এক বছর আগের সূর্যাস্তের স্মৃতি — ইজরাইলের তেল আবিব শহরের নিকটস্থ পুরনো জাফা শহরতলীতে। পর্যটকদের জন্যে পাথরে তৈরি পুরনো সব ঘরবাড়ি, দুই তিন তলা সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অলিগলি সব অক্ষত রাখা হয়েছে।
সারি বেঁধে তিন চারটে কামান সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখা। অটোমান তু্র্কী আমলের সিটাডেলের প্রতিরক্ষাব্যূহের অংশ। ১৭৯৯ সালে স্বয়ং নাপোলেওনের জাহাজবহর সে প্রতিরক্ষাভেদ করে জাফা শহরে সফল আক্রমণ চালায়।
ঊনবিংশ শতকে স্থানীয় ও নবাগত অভিবাসী ইহুদীরা যখন অনতিদূরে তেলআবিব শহরের গোড়াপত্তন করছে, তখন জাফা নগরী কমপক্ষে ৩৭০০ বছরের পুরনো। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী জাফার বন্দর থেকেই ইউনুস নবী — বাইবেলের জোনাহ — সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে বৃহৎকায় মাছের পেটস্থ হন।
মিশরের নিউ কিংডম আমলেও জাফা ছিল কৌশলগত একটি অবস্থান। সেসময়ের জাফাকে ঘিরে একটি ঘটনাই হয়তবা রূপকথার পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আরব্যরজনীর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পটি। খ্রীষ্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে ফারাও তৃতীয় তুথমোসের শক্তিমান সেনাপতি জেহুতি ইজরাইল-কানানের স্বাধীন নগররাজ্যগুলোর ওপর সাম্রাজ্য কায়েম করেন। তখনো ইহুদী রাজ্য ইজরাইল-জুদার গোড়াপত্তন হয়নি। মিশরীদের তদকালীন শত্রু ছিল উত্তরে তুরস্কের হিট্টাইটরা। ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের নগররাজ্যগুলি দুই সাম্রাজ্যের মাঝে এক রকম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়।
জাফা দখলের জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন জেহুতি। নগরপতিকে নিজের ক্যাম্পে দাওয়াত করে নিয়ে এসে আটকে ফেলেন। তারপর দু’শ সৈন্যকে গমের বস্তার মত সাজিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে দুর্গের দরজায় পাঠানো হয়। ঘোষণা করা হয়, রাজ্যপালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন জেহুতি। আর নগরবাসীদের উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে গাধায় করে। উল্লসিত জনগণ দরজা খুলে গাধার কাফেলাকে বরণ করে নেয়ার পর রূপকথার চিচিঙ ফাঁক!
এ গল্প রয়েছে মিশরে প্রাপ্ত বিখ্যাত হ্যারিস প্যাপিরাস ৫০০তে, যেটি এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। প্রাক-আধুনিক যুগেই এই প্যাপিরাসসহ অনেক বস্তু মিশরীয় কোন না কোন রাখাল খুঁজে পেয়ে বিক্রি করে দেয় ইউরোপীয় ধনাঢ্য সংগ্রহকারীর কাছে।
বর্তমান জাফায় রয়েছে অটোমান যুগের বহু নিদর্শন। কিছুই ধ্বংস করা হয়নি। একটা ক্লক টাওয়ার। লাইটহাউজ, জেলখানা — সেটি এখন ফাইভস্টার হোটেল। তিনটা মসজিদঃ মাহমুদিয়া মসজিদ, আল বাহর মসজিদ, আজামি মসজিদ। সবগুলি সাগরতীরে প্রাইম প্রপার্টিতে। আরো আছে সেন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চ, সেন্ট অ্যান্টনিস ম্যারোনাইট চার্চসহ অগণিত ছোটবড় গীর্জা-ক্যাথেড্রাল। এগুলিতে উপাসনা করে মূলত আরব ফিলিস্তিনীরাই। বিশেষত লেবাননী আরবরা ম্যারনাইট তরিকার খ্রীষ্টান। এতগুলি চার্চ থাকার কারণ, যীশু খ্রীষ্টের অন্যতম শিষ্য সেন্ট পিটার নাকি এখানে মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার মাজেজা ঘটিয়েছিলেন।
রূপকথা আর মাজেজার শেষ এখানেই নয়। বন্দর থেকে সামান্য দূরে সাগরের বুকে জেগে থাকা একটা বড় পাথরের নাম অ্যান্ড্রমেডা রক। গ্রীক মিথে জাফার রাজা সিফিয়াস, তার কন্যা অ্যান্ড্রমিডা — যার নামে একটা গ্যালাক্সির নাম। আর তার বউ ক্যাসিওপিয়া — যার নামে একটি তারকামন্ডলের নাম। সিফিয়াস গর্ব করত এ দুজন নাকি জলকন্যাদের থেকেও রূপবতী। জলকন্যারা তাদের বাপ দেবতা পসাইডনের কাছে বিচার দিলে পসাইডন বিশাল এক সমুদ্রদানব পাঠিয়ে জাফাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তখন অনন্যোপায় সিফিয়াস শহরবাসীদের সাথে ষড় করে ঠিক করেন পসাইডনের কাছে বলি দিতে হবে অ্যান্ড্রমিডাকে। তারপর এই পাথরেই শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা হয় অ্যান্ড্রমিডাকে। তাকে দানবের হাত থেকে বাঁচায় পার্সিয়াস — গ্রীক মিথের অন্যতম হিরো।
রূপকথার এ নগরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে এসব খেলে গেল মাথার ভেতরে। রোমহর্ষক ব্যাপার! আধুনিক কালে ফিরিয়ে আনল মোটে চৌদ্দশ বছরের পুরনো আযানের ধ্বনি। মাগরিবের পরে দেখা গেল বহু আরব মুসলিম নরনারী — অনেকে আবায়া পরে — সাগরতীরে হাওয়া খাচ্ছে, সেলফি তুলছে। এসইউভির নাম্বারপ্লেট ওয়েস্ট ব্যাংকের। কে বলবে মোটে এক ঘন্টার রাস্তার ওপারে পবিত্র ভূমি নিয়ে এরা এবং এদের প্রতিবেশীরা বাস করছে অনিশ্চয়তার অন্য এক জগতে?
“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।
অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।
অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।
এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।
মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।
তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।
নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।
আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।
চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।
পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।
৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।
৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।
তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।
আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।
অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।
তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।
কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।
মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।
এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।
তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।
কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।
একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।
বিভিন্ন কালচারে প্রাচীনকালে নরবলির প্রথা চালু ছিল। এ নিয়ে একটু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে চাই। এর থেকে পাঠক ইতিহাসের ‘অপরাধ’গুলিকে ‘ফাস্ট ফুড’ স্টাইলে মূল্যায়নের আগে ভালভাবে সেগুলির পরিস্থিতি যাচাই করার ব্যাপারে একটু শিক্ষালাভ করতে পারেন।
অনেক ধর্মে এখনো পশুবলির প্রথা আছে। ইসলামে গবাদিপশু কোরবানীকে আধুনিকচিত্তের অনেক মানুষ দেখেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসাবে। মনে রাখা দরকার, ইসলামে পশু কোরবানীর লক্ষ্য শুধুমাত্র খাদ্য নয়, বরং নিজের প্রিয় কোন প্রাণীকে নিজ স্বত্ত্ব পরিত্যাগ করে, মায়া ভুলে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা।
হ্যাঁ, আজকের মূল্যবোধের হিসাবে এটা অমানবিক হতে পারে। কারণ আমাদের গোয়াল থাকলে গোয়ালে এখন হাজারো পশু, আলাদা করে একটা প্রিয় পশু সেরকম আর নেই। আর গোয়াল যাদের নেই, তাদের আর পশুর প্রতি মায়াই জন্মাবে কোত্থেকে! অর্থাৎ আসল উপলক্ষ্য থেকে কোরবানীর ব্যাপারটা অনেক দূরে চলে এসেছে, শুধু হয়ে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতা।
তাবৎ হিউমেইন সোসাইটি সদস্যদের এ ভেবে একটু বাস্তববাদী হওয়াটা বোধহয় দরকার যে, যখন পশুবলি প্রথা ইসলাম, খ্রীষ্টান আর ইহুদীধর্মের কুলপিতা ইব্রাহিম বা এব্রাহাম চালু করছেন, তখন তিনি যে প্রাচীন রীতিটার সংস্কারসাধন করছেন সে হল নরবলি! This triggers the tooltipইসমাঈল হোন কিংবা আইজ়্যাক, তিনি নিজেই রাজি ছিলেন এতে, কিন্তু বেঁচে গেলেন ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে এক মেষ দিয়ে স্থানান্তরিত করার কারণে।
এ রূপকথা নয়! জাতিগত স্মৃতির অবশেষ রয়ে গেছে শিক্ষামূলক ‘কিংবদন্তীর’ মধ্যে। ইহুদী ধর্মের সবচে’ বড় সংস্কার হয়েছিল সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নবী দ্বিতীয় ইসাইয়ার আমলে। এসব লেজেন্ডের তখনই উৎপত্তি ‘নতুন’ মূল্যবোধের জাস্টিফিকেশন হিসাবে। সেসময়েই ইহুদীদের ‘ইহুদী’ হয়ে ওঠা। এর পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠীকে ইহুদী না বলে হিব্রু বলা সমীচীন। হিব্রুদের রাজ্যে নরবলি চালু ছিল, আর তাদের রাজারা নিজেদের সন্তানকেই তাদের দেবের উদ্দেশ্যে অগ্নিআহুতি দিত গেহেন্না বলে এক উপত্যকায় — পরবর্তীতে অভিশপ্ত ঘোষিত এই উপত্যকার নাম আর আরবী জাহান্নাম একই শব্দ।
তো এ ধরনের বলিদান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসেই নেই, কালীসাধনার পাঁঠাবলির মূল নরবলিতে। প্রাচীন মিশর, গ্রীসেও একই জিনিস ছিল। আমেরিকাতে তো এই সেদিন, পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দেও অ্যাজ়টেক, মায়া আর অন্যান্যরা পিরামিডের শীর্ষ থেকে মনুষ্যরক্তের বন্যা নামিয়ে দিত।
ফাস্টফুড ইতিহাসবিদরা দ্রুত দেখেশুনে ড্রাইভবাই শুটিং করে যাবেন: ওরা ছিল বর্বর, অনুন্নত; কিংবা তারা ছিল ধর্মান্ধ, সাধারণের সুযোগ নেয়া রাজা আর হুজুরের দল।
কয়েকটা সিম্পল প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে আমার আর্জি: কেন নরবলির সময় বহুক্ষেত্রে শিশুদের বেঁছে নেয়া হত, মানুষ কি এতই অমানুষ? আবার সেসব শিশুর বেশিরভাগই রাজ্যপালের বা পুরোহিতের সন্তান? অ্যাজ়টেকরা হয়ত যুদ্ধবন্দীদের মারত। কিন্তু তাদের না মেরে দাস বানিয়ে গতরখাঁটা কাজ করালেই তো তাদের আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হত।
বুঝতে হলে আপনাকে বহুদিন ধরে বহু দিক থেকে লেখা বহু ইতিহাস পড়ে একটা পরিপূর্ণ কম্প্রেহেনশন আনতে হবে। অথবা অন্ততপক্ষে অবজ়ার্ভার হিসাবে নিজেকে চিন্তা না করে ভাবুন আপনি সে আমলের একজন মানুষ। ভাবুন আপনার দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলি কি হতে পারে, সারভাইভালের জন্য আপনার কী কী দরকার। এ যুগে এধরনের কল্পনা খুব কঠিন কাজ, কারণ আমরা একটা কমপ্লেসেন্ট জেনারেশন — খাদ্য, পোশাক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অ্যাক্সেস, টেক, কোন কিছুর অভাব নেই, আছে উদ্বৃত্ত! তাই আমাদের বাঁধে না নিজেদের মাপকাঠিতে অন্য দেশ-কাল-কালচারের বিচার বসাতে।
আমি একটু চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা। প্রাচীন মানুষ হিসাবে আপনি হতে পারেন পঞ্চাশ থেকে একশ’ মানুষের ছোটখাট একটা দলের নেতা। জাতিদেশের কনসেপ্ট তখনও শুরু হয়নি। জীবিকানির্বাহ হয় শিকার করে, নয়ত প্রাথমিকস্তরের কৃষিকার্য করে। প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। হয়ত পাঁচটা বছর ভাল শিকার জুটলো বা ফলন হলো, তারপর শুরু হলো মন্দা।
খাবার রেশনিং শুরু হলো। কিন্তু পরের বছরও মন্দা। কোনরকমে টেনেটুনে চলছে। কিন্তু জনতা ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আপনার কাছে বা পুরাহিতের কাছে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই — কেন এমন হচ্ছে। বিজ্ঞানের ব’ও জানা নেই । প্রথম যেটা মনে হতে পারে যে প্রকৃতির কোন দৈবশক্তি আপনার বা আপনার গোত্রের ওপর ক্রোধান্বিত। সুতরাং সেই দেবের ক্রোধপ্রশমন করতে হবে। আপনার বউ রাগলে আপনি কী করেন? ফুলের গোঁছা? জুয়েলরি গিফ্ট? হয়ত একটা ডিনার? অর্থাৎ একটা কিছু উৎসর্গ করা দরকার শক্তিমান দেবতার উদ্দেশ্যে।
উৎসর্গ করার জন্যে সবচে’ কার্যকরী যার মধ্যে আপনার অ্যাটাচমেন্ট আছে। বস্তুগত অনুরক্তি নয়, আত্মিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হবে আপনার সন্তান। সন্তান আপনার ভবিষ্যতের বীজ নয় শুধু, সে বড় হলে গোত্রের কর্মক্ষম একজন ব্যক্তিও হবে। গোত্রপ্রধান হিসাবে আপনার প্রভাব আরো বাড়াবে। কিন্তু বর্তমানের অকালটাকে না অতিক্রম করতে পারলে সন্তানসহ গোত্রের বাকি সবাই না খেয়ে মরবেন। এ কথা হয়ত পুরোহিত শুধু বানিয়ে বানিয়ে বলছে না, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। আর অন্যকোন বেটার এক্সপ্লেনেশন তার বা আপনার কাছে নেই। গোত্রের বাকি সবার কাছে আইডিয়াটা উপস্থাপন করার পর নব্বইজন সায় দিল, দশজন দিল না। কী করবেন আপনি?
আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি পরিস্থিতিটা। প্রস্তরযুগের শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্যে সারভাইভ্যালটা এমনি ছিল। ব্রোঞ্জযুগে নতুন টেকনোলজির কারণে আরেকটু ভাল অবস্থায় আসে মানুষ। তারপরও সেরেমোনিয়াল রিলিজিয়াস স্যাক্রিফাইস চলত, কারণ বাপদাদারা করে এসেছে। লৌহযুগে এসে যখন মানবসভ্যতা উপনীত হলো, তখন তাদের কৃষিকাজের লাঙলসহ নতুন নতুন যন্ত্র বেরিয়েছে, শিকারের বহুরকম অস্ত্র। প্রকৃতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। ইসাইয়ার মত সংস্কার তখন অনেক কালচারেই হয়, এবং নরবলি স্থানান্তরিত হয় পশুবলি দ্বারা।
যেকোন প্রাচীন মূল্যবোধকে মূল্যায়নের পরীক্ষা হলো, Did it sound like the only, not just a, good idea at the time? And did everyone else think so?
নতুন মূল্যবোধও একইভাবে এস্ট্যাবলিশ হয়। যারা জোর করে সব সনাতন প্রথাকে বন্ধ করে দিতে চান, আশা করি তারা এটা কনসিডার করবেন!
ইজ়রায়েলের সর্বকালের সবচে’ জনপ্রিয় শিল্পী ওফ়রা হাজ়া গাইছেন এই গানটা। ১৯৭৮এর টিভি সম্প্রচারের ভিডিও এটা। গানটার ১৯৮৪এর ভার্শন পরে ইউরোপ-আমেরিকার চার্টে প্রথম স্থানে ছিল। এই রেকর্ডিংএর সময় ওফ়রা ২১ বছরের তরুণী, কিন্তু ১৯ বছরেই তিনি খ্যাতি কুড়নো শুরু করেন। পরে ইজ়রায়েলের হয়ে ইউরোভিশন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেন। যেসব বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে একসাথে গান করেছেন, তাদের মধ্যে নুসরাত ফতেহ আলী খানও আছেন।
ওফ়রা হাজ়ার ছোটবেলা কেটেছিল তেল আবিবের হাতিকভ়া নামের এক বস্তিতে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ইয়েমেন থেকে আসা কপর্দকশূন্য রেফ্যুজি। সপ্তদশ শতকের ইয়েমেনী কবি সালাম শাবাজ়ির লেখা কবিতায় সুর করা এই গানটা গাইছেন হাতিকভ়ার মিউজ়িক ওয়ার্কশপের সাথে। দলটা তৈরি হয়েছিল তাঁদের মহল্লার গরীব ছেলেমেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুযোগ দেয়ার জন্য।
লঘুচিত্তে গাওয়া এই গানটার বিষয়বস্তু নির্ধনের প্রতি স্রষ্টার মমতার গুণকীর্তন। “যদি ন্যায়পরায়ণের দানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তবে মনে রেখো স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত।” আর খোদার কাছে অনুনয় করা হচ্ছে তাঁকে ‘এল হা’ঈ’ নামে ডেকে, যেটা মুসলিমদের কাছেও স্রষ্টার নিরানব্বই নামের একটা। সপ্তদশ শতকে মধ্যমপন্থী সুন্নি ওসমানী তুর্কীদের সাহায্য করার সন্দেহে ইয়েমেনের জ়াইদী শিয়া বংশীয় ইমাম বা শাসক শাবাজ়ি আর তাঁর ইয়েমেনী ইহুদী গোত্রকে মাওজ়া বলে এক মরুএলাকায় নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তাদের এক-পঞ্চমাংশ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। স্বগোত্রকে সাহস আর আশা যোগানোর জন্যে শাবাজ়ির এ কাব্য রচনা।
গরীবের প্রতি যেমন ইসলামে জ়াকাত দেয়া কর্তব্য, ইহুদী ধর্মেও সেরকমটা আছে। ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের আয়ের এক-দশমাংশ দান-খয়রাতে দিয়ে দেবার নিয়ম কোন কোন তরিকায়। হিব্রু ভাষায় এই বাধ্যতামূলক নিয়মকে বলে স়দাকা, যেটা ইসলামে ঐচ্ছিক দানক্রিয়ারও নাম। ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম মনীষী ইহুদী ধর্মসংস্কারক মুসা বিন মাইমুনের তরিকায় আট শ্রেণীর মধ্যে প্রথম সারির স়দাকা হলো, সত্যিকারের অভাবী কাউকে অনুদান বা সুদহীন ঋণ দেয়া, বিশেষ করে যদি সে অর্থটাকে নিজের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের কাজে লাগায়। আর তাঁর নিয়মাবলীতে ধনী-গরীব সবারই কিছু পরিমাণ দান-খয়রাত করা বাধ্যতামূলক।
বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্রতাকে দেখা হয় স্বর্গীয় গুণ হিসাবে। যে কারণে সন্ন্যাসব্রত নেয়ার একটা ঐতিহ্য তাদের আছে। ইহুদীধর্মে তেমনটা নেই। গরীবদের দয়া করার কথা বলা হলেও ধর্মীয়ভাবে ছোটবেলা থেকে ইহুদীদের এটাই শেখানো হয় যে স্বেচ্ছায় দরিদ্র-পরনির্ভর হওয়া অবাঞ্ছনীয়, সবার উচিত নিজের সাধ্যমত কারিগরি কাজ শিখে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি করা। কারণ আব্রাহাম, জেকব, সলোমন, আইজ়্যাক — ইহুদী ঐতিহ্যে এ সকল নবীই স্বনির্ভর ছিলেন। হয়ত এই মানসিকতার কারণেই পৃথিবীর ইহুদী জনসংখ্যার একটা বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।
সুদখোর ইহুদীর যে স্টেরেওটাইপটা সুপরিচিত, সেটা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত, আর সেটা মুসলিম বিশ্ব নয়, এসেছে পশ্চিমাবিশ্ব থেকে — শেক্সপীয়ারের শাইলক দ্রষ্টব্য। ধনী ইহুদীদের মধ্যে রথ্সচাইল্ড পরিবার সুপরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন রকাফেলার, কার্নেগী, জেপি মর্গান, এরাও ইহুদী ছিলেন — সে ধারণা ভুল। আর দারিদ্র্য থেকে ইহুদীরাও মুক্ত নয়। আল্ট্রা-কনজ়ার্ভেটিভ ইহুদী অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক স্টেটের কিরিয়াস জোয়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে’ গরীব শহর।
ইয়েমেনে ইহুদীদের বসবাস ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে, তারা ঈশ্বরকে ডাকত রহমান নামে, তাদের ধর্মীয় আচারব্যবস্থাও ছিল অন্য এলাকার ইহুদীদের থেকে স্বতন্ত্র। তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দ থেকে ষষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রীষ্টান বিজ়্যান্টাইন সাম্রাজ্য আর আহুরা-মাজ়দার উপাসক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্যের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে, তাতে ইয়েমেনের খ্রীষ্টান আরব আর ইহুদীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে। জ়ু নুওয়াস বলে ইয়েমেনের হিমইয়ার রাজ্যের এক ইহুদী রাজা ইসলামের আবির্ভাবের একশ’ বছর আগে খ্রীষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালান। তাদেরকে ইহুদীধর্মগ্রহণ অথবা মৃত্যু বেছে নিতে বাধ্য করেন, আর যারা ধর্মান্তরিত হয়নি, তাদেরকে চার্চের মধ্যে আটকে রেখে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। সে অত্যাচার থেকে খ্রীষ্টানরা রক্ষা পায় আবিসিনিয়ার খ্রীষ্টান আক্সুম সাম্রাজ্যের সামরিক হস্তক্ষেপে। কিন্তু সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইয়েমেনী ইহুদীদের করতে হয়েছে অধুনাকাল পর্যন্ত।
এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামে ইহুদীদের স্বাধিকার দেবার বিরুদ্ধে কোন নিয়ম নেই। খ্রীষ্টানদের মত তাদেরকে ‘আহলাল কিতাব’ বা খোদাপ্রদত্ত পুস্তকের অনুসারী হিসাবে যথোপযুক্ত ধর্মীয় অধিকার দেয়া আর তাদের সম্পত্তি রক্ষার কথা বলা আছে। হিজরতের পরে মদিনাসনদ বলে একটা চুক্তিনামায় সকলপক্ষের সহমতে এ সকল গ্যারান্টি দেয়া হয়। তাতে একটা রাষ্ট্রেরও গঠনতন্ত্র রূপ পায়, যার সকল সদস্যকে ধর্মগোত্রনির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট অধিকার দেয়া হয়। পরে চুক্তিভঙ্গের কারণে তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্রকে তখনকার সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হয়। তারপরেও অন্যান্য ইহুদীগোত্র মদিনায় মুসলিমদের সাথে দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল পর্যন্ত সহাবস্থান করেছে। অন্যধর্মাবলম্বীদের মত জিজ়িয়া কর তাদের দিতে হত, কিন্তু মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জ়াকাত কর তাদের জন্যে ছিল মওকুফ।
হাজার বছরের বেশি ধরে মুসলিম-ইহুদীরা একসাথে বসবাস করেছে, এটাই স্বাভাবিক যে সে ইতিহাস মিশ্র। মুসলিম রাজ্যগুলি তাদের ইহুদী প্রজাদের সাথে কিরকম আচরণ করেছে, সেটা নির্ভর করে কোন গোত্র-বংশ-ধর্মীয় গ্রুপ ক্ষমতায় ছিল তার ওপর। স্পেনের গ্রানাদাতে একবার যেমন ইহুদীদের ওপর গণহত্যা চলেছে, আবার সেরকমই কোন দূরদর্শী রাজা সেখানে তাদেরকে মুসলিমদের সমান অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগে নিঃসন্দেহে ইউরোপের খ্রীষ্টান রাজ্যগুলির থেকে মুসলিম রাজ্যে ইহুদীরা নিরাপত্তা বেশি পেত। ওসমানী সাম্রাজ্যেও ইহুদীরা যথেষ্ট ইন্টেগ্রেটেড ছিল, শাসন আর করব্যবস্থায় তাদের অনেক অবদান ছিল।
এখন আবারও মুসলিম সমাজ একটা ইহুদীবিদ্বেষী ফেইজ়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কারণ দু’টো। এক, ঊনবিংশ-বিংশ শতকে ইহুদীবিদ্বেষী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির কলোনিতে ইউরোপীয়দেরই প্রভাবে গুজব-ভুল ধারণার বিস্তার ঘটেছে বেশি। সেটা তুঙ্গে উঠেছিল নাৎসিদের ছড়ানো প্রপ্যাগান্ডার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ইজ়রায়েলের আবির্ভাব, আর তার বিরুদ্ধে আরবদের তিনটা যুদ্ধ (খেয়াল করুন, এখনকার ইজ়রায়েলের প্রাণের শত্রু ইরান সেগুলির কোনটাতেই অংশ নেয়নি)। সেই রাজনীতির মধ্যে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে তিরিশ-চল্লিশের দশকে মিশর, লিবিয়া, ইরাক, আর ইয়েমেনে এসবের প্রভাবে কয়েকটি মুসলিম-ইহুদী দাঙ্গা হয়েছে, দু’পক্ষেই বহু ক্ষয়ক্ষতি-মৃত্যু ঘটেছে।
ইয়েমেনে দীর্ঘকালের জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার ইহুদীরা ১৯৪৭এর ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিন বিভাজনের জাতিসংঘ রেজ়োল্যুশনের পরে আরেকবার আক্রান্ত হয়। তাদের ধর্মালয়-বিদ্যালয়-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয় মুসলিম মব্। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বদলে আদেনের মুসলিম পুলিশই লুটতরাজে যোগ দেয়। দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় দু’শ মানুষ প্রাণ হারায়।
অতঃপর শেষবারের মত ইয়েমেনী ইহুদীরা নিঃস্ব হয় ১৯৪৯/৫০এ অপারেশন ম্যাজিক কার্পেটের সময়। সেটা ছিল ইজ়রায়েলের জুয়িশ এজেন্সীর একটা অপারেশন, যার মাধ্যমে এরিত্রিয়া, সাউদি, জিবুতি, ইয়েমেন আর ব্রিটিশ আদেন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে গোপনে আকাশপথে ইজ়রায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এদের বেশিরভাগই দূর-দূরান্ত থেকে স্থাবর সম্পত্তি জমিজমা ছেড়ে আদেনে এসে প্লেনে উঠে পড়ে। তাদের স্থিরচিত্র ইন্টারনেটে আছে, আর সেগুলি দেখে আমার মধ্যে মানবিক সহানুভূতি জাগ্রত হয়, কারণ আমার পিতৃপুরুষও রেফ্যুজি হিসাবে জমিজমা ছেড়ে প্লেনে চড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।
ওফ়রা হাজ়ার বাবা-মাও এভাবে ম্যাজিক কার্পেটে করে ইজ়রায়েলে এসে পড়েন। সেখানে পৌঁছে কিন্তু ইয়েমেনী ইহুদীরা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তাদের স্বকীয় ধর্মীয় পরিচয় খুইয়ে বসেছিল, সেটা একটা আয়রনি! এখন মধ্যপ্রাচ্যের তুরস্ক আর ইরানে কয়েক হাজার বাদ দিলে ইজ়রায়েল ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন ইহুদী জনসংখ্যা নেই।
ও আরেকটা ব্যাপার… এই গানটা ১৯৭৮এ গাওয়া। এসময় একটা বড় আশা নিয়ে ইজ়রায়েল-মিশর দু’দেশের মানুষই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ১৯৭৭এ সারা আরব বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাত ইজ়রায়েলে এসে প্রেসিডেন্ট মেনাহিম বেগিনের সাথে দেখা করেন। ১৯৭৮এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিশরকে ইজ়রায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকরা সিনাই উপদ্বীপের বিশাল ভূখন্ড ফেরত দিয়ে দেয় (গাজ়া বাদে)। কিন্তু দু’দেশেরই কট্টরপন্থীরা একে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ফলশ্রুতিতে সাদাতকে ১৯৮১তে নিজের জীবন দিয়ে তার মাশুল দিতে হয়।
এই গানটা ভাল লাগলে একই সময়ে ধারণকৃত নেশিকোত বায়াম বলে হাজ়ার আরবী-হিব্রু গানটাও শুনে দেখুন! ইম নিন আ’লু গানটার কথা আর অনুবাদ আছে এখানে।
১৮৮১ সালের কথা। রাশিয়ার ৎসার তখন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। এই সম্রাট ১৮৬১তে রুশদেশে ভূমিদাসপ্রথা বিলুপ্ত করার আদেশ জারি করেছিলেন। এ ছিল আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদের মত যুগান্তকারী ঘটনা, যদিও এই সংস্কার ছিল ‘উপর থেকে চাপানো’। গ্রামের চাষারা জমির আর সম্পত্তির মালিকানার অধিকার পেলো ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে কপালে জুটলো করপ্রদানের দায়িত্ব। অনেকে মুক্তি পেয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমালো শহরের দিকে। রুশ শৈল্পিক বিপ্লবের হাওয়ায় তারা বনে গেল শ্রমিক-মজুর। নব্য শিল্পপতিরা তাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ নেয়া শুরু করলো। ফলপ্রসূ চাষাদের পরবর্তী প্রজন্মের নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্ররা গোপন বিপ্লবী সংগঠনে অংশ নেয়া শুরু করলো। আলেকজান্ডার প্রথমদিকে কিছুটা সংস্কার করলেও সাধারণ জনগণকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দিতে ছিলেন চরম নারাজ। ১৮৮১ সালে তাঁকে তার মাসুল দিতে হলো নারোদনায়া ভোলিয়া (জনতার সংকল্প) নামের গুপ্ত সংগঠনের আততায়ীর বোমায় নিহত হয়ে।
প্রতিশোধস্বরূপ গুপ্ত সংস্থাগুলির নেতাদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, এদের একজনমাত্র ছিল ইহুদী। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো, বাদবাকি জনগণের মনোযোগ আততায়ীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে সংখ্যালঘু ইহুদিদের বিরুদ্ধে জনমনে ঘৃণা আর সন্দেহ ছড়ানো শুরু হলো। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে গ্রামছাড়া করলো তাদেরই শতবছরের পড়শী রাশিয়ার সংখ্যাগুরু অর্থডক্স খ্রীষ্টান স্লাভ জাতির মানুষেরা। অনেকে রুশদেশ ছেড়ে মার্কিনে পাড়ি জমায়, আর একটা ছোট অংশ — যারা হয়ত একটু বেশি ধার্মিক — তারা এসে হাজির হয়ে যায় তুর্কী ওসমানলি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত প্যালেস্টাইন প্রদেশে। প্যালেস্টাইনে তখন সেফার্দী মাজহাবের যে ইহুদীরা ছিল তারা আরবীতেই কথা বলতো, পোশাক-আশাকও ছিল তুর্কীদের মতই। রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের আশকেনাজি মাজহাবের ইহুদীরা তুরস্কের সেকেলে অভিবাসন আইনের সুযোগ নিয়ে জমিজমা কিনে থিতু হয়ে বসল। ইহুদিদের সংখ্যা এইভাবে রাতারাতি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও সেসময় তারা তাদের আরব বেদুঈন পড়শীদের সাথে মোটামুটি শান্তিতেই বসবাস করত।
যাই হোক, তার পরে আরো অনেক জল গড়িয়ে গেছে, সে সবারই জানা। আমার উদ্দেশ্য ছিল নিচের ভিডিওটির একটা যথোপযুক্ত ভূমিকা দেয়া। এটি নেয়া হয়েছে ১৯৭১ সালের হিট মিউজিক্যাল ‘ফিডলার অন দ্য রুফ’ থেকে। কাহিনীর মূলচরিত্র তেভিয়ে ১৮৮০এর সময়কার রুশদেশের একটা ছোট গ্রাম আনাতিয়েফকার ইহুদী বাসিন্দা। তাদের পাশাপাশি স্লাভ রুশ অর্থডক্স খ্রীষ্টানদেরও বসবাস। তেভিয়ে একটা পানশালায় গেছে লেজার উল্ফ নামে এক বুড়ো কসাইয়ের সাথে। তেভিয়ে তার বড় মেয়ে ৎসাইতেলের মতামত না নিয়েই লেজার উল্ফের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে ফেলেছে, এই ভেবে যে পাত্র বয়স্ক হলেও কসাইব্যবসার পয়সায় কন্যা সুখে থাকবে। (আসলে কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, সেটাও মজার কাহিনী! জানতে হলে মুভিটা দেখুন — ইউটিউবে আছে।)
লেজার উল্ফ আনন্দের আতিশয্যে পানশালার সবাইকে শ্ন্যাপস খাওয়াচ্ছে, আর সবাই মিলে গান ধরেছে ল্যখাইম — যার অর্থ ‘জীবনের উদ্দেশ্যে’, জীবনে সুখ-দুঃখ যাই আসুক না কেন সবই জলীয়পান করে আনন্দ-উদযাপনের উপযুক্ত। ইহুদীদের নাচগানে বাগড়া দিলো পানশালার উল্টোপ্রান্তে জটলাবাধা রুশ কৃষকের দল। তারা নতুন যুগলের শুভকামনায় বালালাইকার সুরে গান আর কসাক নৃত্য শুরু করে দিল। নাচতে নাচতে দু’দলে ঠোকাঠুকি! সেই দৃশ্যের সন্দেহ আর সাবধানতা ভারি করে তুলেছে পানশালার বাতাস। রুশ চাষা বাউ করে তেভিয়েকে নিমন্ত্রণ করলো একত্রে নাচার জন্যে। কিন্তু ইহুদীদের যে খোদা ছাড়া কারো সামনে মাথানত করা নিষেধ! তেভিয়ে পাল্টা বাউ করলো ঠিকই, কিন্তু একটু তেরচা করে, যেন রুশী তার সরাসরি সামনে না পড়ে। অতঃপর বাড়ানো হাতটা লুফে নিলো, আর দু’দলে মিলে একাত্ম হয়ে গেল নাচতে নাচতে!
পুরো মিউজিক্যালটা দেখার মতো! তেভিয়েদের ট্র্যাডিশন্যাল সামাজিক-পারিবারিক আচার আর তাদের রাজনৈতিক অবস্থা কত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সেটি আমাদের দেশ-সমাজ-ধর্মীয় পরিচয়ের বিবর্তনেরই যেন একটা প্রতিচ্ছবি। আর তার মধ্যে এই গানটা আমার প্রিয় সঙ্গত কারণেই!