হাওয়াই’য়ি রাজতন্ত্রের গোধূলি

প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে নয়নাভিরাম চিরসবুজ দ্বীপপুঞ্জ হাওয়াই’য়ি। এখন হাওয়াই’য়ি যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টেট, পর্যটনের জন্যে ভূবনবিখ্যাত।

হাওয়াই’য়ি একটা সময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই লেখায় বলছিলাম তুভা নামের ছোট্ট একটি দেশ বেদখল হয়ে যাবার কাহিনী। আজকে বলি হাওয়াই’য়ি কিভাবে সার্বভৌমত্ব হারালো।

বড় মানচিত্রে হাওয়াই’য়ির দ্বীপগুলি দেখানো হয়েছে, আর ছোট ইনসেট ম্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে তুলনামূলক অবস্থান। (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

নিচের ডাকটিকেটগুলো যথাক্রমে ১৮৮২, ১৮৯৩ ও ১৮৯৪ সালের। প্রথমটিতে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। দ্বিতীয়টির ছবি হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। তৃতীয়টি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে।

১৮৮২ সালের এই ডাকটিকেটে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্রিটিশ পরিব্রাজক ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৮ সালে হাওয়াই’য়ি দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে নোঙর ফেলেন। সে দ্বীপগুলিতে দেড় হাজার বছর ধরে বসতি ছিল পলিনেশিয়ান জনপদের একটি গোত্রের । ক্যাপ্টেন কুকের দলের সাথে ঝগড়াঝাঁটির জের ধরে হাওয়াই’য়িবাসীর হাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এর কয়েক বছরের মধ্যেই করিৎকর্মা রাজা প্রথম কামেহামেহা ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের অস্ত্রপ্রযুক্তি করায়ত্ত করেন, আর যুদ্ধাভিযান করে সব দ্বীপকে বশ করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কিংডম অফ হাওয়াই’য়ি।

দু’বার ক্ষণস্থায়ী ব্রিটিশ শাসন চললেও এ রাজ্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোভাগে ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু প্রাসাদষড়যন্ত্র ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। রাজা আর বনেদী হাওয়াইয়ানরা অবশ্য ইউরোপীয়-মার্কিনদের সাথে নিয়মিত উঠবোস করত। ইংরেজীও পারত তারা সকলে। এর একটা বড় কারণ মার্কিন প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীদের ধর্মপ্রচার। হাওয়াই’য়িএর নেটিভরা নিজ সংস্কৃতির খোলসটাকে রেখেই স্বেচ্ছায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে। অনেকে মার্কিন-ইউরোপীয়দের সাথে বিয়ের সম্পর্কে মিলে যায়। (প্রশান্ত মহাসাগরের বেশ অনেকগুলো দ্বীপরাজ্যের ইতিহাস একইরকম।)

১৮৩৫ সাল থেকে হাওয়াই’য়ি হয়ে ওঠে আমেরিকায় চিনি আমদানির মূল উৎস। ইউরোপীয়-মার্কিন ব্যবসায়ীরা, আর অল্প কিছু স্থানীয়, রাজার অনুমতিক্রমে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণ করে আখ চাষ শুরু করে । ক্ষেতের কাজ করতে চীন, জাপান, ফিলিপিন থেকেও এসময় ‌অভিবাসী শ্রমিক আসতে শুরু করে।

১৮৯৩ সালের এই ডাকটিকেটে হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির ছবি, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্যবসার স্বার্থে ধীরে ধীরে হাওয়াই’য়িয়ের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন আখচাষীদের নাক গলানো শুরু হয়ে যায়। খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবে আর চিনিরপ্তানির অর্থে বিত্তবান রাজা তৃতীয় কামেহামেহা তাঁর সরকারে অনেক ইউরোপীয়-মার্কিনদের স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গ্যারেট জাড নামে এক মার্কিন মিশনারী। এই ভদ্রলোক অবশ্য বেশ বিশ্বস্ত ছিলেন, মার্কিন নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে হাওয়াই’য়িয়ের নাগরিক হয়ে যান। হাওয়াই’য়িবাসীর মঙ্গল চিন্তা করেই বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেন, কিন্তু সেসবের ফল হয়েছিল উল্টো। তার একটি হলো ‘গ্রেট মাহেলে’।

গ্রেট মাহেলে সংস্কারের মাধ্যমে বিদেশীদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ার আগেই হাওয়াই’য়িয়ের অধিবাসীদের মাঝে জমি পুনর্বন্টন শুরু করা হয়। আমরা আজ জমি-সম্পত্তির মালিকানাকে ধরেই নিই স্বাভাবিক মানবিক অধিকার, হাওয়াই’য়িবাসীর প্রাচীন প্রথানুযায়ী তা কিন্তু ছিল না। নেটিভ আমেরিকানদের মত তাদেরও প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী বসবাসের আর আবাদযোগ্য জমি কমিউনিটি প্রপার্টি, প্রকৃতি তার ভরণপোষণের প্রকৃত মালিক, আর রাজা তার কাস্টোডিয়ানমাত্র।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রজাদের বেশিরভাগ গ্রেট মাহেলে ফরমানের লিখিত ভাষা পড়তে জানত না। আর জমির মালিকানা দাবি করার জন্যে ন্যূনতম সরকারি কর দেবারও সামর্থ্য ছিল না তাদের। তার ওপর চলছিল বিদেশীদের নিয়ে আসা রোগজীবাণুর মহামারি। ফলে অনেকেই এ সংস্কারের আওতা থেকে বাদ পড়ে যায়।

এতে করে বেশির ভাগ পতিত জমি পাঁচটি বড় বড় চিনি কম্পানির হাতে চলে যায়, এরা অধিকাংশই ছিল মার্কিনপরিচালিত। গ্রেট মাহেলে সংস্কারের বছর কয়েকের মধ্যে কামেহামেহা আর জাডের বিদেশসফরের সুযোগ নিয়ে মার্কিনী প্রধান বিচারপতি এমন একটি আইন পাশ করেন, যার ফলে বিদেশীরাও হাওয়াই’য়িতে জমি কিনতে পারে। সে আইনের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজা ও জাড হার মানেন।

আভ্যন্তরীণ ব্যাপারস্যাপারে হাওয়াই’য়িনিবাসী মার্কিনীরা ব্যক্তিগতভাবে যখন এভাবে নাক গলাচ্ছে, তখন মার্কিন সরকারও হাওয়াই’য়িয়ে স্টীমশিপ রিফুয়েলিংয়ের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে তার সামরিক তাৎপর্য বোঝা শুরু করে। পার্ল হারবারের জায়গাটি লীজ় নেয়ার প্রস্তাব দিলেও হাওয়াই’য়িয়ানদের আপত্তির কারণে রাজা লুনালিলো তাতে রাজি হন না। কিন্তু পরবর্তী রাজা কালাকাউয়া মার্কিনদের চাপে সেই লীজ় দিতে রাজি হন (১৮৮৭ সাল থেকে এর মেয়াদ শুরু হয়)। কালাকাউয়া তাঁর রাজ্যের সামরিক গুরুত্ব ভালভাবেই জানতেন, এবং ভয় করেছিলেন যে এই লীজ় না দিলে যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই’য়িকে জোরপূর্বক দখল করে নেবে। অবশ্য এর বিনিময়ে তিনি মার্কিন কংগ্রেসের কাছ থেকে কিছু অস্থায়ী বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন।

১৮৮৭তে কালাকাউয়ার বিরুদ্ধে তাঁরই ক্যাবিনেটের উগ্রপন্থী সদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। মার্কিন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার থার্স্টন ইউরোপীয়, মার্কিন আর কিছু ধনাঢ্য নেটিভদের সমর্থন নিয়ে রাজাকে বাধ্য করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র চালু করতে । আইন পরিবর্তন করে হাওয়াই’য়িয়ের বিদেশী নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর ভোটাধিকারের জন্যে বার্ষিক ন্যুনতম ছয়শ ডলার আয়ের শর্ত আরোপিত হয়। এর ফলে হাওয়াই’য়িয়ের নেটিভদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, আর প্রচুর ইউরোপীয়-মার্কিন বিদেশী হওয়া স্বত্ত্বেও সে অধিকার পায়। চীনা-জাপানী বংশোদ্ভূতদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




এ ঘটনার পরপরই রাজপরিবারের অসন্তুষ্ট কিছু সদস্য রাজাকে অপসারণের চেষ্টা করেন। কালাকাউয়ার বোন লিলি’উওকালানি আর তুতোভাই রবার্ট উইলকক্স এদের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সে বিদ্রোহের কথা আগেই ফাঁস হয়ে যায়, আর উইলকক্স নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

১৮৯১এ কালাকাউয়ার মৃত্যু হলে রাণী হন লিলি’উওকালানি। লিলি’উওকালানি চেষ্টা করেন শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে নেটিভদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ তার বিরুদ্ধে সেই একই থার্স্টন গ্রুপের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এবার তাদের লক্ষ্য হল সশস্ত্র কুএর মাধ্যমে লিলি’উওকালানিকে অপসারণ। মূল ষড়যন্ত্রকারীদের পাঁচজন ছিল মার্কিন, একজন ব্রিটিশ আর এক জার্মান।

১৮৯৪ সালের এই ডাকটিকেটটি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

কুয়ের পরিকল্পনার কথা হাওয়াই’য়িয়ের মার্কিন(!) পুলিশপ্রধানের কানে আসে। ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট চাইলে মার্কিন(!) অ্যাটর্নি জেনারেল বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুলিশপ্রধান রাণীর প্রতিরক্ষার জন্যে লোক জড়ো করা শুরু করেন।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




কু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায়, এবং লিলি’উওকালানির শত্রুরা তাদের সমর্থক ইউরোপীয়-মার্কিন-নেটিভদের সম্মিলিত সৈন্যদল নিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাদে গৃহবন্দী করে রাখে। মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিও স্বদেশী নাগরিকদের রক্তপাতের আশংকায় আর জাপানের হস্তক্ষেপের ভয়ে বন্দরের জাহাজ থেকে মেরিন সেনাদের একটি দলকে শহরে ডেকে পাঠান।

এরকম হুমকির মুখে ব্যাপক রক্তপাতের আশংকায় লিলি’উওকালানি তাঁর অনুগত সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। দু’পক্ষে তারপরও কিছু নেটিভ আর মার্কিন মানুষ মারা যায়। অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হবার লক্ষ্যে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গ্রভার ক্লীভল্যান্ড এই বিতর্কিত কাজটি করতে রাজি হলেন না। তাই তারা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এরপর উইলকক্স ১৮৮৯এ সান ফ্রানসিস্কো থেকে গোপনে অস্ত্রভান্ডারসহ ফিরে এসে চেষ্টা করেন লিলি’উওকালানিকে পুনরোধিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তাঁরা বিফল হন, উল্টো লিলি’উওকালানিকে ‘বিচার’ করে জেলে পুরে দেয় তাঁরই প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল

ক্লীভল্যান্ডের পরে প্রেসিডেন্ট হন ম্যাকিনলি । তাঁর নৈতিক বাছবিচার একটু কমই ছিল। তাছাড়া স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে জয়ের পরে হঠাৎ করে মার্কিনদের হাতে এসে পড়ে প্যাসিফিকের ‘সিকম্যান’ স্পেইনের ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ, কিউবা, গুয়াম, পোর্তো রিকো প্রভৃতি কলোনি। স্পেনের কলোনিগুলি হস্তগত করার সময় এতদিনের জর্জ ওয়াশিংটনের অ্যান্টিকলোনিয়ালিস্ট দর্শন বিস্মৃত হয় মার্কিনরাষ্ট্র!

অবশ্য এনিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়েছিল সেসময়। বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টি চেষ্টা করে ম্যাকিনলির ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিকে চেক দেবার। কিন্তু এ ছিল এক ভিন্ন জনমনস্তত্ত্বের সময়। সারা বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী রণসঙ্গীত চলছে। আর্মস রেস চলছে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে । মরোক্কান ক্রাইসিস, আগাদির ক্রাইসিস ঘটে যাবে পরের দশকেই। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা উঠল বলে। জাপানেরও আনাগোনা বেড়ে গেছে প্যাসিফিকে ১০। এসব মিলিটারিজম যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করে।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




তাই ফিলিপিন ইত্যাদিকে শুরুতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র করা হবে বললেও শেষ পর্যন্ত সেসব যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়ে গেল। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শেষ হবার ঠিক এক মাস আগে ১৮৯৮এর জুলাইতে কংগ্রেস হাওয়াই’য়িকে টেরিটোরি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার বিল পাশ করে দেয়, এবং ম্যাকিনলি তা স্বাক্ষর করেন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পার্ল হারবারের স্বাক্ষী হয় হাওয়াই’য়ি। সে যুদ্ধে প্রচুর নেটিভ হাওয়াইয়ানও অংশ নেয়। ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশতম স্টেট হিসাবে হাওয়াই’য়িকে স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। ১৯৯৩ সালে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে যে ১৮৯৩-৯৪এ হাওয়াই’য়িয়ের রাজসরকারের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের অভ্যুত্থান ছিল বেআইনী, আর তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ক্লিনটন সেই রেজল্যুশন স্বাক্ষর করেন।

ষাটের দশকে হাওয়াই’য়িয়ান ভাষাসংস্কৃতি পুনরুজ্জীবন পায়। স্ল্যাক-কী গীটার, স্টীল গীটার, উকুলেলে — এসব হাওয়াইয়ান বাদ্যযন্ত্রের সাথে সারা বিশ্ব এখন পরিচিত। হাওয়াই চপ্পল কে না চিনে! সার্ফিঙও হাওয়াই’য়িয়ান আবিষ্কার। কোনা দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র জায়গা যেখানে কফির চাষ হয়। লাইলো এন্ড স্টিচ, মোয়ানা, ইত্যাদি মুভিতেও হাওয়াই’য়িয়ের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মাউনা কেয়া পর্বতের ওপর রয়েছে ভূবনবিখ্যাত টেলিস্কোপ অবজারভেটরি ১১

আর হাওয়াই’য়িতে গেলে কোন নেটিভ, কোন শ্বেতাঙ্গই গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণ করবে না আপনাকে। সবাই বলবে আলোহা! — যার অর্থ হতে পারে শুভ সকাল, কিন্তু এর আরো গভীরতা রয়েছে আন্তরিক ভালোবাসার অনুভূতির মধ্যে।

এসব দেখে অবশ্য লিলি’উওকালানি, উইলকক্স গর্ববোধ করতেন বলে মনে হয় না! কারণ, হাওয়াই’য়িয়ের জনসংখ্যার মোটে দশ শতাংশ আজ নেটিভ হাওয়াইয়ান। কিছু প্রভাবশালী নেটিভ হাওয়াইয়ান পরিবার থাকলেও আয় ও সম্পত্তির হিসাবে হাওয়াই’য়িয়ের জনপদগুলির মধ্যে তাদের দারিদ্র্যমাত্রা সর্বাধিক। অবশ্য হাওয়াই’য়িয়ের স্টেট সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার নেটিভ হাওয়াইয়ানদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে। এতে তারা লাভবান হবে নাকি আলস্যে নিপতিত হবে, তা সময়ই বলে দেবে।


(১) প্যাসিফিকের একপ্রান্ত ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপিনস-পাপুয়া থেকে আরেক প্রান্ত সুদূর ঈস্টার আইল্যান্ড পর্যন্ত পলিনেশিয়ানদের ব্যাপ্তি। এমনকি তাইওয়ান আর মাদাগাস্কারের আদিবাসীদের সাথেও এদের ভাষাগত মিল রয়েছে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে তারা বড় বড় ক্যানু নিয়ে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাকে পুঁজি করে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশিরভাগ বাসযোগ্য দ্বীপ একে একে জয় করে ফেলে (মোয়ানা!)। নিউজিল্যান্ডের মাওরিরাও পলিনেশিয়ান। এদের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ, আর যোদ্ধাজাত হিসাবে ইউরোপীয়দের কাছে ছিল সম্মানিত।কিছু গোত্র ছিল নরখেকো! [Polynesians]

(২) আখের রস থেকে সেন্ট্রিফ্যুজের মাধ্যমে চিনি আলাদা করার যান্ত্রিক প্রক্রিয়াও হাওয়াই’য়িবাসী এক মার্কিন আখচাষীর ঊর্বরমস্তিষ্কের ফসল। [Inventor David M. Weston]

(৩) এ শাসনতন্ত্র পরিচিত ‘বেয়োনেট কন্সটিট্যুশন’ হিসাবে কারণ জোরপূর্বক এটি হাওয়াই’য়িয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও তাদের মেরিন সেনাদল তৈরি রেখেছিল আর গুপ্তচর মারফত খবরাখবর সংগ্রহ করছিল। যদি মার্কিন সম্পদ ও জীবনহানির সম্ভাবনা দেখা দিত, তাহলে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৮৮৭তে তারা তা করেনি, কিন্তু ১৮৯৩এ কিছুটা করে। [1887 Constitution of the Kingdom of Hawaii]

(৪) রবার্ট উইলকক্সের আরেক নাম আয়রন ডিউক অফ হাওয়াই। বিসমার্কের নাম ছিল আয়রন চ্যান্সেলর। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড একরোখা এই নেটিভ হাওয়াইয়ান! বিচার করে তাঁকে ফাঁসির রায় দিলেও লিলি’উওকালানির সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেয়ার শর্তে তিনি বেঁচে যান। পরে সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ছেড়ে হাওয়াইয়ান টেরিটোরির সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্যগুলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। সে উদ্দেশ্যে হোমরুল পার্টি শুরু করেন এবং ১৯০১এ হাওয়াই’য়ি সেনেটে মেজোরিটি অর্জন করতেও সমর্থ হন, কিন্তু টেরিটোরির মার্কিন বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট ডোলের ভেটোর কারণে অনেক কিছু করতে পারেননি। একসময় তিনি নেটিভদের জনপ্রিয়তাও হারানো শুরু করেন। ১৯০৩এ তাঁর মৃত্যু হয়, কিন্তু সে পার্টি ও তার উত্তরসূরী দলগুলি এখন পর্যন্ত হাওয়াই’য়িয়ের স্বাধীনতা দাবি করে চলেছে — যদিও স্টেট সংসদে প্রতিনিধিত্ব পাবার মত ভোট এখন তারা পায় না। [Robert William Wilcox]

(৫) লিলি’উওকালানিকে বেশিদিন জেল খাটতে হয়নি।১৮৯৬ সালে তাঁর জন্যে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। তিনি তারপর যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন, মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি থামান। এতে প্রায় সফলও হয়েছিলেন, ১৮৯৭এ মার্কিন সেনেটে ম্যাকিনলির অ্যানেক্সেশনের প্রস্তাব প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হয়। হাওয়াই’য়িয়ের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে একটি ইতিহাসের বই লিখে রেখে যান লিলি’উওকালানি। তাছাড়া নেটিভ সঙ্গীত-সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। [Liliʻuokalani]

(৬) ম্যাকিনলি ছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যে অত্যধিক কর আরোপিত হয়। অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভাল হয়। ১৯০১ সালে এক পোলিশ বংশোদ্ভূত স্টীল মিলের শ্রমিকের গুলিতে তিনি নিহত হন। আততায়ীর উগ্র বামপন্থী দলের সাথে যোগাযোগ ছিল আর তার বিশ্বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার ধনাঢ্যদের সুবিধা দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের সুবিধাবঞ্চিত করছে। ম্যাকিনলির পরে তাঁর পলিসিগুলিকে অব্যাহত রাখেন থিওডোর রোজাভেল্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশ্য ‘কলোনিয়াল এম্পায়ার’ আর ‘ফরেন ওয়ারের’ বিরুদ্ধে জনমতের কারণে মার্কিন সরকার বিশ্ব থেকে আইজোলেশনিস্ট অবস্থান নেয়, এবং তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবারের আক্রমণ পর্যন্ত চলে। [William McKinley]

(৭) মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যে সহনশীলতা রক্ষা করে চলতেন অন্যান্য জাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে, সেসবের উল্টোধারা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকে। বিশেষ করে ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ নামে পরিচিত চিন্তাধারার মাধ্যমে আমেরিকার নেটিভ-অধ্যুষিত এলাকাগুলির ‘উন্নতি-প্রগতির’ স্বার্থে সেসবের সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে জাস্টিফাই করা হ্য়। ফলস্বরূপ, প্রচুর ‘রেড ইন্ডিয়ান’ ট্রাইব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের প্রচুর নারী-শিশুও সেসবে প্রাণ হারায়, আর পূর্বপুরুষদের ভূমি হারিয়ে তারা রিজার্ভেশনে একরকম বন্দিজীবন শুরু করে। [Manifest destiny]

(৮) ব্রিটেনের সাথে নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের নৌশক্তি ও প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। ব্রিটেনের রাজা এডওয়ার্ডের ভাগ্নে ছিলেন জার্মান কাইজার ভিলহেল্ম। তারপরও স্ব-স্ব দেশের সামরিক এ প্রতিযোগিতা থামাতে তাঁরা ব্যর্থ হন। চার্চিল সেসময় নৌমন্ত্রী ছিলেন, তিনি যুদ্ধজাহাজগুলিকে কয়লার পরিবর্তে জ্বালানিতেল দিয়ে চালানোর সংস্কার করেন, কারণ জ্বালানিতেল অধিক কার্যক্ষম আর সাশ্রয়ী। এছাড়াও ড্রেডনট বলে নতুন একধরনের আরমার্ড যুদ্ধজাহাজও ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। জার্মানিও নতুন ধরনের প্রযুক্তি দিয়ে আয়রনক্ল্যাড জাহাজ বানানো শুরু করে, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে ব্রিটিশ নৌশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে এ ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল একটা কারণ। [Anglo-German naval arms race]

(৯) মরক্কোতে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে দু’দুবার সম্মুখসংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমটা ১৯০৬এর মরক্কোসংকট নামে পরিচিত, দ্বিতীয়টা ১৯১১এর আগাদির সংকট। দুই ক্ষেত্রেই ফ্রান্স মরক্কোর ওপর তার ঔপনিবেশিক ‘অধিকারের’ বিরুদ্ধে জার্মানদের ‘আগ্রাসনের’ অজুহাত দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে। জার্মানিও গানবোট পাঠিয়ে সামরিক পেশী প্রদর্শন করে। দু’বারই ব্রিটেন ফ্রান্সের পক্ষ নেয়ায় জার্মানি বিফল হয়। কিন্তু জাতিগতভাবে আর দুই রাজপরিবারের রক্তসম্পর্কের বিচারে জার্মানরা ভেবেছিল ব্রিটেন তাদের পক্ষ নেবে। তা না হওয়ায় তারা অপমানিত বোধ করে, এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপের অন্য শক্তি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও তুরস্কের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। এসব ‘গানবোট ডিপ্লোমেসি’ তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল। [Moroccan Crisis]

(১০) মেইজি রিস্টোরেশনের সময় জাপানে সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয় আর সম্রাটের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। পশ্চিমাদের দেখাদেখি সংসদীয় আইন প্রনয়ণ শুরু হয়। নৌশক্তি বাড়ানোর জন্যে বিপুল ‌অর্থ বরাদ্দ করা হয়। স্পেনের প্যাসিফিক কলোনিগুলির দিকে ম্যাকিনলির যেমন নজর ছিল, জাপানেরও ছিল। ম্যাকিনলি আগেই সে লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হন। জাপান তখন চীন-কোরিয়া-রাশিয়ার দুর্বলতার দিকে মনোনিবেশ করে। ১৮৯৪এ চীনের সাথে যুদ্ধে জিতে তার করদ রাজ্য কোরিয়ার দখল নেয়, আর ১৯০৫এ রুশদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে পশ্চিমাবিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়। রুশদের এ পরাজয়ের ফলে নিকোলাসের বিরুদ্ধে প্রথম বিপ্লব দেখা দেয় রাশিয়াতে। এ ছিল ১৯১৭এর বলশেভিক বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল। [History of the Imperial Japanese Navy (1882-1893)]

(১১) মাউনা কেয়া একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হাওয়াইয়ানদের প্রাচীন ধর্মানুসারে পবিত্রভূমি, দেবতাদের আবাস। তাই এখনো টেলিস্কোপ স্থাপনার বিরুদ্ধে নেটিভরা প্রতিবাদ করে। টেলিস্কোপগুলি অবশ্য বৈজ্ঞানিক অনেক সত্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে বিশাল অবদান রেখেছে। [Mauna Kea]



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!