স্বদেশে পরদেশী উইগুর

Featured Video Play Icon

আজ যে জাতির সঙ্গীত নিয়ে লিখছি, তারা যে কয়েক দশক ধরে নিপীড়িত হচ্ছে, এটা মনে হয় বাকি পৃথিবী ভুলে যেতে বসেছে। গানটা যে ‌অ্যালবাম থেকে নেয়া, তার নাম ‘লিসেন টু দ্য ব্যানড’ — এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে যেসব শিল্পীদের গান নিষিদ্ধ, তাদের নিয়ে এটা করা। গানটার ভাষা উইগুর, দুতারনামক বাদ্যযন্ত্রবাদক গায়কের  নাম কুরাশ সুলতান। তিনি ২০০৬ সালে সুইডেনে নির্বাসনে প্রয়াত হয়েছেন।

উইগুররা চীনের উত্তরপশ্চিমের শ়িনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজিয়নের বাসিন্দা। তাদের খবরাখবর বহির্বিশ্বে খুবই কম পাবেন, বিশেষ করে ২০০৯এর হান-উইগুর দাঙ্গার পর। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বাইরে থেকে কোন সাংবাদিক সেখানে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখে, বেশির ভাগ সময় ঢুকতে দেয় না, আবার নেটিভদের সাথে বেশি মেলামেশা করলে তাদেরকে এস্কর্ট করে প্রদেশের বাইরে বের করে দেয়। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানকার সত্য খবর রিপোর্ট করে। প্রাদেশিক সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারেরই সাজানো, যতই তারা স্বায়ত্তশাসিত বলে নিজেদের দাবি করুক। এরকম আরো দুটো এলাকা আছে চীনে — তিব্বতকে সবাই চিনে দালাই লামার খাতিরে, আরেকটা নেই মেংগু বা ইনার মংগোলিয়া

উইগুরদের ইতিহাসটাও খুব চমকপ্রদ। এরা আসলে তুর্কী জাতি। তুর্কীরা তুরস্কে ঘাঁটি গাঁড়ার আগে ছিল মোঙ্গলদের পড়শি, আর তাদের মতই গরু-ভেড়া-চড়ানো যাযাবর গোষ্ঠী। মোঙ্গল, তিব্বতী, পারসিক আর চৈনিক রাজ্য দিয়ে চারিদিক ঘেরা তুর্কীরা মোঙ্গলদেরও আগে একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছিল, যার নাম গোকতুর্ক। এরা উপাসনা করত তেংরি বলে এক আকাশদেবতার, মোঙ্গলদের মতই। এদের নয়টি ট্রাইব দোকুজ়-ওগুজ়দের একটা উইগুররা। উইগুরদের তুতো ভাইয়েরা আরো পশ্চিমে গিয়ে সফল সাম্রাজ্য গড়েছে, আর উইগুররা ছিল সিল্ক রোডের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাকলা-মাকান মরুভূমি আর তিয়ানশান পর্বতমালার রক্ষক। কুবলাই খানের কজ়মোপলিটান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরকারে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্য তুর্কী জাতের শত্রুদের বিরুদ্ধে এরা  চীনের প্রতাপশালী সুই সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। বাঙ্গালীদের মত উইগুররাও একেক সময় একেক ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমে অ্যানিমিস্ট থাকলেও, পরে মানিকেয়ান হয়েছে, বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ করেছে, নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টানও ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছে মুসলিম। এখনও অনেক উইগুর ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু প্রাচীন নিয়মকানুনের ছায়া রয়ে গেছে।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার অনুন্নত-বিভক্ত-পশ্চাদপর খানশাসিত ছোট ছোট পারসিক-তুর্কী রাজ্যগুলিকে রাশিয়ার রোমানভ় সাম্রাজ্য আর চীনের চ়িং সাম্রাজ্য একের পর এক দখল করে করদ রাজ্য অথবা উপনিবেশ বানানো শুরু করে। উইগুরদের দেশ এসময় চ়িংদের আয়ত্ত্বে আসে। এসময় করদরাজ্য হিসাবে আর দূরত্বের কারণে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রার উপর চীনাদের প্রভাব খুব কমই ছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে চীনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রুশ কম্যুনিস্ট সরকারের প্ররোচনায় ১৯৩৩ আর ১৯৪৪এ দু’বার তারা স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিলেও প্রথমটা কয়েক মাস আর দ্বিতীয়টা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯৪৯এ রুশসমর্থিত দ্বিতীয় স্বাধীন তুর্কেস্তান সরকারের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদেরই ষড়যন্ত্রে প্লেনক্র্যাশে মারা যাওয়ার পর শেষ কম্যুনিস্ট সদস্য মাওৎসেতুংএর কাছে রাজাকারি করে রাজ্য সপে দেয়

এরপর মাওয়ের কালচারাল রেভোল্যুশনের সময় বাকি চীনবাসীদের সাথে সাথে এরাও ভুক্তভোগী হয়েছে। ১৯৪৯এ হানগোষ্ঠীর চীনাদের জনসংখ্যা উইগুরিস্তানে ৬% হলেও সরকারী নীতির কারণে ধীরে ধীরে বেড়ে এখন প্রায় ৪০%। হানরা ব্যবসাবাণিজ্য-চাকরিক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু তারা উইগুরদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে না, সম্মান করে না। স্বভাবতই শ়িনজিয়াং জাতিগত সংঘাতের একটা ঊর্বরক্ষেত্র।

দেং শ়িয়াও পিংএর সংস্কারের আমলে কিছুটা স্বাধিকারচর্চার সুযোগ পেলেও শ়ি জিন পিংএর চাইনিজ় এক্সেপশনালিজ়মের মুখোশপরা চীনা জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসরণের কারণে উইগুররা একটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডারিন না শিখলে তাদের জীবিকা নেই, লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ, মসজিদে অনূর্ধ্ব-আঠারো প্রবেশ নিষেধ, জায়গায়-জায়গায় সারভেইল্যান্স ক্যামেরা বসানো। এমনকি তাদের নিজ দেশের ইতিহাসকেও হানজাতির স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে ইন্জিনিয়ার করা হচ্ছে। অল্প কিছু উইগুর মুক্তির সন্ধানে  কট্টরপন্থী জিহাদী ইসলামে ঝুঁকে পড়েছিল। সেই ভুলের অজুহাতে পুরো জাতটাকে এখন মাশুল গুনতে হচ্ছে। কেউ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামলেই তাদের টেরোরিস্ট তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ‘রিএডুকেশন ক্যাম্পে’ নাকি দশ লাখ উইগুর বন্দী, সেখানে নাকি তাদের জোর করে শুকরের মাংস, অ্যালকোহল খাওয়ানো হয়। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্তের ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি। ইলহাম তোহতী বলে এক অর্থনীতিবিদ উইগুর অনলাইন বলে একটা সাদামাটা ওয়েবসাইট চালাতেন, তাঁর সাথে লাদেনকে জড়িয়ে দিয়ে এখন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে রেখেছে। আবলাজান আইউব বলে এক অরাজনৈতিক জনপ্রিয় পপ গায়ককেও জুনমাসে লাপাত্তা করে দিয়েছে। দালাই লামার মত উইগুরদেরও স্বেচ্ছানির্বাসিত নেত্রী আছেন যার নাম রাবিয়া কাদির, কয়েকবার শান্তির নোবেলের জন্যে মনোনীত হয়েছেন।

ইউটিউবে উইগুর মিউজ়িক সন্ধান করলে অনেক নাচগান দেখবেন, এদের অধিকাংশই শো, বাইরের মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টা যে উইগুররা সুখেশান্তিতে নাচাগানা করে আছে। কামাল আতাতুর্ক একদিকে যেমন সুফী জিকির অবৈধ করেছিলেন, অন্যদিকে দরবেশদের সুফী ঘূর্ণিনৃত্য সমানে চলেছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে — চীন সরকারের এ প্রয়াস তার থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং আরো ভয়ানক কারণ এভাবে উইগুরদের জাতিগত পরিচয়টাকেই তারা ইনজিনিয়ার করে ফেলছে। সোভিয়েতরাও তাদের অনেক সংখ্যালঘু জনসত্ত্বাকে একইভাবে রিডিফাইন করেছিল।

মুসলিম দেশের সরকারগুলি ফিলিস্তিন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও উইগুরদের নিয়ে রহস্যজনকভাবে মৌন থাকে, সম্ভবত চীনের সাথে খাতিরের সম্পর্ক বজিয়ে চলার জন্যে। তুরস্কে অনেক উইগুর নির্বাসনে থাকলেও তুরস্কের সরকারও চুপচাপ, কথা বললেই কুর্দী-আরমেনিয়ানদের পুরনো কংকাল সিন্দুক থেকে বেরিয়ে নাচানাচি করবে। মার্কিন আর ইউরোপিয়ানরাই কিন্তু বছরের পর বছর তিব্বতী-উইগুরদের স্বাধিকারের পক্ষে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। ২০০৮এ একটা গণসংগ্রামের প্রচেষ্টা হলেও ইন্টারনেটে ইনজিনিয়ারড গুজব ছেড়ে চীনারা টেরোরিজ়মের জুজু দেখিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেসময় বাইরে থেকে বিবৃতির বেশি সাহায্য আসেনি। তাই অনেক তরুণ উইগুর স্বাধিকার-সংস্কৃতি-মানবাধিকার ভুলে কষে ম্যান্ডারিন শিখছে। অতএব আপাতত সিপিসি সফল।

গানের ভিডিওটিতে কিছু দৃশ্য ভায়োলেন্ট, ২০০৯এর উরুমচি শহরের দাঙ্গার যেটুকু পাবলিক ভিডিও রেকর্ড আছে তার কিছুটা। বাকি অংশ আগের একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেয়া। ইলহাম তোহতীর একটা হৃদয়ছোঁয়া ইন্টারভিউ পাবেন এখানে

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৫

আমার মতে, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করতে সরকারের থেকে জনগণের ক্ষমতা বেশি। তাদের এই সচেতনতা আসা দরকার যে তারা নিজেরাই ইন্টারনেটে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ছেড়ে দিচ্ছে, আর তারা কি রং পছন্দ বা অপছন্দ করে এধরনের সামান্য তথ্যই হয়ত অ্যানালিটিকার জন্য যথেষ্ট। ফেসবুকগুগলের মত কম্পানিগুলি কিন্তু এখন গ্রাহকদের কি কি তথ্য তাদের কাছে আছে সেটা ডাউনলোড করার সুযোগ দেয়। তা করলেও সে তথ্য কতটুকু গূঢ় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে, সেটা কিন্তু বোঝা সহজ নয়। আর ফেসবুকের সুবিধাগুলি ছেড়ে দিতেও কেউ চায় না। সুতরাং সবচে’ বড় কাজ যেটা করতে পারেন সেটা হলো নিজের মনে বাইরে থেকে কি ঢুকছে তার উপর ফিল্টার বসানো। ফেসবুকে আপনার ফ্রেন্ডের শেয়ার করা পোস্ট, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, টিভিতে যেটাই দেখবেন বা শুনবেন না কেন, পরখ করে দেখবেন আগে যে, কোন একটা খবরের উদ্দেশ্য কি আপনার পিলে চমকে দেয়া? যদি তাই মনে হয়, খবরটা নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন তুলবেন, প্রগতিশীলই হোন, কিংবা রক্ষণশীল। সঠিক প্রশ্ন তুললে সঠিক জবাবের খোঁজ করবেন আর তা খুঁজে পাবেন, আর তখন হয়ত মনে হবে এতে পিলে চমকানোর কিছুই নেই! যদি আপনি গ্রাজুয়েট স্কুলে পড়ে থাকেন, তাহলে জানেন যে একাডেমিক পেপার লিখলে তার কিরকম কড়া রিভিউ হয়। সেরকম রিভিউটা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে, করাটা এখন খুবই দরকারী। আর রাজনৈতিক বা অন্যান্য ব্যাপার যত ইন্টারনেটে শেয়ার করবেন কম, আর সেসবে লাইক যত কম দিবেন, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থাগুলো আপনার ও আপনার সমমনাদের প্রোফাইল করার প্রয়োজনীয় তথ্যও ততটা কম পাবে।

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্যসংগ্রহের মত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেডারেল সরকার অনেক আগে থেকেই নানা পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে ২০১১তে ফেডারেল ট্রেড কমিশন ফেসবুক-গুগলসহ ১১টি কম্পানির কনজিউমার ড্যাটা সংক্রান্ত আচরণ তদন্ত করে এবং অনেক ফাঁকফোকর বের করে। সেসময় এ কম্পানিগুলি প্রাইভেসি জোরদার করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা ঘোষণা করলেও ফেসবুক ভুজুং-ভাজুং প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পেয়ে যায়, কারণ তাদের পয়সাই আসে মানুষের নাড়িনক্ষত্রের খবর আর অ্যাডভার্টাইজিং থেকে। ‘১১র পরে ২০১৩তে যখন এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দেন যে এনএসএ মানুষের ওপর ইন্টারনেটে নজরদারি করে, তখন সিলিকন ভ্যালির কম্পানিগুলি সরকার থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরার চেষ্টা করে। এর ফলে ড্যাটা প্রাইভেসি সংক্রান্ত আলোচনা আর বেশি গঠনমূলক দিকে আগায়নি। সুযোগটা নিয়ে ফেসবুক-গুগলের মত কম্পানিরা আরো পয়সা বানিয়েছে। যাই হোক, এ বছর মার্কিন সরকারের চাপে না হলেও ইউরোপ থেকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কারণে যথেষ্ট চাপ এসেছে এদের ওপর, আর শেয়ারহোল্ডাররাও এদের বিজনেস মডেল নিয়ে সন্দিহান হওয়া শুরু করেছে। ফেসবুকের গত কয়েক সপ্তাহের শেয়ারের দামের পতন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। মার্কিন কংগ্রেস, রবার্ট ম্যুলার আর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে সাথে এদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকছে। এই জল কোথায় গিয়ে গড়ায়, সেটা সময়ই বলে দেবে। এটা মানতেই হবে, ইন্টারনেট দেশসীমাবিহীন একটা মাধ্যম, আর কোন তথ্য হওয়া উচিত গোপনীয়, কোন স্তরের গোপনীয়, আর কি ধরনের রাজনৈতিক ইন্টারনেট প্রোপাগান্ডা বাকস্বাধীনতা পাওয়ার উপযুক্ত, এসব নির্ধারণ করা আর সে ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ঐকমত্যে পৌঁছানো অবশ্যই সময়সাপেক্ষ।

এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। মানুষের গত একশ’ বছরের ইতিহাসে ইন্টারনেট যেমন এসেছে, সেরকম রেডিওও এসেছে, টিভিও বেশিদিন আগে আসেনি। অনেক মানুষ, বিশেষ করে একটু পুরনো প্রজন্মের যারা অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তারা, সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে এখনো খুব বেশি পরিচিত নন। মিলেনিয়ালদের পরে যারা আসবে, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হবে বলে আমার ধারণা।

আরেকটা ব্যাপার স্বীকার করা দরকার। সত্যমিথ্যা বলে ভোটারদের যতটাই ট্রাম্পের দিকে টানা হোক না কেন, ট্রাম্প কিন্তু যথাযথভাবেই গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রতিবাদ-সমাবেশ সমানে চললেও ট্রাম্পকে ষড়যন্ত্র করে কেউ ঠেকায়নি। ট্রাম্পের বিজয় সেদিক থেকে চিন্তা করলে মার্কিন গণতন্ত্রের একটা পরীক্ষিত সাফল্য। কম ব্যবধানে জিতলেও অনেক মানুষই তাকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছে, এবং তার প্রতিপক্ষ সেটা মেনে নিয়েছে। আর ট্রাম্পের আমলে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে যতটা সক্রিয়, সচেতন আর প্রতিবাদী হয়েছে, এটা অনেকদিন এদেশে হয়নি। এদেশের স্বাধীনতাগুলি যে সত্যি সত্যি আছে, তার পরীক্ষা এখনই চলছে, মাঝেমধ্যে এই পরীক্ষাটা জরুরী। ট্রাম্প চাইলেই মানুষের কন্ঠরোধ করতে পারবেন না। এদেশের প্রাইভেট সেক্টর, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, স্টেট ও স্থানীয় সরকার, বিচারালয় — এরা স্বাধীন, শক্তিশালী আর কেউই ট্রাম্পের মুখাপেক্ষী নয়। ট্রাম্প-ব্যাননগোষ্ঠী চাইলেও দেশের সামাজিক মূল্যবোধ আর রাজনৈতিক আলাপচারিতার ধ্যানধারণা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারবে না, এমনকি ইন্টারনেট আর কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা দিয়েও না।

আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা দু’টোই বহুলাংশে গণতান্ত্রিক, আমাদের দেশের মত শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখানো গণতন্ত্রের মত নয়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানুষের জাতীয়তা, মতামত, মূল্যবোধ যেমনটা সমসত্ত্ব, এখানকার মানুষের — এমনকি সাদাদের মধ্যেও — সেরকমটা নয়। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল আর তাদের মাঝখানের সবারই কথা বলার সত্যিকারের স্বাধীনতা আছে। তাদের মধ্যে ইতিহাসের ক্রান্তিকালে বিতর্ক-বিতন্ডা হয়, এদেশে এ নতুন কিছু নয়। এদেশের নতুন অভিবাসীরা সম্ভবত জানেন না, মতপ্রকাশের এ স্বাধীনতা রাখার জন্য আমেরিকা অনেক টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। তাই শুধু সে স্বাধীনতা উপভোগ নয়, সেসবের ইতিহাস আর সমঝোতার কাহিনী আমাদের জানা বিশেষ কর্তব্য। বিশেষ করে ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, সত্তরের দশকে নিক্সনের সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ সমাবেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শান্তিকামী আর বাস্তবতাবাদীদের বিতর্ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর আইসোলেশনিজমের উত্থান, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ — এগুলির মধ্যে অনেক ছোট ছোট জরুরী বৃত্তান্ত আছে যেগুলি হেডলাইনের কারণে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এদেশে সরকার থেকে চাপিয়ে দেয়া সংস্কার কখনো সুখপ্রদভাবে সফল হয়নি; যখন সমাজে আসলেই পরিবর্তন চলে এসেছে, যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীলতার বাঁধা অতিক্রম করেই সেসব নতুন মূল্যবোধ একসময় না একসময় সরকারি বৈধতা পেয়েছে। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্র চলে, দু’পা এগুলে একপা পিছুতে হয়, নতুন ‘সঠিক’ মূল্যবোধ খুঁজে পেতে আর প্রতিস্থাপন করতে সময় লাগে। আজকের মত বিভক্তি ঝগড়াঝাঁটি আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থা এ বিভাজনকে ব্যবহার করলেও এই সৎ ও সমালোচনামূলক বিতর্ক যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য খুবই জরুরী। আর এখনকার খারাপ সময় পার করার পর একসময় না একসময় সামাজিক মূল্যবোধে একটা কনভার্জেন্স আসবে।

যারা বর্ণবাদের উত্থান নিয়ে শংকিত তাদের কিছু আশ্বাস দেই। ট্রাম্পের কারণে ‘১৭র শুরুর দিকে বর্ণবাদী আর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা একটু শোরগোল তুললেও এখন কিন্তু তাদের যারা বেশি কট্টর তারা অনেক ধারায় বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ এমন এক ধরনের মতবাদ যার ‌অনুগামী যত বাড়বে তত তারা নিজেদের মধ্যে মারকাট করবে কার জাত বেশি শুদ্ধ তাই নিয়ে। ট্রাম্পের কারণে এরা যে সাংগঠনিকভাবে একীভূত হয়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিশেষ করে স্টীভ ব্যাননকে সরিয়ে দেয়ার পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে তেমন একটা আতংকিত নই। ট্রাম্পভোটার সাদাদের অনেকের মনের মধ্যে অভিবাসীবিরোধী বা কিঞ্চিৎ বর্ণবাদী মনোভাব দেখলেও আমার হিসাবে তারা সেটাকে উগ্র হিংসাত্মক পর্যায়ে নেয়ার মত মানুষ নয়।

এককভাবে আর গোষ্ঠীগতভাবে যেটা করণীয় সেটা হলো আমাদের যার যার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাধারণ মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলা। শুরুতে মনে হবে তাদের মস্তিষ্ক প্রক্ষালিত। যত বেশি কথা বলবেন, আর রাজনীতি পেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গেও যাবেন, ততই বুঝতে পারবেন এরা কিন্তু আপনার মতই কোন না কোন কারণে ভীত। তাদের ভয়টাকেই আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতারা চাগিয়ে তুলছে, বাড়িয়ে তুলছে, যেমনটা হয়ত আপনার রাজনৈতিক ঘরানা করছে আপনার সাথে। যখন এদের সাধারণ সমর্থকদের সাথে কথা বলবেন, জিজ্ঞেস করবেন তারা ব্যক্তিগতভাবে আসলে কি চায়, দেখবেন যে তারাও চায় আপনার মত একটা ভাল জীবিকা, আবাসস্থল, নিজেদের মত করে জীবনযাপনের স্বাধীনতা আর পরের প্রজন্মের জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ। তারা ভয়ে আছে যে আপনার রাজনৈতিক ঘরানা তাদের এসব চাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আর এ ভয়টাই তাদের পরিচালনা করছে। সেখানে তাদের প্রার্থী নৈতিকতার সীমালংঘন করছেন কিনা তার থেকে বেশি তাকে মূল্যায়ন করা হয় তিনি তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করছেন কিনা তা দিয়ে। কথোপকথনের পরের ধাপে গিয়ে যদি আপনি তাদের সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন, তাদের আস্থা অর্জন করতে পারেন এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে আপনার ব্যক্তিগত চাওয়াটাও মূলত একই আর মতের অমিল থাকলেও বন্ধুত্ব করতে আপনি রাজি, তখন তাদের এবং আপনার নিজেরও ভয়ভীতিগুলি কিছুটা লাঘব হবে, আর অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর পূর্ণচক্র তখনই ভাঙবে। এই কথোপকথনের সময় এখনই! আদর্শবাদ নিয়ে বুলি কপচানোর কিংবা প্রতিপক্ষের ‘পশ্চাদমুখী’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাসাহাসি বা নাক-সিঁটকানোর সময় এখন নয়!

কথোপকথনের মূল বিষয়বস্তু যতদিন থাকবে শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প, ততদিনই প্রগতিশীলতার নামে চলবে অসহিষ্ণুতা আর রক্ষণশীলতার নামে অসাধুতা। আমরা যতক্ষণ না চেষ্টা করব আমাদের ‘প্রতিপক্ষ’কে জানার-বোঝার, তাদের সাথে কথা বলার, ততদিন এই প্রগতিশীল-রক্ষণশীল ভন্ডের দল আমাদেরকে ইন্টারনেট আর টিভির মাধ্যমে আলাদা করে রাখবে, আর বুঝ দেবে যে আমরা একে অপরের শত্রু। যতক্ষণ না আমরা নিজেরা সেই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে সক্ষম হচ্ছি, ততদিন আমাদের ভবিষ্যতে আসতে থাকবে আরো ‘ট্রাম্প’ এবং আরো খারাপ ‘ট্রাম্প’।

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৪

আগের পর্বগুলোতে বলেছি অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর নোংরা পদ্ধতির বৃত্তান্ত। এপর্বে বলবো ২০১৬-এর ব্রেক্সিট নির্বাচন আর মার্কিন সাধারণ নির্বাচনে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর অসত্য প্রচারণার ভূমিকা। আর আগামী পর্বে তাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের করণীয় কি তাই বলে শেষ করব।

উপরের দুই নির্বাচনের আগেই কিন্তু অ্যানালিটিকার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়েছে। পুতিনের রাশিয়াতে এটি পেয়েছে শৈল্পিক রূপ, তার ওপর সেখানে টেলিভিশন-রেডিওও সরকারের (বা পুতিনের নিকটজনের) একচেটিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে, আর ফেসবুকের পরিবর্তে আছে তার ক্লোন ভ্কন্তাক্তিয়ে, যেটা পুতিনের ট্রোলে ভর্তি। তার ফলে আপনারা এমাসেই দেখলেন রুশে পুতিনের ৭৫% ভোটে জয়লাভের নির্বাচন নামের ভং। চীনসরকারও এসব পদ্ধতি ২০০৮-এ তাদের তিব্বত আর শ্শিনজিয়াং-উইগুর প্রদেশের প্রতিবাদ দমাতে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশ, যাদের গণতন্ত্র এদের থেকে বেশি টেকসই আর পরীক্ষিত, ২০১৬তে তাদের ওপরে এসব পদ্ধতি প্রথম সফলতা পায়।

ব্রেক্সিট নির্বাচন হয় ২০১৬র জুনে। তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাবার (বা ব্রেক্সিটের) স্বপক্ষে প্রায় ৫২% ভোট পড়ে, ৭২% ভোটার ভোট দেয়, আর দু’দলে ভোটের তফাত ছিল মোটে ৬লাখ, সাড়ে চার কোটি ভোটের মধ্যে। অর্থাৎ মোটামুটি ১%-এর মধ্যে ফটোফিনিশ। এ নির্বাচনের আগেও দু’দলে বিতর্ক-বিভক্তি হয়েছে অনেক, বিদেশী অভিবাসী-রেফ্যুজি, অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘অন্যায্য’ দাবি-দাওয়া, এসব ছিল হট টপিক। বিশেষজ্ঞরা অনেকভাবেই দেশের মানুষকে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলেন যে এর ফলে যুক্তরাজ্যের যারপরনাই অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্রেক্সিটের স্বপক্ষে ছিল এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসনের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির এক সুবিধাবাদী বিদ্রোহী গ্রুপ, তদ্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন ছিলেন এর বিপক্ষে। আরো স্বপক্ষে ছিল ইউকিপ নামে কট্টর জাতীয়তাবাদী এক পার্টি আর তার নেতা নাইজেল ফারাজ।

ফারাজকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সেই একই ভিলেন রবার্ট মার্সার! তারা ইউকিপকে সাহায্য করে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, কিন্তু তার বিনিময়ে অ্যানালিটিকা নাকি কোন পয়সা নেয়নি। অর্থাৎ এই সার্ভিস ছিল মার্সারের দেয়া ‘উপহার’। যুক্তরাজ্যের আইনে এ অবৈধ, কারণ মার্সার ব্রিটিশ নাগরিক নন। এনিয়ে সেদেশের পার্লামেন্টে এখন তদন্ত চলছে। অপরদিকে বোরিস জনসন গিয়ে ধরেন অ্যাগ্রেগেট আইকিউ বলে এক কানাডিয়ান কম্পানিকে, একই কাজের জন্য। যেটা পরে বেরিয়েছে সেটা হল অ্যাগ্রেগেট আইকিউ হলো গিয়ে কানাডায় কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মাতৃসংস্থা এসসিএলের নাম-ভাঁড়ানো ফ্রন্ট কম্পানি! জনসনের ভোট লীভ প্রচারণীদল তাদের পয়ত্রিশ লাখ পাউন্ড দেয়। দুইদলের মধ্যে নির্বাচনী তহবিল নিয়ে যোগসাজশের সম্ভাবনা আছে, এবং তারা আইনের সীমালংঘন করে বেশি অর্থ খরচ করেছে কিনা পার্লামেন্ট এ নিয়েও তদন্ত করছে।

এপ্রসঙ্গে দু’টো বৃত্তান্ত না বললেই নয়। ইউকিপের ফারাজ মিথ্যা প্রচারণা চালান একটি চটকদার পোস্টারের মাধ্যমে, যেটায় কিছু সংবেদনশীল শ্লোগানের সাথে দেখানো হয় হাজার হাজার আরব-এশিয়ান চেহারার অভিবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ডার ক্রসিংয়ে। এই চিত্র দেখিয়ে ব্রিটেনের যারা খেঁটে খাওয়া মানুষ (যাদের সামান্যসংখ্যকই বর্ণবাদী) তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, এরা ব্রিটেনে ঢুকলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পোস্টার দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ভোটারদের মাইক্রোটার্গেট করা হয়। বোরিস জনসনেরও প্রচারণার অংশ ছিল একটা ডাবলডেকার বাস যার গায়ে লেখা যে ব্রিটেন নাকি ইইউকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড পাঠায়, সে টাকা তাদের এনএইচএস নামের সরকারি গণস্বাস্থ্য প্রকল্পে ব্যয় করলে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার হত। বোরিসের সাথে লন্ডনের গর্বের প্রতীক ডাবলডেকার ব্রিটেনময় ঘুরে বেড়ায়, তার ছবিও ইন্টারনেটে মধ্যবিত্ত ব্রিটিশদের টার্গেট করে ছাড়া হয়।

বলা বাহুল্য দু’টোই মিথ্যাপ্রচারণা। সেই ‘অভিবাসীচিত্র’ আসলে ছিলো ক্রোয়েশিয়া-স্লোভেনিয়া বর্ডারে শরণার্থীশিবিরের ছবি, যারা দাতব্য সংস্থা ও জাতিসংঘের অর্থসাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আর ইইউকে ব্রিটেন যত টাকা পাঠায় তার থেকে বেশি অংকের সুবিধা তাদের থেকে পায়, অর্থের আকারে না হলেও। যথারীতি মানুষের মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিটের স্বপক্ষদল কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের সাহায্যে অবিশ্বাস্যজনকভাবে জিতে যায়।

ট্রাম্পের বিজয় ছিল সেরকমই অবিশ্বাস্যকর। বলছি কিভাবে সে কাহিনী অন্যরকম হতে পারত, তার আগে বলি কেম্ব্রিজ অ্যানালাটিকার সম্পর্ক। ট্রাম্পের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করে অ্যানালিটিকা। ট্রাম্পের সাথে কাজ শুরু করার আগেই তাদের নেটওয়ার্ক ১৭টি স্টেটে বিস্তৃত ছিল। রিপাবলিকান প্রাইমারির পরে তারা এই নেটওয়ার্ক আরো বাড়ায় আর ট্রাম্পের পক্ষে অনলাইন অ্যাডভার্টাইজিং করে, ফেসবুক-টুইটারে ফেক প্রোফাইল দিয়ে সম্ভাব্য ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেকসময় পার্সোন্যাল মেসেজও পাঠায়। পুতিনের রুশ ট্রোলরাও একই ভাবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে। ‌অ্যানালিটিকার কর্মকর্তারা প্রায়শই গর্ব করে বলেছে যে তারা ট্রাম্পের ডিজিটাল প্রচারণা থেকে দেশের কোন অঞ্চলে তার নির্বাচনী সমাবেশ করতে হবে, এসবকিছুই নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। তারা উইকিলিকসের জুলিয়ান আসাঞ্জের সাথে যোগাযোগ করে ক্লিনটনের কেলেংকারিময় ইমেল সংগ্রহের জন্য। রুশ হ্যাকারদের থেকে আসাঞ্জ এগুলোর কিছু পেয়েছিলেন, এখন তিনি দাবি করছেন যে তিনি নাকি অ্যানালিটিকাকে এগুলি দেননি। কিন্তু পরে ঠিকই ব্যক্তিগত আক্রোশবসত সময়মত (ট্রাম্পের হলিউড অ্যাক্সেসের কেলেংকারি ভিডিও যেদিন বেরুলো) এগুলো প্রকাশ করেন।

আমরা ‌অনেকেই জানি না যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা মোটামুটি বড় মাইনরিটি সাধারণত ভোট দেয় না, তারা ভাবে কোন পার্টিই তাদের স্বার্থ দেখে না। এদের কিছু হয়ত বর্ণবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যপাদী, স্রেফ বাইকার বা দন্তনখরহীন কন্সপিরাসি থিওরিস্ট। এরাও কিন্তু ইন্টারনেটে যাওয়া-আসা করে এবং তাদের ওয়েবসাইট-ফোরাম ইন্টারনেটের কোনা-কাঞ্চিতে বিপুল পরিমাণে আছে। গুগল-ফেসবুকের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বে বোঝানো পদ্ধতিতে তাদের চিন্তাধারা কি আর তারা আসলে কি চায় তা জানা সম্ভব, এবং তৃতীয় পর্বের পদ্ধতিতে তাদেরকে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ‘রিইনফোর্সিং মেসেজ’ দিয়ে কোন নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে রাজি করানো সম্ভব। ট্রাম্প যখন দাবি করেছেন যে তাঁর কারণে বিপুল পরিমাণ ভোটার রিপাবলিকান পার্টিতে এসেছে, কথাটা সত্য। সাধারণ রিপাবলিকানদের সাথে ওপরের ঐ গোষ্ঠীর ভোটও যোগ হয়েছে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা এই কাজটা সফলভাবে করেছে, আর ট্রাম্প তাদের এজন্য ৬২ লাখ ডলার দেন। আমার ধারণা ট্রাম্প সত্যিকার অর্থে কট্টর রেসিস্ট নন, কিন্তু তার পক্ষে বর্ণবাদী লেবেলটা অস্বীকার করাটাও সোজা নয়, কারণ তিনি সে ধরনের ভোটারদের ব্যবহার করেছেন। তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা — যারা তার সুরে আকৃষ্ট হয়েছে, তাদের একটা ছোট্ট অংশ ইঁদুর হতে পারে, কিন্তু তিনি নিজে সম্ভবত তা নন, তিনি স্রেফ একজন সেলসম্যান।

একথাও এখানে বলা জরুরী যে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণারও একটা বড় অংশ ছিল ডিজিটাল। কিন্তু তার অ্যানালিটিকাবাহিনীর পদ্ধতি নিয়ে কেউ এখনো প্রশ্ন তোলেনি, তুললে ট্রাম্পই সবার আগে গলাবাজি করে টুইটারে সত্য-মিথ্যা কিছু একটা দাবি করতেন। তার মানে এই নয় যে জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরিতে ক্লিন্টনের প্রচারণী ফার্মের কোনই ভূমিকা নেই।

এখন বলি এরকম অসম্ভাব্য ফলাফল কিভাবে হলো। অনেকেই হয়ত জানেন ক্লিনটন পপুলার ভোটে ট্রাম্পের থেকে প্রায় ৩০লাখ বেশি পেয়েছেন, সেটা মোট ভোটের ২.১%। ইলেক্টরাল কলেজ বলে একটা ব্যাপার আছে এদেশে, যার কারণে প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। একেকটা স্টেটের জন্য বরাদ্দকৃত কিছুসংখ্যক ইলেক্টরাল ভোট আছে, বেশিরভাগ স্টেটের নিয়মানুযায়ী যিনি সেখানে সবচে বেশি ভোট পাবেন, সে যতটুকু ব্যবধানেই হোক, তিনিই পাবেন সে স্টেটের সকল ইলেক্টরাল ভোট। আমেরিকার রাষ্ট্রনির্মাতারাই ইচ্ছা করে এরকমটা বানিয়ে দিয়ে গেছেন, এভাবেই দু’শতাধিক বছর ধরে চলছে, আর এটাকে পরিবর্তন করাও সহজ নয়। এধরনের ‘অন্যায্যতা’ রাখার কারণ হলো যেন কোন অসদুদ্দেশ্যের প্রার্থী চাইলেই জনগণের ভাবপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে পপুলার ভোটে বিজয়ী না হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পুরনো নিয়মটিকেই পুরোপুরি ‘গেম’ করা হয়েছে।

অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী তাদের তহবিলের অধিকাংশ টার্গেট করে ‘রাস্ট বেল্ট’ বলে জনবহুল একটি অঞ্চলে। সেখানকার জনগোষ্ঠী নানাকারণে খারাপ সময় পার করছে। পঞ্চাশ বছর আগে তাদের বাপ-দাদারা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে সমৃদ্ধি পেয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মান। অনেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ধরনের চাকুরিদক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেরকে পুরনোদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা ছিল সহজ। ট্রাম্পও অ্যানালিটিকার হিসাব অনুযায়ী এসব জায়গায় গিয়ে বিশাল সমাবেশ করেন, কিন্তু ক্লিনটন বলতে গেলে সেসব জায়গায় যানই নি, ভেবেছেন গত দু’নির্বাচনের মত এরা ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেবে। অথচ এরাই সুইং স্টেট, যাদের ভোটে শেষ ফলাফল নির্ধারিত হয়। সেসব জায়গায় অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা তাই চলেছে বেশি, ডেমোক্র্যাট শ্বেতাঙ্গ খেঁটে খাওয়া মানুষদের ব্রেক্সিটের উপায়ে কব্জা করা হয়েছে, আর ডেমোক্র্যাট কৃষ্ণাঙ্গদের বোঝানো হয়েছে কালো প্রেসিডেন্টের আমলে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, তাই তারা ভোটই দিতে যায়নি

হিসাব দেখুন। পেন্সিলভানিয়াতে ট্রাম্প জিতেছেন মাত্র ৪৪,০০০ ভোটের ব্যবধানে, সেটা সেখানের মোট ভোট ৬৩ লাখের ০.৭% মাত্র, সেখানের ইলেক্টরাল ভোট পেয়েছেন ২০টি। উইস্কনসিনে জিতেছেন ২৩,০০০ ব্যবধানে, সেটা মোট ভোট ৩০ লাখের ০.৩% মাত্র, ইলেক্টরাল ভোট ১০টি। মিশিগানে জিতলেন মা-আ-ত্র ১১,০০০ বেশি পেয়ে, মোট ভোট ৪৭ লাখের ০.৩%! ইলেক্টরাল ভোট ১৬টি। তার সাথে যদি আরেকটা ছোট স্টেট নিউ হ্যাম্শায়ারকে যোগ করি, সেখানে আড়াই হাজার ব্যবধান, মোট ৮ লাখের ০.৩%, ইলেক্টরাল ভোট ৪টি। অর্থাৎ ৫০টি ইলেক্টরাল ভোট খুবই চুলচেরা ব্যবধানে জিতেছেন। পুরো ইলেক্টরাল ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩০৪, ক্লিনটন ২২৭। ৫০ ইলেক্টরাল ভোট আর সাড়ে ৮০ হাজার পপুলার ভোট (মোট ভোটের ০.০৬%!) এদিক-ওদিক হলে ট্রাম্প পেতেন ২৫৪ ভোট আর ক্লিনটন ২৭৭ পেয়ে আজ থাকতেন মার্কিনের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ৩

দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত যা কিছু বললাম, শুনতে ভয়াবহ মনে হলেও বেআইনি নয়, আর অনেকে হয়ত গায়েও লাগাবে না, কারণ মার্কিনে এসব নিত্যনৈমিত্তিক। আপনার যদি সর্পতৈলে আসক্তি থাকে, তিতাস মলমে আপনার আগ্রহ জন্মাতেই পারে। ফেসবুক যদি সেটার খবর আপনাকে দিয়ে দু’পয়সা কামিয়ে নেয়, ক্ষতি কি? যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব অবৈধ নয়, যতক্ষণ না আপনি (বা আপনার পক্ষে সরকার) প্রতারণার মামলা ঠুকে দিচ্ছে।

এপর্বে বলবো পরের ধাপটা কি, আর কিভাবে দুষ্ট লোকেরা আমার-আপনার-সবার ক্ষতি করছে।

অ্যানালিটিকার মত ফার্ম সম্ভবত এখনো এক কোটির মধ্যে একজনকে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিনপয়েন্ট করে চিহ্নিত করতে পারে না, কিন্তু সমমনা মানুষদের একটা কম্যুনিটিকে পারে। সোজা উদাহরণ দিই। তারা তাদের তথ্যভান্ডারের উপর মেশিন লার্নিং কোরিলেশন অ্যালগরিদম চালিয়ে বের করলো যে যেসব পুরুষদের গোলাপীরং ভীষণ অপছন্দ তাদের অধিকাংশই গেদের ঘৃণা করে, তার সাথে যদি তারা রংধনুপতাকাওলা পোস্টে রাগের ইমো দেয়, তাহলে তো মিলেই গেল। তারা বের করলো যে আপনার জিপকোডে এরকম মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশ, কিন্তু ভোট দিতে যায় মাত্র ২০ শতাংশ। মার্সারপরিবারও গেদের দেখতে পারে না। তারা অ্যানালিটিকাকে বলল আপনার ভোটটা কব্জা করতে। অ্যানালিটিকা ফেসবুকের অ্যাডভার্টাইজিং প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আপনার জিপকোডকে টার্গেট করলো। একে বলে মাইক্রোটার্গেটিং, জিপকোডের সাথে অন্যান্য ক্যাটেগরির সেটের ইন্টারসেকশন করে তারা আপনার এলাকার সমমনা মানুষকে মাইক্রোটার্গেট করতে পারে।

তো সেই উপায়ে আজকে আপনার ফেসবুক ফীডের স্পন্সরড কন্টেন্টে দেখালো এমন একটা খবর যাতে আপনার পিত্তি জ্বলে যায়, ধরুন আপনার এলাকার কোন পদে একজন ডেমোক্র্যাট গে বা লেজ (উল্টোদিক থেকে চিন্তা করলে রিপাবলিকান তথাকথিত হোমোফোব) নির্বাচনপ্রার্থী। খবরটা সত্য হতে পারে, আর অসত্য হলেও আপনি জাংক মেইলের মত ট্র্যাশ করবেন না, মনে মনে একটা রাগের সুড়সুড়ি অনুভব করবেন এবং আপনি এটা মনে রাখবেন। হয়ত আপনার প্রোফাইলে শেয়ারও করবেন, অসত্য বলে আপনাকে কেউ চ্যালেন্জ করবে না, কেউ যেচে পড়ে ঝগড়া করতে যায় না।

পরের হপ্তায় আপনাদের দেখানো হলো ট্রাম্পমামু ইলেকশানে জিতলে বলেছেন কোনো গে-লেজের সাধ্য নাই স্কুলে শিক্ষকতা করে। মনে একটু আনন্দের সুড়সুড়ি লাগলো, লাইক দিলেন এবং ফেসবুকের অ্যালগরিদমও বুঝে নিল পরেরবার আপনি কি লাইক করবেন। অর্থাৎ এবার হয়ত স্পন্সর্ড কন্টেন্টও লাগবে না, আপনার সমমনা কোন ফ্রেন্ডের ফীড থেকেই এর পরের হপ্তায় পড়বেন নিউইয়র্ক বা ক্যালি, সে যেখানেই হোক, স্কুলের পাঠ্যসূচীতে গে-লেজবিষয়ে জ্ঞানদান করা হবে! সেসব জায়গার বাসিন্দা না হলেও, একজন দায়িত্ববান গার্জেন হিসাবে আপনার কলিজা কেঁপে উঠবে। সত্যাসত্য যাচাই না করে মনে মনে ঠিক করে ফেলবেন কে আপনার ভোটের যোগ্য।

শুধু ইন্টারনেট-ফেসবুক নয়, আপনার লোক্যাল টিভিচ্যানেলেও সমানে আপনাকে সুড়সুড়ি দেয়া হলে আপনি রান্নাঘরের ক্যালেন্ডারে ইলেকশানের তারিখটাকে লাল কালিতে বড় করে কয়েকবার দাগিয়ে ফেলবেন। যদি হাতে খুচরা পয়সা থাকে, সেটাও দান করবেন পছন্দের প্রার্থীর প্রচারণা তহবিলে। আর এই পুরো ব্যাপারটা যে ঘটে চলছে, আপনার পাশের জিপকোডের মানুষ হয়ত টেরও পাবে না! হয়তো তাদের উপর চলছে উল্টো ব্যবস্থা, আর তা নাহলে ভোটের দিন লেজ গুটিয়ে বসে থাকার চিকিৎসা।

উপরের সবকিছুই কিন্তু গে-লেজের সামনে ‘এন্টি’ বসালেও সত্য। যে ঘরানার প্রতিই আপনি সহানুভূতিশীল হোন না কেন, অ্যানালিটিকা না হলেও অন্য কম্পানির থেকে আপনার নিস্তার নেই! মানুষ আকৃষ্ট হয় যেটা তার কাছে জেল্লাদার বা ভয়ের তার দিকে। সত্যকে নয়, সে বিশ্বাস করে সেটাই যা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সত্য জিনিস বলতে গেলে কখনোই জেল্লাদার হয় না। দিনের পর দিন সমানে সুড়সুড়ির পর পাশাপাশি দুই জিপকোডের মানুষ হয়ে যাবে পদ্মার এপার আর ওপার, শুধু চাই বারুদে দিয়াশলাই! শার্লটসভিলে আর বার্কলীতে নির্বাচনের পরপর অনেকটা সেটাই হয়েছে। মানুষ মরেছে এদের এসব খেলার জন্যে!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের পুতিনের রঁসুইঘরের মত বদেরা এসবের থেকেও দু’কাঠি সরেস! আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ আর দৃঢ়বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এক ঘন্টার নোটিসে দাঁড়া করিয়ে ফেলবে ভুয়া খবরভরা বিশ্বাসযোগ্য দেখতে খবরের কাগজের ওয়েবসাইট। সত্য খবর বের করা আর লেখা কিন্তু অনেক কঠিন কাজ আর ব্যয়বহুল, সাংবাদিকতায় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় (সেকাজটার ০.১ শতাংশমাত্র আমি এমুহূর্তে করছি!)। মিথ্যা খবর বানানো বহুত সস্তা আর সহজ, একটা ল্যাপটপ নিয়ে কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতে আপনিও বানিয়ে ফেলতে পারবেন।

তাই ধরুন, কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক নামকরা কাগজ না ঘাঁটিয়ে গুগলে হয়ত খুঁজতে গেলেন মিশিগানে হিজাবধারীদের পেটানো হচ্ছে নাকি না, গুগল তাকে হাজারখান ভুয়া খবর দেখাবে তার ধারণার স্বপক্ষে, একটা সত্যও দেখাবে না কারণ খবরটা সত্য নয় — কিন্তু সে কিন্তু বুঝবে উল্টো! আমাদের অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী এধরনের বানোয়াট খবর এসইওর মাধ্যমে গুগলে সবার উপরে বসাবে আর উপরের ফেসবুকীয় পন্থায় পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে। সেসব মিথ্যা খবরকে পরখ করে সত্যটা বের করে জানাতে কিন্তু আসল সাংবাদিকদের ঘাম ছুটে যাবে, সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, কারণ ‌অসত্যের তো কোন তথ্যপ্রমাণ নেই, সত্যেরও মা-বাপ নেই, কী বের করবে তারা! ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।

ভু্য়াখবরের সাথে সাথে অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী চটকদার ডায়ালগসমৃদ্ধ রাজনৈতিক কার্টুন, ভিডিও, জেপেগ বা জিফও বানায় (এগুলিকে বলে ‘মীম’), তাতে তো আরো মহা সুড়সুড়ি! আর দুনিয়ার কোটি কোটি সস্তা চীনা মোবাইল থেকে হ্যাক করে চুরি করা অন্য মানুষের ছবি আর তথ্যও ডার্ক ওয়েবে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলি দিয়েও অ্যানালিটিকা বানিয়ে রেখেছে হাজারো ফেক প্রোফাইল (এ ব্যাপারে পরে সুযোগ হলে প্র্যাকটিক্যাল দেখাব), তাদের মাধ্যমে হাজারো লাইক দিয়ে দিয়ে কোন একটা অসত্য খবর বা মীমকে ভাইরাল বানিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।

আপনি হয়তো ফেক নিউজের ব্যাপারে খুবই, মানে খু-উ-ব-ই সাবধানি। এর থেকেও বিশ্বাসযোগ্য চান? শুনুন সিইও নিক্স সাহেবের বাণী। লিংক: https://youtu.be/mpbeOCKZFfQ

যুক্তরাজ্যের দু’তিনজন সাংবাদিক এই ভিডিওতে সেজেছেন শ্রীলংকার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তার সহকারী, যাদের বাসনা সেদেশে রাজনীতি করে সফল হওয়া। সে উসিলা নিয়ে কথা বলতে গেছেন কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কর্মকর্তাদের সাথে, সাথে গোপনে রেকর্ড করেছেন কথোপকথন।

তাতে নিক্স সাহেব উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কিছু উপায়। উপরেরগুলিতো বলেছেনই, তার ওপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে যদি প্রতিপক্ষ খুব ভালো হয় আর তার নোংরামির কোন প্রমাণ না থাকে তাহলে কি করবেন। উত্তরে নিক্স বলছেন যে তারা প্রতিপক্ষের কাছে ভিনদেশী ব্যবসায়ী সেজে যাবেন, দেখাসাক্ষাত করে তাদের আস্থাঅর্জনের পরে কোন বেআইনি সুবিধার বিনিময়ে উৎকোচের প্রস্তাব করবেন। কিংবা উক্রেনীয় সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে যাবেন মিটিংয়ে, সেই জল আরো কিছুদূর, হয়ত বেডরুম পর্যন্ত, গড়াবে। আর গোপন ক্যামেরাতে এসব রেকর্ড করার পরে সেটা জমা থাকবে ইলেকশানের আগের রাতে ফেসবুক বা ইউটিউবে ছাড়ার অপেক্ষায়। জল যদি বেশিদূর নাও গড়ায়, ভিডিও এডিট করে অন্তত নোংরা একটা রূপ দেয়া সম্ভব। এবং সেটুকুই হয়ত সামান্য ভোটের মার্জিনে জেতার জন্য যথেষ্ট। পুতিনের আগের জীবনের কর্মস্থল সোভিয়েত গোয়েন্দাসংস্থা কেজিবি স্নায়ুযুদ্ধের সময় এপন্থার নিশ্ছিদ্র সদ্ব্যবহার করে, একে তাদের ভাষায় বলে কমপ্রোমাত (অনেকের সন্দেহ পুতিন সরকারের কাছে ট্রাম্পের কেলেংকারিময় কমপ্রোমাত আছে)।

ঐ একই আন্ডারকাভার ভিডিওতে ‌অ্যানালিটিকা দাবি করছে যে তারা সফলভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নামে-বেনামে এসব নোংরামির পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। তার মধ্যে তারা বলেছে আমেরিকা, কেনিয়া-নাইজেরিয়ার মত আফ্রিকার দেশ, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, চীন আর পূর্ব ইউরোপের ‌অনুল্লিখিত একটি দেশের কথা।

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা সমাচার – ২

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। কম্পানিটি নিবন্ধিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে, আর লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে তাদের অফিস আছে। প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্স এখন সাসপেন্ডেড, তিনি ‘ম্যানসিস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কম্পানিটির কাজ হলো ‘ড্যাটা-মাইনিং’ আর ‘বিগ ড্যাটা অ্যানালিসিস’-এর সাহায্যে কর্পোরেট আর রাজনৈতিক মক্কেলের স্বপক্ষে মানুষের চিন্তাধারা আর আচরণ পরিবর্তন করা। সোজা কথায় ‘মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন’! কম্পানিটির যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে, এস,সি,এল বলে আরেক কম্পানির অধীনে। এসসিএলের ব্যবসাও একই রকম, তারা অ্যানালিটিকার মূলধনের ১০% দেয়, আর বাকি ৯০% আসে রবার্ট মার্সারের থেকে।

যারা মার্সার পরিবারের নাম শুনেননি, একটু খুঁজে দেখুন! রবার্ট আর তার মেয়ে রেবেকা চরম রক্ষণশীল আর ট্রাম্প-ব্যাননের সবচে’ বড় পৃষ্ঠপোষক। মার্সার ছিলেন আইবিএমের নামকরা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ, পরে নিজে একটা স্টকে বিনিয়োগের ব্যবসা শুরু করেন, যেখানে তার আবিষ্কৃত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বিলিওনিয়ার বনে যান। পরে ব্যাননকে ব্রাইটবার্ট নিউজ দাঁড়া করাতেও সাহায্য করেন অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে। রেবেকাই ব্যাননকে মোলাকাত করিয়ে দেন ট্রাম্পের সাথে। এখানেই শেষ নয়, ব্যানন ছিলেন অ্যানালিটিকার ভিপি, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার দায়ভার নেয়ার আগে। ট্রাম্পের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন, যিনি রুশদের সাথে দহরম মহরম করে রবার্ট ম্যুলারের কাছে ধরা খেয়ে বসে আছেন, তিনি ছিলেন এসসিএলেরও উপদেষ্টা। আটলান্টিকের ওপারে ব্রেক্সিটের সমর্থনকারী তিনজন ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির রাজনীতিবিদেরও অ্যানালিটিকাতে ‘অর্থলগ্নি’ আছে। বুঝতেই পারছেন যে এই কম্পানি গভীর জলের তিমিমাছ!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করছে যে, তাদের কাছে ২২ কোটিরও বেশি মার্কিনবাসীর প্রত্যেকের ৫ হাজার শ্রেণীর তথ্য আছে। আর সেগুলি ব্যবহার করে তারা সমমনা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে টার্গেট করতে পারে, আর কি ধরনের ইনপুটে তাদের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে তা আন্দাজ করতে পারে। তারা ভেঙে না বললেও ধরে নিতে পারি যে তাদের কর্মচারীদের মধ্যে ড্যাটা সায়েন্টিস্ট, মনস্তত্ত্ববিদ, ডিজিটাল ওয়েবপেজ, ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য কন্টেন্ট সৃজনবিশারদ আছেন। এস,ই,ও জিনিসটাও খুঁজে দেখবেন, এটা হলো গুগল আর অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে কিভাবে আপনার ‘প্রডাক্টটা’ (সেটা নির্বাচনপ্রার্থীও হতে পারে) আর সব প্রতিযোগীর থেকে উপরে উঠে আসবে, তার শিল্প। আরও যেটা না বললেই নয়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গেও পুতিনের ‘বাবুর্চির’ পরিচালিত একই রকম একটা ট্রোল ফার্ম আছে, যার তেরজন কর্মকর্তাকে রবার্ট ম্যুলার দোষীসাব্যস্ত করেছেন ২০১৬ নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের দায়ে।

অ্যানালিটিকা এত তথ্য পেলো কীভাবে?

এটা মনে রাখবেন যে ফেসবুক-গুগলের কাছে আপনি হয়ত সোশ্যাল সিক্যুরিটি বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেননি, কিন্তু তাদের কাছে যে অস্ত্র আছে সেটা আরো মোক্ষম, সেটা হলো আপনার অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছানোর চাবিকাঠি!

অ্যানালিটিকা যোগসাজশ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রুশ-মলদোভান বংশোদ্ভূত লেকচারার আলেকসান্দ্র্ কোগানের সাথে। এই লোক রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন (উপরের ঐ একই শহরে!) আর রুশ সরকার থেকেও ‘গবেষণার’ টাকা পেয়েছেন। ২০১৪ সালে একটা ফেসবুক অ্যাপ বানান, যার নাম ThisIsYourDigitalLife। গবেষণার উসিলায় ফেসবুক তাকে অনুমতি দেয় অ্যাপটির মাধ্যমে শুধু অ্যাপের ব্যবহারকারী নয়, তাদের ফ্রেন্ডদেরও প্রোফাইল ঘাঁটানোর। মনে মনে ভাবুন, আপনি সেই অ্যাপ, অনেক ‌অপরিচিত মানুষের প্রোফাইল-ছবি-ভিডিও-নোটস দেখছেন, তারা সাদা না কালো, কোথাকার বাসিন্দা, জন্ম কবে, বয়স কত, একলা না দোকলা, কিসে কিসে লাইক দিল, স্ট্যাটাস আপডেট অনুযায়ী সে সুখী না দুখী, গেদের দুচোক্ষে দেখতে পারে কি পারে না, কোন গ্রুপে যাতায়াত, হোক্সনিউজ দেখে না চিকেন নুডুল, মাসে কয়বার কোন রেস্টুরেন্টে চেকিন করে, মাকড়সা ভয় করে নাকি আরশোলা, তারা কার বা কিসের প্রতি দুর্বল, যদি আইপি অ্যাড্রেস পান তাহলে তাদের জিপকোড, ইত্যাদি। সেগুলি দেখে আপনি নিজে যা যা আন্দাজ করবেন, এই তথ্যগুলো দিয়ে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তার থেকে শতগুণ বেশি আর শতগুণ দ্রুত আন্দাজ করা সম্ভব। কোগানের এই অ্যাপ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিত্ব কিরকম তা জানার জন্য ব্যবহার করে, অর্থাৎ আরো বেশি কিছু তথ্যও দিয়ে দেয়। এভাবে তিনি দু’মাসের মধ্যে ২,৬০,০০০ মানুষের তথ্য সরাসরি পান, আর তাদের ফ্রেন্ড যারা অ্যাপটা কখনো ব্যবহারও করেনি, তাদের মিলিয়ে সে সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি! এর সাথে তুলনা করুন মার্কিনে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২৫ কোটি। ফেসবুককে কেউ হ্যাক করেনি, আমরাই ফেসবুককে এসব তথ্য দিয়েছি, আর তাই নিয়ে তারা ব্যবসা ফেঁদেছে, ‘গবেষণার’ খেলা খেলেছে।

শুধু ফেসবুক না, আপনি যদি গুগলও ব্যবহার করেন লগ্ডইন অবস্থায়, আপনি কি খুঁজাখুঁজি করছেন, গুগল তা জানবে, এবং পরের বার আন্দাজ করে আপনার পছন্দসই রেজাল্ট আপনাকে দেখাবে। তাছাড়া দুনিয়ার বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে তাদের কোড বসানো আছে, অর্থাৎ আপনি সেসব সাইটে যাচ্ছেন কিনা, তার আগে-পরে আর কি খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেসব তথ্য তারা সংগ্রহ করছে। চিন্তা করুন অ্যানালিটিকা যদি পারত সেটাও কব্জা করতে!

আর এর উপরে আছে কনজিউমার ড্যাটাসেট! আর রাজনৈতিক ‘প্যাক’! কনজিউমার ড্যাটা হলো বিভিন্ন দোকানপাটের সিস্টেমে তাদের খদ্দেরদের নাম-ঠিকানা-ফোন-ইমেলসহ অন্যান্য তথ্য, যেগুলি তারা আপনার কাছ থেকে আপনাকে জানিয়েই সংগ্রহ করে। আপনি ফাইনপ্রিন্ট না পড়েই লিস্টে নাম লিখিয়ে ফেললেন, যার বিনিময়ে হয়ত তারা আপনাকে ডিসকাউন্ট দিল। ইন্টারনেটের কারণে একাজ এখন অনেক সহজ। আর ‘প্যাক’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি, যারা কোন নির্বাচনপ্রার্থীর সমর্থক, তাদের পক্ষে প্রচারণা চালায়, জনে জনে ফোনকল করে, কলিংবেল চেপে ঘরে এসে কথা বলে। তারা সরাসরি প্রার্থীর সাথে জড়িত না হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থসংগ্রহ ও খরচ করতে পারে। এদের কাছেও আছে কোটি কোটি মানুষের তথ্য। আপনি হয়ত যেটা জানেন না বা গা করেন না, সেটা হলো এই সব স্টোর, প্যাক, এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও, আপনারসহ আরো অনেকের খুঁটিনাটি জানে এবং এগুলির কেনাবেচা করে। যেকোন মার্কেটিং-অ্যাডভার্টাইজিং কর্মকর্তা বুঝবেন যে এ এক সোনার খনি!

কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থার ড্যাটা সায়েন্টিস্টের পক্ষে খুবই সম্ভব এসব সাধারণ তথ্য সংগ্রহ করে ফেসবুক থেকে পাওয়া অসাধারণ তথ্যের সাথে লাইন ধরে মেলানো। অর্থাৎ তারা জানে আপনার জটিল কোন রোগ আছে কিনা, সর্পতৈলের প্রতি দুর্বলতা আছে কিনা, আর আপনার সাথে যোগাযোগের উপায়। বাকি থাকলো মান্নান মিয়াকে গিয়ে ধরে তার পয়সা উসুল করা।

বলা বাহুল্য, এসকল তথ্য আপনি স্বেচ্ছাতেই কাউকে না কাউকে দিয়েছেন। ইউরোপে না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বৈধভাবেই এসব তথ্য কেনাবেচা সম্ভব। এই কারণেই প্রতি সপ্তাহে আপনি ভুড়ি-ভুড়ি জাংক চিঠি ও ইমেল ডাস্টবিনে ফেলেন আর অনাহূত ফোনকল-টেক্স্ট পেয়ে বিরক্ত হন!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!