বিভিন্ন কালচারে প্রাচীনকালে নরবলির প্রথা চালু ছিল। এ নিয়ে একটু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে চাই। এর থেকে পাঠক ইতিহাসের ‘অপরাধ’গুলিকে ‘ফাস্ট ফুড’ স্টাইলে মূল্যায়নের আগে ভালভাবে সেগুলির পরিস্থিতি যাচাই করার ব্যাপারে একটু শিক্ষালাভ করতে পারেন।
অনেক ধর্মে এখনো পশুবলির প্রথা আছে। ইসলামে গবাদিপশু কোরবানীকে আধুনিকচিত্তের অনেক মানুষ দেখেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসাবে। মনে রাখা দরকার, ইসলামে পশু কোরবানীর লক্ষ্য শুধুমাত্র খাদ্য নয়, বরং নিজের প্রিয় কোন প্রাণীকে নিজ স্বত্ত্ব পরিত্যাগ করে, মায়া ভুলে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা।
হ্যাঁ, আজকের মূল্যবোধের হিসাবে এটা অমানবিক হতে পারে। কারণ আমাদের গোয়াল থাকলে গোয়ালে এখন হাজারো পশু, আলাদা করে একটা প্রিয় পশু সেরকম আর নেই। আর গোয়াল যাদের নেই, তাদের আর পশুর প্রতি মায়াই জন্মাবে কোত্থেকে! অর্থাৎ আসল উপলক্ষ্য থেকে কোরবানীর ব্যাপারটা অনেক দূরে চলে এসেছে, শুধু হয়ে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতা।
তাবৎ হিউমেইন সোসাইটি সদস্যদের এ ভেবে একটু বাস্তববাদী হওয়াটা বোধহয় দরকার যে, যখন পশুবলি প্রথা ইসলাম, খ্রীষ্টান আর ইহুদীধর্মের কুলপিতা ইব্রাহিম বা এব্রাহাম চালু করছেন, তখন তিনি যে প্রাচীন রীতিটার সংস্কারসাধন করছেন সে হল নরবলি! This triggers the tooltipইসমাঈল হোন কিংবা আইজ়্যাক, তিনি নিজেই রাজি ছিলেন এতে, কিন্তু বেঁচে গেলেন ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে এক মেষ দিয়ে স্থানান্তরিত করার কারণে।
এ রূপকথা নয়! জাতিগত স্মৃতির অবশেষ রয়ে গেছে শিক্ষামূলক ‘কিংবদন্তীর’ মধ্যে। ইহুদী ধর্মের সবচে’ বড় সংস্কার হয়েছিল সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নবী দ্বিতীয় ইসাইয়ার আমলে। এসব লেজেন্ডের তখনই উৎপত্তি ‘নতুন’ মূল্যবোধের জাস্টিফিকেশন হিসাবে। সেসময়েই ইহুদীদের ‘ইহুদী’ হয়ে ওঠা। এর পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠীকে ইহুদী না বলে হিব্রু বলা সমীচীন। হিব্রুদের রাজ্যে নরবলি চালু ছিল, আর তাদের রাজারা নিজেদের সন্তানকেই তাদের দেবের উদ্দেশ্যে অগ্নিআহুতি দিত গেহেন্না বলে এক উপত্যকায় — পরবর্তীতে অভিশপ্ত ঘোষিত এই উপত্যকার নাম আর আরবী জাহান্নাম একই শব্দ।
তো এ ধরনের বলিদান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসেই নেই, কালীসাধনার পাঁঠাবলির মূল নরবলিতে। প্রাচীন মিশর, গ্রীসেও একই জিনিস ছিল। আমেরিকাতে তো এই সেদিন, পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দেও অ্যাজ়টেক, মায়া আর অন্যান্যরা পিরামিডের শীর্ষ থেকে মনুষ্যরক্তের বন্যা নামিয়ে দিত।
ফাস্টফুড ইতিহাসবিদরা দ্রুত দেখেশুনে ড্রাইভবাই শুটিং করে যাবেন: ওরা ছিল বর্বর, অনুন্নত; কিংবা তারা ছিল ধর্মান্ধ, সাধারণের সুযোগ নেয়া রাজা আর হুজুরের দল।
কয়েকটা সিম্পল প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে আমার আর্জি: কেন নরবলির সময় বহুক্ষেত্রে শিশুদের বেঁছে নেয়া হত, মানুষ কি এতই অমানুষ? আবার সেসব শিশুর বেশিরভাগই রাজ্যপালের বা পুরোহিতের সন্তান? অ্যাজ়টেকরা হয়ত যুদ্ধবন্দীদের মারত। কিন্তু তাদের না মেরে দাস বানিয়ে গতরখাঁটা কাজ করালেই তো তাদের আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হত।
বুঝতে হলে আপনাকে বহুদিন ধরে বহু দিক থেকে লেখা বহু ইতিহাস পড়ে একটা পরিপূর্ণ কম্প্রেহেনশন আনতে হবে। অথবা অন্ততপক্ষে অবজ়ার্ভার হিসাবে নিজেকে চিন্তা না করে ভাবুন আপনি সে আমলের একজন মানুষ। ভাবুন আপনার দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলি কি হতে পারে, সারভাইভালের জন্য আপনার কী কী দরকার। এ যুগে এধরনের কল্পনা খুব কঠিন কাজ, কারণ আমরা একটা কমপ্লেসেন্ট জেনারেশন — খাদ্য, পোশাক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অ্যাক্সেস, টেক, কোন কিছুর অভাব নেই, আছে উদ্বৃত্ত! তাই আমাদের বাঁধে না নিজেদের মাপকাঠিতে অন্য দেশ-কাল-কালচারের বিচার বসাতে।
আমি একটু চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা। প্রাচীন মানুষ হিসাবে আপনি হতে পারেন পঞ্চাশ থেকে একশ’ মানুষের ছোটখাট একটা দলের নেতা। জাতিদেশের কনসেপ্ট তখনও শুরু হয়নি। জীবিকানির্বাহ হয় শিকার করে, নয়ত প্রাথমিকস্তরের কৃষিকার্য করে। প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। হয়ত পাঁচটা বছর ভাল শিকার জুটলো বা ফলন হলো, তারপর শুরু হলো মন্দা।
খাবার রেশনিং শুরু হলো। কিন্তু পরের বছরও মন্দা। কোনরকমে টেনেটুনে চলছে। কিন্তু জনতা ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আপনার কাছে বা পুরাহিতের কাছে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই — কেন এমন হচ্ছে। বিজ্ঞানের ব’ও জানা নেই । প্রথম যেটা মনে হতে পারে যে প্রকৃতির কোন দৈবশক্তি আপনার বা আপনার গোত্রের ওপর ক্রোধান্বিত। সুতরাং সেই দেবের ক্রোধপ্রশমন করতে হবে। আপনার বউ রাগলে আপনি কী করেন? ফুলের গোঁছা? জুয়েলরি গিফ্ট? হয়ত একটা ডিনার? অর্থাৎ একটা কিছু উৎসর্গ করা দরকার শক্তিমান দেবতার উদ্দেশ্যে।
উৎসর্গ করার জন্যে সবচে’ কার্যকরী যার মধ্যে আপনার অ্যাটাচমেন্ট আছে। বস্তুগত অনুরক্তি নয়, আত্মিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হবে আপনার সন্তান। সন্তান আপনার ভবিষ্যতের বীজ নয় শুধু, সে বড় হলে গোত্রের কর্মক্ষম একজন ব্যক্তিও হবে। গোত্রপ্রধান হিসাবে আপনার প্রভাব আরো বাড়াবে। কিন্তু বর্তমানের অকালটাকে না অতিক্রম করতে পারলে সন্তানসহ গোত্রের বাকি সবাই না খেয়ে মরবেন। এ কথা হয়ত পুরোহিত শুধু বানিয়ে বানিয়ে বলছে না, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। আর অন্যকোন বেটার এক্সপ্লেনেশন তার বা আপনার কাছে নেই। গোত্রের বাকি সবার কাছে আইডিয়াটা উপস্থাপন করার পর নব্বইজন সায় দিল, দশজন দিল না। কী করবেন আপনি?
আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি পরিস্থিতিটা। প্রস্তরযুগের শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্যে সারভাইভ্যালটা এমনি ছিল। ব্রোঞ্জযুগে নতুন টেকনোলজির কারণে আরেকটু ভাল অবস্থায় আসে মানুষ। তারপরও সেরেমোনিয়াল রিলিজিয়াস স্যাক্রিফাইস চলত, কারণ বাপদাদারা করে এসেছে। লৌহযুগে এসে যখন মানবসভ্যতা উপনীত হলো, তখন তাদের কৃষিকাজের লাঙলসহ নতুন নতুন যন্ত্র বেরিয়েছে, শিকারের বহুরকম অস্ত্র। প্রকৃতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। ইসাইয়ার মত সংস্কার তখন অনেক কালচারেই হয়, এবং নরবলি স্থানান্তরিত হয় পশুবলি দ্বারা।
যেকোন প্রাচীন মূল্যবোধকে মূল্যায়নের পরীক্ষা হলো, Did it sound like the only, not just a, good idea at the time? And did everyone else think so?
নতুন মূল্যবোধও একইভাবে এস্ট্যাবলিশ হয়। যারা জোর করে সব সনাতন প্রথাকে বন্ধ করে দিতে চান, আশা করি তারা এটা কনসিডার করবেন!
গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।
ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!
এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।
এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।
এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা।
কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অগ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।
সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।
ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।
দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।
পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।
এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।
আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেলডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিকগথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁও–হিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।
অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।
পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।
উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।
বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।
এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।
স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।
কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল।
বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।
ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।
লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!
আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।
ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই একই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।
পুরাকীর্তির দরকারটা কি? এটা কি খায় না পিন্দে? গরিব মানুষের আবার পুরাকীর্তি কি? অথবা — আধুনিক যুগে আমরা হবো আধুনিক, কেন ফিরে ফিরে প্রাচীনকে আগলে রাখা? এগুলির সাথে আমাদের বর্তমান পরিচয়ের যোগাযোগ কোথায়?
কিংবা, তালেবান-আইসিসের মত ‘এগুলি মোনাফেকি, মোশরেকি, কুফ্ফার; ধ্বংস কর সব!’
শেষ ‘যুক্তি’টা থেকে উল্টোদিকে যাই।
তালেবানরা যখন বামিয়ানের পাহাড় কেটে তৈরি বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি রকেট মেরে ধুলায় মিশিয়ে দেয়, তখন আমার চোখ ফেঁটে জল এসেছিল। বামিয়ানের বুদ্ধ এমন এক শৈলীর উদাহরণ যাকে বলে গান্ধার শিল্প — ভারতীয় সনাতন বৌদ্ধ শৈল্পিক রীতির সাথে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে আসা গ্রীক শিল্পী আর তাদের বংশধরদের গতিশীল আইডিয়া মিলে তৈরি হয়েছিল অনন্য গ্রেকো-বুডিস্ট আর্ট।
সিরিয়া-ইরাকে আইসিস গণহত্যাসহ নানা অপরাধ তো করেছেই। তার সাথে সাথে পালমিরার প্রাচীন অনন্য স্থাপত্যশৈলী আর জাদুঘরে রক্ষিত পুরাকীর্তি ধ্বংস করেছে। পালমিরাও গান্ধারশিল্পের মত অনন্য কারণ আরবদের সাথে গ্রীক মিলেছে এখানে। আবার অনেক সুন্দর সুন্দর মসজিদ, সমাধি আর সুফী খানকাও ট্যাংক-রোলার দিয়ে গুড়িয়ে আইসিস ধূলিসাৎ করেছে। চোদ্দশ’ বছর ধরে বিভিন্ন মুসলিম আমলে, এমনকি ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চার খলিফার আমলেও, এ এলাকায় এরকম ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি।
মালির তিমবাক্তুতেও ২০১২ সালে ইসলামী কট্টরপন্থী দল আনসারদ্বীন প্রাচীন মালি সাম্রাজ্যের আদি ইসলামী সুফী সন্তদের অদ্বিতীয় সমাধির শৈলী আর সংলগ্ন মসজিদের অংশবিশেষ ধ্বংস করেছে। অথচ সুফীদের মাধ্যমেই সে এলাকায় ইসলামের প্রথম প্রচার-প্রসার হয়।
তাদের এসব করার জন্যে তারা কেতাব ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে সন্দেহপূর্ণ নানা ফতোয়া আর পুরনো উদাহরণ বের করে। কিন্তু আসল ইচ্ছেটা হল, তারা প্রাচীন কালে নবীরা যেমন কা’বা বা অন্য কোন পবিত্রস্থানের ভেতর রাখা মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে মনে মনে পুণ্যার্জন করতে চায়। সুফীদের কোন কোন গ্রুপের ধর্মচর্চা মূলধারার হিসাবে একটু প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পালমিরা-বামিয়ান কি দোষ করলো তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ সিরিয়া-আফগানিস্তান এখন মুসলিম সংখ্যাগুরু, আর কেউই সেসব জায়গায় গিয়ে প্রাচীন ধর্মের অবতারদের উপাসনা করে না।
বরং পুরাকীর্তি টিকিয়ে রাখারই যুক্তি আমার মনে হয় কোরান-সুন্নাহ পড়লে পাওয়া যায়। সূরা আহকাফে বর্ণনা করা হয়েছে আদ্ আর সামুদ জাতের ওপর গজবের কাহিনী। সৎপথ থেকে বিচ্যুত হবার ফলে তাদের নগরগুলিকে ভূমিকম্প আর ঝড় দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়। মাদাইন সালেহ বলে সৌদি আরবের মরুভূমিতে এখনো সামুদ জাতির নগরের ধ্বংসাবশেষ আছে। সুপ্রচলিত একটি হাদীসে মাদা’ইন সালেহর মতো ‘অভিশপ্ত স্থান’ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবার উপদেশ বলা থাকলেও, কুরআনের সূরা রূমের নবম আয়াত অনুযায়ী আমার মতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে নৈতিক শিক্ষাগ্রহণের অনুপ্রেরণা রয়েছে। আর পুরাকীর্তি ধ্বংস করার ইসলামী যুক্তি আমি খুঁজে কোথাও পাইনি।
সৌদির কথা যখন উঠলো, তখন স্বীকার যেতেই হয় আইসিস, তালেবান, আনসারদ্বীন — এদের পেছনে সৌদি সরকারের সরাসরি ইন্ধন যদি না থেকেও থাকে তো তাদের নাকের ডগা দিয়ে ধনাঢ্য সৌদি নাগরিকেরা প্রশ্নবিদ্ধ চ্যারিটিতে পয়সা ঢেলে সন্ত্রাসবাদকে মালসামান দিয়েছে। অথচ সৌদিতে কিন্তু কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জাদুঘরে, জেদ্দা জাদুঘরে অনেক পুরাকীর্তি সংরক্ষিত আছে, যাদের মধ্যে প্রচুর প্রস্তরমূর্তি। সেগুলিও মাঝেমধ্যে বাইরের দেশে ট্রাভেলিং একজিবিশনে যায়। মাদাইন সালেহসহ অন্যান্য নগরেও এখন পর্যটকরা যেতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়ার সবচে’ ‘বর্বর’ মুসলিম রাজ্যটিও তাদের পুরাকীর্তি টিকিয়ে রেখেছে, আর বহির্বিশ্বকে তা প্রদর্শন করে। পরিহাসের ব্যাপার, ওয়াহাবি কট্টরপন্থীরা ইসলামধর্মের সাথেই জড়িত অনেক সমাধিচিহ্ন — সমাধি নয় — ধ্বংস করে দিয়েছে এই অজুহাতে যে অন্যথায় অশিক্ষিত মানুষ সেগুলিতে গিয়ে খোদার পরিবর্তে নবী বা সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করবে।
অন্তত এটুকু মনে হয় দাবি করতে পারি যে ইসলামে খুঁজে খুঁজে পুরাকীর্তিবিরোধী নিয়ম পাওয়া গেলেও পুরাকীর্তির সপক্ষে উদাহরণ কম নয়। শুধু ইসলামে নয়, যেকোন ধর্মের একটু গোঁড়ারা প্রাচীন শিল্পকর্ম বা পান্ডুলিপি নিয়ে একটু অস্বস্তিতেই থাকে। অধুনা ভারতে হিন্দু কট্টরপন্থীরা পাঁচশো বছরের পুরোনো অনন্য স্থাপত্যশৈলীর বাবরী মসজিদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। শুধু যে ধর্মান্ধরাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী ধ্বংস করেছে তা নয়, কমিউনিস্ট চীনে ষাটের দশকে কালচারাল রেভলুশনের সময় অনেক পুরোনো বৌদ্ধ ও তাওইস্ট মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়। প্রাচীন চীন সম্রাটদের সমাধি লুট করে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করে ফেলে সরকারি মদদ পুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রের দল। একই ঘটনা ঘটে কমিউনিস্ট খ্মের রুজ শাসিত কম্বোডিয়াতেও।
যা হোক, ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাকীর্তি ধ্বংস করার যুক্তিখন্ডনের একটা চেষ্টা করলাম। এখন জবাব দিই আধুনিক টেকি বস্তুবাদী আত্মতুষ্ট জেনারেশনের প্রশ্নের। পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের যোগাযোগ কোথায়। কেন তারা অমূল্য।
কম্প্লেসেন্ট বলে আমরা আজকের যুগের অনেক কিছুই মেনে নিই, ধরে নিই ‘গ্রান্টেড’। টাকা আছে, কেন টাকা আছে আড়াই হাজার বছর ধরে জানি না! সুতরাং বিটকয়েনে পয়সা ঢালি! টাকাকে নাকি সে প্রতিস্থাপন করবে। টাকা কেন এতদিন ধরে কি কি গুণের কারণে কি কি প্রয়োজন মেটায় তা আমরা জানি না। এগুলো জানতে হলে ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান পড়ে বোঝা যায়। কিন্তু কেউ কি কখনো চিন্তা করে দেখেছে কি ধরনের পরিস্থিতি প্রাচীন তুরস্কের ছোট্ট লিডিয়া রাজ্যে টাকার উৎপত্তি ঘটালো, অথচ তারও প্রাচীন যুগের আরো উন্নত সভ্যতা মিশরে টাকার প্রচলনই ছিল না?
মনে হতে পারে, এসব প্রশ্ন অবান্তর। কি হবে এসব জেনে! কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি! আমরা দশ হাজার বছর আগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতাম, এখনো করি। যেধরনের কুসংস্কার নিয়ে চলতাম, এখনো সেসব বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে কোন না কোনভাবে। অর্থাৎ খুবই মৌলিক অনেক ব্যাপার আছে যেগুলি দশ হাজার বছর আগে যতটা সত্য ছিল আজও ততটা।
দুনিয়ার সকল মানুষকে ভাবুন একটা বড় প্রাণী, তার বিভিন্ন কোষের মধ্যে নানারকম মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তার বিবর্তন হয়। আমাদের পক্ষে সে প্রাণীটি কোনদিকে গেলে তার উদ্বর্তনটা সুনিশ্চিত হবে, তা বোঝার জন্যে অতীতের দিকেই দৃষ্টিক্ষেপণ একমাত্র রাস্তা। কেন হঠাৎ করে ময়েন্জোদারোর এত উন্নত সভ্যতা বিলুপ্ত হলো সে এক রহস্য। যদি তার সোজাসাপ্টা উত্তর বেরুত, তাহলে বোধহয় আমরা সামগ্রিক সার্ভাইভাল পাজলটার আরেকটা মিসিং পীস পেতাম। ইসলামে আদ্-সামুদের ধ্বংসাবশেষ দেখে যেসকল প্রকারের শিক্ষাগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে হয়ত এও একটা! যখন আদসামুদের মত গজব আবার আসবে তখন ধনীগরীব কেউই পরিত্রাণ পাবে না!
আর এসকল প্রাকটিক্যাল ব্যাপার-স্যাপারের উপরে আছে আর্ট — শিল্প! একটা সুন্দর নিখুঁত কারুকার্য দেখলে কার না মন জুড়ায়! ময়েন্জোদারোর বালাপরিহিত নর্তনরত কিশোরীর ছোট্ট একটা মূর্তির মধ্যে আমাদের অতি আদি এক পূর্বসূরীর যে মানবিক ছবি ফুঁটে উঠেছে, সামনাসামনি দেখলে মনে হয় এ যুগেরই কোন গ্রাম্য লাস্যময়ী বালিকা।
শুধু তাই নয়, ইরাকের এশনুন্নার জিগুরাতে পাওয়া ছোট ছোট নারী-পুরুষ-শিশুর স্ট্যাচুয়েটগুলি যেভাবে হাত জোড় করে চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তাতে চিত্রিত হয়ছে তাদের অসহায়ত্ব। তাদের সহায় ঈশ্বরকেই স্মরণ করছে তারা। সেদেশে দুই নদী ছিল বেয়ারা, মিশরের নীলনদের মত নিয়মিত দু’তীর প্লাবিত করত না। মাঝেমধ্যে খরা হত, তখন আকাল। আবার ভয়াবহ বন্যাও হত, তাতেও জীবন ও সম্পদের ক্ষয়। সেকারণে তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আর ধর্মীয় দর্শন ছিল অদৃষ্টবাদী বা ফেটালিস্ট। নূহনবীর বজরা আর মহাপ্লাবনের কাহিনীও মূলে সেদেশের।
সোজা কথায় আমরা আজ যা যা বিশ্বাস করি, যেসব মূল্যবোধকে উচ্চাসন দিই, আমাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে কেন সেসবে উপনীত হলেন, কি ধরনের পরিস্থিতি তাদেরকে সেসবের দিকে চালিত করল — এসকল কিছুর উত্তর আছে পুরাকীর্তি আর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের গবেষণার মধ্যে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সেসবকে ধ্বংস করে আমাদের পুরনো পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে জোর করে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করতে, আমরা পারব না! কারণ সেসকল প্রাচীনতা আমাদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে, জাতিগত স্মৃতির মধ্যে মজ্জাগতভাবে প্রথিত!
বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি — তালিবানদের ধ্বংস করার আগে ও পরে। ষষ্ঠ শতকে তৈরি এবং হিউয়েস ৎসাং এগুলির বিবরণ দিয়ে গেছেন। আদি মুসলিমদের আমলে টিকে থাকলেও আওরাংজেব প্রভৃতি ফ্যানাটিক শাসক এগুলি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালান।গান্ধার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ লাহোর জাদুঘরে সংরক্ষিত উপবাসরত বুদ্ধের এই মূর্তিটি। সম্ভবত চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে তৈরি। বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির আগে তিনি শ্রমণদের সাথে সংযমসাধনা করতেন, সম্ভবত এটা সে সময়ের প্রতিকৃতি। তাঁর দেহ কংকালসার, চক্ষু কোটরাগত; কিন্তু মুখে স্মিতহাসি আর অসাধারণ এক ঔজ্জ্বল্য। গ্রীক শিল্পীরা ছিলেন রিয়েলিস্টিক, কোন ভারতীয় শিল্পী বুদ্ধকে এ ভাবে কল্পনা করার আইডিয়াও পেত না!পালমিরার দেবতা বা’লের মন্দির ২০১৫তে আইসিস ধ্বংস করে ফেলে। ৩২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরটি খ্রীষ্টান রোমান সম্রাটদের পাগানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযানের সময় বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু নানা সাম্রাজ্যের উত্থানপতন সত্ত্বেও টিকে রয়েছিল আইসিস পর্যন্ত।জার্মানীর ফ্রাংকফুর্টের লীবীগহৌস জাদুঘরে সংরক্ষিত পালমিরিন আর্টের নিদর্শন। ১৫০-২০০ খ্রীষ্টাব্দের লাইমস্টোনে খোদাই করা সমাহিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে পশুবলির রক্ত ধরার পাত্র। শিল্পটির শৈলী আদতে গ্রীক হলেও সাবজেক্ট স্পষ্টতই সেমিটিক (হিব্রু বা আরব) কালচারের মানুষ।পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যের সিদি ইয়াহিয়া আল আন্দালুসি ছিলেন সাংকারে মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ। তাঁর নামে পরিচিত সিদি ইয়াহিয়া মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৪৪০ সালে। তিমবাক্তু সেসময় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্যে সুপরিচিত ছিল — বর্তমানের আফ্রিকার মত নয়। মসজিদের বিশাল কাঠের দরজায় খোদাই করা ডিজাইন ছিল, মাগরেবী রীতির শৈলীতে। আনসারদ্বীন ২০১২তে অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের মালির মুসলিমদের তীর্থস্থান এ মসজিদটির দরজা ভেঙ্গে ইট তুলে বন্ধ করে দেয়।মাদাইন সালেহ বা সালেহ নবীর শহরে এরকম ১৩১টি পাথর কুঁদে তৈরি সমাধি আছে। এগুলি প্রথম খ্রীষ্টাব্দে আল-আনবাত বা নাবাতিয়ান গোত্রের আরবদের তৈরি। কোরানে এদের সামুদ নামে উল্লেখ আছে। জর্দানের পেত্রা শহরের পাহাড় কেটে তৈরি সমাধিগুলিও নাবাতিয়ানদের তৈরি।স্যান্ডস্টোন খোদাই করে তৈরি এ মূর্তিটি খ্রীষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে লিহিয়ানবাসীদের তৈরি। এই সাম্রাজ্য উত্তরপশ্চিম আরব উপদ্বীপে, মদিনা-তাইমা ইত্যাদি শহরসহ বর্তমান লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরব বা সেমিটিক তুতো ভাই নাবাতিয়ানদের সাথে এদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সম্ভবত বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, এবং পরে মাদাইন সালেহসহ বিভিন্ন জায়গায় লাহিয়ানীদের জায়গায় শাসনভার তুলে নেয় নাবাতিয়ানরা। এই মূর্তিটি কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষিত। অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে মাঝেমধ্যে বাইরের জাদুঘরেও লোনে যায়।৬৩০-৬২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের লিডীয় মুদ্রা। ইলেক্ট্রাম নামে সংকরধাতুর তৈরি। সিংহ লিডীয় সংস্কৃতিতে রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতীক। তার মাথার ওপর উজ্জ্বল সূর্য। লিডিয়ার রাজা এসময় ছিলেন সাডিয়াটিস, তাঁর পৌত্র ক্রীসাসের নাম গ্রীক-লাতিন হয়ে ইংরেজীতে এসেছে একটি প্রবচনের মাধ্যমে — রিচ অ্যাজ় ক্রীসাস বলতে খুব ধনবান কাউকে বুঝানো হয়। লিডিয়ার রাজধানী সার্ডিস ভূবনবিখ্যাত ছিল তার সৌন্দর্যের জন্য।ব্রোঞ্জের তৈরি এই নর্তনরত কিশোরীর মূর্তিটি এখন নয়াদিল্লী জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরে আবিষ্কৃত নিদর্শন এটি। মোটে ৪ইঞ্চি এই মূর্তির মধ্যে দৃপ্ত অঙ্গভঙ্গি যেরকম প্রাকৃতিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার কারণে এটি সুপরিচিত শিল্পকর্ম। তার চুলের খোঁপা করার স্টাইল, হাতভর্তি বালা — এগুলি জানান দেয় যে ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় সিন্ধুসভ্যতার সময়ে এখনকার থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেসময় সব সভ্যতা ব্রোঞ্জের কাজ জানত না, কিন্তু এরা পারত, এবং ভালই পারত। ১৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মত শহরগুলোর অবক্ষয় শুরু হয়। প্রত্নত্ত্ববিদরা গৃহযুদ্ধ আর যক্ষ্মার মত রোগের প্রমাণ পেয়েছেন। নগরগুলির অবক্ষয়ের সাথে সাথে নাগরিকরা ধীরে ধীরে গ্রামে চলে যায়, তাই সিন্ধুসভ্যতার আচারব্যবহার ইত্যাদির অবশেষ বেঁচে গেছে গ্রাম্য সংস্কৃতির মধ্যে। অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা বৈদিক ধর্মের মধ্যেও সিন্ধুসভ্যতার প্রভাব রয়েছে।এশনুন্না প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি নগররাষ্ট্র। সেখানকার দেবতা আবুর মন্দির বা জিগুরাতের ধ্বংসাবশেষে এই প্রার্থনাকারীদের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। ২৯০০ থেকে ২৫৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে লাইমস্টোন খোদাই করে তৈরি এগুলো। আসলে প্রার্থনাকারীরা উপাসনা থেকে দৈনন্দিন কাজে ফিরে যাবার আগে দেবমূর্তির সামনে নিজেদের প্রার্থনারত ছোট ছোট মূর্তি স্থাপন করে যেতেন, যেন দেবতা তুষ্ট থাকেন তারা সশরীরে সামনে না থাকলেও। প্রার্থনার ভঙ্গি, পোশাকআশাকের ডিটেইল, পিগমেন্টে রং করা বড় বড় চোখ — সবকিছু প্রাকৃতিক। পোশাক আশাক বর্তমানের হলে বোধহয় আধুনিক চার্চে খ্রীষ্টান প্রার্থনাকারী বলে চালিয়ে দেয়া যেত!
মালয়েশিয়ার এথনিক চীনা শিল্পী ইমী উইয়ের গাওয়া এ গানটি বৌদ্ধ ধর্মের সবচে’ পবিত্র মন্ত্রগুলোর একটি। এর নাম প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রম — সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতার অন্তঃকরণ। অর্থাৎ এ মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে সর্বোচ্চ সত্য উদ্ঘাটনের গূঢ়তত্ত্ব।
মহাযান মতধারার বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞাপারমিতার স্থান উচ্চাসনে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল যে, ইসলামে যেমন দু’টো বড় শাখা শিয়া ও সুন্নী, তেমন বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান ধারা বা ‘যান’ থেরবাদী, তান্ত্রিক আর মহাযানী। থেরবাদী আর মহাযানীর মধ্যে মৌলিক তেমন কোন তফাত নেই; থেরবাদকে ধরা যেতে পারে সনাতন, প্রাচীন; মহাযান অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের স্থানীয় আচারকে একীভূত করে নিয়েছে। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-মিয়ানমারসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে থেরবাদ প্রচলিত। চীন-ভিয়েতনাম-জাপানের মহাযান পন্থার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থেরবাদের থেকে বেশি। মহাযানী ধারার একাংশ ভূটান-তিব্বত-মোঙ্গোলিয়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন শামানিস্ট বিশ্বাসকে মিলিয়ে নিয়ে হয়ে গেছে গূঢ়তাত্ত্বিক অধ্যাত্মবাদ, যার নাম তন্ত্রযান বা বজ্রযান।
ধারণা করা হয়, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রের উদ্ভব খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। সবচে’ প্রাচীন আবিষ্কৃত নমুনাটি ৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, এর নাম অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, কারণ এতে আট হাজার পংক্তি রয়েছে। ১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ শ্রমণ চীনা ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতার অনুবাদ করেন। এর আশপাশ দিয়েই ভারতবর্ষ থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে। চীনের সুপরিচিত শাওলিন টেম্পলের শ্রমণরা মহাযানপন্থারই অনুসারী। আত্মসংযম চর্চার জন্যে চীনা শ্রমণরা যে ধ্যান করে, তাকে তারা ডাকে ‘চান’ বলে। জাপানে গিয়ে চান হয়ে গেছে ‘জ়েন’।
বাংলায় পাল রাজবংশ ছিল মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বড় পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পালরা উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শাসন করে। বিহারের নালন্দা–বিক্রমশীলা আর বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুরবিহার পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। দ্বাদশ শতকে দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এসকল বিহার লুন্ঠিত-বিধ্বস্ত হয় — অবশ্য ইতিমধ্যে পালসাম্রাজ্যের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
নালন্দা-সোমপুর ছিল অনেকটা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত। ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। পালপূর্ববর্তী গুপ্ত আর বর্ধন রাজবংশের আমলে চীন থেকে ঈ জিং, শ়ুয়ান ৎসাং, ফাশ়িয়ান — শেষ দু’জনকে আমরা চিনি ‘হিউয়েন সাং’ আর ‘ফা হিয়েন’ নামে — ভারতের এসব বিহারে এসেছিলেন সংস্কৃত শিখতে আর বৌদ্ধ সূত্রের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তারা চীনে ফিরে সেসবের অনুবাদ করেন — প্রজ্ঞাপারমিতাও ছিল এদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ারাজ্যও পালযুগে নালন্দায় বিহারস্থাপনের জন্যে অর্থ যোগান দেয়।
পালদের যুগেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবির্ভাব হওয়া শুরু করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদের অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর মহাযান-বজ্রযান পন্থার বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় অধ্যয়নের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে তিব্বতের রাজার অনুরোধে সেদেশে যান অতীশ। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তিনি এখনও সম্মানের আসনে অধিষ্ট। ২০০৩এ সোমপুর বিহার দেখতে গিয়েছিলাম যখন, তখন এই ভেবে গায়ে শিহরণ হয়েছিল যে, সাড়ে আটশ’ বছর পূর্বে সেখানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, আর হয়ত প্রাচীন বাংলাতেই তাঁর কথোপকথন হত সঙ্গী-সাথীদের সাথে! এখনো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রচুর বৌদ্ধ পর্যটক এসকল বিহারে তীর্থযাত্রায় আসেন।
প্রজ্ঞাপারমিতা বর্তমানযুগে ‘ধারণী’ মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ মন্ত্র যে পাঠ করবে — সে অর্থ বুঝুক বা নাই বুঝুক — অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করবে না। অনেকটা যেমন আমাদের দেশী সরল ধার্মিক মানুষ অর্থ না জেনে সূরা-দোয়া মুখস্ত করেন আর সোচ্চারে পাঠ করেন। বলতে পারেন, পালযুগে আমরা একই কাজ করতাম বৌদ্ধমন্ত্র নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মচর্চাপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি! চীনা-জাপানীদের বৌদ্ধধর্মের সেই একই দশা! তারা সংস্কৃত শব্দোচ্চারণের স্বদেশী রূপ দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা আবৃত্তি করে — অথচ উচ্চারিত শব্দগুলোর কোন সত্যিকার অর্থ তাদের ভাষাতে নেই!
আনুষ্ঠানিকতার জাল ভেদ করে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে বুদ্ধশিষ্য, গৌতমের অন্যতম সাথী, শারিপুত্রের সাথে কথোপকথন হচ্ছে অবলোকিতেশ্বরের। অবলোকিতেশ্বর হচ্ছেন গৌতমের নির্বাণপরবর্তীযুগে পুনর্জন্ম হয়ে আসা বর্তমানযুগের বোধিসত্ত্ব। সংসারের জাল ছিন্ন করে বোধিপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পরিনির্বাণ গ্রহণ না করে ফিরে ফিরে আসেন ধর্মদীক্ষাদানের জন্যে, যাতে অন্যেও তাঁর শিক্ষা নিয়ে বোধি বা সত্যের সন্ধান পেতে পারে।
শারিপুত্রকে অবলোকিতেশ্বর শেখাচ্ছেন মোক্ষলাভের মূলমন্ত্র: সকল বস্তু, ভাবের অস্তিত্বের সাথে তাদের অনস্তিত্ত্বের কোন পার্থক্য নেই! দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে পরিচিত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনেরশূন্যতাবাদের তত্ত্বে এই চিন্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ তত্ত্ব লিখে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন! মনোভাবটা জাগ্রত করতে হলে চাই কঠোর সাধনা। সোজা ভাষায় যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে, সকল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় এটা অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করা যে, কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে বলেই আমরা তার অনস্তিত্ত্ব বা অভাব বোধ করি। দুঃখজরার মূল প্রথিত সেই জ্ঞানের মধ্যেই। যদি মোহমুক্তি পেতে চাই তাহলে আত্মপরিচয় বা ইগোকে পরিত্যাগ করতে হবে, মিলিয়ে দিতে হবে শূন্যতার মাঝে, যেখানে বস্তু বা ভাবের অনস্তিত্ত্ব আর অস্তিত্ত্বের উপলব্ধির মাঝে কোন ফারাক নেই। দুঃখ থেকে মুক্তি সে পথেই।
এটা অন্য ধর্মদর্শনের মাধ্যমে বোঝানোটা মনে হয় খুব বেশি কঠিন নয়। ইসলামের সুফী মতের সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন। সেখানে খোদাপ্রেমের মদে মত্ত মানুষ নশ্বরতার পরিধি পেরিয়ে হতে চায় স্রষ্টার সাথে একাত্ম। হাদীসের ভাষায় ‘মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করা’! কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরে মন্দভাল যাই ফল হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হওয়া। খুব একটা তফাত নেই প্রজ্ঞাপারমিতার থেকে। বাউলিয়ানার ওপরেও বৌদ্ধ দর্শনের কিছুটা প্রভাব এক সময় পড়েছিল।
বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন বা নাস্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলেও এ ধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। ঊনবিংশ শতকে আর্থার শপেনহাওয়ার তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ় উইল অ্যান্ড রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বইটিতে অস্তিত্ত্বের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছেন মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে। যদিও শপেনহাওয়ার বৌদ্ধ দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন আর সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান, তাঁর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ চিন্তাধারার অনেকটা বিকৃত পশ্চিমা সংস্করণ । শপেনহাওয়ার পক্ষান্তরে অনুপ্রেরণা যোগান আধুনিক যুগের আরো অনেক দার্শনিক, লেখক ও বৈজ্ঞানিককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রয়ড, আইনস্টাইন, য়্যুঙ, মপাসঁ, নয়মান, নিচা, শ্রয়ডিঙার, তলস্তয়, ভ়াগনার — আর নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেরমান হেসা!
এই হেরমান হেসার ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি আমার তরুণ বয়সে পড়া, আমার পরবর্তী চিন্তাভাবনার উপর এর প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বেশ ভাল একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, পরে ইংরেজী দু’টি আলাদা অনুবাদও। এই অসাধারণ কাহিনীতে গৌতম নয়, সিদ্ধার্থ বলে আরেক সমসাময়িক কল্পিত রাজকুমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলোকন করতে পারবেন — তাঁর মনোবেদনা, মোক্ষলাভের সংগ্রাম, শ্রমণজীবন, ‘মধ্যপন্থার’ আবিষ্কার, সংসারে মনোনিবেশ, গৌতমবুদ্ধের সাথে মোলাকাত, শেষ পর্যন্ত নদীপারাপারের তরীচালক হিসাবে তাঁর অহমলোপ আর বোধিপ্রাপ্তি।
হেসা খুবই নিখুঁতভাবেই মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সে তত্ত্বে বোধিলাভের জন্যে থেরবাদের অন্তর্মুখী সাধনার আবশ্যকীয়তা নেই, জাগতিক সুখদুঃখের অনুভূতি অক্ষত রেখেই শূন্যতার উপলব্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ আমি-আপনি যে জাগতিক অবস্থাতেই থাকি না কেন, কিছু মৌলিক সত্যের ওপর মনোনিবেশ করলে অহমের বিলোপ, মনের দ্বন্দ্বগুলি প্রশমন করে দুঃখজরার বিনাশসাধন অসাধ্য নয়।
মনে হয় পাঠক ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পারছেন সব ধর্মের একটা মৌলিক গুণ মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলির নিরসন করে শান্তিতে বিরাজমান হওয়ার পথ বাতলানো। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এব্রাহাম ম্যাজ়লো বলে এক মনস্তত্ত্ববিদ মানবিক চাহিদার খুঁটিনাটি গবেষণা করেছেন। তাঁর শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দৈহিক চাহিদা, তার পরে নিরাপত্তা, তৃতীয়ত প্রেম-ভালোবাসা বা কোন জাতিগোত্রের সাথে একাত্মতার চাহিদা, চতুর্থত শ্রদ্ধা-মর্যাদার চাহিদা, আর সর্বোচ্চ স্তরের নাম দিলেন সেল্ফ়-অ্যাকচুয়ালাইজ়েশন। প্রথম চারটি স্তর অতিক্রম করে মানুষ শেষ স্তরে এসে চায় স্বপরিচয়ে, স্বপেশায় পারফ়েকশন বা পূর্ণতাপ্রাপ্তি। বৌদ্ধ দর্শনে এটা অহম বা ইগোর সর্বোচ্চ রূপ।
ম্যাজ়লো পরে আরো একটি পর্যায় যোগ করেন যার নাম দেন ট্রানসেন্ডেন্স বা স্ব-কে অতিক্রম করা। বৌদ্ধ দর্শনে এটাই অহমের বিলোপ, নিজের থেকে বেশি কিছু হয়ে ওঠা, শূন্যতা!
এপর্যায়ে এসে প্রজ্ঞাপারমিতার শেষ পংক্তি অনুযায়ী আপনি ‘গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!’ — নদীর অপরপারে! স্নান করছেন বোধির আলোকচ্ছটায়! তবে তাই হোক!
আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হবে থ়্যাংকসগিভ়িং নামে রাষ্ট্রীয় ছুটি। প্রতি নভ়েম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার এ দিবস পালিত হয়। পরেরদিন শুক্রবারও অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। শুধু ব্যস্ত থাকে শপিং মল। ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত এ দিনে দোকানপাটে আপনি পাবেন বছরের সবচে’ বড় ছাড়। বিশেষ করে যারা দামী ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী কিনতে চান, তাদের তো পোয়াবারো! অনেক শহরে রঙচঙে ফ্লোট বা সজ্জিত ভেলাসহকারে মার্চিং ব্যান্ডের তালে তালে বেসামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচে’ নামকরা হলো নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে মেইসিজ় বলে চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের আয়োজিত মেইসিজ় থ়্যাংকসগিভ়িং প্যারেইড।
মার্কিনদের জন্যে বড়দিনের মত থ়্যাংকসগিভ়িংও পারিবারিক পুনর্মিলনীর একটা বড় সুযোগ। মায়ের তৈরি (বা পছন্দ করে কেনা!) ক্র্যানবেরি সস, ম্যাশড পটেটো, গ্রেভ়ি, স্প্রাউটস, সুইট কর্ন, গ্রীনবীন ক্যাসরোল, পামকিন পাই আর ঐতিহ্যবাহী স্টাফ়ড টার্কী খেতে ছেলে-মেয়েরা দূরদূরান্তের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তাই এয়ারপোর্ট-হাইওয়েগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মানুরাগী পরিবারদের থ়্যাংকসগিভ়িং ডিনার শুরু হয় ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের ‘গ্রেইস’ প্রার্থনার মাধ্যমে। খাবার পর রাতে সবাই বের হয়ে পড়ে, দোকানপাটের লাইনে দাঁড়িয়ে যায় ‘ডোরবাস্টার ডীল’ ধরার লোভে!
ক’দিন আগে বলছিলাম যে অক্টোবর শেষের হ্যালোউইন আসলে একটি নবান্ন উৎসব বা হারভ়েস্ট ফ়েস্টিভ্যাল। থ়্যাংকসগিভ়িংএর মূলও নবান্নের মধ্যেই! কিভাবে বুঝিয়ে বলি।
চারশ’ বছর আগে, ১৬২০ সালে, মেফ্লাওয়ার নামক এক জাহাজে করে প্রায় একশ’ ‘পিলগ্রিম’ নারী-পুরুষ-শিশু ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পিলগ্রিমরা ছিল ক্যালভ়িনিস্ট প্রটেস্ট্যান্ট খ্রীষ্টানদের একটি গোত্র — এরা ক্যাথলিকদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস তো মানতই না, এমনকি ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট অ্যাংলিকান চার্চের আনুষ্ঠানিকতাতেও তাদের আপত্তি ছিল। নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীন চর্চার লক্ষ্যে তারা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে।
আমেরিকার দক্ষিণে আরামদায়ক ভার্জিনিয়া কলোনিতে যাবার কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারা উত্তরপূর্বের বর্তমান ম্যাসাচুসেটস স্টেটের প্লিমথে নোঙর ফেলতে বাধ্য হয়। যথেষ্ট খাবার মজুদ তাদের ছিল না, আর শীতের সময় বুনো ফলমূলেরও অভাব ছিল। ফলে ঠান্ডায়-অপুষ্টিতে দলটির সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর প্রায় অর্ধেক মারা যায়।
পিলগ্রিমদের নতুন পড়শী ওয়াম্পানোগ ট্রাইবের নেটিভ় আমেরিকানদের সাথে প্রথম প্রথম কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত দু’দলের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিষ্পত্তি হয়। ওয়াম্পানোগরা তাদের মজুদ ভান্ডার থেকে ভুট্টা, শিকারকরা পশুর মাংস, ইত্যাদি দিয়ে পিলগ্রিমদের সাহায্য করে।
শীত শেষে পিলগ্রিমরা নেটিভ়দের কাছ থেকে স্থানীয় জীবনযাত্রার শিক্ষাগুলি নিয়ে চাষাবাদ করে আর তাদের ফসলের ভালো ফলন হয়। সে এলাকায় টার্কী আর বুনো মুরগীর মত পাখিরও প্রাচুর্য ছিল। নবান্নে তাই পিলগ্রিমরা ওয়াম্পানোগদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। আর তাদের কাছ থেকে শীতের সময় নেয়া খাবারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়।
তিনদিনব্যাপী সেই মহাভোঁজে ওয়াম্পানোগরাও হরিণ শিকার করে নিয়ে আসে। ৯০জন নেটিভ় আর ৫০জন পিলগ্রিম মিলে সব খাবার ভাগাভাগি করে খায়। রান্নার দায়িত্বে ছিলেন পিলগ্রিমদের দলের চার মহিলা। ইতিহাসবিদদের ধারণা এ ভোঁজটি হয় ১৬২১এর অক্টোবরের শেষে, মানে হ্যালোউইনের ধারকাছ দিয়ে। অবশ্য পিলগ্রিমরা হ্যালোউইন-ক্রীসমাসের আনুষ্ঠানিকতা মানতো না।
প্লিমথে বসতির গোড়াপত্তনের পরে প্রায় নিয়মিত এই বাৎসরিক ভোঁজ আয়োজন করা হত, তারিখটা স্থির ছিল না। বিশেষ করে ১৬২৩এ খরার কারণে পিলগ্রিমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা খোদার কাছে প্রার্থনা করে, রোজা রাখে। তারপর ‘অলৌকিকভাবে’ দু’সপ্তাহ টানা বৃষ্টি হওয়ায় তাদের ফলন বিপন্মুক্ত হয়। সেবার তাদের থ়্যাংকসগিভ়িং ভোঁজ তাই ছিল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
এরপর শতবছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে পিলগ্রিমদের উত্তরসূরীরা থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। ১৭৭৭এ আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে হবু রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন একে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী সরকারী ছুটির স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফ়ারসন অবশ্য রাষ্ট্রীয় আর ধর্মীয় বিধানের পৃথকীকরণের যুক্তিতে থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ছুটি ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। পাকাপোক্তভাবে ছুটিটি আবার চালু করেন এব্রাহাম লিংকন।
তারিখটা নিয়ে অবশ্য একটু শোরগোল তুলেছিলেন ফ্র্যাংকলিন রোজ়াভ়েল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি নভ়েম্বরের শেষ পঞ্চম বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে চতুর্থ বৃহস্পতিবার (এ বছরের মত!) ছুটি ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যাতে ক্রীসমাস শপিংয়ের জন্যে একটা সপ্তাহ বেশি পাওয়া যায় — তাতে বিক্রিবাট্টা বেড়ে যদি গ্রেট ডিপ্রেশনের মন্দার অর্থনীতিটা একটু চাঙা হয়। এ ব্যাপারটা অনেক রিপাবলিকান মানতে পারেনি। পরে কংগ্রেস আইন করে চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছুটির দিন স্থির করে দেয়।
থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের সাথে মার্কিনদের দানশীলতার একটা ঐতিহ্যও জড়িত। ক্রীসমাসের একমাস আগে থেকে সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান মাঠে নেমে পড়ে তহবিল সংগ্রহের জন্যে। ছুটির আমেজে সাধারণ মানুষও থাকে দরাজদিল। শপিং করে মল থেকে বেরুনোর পথে ঘন্টি-বাজানো অর্থসংগ্রহকারীর সাজানো বালতিতে দু’-চার ডলার ফেলে দিতে কসুর করে না অনেকে — হোক সে অসুস্থ-অনাথ শিশুদের হাসপাতালের জন্যে, কিংবা যুদ্ধাহত অথর্ব সৈনিকের কল্যাণার্থে , অথবা হয়ত গৃহহীন মানুষের খাদ্যসংস্থানের ফ়ুড ড্রাইভ়ের জন্যে।
অনেক নেটিভ় আমেরিকান কলাম্বাস ডে’র মত থ়্যাংকসগিভ়িংকেও মনে করে তাদের জাতির ওপর অত্যাচারের ইতিহাসের অবমাননা হিসাবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, নেটিভ়দের ওপর গতানুগতিক নিষ্পেষণ তুলনামূলক অধুনার ঘটনা — ঊনবিংশ শতকের প্রায় পুরোভাগ জুড়ে। আর সেসময়টাতে নেটিভ়দের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা ছিল বিভক্ত, অসংগঠিত — যার সুযোগ নেয় শ্বেতাঙ্গ র্যাঞ্চার, কাউবয় আর আউটল’রা। কিন্তু তারও আগে নেটিভ়রা ব্রিটিশ-ফরাসী-আমেরিকান সব পক্ষে তাদের সমকক্ষ হয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পিলগ্রিমদের সাথে ওয়াম্পানোগদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনই নেটিভ়দের অন্য ট্রাইব কর্তৃক ভার্জিনিয়াতে সেটলারদের পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও ইতিহাস আছে। আর যদি ইউরোপীয়রা তাদের জমি চুরিই করে থাকে, তাহলে তো আমাদের আর্য-আরব-পারসিক পূর্বপুরুষরাও ইউরোপীয়দের মতই জবরদখলকারী — যাঁরা বাংলার সাঁওতাল, অস্ট্রোনেশিয়ান আদিবাসীদের আবাসভূমি বেদখল করেছিলেন — কতটুকু ছলে-বলে-কৌশলে সে কারো মনে নেই, কারণ সে ঘটনা অধুনার নয়। বর্তমানের মূল্যবোধ দিয়ে অতীতের ‘অপরাধের’ বিচার করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আর নেটিভ় আমেরিকানদের বর্তমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সাড়ম্বরে থ়্যাংকসগিভ়িং উদযাপন করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডেকে অফিসিয়ালি কিন্তু ডাকা হয় নেটিভ় আমেরিকান হেরিটেজ ডে’ নামে।
শেষ করি এই লেখার জুড়ি গানটা নিয়ে কিছু কথা বলে। গানটা আইরিশ গেলিক ভাষায়, গেয়েছেন ময়রা ব্রেনান, প্রখ্যাত নিউ এইজ শিল্পী এনিয়ার বোন। এটি কিন্তু বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অফ় সামসের একটি সাম বা প্রার্থনাগীতি — ক্যাথলিকরা মাসের সময় এরকম গান গেয়ে খোদার প্রশংসাকীর্তন করে। বেশির ভাগ প্রটেস্ট্যান্টরা অবশ্য মাস পালন করে না, কিন্তু পিলগ্রিমরা মাস না করলেও সামগীতি গাইত বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এখনও থ়্যাংকসগিভ়িং থ়ার্সডে’র আগের বা পরের রোববার মার্কিনের চার্চগুলিতে বিশেষ থ়্যাংকসগিভ়িং প্রার্থনা হয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করলেও থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের প্রার্থনার মূল লক্ষ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
আমার কাছে ময়রা ব্রেনানের থ়্যাংকসগিভ়িং সামের সুর ও কথা দু’টিই খুব হৃদয়ছোঁয়া মনে হয়। প্রার্থনাকারীরা বলছেন: “ঈশ্বর, আমাদের করুণা করুন, আশীর্বাদ দিন।। পৃথিবীর সকল জাতি গাইছে আপনার প্রশস্তি।। সকল গোত্রের ন্যায়বিচারক, পথপ্রদর্শক আপনি।। এ ভূমির ফলন্ত ফসল আপনার আশীর্বাদ।। সকল দেশের মানুষের সকল প্রশংসা আপনার।।” সোজা আরবীতে: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বুল আলামীন, আর্ রাহমানির রাহীম — কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফ়াত়িহ়ার প্রথম দু’টি পংক্তি!