জেসমিন ফুল

Featured Video Play Icon

মোলিহোয়া, জেসমিন ফুল, নামের এই চীনা গানটা আমার বেশ পছন্দ।

খুঁজে খুঁজেও অনেক আগে দেখা অন্য আরেকটা ক্লাসিকাল অর্কেস্ট্রা সংস্করণ পেলাম না। আজকাল চীনা সরকারের দাপটে গুগল-অ্যাপল সবাই ‘সংবেদনশীল’ ইন্টারনেট পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এ যেন আরেক কালচারাল রেভোল্যুশন!

কেন জেসমিন ফুল গানটার ভাল সংস্করণটা পেলাম না, এ ভাবতেই মনে পড়ল ২০১১তে তুনিসিয়াতে যে আরব স্প্রিংয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল জেসমিন বিপ্লব। আর তার কিছুমাত্র ছোঁয়া চীনেও লেগেছিল।

গণতন্ত্রের দাবিতে কিছু চীনা যে ইন্টারনেটভিত্তিক বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তার অন্যতম মাস্কট হিসাবে তারা এই জেসমিন ফুল গানটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। গানটা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর মধ্যে বিক্ষোভ-বিপ্লবের নামমাত্র নেই।

গানটির বিষয়বস্তু হলো জেসমিন ফুলের সুগন্ধ-সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা।

তাহলে কেন এ গান চীনের কমুনিস্ট সরকারের টনক নড়ালো? কেন গানটির শিরোনামের চীনা অক্ষরগুলি সেদেশের মোবাইল সেটে ফিল্টার করে নিষিদ্ধ করা হলো ২০১১তে? শুধু তাই না, এমনকি জেসমিন কালচারাল ফেস্টিভাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনও সে বছর বাতিল করে দেয়া হয়।

বুঝাই, ধৈর্য ধরুন।

মোলিহোয়ার উৎপত্তি চীনের চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। যে কাব্যের মাধ্যমে ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে, তার বিলাসিতা কেবল অবস্থাপন্ন বনেদী পরিবারদের পক্ষেই সম্ভব। যেকোন দেশের সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য জমিদারী পরিবার কিংবা বণিকগোষ্ঠী যে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে, সেটা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসেও ষোল আনা সত্য।

মোলিহোয়া গানটা একসময় চিং সাম্রাজ্যের বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীতও ছিল এবং পশ্চিমেও ধীরে ধীরে অপেরা পীসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। আমি যোগাযোগটা ঠিক জানি না, কিন্তু আন্দাজ লাকমে অপেরার ফ্লাওয়ার ডুয়েট (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের মিউজিক ছিল) হয়তবা, হয়তবা…. মোলিহোয়া দিয়ে প্রভাবিত।

সে যাই হোক, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। নানা ওয়ারলর্ডের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যুগের অবসান ঘটান কোমিনতাং পার্টির জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াংকাইশেক

কিন্তু তাঁর শাসনামলেই চীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম ক্যাজু্য়ালটি — ১৯৩৯এ যুদ্ধের অফিশাল শুরুর আগেই। একদিকে উত্তরপশ্চিমে মাওয়ের কম্যুনিস্ট গেরিলা, আরেকদিকে উত্তরপূর্বে জাপানের আগ্রাসন।

তারপরও চীনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক ছাত্র মার্কিন-ইউরোপ থেকে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এসে চীনা সংস্কৃতিকে আধুনিক রূপ দেন।

মার্কিনদের দীর্ঘকালীন সহযোগিতা আর মাওয়ের সাথে চুক্তি করে জাপানীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন চিয়াংকাইশেক (সোভিয়েতদের মাঞ্চুরিয়া দখল একেবারে শেষের সুবিধাবাদী ঘাত।)

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই মাও তার লংমার্চ বিপ্লব ইত্যাদি শুরু করেন। ১৯৪৯এ কোমিন্তাংওয়ালাদের তাইওয়ানে ভাগিয়ে দিয়ে মেইনল্যান্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কায়েম হয়।

প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর কম্যুনিস্ট শাসনামলে ধেঁয়ে ধেঁয়ে ভারিশিল্পের বিস্তার, শিক্ষা-চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি সাধিত হয়। নিঃসন্দেহে তা ছিল সমাজতন্ত্রী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফসল, এর বিপরীতে কী মূল্য দিতে হয়েছিল, তা না বললাম।

ষাটের দশকে মাওয়ের মাথায় ভূত চাপে যে যত দুনিয়ার ইউরোপীয় সংস্কৃতি উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে চীনা গণমানুষের সংস্কৃতি। সব পুরাতনের ধ্বংস করে গড়তে হবে নতুন ইন্সটিটিউশন।

ষাটের দশকে কালচারাল রেভোলুশনের সময় ধ্বংস করা হয় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের পুরনো পাণ্ডুলিপি আর মূর্তি।

তাঁর নামে দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিজান পাইওনিয়ার ছাত্রগোষ্ঠী। চললো মবরুল। তারা যেখানেই পশ্চিমা কিছু কিংবা চীনা চিংযুগের বা সামন্তযুগের কিছু পেলো, সব পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলল। পান্ডুলিপিহীন হলেন গবেষক, যন্ত্রবিহীন বাদ্যযন্ত্রী, ভগ্নমন্দিরের নিচে ভগ্নহৃদয় পুরোহিত।

 

কালচারাল রেভোলুশনে নিগৃহীত হন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ

এসময়ে চিংযুগের অনেক চীনা সঙ্গীতের লিপি হারিয়ে যায় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে ফেলে। কিছু অনেক পরে বেরিয়েছে আবার, বেশিরভাগই বেরোইনি।

বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬এর এই নৈরাজ্যকর সময়ে প্রচুর মানুষ বিনা কারণে বিনা বিচারে শুধু মাত্র পশ্চিমা চর বা কোমিন্তাং-চিংদরদী ইত্যাদি রাজাকারী অভিযোগের সন্দেহে প্রাণ হারায়। অনেক গবেষকের হিসাবে সে সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।

চীনা সঙ্গীতের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে। আগে পশ্চিমা কিংবা চিং প্রভাবে ‘শিল্পের খাতিরেই ছিল শিল্প’। এখন আর্ট হয়ে দাঁড়ালো ‘উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার’, তথা নিষ্পেষিত জনগণের নামে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন। আর তাও যদি না হয়, লোকসঙ্গীতকে তুলে ধরা হলো অপেরা ফর্মে — এ যেন এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ‘ওহে গ্রাম্যবালিকা, কোথা যাও একটু দাঁড়াও…’ ইত্যাদি হলো অপেরা-অর্কেস্ট্রার বিষয়বস্তু। নয়ত, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ক্ষেতে কাজ করি চল’, নয়ত টাইগার টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই নিয়ে লাফালাফির স্মৃতিচারণ।

তো এসবের মধ্যে মোলিহোয়ার মত স্বল্প কিছু পুরনো গান বেঁচে রয়েছিল। কারণ, এসব গানের কথায় নেই কোন সম্রাট-বুর্জোয়ার নাম, নেই বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আভাষ। শুধুই একটি নিষ্পাপ ফুলের গুণকীর্তন।

আর ঠিক এ কারণেই নিষ্পেষক কমুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতীক হিসাবে ২০১১তে এ গানটি বেঁছে নেয়া হয়। সে বিপ্লব বেশি দূর যায়নি। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে মোবাইল-ইন্টারনেটের সকল কলকব্জা। টের পাওয়া মাত্রই মোলিহোয়ার যাত্রাভঙ্গ।

এখনও হংকংশিনজিয়াংয়ে স্বগোত্রীয়-অন্যগোত্রীয়দের ওপর একই কলকব্জা শানিয়ে তাদের জায়গামত পুরো দিচ্ছে কমুনিস্ট রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের সুফলভোগী তাদের কোন বিকার নেই। কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, কবে জেসমিন ফুল মোলিহোয়ার মুক্তি আসবে চীনে।

পুরানো সেই দিনের কথা…

Featured Video Play Icon

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”

রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।

রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।

সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।

আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।

পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।

সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে ‌অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।

এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।

এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।

আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। ‌এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। ‌অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।

শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।

আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!

অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!

কিংডম অফ গড

Featured Video Play Icon

বড়দিনের শুভেচ্ছা সবাইকে!

মার্কিন দেশের মানুষ আজকাল মেরি ক্রিসমাস না বলে অনেক সময় হ্যাপি হলিডেজ বলে সম্ভাষণ করে। উদ্দেশ্য, যারা খ্রীষ্টান নয়, তাদের অনুভূতিতে আঘাত না দেয়া। আর মেরি ক্রিসমাস বললে উল্টো যদি কথা শুনতে হয়, ‘আমি তো খ্রীষ্টান নই’? ভিনদেশী চেহারার হলে তো কথাই নেই। আর কিছু মুসলিম ও ইহুদী আসলেই এ ব্যাপারে একটু স্পর্শকাতর। যাই হোক, মার্কিনরা আপনাকে জোর করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাধ্য করবে না।

আমার অবশ্য মেরি ক্রিসমাস সম্ভাষণ শুনতে ও ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগে না। ক্রিসমাসের উপলক্ষ্যে ছুটি তো আর যেনতেন হলিডে না। সমঝদারদের কাছে সেক্যুলার ছুটি আর স্পিরিচুয়াল ব্রেক একরকম নয়। রিল্যাক্স করার সুযোগ যখন একটু পেয়েছি, স্পিরিচুয়াল একটা ব্রেক হোক সানন্দে।

ডিসেম্বরের ২৫শে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আসলে সম্ভবত হয়নি। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডিসেম্বরের ২৫ দক্ষিণায়ণের দিন, উত্তর গোলার্ধ সূর্য হতে তার সবচে দূরপ্রান্তে গিয়ে আবার ফিরে আসা শুরু করে। অর্থাৎ দীর্ঘরাত্রির পালা শেষ, দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, উষ্ণতা ফিরে আসা শুরু করে ‘পৃথিবীতে’। সাথে আসে বসন্ত ও প্রকৃতির প্রাচুর্য। খ্রীষ্টের জন্মের আগ থেকেই এ দিনটি তাই অনেক প্যাগান ধর্মানুসারীদের, বিশেষ করে রোমানদের কাছে ছিল পবিত্র। এ হলো প্রকৃতির পুনর্জন্ম।

ভার্জিন মেরীর থেকে যীশুর সতীজন্ম ব্যাপারটাও পুরনো আইডিয়া। বিশেষ করে গ্রীক মিথে জিউসের জন্ম একই রকম। এমনকি গৌতমবুদ্ধের জন্মও মায়াদেবীর বুকের পাশ থেকে, অর্থাৎ হৃদয় হতে। তাঁর জন্মও সাধারণভাবে হয়নি।

প্রাচীন মিশরের দেবী আইসিস, অনিষ্টের দেব সেথের ষড়যন্ত্রে নিহত স্বামী অসাইরিসের মৃতদেহের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে লেবাননের রাজপ্রাসাদ থেকে ফেরার পথে দুঃখের আতিশয্যে তাঁকে আলিঙ্গন করেন। আর তার ফলে ‘সতীজন্ম’ হয় দেবতা হোরাসের। মাতা মেরীর কোলে বসা শিশু যীশু যেমন নতরদামসহ নানা গীর্জায় মূর্তিআকারে শোভা পাচ্ছে, আইসিসের ক্রোড়ে মাতৃদুগ্ধপানরত হোরাসের একইরকম ভাস্কর্য বিশ্বের সকল জাদুঘরের প্রাচীনমিশরীয় সেকশনে ভূরি ভূরি রয়েছে। তার কোনকোনটিতে আবার অসাইরিস এসে যুক্ত হয়ে হোলি ট্রিনিটি সম্পূর্ণ করেছেন।

ডায়োনাইসাস বলে এক গূঢ়দেবের উপাসনাও প্রচলিত ছিল যীশুর আগে একই এলাকায়। তাঁর জন্মও ভার্জিন বার্থ। ডায়োনাইসাসের উপাসকরা যেধরনের মিস্টিসিজম বা গূঢ়তত্ত্বের চর্চা করত, তা সুফীবাদ বা বাউলদর্শনের আদিমরূপ ধরলে ভুল করা হবে না। তাদের সেসব মিস্টিক ব্যাপারস্যাপার গ্নস্টিক নামক আদি খ্রীষ্টানদের মাধ্যমে আর্লি ক্রিস্টিয়ানিটিতে এসেছিল, যার অনেক কিছুর ছায়া বর্তমানেও রয়ে গেছে। তার একটা হল কম্যুনিয়ন, যেখানে ক্যাথলিকরা রুটি ও ওয়াইন খায় যীশুর রক্ত-মাংসের প্রতীক হিসাবে, কারণ তা ভক্ষণের মাধ্যমে যীশুর আত্মিক গুণ প্রবেশ করে তাদের আত্মায়, অথচ বলা হয় উল্টো যে তারা প্রবেশ করছে কিংডম অফ গডে। মিশরের নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত গস্পেল অফ টমাসের পান্ডুলিপিতে অনেক কিছু ম্যাথু-মার্ক-ল্যুক-জনের থেকে আলাদা এবং গূঢ়তাত্ত্বিক, কারণ তা ছিল গ্নস্টিকদের মিস্টিক বাইবেল।

অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের দৈব উপায়ে জন্মসহ অন্যান্য অনেক ব্যাপারস্যাপার সে যুগের মানুষের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তেমন কোন নতুন আইডিয়া না নিয়ে এসেও খ্রীষ্টধর্ম এতকিছুর মধ্যে কিভাবে নিজের আলাদা একটা জায়গা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল? অনেকে রোমসম্রাট কনস্ট্যানটিনের দিকে আঙুল তুলে দেখাবেন, কারণ তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করাতেই সে ধর্মবিশ্বাসের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা পায়।

আমার হিসাবে তা শুধু একটিমাত্র কারণ। কনস্ট্যানটিন খ্রীষ্টান হয়েছেন, সেও যীশুর জন্মের তিনশ’ বছর পর। এত শতাব্দী ধরে নানা বিশ্বাস আর ধর্ম আর রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়রানির মধ্যে খ্রীষ্টানরা তো হারিয়ে যেতে পারত। তা তো হয়নি।

খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম আঁকড়ে ধরে রেখেছিল কারণ ক্রিস্টিয়ানিটির বিশ্বাস এমন একটা মানবিক গুণের পরিপূর্ণ অর্থবহতা তাদেরকে দিয়েছিল, যেটা অন্যান্য সমসাময়িক ধর্মে গতানুগতিকভাবে শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় আচারপালনের মাঝে হারিয়ে গেছিল। সে মানবিক গুণটা হলো কমপ্যাশন — করুণা, পরদুঃখকাতরতা যেই শব্দ দিয়েই বলুন না কেন, মনে মনে বোধ না করলে অর্থ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।

লাভ ইয়র এনেমিজ, ডু গুড টু দোজ হু হেইট ইউ, ব্লেস দোজ হু কার্স ইউ, প্রে ফর দোজ হু মিসট্রীট ইউ — এ কথাগুলো শুধু যীশু বলেননি। একই বাণী যুগে যুগে গৌতমবুদ্ধসহ আরো অনেকে দিয়ে গেছেন। এসকল স্ববিরোধী উপদেশের কারণ কি? কারণ, মানবস্বত্ত্বা একক, যখন এক মানুষ আরেককে আঘাত করে, সে তা করে নিজেকেই। এটা কেবল একটি মাত্রা। এসবের অর্থ যে আবার ওম শান্তি বলে দুনিয়া থেকে পলায়নপর হওয়া, তাও নয়। এসবের ‌অর্থ শত দুর্দশা-বিপত্তি-দুঃখ-জরায় জর্জরিত হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের মনের নৈতিক দ্বন্দ্বগুলোকে সামঞ্জস্যে আনা। নিজেকে হারমোনাইজ করা, চক্রের আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে চক্রের মাঝে স্থির থাকা। মিডল পাথ ইজ দ্য বেস্ট পাথ।

সুতরাং যীশুর সতীজন্ম আসলে কমপ্যাশনের জন্ম — সাধারণ জন্ম নয়। ঈশ্বরের উচ্চারিত দৈব প্রেরণার মাধ্যমে স্পিরিচুয়াল রিবার্থ। পশুপ্রকৃতিকে বশ করে শুচি মানবরূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ। খ্রীষ্ট-বুদ্ধসহ যুগে যুগে যত ‘নবী’, ‘দেবদেবী’, পুরাণের বীরপুরুষদেরকে মানুষ রাজাসনে বসিয়েছে, সবাই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে সে আসনের যোগ্যতা লাভ করেছেন। খ্রীষ্টানদের আত্মিক মুক্তির পথে যীশু ভেহিকল বা যান মাত্র। আবার বৌদ্ধধর্মে যে কোন সাধারণ মানুষও নিজ পথে বুদ্ধ হবার আর নির্বাণপ্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ যেকোন সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব আধ্যাত্মিক ‘পুনর্জন্মলাভ’।

ইসলামধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ীও ঈসানবীর সতীজন্ম। আর হযরত মুহাম্মদের(সা) এরকম একটা স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটার উপরে খুব বেশি গুরুত্ব খুব একটা দেয়া হয়না, যদিও কোন কোন সুফী তরিকায় সে ঘটনা বেশ অর্থপূর্ণ। সেটা হল ফেরেশতা জিবরাইলকর্তৃক চারবার মুহাম্মদের বক্ষবিদারণ আর হৃদয় প্রক্ষালন

যীশুর ‘সতীজন্মের’ কারণে তিনিই সেই ব্যক্তি হলেন যিনি নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগ করলেন, ক্রুসিফিকশনের মাধ্যমে আত্মার আরেক সমতলে পৌঁছে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন দুঃখজরা থেকে মুক্তির উপায়। সে সমতলে তিনিই রাজা, কিং অফ কিংস, লর্ড অফ লর্ডস। শুধু ইহুদীদের নয়, সকল চৈতন্যময় উপলব্ধির রাজা, কিং অফ অল কনশাসনেস। সাথে দেয়া ভিডিওতে জর্জ হেন্ডেলের মেসিয়া ওরাটোরিওর হালেলুইয়া কোরাসে সেই ‘রাজার’ মহিমাকীর্তন করা হচ্ছে — ২৭৭ বছর পরেও ক্রীসমাসে এটা এখনও বেশ জনপ্রিয় ক্লাসিকাল সংগীত।

আপনার-আমার-সবার স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হোক, মনের চোখ খুলুক, হৃদয় নিষ্কলঙ্ক হোক — নিজ অন্তরকে জয় করে যেন সকলে হতে পারি মনের ‘রাজা’! মেরি ক্রীসমাস!

ইথিওপিয়ার রাজা আবরাহার ৩৩৫ থেকে ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি মেকেল্লে শহরের আব্রাহা গীর্জার ম্যুরালে শিশু যীশুকে স্তন্যদানরত মাতা মেরীর ছবি। ইসলামের ইতিহাসে একই নামের আরেক ইথিওপীয় রাজা আছেন যার আরব উপদ্বীপে আক্রমণের নেপথ্যে সূরা ফীল নাযিল হয়!
পুত্র দেবতা হোরাস মাতা আইসিসের কোলে বসে স্তন্যপান করছেন। ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এই স্ট্যাচুয়েটটি ৬৬৪ থেকে ৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন মিশরে তৈরি।
দেবী আইসিস ডানে, বামে হোরাস, মাঝে অসাইরিস। এরকম ট্রিনিটি বা ত্রিমূর্তির কনসেপ্ট হিন্দুধর্মেও রয়েছে। ফাদার-সান-হোলিগোস্ট্র খ্রীষ্টান ট্রিনিটি এই ত্রিমূর্তির অ্যাবস্ট্রাক্ট ইন্টারপ্রেটেশন।
মিউনিখের গ্লিপ্টোতেক মিউজিয়ামে শিশু ডায়োনাইসাসকে কোলে নিয়ে তাঁর রক্ষক ও উপদেষ্টা সাইলেনাসের মূর্তি। ভাস্কর্যটি চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকে ক্লাসিকাল গ্রীক যুগের শিল্পী লিসিপাসের তৈরি।
তৃতীয় শতকে তৈরি কন্সট্যান্টিন দ্য গ্রেটের প্রস্তরমূর্তি। কন্সট্যান্টিনের মা হেলেনা ছিলেন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান। কন্সট্যান্টিন তাই ছোটবেলা থেকে সেধর্মের বিভিন্ন ব্যাপারস্যাপার দেখে আসছিলেন। কিন্তু তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন মৃত্যুশয্যায় এসে। তার আগ থেকেই অবশ্য হেলেনা ও কন্সট্যান্টিন নানাভাবে খ্রীষ্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তার বিপরীতে তাঁর উত্তরসূরী রোমসম্রাটরা ছিলেন খ্রীষ্টানদের প্রতি যারপরনাই নির্মম। নিরোর সময় হাজারে হাজারে খ্রীষ্টানদেরকে জনতার বিনোদনের উদ্দেশ্যে ‘সার্কাসের’ ময়দানে হিংস্র জানোয়ারদের খাওয়ানো হয়। কনস্ট্যান্টিন খ্রীষ্টান হবার বারো বছর আগেই খ্রীষ্টান ধর্মগুরুদের আদেশ দেন কাউন্সিল অফ নিকায়ার মাধ্যমে ধর্মটিকে যথার্থ সাংগঠনিক রূপ দিতে। ক্যাথলিক ও অর্থডক্স ধর্মের যাত্রা শুরু হবে, কিন্তু এর ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ্রীষ্টান গোষ্ঠীর নিজস্ব আচার ও ধর্মবিশ্বাস অবদমিত হয়।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা যীশু খ্রীষ্টের লাস্ট সাপারের দৃশ্য যেখানে তিনি তাঁর বারো শিষ্যকে তাঁর নিজ শরীরের রক্ত-মাংস ভক্ষণ করার নিমন্ত্রণ দিচ্ছেন, যদিও তাঁরা খাচ্ছেন রুটি ও ওয়াইন। এর থেকেই হোলি কম্যুনিয়ন বা ইউক্যারিস্ট রিচুয়ালের উৎপত্তি।
প্যাপিরাসের উপরে কপ্টিক ভাষায় লেখা গস্পেল অফ টমাসের একটা কপি কাকতালীয়ভাবে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা একটি জারে খুঁজে পায় মিশরীয় এক কৃষক, ১৯৪৫ সালে। টমাস ছিলেন যীশুর বারো শিষ্যের একজন। প্রধান চার শিষ্যের যে গস্পেলগুলি নিয়ে নিউ টেস্টামেন্ট, তাদের থেকে এটির বিবরণী একটু ভিন্ন। কিছু স্কলার আবার কোরানের কোন কোন অনুচ্ছেদের সাথে এর অংশবিশেষের মিল খুঁজে পেয়েছেন। ধারণা করা হয়, চতুর্থ খ্রীষ্টীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান পুরোহিত আথানাসিওসের নির্দেশে এ গস্পেল মাটিচাঁপা দেয়া হয়। আথানাসিওস সম্রাট কনস্ট্যান্টিনের খ্রীষ্টধর্মগ্রহণের পরে সে ধর্মকে ইন্সটিটিউশনাল রূপ দিতে বহু কঠোর সংস্কারসাধন করেন। ট্রিনিটির আইডিয়াটিকে গ্রহণ করা হয়, আর যেসব তত্ত্বে যীশুকে স্বয়ং ঈশ্বর স্বীকার করা হত না, তাদেরকে অ্যাপোস্টেট বা কাফের আখ্যা দেয়া হয়। এই দলের মধ্যে ছিল বিশপ আরিয়ানাসের আরিয়ান স্কুল। বেশিরভাগ গথ ও অন্যান্য ‘বর্বর’ জাত আরিয়ান চিন্তাধারার খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল।
হালেলুইয়া টাইবেরিয়ান হিব্রু শব্দ যার শব্দমূল দুটি। হিল্লেল মানে প্রশংসা, ‘ইয়া’ খোদা ইয়াৰের আরেক নাম। অর্থাৎ প্রেইজ বি টু গড, সকল প্রশংসা খোদার, আলহামদুলিল্লাহ। হিব্রু বাইবেলের বুক অফ সামসে কয়েকবার এ শব্দ এসেছে। বুক অফ সামসের গানগুলি ডেভিড বা দাউদের নামের সাথে জড়িত। অর্থাৎ হয়তবা দাউদের ওপর নাযিল হওয়া যবুর কেতাবের অংশ। যদিও প্রাচীন মিশরে সামসের গানগুলির প্রায় হুবহু একই গীতি ফারাও আখেনাতেনের শাসনামলে একেশ্বর আতেনের উদ্দেশ্যে রচিত হয়।
ষোড়শ শতকের তুর্কী মিনিয়েচার শিল্পীরা ইসরা বা মিরাজ কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। মিরাজ হলো হযরত মুহাম্মদের অলৌকিকভাবে বুরাকের পিঠে প্রথমে জেরুজালেমযাত্রা, তারপর সাত আসমান পাড়ি দিয়ে স্বর্গ-নরক পরিভ্রমণ, খোদা ও অন্যান্য পয়গম্বরদের সাথে মোলাকাত। সেযাত্রায় আল্লাহ তাঁকে দেন তাঁর প্রাপ্য কমান্ডমেন্টস, ঈমান-নামাজ-রোজা-হজ্জ্ব-জাকাত ইত্যাদির নির্দেশ। যাত্রাশুরুর আগে ফেরেশতা জিবরাঈল চতুর্থ ও শেষবারের মত তাঁর বুক চিরে হৃদয়ের পরিশুদ্ধি করেন। ডানের দৃশ্যে তাই চিত্রিত হয়েছে। যথারীতি মুহম্মদের মুখমন্ডল দেখানো হয়নি, যাতে তাঁর চিত্র পূজোর বস্তুতে পরিণত না হয়ে যায়। কারণ ঈশ্বরই একমাত্র সকল উপাসনার উদ্দেশ্য।
ল্যুক ৬:২৭। ষষ্ঠ চ্যাপ্টারে সারমনস অন দ্য প্লেইনসে যীশু তাঁর জীবনাদর্শগুলি পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরেছিলেন শিষ্যদের কাছে। ‘লাভ দাই এনেমিজ’এর সাথে আরো রয়েছে ‘জাজ নট, অ্যান্ড ইউ শ্যাল নট বি জাজড’ আর ‘ফরগিভ অ্যান্ড ইউ উইল বি ফরগিভেন’।

 

বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য

Featured Video Play Icon

গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।

ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!

এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।

এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।

এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা

কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অ‌গ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।

সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।

ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।

দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।

পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।

এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।

আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেল ডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিক গথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁওহিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।

অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।

পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।

উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।

বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।

এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।

স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।

কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল

বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।

ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।

লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!

আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।

ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।
জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।
বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।
৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।
দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।
ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।
জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।
জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।
১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।
মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই এক‌ই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।
গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)
১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)
১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।
ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।
জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।
বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।

থ্যাংকসগিভিংয়ের মার্কিন ঐতিহ্য

Featured Video Play Icon

আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হবে থ়্যাংকসগিভ়িং নামে রাষ্ট্রীয় ছুটি। প্রতি নভ়েম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার এ দিবস পালিত হয়। পরেরদিন শুক্রবারও অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। শুধু ব্যস্ত থাকে শপিং মল। ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত এ দিনে দোকানপাটে আপনি পাবেন বছরের সবচে’ বড় ছাড়। বিশেষ করে যারা দামী ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী কিনতে চান, তাদের তো পোয়াবারো! অনেক শহরে রঙচঙে ফ্লোট বা সজ্জিত ভেলাসহকারে মার্চিং ব্যান্ডের তালে তালে বেসামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচে’ নামকরা হলো নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে মেইসিজ় বলে চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের আয়োজিত মেইসিজ় থ়্যাংকসগিভ়িং প্যারেইড

মার্কিনদের জন্যে বড়দিনের মত থ়্যাংকসগিভ়িংও পারিবারিক পুনর্মিলনীর একটা বড় সুযোগ। মায়ের তৈরি (বা পছন্দ করে কেনা!) ক্র্যানবেরি সস, ম্যাশড পটেটো, গ্রেভ়ি, স্প্রাউটস, সুইট কর্ন, গ্রীনবীন ক্যাসরোল, পামকিন পাই আর ঐতিহ্যবাহী স্টাফ়ড টার্কী খেতে ছেলে-মেয়েরা দূরদূরান্তের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তাই এয়ারপোর্ট-হাইওয়েগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মানুরাগী পরিবারদের থ়্যাংকসগিভ়িং ডিনার শুরু হয় ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের ‘গ্রেইস’ প্রার্থনার মাধ্যমে। খাবার পর রাতে সবাই বের হয়ে পড়ে, দোকানপাটের লাইনে দাঁড়িয়ে যায় ‘ডোরবাস্টার ডীল’ ধরার লোভে!

ক’দিন আগে বলছিলাম যে অক্টোবর শেষের হ্যালোউইন আসলে একটি নবান্ন উৎসব বা হারভ়েস্ট ফ়েস্টিভ্যাল। থ়্যাংকসগিভ়িংএর মূলও নবান্নের মধ্যেই! কিভাবে বুঝিয়ে বলি।

চারশ’ বছর আগে, ১৬২০ সালে, মেফ্লাওয়ার নামক এক জাহাজে করে প্রায় একশ’ ‘পিলগ্রিম’ নারী-পুরুষ-শিশু ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পিলগ্রিমরা ছিল ক্যালভ়িনিস্ট প্রটেস্ট্যান্ট খ্রীষ্টানদের একটি গোত্র — এরা ক্যাথলিকদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস তো মানতই না, এমনকি ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট অ্যাংলিকান চার্চের আনুষ্ঠানিকতাতেও তাদের আপত্তি ছিল। নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীন চর্চার লক্ষ্যে তারা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে।

আমেরিকার দক্ষিণে আরামদায়ক ভার্জিনিয়া কলোনিতে যাবার কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারা উত্তরপূর্বের বর্তমান ম্যাসাচুসেটস স্টেটের প্লিমথে নোঙর ফেলতে বাধ্য হয়। যথেষ্ট খাবার মজুদ তাদের ছিল না, আর শীতের সময় বুনো ফলমূলেরও অভাব ছিল। ফলে ঠান্ডায়-অপুষ্টিতে দলটির সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর প্রায় অর্ধেক মারা যায়।

পিলগ্রিমদের নতুন পড়শী ওয়াম্পানোগ ট্রাইবের নেটিভ় আমেরিকানদের সাথে প্রথম প্রথম কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত দু’দলের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিষ্পত্তি হয়। ওয়াম্পানোগরা তাদের মজুদ ভান্ডার থেকে ভুট্টা, শিকারকরা পশুর মাংস, ইত্যাদি দিয়ে পিলগ্রিমদের সাহায্য করে।

শীত শেষে পিলগ্রিমরা নেটিভ়দের কাছ থেকে স্থানীয় জীবনযাত্রার শিক্ষাগুলি নিয়ে চাষাবাদ করে আর তাদের ফসলের ভালো ফলন হয়। সে এলাকায় টার্কী আর বুনো মুরগীর মত পাখিরও প্রাচুর্য ছিল। নবান্নে তাই পিলগ্রিমরা ওয়াম্পানোগদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। আর তাদের কাছ থেকে শীতের সময় নেয়া খাবারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়।

তিনদিনব্যাপী সেই মহাভোঁজে ওয়াম্পানোগরাও হরিণ শিকার করে নিয়ে আসে। ৯০জন নেটিভ় আর ৫০জন পিলগ্রিম মিলে সব খাবার ভাগাভাগি করে খায়। রান্নার দায়িত্বে ছিলেন পিলগ্রিমদের দলের চার মহিলা। ইতিহাসবিদদের ধারণা এ ভোঁজটি হয় ১৬২১এর অক্টোবরের শেষে, মানে হ্যালোউইনের ধারকাছ দিয়ে। অবশ্য পিলগ্রিমরা হ্যালোউইন-ক্রীসমাসের আনুষ্ঠানিকতা মানতো না।

প্লিমথে বসতির গোড়াপত্তনের পরে প্রায় নিয়মিত এই বাৎসরিক ভোঁজ আয়োজন করা হত, তারিখটা স্থির ছিল না। বিশেষ করে ১৬২৩এ খরার কারণে পিলগ্রিমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা খোদার কাছে প্রার্থনা করে, রোজা রাখে। তারপর ‘অলৌকিকভাবে’ দু’সপ্তাহ টানা বৃষ্টি হওয়ায় তাদের ফলন বিপন্মুক্ত হয়। সেবার তাদের থ়্যাংকসগিভ়িং ভোঁজ তাই ছিল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

এরপর শতবছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে পিলগ্রিমদের উত্তরসূরীরা থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। ১৭৭৭এ আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে হবু রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন একে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী সরকারী ছুটির স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফ়ারসন অবশ্য রাষ্ট্রীয় আর ধর্মীয় বিধানের পৃথকীকরণের যুক্তিতে থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ছুটি ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। পাকাপোক্তভাবে ছুটিটি আবার চালু করেন এব্রাহাম লিংকন।

তারিখটা নিয়ে অবশ্য একটু শোরগোল তুলেছিলেন ফ্র্যাংকলিন রোজ়াভ়েল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি নভ়েম্বরের শেষ পঞ্চম বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে চতুর্থ বৃহস্পতিবার (এ বছরের মত!) ছুটি ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যাতে ক্রীসমাস শপিংয়ের জন্যে একটা সপ্তাহ বেশি পাওয়া যায় — তাতে বিক্রিবাট্টা বেড়ে যদি গ্রেট ডিপ্রেশনের মন্দার অর্থনীতিটা একটু চাঙা হয়। এ ব্যাপারটা অনেক রিপাবলিকান মানতে পারেনি। পরে কংগ্রেস আইন করে চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছুটির দিন স্থির করে দেয়।

থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের সাথে মার্কিনদের দানশীলতার একটা ঐতিহ্যও জড়িত। ক্রীসমাসের একমাস আগে থেকে সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান মাঠে নেমে পড়ে তহবিল সংগ্রহের জন্যে। ছুটির আমেজে সাধারণ মানুষও থাকে দরাজদিল। শপিং করে মল থেকে বেরুনোর পথে ঘন্টি-বাজানো অর্থসংগ্রহকারীর সাজানো বালতিতে দু’-চার ডলার ফেলে দিতে কসুর করে না অনেকে — হোক সে অসুস্থ-অনাথ শিশুদের হাসপাতালের জন্যে, কিংবা যুদ্ধাহত অথর্ব সৈনিকের কল্যাণার্থে , অথবা হয়ত গৃহহীন মানুষের খাদ্যসংস্থানের ফ়ুড ড্রাইভ়ের জন্যে।

অনেক নেটিভ় আমেরিকান কলাম্বাস ডে’র মত থ়্যাংকসগিভ়িংকেও মনে করে তাদের জাতির ওপর অত্যাচারের ইতিহাসের অবমাননা হিসাবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, নেটিভ়দের ওপর গতানুগতিক নিষ্পেষণ তুলনামূলক অধুনার ঘটনা — ঊনবিংশ শতকের প্রায় পুরোভাগ জুড়ে। আর সেসময়টাতে নেটিভ়দের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা ছিল বিভক্ত, অসংগঠিত — যার সুযোগ নেয় শ্বেতাঙ্গ র‍্যাঞ্চার, কাউবয় আর আউটল’রা। কিন্তু তারও আগে নেটিভ়রা ব্রিটিশ-ফরাসী-আমেরিকান সব পক্ষে তাদের সমকক্ষ হয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পিলগ্রিমদের সাথে ওয়াম্পানোগদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনই নেটিভ়দের অন্য ট্রাইব কর্তৃক ভার্জিনিয়াতে সেটলারদের পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও ইতিহাস আছে। আর যদি ইউরোপীয়রা তাদের জমি চুরিই করে থাকে, তাহলে তো আমাদের আর্য-আরব-পারসিক পূর্বপুরুষরাও ইউরোপীয়দের মতই জবরদখলকারী — যাঁরা বাংলার সাঁওতাল, অস্ট্রোনেশিয়ান আদিবাসীদের আবাসভূমি বেদখল করেছিলেন — কতটুকু ছলে-বলে-কৌশলে সে কারো মনে নেই, কারণ সে ঘটনা ‌অধুনার নয়। বর্তমানের মূল্যবোধ দিয়ে অতীতের ‘অপরাধের’ বিচার করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আর নেটিভ় আমেরিকানদের বর্তমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সাড়ম্বরে থ়্যাংকসগিভ়িং উদযাপন করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডেকে অফিসিয়ালি কিন্তু ডাকা হয় নেটিভ় আমেরিকান হেরিটেজ ডে’ নামে।

শেষ করি এই লেখার জুড়ি গানটা নিয়ে কিছু কথা বলে। গানটা আইরিশ গেলিক ভাষায়, গেয়েছেন ময়রা ব্রেনান, প্রখ্যাত নিউ এইজ শিল্পী এনিয়ার বোন। এটি কিন্তু বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অফ় সামসের একটি সাম বা প্রার্থনাগীতি — ক্যাথলিকরা মাসের সময় এরকম গান গেয়ে খোদার প্রশংসাকীর্তন করে। বেশির ভাগ প্রটেস্ট্যান্টরা অবশ্য মাস পালন করে না, কিন্তু পিলগ্রিমরা মাস না করলেও সামগীতি গাইত বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এখনও থ়্যাংকসগিভ়িং থ়ার্সডে’র আগের বা পরের রোববার মার্কিনের চার্চগুলিতে বিশেষ থ়্যাংকসগিভ়িং প্রার্থনা হয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করলেও থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের প্রার্থনার মূল লক্ষ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

আমার কাছে ময়রা ব্রেনানের থ়্যাংকসগিভ়িং সামের সুর ও কথা দু’টিই খুব হৃদয়ছোঁয়া মনে হয়। প্রার্থনাকারীরা বলছেন: “ঈশ্বর, আমাদের করুণা করুন, আশীর্বাদ দিন।। পৃথিবীর সকল জাতি গাইছে আপনার প্রশস্তি।। সকল গোত্রের ন্যায়বিচারক, পথপ্রদর্শক আপনি।। এ ভূমির ফলন্ত ফসল আপনার আশীর্বাদ।। সকল দেশের মানুষের সকল প্রশংসা আপনার।।” সোজা আরবীতে: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বুল আলামীন, আর্ রাহমানির রাহীম — কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফ়াত়িহ়ার প্রথম দু’টি পংক্তি!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!