসবুজ দ্বীপপুঞ্জ হাওয়াই’য়ি। এখন হাওয়াই’য়ি যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টেট, পর্যটনের জন্যে ভূবনবিখ্যাত।

হাওয়াই’য়ি একটা সময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই লেখায় বলছিলাম তুভা নামের ছোট্ট একটি দেশ বেদখল হয়ে যাবার কাহিনী। আজকে বলি হাওয়াই’য়ি কিভাবে সার্বভৌমত্ব হারালো।

বড় মানচিত্রে হাওয়াই’য়ির দ্বীপগুলি দেখানো হয়েছে, আর ছোট ইনসেট ম্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে তুলনামূলক অবস্থান। (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

নিচের ডাকটিকেটগুলো যথাক্রমে ১৮৮২, ১৮৯৩ ও ১৮৯৪ সালের। প্রথমটিতে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। দ্বিতীয়টির ছবি হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। তৃতীয়টি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে।

১৮৮২ সালের এই ডাকটিকেটে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্রিটিশ পরিব্রাজক ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৮ সালে হাওয়াই’য়ি দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে নোঙর ফেলেন। সে দ্বীপগুলিতে দেড় হাজার বছর ধরে বসতি ছিল পলিনেশিয়ান জনপদের একটি গোত্রের । ক্যাপ্টেন কুকের দলের সাথে ঝগড়াঝাঁটির জের ধরে হাওয়াই’য়িবাসীর হাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়।

এর কয়েক বছরের মধ্যেই করিৎকর্মা রাজা প্রথম কামেহামেহা ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের অস্ত্রপ্রযুক্তি করায়ত্ত করেন, আর যুদ্ধাভিযান করে সব দ্বীপকে বশ করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কিংডম অফ হাওয়াই’য়ি।

দু’বার ক্ষণস্থায়ী ব্রিটিশ শাসন চললেও এ রাজ্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোভাগে ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু প্রাসাদষড়যন্ত্র ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। রাজা আর বনেদী হাওয়াইয়ানরা অবশ্য ইউরোপীয়-মার্কিনদের সাথে নিয়মিত উঠবোস করত। ইংরেজীও পারত তারা সকলে। এর একটা বড় কারণ মার্কিন প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীদের ধর্মপ্রচার। হাওয়াই’য়িএর নেটিভরা নিজ সংস্কৃতির খোলসটাকে রেখেই স্বেচ্ছায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে। অনেকে মার্কিন-ইউরোপীয়দের সাথে বিয়ের সম্পর্কে মিলে যায়। (প্রশান্ত মহাসাগরের বেশ অনেকগুলো দ্বীপরাজ্যের ইতিহাস একইরকম।)

১৮৩৫ সাল থেকে হাওয়াই’য়ি হয়ে ওঠে আমেরিকায় চিনি আমদানির মূল উৎস। ইউরোপীয়-মার্কিন ব্যবসায়ীরা, আর অল্প কিছু স্থানীয়, রাজার অনুমতিক্রমে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণ করে আখ চাষ শুরু করে । ক্ষেতের কাজ করতে চীন, জাপান, ফিলিপিন থেকেও এসময় ‌অভিবাসী শ্রমিক আসতে শুরু করে।

১৮৯৩ সালের এই ডাকটিকেটে হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির ছবি, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্যবসার স্বার্থে ধীরে ধীরে হাওয়াই’য়িয়ের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন আখচাষীদের নাক গলানো শুরু হয়ে যায়। খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবে আর চিনিরপ্তানির অর্থে বিত্তবান রাজা তৃতীয় কামেহামেহা তাঁর সরকারে অনেক ইউরোপীয়-মার্কিনদের স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গ্যারেট জাড নামে এক মার্কিন মিশনারী। এই ভদ্রলোক অবশ্য বেশ বিশ্বস্ত ছিলেন, মার্কিন নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে হাওয়াই’য়িয়ের নাগরিক হয়ে যান। হাওয়াই’য়িবাসীর মঙ্গল চিন্তা করেই বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেন, কিন্তু সেসবের ফল হয়েছিল উল্টো। তার একটি হলো ‘গ্রেট মাহেলে’।

গ্রেট মাহেলে সংস্কারের মাধ্যমে বিদেশীদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ার আগেই হাওয়াই’য়িয়ের অধিবাসীদের মাঝে জমি পুনর্বন্টন শুরু করা হয়। আমরা আজ জমি-সম্পত্তির মালিকানাকে ধরেই নিই স্বাভাবিক মানবিক অধিকার, হাওয়াই’য়িবাসীর প্রাচীন প্রথানুযায়ী তা কিন্তু ছিল না। নেটিভ আমেরিকানদের মত তাদেরও প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী বসবাসের আর আবাদযোগ্য জমি কমিউনিটি প্রপার্টি, প্রকৃতি তার ভরণপোষণের প্রকৃত মালিক, আর রাজা তার কাস্টোডিয়ানমাত্র।

প্রজাদের বেশিরভাগ গ্রেট মাহেলে ফরমানের লিখিত ভাষা পড়তে জানত না। আর জমির মালিকানা দাবি করার জন্যে ন্যূনতম সরকারি কর দেবারও সামর্থ্য ছিল না তাদের। তার ওপর চলছিল বিদেশীদের নিয়ে আসা রোগজীবাণুর মহামারি। ফলে অনেকেই এ সংস্কারের আওতা থেকে বাদ পড়ে যায়।

এতে করে বেশির ভাগ পতিত জমি পাঁচটি বড় বড় চিনি কম্পানির হাতে চলে যায়, এরা অধিকাংশই ছিল মার্কিনপরিচালিত। গ্রেট মাহেলে সংস্কারের বছর কয়েকের মধ্যে কামেহামেহা আর জাডের বিদেশসফরের সুযোগ নিয়ে মার্কিনী প্রধান বিচারপতি এমন একটি আইন পাশ করেন, যার ফলে বিদেশীরাও হাওয়াই’য়িতে জমি কিনতে পারে। সে আইনের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজা ও জাড হার মানেন।

আভ্যন্তরীণ ব্যাপারস্যাপারে হাওয়াই’য়িনিবাসী মার্কিনীরা ব্যক্তিগতভাবে যখন এভাবে নাক গলাচ্ছে, তখন মার্কিন সরকারও হাওয়াই’য়িয়ে স্টীমশিপ রিফুয়েলিংয়ের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে তার সামরিক তাৎপর্য বোঝা শুরু করে। পার্ল হারবারের জায়গাটি লীজ় নেয়ার প্রস্তাব দিলেও হাওয়াই’য়িয়ানদের আপত্তির কারণে রাজা লুনালিলো তাতে রাজি হন না। কিন্তু পরবর্তী রাজা কালাকাউয়া মার্কিনদের চাপে সেই লীজ় দিতে রাজি হন (১৮৮৭ সাল থেকে এর মেয়াদ শুরু হয়)। কালাকাউয়া তাঁর রাজ্যের সামরিক গুরুত্ব ভালভাবেই জানতেন, এবং ভয় করেছিলেন যে এই লীজ় না দিলে যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই’য়িকে জোরপূর্বক দখল করে নেবে। অবশ্য এর বিনিময়ে তিনি মার্কিন কংগ্রেসের কাছ থেকে কিছু অস্থায়ী বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন।

১৮৮৭তে কালাকাউয়ার বিরুদ্ধে তাঁরই ক্যাবিনেটের উগ্রপন্থী সদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। মার্কিন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার থার্স্টন ইউরোপীয়, মার্কিন আর কিছু ধনাঢ্য নেটিভদের সমর্থন নিয়ে রাজাকে বাধ্য করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র চালু করতে । আইন পরিবর্তন করে হাওয়াই’য়িয়ের বিদেশী নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর ভোটাধিকারের জন্যে বার্ষিক ন্যুনতম ছয়শ ডলার আয়ের শর্ত আরোপিত হয়। এর ফলে হাওয়াই’য়িয়ের নেটিভদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, আর প্রচুর ইউরোপীয়-মার্কিন বিদেশী হওয়া স্বত্ত্বেও সে অধিকার পায়। চীনা-জাপানী বংশোদ্ভূতদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

এ ঘটনার পরপরই রাজপরিবারের অসন্তুষ্ট কিছু সদস্য রাজাকে অপসারণের চেষ্টা করেন। কালাকাউয়ার বোন লিলি’উওকালানি আর তুতোভাই রবার্ট উইলকক্স এদের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সে বিদ্রোহের কথা আগেই ফাঁস হয়ে যায়, আর উইলকক্স নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

১৮৯১এ কালাকাউয়ার মৃত্যু হলে রাণী হন লিলি’উওকালানি। লিলি’উওকালানি চেষ্টা করেন শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে নেটিভদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ তার বিরুদ্ধে সেই একই থার্স্টন গ্রুপের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এবার তাদের লক্ষ্য হল সশস্ত্র কুএর মাধ্যমে লিলি’উওকালানিকে অপসারণ। মূল ষড়যন্ত্রকারীদের পাঁচজন ছিল মার্কিন, একজন ব্রিটিশ আর এক জার্মান।

১৮৯৪ সালের এই ডাকটিকেটটি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

কুয়ের পরিকল্পনার কথা হাওয়াই’য়িয়ের মার্কিন(!) পুলিশপ্রধানের কানে আসে। ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট চাইলে মার্কিন(!) অ্যাটর্নি জেনারেল বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুলিশপ্রধান রাণীর প্রতিরক্ষার জন্যে লোক জড়ো করা শুরু করেন।

কু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায়, এবং লিলি’উওকালানির শত্রুরা তাদের সমর্থক ইউরোপীয়-মার্কিন-নেটিভদের সম্মিলিত সৈন্যদল নিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাদে গৃহবন্দী করে রাখে। মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিও স্বদেশী নাগরিকদের রক্তপাতের আশংকায় আর জাপানের হস্তক্ষেপের ভয়ে বন্দরের জাহাজ থেকে মেরিন সেনাদের একটি দলকে শহরে ডেকে পাঠান।

এরকম হুমকির মুখে ব্যাপক রক্তপাতের আশংকায় লিলি’উওকালানি তাঁর অনুগত সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। দু’পক্ষে তারপরও কিছু নেটিভ আর মার্কিন মানুষ মারা যায়। অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হবার লক্ষ্যে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গ্রভার ক্লীভল্যান্ড এই বিতর্কিত কাজটি করতে রাজি হলেন না। তাই তারা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এরপর উইলকক্স ১৮৮৯এ সান ফ্রানসিস্কো থেকে গোপনে অস্ত্রভান্ডারসহ ফিরে এসে চেষ্টা করেন লিলি’উওকালানিকে পুনরোধিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তাঁরা বিফল হন, উল্টো লিলি’উওকালানিকে ‘বিচার’ করে জেলে পুরে দেয় তাঁরই প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল

ক্লীভল্যান্ডের পরে প্রেসিডেন্ট হন ম্যাকিনলি । তাঁর নৈতিক বাছবিচার একটু কমই ছিল। তাছাড়া স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে জয়ের পরে হঠাৎ করে মার্কিনদের হাতে এসে পড়ে প্যাসিফিকের ‘সিকম্যান’ স্পেইনের ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ, কিউবা, গুয়াম, পোর্তো রিকো প্রভৃতি কলোনি। স্পেনের কলোনিগুলি হস্তগত করার সময় এতদিনের জর্জ ওয়াশিংটনের অ্যান্টিকলোনিয়ালিস্ট দর্শন বিস্মৃত হয় মার্কিনরাষ্ট্র!

অবশ্য এনিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়েছিল সেসময়। বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টি চেষ্টা করে ম্যাকিনলির ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিকে চেক দেবার। কিন্তু এ ছিল এক ভিন্ন জনমনস্তত্ত্বের সময়। সারা বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী রণসঙ্গীত চলছে। আর্মস রেস চলছে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে । মরোক্কান ক্রাইসিস, আগাদির ক্রাইসিস ঘটে যাবে পরের দশকেই। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা উঠল বলে। জাপানেরও আনাগোনা বেড়ে গেছে প্যাসিফিকে ১০। এসব মিলিটারিজম যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করে।

তাই ফিলিপিন ইত্যাদিকে শুরুতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র করা হবে বললেও শেষ পর্যন্ত সেসব যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়ে গেল। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শেষ হবার ঠিক এক মাস আগে ১৮৯৮এর জুলাইতে কংগ্রেস হাওয়াই’য়িকে টেরিটোরি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার বিল পাশ করে দেয়, এবং ম্যাকিনলি তা স্বাক্ষর করেন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পার্ল হারবারের স্বাক্ষী হয় হাওয়াই’য়ি। সে যুদ্ধে প্রচুর নেটিভ হাওয়াইয়ানও অংশ নেয়। ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশতম স্টেট হিসাবে হাওয়াই’য়িকে স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। ১৯৯৩ সালে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে যে ১৮৯৩-৯৪এ হাওয়াই’য়িয়ের রাজসরকারের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের অভ্যুত্থান ছিল বেআইনী, আর তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ক্লিনটন সেই রেজল্যুশন স্বাক্ষর করেন।

ষাটের দশকে হাওয়াই’য়িয়ান ভাষাসংস্কৃতি পুনরুজ্জীবন পায়। স্ল্যাক-কী গীটার, স্টীল গীটার, উকুলেলে — এসব হাওয়াইয়ান বাদ্যযন্ত্রের সাথে সারা বিশ্ব এখন পরিচিত। হাওয়াই চপ্পল কে না চিনে! সার্ফিঙও হাওয়াই’য়িয়ান আবিষ্কার। কোনা দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র জায়গা যেখানে কফির চাষ হয়। লাইলো এন্ড স্টিচ, মোয়ানা, ইত্যাদি মুভিতেও হাওয়াই’য়িয়ের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মাউনা কেয়া পর্বতের ওপর রয়েছে ভূবনবিখ্যাত টেলিস্কোপ অবজারভেটরি ১১

আর হাওয়াই’য়িতে গেলে কোন নেটিভ, কোন শ্বেতাঙ্গই গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণ করবে না আপনাকে। সবাই বলবে আলোহা! — যার অর্থ হতে পারে শুভ সকাল, কিন্তু এর আরো গভীরতা রয়েছে আন্তরিক ভালোবাসার অনুভূতির মধ্যে।

এসব দেখে অবশ্য লিলি’উওকালানি, উইলকক্স গর্ববোধ করতেন বলে মনে হয় না! কারণ, হাওয়াই’য়িয়ের জনসংখ্যার মোটে দশ শতাংশ আজ নেটিভ হাওয়াইয়ান। কিছু প্রভাবশালী নেটিভ হাওয়াইয়ান পরিবার থাকলেও আয় ও সম্পত্তির হিসাবে হাওয়াই’য়িয়ের জনপদগুলির মধ্যে তাদের দারিদ্র্যমাত্রা সর্বাধিক। অবশ্য হাওয়াই’য়িয়ের স্টেট সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার নেটিভ হাওয়াইয়ানদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে। এতে তারা লাভবান হবে নাকি আলস্যে নিপতিত হবে, তা সময়ই বলে দেবে।


(১) প্যাসিফিকের একপ্রান্ত ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপিনস-পাপুয়া থেকে আরেক প্রান্ত সুদূর ঈস্টার আইল্যান্ড পর্যন্ত পলিনেশিয়ানদের ব্যাপ্তি। এমনকি তাইওয়ান আর মাদাগাস্কারের আদিবাসীদের সাথেও এদের ভাষাগত মিল রয়েছে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে তারা বড় বড় ক্যানু নিয়ে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাকে পুঁজি করে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশিরভাগ বাসযোগ্য দ্বীপ একে একে জয় করে ফেলে (মোয়ানা!)। নিউজিল্যান্ডের মাওরিরাও পলিনেশিয়ান। এদের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ, আর যোদ্ধাজাত হিসাবে ইউরোপীয়দের কাছে ছিল সম্মানিত।কিছু গোত্র ছিল নরখেকো! [Polynesians]

(২) আখের রস থেকে সেন্ট্রিফ্যুজের মাধ্যমে চিনি আলাদা করার যান্ত্রিক প্রক্রিয়াও হাওয়াই’য়িবাসী এক মার্কিন আখচাষীর ঊর্বরমস্তিষ্কের ফসল। [Inventor David M. Weston]

(৩) এ শাসনতন্ত্র পরিচিত ‘বেয়োনেট কন্সটিট্যুশন’ হিসাবে কারণ জোরপূর্বক এটি হাওয়াই’য়িয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও তাদের মেরিন সেনাদল তৈরি রেখেছিল আর গুপ্তচর মারফত খবরাখবর সংগ্রহ করছিল। যদি মার্কিন সম্পদ ও জীবনহানির সম্ভাবনা দেখা দিত, তাহলে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৮৮৭তে তারা তা করেনি, কিন্তু ১৮৯৩এ কিছুটা করে। [1887 Constitution of the Kingdom of Hawaii]

(৪) রবার্ট উইলকক্সের আরেক নাম আয়রন ডিউক অফ হাওয়াই। বিসমার্কের নাম ছিল আয়রন চ্যান্সেলর। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড একরোখা এই নেটিভ হাওয়াইয়ান! বিচার করে তাঁকে ফাঁসির রায় দিলেও লিলি’উওকালানির সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেয়ার শর্তে তিনি বেঁচে যান। পরে সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ছেড়ে হাওয়াইয়ান টেরিটোরির সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্যগুলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। সে উদ্দেশ্যে হোমরুল পার্টি শুরু করেন এবং ১৯০১এ হাওয়াই’য়ি সেনেটে মেজোরিটি অর্জন করতেও সমর্থ হন, কিন্তু টেরিটোরির মার্কিন বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট ডোলের ভেটোর কারণে অনেক কিছু করতে পারেননি। একসময় তিনি নেটিভদের জনপ্রিয়তাও হারানো শুরু করেন। ১৯০৩এ তাঁর মৃত্যু হয়, কিন্তু সে পার্টি ও তার উত্তরসূরী দলগুলি এখন পর্যন্ত হাওয়াই’য়িয়ের স্বাধীনতা দাবি করে চলেছে — যদিও স্টেট সংসদে প্রতিনিধিত্ব পাবার মত ভোট এখন তারা পায় না। [Robert William Wilcox]

(৫) লিলি’উওকালানিকে বেশিদিন জেল খাটতে হয়নি।১৮৯৬ সালে তাঁর জন্যে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। তিনি তারপর যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন, মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি থামান। এতে প্রায় সফলও হয়েছিলেন, ১৮৯৭এ মার্কিন সেনেটে ম্যাকিনলির অ্যানেক্সেশনের প্রস্তাব প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হয়। হাওয়াই’য়িয়ের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে একটি ইতিহাসের বই লিখে রেখে যান লিলি’উওকালানি। তাছাড়া নেটিভ সঙ্গীত-সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। [Liliʻuokalani]

(৬) ম্যাকিনলি ছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যে অত্যধিক কর আরোপিত হয়। অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভাল হয়। ১৯০১ সালে এক পোলিশ বংশোদ্ভূত স্টীল মিলের শ্রমিকের গুলিতে তিনি নিহত হন। আততায়ীর উগ্র বামপন্থী দলের সাথে যোগাযোগ ছিল আর তার বিশ্বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার ধনাঢ্যদের সুবিধা দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের সুবিধাবঞ্চিত করছে। ম্যাকিনলির পরে তাঁর পলিসিগুলিকে অব্যাহত রাখেন থিওডোর রোজাভেল্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশ্য ‘কলোনিয়াল এম্পায়ার’ আর ‘ফরেন ওয়ারের’ বিরুদ্ধে জনমতের কারণে মার্কিন সরকার বিশ্ব থেকে আইজোলেশনিস্ট অবস্থান নেয়, এবং তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবারের আক্রমণ পর্যন্ত চলে। [William McKinley]

(৭) মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যে সহনশীলতা রক্ষা করে চলতেন অন্যান্য জাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে, সেসবের উল্টোধারা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকে। বিশেষ করে ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ নামে পরিচিত চিন্তাধারার মাধ্যমে আমেরিকার নেটিভ-অধ্যুষিত এলাকাগুলির ‘উন্নতি-প্রগতির’ স্বার্থে সেসবের সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে জাস্টিফাই করা হ্য়। ফলস্বরূপ, প্রচুর ‘রেড ইন্ডিয়ান’ ট্রাইব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের প্রচুর নারী-শিশুও সেসবে প্রাণ হারায়, আর পূর্বপুরুষদের ভূমি হারিয়ে তারা রিজার্ভেশনে একরকম বন্দিজীবন শুরু করে। [Manifest destiny]

(৮) ব্রিটেনের সাথে নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের নৌশক্তি ও প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। ব্রিটেনের রাজা এডওয়ার্ডের ভাগ্নে ছিলেন জার্মান কাইজার ভিলহেল্ম। তারপরও স্ব-স্ব দেশের সামরিক এ প্রতিযোগিতা থামাতে তাঁরা ব্যর্থ হন। চার্চিল সেসময় নৌমন্ত্রী ছিলেন, তিনি যুদ্ধজাহাজগুলিকে কয়লার পরিবর্তে জ্বালানিতেল দিয়ে চালানোর সংস্কার করেন, কারণ জ্বালানিতেল অধিক কার্যক্ষম আর সাশ্রয়ী। এছাড়াও ড্রেডনট বলে নতুন একধরনের আরমার্ড যুদ্ধজাহাজও ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। জার্মানিও নতুন ধরনের প্রযুক্তি দিয়ে আয়রনক্ল্যাড জাহাজ বানানো শুরু করে, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে ব্রিটিশ নৌশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে এ ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল একটা কারণ। [Anglo-German naval arms race]

(৯) মরক্কোতে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে দু’দুবার সম্মুখসংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমটা ১৯০৬এর মরক্কোসংকট নামে পরিচিত, দ্বিতীয়টা ১৯১১এর আগাদির সংকট। দুই ক্ষেত্রেই ফ্রান্স মরক্কোর ওপর তার ঔপনিবেশিক ‘অধিকারের’ বিরুদ্ধে জার্মানদের ‘আগ্রাসনের’ অজুহাত দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে। জার্মানিও গানবোট পাঠিয়ে সামরিক পেশী প্রদর্শন করে। দু’বারই ব্রিটেন ফ্রান্সের পক্ষ নেয়ায় জার্মানি বিফল হয়। কিন্তু জাতিগতভাবে আর দুই রাজপরিবারের রক্তসম্পর্কের বিচারে জার্মানরা ভেবেছিল ব্রিটেন তাদের পক্ষ নেবে। তা না হওয়ায় তারা অপমানিত বোধ করে, এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপের অন্য শক্তি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও তুরস্কের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। এসব ‘গানবোট ডিপ্লোমেসি’ তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল। [Moroccan Crisis]

(১০) মেইজি রিস্টোরেশনের সময় জাপানে সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয় আর সম্রাটের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। পশ্চিমাদের দেখাদেখি সংসদীয় আইন প্রনয়ণ শুরু হয়। নৌশক্তি বাড়ানোর জন্যে বিপুল ‌অর্থ বরাদ্দ করা হয়। স্পেনের প্যাসিফিক কলোনিগুলির দিকে ম্যাকিনলির যেমন নজর ছিল, জাপানেরও ছিল। ম্যাকিনলি আগেই সে লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হন। জাপান তখন চীন-কোরিয়া-রাশিয়ার দুর্বলতার দিকে মনোনিবেশ করে। ১৮৯৪এ চীনের সাথে যুদ্ধে জিতে তার করদ রাজ্য কোরিয়ার দখল নেয়, আর ১৯০৫এ রুশদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে পশ্চিমাবিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়। রুশদের এ পরাজয়ের ফলে নিকোলাসের বিরুদ্ধে প্রথম বিপ্লব দেখা দেয় রাশিয়াতে। এ ছিল ১৯১৭এর বলশেভিক বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল। [History of the Imperial Japanese Navy (1882-1893)]

(১১) মাউনা কেয়া একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হাওয়াইয়ানদের প্রাচীন ধর্মানুসারে পবিত্রভূমি, দেবতাদের আবাস। তাই এখনো টেলিস্কোপ স্থাপনার বিরুদ্ধে নেটিভরা প্রতিবাদ করে। টেলিস্কোপগুলি অবশ্য বৈজ্ঞানিক অনেক সত্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে বিশাল অবদান রেখেছে। [Mauna Kea]

তান্নু তুভা

আজ যে দেশটির ডাকটিকেট দেখাচ্ছি ত্রিশ দশকের ম্যাপসহ, তার স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নামমাত্র স্বাধীন দেশটির নাম তুভা।

১৯৩৬ সালের তুভার এই ডাকটিকেটে দেখা যাচ্ছে রেলের সাথে উটের দৌড়। প্রকৃতপক্ষে তুভায় কোন রেললাইন ছিল না। তুভার ‘উন্নয়নের’ মিথ্যে প্রচারনার উদাহরণ এ ডাকটিকেট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

মোঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার মাঝে স্যান্ডইউচ দেশটি এখন রাশিয়ার একটি স্টেট। ১৯১১ পর্যন্ত এটি চীনের চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য মোঙ্গোলিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যকে ‘কলোনাইজ’ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে কাজ়াখ়, বুখা়রা, খ়িভ়া, কোকন্দ প্রভৃতি খা়নাত আর তুর্কমেন-কিরগিজ় যাযাবরদের একাধিক গোত্র। এর আগেই অবশ্য ষোড়শ শতকে ইভ়ান দ্য টেরিবলের সময় সাইবেরিয়ার সিবির খা়নাতকে বশ করার মাধ্যমে মস্কোর ছোট্ট স্লাভিক রাজত্বটি রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

উপরের দেশগুলি যখন স্বাধীন ছিল, তখন সভ্যদেশে ডাকটিকেটের প্রচলন থাকলেও এরা অনগ্রসর মধ্যযুগীয় রাজ্য হওয়ায় টিকেট ছাড়ত না। তাই রুশ ‘কলোনাইজেশনের’ প্রমাণ হিসাবে সেসব জাহির করতে পারছি না। কাছাকাছি যেটা পড়ে, সেটা এই তুভার স্ট্যাম্প। কলোনাইজেশনের ফর্মুলাটা বলছি। এর সাথে ১৮৩৬এ টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হবার ফর্মুলার মিল আছে — বেমিলও আছে।

তুভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই রুশ বণিক, র‍্যাঞ্চার, আর শিকারীরা চিং সাম্রাজ্যের ফরমান নিয়েই আনাগোনা করত। তারা বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলে। শিকারীরা সেখানকার লোমশ জানোয়ার মেরে তাদের ফার নিয়ে বেঁচতো রাশিয়ার বনেদী পরিবারগুলির কাছে।

১৯১১তে চীনের মানুষ চিং সাম্রাজ্যের উপর যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। বিদেশীদের কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ছিল তাদের অসন্তুষ্টির মূল কারণ (বক্সার বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০১)। ফলে চিংদের বিরুদ্ধে শিনহাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, প্রতিবাদের মুখে ‘বিধবা-সম্রাজ্ঞীর’ হাতের পুতুল ছয়বছরবয়েসী পুত্র সম্রাট পু-য়ী রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেন । পরিশেষে সুন-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে চীনা জাতীয়তাবাদী দল কোমিনতাং প্রভিশনাল প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করে।

ত্রিশ দশকের এই মানচিত্রে তুভার অবস্থান দেখানো হয়েছে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

১৯১১তে চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে মোঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এসময় মোঙ্গোলদের মত তুভার জনগণও অনেকটা হাভাতে জীবনযাপন করছিল। একটা কারণ রুশ ফারশিকারীদের অতিশিকারের কারণে তাদের অন্নসংস্থান কমে যাওয়া, তার ওপর অজন্মা খরা। একদল তুভান নেতা চাইলো মোঙ্গোলিয়ার সাথে যোগ দিতে, আরেকদল চাইলো রুশদের ‘প্রোটেকশন’। কারণ মোঙ্গোলদের থেকে তাদের তুর্কীজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন, শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে দু’জাত মিলে।

রুশ সম্রাট নিকোলাস প্রথমে মনোস্থির করতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত রুশ কলোনিস্ট আর ট্রেডারদের চাপে অজুহাত দাঁড়া করালেন যে তুভায় রুশদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাঁর সেনাবাহিনীর। রুশ সেনাদল প্রথমে একটা ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলো রুশপন্থী তুভানদের, পরে সে প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার অংশ হয়ে গেল।

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। ১৯১৭তে রুশ সাম্রাজ্যের বহুদিনের নড়বড়ে ভিত ভেঙে পড়ল বলশেভিক বিপ্লবের আঘাতে। মস্কো-পেত্রোগ্রাদসহ অল্পকিছু শহরে কম্যুনিস্টরা সরকারের দখল নিলেও প্রাদেশিক অঞ্চলগুলি ৎসারপন্থী ‘শ্বেত রুশ’ জেনারেলদের দখলে ছিল। সেসব অঞ্চলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন সরকার গঠন করা শুরু করে

সেই রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে ১৯১৮তে তুভা প্রথমে দখল করে এক শ্বেতফৌজ জেনারেল কোলচাক। কিন্তু এক বছর পরেই তুভার দখল চলে যায় চীনা ও মোঙ্গোল সেনাদলের কাছে। কম্যুনিস্ট লালফৌজ ধীরে ধীরে যখন শ্বেতরুশদের হারিয়ে দেয়া শুরু করে, তখন তারা ১৯২১এ তুভায় ঢুকে চীনাদের হটিয়ে দেয়। আর তুভার বলশেভিক কমরেডদেরকে দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় — তুভান পিপলস রিপাবলিক

তান্নু-তুভা নামে নতুন ‘স্বাধীন’ দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মোঙ্গোলিয়া। ছোট দেশটি এত সুদূর আর বিচ্ছিন্ন যে তারা স্বাধীন না পরাধীন নাকি পাপেট, তাতে বাকি বিশ্বের কিছু যেত-আসত না। কিন্তু তুভা ডাকটিকেট ইস্যু করত। আর সেগুলিও ছিল নানা রঙের, আর ত্রিভুজ, প্যারালেলোগ্রাম, ডায়মন্ড, ইত্যাদি অদ্ভূত আকারের। তাই যখন বহির্বিশ্বের মানুষের হাতে এসে পড়ত, সবাই তখন আহা-উহু করত

তুভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কু’লার দোন্দুকের মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া অবশ্য রুশরা থামাতে পারেনি। প্রাক্তন বৌদ্ধ শ্রমণ সেই রাষ্ট্রনায়ক চেষ্টা করেন মোঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম ও লামাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সমাজতান্ত্রিক পলিসিকেও পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

১৯২৬এ দোন্দুক বৌদ্ধ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন স্তালিনের টনক নড়ল। মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তুভান ছাত্রকে দেশে ফেরত পাঠালেন। তারা তুভায় এসে ‘জনসংগ্রাম’ সংগঠিত করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৯এ কু’র মাধ্যমে দোন্দুককে অপসারণ করা হয়। পাঁচ জনে মিলে সোভিয়েত স্টাইল সরকার দাড়া করায়। জোরপূর্বক যৌথখামারব্যবস্থা চালু করে; মোঙ্গোল বর্ণমালা উচ্ছেদ করে প্রথমে লাতিন ও পরে সিরিলিক অক্ষরের ব্যবহার চালু করে ; রুশদের নাগরিকত্বপ্রদান শুরু করে; আর বৌদ্ধ ধর্মের লামা আর প্রাচীন ধর্মের শামানদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৩২ সালে দোন্দুককে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

উপরের স্ট্যাম্পটি তার পরবর্তী সময়ের। ১৯৩৬ সালের। বাইরের মানুষ যদিও ভাবত এসব ডাকটিকেট তুভা থেকে প্রকাশিত, তারপরও পারতপক্ষে এগুলি তুভার আলোবাতাস আদৌ পেয়েছে কিনা সন্দেহ! কারণ এগুলি প্রিন্ট করা হয়েছে মস্কোর অফিশাল সোভিয়েত প্রেসে! হয়ত কিছু তুভাতে পাঠানো হয়েছে — তুভার মত বিস্তীর্ণ কম জনধ্যুষিত দেশে সেগুলির কি ব্যবহার ছিল স্তালিনই বলতে পারতেন ভাল! কিন্তু বাকি বিশ্বের ফিলাটেলিস্টদের কাছে এসব স্ট্যাম্প বিকোত বেশ, আর তার থেকে দু’পয়সা কামাই করে নিত সোভিয়েতরা (তখনও তারা সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি)।

এ ডাকটিকেটে দেখানো হচ্ছে যে রেলগাড়ির সাথে রেইস দিচ্ছে ব্যাক্ট্রিয়ান ঊট। ভাবখানা এমন যে, তুভায় এতই প্রগতির বন্যা বইছে যে ঊটকে নিজের চাকরি বহাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

বাস্তবতা হলো, তুভাতে সে আমলে কোন রেললাইনই ছিল না, আর এই একবিংশ শতকেও নেই!

তুভাকে অবশ্য বেশিদিন এই ড্রামার ভিক্টিম হতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্তালিন যখন ১৯৪৪এর অক্টোবরে জার্মান বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযান করে ইউক্রেইন, বেলারুশ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া থেকে উৎখাত করছেন, আর একে একে এ দেশগুলিকে ‘এসএসআর’ নাম দিয়ে ‘মুক্ত’ করে দিচ্ছেন, আর তারা বেজায় খুশি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে, তখন কোন এক সকালে উঠে তুভাবাসী দেখে তারাও কোন ফাঁকে ‘এসএসআর’ নয়, রুশ এসএসআরের ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ) হয়ে গেছে! তাদের সংসদ ‘খুরালে’ কোন ভোটাভুটি ছাড়াই রাবারস্ট্যাম্প মেরে রাশিয়ার কাছে যা স্বাধীনতা ছিল — স্ট্যাম্প ইস্যু করার অধিকারসহ — দেশনেতারা বেঁচে দিয়েছে!

আজ তুভা রুশ ফেডারেশনের ৮৫টি ফেডারেল সাবজেক্ট, যার মধ্যে ২২টি রিপাবলিক, তাদের একটি রিপাবলিক। এখনো দেশটি বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত। রেললাইন একটা চালু হবার কথা ২০২০ সালে।

তুভানদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে মোঙ্গোলদের মত থ্রোট সিঙ্গিং
, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ মনোযোগ কেড়েছে। সেটা শোনার জন্য ইউটিউবে হুন-হুর-তু (Huun Huur Tuu) কিংবা কোঙ্গার-ওল ওন্দার (Kongar-ol Ondar) খুঁজে দেখুন


(১) খা়নাত হলো ‘খা়ন’শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা মুসলিমও হতে পারে, বৌদ্ধও হতে পারে, শামানও হতে পারে। খা়ন শব্দটি মূলে তুর্কী-মোঙ্গোল, আরবী নয়। চেঙ্গিস খা়ন মুসলিম ছিলেন না! [Khanate]

(২) এখানে অবশ্য পু-য়ীর কাহিনী শেষ না, আবার তাঁকে দেখা যাবে জাপানের পাপেট স্টেট মাঞ্চুরিয়ার নামমাত্র ‘সম্রাট’ হিসাবে! [Henry Puyi]

(৩) বিভিন্ন শ্বেতফৌজ জেনারেলও রাশিয়ার সাম্রাজ্যের কোন না কোন এলাকায় ৎসার নিকোলাসকে রাজা মেনে স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ডাকটিকেট ছাড়ত, সেগুলি বেশ চমকপ্রদ আইটেম! [White Movement]

(৪) মোঙ্গোলিয়াতেও লালফৌজের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। সোভিয়েত রাশিয়া বাদে তাই মোঙ্গোলিয়া একটি মাত্র দেশ যেখান সাত দশক কম্যুনিজম চলেছে। [Mongolian People’s Republic]

(৫) পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানও তান্নু-তুভার পোস্টেজ স্ট্যাম্প দেখে খুবই শখ করেছিলেন সেখানে যাবার। কিন্তু মার্কিনদের জন্যে সোভিয়েতের সুদূর একটি অঞ্চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়, বিশেষ করে যখন সোভিয়েতদের পর্যটনশিল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করা, তুভার মত প্রত্যন্ত পশ্চাদপর সমাজব্যবস্থা দেখালে উল্টোফল। ১৯৮৮ সালে ফেইনম্যানের স্বপ্ন পুরো হবার আগেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান। তার ঠিক পরপরই তার তুভা যাবার ভিসা হাজির হয়। [Tuva or Bust!]

(৬)কামাল আতাতুর্কের তুর্কী-আরবী থেকে লাতিনে যাবার মত। খোলস পাল্টে কিছু একটার চেহারা পরিবর্তনই ছিল এসকল ‘রিফর্মার’দের প্রগতিশীলতার উদাহরণ। এতে সামাজিক বাস্তবতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। [Turkish Alphabet Reform]

(৭) সোভেতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা — এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামেমাত্র স্বতন্ত্র ১৫টি প্রজাতন্ত্রের গালভরা অফিশাল নাম, সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। [Republics of the Soviet Union]

(৮) থ্রোট সিঙ্গিং এক অদ্ভূত ‘এলিয়েন’ টাইপের গান, ফুসফুস থেকে গলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা চেম্বারের রেজোন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আওয়াজ তুলতে পারলে মনে হয় যে একই মানুষ দুই বা ততোধিক টোনের শব্দ করছে! একে ওভারটোন সিঙ্গিংও বলে। তিব্বতী বৌদ্ধ শ্রমণরাও এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে। মোঙ্গলদের পাশাপাশি তুভান আর আরো কিছু পূর্ব সাইবেরীয় গোত্রের এ ঐতিহ্য রয়েছে। [Overtone Singing]

(৯) টেড-এক্সের একটা তুভান থ্রোট সিঙ্গিং ভিডিও [Tuvan Throat Singing | Alash | TEDxBaltimore]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!