জুম্মার নামাজের পর ডোম অফ দ্য রকে যে অভিজ্ঞতা, রোববারে চীনা সহকর্মীদের সাথে তার থেকে ভিন্ন রকম। আজ বলি সে কথা, আর ইসলামের ভেতরে-বাইরে এই টেম্পল মাউন্টের কি ইতিহাস, কি তাৎপর্য, তার কিছুটা।
টেম্পল মাউন্ট নামটা পশ্চিমা বিশ্বে ডোম অফ দ্য রকের মতই ভাল চলে। মুসলিম বিশ্বে অবশ্য নামটা একটু সংবেদনশীল। কারণ এই “টেম্পল” মানে হল ইহুদীদের কিং সলোমনের পবিত্র টেম্পল। এর প্রাচীন অস্তিত্ব বায়তুল মোকাদ্দাসের নিচে। ইহুদীদের হাতে গোনা ফ্রিঞ্জ কিছু গ্রুপের এ ব্যাপারে অ্যানাক্রনিস্টিক দাবি রয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে অনতিভবিষ্যতে এখানে তৃতীয় আরেকটি টেম্পল প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্য মুসলিম বা আরবদের সামনে টেম্পল মাউন্ট শব্দটা ব্যবহার না করাটাই শ্রেয়।
আগে বলেছি, অমুসলিমদের ঢোকার জন্যে কেবল একটি ফটক। বাব এল মাগরেব বা মরক্কো গেট নামের এ দরজায় পৌঁছতে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দক্ষিণ প্রবেশপথে গিয়ে লাইন করতে হয়। একটা ফুটব্রীজ ওয়েস্টার্ন ওয়ালের প্রাঙ্গনের ওপর দিয়ে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে গেটটির সাথে। মুসলিমদের জন্যে বরাদ্দ বাকি ১১টি প্রবেশপথের মত এ রাস্তায় ঢোকা সোজা নয়। ইসরাইলী পুলিশ এখানকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। সকল দর্শনার্থীর ব্যাগ-শরীর চেক হচ্ছে মেটাল ডিটেক্টর আর এক্স রে স্ক্রীনে। সূরা-দোয়া পড়ে পার পাবার উপায় নেই।
সকালে যখন মাউন্ট অফ অলিভস আর সিটি অফ ডেভিড একলা ঘুরছি, তখন নাকি চীনা সহকর্মীরা এখানে লাইন করেছিল। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হবার পর তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, বলা হয় এ মুহূর্তে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অবশ্যই জোহরের কারণে এই বিরতি। নামাজের সময়টা অমুসলিম পর্যটকদের উপস্থিতি কাম্য নয়। দুপুরের খাবারের পর আবার চীনারা ফিরে এসেছে, আমিও হোটেলে বিশ্রাম করে এসে ওদের সাথে যুক্ত হয়েছি।
আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে দু’ তিনজন কিপ্পা আর প্রেয়ার শাল’পরা ধার্মিক ইহুদী। এদের পা খালি। পবিত্র ভূমিতে জুতা পরে ঢোকা তো বটেই, বেশির ভাগ ইহুদীদের জন্য এখানে ঢোকাটাই ধর্মে মানা। এদের আসার রাস্তা পর্যটকদের সাথেই। আর ভেতরে ঢুকতে পারলেও ইসলামী ওয়াকফের নির্দেশ অনুযায়ী ধর্মীয় পোশাক পরা কিংবা প্রার্থনা করা বারণ।
এসব ইহুদী তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। ইসরাইলের চীফ রাবিনেট থেকে এখানে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞার কারণ, সলোমনের টেম্পলে যে “হোলি অফ হোলিজ” ছিল তাতে প্রবেশের অধিকার সাধারণ ইহুদীদের আদিকালেই ছিল না। ছিল কেবলমাত্র প্রধান পুরোহিতের। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসসাধনের পর আর সে বাস্তবতা নেই, যদি না ঈশ্বর দৈববলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান।
গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে ইসলামী ওয়াকফের তদারকি। তারা চেক করছে দর্শনার্থীদের পোশাকআশাকের শালীনতা। পুরুষ যারা শর্টস পরেছে তাদের দেয়া হচ্ছে ধূসর রঙের লুংগির মত ক্যানভাসের আবরণ। সে লুংগির প্যাঁচে পড়ে গেল এক সহকর্মী। জেরুজালেমে ঢোকামাত্রই আমি বুঝেছি শর্টস পরলে কোথাও না কোথাও আটকে যাব, তাই বাঁচলাম। মেয়েদের মাথা ঢাকা না থাকলে গরমের মধ্যেই ওয়াকফ সদস্যরা তাদের পরতে দিচ্ছে হুডিসহ জোব্বা।
আমাদের মেয়াদ মোটে এক ঘন্টা। আশপাশেই নজরদারিতে রয়েছে ওয়াকফের লোকজন। ভেতরের প্রাঙ্গনে সাধারণ অনেক মুসল্লী প্রার্থনারত। তবে শুক্রবারের মত মানুষ নেই। মসজিদুল আকসার প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি গেলেই সেখানকার দ্বাররক্ষী বিপরীত পথ প্রদর্শন করছে। কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকতে দিলেও মসজিদুল আকসা আর ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঢোকার অনুমতি অমুসলিমদের নেই।
একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় আমাদের দিকে এগিয়ে এল এক আরব। কিছু টাকার বিনিময়ে ট্যুর গাইড হবার অফার করল। তিন চীনা সঙ্গী আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, লাগবে না, এ আমাদের গাইড। তাতে ভদ্রলোক রাগে গজগজ করতে এক ইউরোপীয় দলের দিকে চলে গেল। সে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! তার থেকে বেশি জানবে আরেক “ট্যুরিস্ট?” তার বেশভূষা দেখে অবশ্য অধ্যাপক বলে মনে হয় না। শুক্রবার জুম্মার পরে দেখেছি বহু প্রফেশনাল ট্যুর গাইড মুসলিমদেরকে ফিরিস্তি দিচ্ছে। ইনি তাদের মত নন।
ডোম অফ দ্য রকের চারপাশ দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলাম। ইহুদীদের “হোলি অফ হোলিজ” নাকি ছিল এখানেই, সাখরা পাথরের ওপর। এই “হোলি অফ হোলিজের” হিব্রু নাম “কোদেশ হা’কোদাশিম।” হিব্রু কোদেশ আর আরবী কুদ্দুস একই শব্দ — পবিত্র। রুহুল কুদ্দুস বা হোলি স্পিরিট শব্দটা প্রায় হুবহু হিব্রুতে তালমুদে রয়েছে — রুয়াখ কোদেশ। হোলি অফ হোলিজ বস্তুটি আসলে একটি পর্দাঘেরা জায়গা বা টেবার্নেকল। তার ভেতরে রাখা ছিল আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট। আর আর্কের ভেতর খোদার কাছ থেকে টেন কমান্ডমেন্টসের যে পাথরে খোদাই ট্যাবলেট মোজেস পেয়েছিলেন, সেগুলি রাখা ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলাইটদের দৈব সহায়তা দিত এই আর্ক।
চীফ রাবিনেটের মতে ডোম অফ দ্য রকের ভেতরেই যে কোদেশ হা’কোদাশিম ছিল তার শক্ত কোন প্রমাণ নেই। সেটি পুরো টেম্পল মাউন্টের যে কোন জায়গায় হতে পারে। অষ্টম/সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব থেকে শুরু করে বহু ধর্মের বহু শাসক এই কম্পাউন্ডের পরিবর্ধন, পরিমার্জন আর ধ্বংসসাধন করেছে। তাই এখন ঠিক করে বলার উপায় নেই কোথায় ছিল সে “কোদেশ হা’কোদাশিম।” সুতরাং পুরো কম্পাউন্ডে ইহুদীদের প্রবেশ না করাটাই নিরাপদ। একই কারণে যারা প্রবেশের সাহস করেছে তারা পুরো কম্পাউন্ডে হাঁটছে খালি পায়ে।
ফাউন্ডেশন রকটি নিয়ে আরো কিছু বিশ্বাস রয়েছে ইহুদীদের। এই পাথরটিকে ভিত্তি করেই নাকি ঈশ্বর বিশ্বজগতের সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। এ পাথরের ওপরই নাকি এব্রাহাম তার পুত্র আইজ্যাককে বলিদান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন অবশ্য এই টেম্পলের অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে ছিল মাউন্ট মোরিয়া বলে একটা উঁচু পাহাড়, আর এই সমতল পাথুরে প্ল্যাটো। আরো নানাবিধ তাৎপর্য আছে এ পাথরের।
ডেভিডের নেতৃত্বে কেনানাইটদের ওপর বিজয়ের মাধ্যমে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ পায় আদি ইসরায়েলাইট জনগোষ্ঠী। ডেভিডের পুত্র সলোমন এই মাউন্ট মোরিয়ার চূড়ায় তৈরি করেন প্রথম টেম্পল প্রাঙ্গন। সেখানে ঈশ্বর “ইয়াওয়ের” উদ্দেশ্যে পশু বলি হত, যেটা ছিল এব্রাহামের উত্তরাধিকার। মুসলিমরাও ঈদুল আযহার সময় সে ঐতিহ্য অনুসরণ করে।
যদিও ইহুদী মত অনুযায়ী সলোমনের টেম্পল এক হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি, অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের হিসাবে সেটি আসলে সপ্তম/অষ্টম খ্রীষ্টপূর্ব শতকের আগে নয়। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, সুলায়মান এ “মসজিদ” তৈরি করেন মানুষ, জ্বীন ও পশুপাখির দৈব সাহায্য নিয়ে। এখানেই তার সাথে সাক্ষাত করেন কুইন অফ শেবা “বিলকিস।” ইহুদী ধর্মের বিশ্বাসও একই।
সলোমনের ঐক্যবদ্ধ রাজ্য শীঘ্রই ইসরাইল ও জুদাহ রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ৫৮৭/৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে দু’রাজ্যের স্বাধীনতাহরণ করে ব্যাবিলনের রাজা নেবুকাদনেসার। তার সেনাদল টেম্পলটি লুটপাটের পর ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ইহুদীদের বশ্যতা স্বীকার না করার এ ছিল প্রতিশোধ। ইহুদী ধর্মমতে খোদা ছাড়া আর কারো আনুগত্যপালন গর্হিত অপরাধ। জেরুজালেমের এলিটদের ধরে নির্বাসনে পাঠানো হয় ব্যাবিলনে — যার থেকে বনি এম’এর বাই দ্য রিভার্স অফ ব্যাবিলন গান।
সলোমনের টেম্পল ধ্বংসের সত্তর বছর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান আকিমেনিদ পারসিক সম্রাট দারিয়ুস। তিনি ইহুদীদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেন। একই সাথে ফিরিয়ে দেন নেবুকাদনেসারের সময় লুন্ঠনকৃত ধর্মীয় অনুষঙ্গের অধিকাংশ। আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট অবশ্য হারিয়ে যায়। দারিয়ুসের সাহায্যে পারসিক ইয়েহুদ প্রদেশে নতুন একটি টেম্পল পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় অ-ইহুদী জনগণের বিরোধিতার মুখে কয়েক বছর সে কাজ স্থগিত থাকে। সম্পূর্ণ হয় সম্রাট সাইরাস বা কুরুশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। অনেক ইহুদী বিবরণীতে তিনিই নাকি তাদের মেসিয়া, ত্রাতা। যীশুর আগেই তার আবির্ভাব।
অমুসলিম দর্শনার্থীদের ভালমত চোখে চোখে রাখে ওয়াকফ সদস্যরা। অন্তত দু’বার স্থানীয় আরবরা এসে কিছু প্রশ্ন করল। আমাদের দু’জনের হাতে যেহেতু বড় লেন্সের ক্যামেরা, তাদের জিজ্ঞাসা “বেরেস?” আমরা কেউ বুঝি না সে কি। “তিভি?” না, না আমরা টিভি নই, প্রাইভেট ছবি তুলছি, টুরিস্ট। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে কেটে পড়লেও সামান্য দূরে দূরেই থাকল। তখন আমার মাথায় লাইটবাল্ব জ্বলে উঠল! আরবী “বেরেস”, ইকুয়াল টু ইংরেজী “প্রেস!”
এক ঘন্টা ফুরোতে না ফুরোতেই ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে সকলকে বের করে দেবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল ওয়াকফের লোকজন। হয়ত আসরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসছে বলে। দ্রুতপদে হাঁটা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম সবচে কাছের গেটটা দিয়ে। এসে পড়লাম খ্রীষ্টান কোয়ার্টারের ভিয়া দোলোরোসার কাছে। হাতে আছে আরো ঘন্টা দুয়েক। তারপর অ্যালেক্সের “শ্কডা” ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে যাবে তেল আবিব এয়ারপোর্টে। এবারের মত যাত্রা হবে সাঙ্গ!
সেকেন্ড টেম্পল আর বায়তুল মোকাদ্দাসের বাকি কাহিনী শেষ করি। পারসিক সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল ইহুদীদের। এই সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড তাদের ইতিহাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময়েই তাদের অধিকাংশ ধর্মীয় দর্শন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। বলা ভাল, বাইরের বিশ্ব থেকে অন্যান্য বহু সংস্কৃতির ম্যাচিওর প্রডাক্টও তাদের ধর্মে ইন্টেগ্রেট হয়।
বিশেষত, এঞ্জেলস, ডেমনস, ডেভিল, প্রিন্স অফ ডার্কনেস, হেভেন-হেল — এসব বিশ্বাসগুলি মূলে অনেকটাই পারসিক জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ঈশ্বর ও শয়তানের ডাইকোটমি পরিষ্কারভাবে তৈরি হয় এ সময়ে। এখনো কিন্তু ইহুদী ও ইসলাম ধর্মে এ ব্যাপারে দার্শনিক বিতর্ক রয়েছে। শয়তান কি ফ্রী এজেন্ট? নাকি কেবল খোদার গূঢ় উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের আনফ্রী এজেন্ট? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে শয়তান আর জোরোয়াস্ত্রিয়ান আহরিমানের মধ্যে তেমন কোন তফাত নেই। এ ব্যাপারে ডেড সী স্ক্রলসের প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য কোন সময় বলব।
পারসিকদের পতন হয় ম্যাসেডনের রাজা মহামতি আলেকজান্ডারের হাতে। লেভান্ট অঞ্চল নিয়ে তার উত্তরসূরী টলেমি ও সেলুকাসের মধ্যে রেষারেষিতে জয় পায় সিরিয়ার সেলুসিড রাজ্য (গ্রীকে সেলেফকোস)। তাদের শাসনামলে সেকেন্ড টেম্পলটিকে পরিণত করা হয় পৌত্তলিক মন্দিরে। ইহুদী ধর্ম ও হিব্রু ভাষায় প্রচুর গ্রীক প্রভাব ঢোকে। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন শহুরে হিব্রুভাষীরা গ্রীক আচার গ্রহণে বাধ্য হয়। যারা একটু বেশি ধার্মিক, তারা এসব থেকে দূরে সরে পূর্বে ডেড সী’র কাছে একরকম সন্ন্যাসব্রত নেয়। ম্যাকাবি-ফ্যারিসি-এসেন-“জীলট” ইত্যাদি গ্রুপ এদের মধ্যে পড়ে।
গ্রীক শাসনের অবসান ঘটায় বিদ্রোহী ম্যাকাবি হাসমনিয়ান বংশ। তবে ক্রমে তারা রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়। আর যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আশপাশ দিয়ে রাজা হন হেরড। রোমানদের মিত্র হেরডই সেকেন্ড টেম্পলের বিশাল সংস্কার করেন। প্রচুর কর আরোপের মাধ্যমে তিনি টেম্পলটির আঙ্গিনা আরো বাড়ান। সে যুগে এই টেম্পল ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ তীর্থস্থান। গ্রীকদের প্রভাব কাটিয়ে ইহুদীরা আবার আগের মত উপাসনা করে এখানে। পূণ্যলাভ ও পাপস্খলনের প্রত্যাশায় রোমান বিশ্ব থেকে জাহাজে করে অগণিত ইহুদী আসত। প্রচুর অর্থ খরচ করে রিচুয়াল বাথের পর কোরবানীর পশুসহ প্রবেশ করত টেম্পলে। তারপর পবিত্র পাথরের নিকটে কোরবানি করে তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হত পশুর রক্ত। হিব্রু আর আরবী ভাষায় “কোরবান” হুবহু একই শব্দ।
নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী যীশু খ্রীষ্টেরও পদধূলিধন্য এই টেম্পল। তবে সমসাময়িক ইহুদী রিচুয়ালগুলোকে সারশূন্য বলে সমালোচনা করেছেন তিনি। কিন্তু টেম্পলের পবিত্রতাকে অস্বীকার করেননি। এই সেকেন্ড টেম্পলের একটা প্রমাণ সাইজ মডেল রয়েছে ইসরায়েল মিউজিয়ামে, যার ছবি দিয়েছি।
সত্তর খ্রীষ্টাব্দে ইহুদীদের চলমান রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহকে নির্মূল করে জেরুজালেমের দখল নেয় রোমসম্রাট টাইটাসের সেনাদল। সেকেন্ড টেম্পলের প্রায় সম্পূর্ণ বিলোপসাধন করে তারা। দ্বিতীয় ও শেষবারের মত টেম্পলের ইহুদী ধর্মীয় পবিত্র অনুষঙ্গগুলি হরণ করে বিদেশী সৈন্যরা। তার মধ্যে ছিল টেম্পল মেনোরা — সাত শাখাবিশিষ্ট মোমবাতিদানি। ইহুদী রাজনৈতিক মানসের মূর্তমান প্রতীক ছিল এটি।
এরপর আর কখনো স্বদেশ ফিরে পায়নি ইহুদীরা — ১৯৪৮ পর্যন্ত (আসলে ঊনবিংশ শতক!)। রোমানরা জেরুজালেম থেকে তাদের বহিষ্কার করে। অনেকে মিশর-সিরিয়া-জর্দান-ইরাক-ইয়েমেনে গিয়ে বসতি গাঁড়ে। প্রায় সন্দেহাতীতভাবে এদের কিছু গোত্র আরবে অভিবাসী হয়, যাদের উল্লেখ আমরা হাদীসে পাই মদীনা বা ইয়াথরিব শহরের অধিবাসী হিসাবে।
ইহুদীদের উচ্ছেদের পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত টেম্পল মাউন্টের ওপর জুপিটারের মন্দির তৈরি করে রোমানরা। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতক নাগাদ সে মন্দিরও হয় ধূলিসাৎ, কারণ সম্রাট কনস্ট্যান্টিনের খ্রীষ্টধর্মগ্রহণ ও তার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। পুরো টেম্পল মাউন্ট হয় রোমানদের গার্বেজ ডাম্প। তবে অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদরা বর্তমান মসজিদুল আকসার নিচে একটি খ্রীষ্টান ব্যাসিলিকার আংশিক ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন। হতে পারে ঐ দক্ষিণাংশে খ্রীষ্টানরা টেম্পলের স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের তাৎক্ষণিক পরে ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন আরব সেনাদল জেরুজালেমে এসে অবরোধ বসায়, তখন জেরুজালেম ছিল খ্রীষ্টান শহর, ইহুদী নয়। তবে এর পূর্ববর্তী তিন দশকের মধ্যে দু’বার হাতবদল হয়েছে এ শহর। পারসিক সাসানী শাহেনশাহ বিজ্যান্টাইন “রোমের” বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় পেয়ে সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল নেয়। খ্রীষ্টান অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া। এই যুদ্ধের সুযোগে সিরিয়ার ইহুদী ট্রাইবগুলিও রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। জেরুজালেম পুনরুদ্ধার ছিল তাদের জন্য ধর্মীয় কর্তব্য। অবশ্য তাদেরকে খুব একটা কদর সাসানীরা করেনি।
এই সংঘাতের ব্যাপারটা কুরআনের সূরা রূমে আছে। সেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে এবং রোম আবার জয়ী হবে। ক্রমে তাই হয়, এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশাতেই জেরুজালেমসহ সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দখল ফিরে আসে বিজ্যান্টাইনদের হাতে। তবে সে বিজয় আসলে পরবর্তী আরেকটি বিজয়ের অগ্রদূত। শীঘ্রই জেরুজালেমের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় আরব বেদুইন সেনাদল। তাদের নমিনাল নেতা নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রা)।
বিজ্যান্টাইন সেনাদল ইতিমধ্যে জেরুজালেম থেকে কেটে পড়েছে। শহরের খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস বাদে সেখানে কোন কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি নেই। অবরুদ্ধ শহরের দরজা মুসলিমদের জন্যে খোলার অনুমতি দিলেন তিনি, শর্তসাপেক্ষে। ওমর (রা) কে ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছ থেকে আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে হবে। আরেক শর্ত, জেরুজালেমে নতুন দিগ্বিজয়ীদের সাথে ইহুদীরা প্রবেশ করতে পারবে না। এটি লিপিবদ্ধ আছে সমসাময়িক খ্রীষ্টান পর্যবেক্ষকদের বিবরণীতে।
অর্থাৎ খুব সম্ভবত সিরিয়া ও আরবের ইহুদীদেরও একাংশ মুসলিম আরবদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এটা অসম্ভব কিছু নয়। এমন সম্ভাবনা ইসলামের আদি ইতিহাস পড়লেও আঁচ করা যায়। জেরুজালেম থেকে রোমানদের বিতাড়িত ইহুদীদের প্রত্যাবর্তনের শতভাগ প্রণোদনা তো ছিলই, তাছাড়াও মদীনা সনদের মত দলিল থেকেও জানতে পারি ইসলামের আদি যুগ থেকেই ইহুদী ও পীপল অফ দ্য বুকএর সাথে মুসলিমদের মিত্রতার উদাহরণ। যদিও বর্তমান রীডিং অনুযায়ী সেসব মিত্রতা স্থায়ী হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আরেকটা কৌতূহলপ্রদ কথা বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে একটি আদি ইসলামী মুদ্রা আছে। উমাইয়া শাসনামলের ইলিয়া প্রদেশ অর্থাৎ ফিলিস্তিন/জেরুজালেমে এটি মুদ্রিত। এর এক পিঠে আরবী কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর অপর পিঠে পাঁচ শাখার মোমবাতিদানি। সেটা দেখতে হুবহু মেনোরা — ইহুদী জাতীয়তাবাদের প্রতীক।
এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা নানাজন নানাভাবে দিয়েছেন। অন্যতম ব্যাখ্যা অবশ্যই ইসলামী জেরুজালেমে ইহুদীদের আংশিক পুনর্বাসনের একটা বড় সম্ভাবনা। হযরত ওমর (রা) নাকি আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদীদের “বহিষ্কার” করেছিলেন। সেটা সত্য নাকি তাদের স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল — সেটা সত্য? এর সরাসরি প্রমাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র বহু শতাব্দীর এডিট করা ইসলামী ইতিহাসের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
যা হোক, উমর (রা) জেরুজালেমে প্রবেশের পর টেম্পল মাউন্টে এসে বিজ্যান্টাইন “আস্তাকুঁড়ের” সন্ধান পান। সেই প্রাচীন পাথুরে প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ পাশে একটি মেকশিফট মসজিদ তৈরি করা হয়। যেটা আদি মসজিদুল আকসা। হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মি’রাজের সময়ে অবশ্যই এখানে সেসব স্থাপনা ছিল না। উমর (রা)এর মসজিদটি এখনো বর্তমান আল আকসার লাগোয়া একটি ভবনে ছিল বলা হচ্ছে। তবে নিশ্চয় অনেক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে সেটি। এই অস্থায়ী মসজিদের কথা গথিক বিশপ আর্কউল্ফের বিবরণীতেও রয়েছে। তবে তার ভ্রমণকাল মুয়াবিয়ার সময়।
আরেকটা প্রসঙ্গ টানি। উমরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে দুই সাহাবী সচেষ্ট ছিল। তাদের একজন ইহুদী থেকে ধর্মান্তরিত, আরেকজন খ্রীষ্টান থেকে — ইসলামী ইতিহাস মতে। এ দু ধর্ম অবশ্যই জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণলাভের জন্যে প্রতিযোগী ছিল। সম্ভবত এরা আসলে ধর্মান্তরিত ছিল না। ছিল বিজয়ী সেনাদলে শামিল “আহলাল কিতাব।” আবার ইহুদী ধর্মান্তরিত এক দল নাকি উপদেশ দিয়েছিল মক্কার কিবলামুখী মসজিদুল আকসাটি টেম্পল মাউন্টের দক্ষিণে প্রতিষ্ঠা না করে উত্তরে প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে যেটা হত, তা হল মক্কার কিবলার মাঝে পড়ে যেত ইসলামের প্রথম আঠারো মাসের কিবলা সেই পবিত্র পাথরটিও। ইহুদী প্রভাব বা সমব্যথিতা না থাকলে মদীনায় মক্কামুখী কিবলা হবার পরেও এ সুপারিশ কিভাবে সম্ভব?
উমর (রা) টেম্পল মাউন্টে নতুন স্থাপনা তৈরির নির্দেশ দেন। সেকেন্ড টেম্পলের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে উঠতে শুরু করে নতুন ধর্মের পবিত্র ধর্মালয়। প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়াবিয়া তার খেলাফতের বায়াত নেন মসজিদুল আকসার ভেতর। ততদিনে আরব বিশ্বে গৃহযুদ্ধ চলমান। প্রথমে আলীর সাথে তালহা-জুবায়ের-আয়েশা, খারেজী ও মুয়াবিয়ার সিরীয় সেনাবাহিনীর। তারপর কারবালার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদের বিরুদ্ধে আদি শিয়া, খারেজী ও ইবনে জুবায়েরের। ৬৯২ খ্রীষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত মক্কা ও মদীনার পবিত্র নগরীর দখল উমাইয়াদের হাতে ছিল না।
তবে সুফিয়ানী উমাইয়ারা নির্বংশ হবার পর শক্তভাবে রাজ্যের হাল ধরে মারওয়ানী খলীফারা। তাদের নেতা সুচতুর মারওয়ান ও তার পুত্র আব্দুল মালিক নিষ্ঠুরতার সাথে বিভিন্ন কোন্দলের সমাপ্তি ঘটান। বিজ্যান্টাইনদের উপঢৌকন পাঠিয়ে কিছুদিনের জন্য উত্তরের সীমান্ত নিরাপদ রাখেন। তারপর বিশ্বস্ত সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাহায্যে ইবনে জুবায়রের পাল্টা খেলাফতের ইতি ঘটান। মক্কার কা’বা শরীফ এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ত্রেবুশে নামক আদি আর্টিলারির আঘাতে। মক্কা অবরোধে ইবনে জুবায়েরের মৃত্যুর পর তিন পবিত্র নগরীর শাসক হন আব্দুল মালিক। পুরো ইসলামী বিশ্ব হয় আবার ঐক্যবদ্ধ।
বিজয়ের পর কা’বা শরীফ পুনর্নির্মাণের কাজটি সমাধা করেন আব্দুল মালিক। তবে তার আগেই মুয়াবিয়ার শুরু করা টেম্পল মাউন্ট পুনর্গঠনের জটিল কাজটি প্রায় সম্পূর্ণ করে আনেন তিনি। মক্কা-মদীনার দখল না থাকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈধতা পেতে এ কাজটি করা অবশ্যকর্তব্য ছিল তার। মসজিদুল আকসার বর্তমান ভিত্তি ও কাঠামো আব্দুল মালিক ও তার পুত্র ওয়ালিদের অবদান।
আর ডোম অফ দ্য রক — কুব্বাত আস সাখরা — এটি ইসলামী স্থাপত্যকলায় একক স্থান অধিকার করলেও প্রাচীন বিশ্বে এমন স্থাপত্যের অন্য উদাহরণ রয়েছে। হয়ত সেসবের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয় আব্দুল মালিকের লেভ্যান্টাইন খ্রীষ্টান স্থপতিরা।
যেমন, জেরুজালেম ও বেথলেহেমের মধ্যে তীর্থযাত্রা চলত। সেই পুরনো রোমান পথের পাশেই ক’বছর আগে আবিষ্কৃত হয় একটি ধ্বংসাবশেষ। এটি চার্চ অফ দ্য ক্যাথিজমা। গর্ভধারী মেরী নাকি বেথলহেম থেকে জেরুজালেমে যাত্রাপথে এখানে একটি পাথরের ওপর খেঁজুর গাছের পাতা ধরে বসে বিশ্রাম নেন। সে পাথরটি আছে এখনো, তার চারপাশে দুই স্তরের চক্রাকার অ্যাম্বুলেটরি, বা হাঁটার রাস্তা। ভেতরের অ্যাম্বুলেটরি পাথর ঘিরে, আর বাইরেরটা অষ্টভূজাকার দেয়াল ধরে। অর্থাৎ হুবহু ডোম অফ দ্য রকের নকশা! কিন্তু এ চার্চটির অস্তিত্বকাল পঞ্চম খ্রীষ্টীয় শতক, অর্থাৎ আরব দিগ্বিজয়ের পূর্বে।
এ ছাড়াও প্রাক-খ্রীষ্টান পাগান কিছু টেম্পল ছিল সিরিয়ার দামেস্ক ও এডেসা শহরে। সেসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোন না কোন পবিত্র পাথর, যেগুলিকে দেবপ্রদত্ত বলে সম্মান করত স্থানীয় আরব ও আরামায়িক অখ্রীষ্টান গোত্রগুলো। অর্থাৎ সেসবেরও একটা অবচেতন স্মৃতি সম্ভবত রয়ে গেছে ডোম অফ দ্য রকের নকশায়। আর যাই হোক, ডোম অফ দ্য রকের পরিকল্পনা সাদামাটা মসজিদের নয়। হয়ত মক্কার কা’বার মতই একটি তীর্থস্থল তৈরির পরিকল্পনা ছিল আব্দুল মালিকের। পরবর্তী যুগের অনেক ইতিহাসবিদ দোষারোপ করে যে কিনি নাকি কা’বার জায়গায় ডোম অফ দ্য রককে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন। আসলে বোধহয় তা নয়। ধর্মপ্রাণ ও আলেম হিসাবে আব্দুল মালিকের খ্যাতি ছিল।
উমাইয়া বংশের পতনের পর আব্বাসী খলীফারা এই স্থাপনাগুলির ব্যাপক সংস্কার করেন। একজন এমনকি আব্দুল মালিকের নাম উঠিয়ে নিজের নাম বসিয়ে দেন নির্মাতা হিসাবে। আব্বাসীদের পরে কায়রোর ফাতিমী শিয়া রাজবংশ তিন পবিত্র স্থানের পৃষ্ঠপোষকতা করে। জেরুজালেমের খ্রীষ্টান বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারের ধ্বংসসাধনের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষিত হয়। এরপর জেরুজালেম দ্বিতীয়বারের মত খ্রীষ্টান শাসনে আসে। ক্রুসেডার রাজারা টেম্পল মাউন্টকে সলোমনের টেম্পল হিসাবে স্বীকার করে। ডোম অফ দ্য রকের ভেতরে ঝোলায় যীশু, মেরি ও সেন্টদের আইকন, আর বাইবেলের পদাবলী। আরবী কোন নকশা বা লেখার ক্ষতিসাধন অবশ্য তারা করেনি। তবে ক্রুসেডাররা পবিত্র পাথরটি থেকে স্যুভনির হিসাবে খন্ড ভেঙে নিয়ে যাবার কারণে সে জায়গাটি ঘিরে দেয়া হয়। এই টেম্পলের নামেই তৈরি হয় অর্ডার অফ দ্য নাইটস টেম্পলার।
দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডারদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হন আইয়ুবী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুর্দী সেনাপতি সালাহ উদ্দীন। আইয়ুবীদের পর আসে মামলুক, তারপর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য। বহু শতকে বহু সংস্কার হয়। এখনো নতুন কোন সংস্কারের সময় পাথরের মেঝে ভাংলেই বেরিয় পড়ে আরো বহু শতাব্দীর পুরনো নিদর্শন।
ইহুদীদের পবিত্র টেম্পলই যে এখানে ছিল তার কি প্রমাণ? সলোমনের তৈরি প্রথম টেম্পলের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন। কারণ সেটা সবচে আদি স্থাপনা। কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু সন্দেহের অতীত নয়। তবে সেকেন্ড টেম্পলের অগণিত নিদর্শন এখানে পাওয়া গেছে। ঊনবিংশ শতকে পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয় যাতে গ্রীক ভাষায় লিখিত সাবধানবাণী, এ সীমানার ভেতরে অ-ইহুদী কেউ প্রবেশ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এমন দুটি ফলক বা অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির তারিখ বৈজ্ঞানিক পন্থায় নিরূপিত হয়েছে রাজা হেরডের শাসানামলে।
মসজিদ আল আকসার দক্ষিণপশ্চিম পাশে কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে আবিষ্কৃত হয়েছে ইহুদীদের ব্যবহৃত গোসলখানা, আর টেম্পলের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনোর সিঁড়ি। দক্ষিণে রয়েছে পাথর তুলে বন্ধ করে দেয়া প্রাচীন হুলদা গেট। দক্ষিণ-পূর্বে সলোমন’স স্টেবল এলাকায় কয়েক বছর আগে ইসলামী ওয়াকফ মারওয়ানী মসজিদ তৈরি করতে গিয়ে বড়সড় খননকার্য চালায়। তার থেকে খোঁড়া পাথর-মাটির অবশেষ ফেলা হয় সীমানার ঠিক বাইরে। ইসরাইলী প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো সেই আবর্জনা ঘাঁটিয়ে চলেছেন। প্রজেক্টটির নাম টেম্পল মাউন্ট সিফটিং প্রজেক্ট। সেকেন্ড টেম্পল যুগের গিল্ডেড মোজাইক ফ্লোরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ড সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়েছে খ্রীষ্টান আমল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ইসলামী আমলেরও নিদর্শন।
জুয়িশ কোয়ার্টারে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে সেকেন্ড টেম্পলে ঢোকার জন্যে হেরডের তৈরি আর্চের ধ্বংসাবশেষ। আর ষাটের দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত মরক্কো কোয়ার্টার পরিষ্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওয়েস্টার্ন ওয়াল। সেটুকু জায়গাই এখন ইহুদীদের ক্ষুদ্র তীর্থস্থান। মোরিয়া পাহাড়ের এ অংশে পুরো কম্পাউন্ডের সাপোর্টিং ওয়াল চলে গেছে বেশ গভীরে। সন্দেহ নেই এটি হেরডের প্রতিষ্ঠিত সেকেন্ড টেম্পলেরই পাথুরে সীমানা। কাছেই রয়েছে বিতর্কিত সুড়ঙ্গপথ। ওয়েস্টার্ন ওয়ালেরই উত্তরাংশ পৌঁছানো যায় এ টানেলের মধ্য দিয়ে। এসব সুড়ঙ্গ মুসলিম কোয়ার্টারের নিচ দিয়ে গেছে। স্বভাবতই আরব-ইহুদী দাঙ্গার ইতিহাস আছে এই টানেল প্রজেক্ট নিয়ে।
বর্তমান যুগে ইসরাইল বিদ্বেষ যে পরিমাণে ব্যাপ্ত মুসলিম বিশ্বে, তেমনটা সব সময় আসলে ছিল না। আদি উমাইয়া আমলের কিছু উদাহরণ টেনেছি। একই ব্যাপার ইসলামের স্বর্ণযুগেও। ইসলামী স্বর্ণযুগ একাধারে ছিল ইহুদী স্বর্ণযুগ। ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রভৃতি মুসলিম মনীষীদের মত মুসা ইবনে মাইমুন, মুসা ইবনে নাহমান নামের ইহুদী মনীষীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অবশ্য মুসলিমদের সমপরিমাণ সম্মান আরব বিশ্বে তাদের সে সময়েও ছিল না। তারপরও দুটো সম্প্রদায় একে অপরের দর্শন ও ইতিহাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। মানুষের মাঝে বিভক্তি এখন প্রাচীন যুগের থেকেও প্রকট। যেটা দেখলাম, শুধু পশুপাখির মধ্যে সে বাছবিচার নেই। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সর্বত্র শান্তির কবুতর। তারা নির্বাধ বিচরণ করছে মসজিদুল আকসার ফাসাদেও, ডোম অফ দ্য রকের প্রাঙ্গনে। উড়ে চলে যাচ্ছে অনতিদূরে খ্রীষ্টান জগতের কেন্দ্রবিন্দু চার্চ অফ দ্য হোলি সেপাল্কারে। কোথাও বাঁধা নেই। নেই মেটাল ডিটেক্টর চেক, কিংবা সূরা পড়ার বালাই।
ঐশ্বরিক শান্তির পায়রা ডানা ছড়িয়ে মানুষকে কবে তার ছায়াতলে আনবে, শুধু সে প্রশ্নের উত্তর এখনো রয়ে গেছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।