সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন

চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরী জাতীয়তাবাদী কুমিন্টাংয়ের বিরুদ্ধে ১৯৪৯এ গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। দাবি করা হয় যে, কম্যুনিস্ট শাসন শুরুর মাধ্যমে তারা চীনের “সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের” যবনিকাপাত করেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই টার্মটি আসলে চীনের কুমিন্টাং জাতীয়তাবাদীদেরই তৈরি ও ব্যবহৃত। অর্থাৎ চীনা কম্যুনিস্টরা কম্যুনিজমের শ্রমিক-চাষী-সৈনিক ইত্যাদি খেঁটে খাওয়া মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব কপচালেও পেতি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সোশালিস্ট মার্কেট পলিসি ছেড়ে দিলেও ঐ পেতি-বুর্জোয়া ন্যাশনালিজম রয়ে গেছে। এটা বলতে গেলে রাশিয়ার মত অবস্থা, স্তালিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিজম চলেছে ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে। আর কম্যুনিজমের পতনের পর সোশালিজম নাই হয়ে গেলেও ন্যাশনালিজম ষোল আনা বর্তমান।

দং শিওয়েনের অংকিত “জাতির গোড়াপত্তন অনুষ্ঠান” চিত্রকর্মে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণারত মাও জেদং, বর্তমান চীনা ন্যারেটিভে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি একই সাথে।

যা হোক, আজকে চীন ও রাশিয়া আপাত মিত্র। তবে সে মিত্রতায় চীনের পাল্লা অসামঞ্জস্যপূর্ণরকম ভারি। আর কোন বাজার না থাকায় রাশিয়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রান্তিক সম্ভাবনা। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে চীনের ওপর রাশিয়া অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ও ভোক্তাপণ্যের জন্য। দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।

কিন্তু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অন্য একটা ব্যাপারে খটকা লাগা স্বাভাবিক। সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি কি চীনা কম্যুনিস্টরা সম্পূর্ণ করেছে? তাইওয়ান তো এখন আর ভিনদেশীদের কলোনি নয়। আর হংকং-মাকাউ তো নব্বই দশকেই ফিরে গেছে, তাও তদকালীন কলোনিয়াল প্রভুদের ইচ্ছায় — সেসব স্থানের মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটে নয়।

সবুজ দাগে দেখানো “নাইন-ড্যাশ” লাইন বরাবর চীনা সমুদ্রসীমার দাবি, যেটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের লংঘন ও প্রতিবেশী দেশগুলির ন্যায্য হিস্যার পদদলন
চিং সাম্রাজ্যের শিখরে চীনের সীমান্তরেখা, ঊনবিংশ শতকের পূর্বার্ধ

এখনো নাইন ড্যাশ লাইন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চীন লেগে থাকে। চীনাদের দাবি অন্যায্যভাবে চিং রাজত্বকালে ও রিপাবলিক অফ চায়না শাসনামলে এসব এলাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নাকি গলাধঃককরণ করেছে। আসুন একটু সে অন্যায্যতার ফিরিস্তিটা দেখি। খেয়াল করে দেখবেন, ১৮৫৮ সালের ঘটনাটা!

১৮৩৯-৪২ঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। পাঁচটি বন্দরে বিশেষ শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশদের। হংকং ব্রিটিশদের দখলে (শুধু হংকং দ্বীপটি, আয়তন ৮০ বর্গ কিমি)। পরে লীজকৃত নিউ টেরিটরিসহ হংকং চীনের কাছে ফিরে যায় ১৯৯৭ সালে। সকল ট্রিটী পোর্টের বিশেষ সুবিধা ত্রিশের দশকের মধ্যে পশ্চিমারা হারায়, প্রথমে মার্কিন মধ্যস্থতায়, পরে চীন-জাপান সংঘাতের ডামাডোলে। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আসার আগেই। ট্রিটি পোর্টগুলিতে চীনা সার্বভৌমত্বই জারি ছিল, কিন্তু পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীরা বিশেষ সুবিধা পেত।

হংকং ও আশপাশের ব্রিটিশ উপনিবেশ পুরো চীনের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র

১৮৪৪ঃ ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশদের মত একই প্রকার আনইকুয়াল ট্রিটীর মাধ্যমে সে পাঁচটি বন্দরে বিশেষ সুবিধাপ্রদান।

১৮৫৬-৬০ঃ ব্রিটিশ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। হংকংয়ের সাথে কাউলুন যুক্ত, ৭০ বর্গ কিমি। এ সুযোগে রুশরা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র করে।

১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধপরবর্তী চিং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

১৮৫৮ঃ ট্রিটী অফ আইগুনের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের হাতে চিং সম্রাটকে ছেড়ে দিতে হয় আউটার মাঞ্চুরিয়া নামক এক বিশাল এলাকা। আমুর-উসুরি নদী দ্বারা সীমানা নির্ধারিত হয়। এলাকা ৬,০০,০০০ বর্গ কিমি, বর্তমান ইউক্রেন সাইজের। এ অঞ্চল এখনো রাশিয়ার হাতে। ভ্লাদিভস্তক মূল শহর, আরেক বড় শহর খাবারস্ক। অধিকাংশ জনসাধারণ মাঞ্চুরিয়ান, রুশ নয়। চীন এখনো এই বিশাল সম্পদশালী এলাকা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কবে চীনের এ হিউমিলিয়েশনের শেষ হবে তাও কারো জানা নেই। ষাটের দশকে সোভিয়েতদের সাথে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সকলে মুখ চেপে আছে।

১৮৫৮ সালে বিনা যুদ্ধে সামরিক হুমকি-ধামকি দিয়ে উত্তরপূর্ব মাঞ্চুরিয়ার বিশাল এলাকা চীনের থেকে হস্তগত করে রুশ সাম্রাজ্য, এলাকাটি এখনো রাশিয়ার অংশ

১৮৫৮ঃ ট্রিটি অফ তিয়েনৎসিনের মাধ্যমে ট্রিটি পোর্টের সংখ্যা ও সুবিধা আরো বৃদ্ধি। ব্রিটিশ-ফরাসীদের পাশাপাশি রুশ-মার্কিন নাগরিকদের এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। রুশরাও পাবে ট্রিটি পোর্টের সুবিধা। প্লাস যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ।

১৮৮৪-৮৫ঃ ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের তিনটি অঞ্চলের (আনাম — ১,৩০,০০০ বর্গ কিমি, তংকিন — ১,০৩,০০০ বর্গ কিমি, কোচিনচিন — ৬৯,০০০ বর্গ কিমি) ওপর ফরাসীদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার। তবে এ ভিয়েতনাম অতীতে বহুবার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। চীনই তাদের প্রাচীনতম শত্রু। ভিয়েতনাম স্বাধীনদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় ১৯৪৮ সালে। ফরাসী-মার্কিনদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধ করলেও চীন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ।

ভিয়েতনামের উত্তরাংশ চিং সাম্রাজ্যের প্রভাববলয়ে থাকায় ফ্রান্স ও চীনের মধ্যে ১৮৮০র দশকে যুদ্ধের মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়

১৮৮৮ঃ ব্রিটিশ ভারতের সিক্কিম অভিযান। তিব্বতের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ছোট রাজ্যটির সাথে প্রটেক্টরেটের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারত। সিক্কিমের আয়তন ৭,০০০ বর্গ কিমি। ওদিকে কিন্তু তিব্বতকে চিং সম্রাট সে অধিকার দেয়নি ইত্যাদি বলা হয়। তিব্বত নাকি চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও তিব্বত ছিল এ এলাকার সার্বভৌম একটি সাম্রাজ্য। কম্যুনিস্ট চীন ১৯৫০ সালে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিব্বতের ক্ষুদ্র প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে “হিউমিলিয়েশনের” সমাপ্তি ঘটায়। এখনো দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের একটি নির্বাসিত সরকার আছে ভারতে। তিব্বতের আয়তন ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি।

১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন তিব্বতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে “শান্তিপূর্ণ মুক্তি” এনে দেয় চীনের লালবাহিনী

১৮৯৪-৯৫ঃ নব্য পরাশক্তি জাপানের সাথে যুদ্ধ ও পরাজয়। তাইওয়ান দ্বীপটি (৩৬,০০০ বর্গ কিমি) জাপানের কাছে সোপর্দ। কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর জাপানী প্রটেক্টরেট, যদিও সেটির পোশাকি নাম এম্পায়ার অফ কোরিয়া। কোরিয়া স্ব অধিকারে একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য ছিল, তবে মোঙ্গল দিগ্বিজয়ের পর পর চীনের ইউয়ান, মিং ও চিং সাম্রাজ্যের লেজুড় হয়ে রয়। তবে সে সম্পর্কটা ছিল করদ রাজ্যের। ১৮৮০র দশকে কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব হরণ করে চিং সাম্রাজ্য। ফলশ্রুতিতে জাপানী আক্রমণ। এখন দুই দেশে বিভক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ (উত্তরঃ ১২০,০০০ বর্গ কিমি, দক্ষিণঃ ১০০,০০০ বর্গ কিমি)। চীন উত্তর কোরিয়ার ওপর বলতে গেলে এখনো সেরকম প্রাচীন প্রভাব খাঁটিয়ে চলেছে। তাইওয়ান ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও ছিল ডাচ-পর্তুগীজ ঘাঁটি। তাইওয়ানের মূল অধিবাসীরা চীনা নয়। চিং সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অন্তর্গত হলেও সেখানে স্থানীয়রা বিদ্রোহ করেছে, জাপানী শাসনের প্রাক্কালে ১৮৮০র দশকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে থাকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪৯এ রিপাবলিক অফ চায়না সরকার গৃহযুদ্ধে হেরে সেখানে পালিয়ে যায়।

১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে তাইওয়ান ও কোরিয়াসহ উত্তরের বেশ কিছু এলাকা চীনের প্রভাবমুক্ত হয়

১৮৯৫ঃ জাপান যুদ্ধে জিতে চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপের পোর্ট আর্থার ও সংলগ্ন অঞ্চলের (৩৫০,০০০ বর্গ কিমি) লীজ পেলেও তিন ইউরোপীয় শক্তি জার্মানি, রাশিয়া ও ফ্রান্স জবরদস্তি করে সে এলাকা লীজে তুলে দেয় রুশদের হাতে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শেষ মাথা বানানোর তাগিদে রুশরা জাপানীদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯০৫এ তাদের মধ্যে যুদ্ধে এবং রুশদের পরাজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সোভিয়েত দখলদারিত্ব। তারপর মাওয়ের কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে ফিরে যায় এ এলাকা।

১৯০৩ সালের রুশ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ের সাথে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়া রেললাইনের সংযুক্তি

১৮৯৯-০১ঃ বক্সার বিদ্রোহ। বিদেশীবিরোধী, খ্রীষ্টানবিরোধী এক পপুলিস্ট মিলিশিয়া যাদের নাম বক্সার, সমানে কচুকাটা করে পশ্চিমা আর তাদের স্থানীয় মিত্রদের। চিং সম্রাজ্ঞী সিশি গোপনে তাদের সমর্থন দেন। বিদ্রোহ দমনে আটটি দেশ অভিযান চালায়, যাদের মধ্যে রুশ ও জাপানীও ছিল। রাশিয়া এ সময় পুরো মাঞ্চুরিয়া (৯৮০,০০০ বর্গ কিমি) দখল করে রাখে ও লুটতরাজ চালায়। বিদ্রোহের পরও তারা সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, ফলশ্রুতিতে জাপানের সাথে ১৯০৫এর যুদ্ধ। জার্মানি দখল নেয় চিংদাওয়ের (৫০০ বর্গ কিমি) আর ফরাসীরা কুয়াংচৌওয়ান (৫০০ বর্গ কিমি)। আর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চিং সম্রাটকে। প্রসঙ্গত, মার্কিনদের যে ক্ষতিপূরণের ভাগ ছিল তা থেকে পরে আমেরিকায় চীনা ছাত্রদের পড়াশোনার ফান্ড তৈরি করে দেয়া হয়, বর্তমান ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও সে টাকায় শুরু।

১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহদমনে চীনে অনুপ্রবেশ করে ৮ জাতির শান্তিরক্ষীবাহিনী

১৯০৫ঃ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়। মাঞ্চুরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ও লিয়াদংয়ের দখল জাপানের হাতে। মাঞ্চুরিয়ার আদিবাসীদের নাম জুরচেন, এরা হান গোষ্ঠীর চীনা নয়।

১৯১১ঃ সপ্তদশ শতক থেকে “আউটার মঙ্গোলিয়া” (১,৫০০,০০০ বর্গ কিমি) চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হলেও ১৯১১তে বিপ্লবের গোলমালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৯এ চীনের প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও রুশ বিপ্লবের জোয়ার এসে পড়ে এখানে। ফলশ্রুতিতে রুশ সোভিয়েত পাপেট একটি পীপলস রিপাবলিক গঠিত হয়। সেই থেকে দুই দেশের বাফার হয়ে রয়েছে বর্তমান মঙ্গোলিয়া দেশটি। যদিও ইনার মঙ্গোলিয়া (১,২০০,০০০ বর্গ কিমি) এখনো চীনের অধীনস্থ তথাকথিত “স্বায়ত্ত্বশাসিত” অঞ্চল। তিব্বতের মত তাদেরও স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। আর মঙ্গোলিয়া দেশটি ধীরে ধীরে প্রকারান্তরে চীনের ইকনমিক কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।

বর্তমান মঙ্গোলিয়া চীন থেকে স্বাধীন হলেও ইনার মঙ্গোলিয়া বলে একটি বিশাল এলাকা এখনো চীনের অধীন

১৯১১ঃ তিব্বতেও একই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সিক্কিম নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে গোলমালের কারণে দক্ষিণ তিব্বতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। নামমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে এরপর তিব্বত ১৯৫০ পর্যন্ত চীনের প্রভাবমুক্ত থাকে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি অন্য কোন দেশ।

১৯২৯ঃ চীনের সাথে সোভিয়েতের প্রথম যুদ্ধ। নতুন চীনা রিপাবলিক মাঞ্চুরিয়ায় চায়নিজ ঈস্টার্ন রেলওয়েতে যে যৌথ প্রশাসন থাকার চুক্তি তা অগ্রাহ্য করে। সোভিয়েত সেনাদল দ্রুত চীনাদের হারিয়ে আগের লীজের চুক্তি পুনর্বহাল করে। এ সুযোগে উসুরি নদীতে একটি বড় দ্বীপ জবরদখল করে নেয়। বলশয় উসুরিস্কি নামের এ দ্বীপ (৩৫০ বর্গ কিমি) মোটে ২০০৪ সালে রাশিয়া ফিরিয়ে দেয় চীনকে।

দখলকৃত কোমিনতাং পতাকা হাতে রুশ লালবাহিনীর সৈন্য

১৯৩১-৩২ঃ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের আগ্রাসন। জার্মানি কর্তৃক ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট এই আক্রমণ। মাঞ্চুরিয়ায় একটি “স্বাধীন” পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জাপান। ক্ষমতাসীন করে ১৯১২তে ক্ষমতাচ্যুত চীনা চিং সম্রাটকে। ১৯৪৫এ সোভিয়েতরা জাপানীদের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও পরে মাওয়ের কম্যুনিস্টদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সঁপে দেয়। এখানকার ঘাঁটি থেকেই চীনা কম্যুনিস্টরা কোমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালায়।

মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের পর রেললাইনে “ক্ষয়ক্ষতি” পরিদর্শনে এসেছে জাপানী পরিদর্শকদল

১৯৩৪ঃ শিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কেস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন। এ সময় চীনে ছিল “স্বাধীন” বিভিন্ন ওয়ারলর্ডদের আধিপত্য। শিনজিয়াং বা উইগুর প্রদেশে কোমিনতাং সমর্থিত এক মুসলিম হুই চীনা ওয়ারলর্ড ও সোভিয়েত পাপেট আরেক ওয়ারলর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। উইগুর খানদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন পূর্ব তুর্কেস্তান রিপাবলিকও আবির্ভূত হয়, যেটা আসলে ছিল ইসলামিস্ট আখরা। কোমিনতাং ওয়ারলর্ড জিতে যাবার প্রাক্কালে সোভিয়েতরা আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয়জনের মাঞ্চু সৈন্যদলকে সহায়তা করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাঠানো লিটল গ্রীন মেনের মত উইগুরে পাঠানো এ সকল রুশ সৈন্যদের পোশাকে কোন পরিচয়ধারী প্রতীক ছিল না। মুসলিম সেই ওয়ারলর্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিনজিয়াংয়ে অপর ওয়ারলর্ডের সোভিয়েত পাপেট শাসন চলে ১৯৪২ পর্যন্ত।

১৯৩৪ সালে প্রথম “স্বাধীন” পূর্ব তুর্কেস্তান (শিনজিয়াং) সরকার

১৯৩৭-৪৫ঃ চীন-জাপান যুদ্ধ, যেটা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চলমান থাকে। এ সময়ে চীনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা ছিল জাপানের দখলে — প্রায় ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানী নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ লাখ মানুষ। চীনকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র — কম্যুনিস্ট ও কোমিনতাং উভয়কেই।

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানীরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে চীনাদের বিপক্ষে

১৯৪৫ঃ জাপানের পাপেট রাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সোভিয়েতরা, ‌হিরোশিমা-নাগাসাকির ঠিক পরপর। তারা জাপানী পাপেট সরকারের সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ করতে করতে সেখানে সোভিয়েতঅধিকৃত উত্তর কোরিয়া থেকে ঢুকে পড়ে বহু চীনা কম্যুনিস্ট, যারা রাশিয়া কিংবা কোরিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তাদের হাতে পড়ে মাঞ্চুকোর সেনাবাহিনীর অস্ত্র। কোমিনতাং সরকারের কাছে সোভিয়েতরা নামমাত্র মাঞ্চুরিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও কম্যুনিস্ট দোসরদের একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মাও সেতুং উত্তরের ঘাঁটি থেকেই কোমিনতাং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে চীনের সবচে শিল্পায়িত এলাকাটির কারখানার কলকব্জা ইত্যাদি খুলে লুট করে নিয়ে যায়। জাপান বা মাঞ্চুকো থেকে সরাসরি সোভিয়েতের ওপর যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও সোভিয়েতরা জাপানীদের সাথে সংযুক্ত সকল কম্পানিকে এমন “গনিমতের মাল” হিসাবে লুট করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে “নিরপেক্ষ” সোভিয়েতরা ঘোষণাব্যতিরেকে আক্রমণ চালিয়ে জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুকো’র দখল নেয়

১৯৪৪-৪৯ঃ শিনজিয়াং উইগুর প্রদেশে আরেকটা “স্বাধীন সোভিয়েত” পাপেট রাষ্ট্র গঠন করে সোভিয়েতরা। ১৯৪৯এ চীনের গৃহযুদ্ধে কম্যুনিস্টদের বিজয়ের পর সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে এ রাষ্ট্রের নেতারা। প্রদেশটি অংশ হয় চীন গণপ্রজাতন্ত্রের।

ছোটখাটর মধ্যে এই ফিরিস্তি আশা করি এ ধারণাটা আপনাদের দেবে যে পশ্চিমারা চীনকে যতটা হিউমিলিয়েট করেছে তার থেকে হাজার গুণে বেশি করেছে তাদের নিকট দুই প্রতিবেশী জাপান ও রাশিয়া — যাদের কোনটিকেই সে আমলে ঠিক পশ্চিমা কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। আর পশ্চিমাদের হাতে যে সকল ক্ষুদ্র এলাকা ছিল সব ফিরে পেয়েছে চীন। পায়নি কেবল রাশিয়ার দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকাগুলি। যেটুকু ফিরে পেয়েছে, তাও কম্যুনিস্ট আদর্শগত কারণে, ১৯৪৯এর পর, যখন মাও-স্তালিন দুই দিন পরপর হ্যান্ডশেক করতে ব্যস্ত, আর কোরিয়ার ভাগ্যনির্ধারণে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে কিছু শান্তি চুক্তি চীন সম্প্রতি করেছে। কিন্তু ভাবুন ইউক্রেনের সাথে দুই বার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি সত্ত্বেও রাশিয়া সেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে “ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভ্রাতৃত্বের” দোহাই দিয়ে — চুক্তিভঙ্গ করে। চাইলে চীন একইভাবে উত্তর মাঞ্চুরিয়ার “নিপীড়িত ‘চীনা’ বেরাদরদের” সাহায্যে এগিয়ে এসে ইউক্রেন সাইজের এলাকাটি বেদখল করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীনের যা লাগে সব পুতিনের রাশিয়া না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে। যদি পুতিনের মৃত্যু হয়, রাশিয়ান ফেডারেশন আলগা হয়ে আসে, তাহলে চীন সেসব এলাকা ফিরে চাইতেই পারে। ১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিপ্লবের পরেও রুশ সাম্রাজ্য আলগা হয়ে এসেছিল। সেসময় সুযোগের সদ্ব্যবহারের অবস্থানে চীন ছিল না, ছিল জাপান।

কদিন আগে একটা খবরে এসেছে যে চীন উত্তর মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন শহরের নাম নিজেদের সরকারী মানচিত্রে দেখানো শুরু করেছে চীনা নামে, সাথে ইংরেজী নাম, কিন্তু রুশে নয়। চীনের টেরিটরিয়াল ক্লেইম করার পন্থা এটাই। যে এলাকায় নিজেদের “ঐতিহাসিক সংযোগ” দাবি করতে চায়, সেখানকার একটি “প্রাচীন” চীনা নাম দেবে, এবং তারপর সেটিকে নিজেদের বলে দাবি করবে। এই কাজটি চীন করেছে ভারতের সাথেও — আকসাই চীন আর অরুণাচল প্রদেশে।

সুতরাং চীনের হিউমিলিয়েশনের শতক নিয়ে বেশি কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ না করে তার প্রতিবেশীদের তক্কে তক্কে থাকা উচিত। ভিয়েতনাম, কোরিয়াকে অতীত বহু শতকে যেভাবে করদ বা ঔপনিবেশিক রাজ্যের হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল, কিংবা মাঞ্চুরিয়া-তিব্বত-ইনার মঙ্গোলিয়া-শিনজিয়াংকে এখনো সহ্য করতে হয়, সেরকম হিউমিলিয়েশনের গিভিং এন্ডে না থাকলে রিসিভিং এন্ডে থাকতে হবে। এ শিক্ষাটা রাশিয়া অতি শীঘ্রই পাবে।

স্বদেশে পরদেশী উইগুর

Featured Video Play Icon

আজ যে জাতির সঙ্গীত নিয়ে লিখছি, তারা যে কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত হচ্ছে, এটা মনে হয় বাকি পৃথিবী ভুলে যেতে বসেছে। গানটা যে ‌অ্যালবাম থেকে নেয়া, তার নাম ‘লিসেন টু দ্য ব্যানড’ — এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে যেসব শিল্পীদের গান নিষিদ্ধ, তাদের নিয়ে এটা করা। গানটার ভাষা উইগুর, দুতারনামক বাদ্যযন্ত্রবাদক গায়কের  নাম কুরাশ সুলতান। তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে নির্বাসনে প্রয়াত হয়েছেন।

উইগুররা চীনের উত্তরপশ্চিমের শ়িনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজিয়নের বাসিন্দা। তাদের খবরাখবর বহির্বিশ্বে খুবই কম পাবেন, বিশেষ করে ২০০৯এর হান-উইগুর দাঙ্গার পর। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বাইরে থেকে কোন সাংবাদিক সেখানে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখে, বেশির ভাগ সময় ঢুকতে দেয় না, আবার নেটিভদের সাথে বেশি মেলামেশা করলে তাদেরকে এস্কর্ট করে প্রদেশের বাইরে বের করে দেয়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানকার সত্য খবর রিপোর্ট করে। প্রাদেশিক সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারেরই সাজানো, যতই তারা স্বায়ত্তশাসিত বলে নিজেদের দাবি করুক। এরকম আরো দুটো এলাকা আছে চীনে — তিব্বতকে সবাই চিনে দালাই লামার খাতিরে, আরেকটা নেই মেংগু বা ইনার মংগোলিয়া

উইগুরদের ইতিহাসটাও খুব চমকপ্রদ। এরা আসলে তুর্কী জাতি। তুর্কীরা তুরস্কে ঘাঁটি গাঁড়ার আগে ছিল মোঙ্গলদের পড়শি, আর তাদের মতই গরু-ভেড়া-চড়ানো যাযাবর গোষ্ঠী। মোঙ্গল, তিব্বতী, পারসিক আর চৈনিক রাজ্য দিয়ে চারিদিক ঘেরা তুর্কীরা মোঙ্গলদেরও আগে একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছিল, যার নাম গোকতুর্ক। এরা উপাসনা করত তেংরি বলে এক আকাশদেবতার, মোঙ্গলদের মতই। এদের নয়টি ট্রাইব দোকুজ়-ওগুজ়দের একটা উইগুররা। উইগুরদের তুতো ভাইয়েরা আরো পশ্চিমে গিয়ে সফল সাম্রাজ্য গড়েছে, আর উইগুররা ছিল সিল্ক রোডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকলা-মাকান মরুভূমি আর তিয়ানশান পর্বতমালার রক্ষক। কুবলাই খানের কজ়মোপলিটান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরকারে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য তুর্কী জাতের শত্রুদের বিরুদ্ধে এরা  চীনের প্রতাপশালী সুই সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। বাঙ্গালীদের মত উইগুররাও একেক সময় একেক ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমে অ্যানিমিস্ট থাকলেও, পরে মানিকেয়ান হয়েছে, বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ করেছে, নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টানও ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছে মুসলিম। এখনও অনেক উইগুর ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু প্রাচীন নিয়মকানুনের ছায়া রয়ে গেছে।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার অনুন্নত-বিভক্ত-পশ্চাদপর খানশাসিত ছোট ছোট পারসিক-তুর্কী রাজ্যগুলিকে রাশিয়ার রোমানভ় সাম্রাজ্য আর চীনের চ়িং সাম্রাজ্য একের পর এক দখল করে করদ রাজ্য অথবা উপনিবেশ বানানো শুরু করে। উইগুরদের দেশ এসময় চ়িংদের আয়ত্ত্বে আসে। এসময় করদরাজ্য হিসাবে আর দূরত্বের কারণে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রার উপর চীনাদের প্রভাব খুব কমই ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে চীনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রুশ কম্যুনিস্ট সরকারের প্ররোচনায় ১৯৩৩ আর ১৯৪৪এ দু’বার তারা স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিলেও প্রথমটা কয়েক মাস আর দ্বিতীয়টা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯৪৯এ রুশসমর্থিত দ্বিতীয় স্বাধীন তুর্কেস্তান সরকারের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদেরই ষড়যন্ত্রে প্লেনক্র্যাশে মারা যাওয়ার পর শেষ কম্যুনিস্ট সদস্য মাওৎসেতুংএর কাছে রাজাকারি করে রাজ্য সপে দেয়

এরপর মাওয়ের কালচারাল রেভোল্যুশনের সময় বাকি চীনবাসীদের সাথে সাথে এরাও ভুক্তভোগী হয়েছে। ১৯৪৯এ হানগোষ্ঠীর চীনাদের জনসংখ্যা উইগুরিস্তানে ৬% হলেও সরকারী নীতির কারণে ধীরে ধীরে বেড়ে এখন প্রায় ৪০%। হানরা ব্যবসাবাণিজ্য-চাকরিক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু তারা উইগুরদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে না, সম্মান করে না। স্বভাবতই শ়িনজিয়াং জাতিগত সংঘাতের একটা ঊর্বরক্ষেত্র।

দেং শ়িয়াও পিংএর সংস্কারের আমলে কিছুটা স্বাধিকারচর্চার সুযোগ পেলেও শ়ি জিন পিংএর চাইনিজ় এক্সেপশনালিজ়মের মুখোশপরা চীনা জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসরণের কারণে উইগুররা একটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডারিন না শিখলে তাদের জীবিকা নেই, লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ, মসজিদে অনূর্ধ্ব-আঠারো প্রবেশ নিষেধ, জায়গায়-জায়গায় সারভেইল্যান্স ক্যামেরা বসানো। এমনকি তাদের নিজ দেশের ইতিহাসকেও হানজাতির স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে ইন্জিনিয়ার করা হচ্ছে। অল্প কিছু উইগুর মুক্তির সন্ধানে  কট্টরপন্থী জিহাদী ইসলামে ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ভুলের অজুহাতে পুরো জাতটাকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামলেই তাদের টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘রিএডুকেশন ক্যাম্পে’ নাকি দশ লাখ উইগুর বন্দী, সেখানে নাকি তাদের জোর করে শুকরের মাংস, অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তের ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি। ইলহাম তোহতী বলে এক অর্থনীতিবিদ উইগুর অনলাইন বলে একটা সাদামাটা ওয়েবসাইট চালাতেন, তাঁর সাথে লাদেনকে জড়িয়ে দিয়ে এখন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রেখেছে। আবলাজান আইউব বলে এক অরাজনৈতিক জনপ্রিয় পপ গায়ককেও জুনমাসে লাপাত্তা করে দিয়েছে। দালাই লামার মত উইগুরদেরও স্বেচ্ছানির্বাসিত নেত্রী আছেন যার নাম রাবিয়া কাদির, কয়েকবার শান্তির নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েছেন।

ইউটিউবে উইগুর মিউজ়িক সন্ধান করলে অনেক নাচগান দেখবেন, এদের অধিকাংশই শো, বাইরের মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টা যে উইগুররা সুখেশান্তিতে নাচাগানা করে আছে। কামাল আতাতুর্ক একদিকে যেমন সুফী জিকির অবৈধ করেছিলেন, অন্যদিকে দরবেশদের সুফী ঘূর্ণিনৃত্য সমানে চলেছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে — চীন সরকারের এ প্রয়াস তার থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং আরো ভয়ানক কারণ এভাবে উইগুরদের জাতিগত পরিচয়টাকেই তারা ইনজিনিয়ার করে ফেলছে। সোভিয়েতরাও তাদের অনেক সংখ্যালঘু জনসত্ত্বাকে একইভাবে রিডিফাইন করেছিল।

মুসলিম দেশের সরকারগুলি ফিলিস্তিন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও উইগুরদের নিয়ে রহস্যজনকভাবে মৌন থাকে, সম্ভবত চীনের সাথে খাতিরের সম্পর্ক বজিয়ে চলার জন্যে। তুরস্কে অনেক উইগুর নির্বাসনে থাকলেও তুরস্কের সরকারও চুপচাপ, কথা বললেই কুর্দী-আরমেনিয়ানদের পুরনো কংকাল সিন্দুক থেকে বেরিয়ে নাচানাচি করবে। মার্কিন আর ইউরোপিয়ানরাই কিন্তু বছরের পর বছর তিব্বতী-উইগুরদের স্বাধিকারের পক্ষে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। ২০০৮এ একটা গণসংগ্রামের প্রচেষ্টা হলেও ইন্টারনেটে ইনজিনিয়ারড গুজব ছেড়ে চীনারা টেরোরিজ়মের জুজু দেখিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেসময় বাইরে থেকে বিবৃতির বেশি সাহায্য আসেনি। তাই অনেক তরুণ উইগুর স্বাধিকার-সংস্কৃতি-মানবাধিকার ভুলে কষে ম্যান্ডারিন শিখছে। অতএব আপাতত সিপিসি সফল।

গানের ভিডিওটিতে কিছু দৃশ্য ভায়োলেন্ট, ২০০৯এর উরুমচি শহরের দাঙ্গার যেটুকু পাবলিক ভিডিও রেকর্ড আছে তার কিছুটা। বাকি অংশ আগের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। ইলহাম তোহতীর একটা হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ পাবেন এখানে

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!