আদি ইসলামী মুদ্রা – ১

আব্বাসী খেলাফতের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আস-সাফ্ফাহর রাজত্বকালের রৌপ্য দিরহাম এটি। সময়কাল ১৩৪ হিজরী, ৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ। বর্তমান ইরাকের বসরা শহরের টাঁকশালে মুদ্রিত। আমার সংগ্রহের। এটি মোটামুটি সহজলভ্য।

এক পিঠে আরবী কুফী হরফে লেখা ‘আল্লাহ ব্যতীত ঈশ্বর নেই, সাক্ষ্য দিচ্ছি তাঁর কোন শরীক (সমকক্ষ) নেই’, চারপাশে লেখা ‘আল্লাহর নামে এটি মুদ্রিত হয়েছে বসরায়, সাল চার ত্রিশ একশ।’ অপর পিঠে লেখা, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর বার্তাবাহক (রসুল)’, আর চক্রাকারে চারপাশে ‘মুহাম্মদ রাসুলাল্লাহকে আমি প্রেরণ করেছি পথনির্দেশনা ও প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসসহকারে, অন্যান্য সকল ধর্মকে প্রতিস্থাপনের জন্যে, যদিও শরীককারীরা তা অপছন্দ করে।’

প্রথম আব্বাসী খলিফা আস-সাফফাহর আমলের দিরহাম

দেখার মত দুটো জিনিস এখানে। এক, হরফগুলোর কোন হরকত বা ভাওয়েল মার্ক নেই। এমনকি নুক্তা কিংবা কনসোন্যান্ট ডিস্টিংশন মার্কও নেই। কেউ সঠিক সূত্র না জানলে, দ (দাল) আর ধ/জ (জাল) গুবলেট করতে পারে। একইভাবে, ব (বা), ত (তা), থ/ছ (থা) এগুলির জন্যেও একটাই হরফ। দ (দদ), ছ/স (সদ) এদেরও একই হাল। স (সিন), শ (শিন) এর অ্যাম্বিগুইটি ‘লা সা/শারিকালাহু’তে পরিপূর্ণরূপে দৃশ্যমান।

আদিতে লিপিবদ্ধ কুরআনেরও একই অবস্থা ছিল। ইসলামী বিবরণীমতে, কুরআনের অর্থ পাল্টে যাবার ভয়ে তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় এগুলি ঠিকঠাক করা হয়। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, সে সংস্কারের কৃতিত্ব ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের। কিন্তু আমার আন্দাজে কাগজের ব্যবহার পুরোমাত্রায় শুরু হবার আগে এ সংস্কার সম্পূর্ণ হয়নি। সেকথায় পরে আসছি। মক্কা থেকে মদিনায় আদি মুসলিমদের অভিবাসনের দীর্ঘ ১৩৪ বছর পরের এ মুদ্রা এ থিওরির একটা সম্ভাব্য প্রমাণ।

আরেকটা চোখে লাগার মত ব্যাপার হল, কুরআনের ৯:৩৩ আয়াত যে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। শুরুটা সামান্য মডিফাই করে মুদ্রিত হয়েছে। এই নগণ্য পরিবর্তনটাও সম্ভবত কুরআন পরিবর্তনের বর্তমান ইসলামী ট্যাবুর পরিপন্থী।

এই মু্দ্রাটি ইসলাম ধর্ম ও আরব খেলাফতের ইতিহাসের খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ সময়কার। ১৩০ হিজরী নাগাদ পূর্ববর্তী উমাইয়্যা খেলাফতের আসন টলায়মান। উমাইয়্যাদের পারিবারিক ‌অন্তর্কলহ থেকে গৃহযুদ্ধ হয়ে গেছে এক দফা। তাছাড়াও বিভিন্ন সুদূর প্রদেশের গ্যারিসন টাউনগুলিতেও বিদ্রোহ। এসব সামাল দিয়ে খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান রাজধানী হার্রানে এসে পৌঁছনোর মাসখানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ‘আব্বাসী বিপ্লব।’

একে বিপ্লব নাম দেবার মূল কারণ বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-জাতের একটা বৈচিত্রময় মোর্চা উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এদের নেতৃত্বে যদিও ছিল মুহাম্মদ(সা)এর চাচা আব্বাসের বংশনামধারী এক আরব পরিবার, বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল আরবদেরই বর্ণভেদী রাজত্ব উচ্ছেদ করা। উমাইয়্যা বংশটি তৃতীয় রাশিদুন খলীফা উসমানের পরিবারের সাথে জড়িত। উমাইয়্যা প্রথম খলীফা মু্য়াবিয়ার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত বাঁধে। আলীর মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের নেতৃত্বে আদি শিয়ারা কুফা শহরে সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় উমাইয়্যা খলীফা ইয়াজিদ কারবালার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এদের নিষ্ঠুরভাবে নিকেশ করে দেন। শিয়া-সুন্নী বিবাদের সেটা শুরুমাত্র।

উমাইয়্যা শাসনামলে বিজিত দেশগুলোতে আরবরা ছিল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। বিদেশী-বিধর্মীদের জানমাল ‘রক্ষার’ বিনিময়ে পোল ট্যাক্স (জিজিয়া) আর ভূমিকর (খারাজ) আদায় করে আরব সৈন্য আর সেনাপতিদের খরচ ওঠানো হত। এ কারণে বিধর্মীদের ইসলামে দীক্ষিত করতে উমাইয়্যাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। যতক্ষণ বিজিত জনগণের প্রতিনিধিরা কড়ায় গন্ডায় কর বুঝিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পদবী-ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর কোন আগ্রাসন হত না। পুরো উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের অনারব জনগণের ১০ শতাংশের নিচে ছিল নতুন মুসলিম।

কিন্তু এসকল মুসলিমরা পরিগণিত হত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। কোন ক্ষেত্রে কর তো দিতে হতই, তার পাশাপাশি পুরনো নাম পরিত্যাগ করে আরবী নাম নিতে হত। আর ‘অ্যাটাচড’ থাকতে হত কোন না কোন আরব ট্রাইবের সাথে। এসব ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নাম ছিল ‘মাওয়ালি’, ইংরেজীতে ‘ক্লায়েন্ট’। আদিযুগের অনেক সাম্রাজ্যেই বিজিত রাজ্যের বনেদী বংশের সন্তানদের সম্রাটের দরবারে হাজির থেকে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি শিখে নিতে হত। এ ‌অনেকটা সেরকম।

সাধারণ অনারবদের সাথে আরবদের বিয়েশাদীর ব্যাপারেও উমায়্যাদের নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদি কোন বড় শহর ইসলামী সৈন্যদলের দখলে আসত, আরব সৈন্যদের অনুমতি ছিল না সে শহরের ভেতরে বসবাসের। তাদের জন্যে অন্যত্র আলাদা ক্যাম্প তৈরি করা হত, যেগুলি পরবর্তীতে দুর্গশহরে রূপান্তরিত হয়। এভাবে আরব জাতিগোষ্ঠীকে ‘সংমিশ্রণ’ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে উমাইয়্যারা।

অন্যদিকে বিজিত বিশাল এলাকা শাসন আরব দলপতিদের পক্ষে একলা সম্ভব ছিল না। খলীফা আর তার দোসররা শিক্ষিত হলেও সৈন্যদের অধিকাংশ ছিল অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত। বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে উমাইয়্যাদের দরকার ছিল আগের আমলের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাহায্য। সেভাবে সিরিয়ার প্রাক্তন বিজ্যান্টিন প্রদেশগুলিতে তারা প্রচুর আরামায়িক, গ্রীক ও লাতিন ভাষায় শিক্ষিত মনোফিসাইট খ্রীষ্টান কেরানী পায়। মনোফিসাইটদের সাথে আবার মুসলিমদের মিল হলো তারাও হোলি ট্রিনিটি কনসেপ্টটা বিশ্বাস করে না। আর ইরাকের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে আরব নেতৃত্বকে সাহায্য করে পাহলাভী-ফার্সী ভাষায় শিক্ষিত আরেকদল বুদ্ধিজীবী। এদের ধর্ম ছিল জোরোয়াস্ট্রিয়ান, মানিকেইজম, মাজদাকিজম, কিংবা নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি।

সিরিয়ার ঐ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই কিন্তু পুরনো গ্রীক ক্লাসিকগুলি ইউরোপের অন্ধকার যুগে বেঁচে গিয়েছিল। তারা প্লেটো-অ্যারিস্টোটল প্রমুখের দর্শনতত্ত্বের বইগুলো আরামায়িক-আরবী ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করে। পরে সেগুলি ছড়িয়ে যায় আরব খেলাফতের আনাচেকানাচে। স্পেন থেকে আবার সেগুলি ফিরে যায় পশ্চিম ইউরোপে।

কিন্তু পর্যায়ক্রমে উমাইয়্যারা এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। তাদের খেলাফতের শেষ নাগাদ সরকারী চাকরি পাবার জন্যে আরবীনামধারী মুসলিম হওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সরকারী ভাষা হিসাবে আরবীকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে উমাইয়্যারা। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নাকি এ ব্যাপারে এত গোঁড়ামি করেন যে, খওয়ারিজমি ভাষায় লেখাপড়াজানা সকল বুদ্ধিজীবীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আর ভাষাটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।

অর্থাৎ, উমাইয়্যা শাসনে অসন্তুষ্ট-ক্ষুব্ধ ছিল বেশ কটি দল। সর্বাগ্রে, বিভিন্ন শিয়া বা শিয়াঘেঁষা দল, যাদের বিশ্বাস খেলাফতের অধিকার কেবলমাত্র মুহাম্মদ(সা)এর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের, অর্থাৎ আলীর বংশধরদের। তারপর, বিভিন্নদেশীয় অনারব মুসলিম, যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক (আজামী) হিসাবে গঞ্জনা ভোগ করে আসছে — এদের মধ্যে স্বপরিচয়ের ব্যাপারে সবচে একগুঁয়ে ছিল ইরানীরা। তৃতীয়ত, ইসলামভিন্ন অন্যান্য ধর্মের বনেদী বংশগুলি, বিশেষ করে সিপাহবদ নামে তাবারিস্তানের জোরোয়াস্ট্রিয়ান সামন্তরা। চতুর্থত, উমাইয়্যা সরকারী কর্মচারীদের একটা বড় অংশ, যারা অনেকে ছিল অমুসলিম কিংবা মুসলিম হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর।

আব্বাসী বিপ্লবের ডামাডোল প্রথমে শুরু হয় প্রত্যন্ত খুরাসান প্রদেশে। উত্তর আফগানিস্তান ও বর্তমান তাজিকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান-উজবেকিস্তানের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এই প্রদেশ। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় উমাইয়্যাদের এখানে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায় জনশূন্য এলাকায় আরব-অনারবরা অবাধে মেলামেশা করত। আরবীর পাশাপাশি ফার্সীতেও বাতচিত শুরু করে দেয় আরবরা, পারসিক পোশাকও পড়তে শুরু করে। খোরাসানের কোন আরব ইরাকে গেলে নাকি তার ভাষা সম্পূর্ণ বোঝার ক্ষমতা ছিল না কারো।

এই খোরাসান ছিল নানা ধরনের অভিনব বিশ্বাসে ভরপুর। প্রাক্তন সাসানী সাম্রাজ্যের প্রজা ইরানী নব মুসলিমরা ধর্মান্তরের পরও তাদের পুরনো ঐতিহ্যগত পরিচয় ধরে রেখেছিল। জোরোয়াস্ট্রিয়ান ধর্মের ‘মিলেনারিয়ান’ বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে কোন এক ত্রাতার উত্থান ঘটবে, যিনি আলোর পক্ষে যুদ্ধ করে অন্ধকারকে পরাজিত করবেন, এসব বিশ্বাস তখনো প্রগাঢ়ভাবে বেঁচে গেছে এদের মধ্যে। বিশেষ করে তাদের‌ই অতীত সভ্যতার ধ্বজাধারী পারসিক সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিক্রিয়ায় এদের মনস্তত্ত্বে কোন এক ‘মাহদীর’ আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১২৫ হিজরী সালটিও এদের কাছে মাহদীর আগমনের নিয়ামক হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

এসকল নওমুসলিম এবং মানিকেইজম ধর্মের অনুসারীদের সমতুল্য মিলেনারিয়ান বিশ্বাসকে ভালভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় কায়সানি হাশেমী বলে এক শিয়া দল। উমাইয়্যারা যেখানে ইসলামধর্মপ্রচারে ছিল বিমুখ, সেখানে এরা মূলধারার ইসলামের সাথে শিয়া ও মানেকইজমের সিনক্রেটিজম ঘটিয়ে খোরাসানের বিশাল জনসাধারণকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর তাদের লুক্বায়িত ইমাম আবির্ভূত হয়ে সারা বিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করবেন। এই শিয়াদের নেতা ছিল আবু মুসলিম আল খোরাসানী বলে এক রহস্যাবৃত সেনাপতি।

অপরদিকে, আবুল আব্বাস ও তার চাচাদের পরিচিতি ছিল পুরো ইসলামী জগতে। আবু মুসলিমের সাথে আব্বাসী পরিবার গোপনে যোগাযোগ করে। আবু মুসলিমের দৃষ্টিতে, বিপ্লবে আব্বাসীদের নেতৃত্ব আর শিয়া সেনাদলের মূল যৌথ লক্ষ্য হল শিয়া ইমামত প্রতিষ্ঠা। আব্বাসী পরিবারের সদস্যরা কুফা-বসরার মত বড় শহরে তাদের পরিচিতদের মাধ্যমে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়। খোরাসানের উমাইয়্যা গভর্নরকে পরাস্ত করে আবু মুসলিম পূর্বদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকেন ইরাকের দিকে।

আবু মুসলিম আর আব্বাসীদের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে উমাইয়্যা সেনাদল পরাজিত হয়, আর মূল শহরগুলিতে তাদের নিযুক্ত গভর্নরদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় বিপ্লবীরা। ৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইরাকসহ খেলাফতের পূর্বাঞ্চল চলে আসে আব্বাসীদের দখলে। সিরিয়া থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে তাদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন দ্বিতীয় মারওয়ান। মিশরে পালিয়ে যাবার পথে ধরা পড়েন পরিবারসহ। নতুন খলীফার নির্দেশে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়। বেঁচে যাওয়া উমাইয়্যা রাজপরিবারের সদস্যদের চালাকি করে নেমন্তন্ন করে এনে খাবার টেবিলে হত্যা করেন আবুল আব্বাস। এভাবে উমাইয়্যাদের পুনরুত্থানের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন তিনি। একমাত্র একজন উমাইয়্যা রাজপুত্র কোনরকমে স্পেনে পালিয়ে যান। সেখানে আন্দালুসিয়ার উমাইয়্যা রাজ্য চালু থাকে আরো তিনশ বছর।

খলীফা হিসাবে আবুল আব্বাস যে দাপ্তরিক নাম গ্রহণ করেন তা হল আস-সাফ্ফাহ, যার অর্থ শেডার অব ব্লাড, রক্তপাতকারী। প্রতিপক্ষকে সন্ত্রস্ত করতে এ নাম নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তার থেকেও বড় তাৎপর্য হলো এটি একটি ‘মেসায়ানিক’ নাম। অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার জন্য যে যোদ্ধা-ত্রাতার আবির্ভাব হবে, তার সম্মাননাকর নাম এটি। বোঝা যাচ্ছে, আস-সাফ্ফাহর অনুসারীদের চিন্তাচেতনার ওপর মিলেনারিয়ানিস্ট প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু তিনি নন, দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর (‘বিজয়ী’), তৃতীয় খলীফা আল-মাহদী (‘ঐশ্বরিকপথনির্দেশিত’), প্রমুখের নামেও মিলেনারিয়ান প্রভাব উল্লেখযোগ্য।

আবার দু’দলের যুদ্ধে আব্বাসীদের কালো পতাকার বিপরীতে উমাইয়্যাদের সাদা পতাকার ব্যবহারটাও পারসিক সংস্কৃতির নওমুসলিমদের জন্যে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ইরানী সভ্যতায় সাদা রং মরণশোকের প্রতীক। এরকম ছোটখাট ব্যাপারগুলি যে শুধু আব্বাসী সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলে তা নয়। আব্বাসী বিপ্লবের প্রথমভাগে শিয়া প্রপাগান্ডা হিসাবে কারবালার যুদ্ধের শোকাবহ রিএন্যাক্টমেন্টও চালু ছিল। এখনো ইরানে সে ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হয়। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব আব্বাসীদের সমসাময়িক অনারব সুন্নি নওমুসলিমদের ওপরও চলে আসে। সেকারণে আজকের মূল আরব ভূখন্ডে কারবালার তাৎপর্য খুব বেশি নেই, অথচ ইরান-ইরাক ও ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।

আস-সাফ্ফাহ পাঁচ বছর শাসনের পর গুঁটিবসন্তে মারা যান। তারপর খেলাফতের শাসনভার নিয়ে আরো এক দফা রক্তক্ষয়ী অন্তর্ঘাত ঘটে। তার ভাই ও চাচাদের সাথে এক ভাতিজা আর শিয়া সেনাপতি আবু মুসলিমের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। নতুন খলীফা আল-মনসুর চক্রান্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন। শিয়া ইমামতের স্বপ্ন সেখানেই আপাতত মাটিচাপা পড়ে। আব্বাসীদের বিশ্বাসঘাতকতার বদলার প্রস্তুতি নিতে শিয়া গোত্রগুলি আবারো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের সকলেই ধর্মপ্রচার বা দাওয়া’র মাধ্যমে অভূতপূর্ব রিক্রুটমেন্ট চালায়। এর আগে ইসলাম ধর্মে অফিশিয়ালি ধর্মপ্রচার তেমন ছিল না। ইসলাম ছিল শুধুমাত্র আরব বিজেতা ও তাদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্মান্তরিত মাওয়ালি ক্লায়েন্টদের প্রিভিলেজ।

আব্বাসী খেলাফতের প্রশাসনব্যবস্থায় আরবদের পাশাপাশি অনারব, এমনকি অমুসলিম বা নামমাত্র মুসলিম কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল। বার্মাকী বলে একটা বনেদী পরিবার হয় আব্বাসীদের বংশানুক্রমিক উজির। এদের পূর্বপুরুষ ছিল হয় পারসিক জোরোয়াস্ট্রিয়ান নয়ত আফগানিস্তানের ভারতীয় বৌদ্ধসংঘের প্রধান। আল-মুকাফ্ফা নামে জোরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিতদের এক বংশধর ও দ্বিতীয় জেনারেশনের মুসলিম মনীষী ভারতীয় শাস্ত্র ‘পঞ্চতন্ত্রের’ ফারসী সংস্করণের আরবী অনুবাদ করেন। সাসানী আমলে রাজাদের রাজকার্য পরিচালনার গাইড হিসাবে এ বইয়ের প্রচলন ছিল। এদের প্রভাবে সিরিয়াভিত্তিক উমাইয়্যাদের বিজ্যান্টিন স্টাইল থেকে উল্টো আরো বেশি প্রাচ্যধর্মী হয়ে পড়ে প্রশাসনব্যবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা হয় আরো বেশি কেন্দ্রীভূত। সাসানী শাহেনশাহদের মত খলীফার অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় খেলাফতের সুদূরতম প্রদেশের কাজকর্ম। অর্থাৎ যেখানে উমাইয়্যারা পছন্দমত ট্রাইবাল চীফদের ওপর প্রাদেশিক শাসনভার পুরোপুরি ছেড়ে দিতেন, সেখানে আব্বাসী প্রশাসন হয় সাসানী পারসিকদের মত কেন্দ্রীভূত, আর একনায়কতান্ত্রিক। অবশ্য দুই খেলাফতের আমলেই ধর্ম থেকে রাজকার্য পৃথক ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।

আব্বাসী খেলাফতে ইরানী এমন প্রভাবের পাশে পুরনো আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যেসব আরব ট্রাইবাল স্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে শহুরে হতে পেরেছে তারা বর্তে গেছে, আর বাকিরা সম্ভবত ফিরে গেছে তাদের আদি মরুময় বাসস্থানে, নয়ত আরো দূরদূরান্তে কোন নতুন রাজ্যজয়ে।

ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও আব্বাসী বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ। আগে বলছিলাম, এই মুদ্রার কুফী হরফের কথা। এর আবির্ভাবের এক বছর আগেই মধ্য এশিয়ায় চীনা তাং সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন আবু মুসলিম। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল চীনা কাগজের কারিগর। তাদের মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে কাগজ। এর ফলে আরবী লিপির চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। আগে পাথরে-চামড়ায় লিখতে হত কষ্ট করে। আর এখন কলম দিয়ে কয়েক খোঁচায় কাজ হয়ে যায়। নুক্তা-হরকত ইত্যাদি দিয়ে অক্ষরগুলোর সঠিক উচ্চারণ বোঝানোর বাঁধা আর থাকে না। সাথে উদ্ভব ঘটে আরবী ক্যালিগ্রাফীর। কুরআনের সাথে সাথে হাদীস ও গ্রীক ক্লাসিকগুলিও প্রথমবারের মত সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

আব্বাসী আমল পর্যন্ত কিন্তু সুন্নাহ বলতে শুধু মুহাম্মদ(সা) নয়, তার যত সঙ্গীসাথী, অন্যান্য আদি মুসলিম, প্রাক্তন ধর্মপরায়ণ চার খলীফা, এমনকি কিছু ন্যায়বিচারক উমাইয়্যা খলীফা, তাদের ট্র্যাডিশনকে একটা ব্ল্যাংকেট টার্ম দিয়ে বোঝানো হত। ১৫০ হিজরীতে ইমাম শাফিয়ীর হাত ধরে আজকের হাদীস সংগ্রহগুলির সূচনা হয়। সুন্নাহ টার্মটা আরো নির্দিষ্ট হয়ে মুহাম্মদ(সা)এর ট্রাডিশন বোঝাতে শুরু করে। এ পর্যন্ত হাদীসগুলি লোকমুখে বেঁচে ছিল। অর্থাৎ, ইসলামের প্রথম ১৫০ বছরে হাদীস জানা ও পালন করার কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেসব প্রমাণ রেট্রোস্পেক্টিভ। ইসলামের ইতিহাসসংক্রান্ত প্রথম বইগুলিও লিখিত হয় আব্বাসী শাসনামলে। সেগুলিও ছিল শ্রুতিনির্ভর, কোন ক্ষেত্রে বহুলাংশে বাইবেল-তোরার বিষয়বস্তু দ্বারা সাপ্লেমেন্টেড। এধরনের ইহুদী ঐতিহাসিক প্রভাবকে নাম দেয়া হয়েছে ইসরাইলিয়াত।

আব্বাসী খলীফাদের আমলে আজকের সুন্নী মতবাদের শুরু হলেও অন্যান্য অনেক যুক্তি ও দর্শননির্ভর বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। তার পাশাপাশি সুফী বিশ্বাসের যাত্রা শুরুও এদের সময়। অনেকভাবে উমাইয়্যা শাসনামলের চিন্তাধারার আড়ষ্টতাগুলি কেটে যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও চিন্তার মোটামুটি স্বাধীনতা ছিল। সিল্ক রোডের বাণিজ্যের মাধ্যমেও বহু কিছুর চালাচালি হয়। শেষ পর্যন্ত আব্বাসীদের সাসানী স্টাইলের অ্যাবসলুট পাওয়ারই ছিল তাদের অধঃপতনের মূল কারণ। পরের দিকের অকর্মন্য খলীফাদের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত মানুষ ধর্মের মাঝে ন্যায়বিচার খুঁজে ফেরে। তার সুযোগ নিতে তৈরিও ছিল কিছু ধর্মীয় নেতা। এদের টানাপোড়েনের রাজনীতির বলি হন ইসলামের স্বর্ণযুগের মনীষীদের অনেকে, তাদের বহু কাজ হয় বিস্মৃত, বহু গ্রন্থাগার হয় ভস্মীভূত। উমাইয়্যা-আব্বাসী দু’খেলাফতের ক্ষেত্রেই সমান খাঁটে এই প্রবাদবাক্য, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি!’

সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

কিংডম অফ গড

Featured Video Play Icon

বড়দিনের শুভেচ্ছা সবাইকে!

মার্কিন দেশের মানুষ আজকাল মেরি ক্রিসমাস না বলে অনেক সময় হ্যাপি হলিডেজ বলে সম্ভাষণ করে। উদ্দেশ্য, যারা খ্রীষ্টান নয়, তাদের অনুভূতিতে আঘাত না দেয়া। আর মেরি ক্রিসমাস বললে উল্টো যদি কথা শুনতে হয়, ‘আমি তো খ্রীষ্টান নই’? ভিনদেশী চেহারার হলে তো কথাই নেই। আর কিছু মুসলিম ও ইহুদী আসলেই এ ব্যাপারে একটু স্পর্শকাতর। যাই হোক, মার্কিনরা আপনাকে জোর করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাধ্য করবে না।

আমার অবশ্য মেরি ক্রিসমাস সম্ভাষণ শুনতে ও ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগে না। ক্রিসমাসের উপলক্ষ্যে ছুটি তো আর যেনতেন হলিডে না। সমঝদারদের কাছে সেক্যুলার ছুটি আর স্পিরিচুয়াল ব্রেক একরকম নয়। রিল্যাক্স করার সুযোগ যখন একটু পেয়েছি, স্পিরিচুয়াল একটা ব্রেক হোক সানন্দে।

ডিসেম্বরের ২৫শে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আসলে সম্ভবত হয়নি। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডিসেম্বরের ২৫ দক্ষিণায়ণের দিন, উত্তর গোলার্ধ সূর্য হতে তার সবচে দূরপ্রান্তে গিয়ে আবার ফিরে আসা শুরু করে। অর্থাৎ দীর্ঘরাত্রির পালা শেষ, দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, উষ্ণতা ফিরে আসা শুরু করে ‘পৃথিবীতে’। সাথে আসে বসন্ত ও প্রকৃতির প্রাচুর্য। খ্রীষ্টের জন্মের আগ থেকেই এ দিনটি তাই অনেক প্যাগান ধর্মানুসারীদের, বিশেষ করে রোমানদের কাছে ছিল পবিত্র। এ হলো প্রকৃতির পুনর্জন্ম।

ভার্জিন মেরীর থেকে যীশুর সতীজন্ম ব্যাপারটাও পুরনো আইডিয়া। বিশেষ করে গ্রীক মিথে জিউসের জন্ম একই রকম। এমনকি গৌতমবুদ্ধের জন্মও মায়াদেবীর বুকের পাশ থেকে, অর্থাৎ হৃদয় হতে। তাঁর জন্মও সাধারণভাবে হয়নি।

প্রাচীন মিশরের দেবী আইসিস, অনিষ্টের দেব সেথের ষড়যন্ত্রে নিহত স্বামী অসাইরিসের মৃতদেহের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে লেবাননের রাজপ্রাসাদ থেকে ফেরার পথে দুঃখের আতিশয্যে তাঁকে আলিঙ্গন করেন। আর তার ফলে ‘সতীজন্ম’ হয় দেবতা হোরাসের। মাতা মেরীর কোলে বসা শিশু যীশু যেমন নতরদামসহ নানা গীর্জায় মূর্তিআকারে শোভা পাচ্ছে, আইসিসের ক্রোড়ে মাতৃদুগ্ধপানরত হোরাসের একইরকম ভাস্কর্য বিশ্বের সকল জাদুঘরের প্রাচীনমিশরীয় সেকশনে ভূরি ভূরি রয়েছে। তার কোনকোনটিতে আবার অসাইরিস এসে যুক্ত হয়ে হোলি ট্রিনিটি সম্পূর্ণ করেছেন।

ডায়োনাইসাস বলে এক গূঢ়দেবের উপাসনাও প্রচলিত ছিল যীশুর আগে একই এলাকায়। তাঁর জন্মও ভার্জিন বার্থ। ডায়োনাইসাসের উপাসকরা যেধরনের মিস্টিসিজম বা গূঢ়তত্ত্বের চর্চা করত, তা সুফীবাদ বা বাউলদর্শনের আদিমরূপ ধরলে ভুল করা হবে না। তাদের সেসব মিস্টিক ব্যাপারস্যাপার গ্নস্টিক নামক আদি খ্রীষ্টানদের মাধ্যমে আর্লি ক্রিস্টিয়ানিটিতে এসেছিল, যার অনেক কিছুর ছায়া বর্তমানেও রয়ে গেছে। তার একটা হল কম্যুনিয়ন, যেখানে ক্যাথলিকরা রুটি ও ওয়াইন খায় যীশুর রক্ত-মাংসের প্রতীক হিসাবে, কারণ তা ভক্ষণের মাধ্যমে যীশুর আত্মিক গুণ প্রবেশ করে তাদের আত্মায়, অথচ বলা হয় উল্টো যে তারা প্রবেশ করছে কিংডম অফ গডে। মিশরের নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত গস্পেল অফ টমাসের পান্ডুলিপিতে অনেক কিছু ম্যাথু-মার্ক-ল্যুক-জনের থেকে আলাদা এবং গূঢ়তাত্ত্বিক, কারণ তা ছিল গ্নস্টিকদের মিস্টিক বাইবেল।

অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের দৈব উপায়ে জন্মসহ অন্যান্য অনেক ব্যাপারস্যাপার সে যুগের মানুষের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তেমন কোন নতুন আইডিয়া না নিয়ে এসেও খ্রীষ্টধর্ম এতকিছুর মধ্যে কিভাবে নিজের আলাদা একটা জায়গা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল? অনেকে রোমসম্রাট কনস্ট্যানটিনের দিকে আঙুল তুলে দেখাবেন, কারণ তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করাতেই সে ধর্মবিশ্বাসের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা পায়।

আমার হিসাবে তা শুধু একটিমাত্র কারণ। কনস্ট্যানটিন খ্রীষ্টান হয়েছেন, সেও যীশুর জন্মের তিনশ’ বছর পর। এত শতাব্দী ধরে নানা বিশ্বাস আর ধর্ম আর রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়রানির মধ্যে খ্রীষ্টানরা তো হারিয়ে যেতে পারত। তা তো হয়নি।

খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম আঁকড়ে ধরে রেখেছিল কারণ ক্রিস্টিয়ানিটির বিশ্বাস এমন একটা মানবিক গুণের পরিপূর্ণ অর্থবহতা তাদেরকে দিয়েছিল, যেটা অন্যান্য সমসাময়িক ধর্মে গতানুগতিকভাবে শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় আচারপালনের মাঝে হারিয়ে গেছিল। সে মানবিক গুণটা হলো কমপ্যাশন — করুণা, পরদুঃখকাতরতা যেই শব্দ দিয়েই বলুন না কেন, মনে মনে বোধ না করলে অর্থ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।

লাভ ইয়র এনেমিজ, ডু গুড টু দোজ হু হেইট ইউ, ব্লেস দোজ হু কার্স ইউ, প্রে ফর দোজ হু মিসট্রীট ইউ — এ কথাগুলো শুধু যীশু বলেননি। একই বাণী যুগে যুগে গৌতমবুদ্ধসহ আরো অনেকে দিয়ে গেছেন। এসকল স্ববিরোধী উপদেশের কারণ কি? কারণ, মানবস্বত্ত্বা একক, যখন এক মানুষ আরেককে আঘাত করে, সে তা করে নিজেকেই। এটা কেবল একটি মাত্রা। এসবের অর্থ যে আবার ওম শান্তি বলে দুনিয়া থেকে পলায়নপর হওয়া, তাও নয়। এসবের ‌অর্থ শত দুর্দশা-বিপত্তি-দুঃখ-জরায় জর্জরিত হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের মনের নৈতিক দ্বন্দ্বগুলোকে সামঞ্জস্যে আনা। নিজেকে হারমোনাইজ করা, চক্রের আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে চক্রের মাঝে স্থির থাকা। মিডল পাথ ইজ দ্য বেস্ট পাথ।

সুতরাং যীশুর সতীজন্ম আসলে কমপ্যাশনের জন্ম — সাধারণ জন্ম নয়। ঈশ্বরের উচ্চারিত দৈব প্রেরণার মাধ্যমে স্পিরিচুয়াল রিবার্থ। পশুপ্রকৃতিকে বশ করে শুচি মানবরূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ। খ্রীষ্ট-বুদ্ধসহ যুগে যুগে যত ‘নবী’, ‘দেবদেবী’, পুরাণের বীরপুরুষদেরকে মানুষ রাজাসনে বসিয়েছে, সবাই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে সে আসনের যোগ্যতা লাভ করেছেন। খ্রীষ্টানদের আত্মিক মুক্তির পথে যীশু ভেহিকল বা যান মাত্র। আবার বৌদ্ধধর্মে যে কোন সাধারণ মানুষও নিজ পথে বুদ্ধ হবার আর নির্বাণপ্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ যেকোন সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব আধ্যাত্মিক ‘পুনর্জন্মলাভ’।

ইসলামধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ীও ঈসানবীর সতীজন্ম। আর হযরত মুহাম্মদের(সা) এরকম একটা স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটার উপরে খুব বেশি গুরুত্ব খুব একটা দেয়া হয়না, যদিও কোন কোন সুফী তরিকায় সে ঘটনা বেশ অর্থপূর্ণ। সেটা হল ফেরেশতা জিবরাইলকর্তৃক চারবার মুহাম্মদের বক্ষবিদারণ আর হৃদয় প্রক্ষালন

যীশুর ‘সতীজন্মের’ কারণে তিনিই সেই ব্যক্তি হলেন যিনি নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগ করলেন, ক্রুসিফিকশনের মাধ্যমে আত্মার আরেক সমতলে পৌঁছে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন দুঃখজরা থেকে মুক্তির উপায়। সে সমতলে তিনিই রাজা, কিং অফ কিংস, লর্ড অফ লর্ডস। শুধু ইহুদীদের নয়, সকল চৈতন্যময় উপলব্ধির রাজা, কিং অফ অল কনশাসনেস। সাথে দেয়া ভিডিওতে জর্জ হেন্ডেলের মেসিয়া ওরাটোরিওর হালেলুইয়া কোরাসে সেই ‘রাজার’ মহিমাকীর্তন করা হচ্ছে — ২৭৭ বছর পরেও ক্রীসমাসে এটা এখনও বেশ জনপ্রিয় ক্লাসিকাল সংগীত।

আপনার-আমার-সবার স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হোক, মনের চোখ খুলুক, হৃদয় নিষ্কলঙ্ক হোক — নিজ অন্তরকে জয় করে যেন সকলে হতে পারি মনের ‘রাজা’! মেরি ক্রীসমাস!

ইথিওপিয়ার রাজা আবরাহার ৩৩৫ থেকে ৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি মেকেল্লে শহরের আব্রাহা গীর্জার ম্যুরালে শিশু যীশুকে স্তন্যদানরত মাতা মেরীর ছবি। ইসলামের ইতিহাসে একই নামের আরেক ইথিওপীয় রাজা আছেন যার আরব উপদ্বীপে আক্রমণের নেপথ্যে সূরা ফীল নাযিল হয়!

পুত্র দেবতা হোরাস মাতা আইসিসের কোলে বসে স্তন্যপান করছেন। ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এই স্ট্যাচুয়েটটি ৬৬৪ থেকে ৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রাচীন মিশরে তৈরি।

দেবী আইসিস ডানে, বামে হোরাস, মাঝে অসাইরিস। এরকম ট্রিনিটি বা ত্রিমূর্তির কনসেপ্ট হিন্দুধর্মেও রয়েছে। ফাদার-সান-হোলিগোস্ট্র খ্রীষ্টান ট্রিনিটি এই ত্রিমূর্তির অ্যাবস্ট্রাক্ট ইন্টারপ্রেটেশন।

মিউনিখের গ্লিপ্টোতেক মিউজিয়ামে শিশু ডায়োনাইসাসকে কোলে নিয়ে তাঁর রক্ষক ও উপদেষ্টা সাইলেনাসের মূর্তি। ভাস্কর্যটি চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকে ক্লাসিকাল গ্রীক যুগের শিল্পী লিসিপাসের তৈরি।

তৃতীয় শতকে তৈরি কন্সট্যান্টিন দ্য গ্রেটের প্রস্তরমূর্তি। কন্সট্যান্টিনের মা হেলেনা ছিলেন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান। কন্সট্যান্টিন তাই ছোটবেলা থেকে সেধর্মের বিভিন্ন ব্যাপারস্যাপার দেখে আসছিলেন। কিন্তু তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন মৃত্যুশয্যায় এসে। তার আগ থেকেই অবশ্য হেলেনা ও কন্সট্যান্টিন নানাভাবে খ্রীষ্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তার বিপরীতে তাঁর উত্তরসূরী রোমসম্রাটরা ছিলেন খ্রীষ্টানদের প্রতি যারপরনাই নির্মম। নিরোর সময় হাজারে হাজারে খ্রীষ্টানদেরকে জনতার বিনোদনের উদ্দেশ্যে ‘সার্কাসের’ ময়দানে হিংস্র জানোয়ারদের খাওয়ানো হয়। কনস্ট্যান্টিন খ্রীষ্টান হবার বারো বছর আগেই খ্রীষ্টান ধর্মগুরুদের আদেশ দেন কাউন্সিল অফ নিকায়ার মাধ্যমে ধর্মটিকে যথার্থ সাংগঠনিক রূপ দিতে। ক্যাথলিক ও অর্থডক্স ধর্মের যাত্রা শুরু হবে, কিন্তু এর ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ্রীষ্টান গোষ্ঠীর নিজস্ব আচার ও ধর্মবিশ্বাস অবদমিত হয়।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা যীশু খ্রীষ্টের লাস্ট সাপারের দৃশ্য যেখানে তিনি তাঁর বারো শিষ্যকে তাঁর নিজ শরীরের রক্ত-মাংস ভক্ষণ করার নিমন্ত্রণ দিচ্ছেন, যদিও তাঁরা খাচ্ছেন রুটি ও ওয়াইন। এর থেকেই হোলি কম্যুনিয়ন বা ইউক্যারিস্ট রিচুয়ালের উৎপত্তি।

প্যাপিরাসের উপরে কপ্টিক ভাষায় লেখা গস্পেল অফ টমাসের একটা কপি কাকতালীয়ভাবে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা একটি জারে খুঁজে পায় মিশরীয় এক কৃষক, ১৯৪৫ সালে। টমাস ছিলেন যীশুর বারো শিষ্যের একজন। প্রধান চার শিষ্যের যে গস্পেলগুলি নিয়ে নিউ টেস্টামেন্ট, তাদের থেকে এটির বিবরণী একটু ভিন্ন। কিছু স্কলার আবার কোরানের কোন কোন অনুচ্ছেদের সাথে এর অংশবিশেষের মিল খুঁজে পেয়েছেন। ধারণা করা হয়, চতুর্থ খ্রীষ্টীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান পুরোহিত আথানাসিওসের নির্দেশে এ গস্পেল মাটিচাঁপা দেয়া হয়। আথানাসিওস সম্রাট কনস্ট্যান্টিনের খ্রীষ্টধর্মগ্রহণের পরে সে ধর্মকে ইন্সটিটিউশনাল রূপ দিতে বহু কঠোর সংস্কারসাধন করেন। ট্রিনিটির আইডিয়াটিকে গ্রহণ করা হয়, আর যেসব তত্ত্বে যীশুকে স্বয়ং ঈশ্বর স্বীকার করা হত না, তাদেরকে অ্যাপোস্টেট বা কাফের আখ্যা দেয়া হয়। এই দলের মধ্যে ছিল বিশপ আরিয়ানাসের আরিয়ান স্কুল। বেশিরভাগ গথ ও অন্যান্য ‘বর্বর’ জাত আরিয়ান চিন্তাধারার খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল।

হালেলুইয়া টাইবেরিয়ান হিব্রু শব্দ যার শব্দমূল দুটি। হিল্লেল মানে প্রশংসা, ‘ইয়া’ খোদা ইয়াৰের আরেক নাম। অর্থাৎ প্রেইজ বি টু গড, সকল প্রশংসা খোদার, আলহামদুলিল্লাহ। হিব্রু বাইবেলের বুক অফ সামসে কয়েকবার এ শব্দ এসেছে। বুক অফ সামসের গানগুলি ডেভিড বা দাউদের নামের সাথে জড়িত। অর্থাৎ হয়তবা দাউদের ওপর নাযিল হওয়া যবুর কেতাবের অংশ। যদিও প্রাচীন মিশরে সামসের গানগুলির প্রায় হুবহু একই গীতি ফারাও আখেনাতেনের শাসনামলে একেশ্বর আতেনের উদ্দেশ্যে রচিত হয়।

ষোড়শ শতকের তুর্কী মিনিয়েচার শিল্পীরা ইসরা বা মিরাজ কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। মিরাজ হলো হযরত মুহাম্মদের অলৌকিকভাবে বুরাকের পিঠে প্রথমে জেরুজালেমযাত্রা, তারপর সাত আসমান পাড়ি দিয়ে স্বর্গ-নরক পরিভ্রমণ, খোদা ও অন্যান্য পয়গম্বরদের সাথে মোলাকাত। সেযাত্রায় আল্লাহ তাঁকে দেন তাঁর প্রাপ্য কমান্ডমেন্টস, ঈমান-নামাজ-রোজা-হজ্জ্ব-জাকাত ইত্যাদির নির্দেশ। যাত্রাশুরুর আগে ফেরেশতা জিবরাঈল চতুর্থ ও শেষবারের মত তাঁর বুক চিরে হৃদয়ের পরিশুদ্ধি করেন। ডানের দৃশ্যে তাই চিত্রিত হয়েছে। যথারীতি মুহম্মদের মুখমন্ডল দেখানো হয়নি, যাতে তাঁর চিত্র পূজোর বস্তুতে পরিণত না হয়ে যায়। কারণ ঈশ্বরই একমাত্র সকল উপাসনার উদ্দেশ্য।

ল্যুক ৬:২৭। ষষ্ঠ চ্যাপ্টারে সারমনস অন দ্য প্লেইনসে যীশু তাঁর জীবনাদর্শগুলি পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরেছিলেন শিষ্যদের কাছে। ‘লাভ দাই এনেমিজ’এর সাথে আরো রয়েছে ‘জাজ নট, অ্যান্ড ইউ শ্যাল নট বি জাজড’ আর ‘ফরগিভ অ্যান্ড ইউ উইল বি ফরগিভেন’।

 

পুরাকীর্তির সপক্ষে

পুরাকীর্তির দরকারটা কি? এটা কি খায় না পিন্দে? গরিব মানুষের আবার পুরাকীর্তি কি? অথবা — আধুনিক যুগে আমরা হবো আধুনিক, কেন ফিরে ফিরে প্রাচীনকে আগলে রাখা? এগুলির সাথে আমাদের বর্তমান পরিচয়ের যোগাযোগ কোথায়?

কিংবা, তালেবান-আইসিসের মত ‘এগুলি মোনাফেকি, মোশরেকি, কুফ্ফার; ধ্বংস কর সব!’

শেষ ‘যুক্তি’টা থেকে উল্টোদিকে যাই।

তালেবানরা যখন বামিয়ানের পাহাড় কেটে তৈরি বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি রকেট মেরে ধুলায় মিশিয়ে দেয়, তখন আমার চোখ ফেঁটে জল এসেছিল। বামিয়ানের বুদ্ধ এমন এক শৈলীর উদাহরণ যাকে বলে গান্ধার শিল্প — ভারতীয় সনাতন বৌদ্ধ শৈল্পিক রীতির সাথে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে আসা গ্রীক শিল্পী আর তাদের বংশধরদের গতিশীল আইডিয়া মিলে তৈরি হয়েছিল অনন্য গ্রেকো-বুডিস্ট আর্ট।

সিরিয়া-ইরাকে আইসিস গণহত্যাসহ নানা অপরাধ তো করেছেই। তার সাথে সাথে পালমিরার প্রাচীন অনন্য স্থাপত্যশৈলী আর জাদুঘরে রক্ষিত পুরাকীর্তি ধ্বংস করেছে। পালমিরাও গান্ধারশিল্পের মত অনন্য কারণ আরবদের সাথে গ্রীক মিলেছে এখানে। আবার অনেক সুন্দর সুন্দর মসজিদ, সমাধি আর সুফী খানকাও ট্যাংক-রোলার দিয়ে গুড়িয়ে আইসিস ধূলিসাৎ করেছে। চোদ্দশ’ বছর ধরে বিভিন্ন মুসলিম আমলে, এমনকি ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চার খলিফার আমলেও, এ এলাকায় এরকম ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি।

মালির তিমবাক্তুতেও ২০১২ সালে ইসলামী কট্টরপন্থী দল আনসারদ্বীন প্রাচীন মালি সাম্রাজ্যের আদি ইসলামী সুফী সন্তদের অদ্বিতীয় সমাধির শৈলী আর সংলগ্ন মসজিদের অংশবিশেষ ধ্বংস করেছে। অথচ সুফীদের মাধ্যমেই সে এলাকায় ইসলামের প্রথম প্রচার-প্রসার হয়।

তাদের এসব করার জন্যে তারা কেতাব ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে সন্দেহপূর্ণ নানা ফতোয়া আর পুরনো উদাহরণ বের করে। কিন্তু আসল ইচ্ছেটা হল, তারা প্রাচীন কালে নবীরা যেমন কা’বা বা অন্য কোন পবিত্রস্থানের ভেতর রাখা মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে মনে মনে পুণ্যার্জন করতে চায়। সুফীদের কোন কোন গ্রুপের ধর্মচর্চা মূলধারার হিসাবে একটু প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পালমিরা-বামিয়ান কি দোষ করলো তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ সিরিয়া-আফগানিস্তান এখন মুসলিম সংখ্যাগুরু, আর কেউই সেসব জায়গায় গিয়ে প্রাচীন ধর্মের অবতারদের উপাসনা করে না।

বরং পুরাকীর্তি টিকিয়ে রাখারই যুক্তি আমার মনে হয় কোরান-সুন্নাহ পড়লে পাওয়া যায়। সূরা আহকাফে বর্ণনা করা হয়েছে আদ্ আর সামুদ জাতের ওপর গজবের কাহিনী। সৎপথ থেকে বিচ্যুত হবার ফলে তাদের নগরগুলিকে ভূমিকম্প আর ঝড় দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়। মাদাইন সালেহ বলে সৌদি আরবের মরুভূমিতে এখনো সামুদ জাতির নগরের ধ্বংসাবশেষ আছে। সুপ্রচলিত একটি হাদীসে মাদা’ইন সালেহর মতো ‘অভিশপ্ত স্থান’ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবার উপদেশ বলা থাকলেও, কুরআনের সূরা রূমের নবম আয়াত অনুযায়ী আমার মতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে নৈতিক শিক্ষাগ্রহণের অনুপ্রেরণা রয়েছে। আর পুরাকীর্তি ধ্বংস করার ইসলামী যুক্তি আমি খুঁজে কোথাও পাইনি।

সৌদির কথা যখন উঠলো, তখন স্বীকার যেতেই হয় আইসিস, তালেবান, আনসারদ্বীন — এদের পেছনে সৌদি সরকারের সরাসরি ইন্ধন যদি না থেকেও থাকে তো তাদের নাকের ডগা দিয়ে ধনাঢ্য সৌদি নাগরিকেরা প্রশ্নবিদ্ধ চ্যারিটিতে পয়সা ঢেলে সন্ত্রাসবাদকে মালসামান দিয়েছে। অথচ সৌদিতে কিন্তু কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জাদুঘরে, জেদ্দা জাদুঘরে অনেক পুরাকীর্তি সংরক্ষিত আছে, যাদের মধ্যে প্রচুর প্রস্তরমূর্তি। সেগুলিও মাঝেমধ্যে বাইরের দেশে ট্রাভেলিং একজিবিশনে যায়। মাদাইন সালেহসহ অন্যান্য নগরেও এখন পর্যটকরা যেতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়ার সবচে’ ‘বর্বর’ মুসলিম রাজ্যটিও তাদের পুরাকীর্তি টিকিয়ে রেখেছে, আর বহির্বিশ্বকে তা প্রদর্শন করে। পরিহাসের ব্যাপার, ওয়াহাবি কট্টরপন্থীরা ইসলামধর্মের সাথেই জড়িত অনেক সমাধিচিহ্ন — সমাধি নয় — ধ্বংস করে দিয়েছে এই অজুহাতে যে অন্যথায় অশিক্ষিত মানুষ সেগুলিতে গিয়ে খোদার পরিবর্তে নবী বা সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করবে।

অন্তত এটুকু মনে হয় দাবি করতে পারি যে ইসলামে খুঁজে খুঁজে পুরাকীর্তিবিরোধী নিয়ম পাওয়া গেলেও পুরাকীর্তির সপক্ষে উদাহরণ কম নয়। শুধু ইসলামে নয়, যেকোন ধর্মের একটু গোঁড়ারা প্রাচীন শিল্পকর্ম বা পান্ডুলিপি নিয়ে একটু অস্বস্তিতেই থাকে। অধুনা ভারতে হিন্দু কট্টরপন্থীরা পাঁচশো বছরের পুরোনো অনন্য স্থাপত্যশৈলীর বাবরী মসজিদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। শুধু যে ধর্মান্ধরাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী ধ্বংস করেছে তা নয়, কমিউনিস্ট চীনে ষাটের দশকে কালচারাল রেভলুশনের সময় অনেক পুরোনো বৌদ্ধ ও তাওইস্ট মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়। প্রাচীন চীন সম্রাটদের সমাধি লুট করে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করে ফেলে সরকারি মদদ পুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রের দল। একই ঘটনা ঘটে কমিউনিস্ট খ্‌মের রুজ শাসিত কম্বোডিয়াতেও

যা হোক, ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাকীর্তি ধ্বংস করার যুক্তিখন্ডনের একটা চেষ্টা করলাম। এখন জবাব দিই আধুনিক টেকি বস্তুবাদী আত্মতুষ্ট জেনারেশনের প্রশ্নের। পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের যোগাযোগ কোথায়। কেন তারা অমূল্য।

কম্প্লেসেন্ট বলে আমরা আজকের যুগের অনেক কিছুই মেনে নিই, ধরে নিই ‘গ্রান্টেড’। টাকা আছে, কেন টাকা আছে আড়াই হাজার বছর ধরে জানি না! সুতরাং বিটকয়েনে পয়সা ঢালি! টাকাকে নাকি সে প্রতিস্থাপন করবে। টাকা কেন এতদিন ধরে কি কি গুণের কারণে কি কি প্রয়োজন মেটায় তা আমরা জানি না। এগুলো জানতে হলে ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান পড়ে বোঝা যায়। কিন্তু কেউ কি কখনো চিন্তা করে দেখেছে কি ধরনের পরিস্থিতি প্রাচীন তুরস্কের ছোট্ট লিডিয়া রাজ্যে টাকার উৎপত্তি ঘটালো, অথচ তারও প্রাচীন যুগের আরো উন্নত সভ্যতা মিশরে টাকার প্রচলনই ছিল না?

মনে হতে পারে, এসব প্রশ্ন অবান্তর। কি হবে এসব জেনে! কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি! আমরা দশ হাজার বছর আগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতাম, এখনো করি। যেধরনের কুসংস্কার নিয়ে চলতাম, এখনো সেসব বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে কোন না কোনভাবে। অর্থাৎ খুবই মৌলিক অনেক ব্যাপার আছে যেগুলি দশ হাজার বছর আগে যতটা সত্য ছিল আজও ততটা।

দুনিয়ার সকল মানুষকে ভাবুন একটা বড় প্রাণী, তার বিভিন্ন কোষের মধ্যে নানারকম মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তার বিবর্তন হয়। আমাদের পক্ষে সে প্রাণীটি কোনদিকে গেলে তার উদ্বর্তনটা সুনিশ্চিত হবে, তা বোঝার জন্যে অতীতের দিকেই দৃষ্টিক্ষেপণ একমাত্র রাস্তা। কেন হঠাৎ করে ময়েন্জোদারোর এত উন্নত সভ্যতা বিলুপ্ত হলো সে এক রহস্য। যদি তার সোজাসাপ্টা উত্তর বেরুত, তাহলে বোধহয় আমরা সামগ্রিক সার্ভাইভাল পাজলটার আরেকটা মিসিং পীস পেতাম। ইসলামে আদ্-সামুদের ধ্বংসাবশেষ দেখে যেসকল প্রকারের শিক্ষাগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে হয়ত এও একটা! যখন আদসামুদের মত গজব আবার আসবে তখন ধনীগরীব কেউই পরিত্রাণ পাবে না!

আর এসকল প্রাকটিক্যাল ব্যাপার-স্যাপারের উপরে আছে আর্ট — শিল্প! একটা সুন্দর নিখুঁত কারুকার্য দেখলে কার না মন জুড়ায়! ময়েন্জোদারোর বালাপরিহিত নর্তনরত কিশোরীর ছোট্ট একটা মূর্তির মধ্যে আমাদের অতি আদি এক পূর্বসূরীর যে মানবিক ছবি ফুঁটে উঠেছে, সামনাসামনি দেখলে মনে হয় এ যুগেরই কোন গ্রাম্য লাস্যময়ী বালিকা।

শুধু তাই নয়, ইরাকের এশনুন্নার জিগুরাতে পাওয়া ছোট ছোট নারী-পুরুষ-শিশুর স্ট্যাচুয়েটগুলি যেভাবে হাত জোড় করে চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তাতে চিত্রিত হয়ছে তাদের অসহায়ত্ব। তাদের সহায় ঈশ্বরকেই স্মরণ করছে তারা। সেদেশে দুই নদী ছিল বেয়ারা, মিশরের নীলনদের মত নিয়মিত দু’তীর প্লাবিত করত না। মাঝেমধ্যে খরা হত, তখন আকাল। আবার ভয়াবহ বন্যাও হত, তাতেও জীবন ও সম্পদের ক্ষয়। সেকারণে তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আর ধর্মীয় দর্শন ছিল অদৃষ্টবাদী বা ফেটালিস্ট। নূহনবীর বজরা আর মহাপ্লাবনের কাহিনীও মূলে সেদেশের।

সোজা কথায় আমরা আজ যা যা বিশ্বাস করি, যেসব মূল্যবোধকে উচ্চাসন দিই, আমাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে কেন সেসবে উপনীত হলেন, কি ধরনের পরিস্থিতি তাদেরকে সেসবের দিকে চালিত করল — এসকল কিছুর উত্তর আছে পুরাকীর্তি আর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের গবেষণার মধ্যে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সেসবকে ধ্বংস করে আমাদের পুরনো পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে জোর করে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করতে, আমরা পারব না! কারণ সেসকল প্রাচীনতা আমাদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে, জাতিগত স্মৃতির মধ্যে মজ্জাগতভাবে প্রথিত!

বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি — তালিবানদের ধ্বংস করার আগে ও পরে। ষষ্ঠ শতকে তৈরি এবং হিউয়েস ৎসাং এগুলির বিবরণ দিয়ে গেছেন। আদি মুসলিমদের আমলে টিকে থাকলেও আওরাংজেব প্রভৃতি ফ্যানাটিক শাসক এগুলি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালান।

গান্ধার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ লাহোর জাদুঘরে সংরক্ষিত উপবাসরত বুদ্ধের এই মূর্তিটি। সম্ভবত চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে তৈরি। বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির আগে তিনি শ্রমণদের সাথে সংযমসাধনা করতেন, সম্ভবত এটা সে সময়ের প্রতিকৃতি। তাঁর দেহ কংকালসার, চক্ষু কোটরাগত; কিন্তু মুখে স্মিতহাসি আর অসাধারণ এক ঔজ্জ্বল্য। গ্রীক শিল্পীরা ছিলেন রিয়েলিস্টিক, কোন ভারতীয় শিল্পী বুদ্ধকে এ ভাবে কল্পনা করার আইডিয়াও পেত না!

পালমিরার দেবতা বা’লের মন্দির ২০১৫তে আইসিস ধ্বংস করে ফেলে। ৩২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরটি খ্রীষ্টান রোমান সম্রাটদের পাগানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযানের সময় বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু নানা সাম্রাজ্যের উত্থানপতন সত্ত্বেও টিকে রয়েছিল আইসিস পর্যন্ত।

জার্মানীর ফ্রাংকফুর্টের লীবীগহৌস জাদুঘরে সংরক্ষিত পালমিরিন আর্টের নিদর্শন। ১৫০-২০০ খ্রীষ্টাব্দের লাইমস্টোনে খোদাই করা সমাহিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে পশুবলির রক্ত ধরার পাত্র। শিল্পটির শৈলী আদতে গ্রীক হলেও সাবজেক্ট স্পষ্টতই সেমিটিক (হিব্রু বা আরব) কালচারের মানুষ।

পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যের সিদি ইয়াহিয়া আল আন্দালুসি ছিলেন সাংকারে মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ। তাঁর নামে পরিচিত সিদি ইয়াহিয়া মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৪৪০ সালে। তিমবাক্তু সেসময় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্যে সুপরিচিত ছিল — বর্তমানের আফ্রিকার মত নয়। মসজিদের বিশাল কাঠের দরজায় খোদাই করা ডিজাইন ছিল, মাগরেবী রীতির শৈলীতে। আনসারদ্বীন ২০১২তে অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের মালির মুসলিমদের তীর্থস্থান এ মসজিদটির দরজা ভেঙ্গে ইট তুলে বন্ধ করে দেয়।

মাদাইন সালেহ বা সালেহ নবীর শহরে এরকম ১৩১টি পাথর কুঁদে তৈরি সমাধি আছে। এগুলি প্রথম খ্রীষ্টাব্দে আল-আনবাত বা নাবাতিয়ান গোত্রের আরবদের তৈরি। কোরানে এদের সামুদ নামে উল্লেখ আছে। জর্দানের পেত্রা শহরের পাহাড় কেটে তৈরি সমাধিগুলিও নাবাতিয়ানদের তৈরি।

স্যান্ডস্টোন খোদাই করে তৈরি এ মূর্তিটি খ্রীষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে লিহিয়ানবাসীদের তৈরি। এই সাম্রাজ্য উত্তরপশ্চিম আরব উপদ্বীপে, মদিনা-তাইমা ইত্যাদি শহরসহ বর্তমান লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরব বা সেমিটিক তুতো ভাই নাবাতিয়ানদের সাথে এদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সম্ভবত বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, এবং পরে মাদাইন সালেহসহ বিভিন্ন জায়গায় লাহিয়ানীদের জায়গায় শাসনভার তুলে নেয় নাবাতিয়ানরা। এই মূর্তিটি কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষিত। অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে মাঝেমধ্যে বাইরের জাদুঘরেও লোনে যায়।

৬৩০-৬২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের লিডীয় মুদ্রা। ইলেক্ট্রাম নামে সংকরধাতুর তৈরি। সিংহ লিডীয় সংস্কৃতিতে রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতীক। তার মাথার ওপর উজ্জ্বল সূর্য। লিডিয়ার রাজা এসময় ছিলেন সাডিয়াটিস, তাঁর পৌত্র ক্রীসাসের নাম গ্রীক-লাতিন হয়ে ইংরেজীতে এসেছে একটি প্রবচনের মাধ্যমে — রিচ অ্যাজ় ক্রীসাস বলতে খুব ধনবান কাউকে বুঝানো হয়। লিডিয়ার রাজধানী সার্ডিস ভূবনবিখ্যাত ছিল তার সৌন্দর্যের জন্য।

ব্রোঞ্জের তৈরি এই নর্তনরত কিশোরীর মূর্তিটি এখন নয়াদিল্লী জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরে আবিষ্কৃত নিদর্শন এটি। মোটে ৪ইঞ্চি এই মূর্তির মধ্যে দৃপ্ত অঙ্গভঙ্গি যেরকম প্রাকৃতিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার কারণে এটি সুপরিচিত শিল্পকর্ম। তার চুলের খোঁপা করার স্টাইল, হাতভর্তি বালা — এগুলি জানান দেয় যে ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় সিন্ধুসভ্যতার সময়ে এখনকার থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেসময় সব সভ্যতা ব্রোঞ্জের কাজ জানত না, কিন্তু এরা পারত, এবং ভালই পারত। ১৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মত শহরগুলোর অবক্ষয় শুরু হয়। প্রত্নত্ত্ববিদরা গৃহযুদ্ধ আর যক্ষ্মার মত রোগের প্রমাণ পেয়েছেন। নগরগুলির অবক্ষয়ের সাথে সাথে নাগরিকরা ধীরে ধীরে গ্রামে চলে যায়, তাই সিন্ধুসভ্যতার আচারব্যবহার ইত্যাদির অবশেষ বেঁচে গেছে গ্রাম্য সংস্কৃতির মধ্যে। অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা বৈদিক ধর্মের মধ্যেও সিন্ধুসভ্যতার প্রভাব রয়েছে।

এশনুন্না প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি নগররাষ্ট্র। সেখানকার দেবতা আবুর মন্দির বা জিগুরাতের ধ্বংসাবশেষে এই প্রার্থনাকারীদের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। ২৯০০ থেকে ২৫৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে লাইমস্টোন খোদাই করে তৈরি এগুলো। আসলে প্রার্থনাকারীরা উপাসনা থেকে দৈনন্দিন কাজে ফিরে যাবার আগে দেবমূর্তির সামনে নিজেদের প্রার্থনারত ছোট ছোট মূর্তি স্থাপন করে যেতেন, যেন দেবতা তুষ্ট থাকেন তারা সশরীরে সামনে না থাকলেও। প্রার্থনার ভঙ্গি, পোশাকআশাকের ডিটেইল, পিগমেন্টে রং করা বড় বড় চোখ — সবকিছু প্রাকৃতিক। পোশাক আশাক বর্তমানের হলে বোধহয় আধুনিক চার্চে খ্রীষ্টান প্রার্থনাকারী বলে চালিয়ে দেয়া যেত!

গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!

Featured Video Play Icon

মালয়েশিয়ার এথনিক চীনা শিল্পী ইমী উইয়ের গাওয়া এ গানটি বৌদ্ধ ধর্মের সবচে’ পবিত্র মন্ত্রগুলোর একটি। এর নাম প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রম — সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতার অন্তঃকরণ। অর্থাৎ এ মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে সর্বোচ্চ সত্য উদ্ঘাটনের গূঢ়তত্ত্ব।

মহাযান মতধারার বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞাপারমিতার স্থান উচ্চাসনে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল যে, ইসলামে যেমন দু’টো বড় শাখা শিয়া ও সুন্নী, তেমন বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান ধারা বা ‘যান’ থেরবাদী, তান্ত্রিক আর মহাযানী। থেরবাদী আর মহাযানীর মধ্যে মৌলিক তেমন কোন তফাত নেই; থেরবাদকে ধরা যেতে পারে সনাতন, প্রাচীন; মহাযান অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের স্থানীয় আচারকে একীভূত করে নিয়েছে। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-মিয়ানমারসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে থেরবাদ প্রচলিত। চীন-ভিয়েতনাম-জাপানের মহাযান পন্থার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থেরবাদের থেকে বেশি। মহাযানী ধারার একাংশ ভূটান-তিব্বত-মোঙ্গোলিয়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন শামানিস্ট বিশ্বাসকে মিলিয়ে নিয়ে হয়ে গেছে গূঢ়তাত্ত্বিক অধ্যাত্মবাদ, যার নাম তন্ত্রযান বা বজ্রযান।

ধারণা করা হয়, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রের উদ্ভব খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। সবচে’ প্রাচীন আবিষ্কৃত নমুনাটি ৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, এর নাম অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, কারণ এতে আট হাজার পংক্তি রয়েছে। ১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ শ্রমণ চীনা ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতার অনুবাদ করেন। এর আশপাশ দিয়েই ভারতবর্ষ থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে। চীনের সুপরিচিত শাওলিন টেম্পলের শ্রমণরা মহাযানপন্থারই অনুসারী। আত্মসংযম চর্চার জন্যে চীনা শ্রমণরা যে ধ্যান করে, তাকে তারা ডাকে ‘চান’ বলে। জাপানে গিয়ে চান হয়ে গেছে ‘জ়েন’

বাংলায় পাল রাজবংশ ছিল মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বড় পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পালরা উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শাসন করে। বিহারের নালন্দাবিক্রমশীলা আর বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুর বিহার পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। দ্বাদশ শতকে দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এসকল বিহার লুন্ঠিত-বিধ্বস্ত হয় — অবশ্য ইতিমধ্যে পালসাম্রাজ্যের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নালন্দা-সোমপুর ছিল অনেকটা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত। ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। পালপূর্ববর্তী গুপ্ত আর বর্ধন রাজবংশের আমলে চীন থেকে ঈ জিং, শ়ুয়ান ৎসাং, ফাশ়িয়ান — শেষ দু’জনকে আমরা চিনি ‘হিউয়েন সাং’ আর ‘ফা হিয়েন’ নামে — ভারতের এসব বিহারে এসেছিলেন সংস্কৃত শিখতে আর বৌদ্ধ সূত্রের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তারা চীনে ফিরে সেসবের অনুবাদ করেন — প্রজ্ঞাপারমিতাও ছিল এদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ারাজ্যও পালযুগে নালন্দায় বিহারস্থাপনের জন্যে অর্থ যোগান দেয়।

পালদের যুগেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবির্ভাব হওয়া শুরু করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদের অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর মহাযান-বজ্রযান পন্থার বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় অধ্যয়নের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে তিব্বতের রাজার অনুরোধে সেদেশে যান অতীশ। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তিনি এখনও সম্মানের আসনে অধিষ্ট। ২০০৩এ সোমপুর বিহার দেখতে গিয়েছিলাম যখন, তখন এই ভেবে গায়ে শিহরণ হয়েছিল যে, সাড়ে আটশ’ বছর পূর্বে সেখানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, আর হয়ত প্রাচীন বাংলাতেই তাঁর কথোপকথন হত সঙ্গী-সাথীদের সাথে! এখনো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রচুর বৌদ্ধ পর্যটক এসকল বিহারে তীর্থযাত্রায় আসেন।

প্রজ্ঞাপারমিতা বর্তমানযুগে ‘ধারণী’ মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ মন্ত্র যে পাঠ করবে — সে অর্থ বুঝুক বা নাই বুঝুক — অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করবে না। অনেকটা যেমন আমাদের দেশী সরল ধার্মিক মানুষ অর্থ না জেনে সূরা-দোয়া মুখস্ত করেন আর সোচ্চারে পাঠ করেন। বলতে পারেন, পালযুগে আমরা একই কাজ করতাম বৌদ্ধমন্ত্র নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মচর্চাপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি! চীনা-জাপানীদের বৌদ্ধধর্মের সেই একই দশা! তারা সংস্কৃত শব্দোচ্চারণের স্বদেশী রূপ দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা আবৃত্তি করে — অথচ উচ্চারিত শব্দগুলোর কোন সত্যিকার অর্থ তাদের ভাষাতে নেই!

আনুষ্ঠানিকতার জাল ভেদ করে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে বুদ্ধশিষ্য, গৌতমের অন্যতম সাথী, শারিপুত্রের সাথে কথোপকথন হচ্ছে অবলোকিতেশ্বরের। অবলোকিতেশ্বর হচ্ছেন গৌতমের নির্বাণপরবর্তীযুগে পুনর্জন্ম হয়ে আসা বর্তমানযুগের বোধিসত্ত্ব। সংসারের জাল ছিন্ন করে বোধিপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পরিনির্বাণ গ্রহণ না করে ফিরে ফিরে আসেন ধর্মদীক্ষাদানের জন্যে, যাতে অন্যেও তাঁর শিক্ষা নিয়ে বোধি বা সত্যের সন্ধান পেতে পারে।

শারিপুত্রকে অবলোকিতেশ্বর শেখাচ্ছেন মোক্ষলাভের মূলমন্ত্র: সকল বস্তু, ভাবের অস্তিত্বের সাথে তাদের অনস্তিত্ত্বের কোন পার্থক্য নেই! দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে পরিচিত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যতাবাদের তত্ত্বে এই চিন্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ তত্ত্ব লিখে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন! মনোভাবটা জাগ্রত করতে হলে চাই কঠোর সাধনা। সোজা ভাষায় যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে, সকল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় এটা অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করা যে, কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে বলেই আমরা তার অনস্তিত্ত্ব বা অভাব বোধ করি। দুঃখজরার মূল প্রথিত সেই জ্ঞানের মধ্যেই। যদি মোহমুক্তি পেতে চাই তাহলে আত্মপরিচয় বা ইগোকে পরিত্যাগ করতে হবে, মিলিয়ে দিতে হবে শূন্যতার মাঝে, যেখানে বস্তু বা ভাবের অনস্তিত্ত্ব আর অস্তিত্ত্বের উপলব্ধির মাঝে কোন ফারাক নেই। দুঃখ থেকে মুক্তি সে পথেই।

এটা অন্য ধর্মদর্শনের মাধ্যমে বোঝানোটা মনে হয় খুব বেশি কঠিন নয়। ইসলামের সুফী মতের সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন। সেখানে খোদাপ্রেমের মদে মত্ত মানুষ নশ্বরতার পরিধি পেরিয়ে হতে চায় স্রষ্টার সাথে একাত্ম। হাদীসের ভাষায় ‘মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করা’! কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরে মন্দভাল যাই ফল হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হওয়া। খুব একটা তফাত নেই প্রজ্ঞাপারমিতার থেকে। বাউলিয়ানার ওপরেও  বৌদ্ধ দর্শনের কিছুটা প্রভাব এক সময় পড়েছিল।

বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন বা নাস্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলেও এ ধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। ঊনবিংশ শতকে আর্থার শপেনহাওয়ার তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ় উইল অ্যান্ড রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বইটিতে অস্তিত্ত্বের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছেন মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে। যদিও শপেনহাওয়ার বৌদ্ধ দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন আর সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান, তাঁর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ চিন্তাধারার অনেকটা বিকৃত পশ্চিমা সংস্করণ । শপেনহাওয়ার পক্ষান্তরে অনুপ্রেরণা যোগান আধুনিক যুগের আরো অনেক দার্শনিক, লেখক ও বৈজ্ঞানিককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রয়ড, আইনস্টাইন, য়্যুঙ, মপাসঁ, নয়মান, নিচা, শ্রয়ডিঙার, তলস্তয়, ভ়াগনার — আর নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেরমান হেসা!

এই হেরমান হেসার ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি আমার তরুণ বয়সে পড়া, আমার পরবর্তী চিন্তাভাবনার উপর এর প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বেশ ভাল একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, পরে ইংরেজী দু’টি আলাদা অনুবাদও। এই অসাধারণ কাহিনীতে গৌতম নয়, সিদ্ধার্থ বলে আরেক সমসাময়িক কল্পিত রাজকুমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলোকন করতে পারবেন — তাঁর মনোবেদনা, মোক্ষলাভের সংগ্রাম, শ্রমণজীবন, ‘মধ্যপন্থার’ আবিষ্কার, সংসারে মনোনিবেশ, গৌতমবুদ্ধের সাথে মোলাকাত, শেষ পর্যন্ত নদীপারাপারের তরীচালক হিসাবে তাঁর অহমলোপ আর বোধিপ্রাপ্তি।

হেসা খুবই নিখুঁতভাবেই মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সে তত্ত্বে বোধিলাভের জন্যে থেরবাদের অন্তর্মুখী সাধনার আবশ্যকীয়তা নেই, জাগতিক সুখদুঃখের অনুভূতি অক্ষত রেখেই শূন্যতার উপলব্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ আমি-আপনি যে জাগতিক অবস্থাতেই থাকি না কেন, কিছু মৌলিক সত্যের ওপর মনোনিবেশ করলে অহমের বিলোপ, মনের দ্বন্দ্বগুলি প্রশমন করে দুঃখজরার বিনাশসাধন অসাধ্য নয়।

মনে হয় পাঠক ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পারছেন সব ধর্মের একটা মৌলিক গুণ মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলির নিরসন করে শান্তিতে বিরাজমান হওয়ার পথ বাতলানো। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এব্রাহাম ম্যাজ়লো বলে এক মনস্তত্ত্ববিদ মানবিক চাহিদার খুঁটিনাটি গবেষণা করেছেন। তাঁর শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দৈহিক চাহিদা, তার পরে নিরাপত্তা, তৃতীয়ত প্রেম-ভালোবাসা বা কোন জাতিগোত্রের সাথে একাত্মতার চাহিদা, চতুর্থত শ্রদ্ধা-মর্যাদার চাহিদা, আর সর্বোচ্চ স্তরের নাম দিলেন সেল্ফ়-অ্যাকচুয়ালাইজ়েশন। প্রথম চারটি স্তর অতিক্রম করে মানুষ শেষ স্তরে এসে চায় স্বপরিচয়ে, স্বপেশায় পারফ়েকশন বা পূর্ণতাপ্রাপ্তি। বৌদ্ধ দর্শনে এটা অহম বা ইগোর সর্বোচ্চ রূপ।

ম্যাজ়লো পরে আরো একটি পর্যায় যোগ করেন যার নাম দেন ট্রানসেন্ডেন্স বা স্ব-কে অতিক্রম করা। বৌদ্ধ দর্শনে এটাই অহমের বিলোপ, নিজের থেকে বেশি কিছু হয়ে ওঠা, শূন্যতা!

এপর্যায়ে এসে প্রজ্ঞাপারমিতার শেষ পংক্তি অনুযায়ী আপনি ‘গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!’ — নদীর অপরপারে! স্নান করছেন বোধির আলোকচ্ছটায়! তবে তাই হোক!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!